বিশাল নিলামঘর। একটু পরেই শুরু হবে নিলাম। ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের মৃদু গুঞ্জনে ঘরটি মুখরিত। কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে দাম হাঁকানো এবং একে অন্যকে টপকে পছন্দের জিনিসটি বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা।
মিস্টার মার্ক স্টিফেন্স বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। অন্যদের থেকে একটু দূরে, ঘরটির এক কোণায় বসেছেন। অন্যরা হয়তো দুজন, তিনজন, কিংবা একা এসেছেন। মিস্টার মার্ক সবসময় একা আসেন।
পুরনো জিনিস কেনার বাতিক আছে তাঁর। এখন পর্যন্ত তিনি নিজের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করেছেন নানা রকম পুরনো জিনিস দিয়ে। কোনটা পাঁচশো বছরের পুরনো, কোনটা বা হাজার বছর। তিনি এসব কিনতে কখনো পিছপা হন না, প্রয়োজনে ঢালেন দেদার টাকা। “শখের তোলা আশি টাকা” বলে একটা কথা আছে। এসব পুরনো জিনিস নিয়ে তিনি কবরে যেতে পারবেন না, তবুও এই বয়সেও বেরিয়ে পড়েন কোথাও কোন মূল্যবান (এবং পুরনো) জিনিস নিলামে বিক্রি হচ্ছে শুনলেই।
একা মানুষ মিস্টার মার্ক। এক সময় তিনি কয়লার ব্যবসা করে রাশ রাশ টাকা কামিয়েছেন। এত টাকা, খরচ করার কোন জায়গা নেই বলেই হয়তো বিস্তর খরচ করে কেনেন পুরনো জিনিস। বিয়ে-থা করেন নি, কাজেই কোন ওয়ারিশ নেই। বাবা, মা সবাই গত হয়েছেন। একটা ভাই ছিল, সেও কয়েক বছর হয় এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এখন মিস্টার মার্ক আর তাঁর কুকুর রকি একটা বিশাল বাড়িতে থাকেন। একজন বাবুর্চি, একজন ড্রাইভার আর একজন ম্যানেজার ছাড়া আর কেউ সেখানে তাঁকে সঙ্গ দেয়ার মতো নেই।
তবে সেজন্য খারাপ লাগে না মিস্টার মার্কের, তিনি একা থাকতেই পছন্দ করেন। পাহাড়ের কোলে তৈরি তাঁর বাড়ি, নিচেই সাগরের নীল ঢেউ এসে কিছুক্ষণ পর পর বিকট গর্জনে আঘাত হানে। চারিদিক সবুজে আচ্ছন্ন, দেখতে ভারী সুন্দর জায়গাটা। এমন একটা জায়গায় নিজের সংগ্রহের পুরনো জিনিসপগুলো, বইপত্র, পিয়ানো আর পেছনে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি নিয়ে তাঁর দিব্যি কেটে যাচ্ছে। আর তো ক’টা দিন, তারপরই ওপারের ডাক এসে পড়বে, তারপর “সাঙ্গ হবে খেলা।”
মিস্টার মার্ক প্রথম যে পুরনো জিনিসটি কিনে নিজের এই শখটির গোড়াপত্তন করেন, সেটা হল একটা চীনা চা-য়ের সেট। ছ’টা কাপ, পিরিচ, ট্রে এবং কেতলি নিয়ে বাহারি একটা চীনেমাটির সেট। সেটা কিনতে বেরিয়ে গিয়েছিলো পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার। একটা চায়ের সেটের দাম কতই বা হবে, একশো ডলারও হবে না। কিন্তু পুরনো জিনিস বলেই না এত দাম। কোন এক মিং রাজা নাকি এই চায়ের পাত্রে চা পান করতেন। কোন জিনিস এক বছরের পুরনো হলে সেটা জঞ্জাল, আর এক হাজার বছরের পুরনো হলেই সেটা ভয়ানক মূল্যবান জিনিস। ইতিহাস, ঐতিহ্যের ব্যাপার চলে এলেই দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। যত পুরনো, তত মূল্যবান। আজব এই পৃথিবী। মানুষ আজব জীব, তাদের কাণ্ডকারখানাও আজব।
সেই যে শুরু হল, তারপর আর থামেননি তিনি। জমিয়েছেন পুরনো অস্ত্র, অলঙ্কার, মুদ্রা, মূর্তি, সব। তাঁর সংগ্রহশালায় ঢুকলে একটা প্রাচীনত্বের গন্ধ নাকে এসে লাগে।
সব নিলাম প্রতিষ্ঠানই কোন নিলাম অনুষ্ঠিত হবার আগে একটা নোটিশ টাঙিয়ে দেয়, কী কী বিক্রি হবে। জিনিসগুলোর ছবি আর বর্ণনা দিয়ে দেয় সাথে। মিস্টার মার্ক একটা ছুরির ছবি দেখে আগ্রহী হয়েছেন, তাই এসেছেন। ছুরিটা একজন পর্তুগিজ নাবিকের ছিল, সে যখন তার জাহাজে করে আনারস-টানারস নিয়ে পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে ব্যবসার মতলবে ভারতে প্রথম প্রবেশ করলো, তখন তার কোমরে গোঁজা ছিল এই দশাসই একটা ছুরি। কাজেই মিস্টার মার্কের এটা না কিনলেই নয়।
একজন ফিটফাট পোশাক পরা লোক ঘরটিতে ঢুকলেন সামনের দরজা দিয়ে। সব ফিসফাস, গুঞ্জন সাথে সাথে বন্ধ। সবাই নড়েচড়ে বসলেন, প্রস্তুত হয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, এখনই নিলাম শুরু হবে।
লোকটি একটা মেহগনি কাঠের টেবিলের ওপাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, হাতে সোনালী কাজ করা একটা বাহারি হাতুড়ি। এটা দিয়েই বাড়ি দিয়ে দিয়ে নিলাম ডাকা হবে।
লোকটি উপস্থিত ক্রেতাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কাজ শুরু করলেন।
প্রথমে ছোটখাটো জিনিস দিয়ে নিলাম শুরু হল। একজন লেখকের নিজের সই করা বইয়ের পাণ্ডুলিপি বিক্রি হল আট হাজার ডলারে। তেমন কেউ দাম হাঁকাল না, কাজেই দ্রুত কাজ সমাপন হয়ে গেল।
তারপর একটা মূর্তি। যীশুর মাতা মেরীর মূর্তি। অজানা এক ভাস্করের তৈরি। কালো পাথরের। দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু মিস্টার মার্ক সেদিকে দৃকপাত করলেন না। তিনি যখন একটি নির্দিষ্ট জিনিস কেনার জন্য মনস্থির করেন, তখন আর অন্য কিছুর দিকে মনোযোগ দেন না। তখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয় শুধু মাত্র ওটা। এখন তাঁর মাথায় ঘুরছে ছুরিটা।
আরও কয়েকটা জিনিস বিক্রি হল। ধীরেসুস্থে চলছে কাজকর্ম। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল পরিবেশ। কেউ কোন গণ্ডগোল করছে না। হয়তো কেউ নাকের ডগা থেকে ছোঁ মেরে দশ হাজার বেশি টাকা দিয়ে জিনিসটা নিয়ে চলে গেল, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই। নিলামের নিয়মই তো এমন। এক একটা জিনিসের প্রকারভেদে দাম ভিন্ন। কোন জিনিস কিনতে হলে আগের ক্রেতার চেয়ে পাঁচ হাজার ডলার দাম বেশি হাঁকাতে হবে, কোন জিনিসের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কটা বিশ হাজার।
অবশেষে একটা মখমলের কাপড়ে করে ছুরিটা মঞ্চে নিয়ে আসা হল। নড়েচড়ে বসলেন মিস্টার মার্ক স্টিফেন্স। এইবার তাঁর পালা। কোনমতেই যেন কেউ জিনিসটা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে না পারে।
নিলামওয়ালা লোকটি ডাকা শুরু করলেন। পাঁচ হাজার ডলার থেকে শুরু হচ্ছে। পাঁচ হাজার করে দাম বাড়াতে হবে। পাঁচ হাজার এক, পাঁচ হাজার দুই, … …
দশ হাজার। উত্তেজিত কণ্ঠে দাম হেঁকে বসলেন মিস্টার মার্ক।
নিলামওয়ালাকে বেশ খুশি খুশি দেখায়। যত দাম বাড়বে, ততই লাভ। দশ হাজার বলেছেন মিস্টার মার্ক। দশ হাজার এক, দশ হাজার দুই, … …
মিস্টার মার্ক চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। ইস, কেউ যদি আর দাম না ডাকতো।
দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে নিলামওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, দশ হাজার তিন।
কেউ দাম হাঁকাল না। নিলামওয়ালা হতাশ হয়েছেন, বোঝাই যাচ্ছে। তবুও হাতুড়িটা ঠোকার আগে একটু অপেক্ষা করলেন, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নিলেন।
মিস্টার মার্ক উসখুস করছেন।
নিলামওয়ালা অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ মনে হাতুড়িটা টেবিলে ঠুকে বললেন, Sold. অর্থাৎ বিক্রি হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে তিনি আরও বেশি দাম আশা করেছিলেন।
মিস্টার মার্ক নিজেও যে অবাক হন নি তা নয়। তিনি ভেবেছিলেন, এত পুরনো একটা ইতিহাস জড়ানো পর্তুগিজ নাবিকের ছুরি, কম করে হলেও পঁচিশ হাজার তো দাম উঠবেই। কিন্তু আজ ভাগ্য যে বড় সুপ্রসন্ন দেখা যাচ্ছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিনে নিচ্ছেন তিনি, একেবারে “জলের দরে।”
এগিয়ে এসে ছুরিটা গ্রহণ করার অনুরোধ করলেন নিলামওয়ালা। মিস্টার মার্ক বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। তাঁকে একটা বড় মোড়কে ভরে দেয়া হল ছুরিটি। তার আগে তিনি ভাল করে দেখে নিলেন, নিলামওয়ালা তাঁকে ঠকিয়ে অন্য জিনিস গছিয়ে দিচ্ছে কীনা। নাহ, সেই জিনিসই, আসল। বাহারি কাজ করা ছুরির হাতল, দামেস্ক ইস্পাতের ফলা। পুরনো বলে বিভিন্ন জায়গায় একটু-আধটু মরচে পড়ে জানান দিচ্ছে। হাতে নিয়ে একটা শিহরণ অনুভব করলেন তিনি। কে জানে, এই ছুরি নিয়ে সেই নাবিক কী করেছিল, কী কী কেটেছিল? আচ্ছা, খুনখারাবী করেছিল কি? ভাবতেই হাসি পেয়ে যায় মিস্টার মার্কের।
ঘরটিতে বসে থাকা অন্য ক্রেতাদের দিকে হাসি মুখে তাকালেন তিনি। অবাক হয়ে দেখলেন, সবাই কাঠের পুতুলের মতো তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, একদৃষ্টিতে। একটু বিব্রত লাগলো তাঁর। তিনি খেয়াল করলেন, পেছনের কাতারে বসে আছেন তাঁর বহু দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী মিস্টার ফোর্ড। মিস্টার ফোর্ডও একজন কোটিপতি। বহু নিলামে মিস্টার মার্কের ওপর দাম হাঁকিয়ে জিনিস কিনে নিয়ে গেছেন। আজ তিনি একেবারে চুপ, আর সবার মতো উনার মুখও গম্ভীর।
এখন মিস্টার মার্ক বেরিয়ে যাবেন। তাঁর কাজ শেষ হয়েছে, আর থাকার দরকার নেই। যাবার পথে একটু টিপ্পনী কেটে মিস্টার ফোর্ডকে বললেন, কী ব্যাপার, আজ আমার ওপর দাম হাঁকালেন না?
মিস্টার ফোর্ড সেই গম্ভীর চেহারা ধরে রেখেই বললেন, সাবধানে থাকবেন, মিস্টার মার্ক।
তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন মিস্টার মার্ক, তিনি রসিকতা করছেন না। সহসা একটা অস্বস্তি পেয়ে বসে তাঁকে।
গাড়িতে উঠে বসেন তিনি। শোফার জিম গাড়ি চালাচ্ছে। ত্রিশ বছর বয়সী হাসিখুশি যুবক। বৃদ্ধদের সাথে তরুণদের ঠিক বনে না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশ আন্তরিক সম্পর্ক। তিনি বললেন, বাড়ি চল।
গাড়ির পেছনের সীটে আরাম করে বসেছেন মিস্টার মার্ক, কোলের ওপর রাখা আছে ছুরির বাক্সটা। তিনি মোড়কটা খুলে ফেলেন। নিরীহদর্শন একটা ছুরি। একজন নাবিকের কাছে ছিল এটা, সেই নাবিক হয়তো জলদস্যুই ছিল, দুয়েকটা খুনটুনও হয়তো এই ছুরি দিয়ে হয়েছে, কিন্তু সেটা তো অতীত। অতীত নিয়ে ভয় পাবার কী আছে? নিজেকেই ধমক দেন মিস্টার মার্ক, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কুসংস্কার বিশ্বাস করার কোন মানে হয় না। অনেকে মনে করে, বিভিন্ন জিনিসে অভিশাপ থাকে, সেটা যার হাতে যায়, তারই অমঙ্গল হয়। এই ছুরির ইতিহাস নিশ্চয়ই মিস্টার ফোর্ড জানেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
বাসায় এসে নিজের সংগ্রহশালায় কাঁচের দেয়ালের আড়ালে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন তিনি ছুরিটা, যাতে ঘরে এলেই এটা দেখা যায়, সবার আগে চোখে পড়ে। ছুরিটা দেখতে সুন্দর, কিন্তু কোন দামী মণিমুক্তা বসানো নেই। এর যতটুকু মূল্য, সবটুকুই এর বয়সের জন্য।
রাত হয়েছে, মিস্টার মার্কের চীনা বাবুর্চি মং টেবিলে খাবার দিলো। সে চীনা হলেও সাপ-বিচ্ছুর পাশাপাশি এদেশী খাবারও রান্না করতে পারে চমৎকার, তাই তার চাকরি এখনো বহাল আছে।
ম্যানেজার একজন আছে মিস্টার মার্কের, তার কাজ হল বিভিন্ন কাজে মিস্টার মার্ককে সাহায্য করা, যেমন ব্যাংক আর উকিলের সাথে যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা চিঠিপত্রের জবাব দেয়া, পুরনো জিনিসগুলো ঝাড়পোছ করে চকচকে রাখা ইত্যাদি। শেষোক্ত কাজটি সে অত্যন্ত বিতৃষ্ণার সাথে করে থাকে, কিন্তু উপায় কী? এই বুড়োর নিমক খায় সে, কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে এই “ফেলনা” জিনিসগুলো ঘাঁটতে হয়। একবার একটা প্রাচীন দোনলা বন্দুকের নল পরিষ্কার করতে গিয়ে নলের ভেতর থেকে একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এসেছিলো, সেটা সে মিস্টার মার্কের কাছে সযত্নে গোপন করে গেছে, তিনি জানতে পারলে নিশ্চয়ই চিৎকার-চেঁচামেচি করে কেলেঙ্কারির একশেষ ঘটিয়ে ছাড়তেন। মিস্টার মার্কের কাছে এই জিনিসগুলোই সব, এগুলোকে তিনি সন্তানসম জ্ঞান করে থাকেন। মনুষ্য প্রজাতিটির প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ নেই, কাজেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেক কাজ তিনি নিজে করেন। তাঁর বাগানে কোন মালী নেই, তিনি নিজ হাতে গাছে পানি দিয়ে থাকেন।
ম্যানেজার রিচি এখানেই থাকে। ওর মায়ের অসুখ বলে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে আজ সকালে চলে গেছে। মা সুস্থ্য হলেই ফিরে আসবে। আপাতত বাড়িতে এখন শুধু বাবুর্চি মং রয়েছে। জিমও চলে গেছে নিজের বাসায়। সে এখানে থাকেনা, রাতবিরেতে গাড়ি নিয়ে বের হওয়াও দরকার হয় না মিস্টার মার্কের। তবুও ফোন আছে, ফোন করলেই কাছে ওর বাসা, স্ত্রীকে নিয়ে থাকে, সেখান থেকে এক দৌড় দিয়ে চলে আসতে পারবে।
মিস্টার মার্ক ফোন করলেন মিস্টার ফোর্ডকে। ব্যাপারটা খোলাসা করা দরকার। কেন তিনি এমন হুঁশিয়ারি দিলেন সেটা না জানা অবধি মনটা ঠিক শান্ত হচ্ছে না।
ফোনে দু’বার রিং হবার আগেই তুলে নিলেন মিস্টার ফোর্ড। ধরেই বললেন, আমি জানতাম, আপনি ফোন করবেন।
কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি আমাকে খানিকটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন, সেটা স্বীকার করতেই হয়।
ঐ ছুরি অভিশপ্ত। ভারী স্বরে বললেন মিস্টার ফোর্ড।
ওহ গড। বিরক্তির সুরে বললেন মিস্টার মার্ক। কী কাহিনী আছে এটার? এটা কয়েকজন মানুষকে খুন করেছে, এই তো?
না।
তাহলে?
এই ছুরি যার কাছে থাকে, তার আশেপাশের মানুষের, এমনকি নিজেরও অমঙ্গল হয়। তাদের জীবন সংশয় হয়।
কেন?
কেন জানি না। এই ছুরি ছিল একজন জার্মান ভদ্রলোকের দখলে, তিনি এটা এক সপ্তাহও রাখতে না পেরে গোপনে বিক্রি করে দেন আরেক জায়গায়। তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা কয়েক দিনের মধ্যেই খুন হয়, অজানা আততায়ীর হাতে, তারপর আর রাখতে সাহস পাননি। তারপর একজন আমেরিকান ধনকুবের খুব সস্তায় পেয়ে ঘরে সাজিয়ে রাখেন। তিনি দুই রাতের মাথায় খুন হন, পেটে বিঁধে ছিল এই ছুরিটা। হাত ঘুরতে ঘুরতে এটা এখন এসে পড়েছে আপনার কাছে। আমার আর আপনার মধ্যে মন কষাকষি আছে, সেটা স্বীকার করি। তবুও একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি, এই ছুরি যত তাড়াতাড়ি পারেন, বাসা থেকে দূর করুন। বিশ্বাস করুন, আমি তামাশা করছি না। এটা আপনার সর্বনাশ করবে, রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। পারলে সাগরে ফেলে দিন।
মিস্টার মার্ক ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ভাল গল্প। শুনে আনন্দ পেলাম। তবে সত্যি কথা জানেন কি মিস্টার ফোর্ড, এই যুগে এসে কোন কুসংস্কারে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। সবাই এগিয়ে চলেছে, আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি, তাহলে চলবে কেন?
আমি আমার কথা বলে দিলাম, এখন আপনার যা ইচ্ছে করুন। আমি অনেক জিনিস আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে, দাম হাঁকিয়ে কিনেছি। কিন্তু এই ছুরির বেলায় টুঁ শব্দটিও করিনি। আপনার কি একটুও খটকা লাগে নি? কারণ আমি জানি, ছুরিটা অশুভ।
বলতেই হচ্ছে মিস্টার ফোর্ড, কোন কিছুর শুভ অশুভ বলে কিছু নেই।
আপনার ব্যাপার। আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমি এই আশঙ্কাই করছিলাম।
ঠিক আছে। কথা বলে ভাল লাগলো। রাখি আজ।
রাখি। সাবধানে থাকবেন, আবার বলছি।
সাবধানেই থাকবো। ধন্যবাদ।
ফোন নামিয়ে রেখে মিস্টার মার্ক নিজের মনেই বললেন, আজকের যুগেও মানুষ এসবে বিশ্বাস করে?
আর মিস্টার ফোর্ড নিজের বাড়িতে বসে গলায় ঝুলানো ক্রসটি স্পর্শ করে বললেন, হে ঈশ্বর, এই মানুষটিকে তুমি রক্ষা কর।
মিস্টার মার্ক শোবার আয়োজন করেছেন। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম। সকালে উঠে আবার কাজকর্ম আছে। কাজ বলতে বাইরে হাঁটা, প্রাতঃকালীন বায়ু সেবন, বই পড়া, পুরনো জিনিসের দেখভাল করা ইত্যাদি।
এতক্ষণ ছুরিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, আর নিজের মনেই হাসছিলেন যে কেন তাঁর ভয় ভয় লাগছে। একটা ছুরি, যেটা কীনা প্রায় পাঁচশো চৌদ্দ বছরের পুরনো, সেটা নিয়ে ভয় পাবার কোন কারণ নেই।
তিনি এক গেলাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁকে একজন সুখী মানুষ বলা চলে, তাঁর বালিশে মাথা দেওয়া মাত্রই অঘোর ঘুমে তলিয়ে যান তিনি। অসুখী মানুষ ঘুমের ওষুধ খেয়েও সারারাত জেগে বসে থাকে, এপাশ-ওপাশ করে কাটায় বিনিদ্র রজনী। ঘুম হল ঈশ্বরের একটি বিশেষ আশীর্বাদ, সবার কাছে এটা থাকে না।
ঘুমের মধ্যে মিস্টার মার্ক স্বপ্ন দেখলেন, মিশরের প্রাচীন ফারাও রাজা তুতানখামেন স্বপ্নের মধ্যে খুব ধীরে ধীরে বলছেন, “যারা ফারাওদের শান্তি নষ্ট করবে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।” যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে তাঁর গলার স্বর।
পিরামিড আছে মিশরে, আছে তুতানখামেনের সোনার মুখোশ। অনেকে বলে, এই মমি অশুভ। সত্যিই যে প্রত্নতাত্ত্বিক এই মমি উদ্ধার করেছিলেন, যাঁরা ছবি তুলেছিলেন, যাঁরা গর্ত খুঁড়েছিলেন, সবাই মারা যান অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে। কেউ মারা গিয়েছিলেন পিস্তল থেকে ছিটকে আসা গুলি থেকে। যে জাহাজে রাখা হয়েছিলো এই মমির কফিন, সে জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়েছিল। যে বাড়িতে কফিন রাখা হয়েছিল, সে বাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিলো। কতটুকু সত্যি আর কতটুকু বানানো কে জানে। এসব গল্পের ডালপালা অত্যন্ত বেশি ছড়ানো হয়, সত্যি থেকে মিথ্যা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
মিস্টার মার্ক অবশ্য এসবের একবিন্দুও বিশ্বাস করেন নি, তিনি পুরনো জিনিসের ভক্ত হলেও ধরে নিয়েছেন, সস্তা পাবলিসিটির জন্য এটা করা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে দুর্ঘটনার গল্প।
তারপরেও তিনি কেন মিশরের রাজাকে স্বপ্নে দেখলেন সেটা স্পষ্ট নয়। তিনি তো কারো শান্তি নষ্ট করেন নি, কাজেই তাঁর “ধ্বংস অনিবার্য” হবার কোন কারণ নেই।
নাকি কারণ সত্যিসত্যি আছে? ছুরিটা কিনে তিনি কারো আত্মাকে খেপিয়ে দেন নি তো? ধুর, সব ভুয়া, ভয়ের কিচ্ছুটি নেই। ঘুমোও, মার্ক, বিশ্রাম কর, নিজেকেই বললেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ ধড়মড় করে তিনি বিছানায় উঠে বসেন, ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। তিনি কি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন? না তো, স্বপ্ন দেখলেও দুঃস্বপ্ন দেখেন নি। তাহলে ঘুম ভাঙল কীসে?
তাঁর চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায় ফোন বেজে ওঠার শব্দে।
এত রাতে কার ফোন? নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ। রাত দুপুরে কেউ অত্যন্ত আনন্দের কোন সংবাদ দেয়ার জন্য ফোন করেছে, এমন ঘটনা বিরল।
অশুভ আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে মিস্টার মার্কের। তিনি ভয়ে ভয়ে ফোন ধরেন।
ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত কণ্ঠ বলে, মিস্টার মার্ক?
হ্যাঁ। বলছি।
আমি ইন্সপেক্টর ক্লারেন্স মাইকেল।
এত রাতে? কী ব্যাপার?
ব্যাপার খারাপ। রিচি জোন্স আপনার ওখানে কাজ করতো? আপনার ম্যানেজার ছিল?
গলা শুকিয়ে গেছে মিস্টার মার্কের, তিনি ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ।
সে খুন হয়েছে। আপনার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে এক নির্জন রাস্তার ধারে ওর ছুরিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। এখনো আততায়ীকে ট্র্যাক করা যায় নি, চেষ্টা চলছে। আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?
ন্ ন্ ন্ না তো? গলা কেঁপে যাচ্ছে মিস্টার মার্কের।
তবুও আপনাকে একটু হাজিরা দিতে হবে। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ। এত রাতে আসার দরকার নেই, সময় করে কাল একটু পুলিশ স্টেশনে চলে আসুন।
অবশ্যই, অবশ্যই।
বেশ, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, মিস্টার মার্ক।
মিস্টার মার্ক ফোন কেটে দিলেন। রিচি খুন হয়েছে। মিস্টার ফোর্ড বলেছিলেন, এই ছুরি যার কাছে থাকবে, তার আশেপাশের লোকজনের ওপর ধেয়ে আসবে বিপদ। এটা কি প্রথম বিপদ? বিপদ মানেই কি মৃত্যু? জলজ্যান্ত একটা মানুষ খুন হয়ে গেল?
ফোন নামিয়ে রেখে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন মিস্টার মার্ক, তারপর তিনি নিজেই জানেন না, কেন তাঁর পুরনো জিনিসের সংগ্রহশালার দিকে হাঁটা দিলেন।
দরজা ভেজিয়ে ঢুকলেন তিনি, বাতি জ্বালালেন। বলা বাহুল্য, তিনি এসে দাঁড়ালেন ছুরিটার সামনে।
ভ্রূ কুঁচকে গেছে তাঁর। তিনি ছুরিটা দেখছেন না, দেখছেন ছুরিটার পায়ের কাছের দেরাজের কাঠটা।
একটা খয়েরী, গাঢ় খয়েরী রঙয়ের ছোট্ট গোলক দেখা যাচ্ছে। কী ওটা?
সহসা তাঁর রক্ত হিম হয়ে যায়, যখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি এক ফোঁটা রক্তের দিকে তাকিয়ে আছেন।
রক্ত এখানে কী করে এলো? কোনভাবেই আসার কথা নয়। মিস্টার মার্ক দ্বিধায় পড়ে গেলেন।
ছুরিটা যেন তাঁর দিকে নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অত্যন্ত সাধারণ একটা জড়বস্তু। আর সব জিনিসের মতোই। ঐ তো তাঁর চীনে চায়ের সেট, ওটার সাথে তো এটার কোন পার্থক্যই নেই। নগদ টাকা দিয়ে কেনা একটা পুরনো জিনিস, আর কিছু তো নয়।
দেয়ালে পড়েছে কীসের যেন ছায়া, থেকে থেকে শিউরে উঠতে লাগলেন মিস্টার মার্ক। সারারাত আতঙ্কে ঘুমোতে পারলেন না তিনি। বাড়ির সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে রাখলেন, অন্ধকারে ভয় করতে লাগলো তাঁর। মংকে ডেকে তুললেন, সে অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো, যখন দেখল যে তার মনিব এই রাতদুপুরে ভীষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। যিনি সারাজীবনে কোন কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেন নি যে কোন জিনিস অপয়া, কোন জিনিসের সাথে লেপটে থাকে দুর্ভাগ্য, তিনি একটা বাচ্চা ছেলের মতো ভয়ে জুজু হয়ে গেছেন।
*****
সেই রক্তের ফোঁটার কথা কাউকে বলেন নি তিনি। নিজের ঘাড়ে বিনা দোষে ঝামেলা টানা কেন? তিনি কাউকে কিছু বলেন নি, বলেন নি বাবুর্চি মং কিংবা ড্রাইভার জিমকে। অবশ্য মিস্টার ফোর্ড একবার ফোন করে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন, “বলেছিলাম না?”
মিস্টার মার্ক কোন জবাব দিতে পারেন নি। কী জবাব দেবেন? এই ছুরি নিশ্চয়ই পঞ্চাশ মাইল দূরে উড়ে গিয়ে রিচিকে খুন করে আসেনি। কিন্তু তবুও একটা খটকা থেকেই যায়।
মিস্টার মার্ক নিয়মমতো পুলিশের কাছে হাজিরা দিয়েছেন, তদন্তে সবরকম সাহায্য করেছেন। খোঁজাখুঁজি করে কিছুই পাওয়া যায় নি। একটু আভাষ পর্যন্ত পায় নি পুলিশ, নির্বিরোধী একজন মানুষ রিচিকে কে খুন করতে পারে। মিস্টার মার্ককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা, এমনকি কোন শত্রুতা কিংবা টাকাপয়সা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছে কীনা সেটা জিজ্ঞেস করতেও ছাড়ে নি।
মিস্টার মার্ক রিচির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখলেন, কালো কোট-টাই পরে মিস্টার ফোর্ডও সেখানে উপস্থিত। দুঃখী দুঃখী চেহারা করে তিনি রিচির কবরে ফুল দিলেন, যেন খানিকটা দায়ভার মিস্টার ফোর্ডের নিজেরও আছে।
যাবার সময় তিনি বলে গেছেন, এখনো সময় আছে মিস্টার মার্ক, ছুরিটা দূর করুন।
দূর করেন নি তিনি। একটা সাধারণ ছুরি, কথা নেই বার্তা নেই সেটা ফেলে দিতে হবে? নিশ্চয়ই তদন্তে কোন গাফিলতি হয়েছে, ঠিকমতো খুঁজলেই বেরিয়ে পড়বে আসল খুনি কে, মনে মনে ভাবলেন মিস্টার মার্ক।
*****
মিস্টার মার্ককে যথারীতি খাবার সার্ভ করলো মং, তারপর সরে গেল। মংয়ের কাজ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, গোছানো, প্রশংসার দাবীদার।
খেতে খেতে তিন ভাবছেন, মং নিজে খায় কখন? কখনো তিনি ওকে খেতে দেখেন নি। সবসময় লোকটার রান্না খাচ্ছেন, অথচ একবারও জিজ্ঞেস করে দেখা হয় নি, সে কখন খায়, কী খায়, কোন অসুবিধা হচ্ছে কীনা। মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে চীনদেশীয় লোকটি। সে কথা বলে খুবই কম, কিছু জিজ্ঞেস করলে পারলে মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
ডিমের অমলেটটা খুব তারিয়ে তারিয়ে খেলেন তিনি। মং এটার সাথে আরও বিশেষ কিছু দিয়েছে বলে স্বাদ বেড়ে গেছে বহুগুণ। চীনারা হল জাত বাবুর্চি। তারা যদি একটা তেলাপোকা কিংবা কাঁকড়াবিছে ধরে এনেও সেদ্ধ করে দেয়, তাহলেও মনে হবে যে এটা সত্যিই খুব সুস্বাদু খাবার।
মিস্টার মার্ক ঠিক করলেন, এখন থেকে দৈনিক কিছু সময় মংয়ের কাছ থেকে ওর বিদ্যাটা আয়ত্ত করবেন। পুরুষ মানুষ রান্না শিখলে নাকি মেয়েদের থেকেও ভাল রান্না করতে পারে। বয়স হয়েছে, অথচ কিছুই শেখা হল না, আফসোস।
মাঝে মাঝেই মনে পড়ছে তাঁর রিচির কথা। আহা, ছেলেটি বড় ভাল ছিল। শান্তশিষ্ট, নিরীহ। কে তাকে খুন করলো? সে এতদিন তাঁর কাছে কাজ করেছে, বিশ্বস্ত ম্যানেজার ছিল, আর তাকে ভুলে গিয়ে তিনি মজা করে অমলেট খাচ্ছেন? মিস্টার মার্কের একটু মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি মনেপ্রাণে কামনা করেন, রিচির আত্মা যেন শান্তি পায়।
খাবার শেষ হলে মং এসে সব বাসনকোসন সরিয়ে নিয়ে যায়। ডাকতে হয় না, ঠিক সময়ে নিজেই আসে। আজ আসছে না। কোথায় গেল?
মিস্টার মার্ক ডাকলেন, মং। মং।
অনেক বড় করিডোর বলে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো, অনেকটা প্রলম্বিত হয়ে। ম—ং, ম—ং।
কোন উত্তর নেই।
তিনি রান্নাঘরের দিকে চললেন। বাবুর্চি মং আর কোথায় থাকবে? কখনো রান্নাঘরে যান না মিস্টার মার্ক, সেটা মংয়ের নিজস্ব রাজ্য। তাঁর বিচরণ লন, স্টাডি আর নিজের কালেকশন রুম। কিন্তু আজ তিনি রান্নাঘরে এসে হাজির হলেন।
রান্নাঘরের দরজা ভেজানো, তিনি ঠেলা দিয়ে ঢুকে পড়লেন। সুপরিসর রান্নাঘর। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।
মিস্টার মার্ক প্রাণপণ চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।
রান্নাঘরের মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে মং, তার ছোট ছোট চোখ দুটো খোলা। ভয়ে বিস্ফোরিত।
তবে মিস্টার মার্ক তাকিয়ে আছেন মংয়ের বুকের দিকে, তার পরনের সাদা কাপড় লাল হয়ে আছে, গলগল করে একটা তরল বেরিয়ে আসছে। টাটকা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে, বুঝতে পারলেন তিনি।
পুলিশে খবর দেয়ার আগে তিনি ইচ্ছে করেই নিজের কালেকশন রুমে এসে দাঁড়ালেন, ছুরিটার সামনে।
যা ভেবেছিলেন তাই। ছুরিটার পাশে এখন পড়ে আছে দু ফোঁটা রক্ত।
*****
মিস্টার মার্ককে এবার বেশ ঝামেলা পোহাতে হল। মং যখন খুন হয়, তখন বাসায় মানুষ বলতে তিনি একাই ছিলেন। কাজেই সন্দেহের তীর তাঁর দিকেও আসে। বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদে মোটেও সন্তুষ্ট না হতে পেরে অবশেষে ইন্সপেক্টর ক্লারেন্স মাইকেল অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিদায় নিলেন। সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড়ের চেষ্টা হল, জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বাদ গেল না ড্রাইভার জিমও। এমনও তো হতে পারে ওদের মধ্যে কোন গোপন শত্রুতা ছিল। কিন্তু মিস্টার মার্ক নিজে সাক্ষ্য দিলেন, এদের মধ্যে কোন ঝামেলা ছিল না।
অগত্যা দ্বিতীয় কেসটাও ঝুলে রইলো। মংয়ের লাশ পোস্টমর্টেম শেষে পাঠিয়ে দেয়া হল সানফ্রানসিসকোতে, সেখানে চায়না টাউনে তার কিছু আত্মীয় আছে, তারাই সৎকার করবে, নিজেদের রীতি অনুযায়ী।
মিস্টার মার্কের বাড়িতে চিরুনি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন ইন্সপেক্টর ক্লারেন্স, পুরো বাড়িটা খুঁজেও কোন সন্দেহজনক কিছু পায় নি পুলিশ। তাহলে কে এসে মংকে খুন করে গেল, সেটা খোলাসা হবে কী করে? মিস্টার মার্ক ভয়ে পুলিশকে বলেন নি ছুরির ব্যাপারটা অথবা রক্তের ফোঁটার ব্যাপারটা। পুলিশেরও দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, সৌভাগ্যক্রমে অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে।
মিস্টার ফোর্ড আবার ফোন করেছিলেন। আবারো ভারী, শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠস্বরে কথা বলেছেন, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সতর্ক করেছেন তাঁকে, “এখনো সময় আছে। আপনার পালা আসতে কতক্ষণ?”
*****
মিস্টার মার্ক এখন এই বিশাল প্রাসাদে একা। ইচ্ছে করেই একা রয়েছেন। কাউকে সাথে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না, যদি সেই মানুষটির কোন ক্ষতি হয়? যদি আরও কেউ মারা যায়? তাই ড্রাইভার জিম এবং প্রতিবেশী স্যাম যখন তাঁর সাথে থাকতে চাইলো, তখন বেশ রুঢ় ব্যবহার করেই তাদেরকে দূর করে দিলেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন না যে দুটো দুর্ঘটনার সাথে, দুটো খুনের সাথে এই ছুরিটার কোন সম্পর্ক আছে, তবুও তিনি ঝুঁকি নিতে চান না। যা বিপদ আসার তাঁর একার ওপর আসুক।
অন্য কোথাও গিয়ে তিনি থাকতে পারতেন, কিন্তু কেন যান নি, কেন একা এখানে থেকে গেলেন, সেটা রহস্যজনক ব্যাপার। কে জানে, তিনি হয়তো ভয়ের মুখোমুখি হতে চেষ্টা করছেন। অনেক সময় দেখা যায়, যে জিনিস নিয়ে খুব ভয় হয়, সেটার মুখোমুখি দাঁড়ালে ভয়টা কেটে যায়, দেখা যায়, আতঙ্কের কিছুই নেই।
আরও একটা আজব ব্যাপার ঘটেছে। তিনি পোষা কুকুর রকির গলার চেন খুলে দিয়েছিলেন আজ সকালে। সে খানিকক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর দৌড়ে পালিয়ে গেল, যেটা কোন পোষা কুকুর কখনো করে না। রাত হয়েছে, এখনো ফিরে আসে নি রকি। কোথায় গেল মিস্টার মার্ক জানেন না। কিছু দেখে সে কি খুব ভয় পেয়েছে? মিস্টার মার্কের কেন যেন মনে হচ্ছে, রকি আর ফিরে আসবে না।
এখন গভীর রাত। মিস্টার মার্ক ঘুমোনোর চেষ্টা করছেন। ঘুম আসছে না। তিনি কান পেতে শুনছেন সমুদ্রের গর্জন, বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। কয়েকশো ফুট নিচে।
মিস্টার মার্ক ভেড়া গোণার চেষ্টা করলেন, একশো থেকে এক পর্যন্ত উল্টো দিকে গুণলেন, কাজ হল না।
খুব বেশীক্ষণ পার হবার আগেই তাঁকে কেউ একজন যেন চুম্বক দিয়ে টেনে নিয়ে বিছানা থেকে ওঠাল। নিমেষেই তিনি আবিষ্কার করলেন, তিনি তাঁর কাঁচের দেরাজের সামনে। ছুরিটার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। বুঝতেই পারছেন তিনি, তাঁর নিজের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই, কেউ একজন যেন সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো তাঁকে আকর্ষণ করে এই ঘরে টেনে এনেছে। এবার কার পালা?
ছুরিটাকে এখন আর জড়পদার্থ বলে মনে হচ্ছে না মিস্টার মার্কের, যেন মনে হচ্ছে এটা জ্যান্ত। যেন দুটো গনগনে চোখ মেলে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। যেন বলছে, আমি আছি, আমি আছি। আমাকে ভুলে যেতে দেবো না। স্পষ্ট শুনতে পেলেন মিস্টার মার্ক, কেউ একজন তাঁর কানে কানে বলছে, দাঁড়িয়ে আছ কেন? ছুরিটা হাতে তুলে নাও।
তাই করলেন মিস্টার মার্ক। ভয়ে ভয়ে দেখলেন, এখনো সেই দু’ফোঁটা রক্ত। দেরাজের ওপর শুকিয়ে আছে দুটো খয়েরী গোলক।
অজানা কণ্ঠ বলল, এবার দেখো, আমি কী করতে পারি।
মিস্টার মার্কের মাথার ভেতরে দ্বিতীয় একজন বলে উঠলো, না না, আমি তোমাকে আর কোন সর্বনাশ করতে দেবো না।
প্রথম কণ্ঠ পুনরায় বলল, দেখো, আমি কী করতে পারি। দেখো, আমি কী করতে পারি, দেখো, আমি কী করতে পারি … …
পাগলের মতো বোধ হতে লাগলো মিস্টার মার্কের, তিনি ছুরিটা রেখে দিয়ে টলতে টলতে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সোজা চললেন পাহাড়ের কোণে, বেরিয়ে থাকা খাঁজটার দিকে, ঠিক যেটার নিচে এসে আঘাত হানছে সাগরের উত্তাল ঢেউ।
একটি কণ্ঠ বলছে, অসম্ভব, তোমাকে আমি এটা করতে দেবো না।
আরেকটি কণ্ঠ ভাঙা রেকর্ডের মত বলে চলছে, দেখো, আমি কী করতে পারি। দেখো, … …
মিস্টার মার্ক অন্ধকারে চিৎকার করে উঠলেন, থামো। থামো, প্লীজ। থামো। আমি আর পারছি না।
আঁধার রাত ফুঁড়ে দিলো মিস্টার মার্কের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, যেন ভীষণ যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছেন। খানিক দূরে ড্রাইভার জিমের বাসা, কিন্তু এতদূরে তাঁর চিৎকার পৌঁছনোর কথা নয়। পৌঁছলেও জিমের গভীর ঘুম ভাঙানোর জন্য তা যথেষ্ট জোরালো ছিল না।
পুনশ্চঃ
মিস্টার মার্ককে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিশ প্রায় শতভাগ নিশ্চিত, তিনি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছেন, মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তারপর তাঁর লাশ সাগর টেনে নিয়ে গেছে। রাতের কোন এক সময়ে ঘটনাটি ঘটে থাকবে। কেসটা ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে। নিকটতম, দূরতম, কোন আত্মীয়ই তাঁর নেই, কেউ এসে কিছু দাবীও করেনি। তাঁর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। এখন এই বাড়িটাকে একটা মিউজিয়াম করে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। লোকজন এসে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে পারবে অনেক ঐতিহাসিক এবং মূল্যবান জিনিসপত্র, যার সবই ছিল মিস্টার মার্কের সাধের সংগ্রহ।
মিস্টার ফোর্ড অবশ্য মিস্টার মার্কের মৃত্যুর জন্য কে (অথবা কী) দায়ী, সেটা নিয়ে নিজস্ব একটা ধারণার ওপর অটল আছেন। তবে কাউকে বলেন নি। মানুষ বড় অবিশ্বাসী; কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং হাসাহাসি করবে। একবিংশ শতাব্দীতে নিজের ক্ষমতার ওপর মানুষ বড় বেশি ভরসা করা শুরু করেছে।
শীঘ্রই মিউজিয়ামের কাজ শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য জিনিসের সাথে ছুরিটাও জায়গা অদলবদল করে সাজানো হচ্ছে। দুজন কর্মী জিনিসগুলো ভাগাভাগি করে এখান থেকে সেখানে নিচ্ছে।
হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করলো, রবার্ট, দেখে যাও।
রবার্ট নামের লোকটি বলল, কী ব্যাপার, ডানকান?
এই ছুরিটার পাশে এটা কী?
দেখি তো।
দুজন লোক বেশ কিছুক্ষণ পর্তুগিজ নাবিকের সেই ছুরিটার পাশে জমে থাকা বস্তুটির দিকে তাকিয়ে রইলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
তাদের বুঝতে বাকি নেই, খয়েরী জিনিসটি হচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া তিন ফোঁটা রক্ত।
……………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………………….