‘ও রে ব্বাপরে! কী সাংঘাতিক হাড় কাঁপানো ঠান্ডা! সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট পরা, তারপরেও একটা চাদর মুড়ি দেওয়া। মাথায় কান ঢাকা টুপির ওপর মাফলার জড়ানো। তাতেও ঠান্ডা যেন কিছুতেই বাগ মানছে না।
উত্তর দিক থেকে হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে, শিশিরের ফোঁটা জমে গিয়ে জল হয়ে টপ্ টপ্ করে গায়ে মাথায় পড়ছে; সব মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেন যে মরতে এই মাঝরাতে লেপের গরম ছেড়ে বেরোবার কথা ভেবেছিলুম জানি না। কিন্তু তখন তো আর কিছু করার নেই। বেরিয়ে যখন পড়েছি… কী ব্যাপার রে পল্টু? চা কি এখনও হয়নি?’
এই, এই হল রায়সাহেবের দোষ।
গরম চায়ে চুমুক না দেওয়া অবধি রায়সাহেব কিছুতেই ঠিকমতো মুখ খুলতে চান না। এদিকে গপ্পোটা সবে জমে উঠছে। এই সময়ে এমন বেয়াড়া ব্রেকিং সহ্য করা যায়? অতএব আমরাও সমস্বরে চেঁচিয়ে বলি, ‘কী হল পল্টুদা? চা-টা দাও!’
‘এই যে, এই যে, এসে গেছে গরমাগরম দার্জিলিং টী’, বলতে বলতেই ট্রেতে চায়ের ভাঁড় সাজিয়ে নিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পল্টুদা। পরপর নামিয়ে দিল আমাদের সামনে উঁচু বেঞ্চির ওপর। রায়সাহেব সেই আগুন-গরম ভাঁড় হাতে তুলেই দিব্যি একটা চুমুক দিয়ে খোশমেজাজে বলে উঠলেন, ‘আঃ! এই নাহলে পল্টুর হাতের চা! দীর্ঘজীবী হয়ে থাক্ বাবা, আর দীর্ঘজীবী হোক তোর কফি হাউস।’
আমরা সবাই হো-হো করে হেসে উঠলুম। কারণ সত্যিই পল্টুদার এই চায়ের দোকানের নাম ‘কদমতলা কফি হাউস’, যদিও কফি নামের বস্তুটি এখানে খুবই দুর্লভ। তবে হ্যাঁ, কলকাতার নামজাদা কফি হাউসের মতো এটাও এ অঞ্চলের একটা জমজমাট আড্ডাখানা বটে। দোকানটা একদম বাজারের পাশেই, ফলে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়েসের টিম এখানে এসে আড্ডা জমায়, আর দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে দেয়।
ঠিক তেমনই একটা দল হলুম আমরা। সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাখা গজিয়েছে, তাই রোজ সন্ধেবেলা নিয়ম করে এখানে আসা শুরু করেছি। বড় হবার মজা নিচ্ছি আর কী! আর এখানে এসেই আমরা আবিষ্কার করেছি এই মহাবিস্ময় রায়সাহেবকে।
ভদ্রলোকের পুরো নাম কী তা জানার সুযোগ হয়নি কখনো। পাড়ার ছোট থেকে বড় সকলের কাছেই তিনি রায়সাহেব, তাই আমরাও তাঁকে রায়সাহেব নামেই ডাকতে শুরু করেছি, আর কখন কোন্ ফাঁকে যে তিনি আমাদের মন কেড়ে নিয়েছেন জানতেও পারিনি। অথচ বেশি নয়, সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন তিনি দেখা দেন এই আড্ডাখানায়, আর যখন যেমন পরিবেশ থাকে, ঠিক তারই মানানসই করে তাঁর ঝুলি থেকে বের করে আনেন এক একটি জম্পেশ গপ্পো, তাঁর ভাষায় জীবনের জলজ্যান্ত ঘটনা।
ঠিক সেইরকমই একটা দিন হল আজকের দিনটা। বিকেল থেকেই চেপে শীত পড়েছে। আকাশটাও মেঘলা। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার। আমরা একে একে দোকানে ঢুকে বেঞ্চি দখল করে একপ্রস্থ চা খেয়েছি কি খাইনি, এমন সময় লোডশেডিং। পল্টু একটা মোমবাতি জ্বেলে এনে বেঞ্চির ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। সেই ভুতুড়ে আলোয় আমাদের ছায়াগুলো চারদিকের দেওয়ালে কাঁপতে থাকল।
ঠিক এই মোক্ষম মুহূর্তে রায়সাহেব ঢুকলেন, আর একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়েই ঘোষণা করলেন, ‘বাঃ! কী অসাধারণ পরিবেশ! তোদের দেখে যে আমার সেই উত্তরপ্রদেশের প্রেতগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে রে!’
ব্যস! আর যায় কোথায়? এতক্ষণের জড়োসড়ো ভাব পলকে উধাও। নতুন গপ্পো দরজায় এসে কড়া নাড়ছে বুঝতে পারলাম।
হৈ হৈ করে সবাই মিলে রায়সাহেবকে তোয়াজ করে বসাই। তারপর তাঁকে ঘিরে এগিয়ে বসি আমরা পাঁচজন। দরজা দিয়ে বেশ ভাল হাওয়া ঢুকছে। তার মানে ঠান্ডাটা বাড়ছে। তার সঙ্গে লোডশেডিং।
এবার পাল্লা দিয়ে একটা ভূতের গপ্পো। একেবারে সোনায় সোহাগা।
সুতরাং শুরু হয়ে গেল রায়সাহেবের গপ্পো, থুড়ি, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
* * * * *
ইতিমধ্যে চা এসেছে। তারপর রায়সাহেবের কথায় আমাদের হাসির পাল্লা। হাসি থামলে রায়সাহেব মুখটা গম্ভীর করে বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, তারপর শোন্। বেনারসের বাস তো আসবে সাড়ে এগারোটায়। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তার পাঁচ মিনিট আগেই…’
‘এক মিনিট রায়সাহেব, এক মিনিট’, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ঋজু। রায়সাহেব থমকে গিয়ে ওর দিকে তাকালেন।
ঋজু বলল, ‘এরকম মাঝখান থেকে গল্প শুরু করলে চলবে? প্রথম থেকে বলুন!’
রায়সাহেব বললেন, ‘ও, আগের কথা কিছু বলিনি বুঝি? বেশ তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করা যাক।’
এই বলে রায়সাহেব পায়ের ওপর পা তুলে গুছিয়ে বসলেন। তারপর ভাঁড়ের শেষ চা-টুকুতে চুমুক দিয়ে ভাঁড়টা বেঞ্চিতে রেখে বলতে শুরু করলেন, ‘তখন আমি একটা বেসরকারী কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলাম, বুঝলি? প্রায়ই নানা অর্ডার ধরতে এখানে সেখানে যেতে হত। তা সেবার একটা বড়সড় অর্ডারের ব্যাপারে যেতে হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের রেনুকুট শহরে। ছোট পাহাড়ি শহর। সারাদিনে একটাই মাত্র ট্রেন সেখানে যাতায়াত করে। তার নাম শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস।
কিন্তু জায়গাটার সিনিক বিউটি দারুণ। আর শীতকালে ওয়েদারটাও খুব ভাল থাকে সেখানে।
‘তা আমি যে কোম্পানীতে গিয়েছিলাম, তার কাছেই আমাদের নিজেদের কোম্পানীর একটা গেস্ট হাউস ছিল। একটা নেপালী ছেলে ছিল তার কেয়ারটেকার। খুব ভাল ছেলে। আর তার বাংলা কথা শুনলে কে বলবে যে সে নেপালী!’
‘তা যাই হোক, প্রথম দুদিনে কাজ প্রায় সব গুছিয়েই এনেছিলাম, তবু শেষ পর্যন্ত একটা সামান্য কাজ বাকি রয়ে গেল, যার জন্যে পরের দিনটাও থেকে যেতে হল, আর সেইটাই হল আমার ভাগ্যের ফের। ঐ শেষদিনের বাকি কাজটুকুর জন্যেই সব প্ল্যান ওলটপালট হয়ে গেল, আর তার ফলেই সেই…’
‘কী? ভূত?’ আমরা প্রায় সবাই একসঙ্গে বলে উঠি।
রায়সাহেব ফিক করে হেসে বললেন, ‘এ কী রে? এত তাড়াতাড়ি ভূত কোত্থেকে আসবে? দাঁড়া, সবটা শোন্ আগে!’ বলে দু-এক মুহূর্ত থেমে বোধহয় একটু স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘পরের দিনটা ছিল শনিবার। আমি জানতাম, যা কাজ আছে, তা বেলা বারোটার মধ্যেই হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন আর ফেরা যাবে না। কারণ ওখান থেকে ফেরার ট্রেন একটাই, সকাল সাড়ে এগারোটায়। তারপর সারাদিনে আর ট্রেন নেই। কাজেই পরের দিন রবিবার ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরতে সেই সোমবার সকাল। তার বদলে আমি যদি সেই রাত্রেই বাস ধরে বেনারস চলে যাই, আর রবিবার সারাদিন বেনারসটা ঘুরে নিয়ে সেখান থেকেই রাত্রের ট্রেন ধরে ফিরি, সেই একই সময়ে, মানে সোমবার সকালেই আমি পৌঁছে যাব কলকাতায়। মাঝখান থেকে বেনারসটা আমার ঘোরা হয়ে যাবে।’
‘অবশ্য তখন তো আমি এসব কিছুই জানতাম না। ওদিকের জায়গাগুলো চিনতামও না সেভাবে। এই প্ল্যানিংটা আমায় দিয়েছিল গেস্ট হাউসের সেই নেপালী ছেলেটি।
আমিও টগবগে উত্তেজনায় সেই প্ল্যান শুনেই লাফাচ্ছিলাম।’
‘কিন্তু তারপর, শনিবার রাত্রে বেনারসের বাস ধরার জন্যে গেস্ট হাউস থেকে বাইরে বেরোতেই বুঝলাম কী ভুলটা করেছি। বাপরে! সে কী সাংঘাতিক শীত! গায়ের সমস্ত গরম জামা ভেদ করে ঠান্ডা ঢুকে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মুখের ভেতর অর্কেস্ট্রা বাজছে, আর শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে। কোনরকমে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম, আর তার কিছুক্ষণ পরেই বাস আসতে লাফিয়ে বাসের ভেতর ঢুকে পড়তে মনে হল, এবারের মত বোধহয় প্রাণে বেঁচে গেলাম।’
এতটা বলে দম নেবার জন্যে রায়সাহেবচুপ করলেন। আমরা এতক্ষণ আর কোন কথাই বলিনি। এবার রায়সাহেবকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অয়ন শুধু বলে উঠল, ‘তারপর?’
রায়সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর কিছুটা যেন অন্যমনস্কভাবে বলতে শুরু করলেন, ‘বাসটা রেনুকুট থেকে বেনারস যেতে সময় নেয় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা।
মাঝে একবার শুধু একটা ধাবায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। অর্থাৎ সাড়ে এগারোটার বাসটা বেনারস গিয়ে পৌঁছবে ভোর পাঁচটা নাগাদ। আমি টিকিট কেটে একটা জানলার ধারের সীটই পেলাম। সঙ্গের স্যুটকেশটা মাথার ওপর বাঙ্কে তুলে দিয়ে চাদর টাদর মুড়ি দিয়ে বেশ জমিয়ে সেট হয়ে বসলাম নিজের সীটে। এবার জমিয়ে একটা ঘুম লাগাতে হবে। এক ঘুমেই পৌঁছে যাব বেনারস। তারপর কোন একটা ধর্মশালায় উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। আঃ! তোফা!
‘কিন্তু হা হতোস্মি! ঘুম হবে কী! বাসের মোটা মোটা কাঁচের জানলার কোণ দিয়ে যে তীক্ষ্ণ হাওয়ার কণাগুলো ঢুকে পড়ছে, তা শরীরের যেখানেই এসে পড়ছে, যেন ইঞ্জেকশান ফোটার অনুভূতি। একবার করে ঝিমুনি আসছে, আবার সেই ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ সে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে।’
‘এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সজাগ হয়ে দেখি, বাসটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু দাঁড়ালো কোথায়? এর মধ্যেই সেই ধাবায় এসে গেল নাকি? না, চারিদিকে তো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! জানলার একটা পাল্লা তুলে দেখি, খুব দূরে দু-একটা আলোর রেখা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে টুকটাক করে একটা দুটো লোক দেখি বাস থেকে নামছে। আমিও ভাবলাম, একটু নেমে হাত পা ছাড়িয়ে নিই। এই ভেবে বাস থেকে নামলাম। ফাঁকা ধূ ধূ রাস্তা। যারা নেমেছিল, তারা রাস্তার এপাশে ওপাশে প্রাকৃতিক কর্ম সারছে। আমিও সেই একই উদ্দেশ্যে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বাসের পেছন দিকটায় গেলাম। আর সেটাই হল আমার কাল।
হঠাৎ কোন জানান না দিয়েই বাসটা গর্জে উঠল, আর পরক্ষণেই শাঁইশাঁই করে ছুটল রাস্তা ধরে।’
‘আমার অবস্থাটা তখন বুঝে দেখ।
দুদ্দাড় করে ছুটছি বাসের পেছনে, আর প্রাণপণে চিৎকার করছি গলা ফাটিয়ে। কিন্তু শুনবে কে? বাসের জানলা দরজা সব তো চেপেচুপে বন্ধ! ড্রাইভার বা কন্ডাকটার কেউ জানে না যে আমি বাইরে রয়ে গেলাম, কারণ কাউকে বলে তো নামিনি! নিমেষের মধ্যে আমার স্যুটকেশ কোলে নিয়ে কোন্ অন্ধকারে হারিয়ে গেল বাসটা, আর আমি অজানা কোন্ জায়গায় শুনশান রাস্তার মধ্যে দিশাহীন জাহাজের মতো টাল খাচ্ছি।’
‘নিজের বোকামির জন্যে নিজেকেই তখন তেড়েফুঁড়ে গালাগাল দিচ্ছি, আর ভাবছি এবার কী করা যায়। চারপাশে কোথাও কোন আলোর চিহ্ন নেই। অর্থাৎ এইসব দূরপাল্লার বাস এখানে ভুলেও দাঁড়াবে না, বিশেষ করে এই দুর্দান্ত শীতের রাত্রে তো নয়ই। যদিও আমার নিজের ঠান্ডার অনুভূতি তখন উধাও হয়ে গেছে। উল্টে আমি তখন রীতিমতো ঘামছি, টেনশানে আর দুশ্চিন্তায়। স্যুটকেসের মধ্যে আমার সব জামাকাপড় আর কাগজপত্র, কিছু টাকাও আছে। কিভাবে আবার সেই বাসটাকে খুঁজে পাবো? আদৌ আর পাবো কি?’
‘এইসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা ধরে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে, আর মাঝে মাঝে পেছনদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, যদি কোনও বাসের আভাষ পাই, যদি কোনভাবে সে-বাসকে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু কোথায় কী? যেদিকেই তাকাই, বাস কেন, জনপ্রাণীরও চিহ্ন নেই কোথাও। ঠিক এই সময় প্রায় আধমাইল দূরে একটা আবছা আলোর রেখা দেখতে পেলাম। প্রাণ যেন নেচে উঠল। আলোটা রাস্তার ডানদিকে খানিকটা দূরে। মনে হল রাস্তার পাশেই হবে। তড়বড় করে পা চালালাম।’
‘হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে দেখি, আলোটা জ্বলছে একটা পেট্রল পাম্পের মাথায়। একপাশে আবছা অন্ধকারে একটা চৌকির ওপর বসে চারটে লোক গুলতানি করছে।
মাঝখানে কয়েকটা গেলাস আর পানীয়। আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হল লোকগুলো। খুব স্বাভাবিক। এই গভীর রাতে আমার মত একজন ভিনদেশী লোক! তাদের চেহারাগুলোও রীতিমতো ভয় লাগার মতো। অন্ধকারের মধ্যে গা শিরশির করে উঠবে তাদের দেখলেই। কিন্তু আমি তো নিরূপায়। ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে আমার কথা বললাম। মনে হল, আমার কথা শুনে যেন হঠাৎ একটা হিংস্র আনন্দ ভেসে উঠল লোকগুলোর মুখে। দেখে কেমন একটা অজানা ভয় গুড়গুড়িয়ে উঠল মনের মধ্যে।
সাংঘাতিক চেহারার চারজন লোক, এদিকে আমি একা। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে পকেটের শেষ সম্বল টাকাগুলো কেড়ে নেয়? দেখলাম, আমার কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না তারা। তার বদলে তারা এক এক করে গা ঝাড়া দিয়ে চৌকি থেকে ওঠার চেষ্টা করছে। বুঝলাম মতলব খারাপ। এই মুহূর্তে ছুটে না পালালে আর উপায় নেই। কিন্তু কোথায় পালাব? ওদের হাত থেকে কি পালাতে পারব? ভাবতে ভাবতে এক পা এক পা করে পেছোচ্ছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তেই একটা জিনিষ দেখে অবাক হয়ে গেলাম, আর আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে এল, আর বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা উথালপাথাল হতে আরম্ভ করল। লোকগুলো চৌকি থেকে উঠছে না, যেন হাওয়ায় ভেসে উঠে আসছে আমার দিকে। ওদের মুখগুলো এক নিমেষে বদলে কেমন লম্বামতন হয়ে গেছে, আর প্রত্যেকের মুখের পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো করে শ্বদন্ত।’
‘আতঙ্কে পরিত্রাহি চিৎকার করে দৌড় মারলাম বড়রাস্তার দিকে।
আমার বুকটা ধড়ফড় করছে মাথা কাটা জিওল মাছের মত, গা হাত পায়ে কোন জোর নেই। ওদিকে রাস্তার ওপর কি কোন আলো দেখা যাচ্ছে? যেন পাশাপাশি দুটো আলো এগিয়ে আসছে না এদিকেই? ওটা কি বাসের আলো? যে করেই হোক, ওটাকে থামাতেই হবে। আমি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাগলের মত হাত নাড়তে লাগলাম, আর চেঁচাতে লাগলাম। কী আশ্চর্য, বাসটা দাঁড়িয়েও গেল। কন্ডাকটার বাসের দরজা খুলে নেমে এল রাস্তায়।
যাত্রীরাও কেউ কেউ নেমে পড়ে অবাক চোখে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। আমি তখন উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছি।
কিন্তু মনের জোর আবার ফিরে পেয়েছি। হাঁফাতে হাঁফাতেই ছোট করে ঘটনাটা বললাম। আর বলার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য, সবাই দেখলাম বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে লাগল।
কন্ডাকটার একটু হেসে বলল, ‘আদমী কাঁহা হ্যায় বাবু? আপ খুদ দেখিয়ে না! ওঁহা হ্যায় কুছ?’ লোকটা আঙুল দেখাচ্ছিল আমার পেছনদিকে, যেখান থেকে আমি একটু আগেই ছুটে পালিয়ে এসেছি। সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আধো অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে, একটা আদ্যিকালের ভেঙে পড়া পেট্রল পাম্প, যেখানে আলো জ্বলা দূরে থাক, গত তিরিশ বছরে কেউ পা রেখেছে কিনা সন্দেহ। অবিশ্বাসে, আতঙ্কে আমার দম বন্ধ হয়ে এল। এতক্ষণের উত্তেজনা শরীর আর নিতে পারল না। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।’
এতক্ষণের পর থেমে একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন রায়সাহেব। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিল্টু যেন ঝাঁপিয়ে উঠে বলে ফেলল, ‘তারপর?’
বিল্টুর কথায় আমরাও যেন সঙ্গে সঙ্গে হুঁশ ফিরে পেলাম, আর তখনই বুঝলাম, আমরা এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাস হয়ে ছিলাম।
রায়সাহেব বললেন, ‘তারপর আর কী? একটু পরেই জ্ঞান ফিরে এল। ওরা বেশ যত্ন করে জলটল দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল। আর রাত তিনটে নাগাদ মাঝরাস্তার সেই ধাবায় গিয়ে আমার বাসটাকেও খুঁজে পেয়েছিলাম। সরকারী বাস ছিল, আর তার টিকিটও আমার পকেটে ছিল, তাই আর কোন অসুবিধা হয়নি।’
ঋজু বলল, ‘কিন্তু সেই পেট্রল পাম্পের রহস্যটা? সেটা কিছু জানা গেল না?’
‘তা জানা গেল বৈকি’, রায়সাহেব বললেন, ‘বাসের লোকেরাই জানাল যে, বহুদিন আগে ঐ পেট্রল পাম্পে এরকমই এক শীতের রাতে ভয়ঙ্কর এক ডাকাতি হয়। ডাকাতরা শুধু লুঠই করেনি, সেদিন সেখানে থাকা চারজন লোককে তারা খুন করে রেখে গিয়েছিল সাক্ষী লোপাট করার জন্যে। সেই থেকে ঐ জায়গাটায় রাতবিরেতে কেউ পা রাখলেই তাদের দেখতে পায়, আর পরের দিন তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। আমার চরম সৌভাগ্য যে আমি ওদের কবল থেকে জ্যান্ত ফিরতে পেরেছি।’
আমরা চুপ। পুরো গল্পটা আমাদের থমকে দিয়েছে। কেউ কোন কথা বলছি না।
ঠিক এই সময় কারেন্টটা চলে এল। আমরা সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম। যেন এই দমবন্ধ করা অবস্থা থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপরেই তাকিয়ে দেখি, আরে! রায়সাহেব নেই। এই অন্ধকারের মধ্যেই কখন যেন বেরিয়ে গেছেন নিঃসাড়ে। পল্টুদা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘হ্যাঁরে। রায়সাহেব কোথায় গেলেন? এই তো গল্প বলছিলেন!’
ঋজু বলল, ‘আমরাও তো তাই দেখছি। চুপচাপ হাওয়া হয়ে গেছেন।’
পল্টুদা বলল, ‘দেখলি! আজকেও চায়ের পয়সা না দিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেলেন।’
আমরা সবাই মিলে হো হো করে হেসে উঠলাম।
………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………