জলের তলে

জলের তলে

গত বারে পূজোর আগেই মামাতো ভাই , বিল্টু ফোন করলো….” সারা জীবন তো শহরের পূজো দেখলে , এবারে আমাদের গ্রামের পূজো একবার এসে দেখে যাও..” !
আমি সেবার মামার মৃত্যুতে ওদের ওই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দ পুরে গিয়েছিলাম ! বিংশ শতাব্দীর ছোঁয়া একটুও লাগেনি ! বর্ধমান স্টেশন থেকে বাসে কাটোয়ার দিকে প্রায় আধ ঘন্টা যেতে হয়…তারপর সেখান থেকে ভ্যান রিকশা …অবশেষে বাকি পথটুকু হন্টন..!
তবে হ্যাঁ…যারা গ্রাম ভালোবাসে , তাদের জন্যে আদর্শ জায়গা l মামা চিরকাল ক্ষেত খামার …চাষ বাস নিয়েই কাটিয়েছে , বিল্টুও তাই l আমাদের মতো শহুরে মানুষদের দু একদিন ভালো লাগবে…l
সবুজ ধান ক্ষেত….মরাই…গোয়াল ভরা গরু….বড়ো বড়ো মাছ ভর্তি পুকুর…তাজা হাঁস মুরগির ডিম……..

বটের ছাওয়া…বাঁশ বন…..শেয়ালের ডাক….কাশ ফুলের বাহার….শিউলি ফুলের গন্ধ…জিভে জল আনা খেজুর রস আর গুড় ….আরও কত কি আছে !
…..শুধু নেই , আলো জ্বালা রাস্তা ঘাট….সিনেমা…হোটেল রেস্টুরেন্ট ….শপিংমল….এসি..
ফ্রিজ ….ফোনের টাওয়ার l আমি জানিনা এই পাঁচ বছরে কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি না ?
ওর আবদার সন্তপর্নে পাশ কাটাবার চেষ্টা করলাম !
” আমি চেষ্টা করবো …তবে কথা দিতে পারছি না ” !

” জানি…তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো ? ” ও প্রান্ত থেকে ওর চিন চিনে গলা ভেসে আসে ” আরে ! দুদিনের জন্যে এলে , এমন কিছু গাঁইয়া হয়ে যাবে না…” ! ও আমার সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে চাইছে l যাতে আমি রাজী হই ! …এখানকার পূজো ছেড়ে…আমোদ আহ্লাদ ত্যাগ করে…ওই জন মানব হীন ….রাতে লো ভোলটেজের আলো…নেট নেই…ধূর,পোষাবে না…!
” কিছু মনে করিস না..পরে একদিন যাবো , তাছাড়া ছেলে …পূজোর কদিন আসে , মুম্বাই থেকে..” !
অভিমানী গলায় বললো ” খুব আশা করেছিলাম, পূজোর কটা দিন গল্প করে কাটাবো..” আসলে ও আর আমি তিন চার বছরের ছোট বড়ো…ছোটবেলা থেকে কেন জানিনা ও আমার খুব অনুগত ছিল ! ওরা গ্রামাঞ্চলে থাকে বলেই হয়তো , আন্তরিকতাটা এখনও হারিয়ে যায়নি !
” রাগ করিস না , শীতের দিকে তোর বৌদিকে নিয়ে যাবো ”
” তুমি আর এসেছো ! সেই বাবা মারা যাবার পর থেকে এই পাঁচ বছরে সময় হলো না…” মোক্ষম বলেছে..কি উত্তর দোব ? কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম l
” বাবা..তোদের এখন ওখানে অনেক উন্নতি হয়েছে l এতক্ষন কথা বলছিস…টাওয়ার আছে তাহলে !! ”
” সে গুড়ে বালি , আমি বর্ধমান এসেছি…জমির সার কিনতে ”
” তাই বল , তোরা বরং একবার ঘুরে যা..”
” তুমি তো জানো, আমি একদিন গেলেই এখানে অন্ধকার….আচ্ছা, তোমার ভূতের গল্প লেখার নেশাটা এখনও আছে ?” খটকা লাগলো ! হঠাৎ এ কথা কেন ?
” তা এখনো একটু আধটু লিখি…”
” সে জন্যেই আসতে বলছিলাম …এখানে এলে গল্প লেখার খোরাকটা পেতে..” আমার কান সজাগ হলো l
” কেন ? ওখানে আবার কি খোরাক আছে ? ”
” ….একটা জিনিস তোমায় দেখাবো আর শোনাবো , যাতে করে তুমি একটা ভালো স্টোরি পেয়ে যাবে..”
” কি দেখাবি আর শোনাবি , কোন বস্তা পচা পুরোনো ভূতের গল্প..আর তার সাথে মিলিয়ে কিছু নিদর্শন ..তাইতো ?,” তুই ওই বলে আমাকে ভোলাচ্ছিস l
” মা কালীর দিব্যি , বিশ্বাস করো ! তুমি পূজোর মধ্যে দুদিনের জন্যে এস ! …তোমাকে একটা অভিশপ্ত পুকুর…আর এক বিদেহী আত্মা দেখাতে চাইছি… l কয়েকজন ছাড়া , ব্যাপারটা কেউ জানে না l জানলেও , ভয়ে কানাকানি করে না ! আমি সবে মাত্র জেনে ফোন করেছি ” …আমার পুরোনো রোগ মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে l উত্তেজনার সঙ্গে কৌতূহল মিশছে l ঠাকুরের দিব্যি খেয়ে বিল্টু আমাকে অন্তত ভড়কি মারবে না ! তবে কি কিছু আছে ? …গোবিন্দপুর হাতছানি দিচ্ছে l
” একটু খোলসা করে বল ..অতটা পথ গিয়ে…যদি দেখি…..ভাঁওতা..”
ও মনে হয় আমার কথায় ক্ষুন্ন হলো ” তুমি ছোট বেলায় পানি মুড়ার নামশুনেছ ?” মনে পড়ে গেলো..একধরণের জলভূত ….পুকুরের পাড়ে থাকতো…কিন্তু সে তো গল্প !

” দ্যাখ ভাই ঝেড়ে কাশ, ব্যাপারটা কিরকম ধোঁয়াটে লাগছে ”
বোধ হয় অনেকক্ষন কথা বলা হয়ে গেছে দেখে , ও শেষ টানতে চাইলো l সত্যি তো বিল উঠছে ওর l
” ..তোমাকে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি…নিরাশ হবে না l কেননা আমিও কিছুটা স্বাক্ষী আছি l এবং ইতিমধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেছে …জানিনা এরপর কি ঘটবে.. l রাজী থাকলে জানিও, বর্ধমান স্টেশোনে তোমার জন্যে ওয়েট করবো..” লাইন ছেড়ে দিলো l
￰ভাবনায় ফেলে দিলো ! এতদিন বাদে এরকম একটা সংবাদ….আধুনিক সভ্যতায় যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ! ওর কথাগুলো মনে মনে সাজালাম …..পুকুর….পানি মুড়া..
..বিদেহী আত্মা…অঘটন…স্বাক্ষী.. !!

……….পূজো আসতে এখনো দিন বারো বাকী l এর মধ্যে আরও কিছু তথ্য জানা দরকার l গ্রামের মানুষ এমনিতেই তিল কে তাল করে ! স্ত্রীকে বলে রাখলাম ! ও অবাক হয়ে গেলো l বললাম …ও একেবারে নাছোড় বান্দা, জানোই তো l আসল কথাটা উহ্য রাখলাম l ছেলে অতদিন বাদে আসবে… l একটু তানানা করছিলো ! বললাম , দুদিনের ব্যাপার… l
….. দিন তিনেকের চেষ্টায় বিল্টুর লাইন পেলাম…যেটুকু কেটে কেটে কথা হলো তার সারমর্ম হচ্ছে..l
ওদের গোবিন্দপুর থেকে কিছুটা দূরে….দীঘির ধার বলে একটা জায়গা আছে l সেখানে পালবাড়ীর বড়ো বউ এক বছর আগে …ওদের বাড়ীর সামনের পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে, পারিবারিক কারণে ! তারপর থেকেই…পুকুরে শুরু হয় নানান উৎপাত ! হঠাৎ হঠাৎ মাছ মরে ভেসে ওঠে…..জলের মাঝে বড়ো বড়ো বুড়বুড়ি কাটে ! ধারে কাছে যা দুএকটা বাড়ী আছে, সেখানে বেশীর ভাগ সময় অসুখ বিসুখ লেগে আছে l সন্ধ্যে বেলা পালবাড়ির কেউ কেউ বড়ো বৌকে পুকুরের কালো জলে ভেসে থাকতে দেখেছে l আবার কখনও বা পুকুর ঘাটে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে ! একদিন ঘাটের পাশে গাব গাছে পা ঝুলিয়ে বসেছিল…আর একটা কি বলতে গিয়েই বিল্টু ঢোঁক গিলে ফেললো l এতে রহস্য আরও ঘনীভূত হলো !
…..এরপরে অপেক্ষা বা না যাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই..l পাকা কথা দিয়ে দিলাম…..অষ্টমীর দিন সকালে যাচ্ছি….l ও বর্ধমান স্টেশনে অপেক্ষা করবে জানালো l

অষ্টমীর দিন বেলা বারোটার মধ্যে বিল্টুর সঙ্গে ওর বাড়ী পৌছালাম l ওর বউ রিনা আর মেয়ে, হাসি মুখে আপ্যায়িত করলো l রিনার জন্যে শাড়ি , আলতা, সিঁদুর , মিষ্টি আমার গিন্নী পাঠিয়ে দিয়েছিলো l আমি ওর মেয়ের হাতে হাজার টাকা দিলাম l খুব খুশী হলো ! সাদাসিধে জীবন ও মন গুলোও পরিষ্কার…অল্পতে খুশী হয় l অবশ্য , কিছু জায়গায় শহুরে বিষ ঢুকতে শুরু করেছে l অনেক রান্না বান্না করেছিল… l
বিকালে ঠাকুর তলায় …গ্রামের একমাত্র দূর্গা প্রতিমা দেখাতে নিয়ে চললো বিল্টু l পথে বেরিয়ে এই প্রথম আসল বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেলাম l কেননা, ও পই পই করে বলে দিয়েছিল…বাড়ীতে মুখ না খোলার জন্যে ! স্টেশন থেকে আসার সময়ও বাসে ভীড়ের জন্যে কথা বলা যায় নি l
ঠাকুর প্রণাম করে…একটা চায়ের দোকান থেকে দু ভাঁড় চা নিয়ে, পাশেই ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ালাম l
চায়ে চুমুক দিয়ে বিল্টু বললো ” তুমি সাইকেল এখনও চালাও তো ? “, ভুরু কুঁচকে ঘাড় নাড়লাম !
” কাল বিকেলে দুটো সাইকেল নিয়ে…বন্ধুর বাড়ীর নাম করে বেরোবো ”
” এখান থেকে কত দূর ? এখানকার যা রাস্তার অবস্থা…তার ওপর সাইকেল ! ” হাতে চায়ের ভাঁড় l
” একটু চেনা টেনা বাঁচিয়ে যেতে হবে …নাহোলেই প্রশ্নের ঝড় ” ও খালি ভাঁড় টা পাশে ফেলে দিলো l
” গ্রামের এই ব্যাপারগুলো এখনও যায়নি..কোথায় যাচ্ছো ? …কেন যাচ্ছো ? কি দরকার ? নাজেহাল করে দেবে..পরক্ষনেই বাড়ীতে খবর চলে যাবে..” ও একবার এদিক ওদিক তাকালো l
” কতক্ষন লাগবে সাইকেল করে যেতে ? ” চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম l
” মিনিট কুড়ি লাগবে.. সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাবো ” গলার স্বর একটু নামিয়ে বললো l
” তুই এর আগে গিয়েছিলি ? বা কিছু দেখেছিস ?”
” পুকুরপাড়ে সকালে গেছি..রাত্রে ? অত সাহস বুকে নেই ! শুধু তোমার জন্যেই যাওয়া ” ওর চোখে মুখে একটা রহস্য খেলা করছে !
” জানি , ছোটবেলা থেকেই আমার ভক্ত ছিলিস..” সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়া ছাড়লাম.. ” আচ্ছা, তুই সেদিন ফোনে কি একটা বলতে গিয়ে ঢোঁক গিল্লি বলতো ? ”
আবার একবার এপাশ ওপাশ তাকিয়ে গলাটা আরও খাদে নামিয়ে বললো ” গত চার মাস আগে…পাল বাড়ীর মেজো বৌটাকেও …..টেনে নিয়ে গিয়ে বড়ো বৌটা , পুকুরের পাশে নরম কাদামধ্যে মাথা ঢুকিয়ে মেরেছে !”

সিগারেটের ছাই ঝাড়লাম l মনের মধ্যে কথার কাটা কুটি চলছে l ” কোন মানুষের কাজ নয় তো ? ভূতের গল্প ফেঁদে খুন করছে..” !
” ….তাহলে তোমাকে ডাকতাম না….পুলিশরাই ব্যবস্থা নিতো ” ওর গলাটা একটু চড়লো l
” এতো শিওর হচ্ছিস কি করে ? ” শেষ টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিলাম l ও একটু চুপ করে রইলো l
” পাল বাড়ীর মেজো ছেলে নির্মল , যার বউ মরেছে …সে আমার বন্ধু ! ” সোজাসুজি আমার মুখের দিকে তাকালো..” গত পাঁচ মাস ধরে প্রতিটি কথা ও আমায় বলেছে..” l আমার জানবার ইচ্ছে ক্রমশ বাড়ছে..এতো দেখছি , ছাই চাপা আগুন !
” দ্যাখ …তুই যদি অর্ধেক কথা পেটে, আর অর্ধেক কথা মুখে বলিস…তাহলে তো পুরো ঘটনাটাই আমি , পাঠক পাঠিকাদের লিখে জানাতে পারবো না ! গল্পটাই জোলো হয়ে যাবে ” l
” বলবো…সব কথাই জানাবো l তোমার মতো লেখক তো নই…সব সাজিয়ে বলতে পারবো ? ” ওর ভুলটা বোধহয় বুঝতে পারলো l ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো ” সাত টা বাজতে চললো…চলো বাড়ী ফিরি , আমরা গেলে..ওরা ঠাকুর তলায় আসবে..সন্ধি পুজো দেখতে l তখন ফাঁকা বাড়ীতে…..বাকীটা শোনাবো ” l
” ভেরি নাইস , চল ” উত্তেজনা আমার কণ্ঠে l
ওরা পূজো দেখতে যাবার আগে…আমাদের জন্যে মুড়ি , বেগুনি , নারকেল নাড়ু আর চা দিয়ে গেলো l আহা…অনেকদিন পর নাড়ু খাচ্ছি !
খেতে খেতে বিল্টু শুরু করলো…তার না বলা কথা..আমি একাগ্র শ্রোতা !

” …..বড়ো বউ আর মেজো বৌয়ের মধ্যে বনিবনা কোনোদিনই ছিল না l যৌথ পরিবারে যা হয়ে থাকে.. l কিন্তু বিপরীত হচ্ছে দু ভাই….বউদের অশান্তি , খিটিমিটি, দেখেও আমল দেয় না… l ভাইয়ে ভাইয়ে …গলায় গলায় ! এই দেখে দুই বউই জ্বলে পুড়ে মরে…আলাদা করে স্বামীদের বুঝিয়ে লাভ হয় না.. l
একদিন চরম বিস্ফোরণ ঘটলো ! তুমুল চেঁচামেচির মধ্যে সবাইয়ের সামনে বড়ো ভাই মুখ খুললো l বড়ো বউকে যাচ্ছেতাই ভাবে ধমকালো l ব্যাস…যেন আগুনে জল পড়লো l পুরো বাড়ী নিস্তব্ধ হয়ে গেলো l বড়ো বউ সেই যে চুপ করলো…মরার আগে পর্যন্ত কথা বলেনি l
পরদিন সন্ধ্যে বেলা…গা ধুতে গিয়ে পুকুর থেকে আর উঠলো না ! কয়েক ঘন্টা বাদে দেহ ভেসে উঠলো l পুলিশ এলো….মরা দেহ কাটা ছেঁড়া হলো ! আত্মহত্যার কেস হলো l ….গতবছর থেকেই পাল বাড়ী চুপ চাপ হয়ে গেলো… l
মরার কিছুদিন বাদ থেকেই …অন্যান্যরা কিছু না দেখলেও , বাড়ীর লোকরা বড়ো বউকে পুকুরের আশেপাশে দেখতে পেতো ! বাড়ির মধ্যেই কথাটা সীমাবদ্ধ ছিল , পাছে বাড়ী আর পুকুরের বদনাম হয়ে যায় l বাড়ীর সবাই সযত্নে পুকুর ব্যবহার করা ত্যাগ করলো l ”

একটানা কথা বলে বিল্টু জল খাবার জন্য থামলো …..l ￰ফ্লাস্ক থেকে দুজনে চা ঢাললাম l
“….মাস ছয়েক আগে হঠাৎ করে মেজো বৌএর ফিটের রোগ ধরা পড়লো ! …সেদিন দোতলা থেকে সন্ধ্যে বেলা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে….হাত পা শক্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো ! ভাগ্য ভালো , সেই সময় বড়োবাবুর ছেলে ওপরে উঠছিলো …l কোন রকমে ধরে ফেলে… l নাহলে সেদিনই সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মারা যেত !
…..এরপর থেকেই দু একদিন বাদে বাদেই ফিট হতে শুরু হলো l ডাক্তার , বদ্যি কিছু বাদ গেলো না… l কোন উপশম হলো না…বরং বেড়েই চললো… l একটা নতুন উপসর্গ লক্ষ্য করা গেলো…ইদারা বা টিউওয়েলের জলে চান বা গা ধুতে চাইতো না.. l খালি পুকুরে যেতে চাইতো ! বাড়ীর লোক সতর্ক থাকতো l খিড়কি দরজায় চাবি দেওয়া হলো ! বাড়ীর কুলগুরুকে ডেকে পূজো আচ্ছাও করা হলো….l কিন্তু কোন লাভ হলো না l ওরা নিশ্চিত হলো…বড়ো বৌয়ের আত্মা ভর করেছে …প্রতিশোধ নিতে l

গয়া গিয়ে পিন্ডি দিয়ে আসা হলো…নির্মল আমার সঙ্গে দেখা হলেই দুঃখের কথা জানাতো ! কি সান্তনা দোব মাথায় আসতো না..” — আমাদের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো l দূর থেকে ভেসে আসছে…ঢাকের আওয়াজ ! মনে হয় সন্ধি পূজা শুরু হয়ে গেছে l
এবার গল্প টা একটা রূপ পাচ্ছে ! ” তারপর ?”
ও আবার শুরু করলো l
” …..বড়ো ভাইয়ের ছেলে পাটনায় চাকরী পেয়ে চলে যাবে…তাই বাড়ীর সবাই তাকে বর্ধমান স্টেশনে তুলতে যাবে… l মেজো বউকে দেখার জন্যে বড়োবাবু আর নির্মলের মেয়েকে বাড়ীতে রেখে গেলো l তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে….মেজো বউ খিড়কি দরজার চাবি খুলে কোন এক সময়ে ওই রাক্ষুসে পুকুরে চলে গেলো !

মাকে ঘরে না দেখেই ….হাঁফাতে হাঁফাতে ওরা ছুটলো পুকুর ঘাটে ! ভয়ার্ত চোখে দেখলো….ঘাটের পাশে নরম কাদা মাটিতে মুখ গুঁজড়ে মায়ের মরা দেহটা পড়ে আছে !
…এবার পুলিশের হয়রানি বেশী হলো l নির্মল একদম ভেঙে পড়লো…l চারপাশে কানাকানি শুরু হলো ! সকলেই পাল বাড়ী আর পুকুরকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো l সকলেরই মনে ভয় দানা বেঁধেছে ! ” ও থামলো l
ওর চোখেও ভীত চাউনি l

হাতের আঙ্গুল মটকালাম ” তোর বন্ধু জানে , আমার কথা…”
” হ্যাঁ…ওর বাড়ীতে সাইকেল রেখে …তারপর পুকুর পাড়ে যাবো ! যদি বরাতে থাকে….দেখা পাবে ! ”
মনমরা অবস্থায় মাথা দোলালাম ” না রে বিল্টু…এ যাত্রায় আর হলো না….মেজো বৌয়ের ওপর যদি প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে , তাহলে তো আর এ তল্লাটে থাকার কথা নয় ! ”

আমার শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললো ” গত পনেরো দিন আগে নির্মল ওর বৌদিকে দেখলো বলেই তো ….তোমায় ফোন করে আসতে বললাম…..” l আমার চোখে মুখে হারানো উত্তেজনা আবার ফিরে এলো l
” কোথায় এবং কি দেখলো ? ” উৎসাহের গলা !
ও মুখ খোলবার আগেই….রিনা আর তার মেয়ে ফিরলো l আমরাও ওই প্রসঙ্গ বন্ধ করলাম l …আর একটু বাদে এলে কি ক্ষতিটা হতো ? …আবার অপেক্ষা…… ll

রাত্রে আমি আর বিল্টু এক সাথে শুলাম …l আমার মনে , নির্মলের দেখা পাওয়ার ব্যাপারটা …শোনার আগ্রহ ক ঘন্টায় আরো বেড়েছে ! মন বলছে, ওর বিদেহী আত্মা যদি এখনও থেকে থাকে…..তাহলে বড়ই বিপদ ! কেননা , বড় বৌ নিশ্চয়ই পিশাচিনীতে পরিণত হয়ে গেছে ! পীরবাবার কথা মনে পড়ছে…কিন্তু তিনিও এখন ইহ জগৎে নেই ! ( ভূতে ধরা গল্পে )

রাত দশটা বেজে গেছে l বিল্টুকে বললাম ” নির্মল ..
কি দেখেছে ? ” খাটে বসে ও চাপা গলায় বললো ” সন্ধ্যে তখনও হয় নি…স্ত্রীর ওইভাবে মৃত্যু , ওর মনটাকে ভেঙে একেবারে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিলো ! চেয়ারে বসে নানান কথা ভাবছিলো l ..আর কদিন বাদেই পূজো , মা মরা মেয়েটার মুখটা বারে বারে চোখের সামনে ভেসে উঠছে !

…..আচমকা..পুকুরের ধার থেকে , ঝ – পা – ঙ করে কিছু একটা ভারী জিনিস জলে পড়ার শব্দ কানে এলো ! …ভয়ে ওর বুক শুকিয়ে গেলো ! তবে কি আবার কেউ বৌদির হাতের শিকার হলো ?..একপ্রকার ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে , পুকুর ঘাটে এসে দেখে…জলটা ঘূর্ণির মতো ঘুরছে ! সন্ধ্যের আবছা আলোয়…ওর চোখে পড়লো , বৌদির মুন্ডুটা ওই ঘূর্ণির ওপর ভাসছে ! মরা দৃষ্টি ওর চোখের দিকে….হঠাৎ ! খিল খিল করে হেসে….পেট পর্যন্ত কদর্য শরীর টা কালো জলের ওপর দেখা দিলো ! কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই , আবার জলের ভেতর সেঁধিয়ে গেলো l

…এইসময় বাড়ীর লোক বেরিয়ে এসে, ওকে নিয়ে বাড়ী ঢোকালো l ওর খিড়কি দরজা খোলার শব্দ , ভাগ্যিস মেয়ে শুনতে পেয়েছিলো l …ওই বীভৎস মূর্তি ওর মনে দারুন আঘাত হানলো ! কি রকম যেন ঘোরের মধ্যে আজকাল থাকে ! মেজো বৌয়ের মতো …পুকুরে যাবার বাই দেখা দিয়েছে ! ” ও থামলো l

আমার মুখেও কোন কথা নেই.. l মাথার মধ্যে একটা বিপদ ঘন্টি বাজতে শুরু করেছে ! ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে…সামনে বিরাট বিপদের মধ্যে পড়তে চলেছি.. l প্রাণ সংশয়েরও সম্ভাবনা হতে পারে.. l
নানা রকম অশুভ চিন্তা মনে ঘোরাফেরা করতে লাগলো l না…অনেক রাত হতে চললো, বিল্টুও ঘুমোয় নি ! মুখে চোখে জল দিয়ে এসে ঘুমোবার চেষ্টা শুরু করলাম l
…আজ নবমী l …টাওয়ার না থাকার ফলে বাড়ীতেও ফোন করতে পারছি না l অবশ্য কাল সকালেই ফিরে যাবো l ছেলেও আছে…তাই ভাবনাটা একটু কম l

…..বিকেল বিকেল দুটো সাইকেল নিয়ে বেরোলাম l ও নিয়েছে ওর মেয়েটার লেডিস সাইকেল l বাড়ীতে যথারীতি বলা হয়েছে …এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি ! ফিরতে একটু দেরী হবে l রাত্রে অবশ্য খাওয়ার আগেই ফিরবো l
ওদের পাড়া ছাড়িয়ে…আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ধরে চলেছি ! মাঝে মাঝে কাশ ফুলের জঙ্গল ! দূষণ মুক্ত বাতাস…নীল আকাশে সাদা স্তুপ মেঘের সারি..চোখেরও আরাম ! পশ্চিম দিক রাঙা করে সূর্যদেবের যাবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে ! সঙ্গে করে টর্চ আর ক্যামেরাটা নিয়ে এসেছি l কমপক্ষে , পুকুরটার একটা ছবি তুলবো l পাঠক পাঠিকাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যে l

বিল্টু বললো ….এবার আমরা বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরবো ! এই সোজা রাস্তাটা হীরা গ্রামের ভেতর দিয়ে কালনা চলে গেছে l বাঁ দিকের রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত সরু l এটা দীঘির ধার গিয়ে শেষ হয়ে গেছে ! এতটা পথ আসতে…রাস্তায় দু একটা ভ্যান রিক্সা আর সাইকেল ছাড়া কিছু চোখে পড়েনি l
একটা দোতলা রং চটা বাড়ীর সামনে এসে ওর কথামতো দাঁড়ালাম l ….তারমানে এটাই পাল বাড়ী ! ও বলে রেখেছে আমাদের আসার কথা … l আমার এদিক সেদিক তাকানো দেখে বললো ” তুমি যা খুঁজছো …ওই মানুষ খেকো পুকুরটা বাড়ীর পেছন দিকে l ”

আমাদের সাড়া পেয়ে নির্মল আর ওর দাদা বেরিয়ে এলো ! নির্মলের বয়স আমারই মতন l কিন্তু চোখে মুখে বিষাদের ছায়া…শরীরে বার্ধক্যের আগাম চিহ্ন ! যেন শ্বশান ফেরত মানুষ ! ম্লান মুখে আমাদেরকে আপ্যায়িত করলো l
বিল্টু ” আলো থাকতে থাকতেই আমার দাদা একটু পুকুরটা দেখতে চাইছে ” বড় ভাই ঘাড় নেড়ে ভেতর থেকে চাবিটা এনে হাতে দিয়ে বললো ” তুমি সবই চেনো ..একটু দেখিয়ে দাও..আমরা ঘরে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি ” বুঝলাম…ভয় এখনও ওদের ঘিরে রেখেছে !

বাগানের মধ্যে সরু রাস্তাটা ধরে বাড়ীর পেছন দিকে চললাম l দরজা খুলে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালাম… l এই সেই রহস্যময় জলাশয়…বেশ বড়ো ! লম্বাটে ধরণের গড়ন , কালো জলে কিছু কিছু জায়গায় শ্যাওলা ভাসছে l ও পাড়ে কয়েকটা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর চোখে পড়লো ! চারধারে আগাছায় ভরা…বড়ো বড়ো গাছও আছে l নিম , গাব , সজনে , আর কয়েকটা তাল গাছ !

দুটো সিঁড়ি নেমে জলের কাছাকাছি এলাম l বিল্টু পিছু থেকে কাঁপা গলায় বললো ” মরার ইচ্ছে হয়েছে নাকি ? “….চারিদিকে গাছপালার ভিড় থাকার ফলে ….সূর্যেরআলো কম পড়ে..তাই জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে ! রীতিমতো দিনের আলো কমে এসেছে ! জলের দিকে তাকিয়ে ….ভাবলাম, এর মধ্যেই কি ও থাকে ?
বিল্টুর গলা পেলাম..” ওই তোমার ডান পাশেই কাদা মাখা জায়গাটায় , নির্মলের স্ত্রীর দেহটা পড়ে ছিল ” !

জায়গাটার দিকে তাকাতেই…শরীরের মধ্যে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো..!! এরকম তো আমার হয় না.. ! চোখ সরিয়ে নিলাম ” এই ঘাটটাতে বসে খানিকটা সময় কাটিয়ে ফিরে যাবো ” l গলায় সেরকম জোর পেলাম না ! চারিদিকে কিরকম একটা গা ছমছমানী পরিবেশ তৈরী হতে শুরু করেছে l কে যেন কানে ফিস ফিস করে সমানে বলতে শুরু করলো…ফিরে যা…এখনও সময় আছে…..চলে যা… l
বিল্টুর ডাকে চেতনা জাগ্রত হলো ” ওরা চা খেতে ডাকছে..শুনতে পাচ্ছো ?
” ও..হ্যাঁ হ্যাঁ চল. , একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম…শুনতে পাইনি ” সিঁড়ি বেয়ে উঠে ফিরতে যাচ্ছি…কাছেই যে ঝাঁকড়া গাব গাছটা ছিল , তার উঁচু ডালটা সজোরে দুলে উঠলো ! মনে হলো , কে যেন শক্ত পা দিয়ে ডালটাকে নাড়িয়ে দিলো !

” ……হনুমান নাকি ? ” কথাটা বললাম বটে…নিজের কানেই অস্বাভাবিক ঠেকলো ! মোটা ডালটা আবছা অন্ধকারে তখনও নড়ছে…কিছু পাতাও উড়ে জলে পড়লো !
” ….তাহলে তো দেখা যেত…” ওর মুখটা ভয়ে আমসি হয়ে গেছে l আমার হাত ধরে টানলো ” এখানে আর দাঁড়িও না…চলো ” ওর হাতটা কাঁপছে !
বুঝতে পারছি না…এখনই এই অবস্থা হলে…রাতে কতক্ষন ওকে পাশে পাবো ? তবে আমারও স্নায়ুর জোর যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কমছে , তার ইঙ্গিত আজ একটু আগেই বুঝলাম !

এরপরের কয়েক ঘন্টা… যে আমার স্নায়ুর মনোবল কে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে…তখনও বুঝিনি !
আমরা এক সঙ্গে চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো..সন্ধ্যের পরে ওই অলুক্ষুনে পুকুরে না যাওয়ার জন্যে ওরা বলছিলো !
ওর দাদার ভারী গলা ” ..বুঝলে শঙ্কর, সেদিন নির্মল ওর বৌদিকে দেখার পর থেকে …পুকুরে যাওয়ার জন্যে খালি অজুহাত খুঁজছে ! …আমরাই বোঝাচ্ছি আর বাধা দিচ্ছি ”

” দাদার কথা ঠিক ! ” নির্মল শুকনো কণ্ঠে বললো “..কি রকম একটা টান অনুভব করছি…সন্ধ্যের পর থেকে ঠিক বোঝাতে পারবো না.., ! মনে হচ্ছে , কে যেন গলায় দড়ি পরিয়ে টানছে ..” — ওর কথায় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হলো ! তার মানে , ও টানে পড়ে গেছে ! এখান থেকে ওকে তাড়াতাড়ি না সরাতে পারলে…ওর মৃত্যু অবধারিত l পিশাচিনীর কবলে পড়ে গেছে l

” ..আমার মনে হয় , আপনাদের এই বাড়ী ছেড়ে …যত শীঘ্র সম্ভব অন্য জায়গায় চলে যাওয়া উচিত ” দুই ভাই সহমত হলো l চা খাওয়া হয়ে গেছে..সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে….বিল্টুর ওঠার কোন লক্ষন দেখছি না !
শেষ কালে আমিই বলে উঠলাম ” চল…এবার পুকুরের দিকে যাওয়া যাক , যার জন্যে এতদূর আসা..” দেখলাম..বিল্টুর মুখে ভয়ের ছোঁয়া ! চুপ করে বসে আছে…মনে হয় দোটানায় পড়ে গেছে l …

এইসময় ছিলে ভাঙা ধনুকের মতো নির্মল দাঁড়িয়ে উঠলো…” কেউ না যাক , চলুন আমি যাচ্ছি..” ওর কথায় আমরা সবাই চমকে উঠলাম ! ওর সারা শরীরে একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে ! চোখের তারা গুলো থির থির করে কাঁপছে…যেন কেউ সন্মোহন করেছে ! হাত পা গুলো শক্ত পেশী বহুল হয়ে যাচ্ছে.. l
….আমি জানি ….বাইরে থেকে এক অশুভ শক্তি ওকে পুকুরে নিয়ে যেতে চাইছে ! আমার কৌতূহল মেটানো থেকে ওকে বাঁচানো আগে দরকার !
শক্ত গলায় জোরে বললাম ” না…কেউ ওখানে যাবে না…আমিও না ” কথাটা কানে যেতেই…ও আমার দিকে কটমট করে তাকালো ! চোখে আগুন ঝরছে ! এক লহমায় ছিটকে ও বাইরের দিকে ছুটলো !

আমরা তিনজনে ওকে জাপটে ধরলাম l এতো দানবের মতো শক্তি ওর গায়ে কোথা থেকে এলো ?…আমরা তিনজনে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছি ! মিনিট দশেক টানা হ্যাঁচড়ার পর ও খানিকটা নিস্তেজ হলো ! ওকে ধরাধরি করে ঘরে শুইয়ে চাবি দিয়ে দেওয়া হলো ! নির্মলের দাদার মুখটা দেখে সত্যি কষ্ট হলো ..ভেবে পাচ্ছে না কি করবে ? মেয়েটাও কাঁদছে …! আমরা রীতিমতো ঘেমে গেছি নির্মলকে সামলাতে.. l বাইরে ইতিমধ্যে অন্ধকার ছেয়ে গেছে ..l

…এই সময় , কানে এলো কে যেন খিড়কি দরজাটা বাইরে থেকে ধাক্কাচ্ছে … !! আমি আর বিল্টু বাইরে এলাম টর্চ হাতে l ক্রমশ ধাক্কার জোর বাড়ছে ! দরজার কাছাকাছি এগিয়ে এসেছি ! পুরোনো দরজার পাল্লা দুটো শব্দের আওয়াজে কাঁপছে ! …মনে হচ্ছে , বেশ কয়েকজন শক্ত সমর্থ লোক একসঙ্গে ঠেলছে l …আর কিছুক্ষন চললে , দরজাটা ভাঙতে বাধ্য ! অপর প্রান্তে কে বা কারা আছে ? দেখার ইচ্ছে জাগলো !
বিল্টুর দিকে তাকিয়ে বললাম ” চাবিটা নিয়ে আয়…”

” না…দরজাটা খুলো না..” হিস্টরিয়া গ্রস্ত রোগীর মতো চেঁচালো ও !
বুঝলাম …দারুন ভয় পেয়েছে….যেটা স্বাভাবিক
” দরজা খুললে , আমরাও ওর আকর্ষণে পড়ে যাবো… ” কথাটা কান দিয়ে ঢুকে মাথায় আঘাত করলো l

জেদকে দমন করলাম..আরও একটা কারণে ! সেটা হলো দরজার কাছাকাছি থাকার ফলে একটা বাসি পচা মাংসের গন্ধ …আমার নাকে আসছিলো !
এই সময় আমার পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো…কানে ঠেকাতেই , ছেলের উদ্বিগ্ন গলা কানে এলো…..” বাপি , তুমি এখনই বাড়ী ফিরে এস ”
নতুন অজানা আশংকায় বুকটা দুলে উঠলো ! ” ক–কি….হয়েছে ? ” তোৎলালাম l

” ….অনেক চেষ্টার পর ফোন পেয়েছি..মায়ের সকাল থেকে প্রচন্ড জ্বর…এখন টেম্পারেচার …চার ছাড়াচ্ছে , ভুল বকছে…” লাইন কেটে গেলো !
উভয় সংকট ….মাথার গ্রে সেল গুলো ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে ! মনে হচ্ছে , চোখ মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে ! দরজার শব্দ ধীরে ধীরে কমছে …! মাথা টাকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে চেয়েও পারছি না l …বিল্টুকে বাড়ীর ব্যাপারটা বলাতে…ও কোন কথা না বলে , সাইকেল বার করতে লাগলো l বুঝতে পারছি..ওর স্নায়ুও এই ভার সহ্য করতে পারছে না…..পালাতে চাইছে !

…… এই সময় ঝপাং করে কে যেন পুকুরের জলে ঝাঁপ দিলো…সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলো !
জানিনা আজকের রাতের মতো ফাঁড়া কাটলো কি না ?? …
বাস রাস্তা পর্যন্ত বিল্টু আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো…খুব আফসোস করছিলো না খেয়ে আসার জন্যে l আমার তখন বাড়ীর চিন্তা…কখন পৌঁছবো কে জানে ? দুটো চিন্তা মাথায় পাক খাচ্ছে..এক) স্ত্রী এখন কেমন আছে ? …..দুই) পাল বাড়িতে এখন কি হচ্ছে ?

…..একাদশীর দিন জ্বর ছাড়লো বৌয়ের…ভাইরাল ফিভার l বিল্টুই দু মিনিটের জন্যে ফোনে …বৌদির খবর জানলো ! আর আমাকে জানালো …রাত্রিটা কোনোরকমে কাটিয়ে ..ভোরেই ওরা বাড়ীতে তালা ঝুলিয়ে…বড়ো বাবুর ছেলের কাছে চলে গেছে…আমি শুধু বিল্টুকে বললাম, রহস্যটা সমাধান হলো না…একটা অভিশপ্ত বাড়ীর সংখ্যা শুধুমাত্র বাড়লো !!!.

……………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত