ডক্টর, আপনি এত দূরে বসেছেন কেন? কাছে এসে বসুন। দূর থেকে কথা শোনা যায়, কিন্তু কথার “ভাব”- টা অনুভব করা যায় না। আমি যে ঘটনাগুলো বলবো, সেগুলো বুঝতে হলে, সেগুলোর আসল শিহরণ পেতে হলে আপনাকে কাছে এসে বসতে হবে।
আমার আসল “ভাব” পাওয়ার দরকার নেই। আমরা কি কথা শুরু করতে পারি?
অবশ্যই, ডক্টর। তবে আপনি এই ছোট্ট কুঠুরিতে ঢুকে আমার মুখোমুখি বসলে আরও আন্তরিক আলাপ করা যেত।
কোন দরকার নেই। আন্তরিক আলাপের কোন প্রয়োজন দেখি না।
ডক্টর সিম্পসন মনে মনে স্মরণ করলেন ডক্টর এনরিকের কথা। তিনি বলেছেন, কোন অবস্থাতেই এই বব হ্যাডিংসের কাছে যাওয়া যাবে না। সে কিছু দিতে চাইলে নেয়া যাবে না। তার হাতের নাগালে যাওয়া যাবে না কিংবা তাকে কাছে আসতে দেয়া যাবে না। সে উল্টোপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করলেই ডক্টর সিম্পসন হাতের ছোট্ট যন্ত্রটির সুইচ টিপে দেবেন, সাথে সাথে অ্যালার্ম বাজা শুরু হবে, পাঁচজনের একটি দল এসে সাথে সাথে ববকে কব্জা করে ফেলবে।
এত সতর্কতার কারণ, বব একজন মানসিক রোগী। মানসিক রোগীদের অনেক আজব কাজ করতে দেখা যায়। যেমন, জিনিসপত্র ছেঁড়া কিংবা ভাঙা, মানুষকে আঘাত করা ইত্যাদি। কিন্তু কিছু কিছু লোক হয়ে যায় বিকৃত মানসিকতার, তাদেরকে বলা হয় “সাইকোপ্যাথিক কিলার।” তারা মানুষ খুন করে মজা পায়। বব হ্যাডিংস একজন সাইকোপ্যাথিক কিলার। উন্নত দেশগুলোতে এমন অনেক কিলার আছে, যারা কোন এক কারণে, দুর্ঘটনা, আঘাত কিংবা স্নায়বিক চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে; ক্ষেত্রবিশেষে কোন কারণ ছাড়াই মানুষ খুন করা শুরু করে। তাদের মধ্যে যারা বেশ বুদ্ধিমান, তাদের কাজকর্মে থাকে আশ্চর্য গোছানো ভাব, যার কারণে এসব খুনের কারণ অনুসন্ধান করতে পুলিশের গলদঘর্ম হতে হয়।
বব হ্যাডিংস দু’টি খুন করেছে। পুলিশ ঘটনাগুলোর অনেক কিনারা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। তৃতীয় খুনের আগেই সে ধরা পড়ে যায়। তারপর তার সরাসরি মৃত্যুদণ্ড হবার কথা, কিন্তু সে আছে মানসিক হাসপাতালে, মানসিক ভারসাম্যহীন বলে এখন সে একটি সংকীর্ণ সেলে দিনাতিপাত করছে। এক নামে তাকে সবাই চেনে, আর ভুলে কেউ তার নাম উচ্চারণ করে ফেললে ভয়ে নিজের বুকে ফুঁ দেয়। বেশিরভাগ ডক্টরেরই আশঙ্কা, কিছুতেই সে আর সুস্থ হবে না। তারপরেও সে একটা ইন্টারেস্টিং কেস হিসেবে রয়ে গেছে এখানে। হয়তো তার মৃত্যু হবে এখানেই, বন্দী দশাতেই।
ডক্টর সিম্পসন মাঝেমধ্যেই তাঁর বন্ধু সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করেন এসব রোগীদের সাথে একান্ত কথাবার্তার, একান্ত সাক্ষাৎকারের। এবার তাঁর বন্ধু ডক্টর এনরিক এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ভয়ংকর খুনী বব হ্যাডিংসের সাথে কথা বলার জন্য। এজন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
ডক্টর সিম্পসন লক্ষ করেছেন, সাধারণ অপরাধীদের মধ্যে অপরাধের কথা বর্ণনা করার সময় মুখে একটা অনুতাপের ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু সাইকোপ্যাথিক কিলারদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা অত্যন্ত আনন্দের সাথে তাদের কৃতকর্মের বর্ণনা দিয়ে থাকে। কখনো তারা এসব ব্যাপার গোপন করতে চায় না, লুকোছাপা করতে চায় না। ঘটনার বর্ণনার সময় তাদের চোখ গুলো কেন যেন চকচক করতে থাকে।
এখন ডক্টর সিম্পসন বসেছেন বব হ্যাডিংসের সেলের বাইরে। লোহার শিকের আড়াল থেকে কথা বলছে বব, কথাবার্তায় অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং খুশির ছাপ। কারো বোঝার উপায় নেই যে সে কিছুদিন আগেই দু’দুটো বীভৎস খুন করেছে। ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করে।
ডক্টর সিম্পসন একা বসে আছেন, সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। কোন দরকার ছিল না, প্রতিটি খুনের আলামত, কেস রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ সবকিছু নথিবদ্ধ করে রাখা আছে নির্দিষ্ট জায়গাতেই, ডক্টর সিম্পসন একটা বোতাম টিপেই জেনে নিতে পারেন আদ্যোপান্ত। কিন্তু তাঁর এটাই অভ্যাস, তিনি পেশেন্ট কিংবা অপরাধীর নিজের মুখ থেকেই সবকিছু শুনতে পছন্দ করেন। নিজের মুখের কথার মধ্যে পেশেন্টের নিজস্ব অনুভূতি মিশে থাকে, কাগজের রিপোর্টে কিংবা অনলাইন নথিতে সেটা থাকবে কেন?
দুজন নিরাপত্তা প্রহরীকে ডক্টর সিম্পসনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন ডক্টর এনরিক, কারণ বব হয়তো যেকোনো উপায়ে কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। সে অত্যন্ত ধুরন্ধর ব্যক্তি, তার কাছ থেকে নিশ্চিন্ত হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু ডক্টর সিম্পসন সেটা মানা করে দিয়েছেন। কোন অপরাধীর সাথে কথা বলার সময় কথা বলতে হয় একা। লোকজন আশেপাশে থাকলে সে দ্বিধা করবে, সহজ হতে পারবে না। ডক্টর সিম্পসন সেটা চান না। আহত বাঘের অনুসরণ করার সময় যত লোকজন নিয়ে যাওয়া হয়, ততই ঝামেলা বাড়ে।
শুরু কর, বব। নিজের রেকর্ডার চালু করলেন তিনি। সব আলাপচারিতা রেকর্ড হয়ে যাবে, তারপর তিনি নিজে একা একা তাঁর ঘরে বসে বসে শুনবেন। এক সীটিংয়ে সব কথা শুনতে হবে, কিছুই বাদ দিয়ে নিজের বাড়িতে ফেরত যাবেন না তিনি।
বব হ্যাডিংসের ঠোঁটের কোণায় একটা মৃদু হাসি খেলে গেল। সে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করলো তার কাহিনী।
আমি আর আমার স্ত্রী থাকতাম ভিক্স এভিনিউয়ের একটা ছোট্ট এপার্টমেন্টে। পয়সা জমিয়ে আমরা দুজন কিনেছিলাম ফ্ল্যাটটা, বিয়ের পরপরই উঠে এসেছিলাম এখানে।
আমি চাকরি করতাম, আর আমার স্ত্রী মনিকা বাচ্চাদের একটা স্কুলে পড়াত। দুজনের সংসার, কোন ঝামেলা নেই, ছিমছাম পরিবার। সকালে দুজন একসাথে ব্রেকফাস্ট করি, তারপর দুজন কাজে বেরিয়ে যাই, দু’দিকে। সারাদিন কাজকর্ম করি। আমার স্ত্রী ফেরে বিকেলে, আমি ফিরি রাতে। দুজন গল্পসল্প করি, টিভি দেখি, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। ছুটির দিনে ঘুরতে যাই ধারেকাছে, পার্টিতে। বড়সড় ছুটিতে যাই পিকনিকে, কাম্পিংয়ে।
একজন সুখী মানুষ হতে গেলে যা যা দরকার, তার সবই ছিল আমার। সবকিছু ভালোই চলছিল।
কিন্তু সমস্যা হল, আমার জীবনে কোন বৈচিত্র্য ছিল না, কেমন যেন একভাবে চলছিল সব, একটা অসীম লুপের মধ্যে ঘোরপাক খাবার মতো। এভাবে ক’দিন কাটানো সম্ভব? বাসা আর অফিস, অফিস আর বাসা। মাঝেমধ্যে পার্টি, নাচগান, সিনেমা, ড্রিংক করা, ব্যস। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার বহু পুরুষ আগে অতিবৃদ্ধ-প্রপিতামহ ছিলেন স্প্যানিশ জলদস্যু, আমি তাঁর উত্তরসূরি বলেই হয়তো এভাবে পেঁয়াজ-মরিচবিহীন, মশলাছাড়া জীবন কাটানোটা অসম্ভব বলে মনে করলাম। জীবনে একটা “স্পাইস”, একটা টুইস্ট আনার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম।
কী করে উত্তেজনা আনা যায়? আমি আমার স্ত্রীকে খুলে বললাম সমস্যাটা। সে সমাধান দিলো সাধারণ উপায়ে, চল, একটা লম্বা ছুটি নিয়ে ঘুরে আসি। না হয় দেশের বাইরে একটা ট্রিপ নিই।
আমার মনঃপূত হল না কথাটা। ফিরে এসে তো সেই একই কাজ করতে হবে।
আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। কিচ্ছু ভাল লাগে না। অফিসের কাজ করে যাচ্ছি ঠিকই, স্ত্রীর সাথে, বন্ধুদের সাথে কথাবার্তা, গল্পগুজব চালিয়ে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আমার মন প্রস্তুত হচ্ছিল ভয়ংকর কিছু একটা করার জন্য। বারোয়ারী, আটপৌরে জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে পড়েছিলো।
এক রাতে আমি তাই ঠিক করলাম, আমি খুন করবো।
কাকে খুন করবো? কাছের মানুষ দিয়েই শুরু করি না কেন? আমার স্ত্রী মনিকা তো আছেই। সে আমাকে খুব বিশ্বাস করে, কাজেই সহজ শিকার হতে পারে সে-ই।
আমি প্ল্যান কষে ফেললাম। স্বাভাবিকভাবে মারলে হবে না, বীভৎস উপায়ে, তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে মারতে হবে। আমি ছিলাম খুব সাধারণ একটা মানুষ, ছিলাম আদর্শ স্বামী, কোন ভয়ংকর কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল না, কিন্তু কোন দুঃসময়ে আমার মনে শয়তান এসে বাসা বেঁধেছিল, ঈশ্বরই জানেন।
রাত তখন একটা। আমি বিছানায় শুয়ে নেই, বাথটাবে পানি ভরছি। মনিকা ঘুমোচ্ছে।
বাথটাব পুরো ভর্তি করলাম আমি, কানায় কানায় পূর্ণ করলাম। পানি উপচে পড়ার উপক্রম হওয়ার সময় বন্ধ করলাম পানির ট্যাপ।
নিজের শোবার ঘরে চলে এলাম। মনিকা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরল। আমি জানি ওর ঘুম খুব গভীর, দু’তিনবার না ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।
আমি একগোছা দড়ি বের করলাম, আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে, কোন শব্দ না করে ওর হাত দুটো বাঁধলাম, পা দুটো বাঁধলাম। কোন দরকার ছিল না, শারীরিক শক্তির দিক দিয়ে সে আমার সাথে পারবে না, কিন্তু আমি চাইছিলাম, কোন ঝামেলা যাতে না ঘটে, হাত-পা ছুঁড়ে সে যেন আমাকে আহত করতে না পারে।
আমি ওর মুখে গুঁজে দিলাম কাপড়। এখন ওর নিঃশ্বাস নেয়ার একটা পথই আছে, ওর নাক।
কাজটা করতে গিয়ে আমি টের পেলাম, আমার মধ্যে একরকম উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে, আমার বেশ আনন্দ লাগছে। কে জানে, হয়তো অন্য অপরাধীদেরও আনন্দ লাগে। আপনার কেমন লাগছে, ডক্টর?
ডক্টর সিম্পসন জবাব দিলেন না, আধো-অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইলেন।
বাথরুমে ওকে নিয়ে গেলাম, পাঁজাকোলা করে। তারপর ওকে শুইয়ে দিলাম উপুড় করে, এমনভাবে যেন ওর শরীরটা বাথটাবের বাইরে থাকে, কিন্তু মাথাটা থাকে পানির ভেতরে। ঠেসে ধরলাম ওর মাথা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জেগে উঠলো মনিকা, নিঃশ্বাসে প্রথম বাধাটি যখন এলো, তখনই। ওর মাথা এখন চেপে ধরা আছে বরফশীতল পানিতে।
বাথটাবের পানিতে একটা আলোড়ন উঠলো, ছাড়া পাওয়ার জন্য, মাথা তোলার জন্য ছটফট করছে সে। হাত-পা বাঁধা, কিন্তু তাতেই সে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো।
আমি হাতের চাপ আলগা করলাম না। ঘড়ি ধরে বসে আছি, পুরো এক মিনিট হওয়ার জন্য। সাধারণ মানুষ দু’মিনিটের মতো পানির নিচে দম রাখতে পারে, মেয়েদের জন্য সময়টা একটু কম। তাছাড়া প্রথমবারেই তো আর ওকে মেরে ফেলবো না, ওকে অনেকক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ধীরে ধীরে মারতে হবে, নিস্তেজ করে ফেলতে হবে। সার্কাসের পেশাদার লোকেরা পারে প্রায় তিন মিনিট দম রাখতে, কিন্তু মনিকার ক্ষেত্রে এটা দরকার হবে না।
আমি নির্বিকারচিত্তে এক মিনিট পুরো হবার জন্য অপেক্ষা করলাম, তারপর ওর মাথাটা তুলতে দিলাম পানির ওপরে।
পানি থেকে মুখ তুলেই সে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো, যেটা খুব ভুল কাজ। ধীরে ধীরে ফুসফুসে বাতাস ঢুকতে দিতে হয়, নইলে শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। আমি দেখলাম, যন্ত্রণায় মনিকার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে আছে, সে ছাড়া পাওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে বৃথাই চেষ্টা করছে। মুখে কাপড় গোঁজা বলে চিৎকার করতে পারছে না, একটা ভোঁতা আওয়াজ বেরুচ্ছে শুধু।
মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতেও পারছে না, আপ্রাণ বাতাস টেনে নেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নাকের ফুটোগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।
আমি ওর যন্ত্রণা দেখে পুলকিত হলাম। মাত্র দশ সেকেন্ড সময় দিলাম ওকে, তারপরই আবার চেপে ধরলাম ওর মাথা, পানির ভেতরে।
পুরো এক মিনিট অপেক্ষা করলাম আবার, দ্বিতীয় দফাতেও। যখন ওর মাথাটা তুলে ধরলাম, তখন সে নিস্তেজ হয়ে গেছে। তারপরও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। অবাক হবার ব্যাপার হল, তৃতীয়বারে সে আমাকে কোন বাধা দিলো না, কোন হুটোপুটি করলো না। বোধহয় বুঝতে পেরেছে, এভাবে শক্তি ক্ষয় করে সে নিজের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমিয়ে ফেলছে, শক্তি ফুরিয়ে গেলে দম রাখা আরও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমি আবার এক মিনিট ওর মাথাটা পানিতে ডুবিয়ে রাখলাম, তারপর চুলের মুঠি ধরে তুলে আনলাম। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নিশ্চয়ই ওর নাক দিয়ে পানি ঢুকে গেছে, কারণ এক মিনিট দম রাখতে না পেরে অনেকে পানির নিচে থেকেই দম নেয়ার চেষ্টা করে, সেই সুযোগে ফুসফুসে ঢুকে পড়ে পানি, জ্বালিয়ে দেয় বুকের ভেতরটা। আমি ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম, অসহ্য যন্ত্রণায় ওর ফুসফুস ফেটে যেতে চাইছে, সে এখন মরতে পারলেই বাঁচে। আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে সে মারা যাবে।
আমার তখন নেশার মতো হয়ে গেছে, আমি তখন হাসিমুখে ওকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি। ডক্টর, বিশ্বাস করবেন না, ওর চোখে আমি একটা আশা দেখেছিলাম, ক্ষীণ আশা যে ওকে আমি ছেড়ে দেবো, সে বেঁচে যাবে। মানুষ শেষ মুহূর্তেও আশা রাখে। সে আশা দেখলেই বোঝা যায়, বোঝার জন্য কথা বলার দরকার হয় না।
মানুষকে যন্ত্রণা দেয়ার যেমন আনন্দ আছে, তেমন আনন্দ আছে আশাভঙ্গ করার। আমি তাই মনিকার চোখের আকুতি উপেক্ষা করে ওর মাথা আবার ঠেসে ধরলাম পানিতে। এবার অবশ্য সে একটু বেশি সময় পেয়েছিলো, কারণ আমি ওর মৃত্যুতে একটা ভিন্ন মাত্রা আনার জন্য শীতল পানিকে গরম পানিতে বদলে দিতে খানিকক্ষণ সময় নিয়েছিলাম। বাথটাব পুরোপুরি খালি করেছিলাম, তারপর ভরে নিয়েছিলাম আগুনগরম পানি।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অনেক ঠাণ্ডা কোন জায়গায় হাত রাখার পর যদি সাধারণ তাপমাত্রার কোন জিনিসে কেউ হাত রাখে, তাহলে তার কাছে সেটা মনে হয় খুব গরম। আমি সাধারণ তাপমাত্রার পানি দিই নি, দিয়েছি স্ফুটনাংকের কাছাকাছি পানি। হা হা, গরম পানির সুবিধেটা থাকাতে ভালোই হয়েছে, এখন মনিকার মুখের চামড়া পুড়ে ফোসকা পড়ে যাবে, আবার সে নিঃশ্বাসও নিতে পারবে না, শ্বাস নিতে চাইলে ওর নাকের ভেতরটা থেকে শুরু করে গলা অবধি পুড়ে যাবে।
বললে বিশ্বাস করবেন না, মনিকার মুখের নরম চামড়া কেমন করে গলে গলে যাচ্ছে, সেটা দেখে আমার ভীষণ আনন্দ হল। দুয়েকবার যে নিজের হাতটাও পানিতে ডুবাতে ইচ্ছে হল না তা নয়। কিন্তু আমি পাগল হলেও বোকা নই, হা হা হা। কাজেই মনিকার মুখটা যখন এক মিনিট পরে পানি থেকে তুলে ধরলাম, তখন ওর মুখটা আর মানুষের মুখ বলে চেনা যায় না, পুড়ে গেছে, মাংস গলে গলে খসে পড়েছে, ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে সাদা হাড়। ওকে ধরে রাখার জন্য তখন আমি মস্ত একটা সাঁড়াশি ব্যবহার করছিলাম ডক্টর। ভাল বুদ্ধি, কী বলেন?
তখনই হয়তো মনিকা মরে গিয়েছিল, কারণ সে একদম নড়াচড়া করছিলো না। তারপরও কাজ যখন শুরু করেছি, তখন শেষ তো করতেই হয়। এসব কাজে কোন খুঁত রাখতে নেই। আমার প্রথম কাজ হলেও এটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। কাজেই আমি আরেকবার ওকে পানিতে ডুবিয়ে দিলাম, এবার রাখলাম পুরো পাঁচ মিনিট। আমার ধৈর্যের অভাব নেই, পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে আমার সময় লেগেছে ঝাড়া আধঘণ্টা। একটা বুলেট কিংবা ছুরি ব্যবহার করলে হয়তো এক সেকেন্ডেই কাজটা সমাধা হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু তাতে কি আর এই অদ্ভুত আনন্দটা পেতাম? আপনিই বিবেচনা করে বলুন, ডক্টর।
ডক্টর সিম্পসন ঝিম ধরে বসে আছেন। তাঁর দুচোখ বন্ধ। তিনি ঐ অবস্থাতেই বললেন, বলে যাও।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর পর অনেকেরই মাথা গরম হয়ে যায়, অপরাধবোধে পাগল হয়ে যাবার দশা হয়। অস্থির হয়ে হয়তো নিজেই পুলিশে ফোন করে, কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি আমার বউকে মেরে ফেলেছি। তারপর হেঁচকি তুলতে তুলতে জেলে চলে যায়। এদেশে হরহামেশাই তো এমন হচ্ছে।
আমার ধরা দেয়ার কোন ইচ্ছে নেই। সত্যি বলতে, আমার তখন এমন অবস্থা হয়েছে, বুড়ো এক বাঘ যেমন প্রথম নরমাংসের স্বাদ পাওয়ার পর একটা তৃপ্তি অনুভব করে, আমিও প্রথম খুনটা করে তেমন কিংবা তার চেয়েও বেশি আনন্দ পেলাম। আমি অনুভব করলাম, আমার মনের হতাশাটা কেটে গেছে, বেশ ফুরফুরে লাগছে। একটা লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি যেন। সেই ফ্ল্যাটে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি খুশিমনে প্রাণখুলে অনেকক্ষণ হাসলাম। নিজেকে কেউকেটা গোছের একজন মনে হল; মনে হল আরও কয়েকটা খুন করার মতো সাহস পেয়েছি। মানুষ মারার মতো আনন্দময় কাজ পৃথিবীতে নেই, সেদিনই আমি উপলব্ধি করলাম। ভাগ্যিস মনিকাকে মেরে ফেলার বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিলো।
মনিকা তখন মরে ভূত হয়ে গেছে। আমার প্ল্যানে ছিল কী করে ওকে খুন করতে হবে, এবং কীভাবে ওর লাশটা গুম করে ফেলতে হবে। কাজেই আমি ওর লাশটা বস্তায় ভরে গাড়িতে করে সেই রাতেই সোজা চলে গেলাম বেশ দূরে। এখনই হাপিশ হয়ে যেতে হবে আমাকে, কাজেই গাড়িতে নিয়ে নিয়েছিলাম দরকারি দুয়েকটা জিনিস, পকেটে নিয়ে নিয়েছিলাম টাকাপয়সা। বদ পুলিশগুলো কোন মেয়েমানুষ মারা গেলেই প্রথমে সন্দেহ করে মেয়েটির স্বামীকে, কাজেই ওরা আমাকে ধরতে পারলে কপালে খারাবি আছে, পেটে রুলের গুঁতো মেরে সব কথা বের করে ফেলবে, আন্দাজ করতে আমার এতটুকু দেরী হয় নি। কাজেই রাতের অন্ধকারে, কাকপক্ষীকে জানতে না দিয়ে আমার এই পশ্চাদপসরণ।
অবশ্য আমি দূরে চলে গেলেও একবার থামতে হল, মাইল বিশেক দূরে, একটা খামারে। খামারের মালিক রিচার্ড তখন ঘুমে, বলাই বাহুল্য। আমি অনেকবার এখান থেকে গরু, ভেড়া আর শুয়োরের মাংস কিনেছি। ভাল সার্ভিস দেয় ওরা, পরিচিত বলে খানিকটা কম দামেও মাংস পাই মাঝে মাঝে।
খামারের দরজায় থাকে দশাসই দুটো শিকারি কুকুর, হাঁকডাক করে পাড়া মাথায় তোলার আগেই আমি ওদের নাকে ধরলাম ঘুমের ওষুধ, এক সেকেন্ডেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো ওগুলো। দেখেছেন ডক্টর, একটা খুন করতে গেলে কত দিকে খেয়াল রাখতে হয়, কত খুঁটিনাটি মনে রাখতে হয়?
মনিকার লাশটা এনে ফেললাম শুয়োরের খোঁয়াড়ে। আপনি তো জানেন ডক্টর, শুয়োর হচ্ছে প্রাণীজগতের সবচেয়ে বদ জীব, সারাদিন ধরে নোংরা কাদায় গড়াগড়ি খায়, খাওয়াদাওয়া করে, আবর্জনা-মলমূত্র যা পায় তাই গেলে, আর বাচ্চা পয়দা করে। যেমন নোংরা তাদের আবাস, তেমন দুর্গন্ধময়। আপনি এই বয়সে শুয়োরের মাংস খাবেন না ডক্টর, প্রাণীজগতে শুয়োরের পরিপাক সিস্টেম সবচেয়ে সিম্পল বলে ওদের খাবার ঠিকমতো হজমই হয় না, কাজেই ওদের মাংস খেতে গেলে মানুষের ক্ষতি হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আপনি গরু কিংবা ভেড়ার মাংস খাবেন, বুঝলেন ডক্টর? আমি পাগল হলেও একটা ভাল পরামর্শ বিনামূল্যে দিয়ে দিলাম। আপনারা ডাক্তাররা তো আর এমনটা করেন না, সবকিছুতেই পয়সা নেন, হা হা হা।
আমার বেশি কথা বলার অভ্যেস আছে, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। কী করবো বলুন, মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ আমার খুবই কম। কাজেই যখন কাউকে পাই, মনে যা আসে, তাই বলে ফেলি। নিজের সাথে আর কত কথা বলা যায়?
কাজের কথায় আসি। একবার দেখেছিলাম, মরা একটা ভেড়ার বাচ্চাকে রিচার্ড এনে শুয়োরের খোঁয়াড়ে ফেললো, ওটাকে নিমেষেই চেটেপুটে খেয়ে শেষ করে দিলো শুয়োরেরা, আমি এক মিনিটের ভেতরেই দেখলাম, শুধু কয়েকটা হাড় পড়ে আছে। তখনই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিলো। মনিকার লাশটা খাইয়ে দেবো শুয়োর দিয়ে। সবাই সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করবে, কিন্তু শুয়োরের খোঁয়াড়ে? কখনোই নয়। বেওয়ারিশ লাশ “ডাম্প” করার জন্য অনেকেই এই উপায় অবলম্বন করে, নিশ্চয়ই জানেন, ডক্টর।
আমি বাসা থেকেই মোটামুটি “সাইজ” করে কেটে আনা মনিকার শরীরের বিভিন্ন অংশ ছুঁড়ে দিলাম খোঁয়াড়ের মাঝখানে। হাত, পা, মাথা।
সবগুলো টুকরো মাটিতে পড়ার আগেই বদ শুয়োরগুলো জেগে উঠলো, এত রাতেও ভুরিভোজ লাগিয়ে দিলো। আমি দু’মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলাম, মনিকার শরীরটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে প্রাণীগুলোর পেটে। সে কি আজ সকালেও ভাবতে পেরেছিল এই পরিণতির কথা? মনে তো হয় না। সে সবসময় আদর করে আমাকে ডাকতো “হানি” বলে। ধন্যবাদ মনিকা, আজ তুমি মরে গিয়ে আমাকে বড় আনন্দ দিলে। আমাকে একটা নতুন জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে।
জানোয়ারগুলো কয়েক মিনিটে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার চিৎপাত হয়ে কাদায় গড়িয়ে পড়লো, আমিও সটকে পড়লাম। বজ্জাত প্রাণীগুলোর প্রতি আমি অতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাকেও খাবার হিসেবে বিবেচনা করতে কতক্ষণ?
গাড়িটা রেখে গেলাম রাস্তার ধারে, নইলে আমাকে অনুসরণ করে চলে আসবে খাটাশ পুলিশগুলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়েচলা রাস্তা অনুসরণ করলাম। সবকিছুই আগে থেকে প্ল্যান করা আছে, এই পথ শেষ হয়েছে নদীর ধারে, আমি পুল পার হয়ে চলে যাবো ওপারের শহরটাতে, ঘষেমেজে চেহারা পাল্টে নতুন জীবন শুরু করবো। কেউ আমার টিকিটাও ছুঁতে পারবে না।
মানুষ যখন আত্মবিশ্বাসের সাথে অন্যায় করা শুরু করে, তখন তার সব কাজেই দক্ষতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কাজেই আমি যখন নিজের নামধাম পাল্টে দিব্যি নিরীহ এক ছোকরা সেজে নৌকা সারাইয়ের কাজে যোগ দিলাম, তখন ধুমসো পাহাড়ের মতো শরীরের অ্যালেক্স নামের বোট ফ্যাক্টরির মালিকও আমাকে সন্দেহ করতে পারে নি।
আমি রাতদিন ভূতের মতো খাটি, মাথা নিচু করে। মুখ খুললেই বিপদ, কারণ কার মধ্যে কী আছে কে জানে? পুলিশ হয়তো হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে, বেফাঁস কিছু বলা যাবে না কোনমতেই। কে বলবে, আমি কয়েকদিন আগেও স্যুট-টাই পরে অফিসে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করেছি। মানুষের রং বদলানো হচ্ছে সবচেয়ে সহজ কাজ। এটা যে যত সহজে পারে, সে তত বেশিদিন টেকে।
ভালো কাজ দেখিয়ে মালিকের সুনজরে এলাম কয়েকদিনের মধ্যেই। ওর অল্পবয়সী মেয়ে জুলিয়া ছিল আমার দ্বিতীয় শিকার। জানেন নিশ্চয়ই, ডক্টর সিম্পসন, হে হে।
বব হ্যাডিংস যখন হাসে, তখন তার কুচকুচে কালো রঙয়ের জিভ দেখা যায়। অতি অরুচিকর দৃশ্য, যেন একটা মস্ত সাপ জিভ বের করে নাড়ছে। ডক্টর সিম্পসন দু’চোখ বন্ধ করে ঝিম ধরে আছেন বলে দেখতে পেলেন না।
মেয়েটা অল্পবয়সী, সুন্দরী। আমি সহজেই ওকে হাত করলাম। প্রেমের সম্পর্ক তো এ-দেশে অল্পেই গড়ে ওঠে, আবার অল্পেই ভেঙে যায়। কাজেই ওকে যখন বললাম, তোমার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি, তখন সে সহজেই বিশ্বাস করলো। মেয়েটা সরল, নিষ্পাপ গোছের। এবং বোকা, বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমার মাথায় তখন দ্বিতীয় খুন করার জন্য জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে, কাজেই আমি ঠিক করলাম, ওকে মেরে ফেলতে হবে।
ধুমসো মোটকু অ্যালেক্স প্রথমে সম্পর্কটা মেনে নিতে চায় নি। আমিও যে খুব একটা এগিয়েছি তা নয়, কিন্তু জুলিয়া আমার ভালোমানুষের মতো মুখখানা দেখে একেবারে আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওর বাবাকে বিয়েতে রাজী করাল। তারপর আমরা একদিন বিয়ে করে ফেললাম। আমার দ্বিতীয় বিয়ে, তবে জুলিয়া জানে, আমি ভাগ্যাহত একজন অতি সৎ যুবক, যে কাজের সন্ধানে এই শহরে এসেছে এবং নৌকা সারাই করে চলেছে।
বিয়ের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বললাম, তোমার বাবার সাথে কাজ করে আমি ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছি না। নিজেকে কেমন চাকর চাকর মনে হচ্ছে। অন্যের অধীনে কাজ করতে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু জামাই হয়ে শ্বশুরের সাথে কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে চল, আমরা অন্য কোথাও চলে যাই, তারপর কোন একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করি।
জুলিয়া নামের বেকুব মেয়েটা তাতেই রাজী। আমরা শহরতলীতে একটা ছোট্ট ঘর তুললাম। মজার ব্যাপার হল, জুলিয়া ওর বাবার কাছ থেকেই কিছু টাকা এনে আমাকে দিলো বাড়ি বানানোর জন্য। সে তো আর জানে না আমার ভেতরে কী আছে।
একটা ছোট স্টোর চালাই, আমি আর জুলিয়া পালাক্রমে দোকান দেখাশোনা করি, শহর থেকে মাল নিয়ে আসি, বিক্রি করি। মাঝেমধ্যে ধুমসো শ্বশুর মশায়ের সাথে দেখা করে আসি, একসাথে সস্তা মদ খাই। ভালোই চলে যাচ্ছিলো। জুলিয়া আমাকে খুব ভালোবাসতো, এমন চমৎকার একটা মেয়েকে স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ খুন করার চিন্তাই করবে না, কিন্তু একবার যে এটা করেছে, সে ছাড়া আর কে বুঝবে যে এটাতে কী মজা?
পুরো বাড়িটাতে বাসিন্দা বলতে আমি, জুলিয়া আর পাহারাদার কুকুর “লিটল”। নামেই লিটল, আসলে বিশালদেহী একটা কুকুর, বড় বড় বাঁকানো দাঁত দেখলে ভয় লাগে। আমি ওটাকে কিনে এনেছি, ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভয়ংকর কুকুর, জুলিয়াকে বলেছি যে রাতবিরেতে নিরাপদে থাকা এতে নিশ্চিত হবে। জুলিয়া কুকুর পছন্দ করে না, কিন্তু সে আমার সব কথাতেই সায় দেয়, কাজেই লিটলকে বাসায় রাখতে মানা করেনি। একটা মেয়ে যে স্বামীকে কি পাগলের মতো ভালবাসতে পারে, জুলিয়াকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না, ডক্টর। এখন আর দেখবেন কী করে, আফসোস।
ডক্টর সিম্পসন চোখ খুলে দেখলেন, এক মুহূর্তের জন্য বব হ্যাডিংসের চোখে বেদনার ছাপ পড়েছে। কিন্তু সেটা সহসাই মিলিয়ে যায়, তার চোখে আবার চকচকে ভাবটা ফিরে আসে। ডক্টর সিম্পসন আবার ঝিম মেরে গেলেন।
আমি প্রতিদিন লিটলের দেখাশোনা করতাম। জুলিয়া তো ছোঁবে না, কাজেই আমার নিজের হাতে ওকে খাইয়ে দিতে হতো। কাঁচা মাংস ছাড়া কিছুই খেত না সে। কেন কুকুরটার কথা এত করে বলছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ডক্টর।
সেদিন সকাল থেকেই লিটল বড়ই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছিল, কাজেই ছেড়ে না রেখে চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম।
জুলিয়া জিজ্ঞেস করলো, লিটলের কী হয়েছে, সোনা? এমন করছে কেন? কুকুরের ডাক শুনলেও ভয় পায় জুলিয়া। আর লিটলের গলার স্বর বাজখাঁই, মাঝেমধ্যে আমারই পিলে চমকে যায়। তবে ভরসার কথা, খাবারদাবার দিই বলে কুকুরটা আমার খুব অনুগত।
জুলিয়াকে বললাম, বুঝতে পারছি না। আজকের দিনটা দেখি, তারপর না হয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। হয়তো কোন অসুখ করেছে। পশু হাসপাতাল একটু দূরে, কিন্তু গাড়ি নিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই। ততদিনে আমাদের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ভ্যান কেনা হয়েছে।
ঘটনা কী বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। লিটলকে আমি পুরো চব্বিশ ঘণ্টা না খাইয়ে রেখেছিলাম। এখন খিদের চোটে পাগল হয়ে গেছে সে, চেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি মৃদু হেসে অপেক্ষা করলাম। লিটলের গর্জন যাতে কানে না আসে, সেজন্য উঁচু শব্দে গান ছেড়ে দিলাম। রক মিউজিক। গায়ক একটু পর পর বলছে, “কিল মি, কিল মি, … …”, কি কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না ডক্টর?
রাত নামলো। আজ রাত আমার বড় সুখের রাত হতে যাচ্ছে।
ঘুমন্ত জুলিয়াকে আমি সন্তর্পণে বেঁধে ফেললাম, ঠিক যেমন করে মনিকাকে বেঁধেছিলাম। মনিকার বেলায় একটু-আধটু হাত কেঁপেছিল, এবার সে সমস্যাও নেই, কারণ খুব ভাল করে জানা আছে, কী করতে হবে। অভ্যেস, বুঝলেন ডক্টর। অভ্যেস করলে আপনার কাছে মানুষ মারাও পানির মতো সোজা হয়ে যাবে, হা হা হা। তাছাড়া আমার কপালে পড়েছে সব ঘুমকাতুরে মেয়ে, এটাও একটা ভারী আজব ব্যাপার।
ডক্টর সিম্পসনের কপালের কুঞ্চিত চামড়ায় একটু ভাঁজ পড়লো, কিন্তু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসলেন।
বাড়ির বাইরে বাঁধা আছে লিটল, আমি জুলিয়াকে ওর কাছে নিয়ে ফেললাম। সারাদিন অভুক্ত থেকে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে লিটল। এখন মাটিতে থুতনি রেখে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো, লেজ নাড়তে শুরু করলো। ভেবেছে খাবার নিয়ে এসেছি, না দিলে হয়তো আবার চেঁচামেচি শুরু করবে।
সারা শরীর আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা বলে জুলিয়ার নড়াচড়ার কোন উপায় নেই। তবে মনিকাকে খুন করার সাথে পার্থক্য হল, মনিকার মুখে কাপড় গোঁজা ছিল, আর ওর মুখ খোলা। ইচ্ছে করেই মুখ খোলা রেখেছি। মৃত্যুর সময় সে কেমন করে চেঁচায়, সেটা দেখার বড় ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি আস্তে করে জুলিয়াকে শুইয়ে দিয়ে তার চেয়েও সাবধানে লিটলের গলার চেন খুলে দিলাম। লিটল দাঁত খিঁচোল। জুলিয়া ওকে পছন্দ করে না, সে-ও বোধহয় জুলিয়াকে পছন্দ করে না।
গরগর শব্দ করে আমার দিকে তাকাল লিটল। আমি হাতের ইশারা করতেই কুকুরটা জুলিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বিকট গর্জনে ছিন্নভিন্ন করা শুরু করলো জুলিয়াকে। কাঁচা মাংসের স্বাদ পাচ্ছে সে, নরমাংসের স্বাদ। এরপর আর অন্য মাংস মুখে রুচবে কীনা কে জানে।
আমি সিঁড়ির ওপর বসে আছি, ভাল করে লক্ষ করছি কী ঘটে।
জুলিয়া এক মুহূর্তেই জেগে গেছে, আর চিৎকার শুরু করেছে, গলা ফাটিয়ে, প্রাণভয়ে। কিন্তু সুখের ব্যাপার, সবচেয়ে কাছের বাড়িটাও বেশ খানিকটা তফাতে, এত রাতে ওর চিৎকার কারো কানে পৌঁছাবার কথা নয়। এজন্যই তো ওর মরণ আর্তনাদ ঝক্কিঝামেলা ছাড়া শুনতে পাচ্ছি।
জুলিয়া আমার দিকে তাকাচ্ছে না, শুধু নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মৃত্যু মানুষকে কতটা স্বার্থপর করে দেয়, দেখলেন ডক্টর? প্রাণপ্রিয় স্বামীকেও ভুলিয়ে দেয়, হা হা হা।
কুকুরটা একসময় খাওয়ার সুবিধের জন্য জুলিয়ার হাতের বাঁধন ছিঁড়ে ফেললো। তাতে কিছু যায় আসে না, জুলিয়া ততক্ষণে খুব দুর্বল হয়ে গেছে, সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। চিৎকার করতে করতে সে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে, অসহ্য যন্ত্রণায় শরীরের ছেঁড়া, মাংস বের হয়ে যাওয়া অংশগুলো ঢাকার চেষ্টা করছে, কুকুরটাকে দুর্বল হাতে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না, বলাই বাহুল্য।
লিটল একটানে ছিঁড়ে ফেললো জুলিয়ার কণ্ঠনালী, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগলো, জায়গাটা ভরে গেল তাজা রক্তের নোনা গন্ধে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। আমি ব্যাপারটা তখনও মন দিয়ে দেখছি। আহা, কি আনন্দময় দৃশ্য।
একসময় চেটেপুটে জুলিয়ার রক্তমাখা শরীরটার সিংহভাগ খেয়ে শেষ করলো লিটল, লম্বা জিভ বের করে চাটল নিজের মুখ। নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছিলো কুকুরটার, নইলে একটা আস্ত মানুষের আশিভাগ একবারেই সাবড়ে দেয় কী করে? আমার মনে পড়লো মনিকার কথা, কীভাবে শুয়োরগুলো মনিকার মৃতদেহ কয়েক মিনিটেই সেঁটে দিয়েছিলো। আমার মুখে একটা হাসি খেলে যায়। সেদিনও এমন আনন্দবোধ হয়েছিলো আমার।
লিটলের মুখের দু’পাশ দিয়ে তখনও রক্ত বেয়ে পড়ছে, ঘেন্না লাগবে অনেকের দেখে, কিন্তু আমি এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলোলাম। কৃতজ্ঞস্বরে গরগর আওয়াজ করলো সে।
আমি একবার তাকালাম লিটলের ভুক্তাবশেষের দিকে। কে বলবে যে এখানে একটু আগেই একটা জলজ্যান্ত মেয়ে শুয়ে ছিল? এখন এখানে কিছু রক্ত, মাংসের পিণ্ড, হাড় এসব পড়ে আছে, যেন কসাইখানার ঘর, এখনো পানি দিয়ে ধোয়া হয় নি। কুকুরদের খাওয়াদাওয়ার প্রক্রিয়াটা খানিকটা নোংরা, স্বীকার করতেই হবে। যাক, লিটলের আরও এক বেলার খাবার হয়ে যাবে।
পেছনে ফেলে গেলাম আমি শহরতলীর সেই বাড়ি, লিটল, আমার দোকান। সারারাত ধরে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে আরেক শহরে, আমার জীবনের আরেকটি অধ্যায় শুরু করতে হবে। আমি হৃষ্টচিত্তে ভ্যানটা নিয়ে রওনা দিলাম। খুব ভাল লাগছে আমার। আরেকটা খুন করতে হবে। আবার সেই নেশা-নেশা ভাবটা হচ্ছে। এই নেশা মদের নেশা নয়, তার চেয়ে অনেক তীব্র একটা নেশা। একেই কি বলে রক্তের নেশা?
আমি আবার নাম ভাঁড়িয়েছি। এছাড়া উপায় কী? বেঁচেবর্তে থাকতে হলে, নির্বিঘ্নে খুন করা চালিয়ে যেতে হলে তো আমাকে নামধাম পাল্টে চলতেই হবে।
আমি এবার আর কোন পুল পার হই নি, একেবারে নদীপথে স্টিমারে করে চলে এসেছি বহুদূরের একটা শহরে। আমি সারাজীবন সমুদ্রের ধারে কাটিয়েছি বলেই কীনা জানি না, আমার পছন্দের জায়গাগুলো সবসময় সমুদ্রের ধারের শান্ত শহরগুলো, যেখানে বালির ওপর ডিম পেড়ে যায় কচ্ছপ, রৌদ্রস্নান করে লোকজন, রোদে পিঠ দিয়ে।
আমার মতো খুনীর মুখে কি কাব্যিক কথা শুনে অবাক হচ্ছেন, ডক্টর? বললে বিশ্বাস করবেন না, জুলিয়াকে খুন করার তিন দিনের মাথায় ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটা হল,
তোমাকে খাইয়ে দিয়েছিলাম কুকুর দিয়ে,
তোমার জীবনের মধুর সমাপ্তি ঘটেছিলো … …
ডক্টর সিম্পসন বলে উঠলেন, আমি এখানে কবিতা শুনতে আসি নি। তুমি ঘটনাটা বল।
বব হ্যাডিংস আবার কালো কুচকুচে জিভ বের করে কুৎসিত হাসি হাসার আগেই তিনি পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
বব হ্যাডিংস খানিকক্ষণ দম নিয়ে নিলো, তারপর আবার তার গল্প বলতে শুরু করলো।
কিছুদিন নৌকা সারাই করেছি, দোকানদারি করেছি, আরেকটা পরিচয় যোগাড় করতে দেরী হল না। জাল কাগজপত্র দেখিয়ে, নকল নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম আরেকটা সুপার শপের সেলসম্যান হিসেবে। ফিটফাট পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকি, ক্রেতা এলেই বিগলিত হাসি হেসে দু’নম্বরি জিনিস গছিয়ে দিতে চেষ্টা করি।
একদিন আমার দোকানে এলো একটা ভারী সুন্দরী মেয়ে। প্রথম দেখাতেই আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। সোনালী চুল, বড় বড় চোখ, মিষ্টি হাসি। আর কারো দিকে না তাকিয়ে যখন আমার দিকেই এগিয়ে এলো, তখনই আমি মুখে সুরুত করে পানি টেনে নিলাম। না, ওকে দেখে লোভ লেগেছে অন্য কারণে। খুন করার জন্য এর চেয়ে ভাল মেয়ে আর হয় না।
বললে এটাও বিশ্বাস করবেন না ডক্টর, সেই মেয়েটা আমার কাছ থেকে প্রথমবারেই অনেক টাকার জিনিস কিনে নিয়ে গেল, আমি বেছে বেছে ভাল জিনিস দিলাম। আমি চেষ্টা করলাম কেনা দামের চেয়েও কম দামে ওর কাছে জিনিস বিক্রি করতে, আর খুঁটিনাটি কথা বলে জানার চেষ্টা করলাম সে কে, কোথায় থাকে।
মেয়েটার নাম লিন্ডসি, থাকে এখানেই। আমার মতো একজন সামান্য সেলসম্যানের মধ্যে সে কী দেখেছিলো কে জানে, আমাকে নিমন্ত্রণ করে বসলো লাঞ্চের। আমার অত্যন্ত ভদ্র আচরণ নাকি ওকে খুব “নাড়া” দিয়েছে।
আমাকে আর পায় কে। তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেলাম।
সেই লাঞ্চ হল অতি রোমান্টিক পরিবেশে। তারপর থেকে আমরা একে অন্যের দিকে অতি দ্রুত ঝুঁকতে লাগলাম। লিন্ডসি আমাকে ভালবাসতে লাগলো, আর আমি নতুন শিকার পাওয়ার আনন্দে তখন পাগলপ্রায়। আমি অবশ্য ভদ্রতা করে বললাম, তুমি কোথায় আর আমি কোথায়। আমি সামান্য সেলসম্যান, আর তুমি … …
কে শোনে কার কথা, লিন্ডসি পারলে আমাকে এখুনি বিয়ে করে ফেলে। মেয়েরা একটু বোকা হয়, কমবয়সী মেয়েরা হয় আরও বোকা, জানেনই তো ডক্টর। খিক খিক করে হাসল বব হ্যাডিংস।
লিন্ডসির বাবা-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও আমরা দুজন বিয়ে করে ফেললাম। ওর বাবা-মা সত্যিকারের ভদ্র মানুষ, আমাকে চেনেন না জানেন না, অথচ একমাত্র মেয়ের স্বামী হিসেবে আমাকে খুব যত্ন করতে শুরু করলেন। অতি অল্প ব্যবধানে তিন-তিনটে বিয়ে, আবার জামাই-আদর, আমার ভাগ্যটা একবার ভেবে দেখুন ডক্টর।
আমি তখন মনে মনে গুছিয়ে এনেছি কীভাবে ওকে খুন করবো। লিন্ডসির আনন্দে-উচ্ছ্বাসে দিন কাটছে, সে যে আমাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করছে না সে ব্যাপারে আমি একশোভাগ নিশ্চিত ছিলাম।
কিন্তু ভুল হয়ে গিয়েছিলো আমার, ডক্টর। মারাত্মক ভুল। এসব লাইনে একটা ভুলই অনেক বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
এরকম একটা কুংফু-ক্যারাটে জানা মেয়েকে বিয়ে করা আমার মোটেই উচিৎ হয় নি। এসব মেয়েগুলো তায়কোয়ান্দো আর কুংফুর প্যাঁচ শিখে খুব ঘাঘু হয়ে যায়, ঘুম হয়ে কুকুরের মতো পাতলা। তাই তিন নম্বর খুন করতে গিয়ে গোলমাল হয়ে গেল। আমি চেয়েছিলাম দানে দানে তিন দান পূর্ণ করতে। যেকোনো কাজ তিনবার করতে হয়। তিন অতি রহস্যময় সংখ্যা, জানেন তো, ডক্টর। তিন ছাড়া পূর্ণতা হয় না।
(এ পর্যায়ে লিন্ডসি নামের মেয়েটিকে মুখ খারাপ করে অত্যন্ত কুৎসিত গালি দিলো বব। স্টেনোগ্রাফার মরিসন ভদ্র ভাষায় কেস ফাইল লেখার নির্দেশ পেয়েছে বলে সে গালিটা এড়িয়ে গেছে।)
মেঝেতে থুথু ফেলে বব হ্যাডিংস বলতে লাগলো, এবারের খুনের প্ল্যানটা ছিল আরেকটু বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কেমিস্ট্রির ছোঁয়া ছিল। টাকাপয়সা খরচ করে যোগাড় করেছিলাম জংলিদের একটা ভেষজ বিষ। ইচ্ছে ছিল, ঘুমের মধ্যে লিন্ডসির পেশীতে সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধটা ঢুকিয়ে দেবো। আমি চোখের সামনে এই ওষুধ অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করার ফলে একটা গরুকে ছটফট করে মরতে দেখেছি। শুনেছি, একশোটা ছুরি শরীরে গেঁথে দিলেও নাকি এত যন্ত্রণা হয় না।
শুনেই আমার জিভে জল চলে এসেছে। এটাই তো চাই। কাজেই এক কানে দুল আর গলায় হাড়ের মালা পরা একটা হিপ্পি বুড়ো ভামের পেছনে ঘুরে ঘুরে যোগাড় করলাম এক শিশি বিষ। কয়েক ফোঁটা দিলেই যেখানে কাজ হবে, সেখানে আমি পুরো শিশি প্রয়োগ করবো, এতে যন্ত্রণা নিশ্চয়ই অনেক বেড়ে যাবে। হিপ্পি বুড়ো আমাকে বলেছে, বিফলে মূল্য ফেরত। ওরা এক কথার মানুষ।
রাত এসেছে আবার। অপকর্ম করার জন্য আদর্শ সময় হচ্ছে রাত্রি দ্বিপ্রহর। অবশ্য এগুলো আমার জন্য অপকর্ম নয়, আনন্দকর্ম, হা হা।
আমি সিরিঞ্জে চেপে চেপে ঢুকালাম ওষুধ। ওষুধ তো নয়, বিষ। তারপর পা টিপে টিপে লিন্ডসির দিকে এগিয়ে গেলাম। সে সত্যিই ঘুমিয়ে আছে কীনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওর সামনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। হ্যাঁ, সে সত্যিই ঘুমিয়েছে। সারা ঘরে ওর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মানুষ গভীর ঘুমের সময় ঘন, গভীর নিঃশ্বাস ফেলে।
আমি সিরিঞ্জের সূচটা লিন্ডসির বাহুতে ঢুকিয়ে দিতে গেলাম। আর এক ইঞ্চি দূরে ওর মৃত্যু, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। এবং আমার জন্য আনন্দ।
হঠাৎ ওর চোখ দুটো খুলে গেল। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম, আমার হাতের সিরিঞ্জটা এক লাথিতে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। হারামী মেয়েটা আমার দুর্বল জায়গায় একটা ঘুষি মেরে বসলো।
আমার তলপেট ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। আমি “আউক” শব্দ করে বসে পড়লাম মাটিতে।
কী করে লিন্ডসি জেগে উঠলো, সেটা বোঝার আগেই আমাকে আরও কয়েকটা দমাদম মার বসিয়ে দিলো, কত বদ মেয়ে চিন্তা করুন, ডক্টর।
দশ মিনিটের মাথায় আমি পুলিশের গাড়িতে, গোমড়া মুখে আমার চেয়েও গোমড়ামুখো কয়েকটা পুলিশের সাথে থানার দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
দু’দুবার আমার প্ল্যান সফল হয়েছিলো। কিন্তু এবার হল না। তিন দান হল না। তাতে আমার আক্ষেপ নেই। আমার আক্ষেপ হল, এত টাকাপয়সা খরচ করে কেনা বিষটার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা হল না। বলেছিলাম না ডক্টর, এমন একটা কুংফু জানা মেয়েকে বিয়ে করা মোটেই ঠিক হয় নি, এদের ঘুম হয় কুকুরের চেয়েও পাতলা। আর স্বামী বলে একটু ছাড় পর্যন্ত দিলো না, কেমন করে পেটাল আমাকে। ঝিম ধরে পড়ে ছিল বিছানায়, ভাবতেই পারি নি যে বিষটা ওর হাতে ঢুকিয়ে দেয়ার আগেই সে জেগে যাবে।
সবই তো শুনলেন, ডক্টর। আপনাকে ঘটনাগুলো বলে শান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে অনেকদিন পর কোষ্ঠকাঠিন্য সেরে গেল, হা হা হা।
বব হ্যাডিংসের গল্প শেষ। সে অনেকক্ষণ ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তাকে সত্যিই ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলো, লিন্ডসি এখন কোথায় আছে, ডক্টর?
ডক্টর সিম্পসন জবাব না দিয়ে উঠে পড়লেন। তিনি জানেন লিন্ডসি এখন কোথায় আছে। সে আবার বিয়ে করেছে, একজন অল্পবয়স্ক গলফ খেলোয়াড়কে, বেশ সুখেই আছে। অন্তত এখনো ওর স্বামী ওর বাহুতে বিষ প্রয়োগ করতে চায় নি। করতে গেলেও হয়তো বব হ্যাডিংসের দশা হবে, “দুর্বল জায়গায়” লাথি খেয়ে চৌদ্দ শিকে ঢুকতে হবে। বব হ্যাডিংসকে লিন্ডসির খবর জানানোর কোন দরকার নেই।
ডক্টর সিম্পসন লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন থেকে নিজের সেলের লোহার শিকগুলো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বব চিৎকার করছে, চলে যাচ্ছেন কেন ডক্টর? আমার মুক্তির ব্যবস্থা করুন। আমি আরও কয়েকটা মেয়েকে খুন করতে চাই। আরও খুন না করলে আমি কিন্তু পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবো।
সহসা আপনি থেকে তুইয়ে নেমে আসে সে, মুখ খিস্তি করে গালিগালাজ করা শুরু করে। চলে যাচ্ছিস কেন ডক্টর? থাম্ বলছি। দুটো মেয়েকে কুকুর দিয়ে খাইয়েছি, শুয়োর দিয়ে খাইয়েছি। তোকে আমি নিজে খাবো। তোর মাংস লবণ দিয়ে কচকচ করে চিবিয়ে খাবো। এই … …
লম্বা করিডোরের পাথরের দেয়ালে বব হ্যাডিংসের বিকট চিৎকার আর অশ্রাব্য গালিগালাজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। একসময় ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে যায়।
করিডোরের শেষ মাথায় একটা লোহার দরজা, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একজন গার্ড, সে দরজা খুলে দিলো, সরে দাঁড়িয়ে ডক্টরের জায়গা করে দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের অফিস ছেড়ে সেখানে হাজির হলেন ডক্টর এনরিক, সম্ভবত সেই গার্ড ইন্টারকমে বলে দিয়েছে।
কেমন ইন্টার্ভিউ হল, সিম্পসন?
ভাল।
যাচ্ছ কেন, বোসো, কফি খাও। কফি আনতে বলি?
না, এনরিক, বাসায় যাবো। তুমি সুযোগ করে দিয়েছ, এজন্য ধন্যবাদ।
না না, ধন্যবাদ দেয়ার কী আছে, বন্ধুর জন্য এটুকু করবো না? আবার এসো, অনেক ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার এখানে আছে, তুমি সীটিং নিয়ে মজা পাবে। আমি ব্যবস্থা করে দেবো।
দেখি।
অল্প কথায় বিদায় নিয়ে ডক্টর সিম্পসন চলে আসেন। গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করেন তিনি, বড় রাস্তায় উঠে পড়লেন।
***
ডক্টর সিম্পসনের পেট গুলোচ্ছে। ঝিম ধরে বসে ছিলেন বলে বুঝতে পারেন নি।
বাসায় এসেই একবার মুখ ভরে বমি করেছেন, কিন্তু তাতেও ভালো লাগছে না। শরীরটা কেমন ভারী ভারী ঠেকছে, মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। জ্বর আসছে হয়তো।
তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, বীভৎস খুনের বর্ণনা শুনে তাঁর গা গুলোলে তো চলবে না। তারপরেও তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি পেটে যা আছে সব বমি হয়ে বেরিয়ে যাবে।
হাতে-মুখে পানি দিয়ে তিনি যখন নিজের বড় ইজিচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন, তখন তাঁর মনে চকিতে একটা প্রশ্ন খেলে গেল, সত্যি সত্যি কি মানুষ খুন খুব আনন্দময় একটা কাজ? বব হ্যাডিংস যেমন ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে, যেমন জোর দিয়ে বলল, তাতে খানিকক্ষণের জন্যে হলেও তাঁর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছে।
কে জানে, তিনি তো আর খুন করে দেখেন নি, কেমন লাগে। সিগারেটে তো কোন স্বাদ নেই, সেটা কোন সুঘ্রাণওয়ালা জিনিসও নয়, তবুও এই কটুগন্ধী বিশ্রী জিনিসটা তো অনেকেই আরাম করে খায়, যেন এর মতো জিনিস আর দুনিয়াতে নেই। তিনি নিজেও খান।
ডক্টর সিম্পসন একটা দ্বিধা, একটা খটকা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
…………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………….