আমি যাঁর জীবনের আশ্চর্য কাহিনী বলব, তাঁর নাম হচ্ছে আনন্দমোহন সেন। আমি তাঁকে চিনি না, চোখেও দেখিনি, খুব সম্ভব তাঁর মৃত্যু হয়েছে আমার জন্মাবার আগেই।
আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এমন একজন লোকের জীবনকাহিনীর সঙ্গে আমি পরিচিত হলাম কেমন করে? আগে এই জিজ্ঞাসারই জবাব দেওয়া উচিত। নইলে আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন যে, নিজের মনগড়া কোনও গল্প বলে খামোখা আপনাদের পিলে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এই বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক জগতে আনন্দমোহনের গল্প যে বিশ্বাসযোগ্য হবে না, আমিও অস্বীকার করি না। কিন্তু যে কাহিনী আমি নিজে রচনা করিনি, তা সত্য বা মিথ্যা বলে একতরফা ডিক্রি জারি করার অধিকারও আমার নেই। বিশ্বাস করা বা না করার ব্যাপারে আমি আপনাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে রাজি আছি।
………..শঙ্কর বসু ছিলেন পেশায় অধ্যাপক এবং আমার বন্ধু। এবারের পূজোর ছুটিটা তাঁর দেশের বাড়িতে কাটাবার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাঁর দেশের বাড়ি বর্ধমানের দামোদর নদের ধারে। এর আগে আর কখনো আসিনি এখানে। তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকেই একখানা বড় তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল।
চিত্রের বিষয়বস্তু এই :
চারিধার অন্ধকার। একজন তরুণী – তার ডানহাতে একটা সেকেলে লন্ঠন। লন্ঠন ধরা হাতটা উঁচু করে তুলে ধরেছে সে। তরুণীর দেহের অন্যান্য অংশ অন্ধকারের ভেতর প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে, কেবল ভাল করে দেখা যাচ্ছে তার মুখখানি – অপূর্ব ও জীবন্ত সৌন্দর্যে ভরা সেই মুখ। সেই মুখের ঠিক পেছনেই খানিক স্পষ্ট ও খানিক অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আর একটি মূর্তি। সে মূর্তি এক যুবকের। সেই যুবকের মুখেচোখে ফুটে উঠেছে বিষম বিস্ময় ও দারুণ আতঙ্ক। তরুণীর লন্ঠনের আলোতে যুবক বোধহয় এমন কোনও ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেয়েছে, যাতে মানুষের বুকের রক্ত জমে যায় বরফের মতো।
অদ্ভুত বিষয়বস্তু। তরুণী কি দেখাতে চাইছে এবং যুবক কেনই বা এত ভয় পেয়েছে? ছবিতে তার কোনও ইঙ্গিত নেই।
শঙ্কর হেসে বলল, ” হিমাংশু, এরকম রহস্যময় ছবি বোধহয় তুমি আগে কখনো দেখনি?”
না, ছবির ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম আমি, ” এই ছবিতে চিত্রকর কি দেখাতে চাইছে? ছবিতে যে দৃশ্য রয়েছে, মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে কোনও একদিন সত্যি সত্যিই তা-ই ঘটেছিল”।
শঙ্কর বলল, ” তোমার অনুমান মিথ্যে নয়। ছবিখানি আঁকা হয়েছে একটি সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে”।
কি সেই ঘটনা?
উঃ ভয়ঙ্কর! এই ছবিতে ফুটে উঠেছে একটি বিয়োগান্ত নাটকের শেষ দৃশ্য। ওই যে তরুণী, ওর নাম লীলা। আর ওই যে যুবক, ওর নাম আনন্দমোহন সেন কে ওরা?
লীলা হচ্ছে সেই সময়কার প্রখ্যাত চিত্রকর চন্দ্রমোহন চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। আনন্দমোহন ছিল তাঁরই কৃতিছাত্র। এই ছবি সেই আনন্দমোহনেরই আঁকা। ছবির এই দৃশ্য যখন বাস্তবে ঘটেছিল, তখন তার ছিল তরুণ বয়স। লীলা বা আনন্দমোহন – কেউই এখন আর বেঁচে নেই”।
এখন পুরো কাহিনীটা শুনি?” বললাম আমি।
আমার বাবা আনন্দমোহনের নিজের মুখ থেকে গল্পটি শুনে আমায় বলেছিলেন অনেকদিন আগে। বাবা’কে আনন্দমোহন খুব ভালবাসত, তাই মারা যাওয়ার আগে বাবাকে এই ছবিখানা উপহার দিয়ে গিয়েছিল”।
কিন্তু কাহিনীটা কিরকম?
একটু ধৈর্য ধর। এমন রোদে-ধোয়া সকালে এইসব কাহিনী শুনলে অবিশ্বাস্য অস্বাভাবিক মনে হবে। অলৌকিক কাহিনী সবসময় জমে রাতের নিরালা পরিবেশে।”।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ, গল্পটি শুধু ভয়ানকই নয়, অলৌকিক’ও?”
শুনলেই বুঝবে
তারপর সেদিন সন্ধেবেলায় বসে বসে শঙ্করের মুখ থেকে ছবিটার ব্যাপারে পুরো কাহিনীটা শুনলাম। সেই সন্ধেটা ছিল বাস্তবিকই অলৌকিক গল্প শোনার পক্ষে রীতিমতো উপযোগী।
সন্ধের আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে, ঝোড়ো হাওয়ার উদ্দাম দীর্ঘশ্বাসে বাগানের গাছপালাগুলো থেকে থেকে মর্মর শব্দে আর্তনাদ করে চলেছে, মেঘে-মেঘে ঢাকা আকাশ, পৃথিবী ঘেরা অন্ধকারের ঘেরাটোপে। মাঝেমাঝে অন্ধকারকে ধাক্কা মেরে মেঘের পর্দা ছিঁড়ে আকাশ থেকে পৃথিবীতে সাঁৎ করে নেমে আসছে বিদ্যুতের তীব্র শিখা এবং ক্ষণিকের জন্য দেখা যাচ্ছে বিপুল দামোদরের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গভঙ্গ।
লম্বা চওড়া বারান্দা। একটা সেকেলে গোল মার্বেল টেবিলের ওপর টিমটিম করে জ্বলছে হ্যারিকেন ল্যাম্প, তার স্বল্প আলো বারান্দার অন্ধকারকেই প্রকট করছিল মাত্র। স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না এবং অস্পষ্টতার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে বেশ একটা রহস্যের সম্ভাবনা।
বাইরের দিকে মুখ করে এবং দেওয়ালের দিকে পিঠ রেখে দুখানা পুরনো ইজিচেয়ারের ওপর চুপ করে বসে আছি আমরা দুই বন্ধু – শঙ্কর এবং হিমাংশু। কোথাও নেই মানুষের কাজের বা কন্ঠের সাড়াশব্দ। আমরা উপভোগ করছিলাম এই বৃষ্টিধারা ধৌত নির্জনতা।
বোধ করি, বৃষ্টি আর ঝড়কে ফাঁকি দেবার জন্যই হঠাৎ একটা বাদুড় ভেতরে এসে বারান্দার ছাদ ঘেঁষে দুই ডানা দিয়ে ঝটপট শব্দ তুলে উড়ে বেড়াতে লাগল।
আমি বললাম, ” লেখকরা অলৌকিক গল্প বলবার সময়ে প্রায়ই বাদুড়ের উল্লেখ করেন। তোমারও গল্পে বাদুড় আছে নাকি?”
না”।
তাহলে সেই ভ্রম সংশোধনের জন্য বাদুড় নিজেই এসে হাজির হয়েছে। রসিক বাদুড়কে ধন্যবাদ। নাও, এখন শুরু কর তোমার কাহিনী”।
শঙ্কর তার কাহিনী শুরু করল :
……আজ থেকে অন্তত সত্তর বছর আগেকার কথা।
সেসময় ফটোগ্রাফ তোলবার কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে বটে, তবে বাংলায় তার প্রভাব একরকম ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মানুষের অহং জ্ঞান অল্প নয়, মৃত্যুর আগে সে ইহলোকে নিজের স্থায়ী চিহ্ন কিছু কিছু রেখে যেতে চায় এবং ধনীদের ভেতরেই এই প্রবণতা ছিল সবচেয়ে বেশী।
বাংলার প্রাচীন ধনী পরিবারের বসতবাড়ির ভেতরে গেলেই দেখা যাবে, দেওয়ালে দেওয়ালে চারিদিকে টাঙানো রয়েছে বড় বড় তৈলচিত্রের পর তৈলচিত্র – অধিকাংশই পূর্বপুরুষদের। আজকের যুগে ধনী এবং নির্ধনরাও যেমন সাধারণ ফটোগ্রাফের মাধ্যমে নিজেদের ছবি তুলে রাখে ; তখনকার দিনে শুধুমাত্র ধনীরাই সেই সুযোগ পেতেন। কিন্তু সেকালে তাঁদের মধ্যে কেবল তৈলচিত্রের চলন ছিল। আর এজন্য তাঁরা বড় বড় চিত্রকরকে আহ্বান করতেন। সে যুগের সাধারণ গেরস্তরা এই বিলাসিতাকে মনেও ঠাঁই দিতে পারত না, কারণ তৈলচিত্র আঁকাতে যত টাকা দরকার তত টাকা থাকত না তাঁদের পকেটে।
চন্দ্রমোহন চৌধুরী বা চন্দ্রবাবু সেযুগের একজন নামজাদা মূর্তিচিত্রকর ছিলেন। শিল্পীসমাজে তাঁর ছিল ‘ ওস্তাদ’ বলে খ্যাতি। এবং ধনীসমাজে তাঁর ছিল বিশেষ সমাদর। চন্দ্রবাবুর ছাত্রও ছিল অনেক। অবসর কালে তিনি তাদের চিত্র সন্মন্ধে শিক্ষা দিতেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল আনন্দমোহন।
আনন্দমোহন ছিল যাকে বলে অনাথ। তার বাড়িঘর, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কেউই ছিল না। কিন্তু আনন্দমোহনের চিত্রাঙ্কনপটুতা ও মিষ্ট প্রকৃতি দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন চন্দ্রবাবু। তাকে তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, নিজের ছেলের মতো করে।
চন্দ্রবাবুর পক্ষে আনন্দমোহনের মতো একজন শক্তসমর্থ, বিশ্বস্ত যুবকের আবশ্যক ছিল অত্যন্ত। চন্দ্রবাবু ছিলেন চিরকুমার, নিজে আর্ট নিয়ে এতটাই মত্ত হয়ে থাকতেন যে প্রৌঢ় বয়সেও তাঁর কখনো মনে হয়নি যে প্রত্যেক মানুষের মতো তাঁর জীবনেও ‘বিয়ে’ নামক অনুষ্ঠানটির প্রয়োজন আছে। তাঁর প্রয়াত ছোট ভাইয়ের একটি মেয়ে ছিল, তার নাম লীলা। গৃহস্থালির সমস্ত কর্তব্য সে-ই পালন করত। আর গৃহস্থালির বাইরের যা কিছু কাজ তার ভার ছিল আনন্দমোহনের ওপর। এই দুজনের হাতে সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে চন্দ্রবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে করতেন কলালক্ষ্মীর সেবা।
কলকাতার হট্টগোল চন্দ্রবাবুর মোটেও ভাল লাগত না। অথচ তাঁর পক্ষে কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেই নয়। তাই তিনি বাস করতেন শহরতলির এমন এক জায়গায় যেখানে শহরের কাছাকাছি থেকেও উপভোগ করা যায় পল্লীপ্রকৃতির নির্জনতা।
ভাবো একবার, সত্তর বছর আগে সেইসময়ের কথা! তখন কলকাতায় না ছিল ইলেকট্রিক, না মোটর, না ছিল বাস, না ছিল আধুনিক সুযোগসুবিধা। অনেক রাস্তায় থাকত মিটমিটে তেলের আলো এবং অনেক রাস্তার দুধারে থাকত খোলা ড্রেন। খোলা ঘর এবং বস্তি দেখা যেত যেখানে সেখানে। আজ কলকাতায় তুমি সরকারি বাগান ছাড়া ছোটবড় মাঠ প্রায় খুঁজেই পাবে না; কিন্তু তখনকার দিনে কলকাতার বহু স্থানেই এত মাঠ-ময়দান আর ছোটখাটো জঙ্গলের মতো ছিল যে সেখানে গেলে শহরে বসেই দেখতে পাওয়া যেত পল্লীবাংলার ছবি।
তখন শহরের অবস্থাই যখন এরকম ছিল, তখন শহরতলির অবস্থা কিরকম ছিল বুঝতেই পারছ। তখন টালিগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে গেলে মনে হতো অরণ্যে এসেছি। এমনি জায়গাতেই ছিল চন্দ্রবাবুর বসতবাড়ি। এবং ওঁর চিত্রশালা ছিল সেখান থেকে খানিক দূরে, কলকাতার প্রান্তসীমায়।
আসল গল্প শুরু করার আগে আরেকটা কথা বলে রাখি। লীলার বয়স হয়েছিল ষোলো সতেরো। তখনকার দিনে হিন্দুর ঘরে এই বয়সের কোনও মেয়ে কুমারী থাকত না। কিন্তু চন্দ্রবাবু ছিলেন ইংরেজি মেজাজের লোক। তিনি মনে করতেন, এত অল্প বয়সে কোনও মেয়ের বিয়ে হওয়া ঠিক নয়।
কেবল পরমা সুন্দরী বললেও লীলার রূপের সঠিক বর্ণনা দেওয়া যায় না। সে ছিল অদ্ভুত রূপসী। গায়ের রঙ, গড়ন, মুখ-চোখ ছিল এমন ধারা যে খুঁজলেও তার জোড়া মিলত না। তার ওপর লীলার প্রকৃতিও ছিল অতি মধুর, অতি নম্র।
সুতরাং এমন একটি মেয়ের দিকে যে যুবক আনন্দমোহন আকৃষ্ট হবে, এ হচ্ছে খুব সহজ কথা। মনে মনে সে অদূর ভবিষ্যতে লীলাকেই নিজের সহধর্মিণী রূপে কল্পনা করত। লীলাও বোধহয় তা বুঝতে পারত – যদিও আনন্দমোহন কোনওদিনই তা মুখে প্রকাশ করেনি।
আনন্দমোহন এবং লীলা ছিল একই জাতের লোক, তবু আপাতত লীলার সঙ্গে যে তার বিবাহ কার্যত অসম্ভব, এ সত্য আনন্দমোহনের অজানা ছিল না। কারণ আগেই বলেছি, আনন্দমোহন ছিল অনাথ, পরের আশ্রয়ে বাস করে। সে লীলাকে বিয়ে করতে চাইলে হয় চন্দ্রবাবু খাপ্পা হয়ে উঠবেন নয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন এই অদ্ভুত প্রস্তাব।
অতএব নিজেকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তৈরি করে তোলবার চেষ্টা করছিল আনন্দমোহন।
চন্দ্রবাবু নিজেই মত প্রকাশ করেছেন, আর্ট স্টুডেন্ট হিসেবে আনন্দমোহনের শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে, অল্পদিনের মধ্যেই সে স্বাধীন ভাবেই চিত্রাঙ্কন ব্যবসা অবলম্বন করতে পারবে।
স্বাধীন হওয়ার অর্থই হচ্ছে অর্থ উপার্জন করবার ক্ষমতা। ধনীসমাজে আনন্দমোহনের যদি পসার হয়, তাহলে তার হাতে লীলাকে সমর্পণ করতে চন্দ্রবাবুর নিশ্চয়ই আপত্তি হবে না।
আনন্দমোহন দিনের পর দিন গুনছিল সেই আশাতেই।
তারপর একদিনসেদিন সন্ধে হয় হয়।
অন্যান্য ছাত্ররা বিদায় নিয়েছে, চিত্রশালার মধ্যে কাজ করছে আনন্দমোহন একাকী।
একখানি বড় ঘর – দোতলার ওপরে। এখানে সেখানে, দেওয়ালের ওপর রয়েছে অনেকগুলো ছোট বড় সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ ছবি। সবই তৈলচিত্র। তখনকার দিনে শিক্ষিত বাঙালি চিত্রকররা সাধারণত জলীয় রঙ বা ‘ ওয়াটার কালার’ ব্যবহার করতেন না। জলীয় রঙ ব্যবহার করত যারা, শিক্ষিতরা অবজ্ঞা করে তাদের ডাকতেন ‘পটুয়া’ বলে। বাংলার আধুনিক শিক্ষিত সমাজে জলীয় রঙের প্রাধান্য স্থাপন করেন সর্বপ্রথমে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ।
তাড়াতাড়ি স্বাধীন হওয়ার জন্য আনন্দমোহন পরিশ্রম করত প্রায় দিবারাত্রব্যাপী। অন্যান্য ছাত্ররা ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ার পরেও সে অনেকক্ষণ ধরে চিত্রশালায় রঙ আর তুলি নিয়ে নিযুক্ত হয়ে থাকত।
কোনও খেয়ালী ক্রেতার ফরমাশে সে আঁকছিল একখানা অদ্ভুত ছবি। নরকের দৃশ্য।
যমদূতেরা জনৈক পাপীকে ধরে অগ্নিকুন্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়েছে।
পাপীর মূর্তি আঁকা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। কিন্তু আনন্দমোহন বিপদে পড়েছে যমদূতগুলোর চেহারা কিরকম হবে,তা নিয়ে।
জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে যমদূতের পরিচয় হয় না। আনন্দমোহনও কখনো দেখেনি। যমদূতের চেহারা যে ঠিক কিরকম হওয়া উচিত, আনন্দমোহন কিছুতেই তা ধারণাতেও আনতে পারছে না।
বিলাতি ছবিতে Imp, Demon & Devil প্রভৃতিকে যারা দেখেছে, তাদের কালো কালো প্রায় মানুষের মতো চেহারা, কিন্তু তাদের মাথায় থাকে শিং, পেছনে থাকে ল্যাজ এবং পায়ে থাকে গরুর মতো ক্ষুর।
কিন্তু যিনি ছবির ফরমাশ দিয়েছেন তিনি একজন পরম হিন্দু। গঙ্গাজল ছাড়া আর কোনও জল পান করেন না তিনি। আনন্দমোহন অনায়াসেই ফিরিঙ্গি Imp, Demon & Devil এর মূর্তি আঁকতে পারত, কিন্তু সেসব ক্রিশ্চানী মূর্তি দেখলে হিন্দু ক্রেতার ‘হিন্দুত্ব’ নিশ্চয়ই জখম হবে।
আর ছবি আঁকা সম্ভব নয়। চিত্রশালার মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে সন্ধ্যার অন্ধকার। বাইরে ক্রমে ক্রমে স্তব্ধ হয়ে আসছে নাগরিক কোলাহল।
তখনও তুলি হাতে করে আনন্দমোহন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে – ‘ যমদূতদের…..হিন্দু মতে জাহান্নামের দূতদের চেহারা ঠিক কিরকম হয়? রাক্ষসের মতো? ভূতপ্রেতের মতো? কিন্তু রাক্ষস বা ভূতপ্রেতদের চেহারাই বা কিরকম হয়? আমি তো কখনো তাদের চোখে দেখিনি’।
অনেক মাথা ঘামিয়েও কূলকিনারা না পেয়ে আনন্দমোহন শেষটা ধৈর্য হারিয়ে বলে উঠল, ” নিকুচি করেছে! যমদূতেরা জাহান্নামে যাক, আমি তাদের আঁকতে পারব না!”
……সঙ্গে সঙ্গে তার পেছন থেকে চাপা গলায় কে যেন হেসে উঠল।
সচমকে আনন্দমোহন ফিরে দেখল, ঠিক তাঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা অপরিচিত মূর্তি।
চিত্রশালার ভেতর তখন ভালো করে চোখ চলে না। বেশ ঘন অন্ধকার। বাইরে শোনা গেল প্যাঁচার ডাক।
মূর্তি স্থির চক্ষে তাকিয়ে ছিল চিত্রপটের অসম্পূর্ণ যমদূতগুলোর দিকে। বিচিত্র চেহারা আগন্তুকের। মাথায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, মস্ত একটা পাগড়ি এমনভাবে পরেছে যে মুখের অর্ধেক প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। পোশাকও সাধারণ লোকের বা বাঙালীর মতো নয়, সাজগোজ দেখলে মনে হয় সে কোনও রাজা-রাজড়া! এমনকি কটিবন্ধ থেকে ঝুলছে একখানা তরবারি পর্যন্ত!
সৈনিকের মতো সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মূর্তি। অন্ধকারে তাকে খানিক দেখা যাচ্ছিল, খানিক দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও ঝকমক করে উঠছিল তার স্বর্ণখচিত এবং নানা রত্নে অলঙ্কৃত বহুমূল্য পোশাকটা।
এমন মূর্তি এখানে দেখবার আশা আনন্দমোহন করেনি। সে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল।
মূর্তি গম্ভীর স্বরে বলল, ” ছোকরা, পৃথিবীতে যখন বেঁচে আছ, যমদূতদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”
তার চেহারা আর গলার স্বর রীতিমতো কাঁপুনি ধরিয়ে দিল আনন্দমোহনের বুকে। কিন্তু একটা জবাব না দিলেও চলে না। কোনওরকমে জড়ানো গলায় মিনমিন করে বলল, ” আজ্ঞে খরিদ্দারের ফরমাশ! ”
মূর্তি একখানা হাত রাখল আনন্দমোহনের কাঁধের ওপর। আনন্দমোহনের মনে হল, তার সর্বাঙ্গের ওপর দিয়ে যেন বয়ে গেল একটা তরঙ্গায়িত তুষারবারির হিল্লোল। সে পিছিয়ে দাঁড়াল সভয়ে।
মূর্তি বলল, ” খরিদ্দারের ফরমাশেও আর কোনওদিন যমদূতদের দেখবার চেষ্টা কোরো না”।
আনন্দমোহন ভয়ে ভয়ে বলল, ” চন্দ্রবাবুর কাছে আপনার কোনও দরকার আছে? অনুগ্রহ করে এই আসনে বসুন”।
“……চন্দ্রমোহন চৌধুরী কোথায়?”
“…..আজ্ঞে তিনি কাজে বেরিয়েছেন। ফিরতে রাত হবে”।
“…..চন্দ্রমোহন চৌধুরীকে বোলো, আমি মোহনপুরের মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণ। আগামীকাল ঠিক রাত আটটার সময় আমি আবার আসব তার সাথে দেখা করতে। সে যেন এখানে হাজির থাকে”।
মূর্তি হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। তারপর সোজা বেরিয়ে গেল নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। ঘরের আবহ এতক্ষণ যেন তুষারশীতল হয়ে ছিল,মূর্তি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঘরের মধ্যে জেগে উঠল গ্রীষ্মের উত্তাপ।
আনন্দমোহনের কেমন কৌতূহল হল, চিত্রশালা থেকে বেরিয়ে মূর্তি কোন দিকে যায় দেখবার জন্য। ওই জানলাটার তলাতেই আছে চিত্রশালা থেকে বেরিয়ে যাবার একমাত্র দরজা। সে তাড়াতাড়ি জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
প্রায় দশ মিনিট জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিন্তু সদর দরজা দিয়ে কাউকেই বেরোতে দেখা গেল না।
আনন্দমোহন ভাবলে, তবে কি লোকটা এখনও বাড়ির ভেতরেই আছে?
এই সম্ভাবনা মনে হতেই আনন্দমোহনের সমস্ত দেহ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! কি এক অজানা ভয়ে সে তাড়াতাড়ি ওপরের ঘর থেকে বেরিয়ে একতলায় নেমে গেল। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখা গেল না।
গেল কোথা দিয়ে লোকটা?
এই আশ্চর্য ব্যাপার নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে সে চিত্রশালার দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁফ ছাড়ল।
চন্দ্রবাবু একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, ” মোহনপুরের মহারাজা মহেন্দ্রনারায়ণ! কখনও তো তাঁর নাম শুনিনি। কি চান তিনি? নিশ্চয়ই আমার হাতে তাঁর রাজ্যভার সমর্পণ করতে আসবেন না? বোধহয় তাঁর একখানা ছবি আঁকাতে চান? বেশ, আগামীকাল যথাসময়েই মহারাজা মহেন্দ্রনারায়ণকে সসন্মানে অভ্যর্থনা করবার জন্য চিত্রশালায় উপস্থিত থাকব”।
পরদিনের সন্ধ্যা।
চিত্রশালার ভেতরে একমাত্র আনন্দমোহন ছাড়া আর কোনও ছাত্র নেই।
চন্দ্রবাবু ঘরের ভেতর পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ” আটটা তো বাজে-বাজে। আনন্দমোহন, কই, এখনও তো কারোর টিকি দেখতে পাচ্ছি না”।
“…..আজ্ঞে, তিনি ঠিক আটটার সময় আসবেন বলেছিলেন”।
“…..কি পরিচয় দিয়েছিল নিজের? মোহনপুরের মহারাজা মহেন্দ্রনারায়ণ?”
“…..আজ্ঞে হ্যাঁ”।
“…..দেখতে কিরকম ছিল?”
“…..দেখেই মনে হচ্ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি”।
“…..বয়স কত?”
“….বলা শক্ত স্যার! তবে এটুকু বলতে পারি বয়সে তিনি যুবক নন”।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চন্দ্রবাবু বললেন, ” আটটা বাজতে তো আর এক মিনিট বাকি। এখনও তো মহারাজের দেখা নেই। আনন্দমোহন, আমি কিন্তু আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপরেই আমি চলে যাব, কারণ আমার এখন অনেক কাজ। মহারাজ যদি তারপরেও আসেন, তুমিই তাঁর সঙ্গে কথা কয়ে নিয়ো। জীবনে আমি ঢের রাজা-মহারাজা দেখেছি। কোনও মহারাজার জন্যই আমি এখানে ধর্না দিয়ে বসে থাকতে রাজি নই। মহারাজদের চেয়ে আমি মহাশয়দের বেশি পছন্দ করি”।
ঠিক এইসময় ঢংঢং করে ঘড়িতে রাত আটটা বাজল।
একতলা থেকে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ির ওপর শোনা গেল না কারোর পায়ের শব্দ, কিন্তু ঘরের দরজার সামনে দেখা গেল মোহনপুরের মহারাজা মহেন্দ্রনারায়ণের মূর্তি।
মহেন্দ্রনারায়ণের মূর্তির ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল এমন একটা আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের ভাব যে চন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি মাথা হেঁট করে তাঁকে প্রণাম না করে পারলেন না।
মহেন্দ্রনারায়ণ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালেন।
চন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি একখানা চেয়ার টেনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আজ্ঞে বসতে আজ্ঞা হোক”।
মহেন্দ্রনারায়ণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না, দাঁড়িয়ে রইলেন।
চন্দ্রবাবু বললেন, ” আপনিই কি মোহনপুরের মহারাজ বাহাদুর?”
“…..হ্যাঁ”।
“…..আনন্দমোহনের কাছে শুনলাম, আমার সঙ্গে মহারাজ বাহাদুরের কোনও দরকার আছে?”
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মহেন্দ্রনারায়ণ হাত তুলে আনন্দমোহনকে দেখিয়ে বললেন, ” তোমার ও লোকটি কি বিশ্বস্ত?”
“….আজ্ঞে হ্যাঁ, অত্যন্ত বিশ্বস্ত “।
পরিচ্ছদের ভেতর থেকে একটা ছোট বাক্স বের করে মহেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ” এই বাক্সটা নিয়ে ওকে কাছাকাছি কোনও জহুরির কাছে যেতে বলো। ও যাচাই করে আসুক, এই বাক্সের ভেতর যা আছে, তার দাম কত?”
বাক্সটি নিয়ে আনন্দমোহন বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। জহুরির বাড়ি যেতে তার বেশীক্ষণ লাগল না।
জহুরির কাছে এসে আনন্দমোহন বলল, ” বাক্সটা খুলে দেখুন”।
বাক্সের ভেতর ছিল নানারকম রত্নখচিত অলঙ্কার!
জহুরি তা দেখে সবিস্ময়ে বলল, ” আনন্দমোহনবাবু, এত সব জড়োয়া গহনা কার?”
“…..মোহনপুরের মহারাজার”।
জহুরি পরম বিস্মিত হয়ে বলল, “….আশ্চর্য! এরকম জড়োয়া গহনা একালেও কেউ ব্যবহার করে নাকি?”
“….কেন? গহনাগুলো কি ভাল নয়?”
“….বলেন কি? এমন চমৎকার গহনা আজকাল কেউ পরা তো দূর, দেখতেও পায় না! এরকম খাঁটি গহনার চল ছিল সেই নবাবী আমলে”।
“….এগুলোর দাম বলতে পারেন?”
“….নিশ্চয়ই পারি”।
জহুরি গহনাগুলো নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ পরীক্ষার পর বলল, ” ভারি দামি গহনা দেখছি”।
“….কত দাম হবে?”
“…..দশ লক্ষ টাকার কম নয়”।
শুনে আনন্দমোহনের মাথা ঘুরতে লাগল। দশ লক্ষ টাকার ভার বহন করে এখানে এসেছে সে! অথচ সে কিছুই অনুভব করেনি। দশ লক্ষ টাকা এত হালকা!
সেইসময় দশ লক্ষ টাকা প্রায় কয়েক কোটি টাকার সমান।
……..ওদিকে আনন্দমোহন ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার পরেই মহেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর স্বরে বললেন, ” শোনো চন্দ্রমোহন, এখানে আজ আমার মিনিট কয়েকের বেশী থাকবার উপায় নেই। কিছুদিন আগে কলকাতার এক রঙ্গালয়ে তোমার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে আমি দেখেছিলাম। তাকে আমি বিবাহ করতে চাই”।
চন্দ্রবাবু সচকিত চোখে মহারাজের মুখের দিকে চাইলেন। কি শুনলেন ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারলেন না। অদ্ভুত প্রস্তাব।
মহারাজ অবিচলিত কন্ঠে বললেন, ” তুমি অবাক হচ্ছ কেন? আমার চেয়ে ধনী পাত্র পাবার আশা তুমি কর নাকি?”
চন্দ্রবাবু তখনও জবাব দিতে পারলেন না। কেবল এই অদ্ভুত প্রস্তাব বা বিস্ময়ের জন্য নয়, আগন্তুককে দেখে তাঁর বুকের ভেতর জাগ্রত হয়েছে কেমন এক অজ্ঞাত আতঙ্ক! তাঁর ইচ্ছা হল, তিনি সেখান থেকে এক ছুটে পালিয়ে যান, কিন্তু কেবল ভদ্রতার খাতিরেই সে ইচ্ছা তিনি দমন করলেন।
অনেক কষ্টে শেষটায় তিনি বললেন, ” মহারাজ বাহাদুর, আপনার প্রস্তাব শুনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কিন্তু লীলা বালিকা নয়, তার মত না নিয়ে আপনাকে কেমন করে কথা দেব?”
মহেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ” চন্দ্রমোহন, আমাকে ছলনা করবার চেষ্টা কোরো না। আমি জানি, তুমিই লীলার একমাত্র অভিভাবক, তোমার অনুরোধ কিছুতেই সে অমান্য করবে না”।
বলতে বলতে মহারাজ চন্দ্রবাবুর দিকে দু’পা এগিয়ে এলেন। চন্দ্রবাবু পিছিয়ে গেলেন। তাঁর ভয় আরও বেড়ে উঠল, এই অদ্ভুত মূর্তির কাছে একলা থাকাও বিপজ্জনক, তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ” হে ঈশ্বর, আনন্দমোহনকে অবিলম্বে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। ও যেন এখনই ফিরে আসে”।
মহেন্দ্রনারায়ণ অধীর কন্ঠে বললেন, ” বলো, তোমার মত কি?”
চন্দ্রবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ” কিন্তু মহারাজ, আপনার জাতি…..”
বাধা দিয়ে মহারাজ বললেন, ” আমার জাতি! তুমি কি জানো না রাজা রাজড়ারা সব জাতেই বিবাহ করতে পারে?”
“…..কিন্তু….. ”
“…..আর কোনও কিন্তু নয়। শোনো সেই ছোকরা বাক্স নিয়ে ফিরে এলেই শুনবে, তার ভেতর আছে লক্ষ লক্ষ টাকার জড়োয়া গহনা। এ গহনা পাবে লীলাই। তার ওপর যৌতুক স্বরূপ আমি দেব আরও দশ লক্ষ টাকা! এর পরেও তোমার আপত্তি আছে?”
মহেন্দ্রনারায়ণ নিষ্পলক নেত্রে চন্দ্রবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন। চন্দ্রবাবুর মনে হল, সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি যেন তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি হরণ করে নিচ্ছে। তাঁর মুখ দিয়ে যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বেরিয়ে গেল – “আমার কোনও আপত্তি নেই”।
ঠিক এইসময় গহনার বাক্স নিয়ে ফিরে এল আনন্দমোহন। তাকে দেখে চন্দ্রবাবু যেন মনের ভেতর খানিকটা জোর পেলেন। ভাবলেন আর একটু আগে যদি ছোকরা আসত তাহলে আমি কথা দিতাম না।
আনন্দমোহন বলল, ” জহুরি গয়নাগুলো দেখে জানাল, বাক্সের ভেতর দশ লক্ষ টাকার গহনা আছে”।
চন্দ্রবাবুকে লক্ষ্য করে মহেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ” শুনলেন?”
চন্দ্রবাবু নিজের মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে চাইলেন, ‘ মহারাজ দেখতেও সুপুরুষ নন, বয়সেও নবীন নন। কিন্তু লীলা হবে মহারাণী আর সম্পত্তিও পাবে বিশ লক্ষ টাকার, তার পক্ষে যেটা কল্পনাতীত। সুতরাং এমন বিবাহে সম্মতি দিলে আমার পক্ষে বিশেষ অন্যায় হবে না’। তাই এবার প্রকাশ্যে বললেন, ” কিন্তু মহারাজ, আমার একটি আর্জি আছে”।
“….বলো”।
“….বিবাহের আগে লীলার সঙ্গে আপনার পরিচয় করা উচিত “।
“….আজ আর সময় নেই। আগামীকাল ঠিক সন্ধে আটটার সময় তোমার বাড়িতে আমি যাব”।
“…..আমার ঠিকানা জানেন?”
“….জানি, গহনার বাক্সটা তোমার কাছেই রেখে গেলাম”।
“…..একটা রসিদ দিই?”
চলে যেতে যেতেই মহারাজ বললেন, ” কোনও প্রয়োজন নেই। আমায় ঠকাতে পারে এমন কোনও মানুষকে আমি জানি না”।
চন্দ্রবাবুর মনে হল, ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল যেন একটা অপার্থিব ছায়া!
আনন্দমোহন নিজের সন্দেহভঞ্জনের জন্য আজও গিয়ে দাঁড়াল জানলার ধারে। গতকালের মতো আজও মহারাজকে দরজা দিয়ে বেরোতে দেখা গেল না।
ব্যাপারটা বড়ই আশ্চর্য, বড়ই অদ্ভুত, বড়ই ভয়াবহ! কিন্তু মুখে সে কিছুই প্রকাশ করল না।
আর এসব কথা নিয়ে আলোচনা করার মতো মনের অবস্থাও ছিল না তার। সে বুঝল, তার সুখের মেঘে আগুন লাগতে আর দেরী নেই। যাকে কেন্দ্র করে তার ভবিষ্যতের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা বিকশিত হয়ে উঠেছিল, এইবার সেই দেবীকে বিসর্জন দিতে হবে অশ্রুজলে। তবু সে স্বার্থপর হতে চায় না। লীলা যদি সুখী হয়, হোক সে মোহনপুরের মহারাণী।
চন্দ্রবাবু অতিথি সৎকারের জন্য আহার্যের আয়োজন করেছিলেন প্রচুর। ডিমের পরোটা, লুচি, পোলাও, মাংস, তিনরকম মাছ,তিনরকম নিরামিষ তরকারি, রুই মাছের ডিমের চাটনি, ইলিশ মাছের ডিমভাজা, সন্দেশ, রসগোল্লা,দই, রাবড়ি আর ছানার পায়েস। লীলা নিজের হাতে সারাদিন ধরে এইসব রেঁধেছে। যদিও এখনও সে জানে না যে অতিথি আজ আসছেন, তাঁর সঙ্গে তার ভবিষ্যতের সম্পর্ক কি!
আনন্দমোহনও তার কাছে কোনও কথা ভাঙেনি। নিজের দুঃখ সে পুষে রেখেছে নিজের মনের ভেতরেই।
বোধহয় তার মুখেও মনের ছায়া পড়েছিল কিছু কিছু। কারণ লীলা মাঝেমাঝে প্রশ্ন করেছে, ” আনন্দমোহনবাবু, আপনার মুখ আজ এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
আনন্দমোহন সহাস্যে লীলার প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়েছে এই বলে, ” শরীরটা আজ তেমন ভাল নেই”।
কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটা বাজল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজায় দেখা গেল মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণ’কে।
ধ্বক করে উঠল চন্দ্রবাবুর বুকের ভেতরটা। মহারাজের এমন আকস্মিক আবির্ভাব তিনি প্রত্যাশা করেননি। ঠিক মনে হল, মহারাজ যেন হাওয়ার ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন। যদিও এমন চিন্তা হাস্যকর, তবু চন্দ্রবাবুর এটাই মনে হল।
কেবলমাত্র বিস্মিত হল না আনন্দমোহন। সে এটাই আশা করেছিল।
মহারাজ দরজার কাছ থেকেই বললেন, ” আমার হাতে আধঘন্টার বেশী সময় নেই। তোমার ভ্রাতুষ্পুত্রী কোথায়? ”
চন্দ্রবাবু বললেন, ” দোতলায়”।
“…..তবে চলো দোতলায়। মনে রেখো, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটার সময় আমায় এখান থেকে যেতে হবে”।
ভাল করে মহেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে এবার চন্দ্রবাবু শিউরে উঠলেন। আনন্দমোহনেরও দুই চক্ষু হয়ে উঠল বিস্ফারিত।
মহেন্দ্রনারায়ণ আজ এসেছেন এক পদস্থ সৈনিকের বেশে এবং তাঁর মুখখানা আজ ভালভাবেই দেখা যাচ্ছে। আর সে কি মুখ!
মুখের চামড়ার রঙ একেবারে হলদে, তাতে জীবনের কোনও পরশ নেই যেন। রক্তহীন, ফ্যাকাসে চামড়া। চোখের ওপরের আর নীচের সাদা অংশটাই বেশী দেখা যাচ্ছে – যেন চোখ উলটে আছে নয়তো কোনও বদ্ধ উন্মাদের চোখ। মাথার লম্বা লম্বা রুক্ষ, কটা চুলগুলো এসে পড়েছে কাঁধের ওপর, যেন তেলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঘুচে গেছে বহুকাল। ওষ্ঠ এবং অধর কালো কুচকুচে, ঠোঁটের দুই পাশ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে দুপাশে দুটো শ্বাপদের মতো হিংস্র, হলদে রঙের লম্বা দাঁত! হঠাৎ দেখলে মনে হয় এ যেন বহুকাল আগের গলায় দড়ি দেওয়া বাসি মড়ার মুখ, কোনও দুষ্ট প্রেতাত্মা সেই মৃতদেহের ভেতর আশ্রয় নিয়ে মুখখানাকে করে তুলেছে কতকটা জীবন্ত!
মনের ভাব প্রাণপণে গোপন রেখে চন্দ্রবাবু বললেন, ” আসুন মহারাজ বাহাদুর, আমরা দোতলায় যাই”।
সশব্দে ভারী ভারী পা ফেলে মহেন্দ্রনারায়ণ সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগলেন – ঠিক যেন যন্ত্রচালিত পুতুল। কিংবা যেন কোনও পুতুল বাজিকর পুতুলকে চালনা করছে অদৃশ্য রজ্জুর সাহায্যে।
উপরের ঘরে বসেছিল লীলা। মহেন্দ্রনারায়ণকে দেখেই সে চমকে আড়ষ্ট হয়ে রইল কাঠের মতো।
চন্দ্রবাবু বললেন, ” লীলা, ইনি হচ্ছেন মোহনপুরের মহারাজা মহেন্দ্রনারায়ণ”।
লীলা নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করলে।
মহেন্দ্রনারায়ণ প্রায় আধ মিনিট ধরে লীলার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ফিরে পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” চন্দ্রমোহন, একবার ওই ঘরে আমার সঙ্গে এসো “।
চন্দ্রবাবু বললেন, ” যাচ্ছি মহারাজ বাহাদুর, আপনার যখন সময় নেই তখন তাড়াতাড়ি খাওয়ার ব্যবস্থাটা করে যাই”।
মহেন্দ্রনারায়ণ অত্যন্ত বিস্মিত স্বরে বললেন, ” খাবার!”
চন্দ্রনাথ বললেন, ” মহারাজ বাহাদুর! আপনাকে খাওয়াবার শক্তি কোথায় আমার? সামান্য আয়োজন করেছি”।
“…..সামান্য বা অসামান্য কোনও খাদ্যই আমি গ্রহণ করতে পারব না”।
“….সে কি! লীলা সারাদিন ধরে এত কষ্ট করে রাঁধল…..”
“…..বাজে সময় নষ্ট কোরো না। পাশের ঘরে চলো”।
অগত্যা আর বাক্যব্যয় না করে মহেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে চন্দ্রবাবু পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। বললেন, ” এখন, কি আদেশ বলুন”।
“…..এই নাও দশ লক্ষ টাকার নোট। লীলাকে আমি সঙ্গে নিয়ে মোহনপুরে ফিরে যেতে চাই”।
চন্দ্রবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ” বিবাহ না করেই?”
“……আমাদের বংশের নিয়ম, পাত্র রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে পাত্রীকে বিবাহ করবে”।
চন্দ্রবাবু বিনীতভাবে বললেন, “মহারাজার রাজ্যের কথা জানি না, কিন্তু এদেশে ও নিয়ম অচল”।
মহেন্দ্রনারায়ণ সিধে হয়ে দাঁড়ালেন, মাথায় তিনি যেন উঁচু হয়ে উঠলেন আরও এক ফুট! দীপ্ত চক্ষে চন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরকে আরও গম্ভীরতর করে বললেন, ” চন্দ্রমোহন! আমাকে তোমাদের দেশের নিয়ম মেনে চলতে হবে নাকি? লীলাকে আমার হাতে সমর্পণ করবে বলে তুমি কথা দিয়েছ – নিজের কথা রাখতে তুমি বাধ্য। আগামীকাল লীলাকে আমার সঙ্গে মোহনপুরে যেতে হবে। বুঝলে? বুঝলে? বুঝলে?”
মহারাজের সেই দীপ্ত দৃষ্টির মধ্যে ছিল যেন কোনও জাদু! আবার চন্দ্রবাবুর মনে হল, তাঁর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি যেন বিলুপ্ত হয়ে গেল! সামনের মূর্তি যেন প্রভু, তিনি যেন গোলাম!
মাথা নত করে চন্দ্রবাবু বললেন, ” যে আজ্ঞে, তাই হবে”।
মহেন্দ্রনারায়ণ বলতে লাগলেন, ” আগামীকাল সকাল দশটার সময় সিপাহীদের সঙ্গে ডুলি আসবে। লীলা যেন প্রস্তুত থাকে। তার সঙ্গে আর কেউ যেতে পারবে না। এই আমার আদেশ। তুমি কথা দিয়েছ, এ আদেশ অমান্য করে নিজের বিপদ ডেকে এনো না”।
বলেই মহেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাইরে এবং তারপর বেরিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতর থেকে।
চন্দ্রবাবু আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
লীলা ও চন্দ্রমোহন সেই ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
লীলা শিউরে উঠে বলল, ” উঃ, মহারাজের কি ভয়ঙ্কর চেহারা!”
চন্দ্রবাবু যেন স্বপ্নাবিষ্টের মতো বললেন, ” ভয়ঙ্কর চেহারা?”
লীলা সভয়ে বলল, ” মাগো! তুমি কি লক্ষ্য করে দেখনি, মহারাজা যতক্ষণ এখানে ছিলেন, একবারও তাঁর চোখের পাতা পড়েনি? ঠিক যেন মরা মানুষের চোখ!”
আনন্দমোহন বলল, ” আমি আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য জ্যান্ত মানুষের বুক ওঠে-নামে। কিন্তু মহারাজের বুক ছিল একেবারে স্থির। ঠিক যেন মরা মানুষের বুক”!
চন্দ্রবাবু বললেন, ” তোমরা ভুল দেখেছ। মরা মানুষ কখনো চলে-ফেরে? কথা কয়?”
লীলা বলল, ” তা ঠিকই। কিন্তু আমি যদি একটি রাজ্যও পাই তো তবু দ্বিতীয়বার তোমার ওই মহারাজ বাহাদুরকে দেখতে রাজি হব না!”
চন্দ্রবাবু শ্রান্ত স্বরে বললেন, ” আমি বললেও রাজি হবি না?”
লীলা আদর করে দুই হাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ” তুমি বললে সব পারি”।
“…..পারিস তো?”
“….হ্যাঁ জ্যাঠামশাই “।
“…..তাহলে শুনে রাখ, ওই মহারাজ বাহাদুরের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে। আমি কথা দিয়ে দিয়েছি”।
লীলা দারুণ বিস্ময়ে চমকে উঠল।
চন্দ্রবাবু আবার বললেন, ” আগামীকাল সকাল দশটার সময় তোকে মোহনপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহারাজের লোকজন আসবে। সঙ্গে আমরা কেউ থাকব না। তোর বিয়ে হবে মোহনপুরেই। ”
চন্দ্রবাবুর মনে হল, কথাগুলো যেন তিনি নিজে বললেন না, কেউ যেন জোর করে তাঁকে বাধ্য করল কথাগুলো বলতে।
লীলা চেয়ে রইল বিস্ফারিত চোখে।
চন্দ্রবাবু আবার বললেন, ” মহারাজ বাহাদুর তোর জন্য বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি আমার হাতে দিয়ে গিয়েছেন”।
লীলা আর কিছু বলল না, মাথা নত করলে কেবল।
তার অভাবে সমস্ত বাড়িখানা কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। চন্দ্রবাবুর আর কিছু ভাল লাগছে না।
নিজেকে তাঁর অপরাধী মনে হচ্ছে। একজন অজানা – কেবল অজানা নয়, প্রাচীন বয়সী এবং ভয়াবহ কুৎসিত বিদেশীর হাতে টাকার লোভে এমন করে লীলাকে সমর্পণ করা তাঁর পক্ষে উচিত হয়নি কিছুতেই। না জানি তিনি লীলার চোখে কতখানি হীন হয়ে পড়েছেন!
কিন্তু লীলা তো জানে না, তাঁর কোনও উপায় ছিল না। মহেন্দ্রনারায়ণ নিশ্চয়ই কোনও মায়াবী। সে যখনি এসেছে তখনি কি এক মন্ত্রগুণে তাঁকে যেন বশ করে ফেলেছে। তার সামনে তিনি হারিয়ে ফেলতেন তাঁর সমস্ত নিজস্বতা। তার হাতে লীলাকে তিনি সমর্পণ করেছেন সম্পূর্ণ নিজের অজ্ঞাতসারে। লীলার সঙ্গে দেখা হলে এই সত্যটাই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
আনন্দমোহনও ওদিকে যে মনমরা হয়ে আছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। চন্দ্রবাবুর বাড়িতেও সে খুব অল্পক্ষণই থাকে। চিত্রশালায় গিয়ে দিনের পর দিন অধিকাংশ সময়েই সে কাজকর্মের মধ্যে ডুবে থেকে ভোলবার চেষ্টা করে লীলার অভাব। তিনদিনের কাজ সে শেষ করে ফেলে একদিনেই।
প্রায় এক মাস কেটে গেল। লীলার কোনও খবর নেই।
একদিন আনন্দমোহনকে ডেকে চন্দ্রবাবু বললেন, ” ব্যাপার বড় ভাল বুঝছি না”।
“…..কি ব্যাপার?”
“….যাওয়ার সময় লীলা আমায় বলে গিয়েছিল, নিয়মিতভাবে চিঠিপত্র লিখবে। কিন্তু এই গত একমাসে তো তার একখানা চিঠিও পেলাম না। এর কারণ কি?”
“…..হয়তো তার অসুখ করেছে”।
“….আমারও সেই ভাবনা হচ্ছে। এখন কি করা উচিত বলো দেখি”?
“…..মোহনপুরে নিজে একবার গিয়ে দেখুন না?”
“…..মহারাজ যদি অসন্তুষ্ট হন?”
কেন?
আমি তাঁর তুলনায় গরীব। তুচ্ছ পোটো। সকলের সামনে আমাকে শ্বশুর বলে মানতে যদি তাঁর বাধে?”
তবু আপনার একবার যাওয়া উচিত।
তা ঠিক। লীলার প্রতিও তো আমার একটা কর্তব্য আছে! বেশ আনন্দমোহন, কালকেই আমি মোহনপুর যাত্রা করব”।
মোহনপুর হচ্ছে একটা ছোটখাটো শহর। প্রধান রাজপথটি মাঝারি আকারের, সোজা চলে গিয়ে শেষ হয়েছে রাজবাড়ির ফটকের সামনে। ফটকের মুখে। বন্দুক ঘাড়ে করে পাহারা দিচ্ছে সুসজ্জিত সিপাহী। প্রকাণ্ড প্রাসাদ – মাঝখানে মস্ত গম্বুজ।
চন্দ্রবাবু সিপাহীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ” মহারাজ বাহাদুরের সঙ্গে দেখা হবে?”
সিপাহী বলল, ” ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করুন”।
“…..তিনি কোথায়?”
“….ওই যে, এই দিকেই আসছেন”।
চন্দ্রবাবু দেখলেন, একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক রাজবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। চন্দ্রবাবু তাঁকে নমস্কার জানালেন।
ম্যানেজার বললেন, ” মহাশয়ের কি চাই?”
“….একবার মহারাজ বাহাদুরের দর্শন প্রার্থনা করি”।
“…..আপনি কোথা থেকে আসছেন?”
“…..কলকাতা থেকে”।
“…..আপনি মহারাজ বাহাদুরকে চেনেন?”
“…..কিছু কিছু চিনি”।
“…..কি সূত্রে তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয়?”
চন্দ্রবাবু প্রথমে ভেবে রেখেছিলেন, মহারাজের সাথে তাঁর আসল সম্পর্কের কথা বাইরের কারোর কাছে ভাঙবেন না। কিন্তু এখন তাঁকে বাধ্য হয়ে বলতে হল, ” মহারাজ বাহাদুরের সঙ্গে আমার ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিবাহ হয়েছে”।
ম্যানেজার সচমকে চন্দ্রবাবুর মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, “অসম্ভব! ”
চন্দ্রবাবু আহত কন্ঠে বললেন, ” কেন, অসম্ভব কেন? আমার চেহারা হোমড়া চোমড়া নয় বলে কি আমার ভ্রাতুষ্পুত্রীও মহারাজের অযোগ্য হবে?”
“….না মশাই, তা নয়। আমি সেই কারণে ‘ অসম্ভব’ বলছি না”।
“…..তবে?”
“….আমাদের মহারাজা এখনও বিবাহ করেননি “।
এইবার চন্দ্রবাবুর বিস্মিত হবার পালা। খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন, “এত বয়সেও তাঁর বিবাহ হয়নি, আমাকে কি এই কথা বিশ্বাস করতে হবে?”
“…..মশাই কি বলছেন? আমাদের মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ এই সবে তেইশে পা দিয়েছেন।”
চকিত স্বরে চন্দ্রবাবু বললেন, ” আপনাদের মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণ? ”
“…..হ্যাঁ, আমাদের মহারাজার ও-ই নাম”।
“…..তবে কি কলকাতায় গিয়ে তিনি নাম ভাঁড়িয়েছিলেন?”
“…..কতদিন আগে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?”
“…..তা মাসখানেক আগে”।
ম্যানেজার এইবার হেসে বললেন, ” মশাই, কোনও জুয়াচোরের পাল্লায় পড়েছেন। আমাদের মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণ গেল হপ্তায় বিলেত থেকে ফিরেছেন। বিলাতে তিনি আট মাস ছিলেন”।
চন্দ্রবাবুর মাথায় যেন এবার বাজ ভেঙে পড়ল। তবে কি তিনি লীলাকে সমর্পণ করেছেন কোনও প্রতারকের কবলে? তবু তিনি একটা নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” এখানে মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণ বলে কেউ আছেন?”
“…..একালে নেই। সেকালে ছিলেন”।
“…..মানে?”
“…..মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন আমাদের বর্তমান মহারাজার গ্রান্ডফ্রাদার। পিতামহ। ষাট বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে”।
চন্দ্রবাবু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন বজ্রাহতের মতো। তারপরেই তাঁর মাথার ভেতর দিয়ে খেলে গেল আরও এক ভয়াবহ সম্ভাবনার বিদ্যুৎ। তাড়াতাড়ি তিনি বললেন, ” মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণের কোনও প্রতিকৃতি আছে?”
ম্যানেজার হেসে বললেন, ” আপনি সন্দেহভঞ্জন করতে চান? বেশ আসুন। রাজবাড়ির বৈঠকখানায় মহারাজের পূর্বপুরুষদের অয়েলপেইন্টিং আছে”।
…………….. প্রকাণ্ড বৈঠকখানা, রাজকীয় ঐশ্চর্যে পরিপূর্ণ – দেওয়ালে দেওয়ালে বড় বড় নতুন ও পুরনো তৈলচিত্র।
একদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ম্যানেজার বললেন, ” ওই দেখুন মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণকে। শুনেছি তাঁর মৃত্যুর তিন দিন আগে এই ছবিখানা আঁকা হয়। তিনি হঠাৎ মারা যান জলে ডুবে। কিন্তু তাঁর দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ”
কিন্তু এসব কথা চন্দ্রবাবুর কর্ণে প্রবেশ করছিল না। প্রায় বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে তিনি চিত্রাঙ্কিত মহেন্দ্রনারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিষ্পলক নেত্রে।
…..এই তো লীলার স্বামী মহেন্দ্রনারায়ণ! তবে তিনি দেখেছেন এক অপার্থিব মৃত মুখ, আর ছবির এ মুখ হচ্ছে জীবন্ত মানুষের – আকাশ পাতাল তফাত, কিন্তু মুখ এক!
চন্দ্রবাবুর মনে হল ছবির মহেন্দ্রনারায়ণ যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে ক্রুর উপহাসের হাসি হাসছেন!
ম্যানেজার তাঁর গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ” মশাই, সাড়া দেন না কেন? এখন আপনার সন্দেহ মিটল তো?”
সুপ্তোত্থিতের মতো চন্দ্রবাবু বললেন, ” অ্যাঁ, কি বলছেন? হ্যাঁ, একমাস আগে এই মূর্তিই আমার বাড়িতে গিয়েছিল “।
“……পাগলের মতো প্রলাপ বকবেন না”।
চন্দ্রবাবু হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠে বললেন, ” পাগল এখনও হইনি, এইবারে হব” – বলতে বলতে তিনি অবশ হয়ে বসে পড়লেন গৃহতলে।
গতকাল তিনি মোহনপুর থেকে কলকাতা ফিরেছেন। তাঁর মুখ থেকে সব শুনেছে আনন্দমোহনও।
দুজনেরই মনের অবস্থা ভাল নয়। কথা নেই কারোর মুখে। হঠাৎ সজোরে বেজে উঠল সদর দরজার কড়াজোড়া। তারপরেই দরজা খোলার শব্দ।
চন্দ্রবাবু বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ” বেয়ারা কেন দরজা খুলে দিল? এত রাত্রে কে আবার জ্বালাতে এল?”
সিঁড়ির ওপরে লঘুপদের দ্রুত শব্দ শোনা গেল। তারপরেই বেগে ঘরের ভেতর এসে ঢুকল লীলা।
কিন্তু এ কি মূর্তি! কি বেশ তার!
এলোমেলো এলানো চুল – যেন তেল-জলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বহুকাল!
অসম্ভব আতঙ্কে তার চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, গাল দুটো ভেতরে বসে এবং থরথর করে কাঁপছে সর্বাঙ্গ।
ধুলোকাদা মাখা পরনের কাপড়ের পাট নেই, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া এবং সেখানা হচ্ছে সেই কাপড় যা পরে সে গিয়েছিল মোহনপুর।
মাটির ওপর ধপাস করে বসে পড়ে লীলা চেঁচিয়ে উঠল, ” জল! জল! নইলে এখনি বুক ফেটে যাবে!”
আনন্দমোহন তাড়াতাড়ি জল এনে দিল, সে একসঙ্গে ঢকঢক করে তিন গেলাস জল খেয়ে ফেলল। যেন কতদিনের মরুভূমির তৃষিত।
আবার সে চেঁচিয়ে উঠল, ” খাবার! খাবার! নইলে এখনি আমি মরে যাব!”
চন্দ্রবাবু নিজের খাবারের পাত্রগুলো তখনি তার দিকে ঠেলে দিলেন। লীলা দু-হাতে গোগ্রাসে খাবারগুলো মুখে তুলে খেয়ে নিল, কিন্তু মিটল না তার দারুণ ক্ষুদা! নিজেই হুমড়ি খেয়ে আনন্দমোহনেরও খাবারের পাত্রগুলো টেনে নিয়ে আবার দুই হাতে খেতে আরম্ভ করল – যেন তার দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা!
চন্দ্রবাবু নির্বাক বিস্ময়ে লীলার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এই অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করতে লাগলেন। আনন্দমোহনও।
পানাহার শেষ করেই ভীতস্বরে এবার লীলা বলে উঠল, ” সব কথা পরে হবে। যদি আমাকে বাঁচাতে চাও শিগগীর একজন ভালো রোজাকে ডেকে আনো! একটুও দেরী কোরো না – একটুও না!”
আনন্দমোহন রোজা ডাকতে ছুটল তখনি। সেই পাড়াতেই এক বিখ্যাত রোজার বাড়ি ছিল।
মিনতি ভরা কন্ঠে লীলা বলল, ” জ্যাঠামশাই, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। এ ঘরে আমাকে একলা ফেলে যেও না!”
“……যাব না মা, যাব না! আমি তোর কাছেই থাকব!”
“…..হ্যাঁ, আমার কাছেই থাকো! একলা হলেই আমি মরব!”
“……তোর কথার মানে বুঝতে পারছি না”।
আগেই বলেছি, এ ঘরের মাঝের এক দরজা দিয়ে পাশের ঘরে যাওয়া যায় এবং দেখাও যায় তার ভেতরটা! সেই দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠে লীলা অতি আর্তস্বরে আবার চিৎকার করে উঠল, ” ওগো, সে এসেছে, সে এসেছে! ”
চন্দ্রবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ” কে এসেছে রে?”
“…..সে….সে….সে! তার নাম নেই, তার দেহ নেই, কিন্তু আছে। জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই, তুমি কি পচা মড়ার দুর্গন্ধ পাচ্ছ না?”
চন্দ্রবাবু ভয় পেয়ে বললেন, ” কই, পাচ্ছি না তো!”
“…..কিন্তু আমি পাচ্ছি। আমাকে সে ফাঁকি দিতে পারবে না!”
“…..তুই কার কথা বলছিস, লীলা?”
“…..সে… সেই সে! আবার আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে! ”
“…..কোথায় সে?”
আঙুল দিয়ে পাশের ঘরটা দেখিয়ে কান্নাভরা গলায় লীলা বলল, ” ঐখানে! ওই যে দাঁড়িয়ে আছে, আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! উঃ! কি ভয়ানক!”
পাশের ঘরের দিকে ত্রস্ত চোখে তাকালেন চন্দ্রবাবু। হ্যাঁ, সত্যিই ওখানে সুদীর্ঘ ছায়ার মতো কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে বলেই তো বোধ হচ্ছে! তারপর ভাল করে দেখে বুঝলেন, তাঁরই চোখের ভ্রম। ওপর থেকে সমুজ্জ্বল আলোর আঁধার ঝুলছে, ছায়া বা কায়া কোন কিছুই নেই ওখানে। খালি ঘর।
বললেন, ” তুই ভুল দেখছিস লীলা। ও-ঘরে কেউ নেই”।
দুই বাহু দিয়ে চন্দ্রবাবুকে জড়িয়ে ধরে লীলা আকুল স্বরে বলল, ” আছে,আছে,আছে! আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ও আমাকে আবার নিয়ে যাবে। তুমি যদি একবার ছেড়ে যাও, ও আমাকে আবার নিয়ে যাবে”।
এমন সময় রোজাকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দমোহন পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল।
রোজা ভেতরে এসেই বলল, ” আমি এই ঘরে কোনও দুষ্ট আত্মাকে অনুভব করছি!…..হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই। দুষ্ট আত্মা…পিশাচ! পিশাচ! রাজা নলের দেহে যেমন শনি ঢুকেছিল, সেই পিশাচও তেমনি কোনও মানুষের মৃতদেহের মধ্যে ঢুকে পৃথিবীর ওপর অত্যাচার করে বেড়ায়। ভয়ানক এক পিশাচ! আমাকে আগে এই ঘরে বসেই কাজ আরম্ভ করতে হবে”।
আনন্দমোহন ভীত, সন্দিগ্ধ চোখে পাশের ঘরে দাঁড়িয়ে ফিরে ফিরে তাকাতে লাগল। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কোনও কিছুই দেখতে পেল না। অথচ এইটুকু অনুভব করতে পারল, ঘরের ভেতর সে এবং রোজা ছাড়া অন্য কোনও হিংস্র, ভয়ানকের অস্তিত্ব আছে।
উত্তেজনার পর চন্দ্রবাবুর দেহ ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছিল, কিন্তু সেই অবস্থাতেই রোজার কথা শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল তাঁর সর্বাঙ্গ।
লীলা চোখের সামনে কি দেখতে পাচ্ছিল তা সেই-ই জানে, কিন্তু এবারে সে চক্ষু মুদে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রোজা মাটির ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতে উদ্যত হল – এবং ঠিক সেই মূহুর্তেই ঘরের ভেতর এসে ঢুকল একটা প্রবল দমকা হাওয়া – সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলোটা গেল নিভে।
রোজা চিৎকার করে বলল, ” আলো, আলো – শিগগীর আর একটা আলো আনো। অন্ধকারে ফুটে উঠেছে দুটো মারাত্মক দীপ্ত চক্ষু, এখনি সর্বনাশের সম্ভাবনা। শিগগীর আলো আনো – আলো, আলো, আলো!”
চন্দ্রবাবু আত্মহারার মতো এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে টেবিলের ওপর থেকে আলোটা নিয়ে ও ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।
লীলা তীক্ষ্ণস্বরে কেঁদে উঠে বলল, ” জ্যাঠামশাই যাবেন না….যাবেন না…..আমাকে একলা ফেলে যাবেন না জ্যাঠামশাই…..! ”
“…..আমি তোর সামনেই আছি, মা। আলোটা ও ঘরে রেখেই আবার তোর পাশে এসে বসব”…..বলতে বলতে চন্দ্রবাবু পাশের ঘরে গিয়ে আলোটা মেঝের ওপর বসিয়ে দিয়েই আবার এ ঘরে ফিরে আসতে যাবেন…….
এমন সময় আচম্বিতে দুই ঘরের মাঝের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে! পরমূহুর্তেই লীলার কন্ঠে জাগল চিৎকারের পর চিৎকার!
চন্দ্রবাবু পাগলের মতো মাঝের দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আনন্দমোহন এবং রোজাও যোগ দিল তাঁর সঙ্গে। ও ঘরের মধ্যে লীলার বিষম চিৎকার ও ব্যাকুল ক্রন্দন আরও বেড়ে উঠল, কিন্তু তিনজনের সমবেত শক্তিও দরজার পাল্লাদু’খানাকে এক চুল ফাঁক করতে পারল না।
তারপরেই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল লীলার কণ্ঠস্বর! ও ঘরের বারান্দার দিকের একটা দরজা খুলে যাবার শব্দ শোনা গেল। তারপরেই অকস্মাৎ খুলে গেল দুই ঘরের মাঝের দরজাটা। আনন্দমোহন, রোজা এবং চন্দ্রবাবু প্রাণপণ দরজা ঠেলছিলেন, দরজাটা সহসা খুলে যেতেই তিনজনে টাল সামলাতে না পেরে খোলা দরজার ভেতর দিয়ে ও ঘরে মেঝের ওপর পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে।
আলো এনে দেখা গেল, ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
আনন্দমোহন বারান্দায় যাওয়ার খোলা দরজা দিয়ে ছুটে গেল বাইরে। সেদিন উঠেছিল প্রতিপক্ষের চাঁদ। চারদিক করছে ধবধব।
বারান্দার তলাতেই একটা ছোট রাস্তা। তারপরেই একটা পুষ্করিণী এবং ভাঙা ঘাট।
সেই ভাঙা ঘাটের সামনে পুষ্করিণীর খানিকটা জল ঘুরছিল চক্রের পর চক্র দিয়ে। যেন এইমাত্র সেখানে কোনও ভারি জিনিস পড়েছে কিংবা কেউ ঝাঁপ খেয়ে অতলে তলিয়ে গেছে……..
তারপর কেটে গিয়েছে বারো বছর – অর্থাৎ এক যুগ।
দেবতারা নাকি অমর, তাঁদের কথা বলতে পারি না; কিন্তু মানুষের পৃথিবীতে এক যুগ বড় অল্পকালের কথা নয়। এই দেখ না, ধরতে গেলে বারো বছরের মধ্যেই সমস্ত পৃথিবীতে রক্তসাগরের ঢেউ খেলার জন্য ধূমকেতুর মতো হিটলারের আবির্ভাব এবং অন্তর্ধান।
এই বারো বৎসর পর লীলাকে না ভুললেও তার অভাব আনন্দমোহনকে আর তেমন ভাবে আঘাত দেয় না। চন্দ্রবাবু পরলোকে। নিজের সম্পত্তি তিনি দান করে গিয়েছেন আনন্দমোহনকেই এবং আনন্দ’ও এখন একজন ভারতবিখ্যাত চিত্রকর। তার খ্যাতি হয়তো চন্দ্রবাবুর চেয়েও বেশী।
সেদিন আনন্দমোহন চিত্রশালায় বসে নিজের মনে কাজ করছে। এমন সময় একটি ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। আনন্দ মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল জিজ্ঞাসু চোখে।
আগন্তুক বলল, ” আমি মোহনপুরের মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণের প্রাইভেট সেক্রেটারি “।
‘ মোহনপুর, মোহনপুর!… ‘ স্মৃতি বীণার একটি পুরাতন তার নতুন করে যেন বেজে উঠল অনেকদিন পর!
বাইরে কোনওরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ না করে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, “আমার কাছে কি দরকার?”
লোকটি বলল, ” মহারাজ বাহাদুরের একখানা তৈলচিত্র আঁকবার জন্য আপনি মোহনপুরে যেতে পারেন? পারিশ্রমিক যা চাইবেন পাবেন”।
আনন্দমোহন সম্মতি জানাল।
“…..কবে যেতে পারবেন?”
“….আগামী রবিবার “।
…….যথাসময় আনন্দমোহন মোহনপুরে গিয়ে উপস্থিত হল।
বৈঠকখানায় বসেছিলেন মহারাজ বাহাদুর। অতি সদালাপী লোক। তাঁর সঙ্গে কথা কইতে কইতে হঠাৎ আনন্দ’র দৃষ্টি পড়ল দেওয়ালে ঝোলানো মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতিগুলোর ওপর। মহারাজের কি একটা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সে একেবারে থেমে গেল – বিস্ফারিতনেত্রে আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল মহেন্দ্রনারায়ণের ছবিখানার দিকে। তার মনে হল ছবির মুখ যেন তাকে দেখেই নির্দয় ব্যঙ্গভরা হাসি হাসছে।
মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণ বিস্মিত হয়ে বললেন, ” মনে হচ্ছে আমার পিতামহের ছবি দেখে আপনি ভয় পেয়েছেন! কেন বলুন দেখি?”
আনন্দমোহন তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল।
সন্ধ্যার পর বেড়িয়ে আনন্দমোহন বাসার দিকে ফিরে আসছে। মোহনপুরের প্রাসাদের একটা ঘরেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মোহনপুর এবং তার আশেপাশে দেখার কিছুই নেই। বন, মাঠ আর নদী ছাড়া।
তখন চাঁদ উঠেছিল। খন্ড চাঁদ। অন্ধকার একটুখানি পাতলা হয়েছিল বটে, কিন্তু ভাল করে নজর চলে না। তার ওপর আনন্দ যেখান দিয়ে আসছিল, সেখানে পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে বড় বড় গাছের পর গাছ সৃষ্টি করেছে চোখ-অন্ধ করা অন্ধকার।
তফাতে দেখা গেল একটা আলো।
খানিক এগিয়ে আনন্দ দেখল, আলো হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি। আরও এগিয়ে বুঝল মূর্তিটা কোনও স্ত্রীলোকের। কাছে এসে দেখল লীলার মূর্তি।
নিজের চোখকে আনন্দ বিশ্বাস করতে পারল না, চমৎকৃত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দুই চোখ বিস্ফারিত।
লীলা নীরবে হাসল – অতি মৃদু করুণ হাসি।
আনন্দ বলল, ” লীলা”।
ওষ্ঠাধারে তর্জনী রেখে লীলা কথা কইতে বারণ করল আনন্দকে। তারপর আনন্দ’কে তার অনুসরণ করতে ইশারা করল।
বিনা বাক্যব্যয়ে আনন্দ তার অনুসরণ করতে লাগল।
লীলার পেছন পেছন যেতে যেতে তার হাতের লন্ঠনের আলোতে আনন্দ এ’ও লক্ষ্য করল, আজও লীলার পরণে সেই শাড়িটা, যেটা পরে সে যাত্রা করেছিল মোহনপুরের দিকে।
বন। এত নিস্তব্ধ যে একটা ঝিঁঝিঁপোকার ডাকও কানে আসছে না, গাছের একটা পাতারও শব্দ হচ্ছে না। পৃথিবী যেন মরে গিয়েছে। এটা যেন ইহলোক নয়, পরলোক।
বন শেষ। নদীর ধার, কিন্তু জলকলরোল শোনা যায় না। মরা চাঁদের আলো। বাতাসও স্থির।
নদীর ধারের একখানা পুরনো বাড়ির খানিকটা ভেঙে পড়েছে, খানিকটা দাঁড়িয়ে। লীলা লন্ঠন হাতে তার ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
একখানা মস্ত ঘর। তারই ভেতর গিয়ে দাঁড়াল লীলা এবং আনন্দমোহন।
লন্ঠনটা তুলে ধরল লীলা। সেই চাপা আলোয় আনন্দ দেখতে পেল, খাটের ওপর একেবারে সিধে হয়ে বসে আছে মোহনপুরের অতীতের মহারাজ মহেন্দ্রনারায়ণের ভীষণ মূর্তি! বীভৎস, ভয়ঙ্কর!
বিকট চিৎকার করে আনন্দমোহন মূর্ছিত হয়ে পড়ল।
পরদিন প্রভাতে নদীর ধারে মোহনপুরের শ্মশানে আনন্দকে পাওয়া গেল। তখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। তার কাছে পড়ে ছিল একটা সেকেলে লন্ঠন।
( সমাপ্তি)