পরিতোষবাবুর বাড়িটা একটু নির্জনে। শহরতলির একদম ভিন্ন প্রান্তে। আশপাশে তেমন কোনও বাড়ি নেই। আছে শুধু গাছগাছালি ঘেরা একমুঠো সবুজের ছোঁয়া। বাড়ির একপাশে বিরাট মাঠ। অন্য দিকে বিরাট বিল। মাঠের দু’দিকে দুটো গোলপোস্ট দেখলে মনে হয়, সকালে বা বিকেলে এখানে পাড়ার ছেলেরা হয়তো ফুটবল খেলতে আসে। তবে এখন কেউ নেই। ছেলেরা সন্ধেবেলায় ফিরে গিয়েছে যার-যার ঘরে। এখন শুধু শূন্য দুটো গোলপোস্ট আবছা! গোধূলির ছায়ামাখা অন্ধকারে ছায়াছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছায়াময় হয়ে আছে বিশাল ঝিলটাও। তার বুকে এখন আবছা-আবছা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে।
পরিতোষবাবুর বাড়ির সামনে বাইকটা পার্ক করলেন নির্মলবাবু। বিশাল লোহার গেট খুলে মোরাম বিছানো পথ ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। আরও আগে আসা উচিত ছিল। বিগত সাতদিন ধরে পরিতোষবাবু অফিসে আসছেন না! মোবাইলে ফোন করলে ‘সুইচূড অফ’ শোনা যাচ্ছে! ল্যান্ড ফোন ক্ৰমাগত বেজেই চলেছে। কেউ ধরছে না! প্রথম-প্রথম খুব একটা পাত্তা দেননি। ভেবেছিলেন, হয়তো পরিতোষবাবু কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন। ভদ্রলোক তো আর সংসারী নন। অকৃতদার, ঝাড়া-ঝাপটা একজন মানুষ। হয়তো কী খেয়াল হয়েছে, ব্যাগট্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটানা যখন সাতদিনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, তখনই নির্মলবাবুর মন ‘কু’ গাইতে শুরু করল। পরিতোষবাবু তো এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন নন! অফিসের কাজ ফেলে কাজপাগল মানুষটি এতদিনের জন্য এমন নিরুদ্দেশের পথে ধাঁ হয়ে গেলেন! এমনকী তাঁর অফিসকলিগ, প্ৰাণের সঙ্গী নির্মলবাবুকেও কিছু বললেন না! নাঃ, সম্ভব নয়! নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েননি তো! অসুস্থ হলে তো দেখারও কেউ নেই। অথবা কোনও বিপদে…
অনেক কিছুই ভাবতে-ভাবতেই ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালেন দরজার সামনে। নাহ, দরজায় তালা নেই। দরজাও ভিতর থেকে বন্ধ! অর্থাৎ পরিতোষবাবু বাড়িতেই আছেন! অথচ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই! গোটা বাড়ি অন্ধকার! কোথাও একফোঁটা আলোও জুলছে না! ঘর অন্ধকার করে ভদ্রলোক ভিতরে করছেন কী! বিস্মিত হয়ে নির্মলবাবু ডোরবেলে হাত রাখলেন। ডোরবেল মিষ্টি সুরে বেজে উঠল! কয়েকমুহুর্তের স্তব্ধতা। পরক্ষণেই ভিতর থেকে সাড়া এল, “কে?”
“আমি নির্মল পরিতোষদা,” গলা চড়িয়ে উত্তর দেন নির্মল, “নির্মল হালদার।”
আবার একটু নিস্তব্ধতা। তারপর উত্তর এল, ‘আসছি।”
কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপরই খুট করে খুলে গেল দরজা।
পরিতোষবাবুর ছায়ামূর্তি দেখা গেল। পরনে পাঞ্জাবিপাজামা, অত্যন্ত পরিচিত দীর্ঘদেহী ও ঋজু ছায়ার স্তিমিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “এসো। ভেতরে এসো।”
ভিতরে পা রাখতেই কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগল নির্মলবাবুর। সারা ঘর অন্ধকার! লোডশেডিং নাকি! কিন্তু তা হলেও তো মানুষ একটা আলো, নিদেনপক্ষে একটা মোমবাতিও জ্বালিয়ে রাখে! অন্ধকারটা চোখে সইয়ে নিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। আবছা-আবছা সোফার অবয়ব চোখে পড়ল! তাঁর সামনের টেবিলটার অস্তিত্বও টের পেলেন। কিন্তু বাকি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।
“এত অন্ধকার কেন পরিতোষদা?” কোনরকমে হোঁচট খেতে-খেতে এগোচ্ছেন নির্মলবাবু। পরিতোষবাবু ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। এতক্ষণে একটা আলোর রশ্মি দেখা গেল। ভদ্রলোক টর্চ জ্বেলেছেন। টর্চের আলোয় সোফাটাকে দেখে নিয়ে আরাম করে বসরেন নির্মলবাবু। কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, “লোডশেডিং নাকি?”
“না…না!” পরিতোষবাবু এবার টর্চটা নিভিয়ে দিয়েছেন। নির্মলবাবু বিস্মিত হয়ে দেখলেন, এমন জমাটবদ্ধ অন্ধকারেও দিব্যি স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছেন তিনি। বিনা বাধায় এগিয়ে এসে বসলেন। ওঁর মুখোমুখি, “লোডশেডিং নয়। আমিই আলো নিভিয়ে রেখেছি।”
“আপনিই আলো নিভিয়ে রেখেছেন!” বিস্ময়ে হতবাক নির্মলবাবু, “কিন্তু কেন?”
পরিতোষবাবুর গলা যেন একটু কাঁপল, “কারণ আলো থাকলেই ছায়া দেখা যায়! আমি আলো জ্বালালেই ছায়া দেখতে পাব!”
বিস্ময়ের পর-বিস্ময়! ছায়ার ভয়ে পরিতোষবাবু আলো নিভিয়ে রেখেছেন!! এ কী জাতীয় অদ্ভুত কথা! নাকি রসিকতা।
“তুমি জান না নির্মল!” পরিতোষবাবুর গলায় ত্ৰাস স্পষ্ট, “আলো জ্বললেই ওরা আমায় চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরে। একবার নয়, বারবার আসে। আমার চোখের সামনে হেঁটে চলে বেড়ায়!”
“কারা!”
“ছায়ারা!”
“কী বলছেন পরিতোষদা!” নির্মলবাবু বললেন, “সে তো আমাদেরও সবার ছায়া দেখা যায়। আমরাও একে অপরের ছায়া দেখতে পাই। তাতে ক্ষতি কী?”
“সে ছায়া নয় ভাই।” তিনি একটু থেমে বললেন, “কীভাবে তোমায় বোঝাব বুঝতে পারছি না। তুমি বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু সত্যিই আমি ছায়া দেখতে পাই।”
“কী রকম ছায়া?”
“ধরো রাস্তা দিয়ে দুটো মানুষ যাচ্ছে! তাদের দুটো ছায়া পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তিনটে ছায়া দেখতে পাই৷” পরিতোষবাবুর কণ্ঠস্বরে শিরশিরে হিমেল অনুভূতি, “দেখতে পাই, ওই দুটো ছায়ার পিছন-পিছন আর-একটা ছায়াও ওদের ফলো করছে। কিন্তু ধারে কাছে কোনও মানুষই নেই! কোনও মানুষের ছায়া ওটা নয়। ছায়াটা শুধু অনুসরণ করে! আর যাঁকে অনুসরণ করে সে বাঁচে না!”
নির্মলবাবু বুঝতে পরেন, পরিতোষবাবু কোনও কারণে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন! হয়তো দিনের পর দিন নিঃসঙ্গতার ফলে তাঁর মস্তিষ্ক উদ্ভট-উদ্ভট কল্পনা করছে। তিনি পরিতোষবাবুকে বাধা দিলেন না। পরিতোষবাবু তখনও আত্মগতভাবে বলে চলেছেন, “প্রথম-প্রথম আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি। প্রথম যখন ঘটনাটা ঘটল…”
“কী ঘটল!”
পরিতোষবাবু একটু থামলেন। বোধ হয় কিছু ভাবছেন। অথবা নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “সেবার আমার অশীতিপর পিসেমশাইয়ের আচমকা সেরিব্রাল অ্যাটাক হল। খুবই খারাপ অবস্থা। আমরা সবাই নার্সিংহোমে পালা করে রাতপাহারা দিচ্ছি। পিসেমশাইয়ের অবস্থা স্টেবল ছিল না! ভেন্টিলেটরে আছেন। কখনও একটু ভালর দিকে যাচ্ছেন, কখনও বা চূড়ান্ত খারাপের দিকে। ডাক্তাররা কোনও গ্যারান্টি দিতে পারছেন না! ঠিক তখনই অদ্ভূত ঘটনাটা ঘটল!”
“কী।” নির্মলবাবু কৌতুহলী হয়ে জানতে চান।
“আই সি ইউ-র ঘরে তখন আমরা তিনজন ছিলাম। আমি, ডাক্তারবাবু আর শয্যাশায়ী পিসেমশাই,” পরিতোষ ঢোক গিললেন, “ঘরে তখন সাদা ফটফটে দেওয়ালের দিকে অবাক হয়ে দেখলাম, দেওয়ালে চারটে ছায়া পড়েছে! একটা আমার, একটা ডাক্তারবাবুর, একটা শুয়ে থাকা পিসেমশাইয়ের। কিন্তু চতুর্থটা!
চতুর্থটা কার ছায়া? ঘাড় ঘুরিয়ে দেকার চেষ্টা করলাম। পিছনে কেউ আছে কি না! কিন্তু বিশ্বাস করো! কেউ ছিল না! ওই ঘরে শুধু আমরা তিনজন। আমাদের তিনজনের ছায়াগুলো কাঁপছে, নড়ছে। কিন্তু চতুর্থটা একদম স্থির! যেন চুপ করে ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে!”
“তারপর?”
“প্ৰথমে ঘটনাটাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম চোখের ভুল।” পরিতোষবাবুর কণ্ঠে ভয়, “কিন্তু সেদিন রাত্রেই ছায়াটাকে আবার দেখলাম!”
“আবার দেখলেন!”
“হ্যাঁ, দেখলাম তাকে। পিসেমশাইকে নিয়ে তখনও যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, রাতটাও কাটে কিনা সন্দেহ। তাই সেদিন রাতে আমি আই সি ইউ-র বাইরেই বসেছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম অন্তিম মুহুর্তের। তখনই দেখি, দেওয়ালে কার যেন ছায়া! আশপাশে কেউ নেই। কোনও মানুষ নেই। শুধু একটা ছায়া সরীসৃপের মতো চুপিচুপি পিসেমশাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল! দেওয়াল বেয়ে চলল অন্য দিকে। মাথার উপর সার-সার টিউবলাইট আচমকা দপদপিয়ে উঠল! মনে হল, যেন ভোল্টেজ বারবার ফ্লাকচুয়েট করছে! আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছিল! ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। তবু সাহসে ভর করে ছায়াটার পিছু নিলাম। ছায়াটা কিন্তু থামছে না। দেওয়াল বেয়ে সরীসৃপের মত সে চলেছে বার্নিং ওয়ার্ডের দিকে। আমিও পায়ে-পায়ে বার্নিং ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছায়াটা আমার অস্তিত্বকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে সোজা ঢুকে গেল বার্নিং ওয়ার্ডে!”
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন পরিতোষবাবু। সামান্য একটু জল খেলেন। নির্মলবাবু তখনও সাগ্রহে ওঁর কথা শুনছেন।
“আশ্চর্যজনকভাবে পরদিনই আমার পিসেমশাইয়ের অবস্থার দারুণ উন্নতি ঘটল। ডাক্তার বললেন, “মিরাকল!” আমরা সবাই স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম! কিন্তু বিস্ময়ের তখনও কিছু বাকি ছিল!” তিনি কাঁপা গলায় বলেন, “সেদিন সকালেই বুকফাটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল বার্নিং ওয়ার্ড থেকে! জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, যখন আমার পিসেমশাই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছিলেন, ঠিক তখনই বার্নিং ওয়ার্ডের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ছায়াটা যখন বার্নিং ওয়ার্ডে ঢুকছিল, তখন ঘড়ি দেখেছিলাম। সময়টা ছিল ঠিক রাত বারোটা বেজে পয়ত্ৰিশ মিনিট। আর ঠিক ১২টা বেজে ৩৬ মিনিটেই বার্নিং ওয়ার্ডের ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ ওঁর পরিবার এবং ডাক্তাররাও বারবার বলছিলেন, “ভদ্রলোকের মৃত্যুটা সত্যিই আশ্চর্যজনক। কারণ, তাঁর অবস্থা মরে যাওয়ার মতো ছিল না। তিনি দ্রুত উন্নতিও করছিলেন!! অথচ…”
নির্মলবাবু সজোরে হেসে উঠলেন, “এতেই আপনি এত ভয় পেয়ে গেলেন? এ তো হতেই পারে! কত রোগী এভাবে বেঁচে যাচ্ছে! কত রোগী এভাবে মরছে। মেডিক্যাল জার্নালে এরকম গুচ্ছ-গুচ্ছ রেফারেন্স পাওয়া যায়!’
“না ভাই শুধু এটুকুই নয়!” পরিতোষবাবু জানালেন, “এর পরও আমি তাকে দেখেছি।”
“সে কী!” এবার বিস্মিত না হয়ে পারলেন না নির্মলবাবু, “কোথায়?”
“আমাদের অফিসে! সি ই ও-র পিছনে। কনফারেন্স রুমে!”
তিনি থমকে গেলেন। দিনপনেরো আগেই একটা অদ্ভূত অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে ওঁদের অফিসের সিইও মিঃ জগন্নাথ কাপাডিয়ারা ভদ্রলোক স্ত্রী, পুত্ৰ সহ লং ড্রাইভে গিয়েছিলেন। দিঘায় যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু পথেই একটা বিশালদেহী ট্রাক গাড়িটাকে ধাক্কা মারে! অদ্ভুতভাবে মিসেস কাপাডিয়া ও ওঁদের ছেলে রোহন বেঁচে গিয়েছে। বিন্দুমাত্র আঁচড়ও লাগেনি তাদের ওই মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে। কিন্তু মিঃ কাপাডিয়াকে বাঁচানো যায়নি। তিনি স্পট ডেড।
“মনে আছে? লং ড্রাইভে যাওয়ার আগের দিন মিঃ কাপাডিয়া আমাদের সঙ্গে লাস্ট মিটিং করেছিলেন।” পরিতোষবাবু বিড়বিড় করে বলেন, “সেই মিটিংয়ে তুমি ছিলে, আমি ছিলাম, চেয়ারম্যান সাহেব ছিলেন, আর সিইও ছিলেন। আমরা চারজন কথাবার্তাতেই ব্যস্ত, আচমকা আমার চোখ পড়ল দেওয়ালে! যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল! দেওয়ালে আমাদের চারজনের বসে থাকার ছায়া পড়েছে! আর-একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সি ই ও সাহেবের চেয়ারের পিছনে। কিন্তু কোনও মানুষ নেই।”
“সে তো পিওন আবদুলের ছায়াও হতে পারত,” বাধা দিলেন নির্মলবাবু, “ও কফি দিতে এসেছিল কনফারেন্স রুমে!”
“না! ওটা আবদুলের ছায়া ছিল না!” পরিতোষবাবু জোর দিয়ে বলেন, “আবদুল তখনও কফি দিতে আসেনি। তা ছাড়া ওর ছায়া হলে নড়াচড়া করত। কিন্তু ছায়াটা একটুও নড়েনি। স্থির হয়ে ঠিক সি ই ও সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। যেন ও কিছুর অপেক্ষা করছে! আমি নিশ্চিত জানতাম, ও সি ই ও সাহেবকে নিতে এসেছে। আমি মিঃ কাপাডিয়াকে কথাটা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম কথাটা বলার জন্য। উনি বেসমেন্টে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। ছুটিএ পর দৌড়ে গিয়েছিলামও সেদিকে। কিন্তু ততক্ষণে মিঃ কাপাডিয়া গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছেন! আমি অসহায়ের মতো দেখলাম ওঁর গাড়িটা গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! উনি ড্রাইভ করছেন। আর পিছনের সিটে বসে আছে সেই কালান্তক ছায়া! আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না! কিছু করতে পারলাম না! সব শেষ হয়ে গেল আমার চোখের সামনে! আমি জানতাম সব কিছু! কিন্তু কিছু করার আগেই সব শেষ…”
“তারপরও ছায়াটাকে দেখেছিলেন?” নির্মলবাবু প্রশ্ন করলেন।
“হ্যাঁ!” কিচুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন পরিতোষবাবু, :ফের দেখেছিলাম।”
“কোথায়?”
তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ওঁর এই নীরবতা অসহ্য লাগছিল নির্মলবাবুর। অদ্ভুত সেই নীরবতার মধ্যে যেন হৃদস্পন্দনের আওয়াজও শোনা যায়। শোনা যায় ঘড়ির টিকটিক শব্দ। এক রকম অসভ্যের মতোই সেই নীরবতা ভেঙে জোরাল গলায় প্রশ্ন করলেন তিনি, “কোথায় দেখেছেন?”
ওঁর এই তীব্র প্রশ্ন যেন ঘরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে-হতে ফিরল, ‘কোথায়… কোথায়…’
পরিতোষবাবু চুপ করে থাকলেন। যেন প্রতিধ্বনিটাকে মিলিয়ে যেতে দিলেন। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, তোমার বাইকের পিছনে।”
“কী!” নির্মলবাবুর কন্ঠে বিস্ময়, আমার বাইকের পিছনে! করে?”
“শেষ যেদিন অফিসে গিয়েছিলাম সেদিন!” পরিতোষবাবু বললেন, “সরি ভাই, তোমাকে আমার বলা উচিত ছিল! সেদিন যখন তুমি হাফ লিভ নিয়ে চলে যাচ্ছিলে, সেদিন তোমার বাইকের পিছনে বসেছিল সে। তুমি আমায় হাত নাড়িয়ে বাই-বাই করছিলে! আর আমি দেখছিলাম, তোমার বাইকের পিছনে বসে চলে যাচ্ছে সেই সর্বনেশে ছায়া! আমি শুধু দেখলাম! আমার কিছু করার ছিল না। সরি ভাই!”
“কী বলছেন যা তা!” ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠেন নির্মলবাবু, “এখন আপনি এসব গালগল্প বলে আমায় ভয় দেখাচ্ছেন!”
“ভয়ের জগতে যে তুমি আর নেই নির্মল!” পরিতোষবাবু বিষগ্ন স্বরে বললেন, “এখন তুমি সব ভয়ের উর্ধের্ব!”
“আমি বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করি না আপনার কথা!” তিনি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠেন, “আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমি এখানে জলজ্যান্ত বসে আছি, আর আপনি কিনা…”
আচমকা হাতের টর্চটা জ্বেলে নির্মলবাবুর ছায়ামূর্তির উপরে ফেললেন পরিতোষবাবু! হ্যাঁ! তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক। দেওয়ালে স্পষ্ট দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে। মুখোমুখি সোফায় বসে আছে তারা! অথচ তাঁর সামনের সোফায় কেউ নেই। শুধু দেওয়ালে পড়ে আছে নির্মলের ছায়া! অথচ মানুষটা নেই!
“কী দেখছেন।” শূন্য থেকে নির্মলের গলার আওয়াজ ভেসে এল! দেওয়ালের ছায়াটা অশান্তভাবে নড়ে উঠেছে, “কী দেখছেন অমন করে?”
বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পরিতোষবাবু। নির্মলকে বোঝানো যাবে না! শত বললেও তিনি বিশ্বাস করবেন না। তাই একটু চুপ করে থেকে বললেন তিনি, “কিছু না। ছায়া!”
……………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………….