পীরবাবার শক্তি

পীরবাবার শক্তি

পীরবাবা , ….তান্ত্রিক -?- ওঝা ?–কাপালিক ?… কি না বলতে পারবো না l তবে আমার মতো অবিশ্বাসী লোকও , এখন ভৌতিক শক্তিকে মানি l তার সঙ্গে এটাও মানি — অশুভ শক্তির সাথে মোকাবিলা করার মতো কিছু মানুষ এই পৃথিবীতে আছে l তার মধ্যে পীর বাবা অন্যতম l আমার বেশ কয়েকটা গল্পে তাঁর শক্তির কথা আপনাদের বলেছি l
এখনও কোন অশুভ শক্তির উপস্থিতিতে ওনার কথা প্রথম মনে পড়ে l ￰দুর্ভাগ্য , তিনি ইহ জগতে এখন নেই l তার যোগ্য শিষ্য রফিক সেই কাজে ব্রতী হয়েছে l আজ , পীরবাবার একটা ঘটনা বলবো l যা এখনো পর্যন্ত আমি কোথাও লিখিনি বা প্রকাশ করিনি l
মাঝে মাঝেই বাবার মাজারে চলে যেতাম l ওনার নানারকম কার্য কলাপ দেখতাম আর আমার গল্পের রসদ যোগাড় হতো l কিন্তু সেই হেমন্তের শিশির পড়া সন্ধ্যের কথা কোনদিন ভুলবো না l বিশদ বিবরণে যাবো না l কখনও সময় সুযোগ হলে বিস্তারিত ভাবে জানাবো l
সেদিন পীর বাবাকে প্রণাম করে সন্ধ্যের মুখে বাড়ির রাস্তা ধরলাম l ￰মেঠো পথ, দু ধারে আলুর ক্ষেত l শিশির পড়ে এরই মধ্যে পথ পিছল হয়ে গেছে l ছোট টর্চ নিয়ে কালিপুর অটো স্ট্যান্ডএর দিকে চলেছি l হঠাৎ দেখি , ক্ষেতের মধ্যে থেকে গোটা চারেক ইয়া তাগড়াই কুকুর উঠে এলো l একটু ভয় পেয়ে গেলাম ! কামড়াবে নাকি ? কুকুর গুলো সামনের রাস্তা জুড়ে বিশ্রী ভাবে দাঁত বার করে ডাকতে শুরু করলো l গরগর করে মুখ থেকে ভয় ধরানো একটা শব্দ বার করছে l
টর্চের আলোয় চোখগুলো জ্বলছে l ￰এগোবো যে তারও উপায় নেই l ক্রমশ ওরা যেরকম হিংস্র হয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে খাবলা করে মাংস গা থেকে খুবলে নেবে ! এদিকে চারিদিক শুনসান… l কাকে বাঁচাতে বলব? একটাই রাস্তা , পিছু ফিরে পুনরায় মাজারে ফিরে যাওয়া l
পিছু ফিরতেই , আতঙ্কের চোখে দেখি — পিছন দিকেও একটা কালো কুকুর l কিন্তু অতটা হিংস্র মনে হলো না l এক মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম l ওর পাশ কাটিয়ে লাগালাম উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় , পীরবাবার মাজারের দিকে l
শুনতে পাচ্ছি , পেছনে ওদের কান কাঁপানো বীভৎস ডাক l ওরাও তীব্র গতিতে ছুটে আসছে, কালান্তক যমের মতো l পারবো কি ? ওরা ধরার আগে মাজারে পৌঁছতে ? প্রানপনে ছুটছি আবছা অন্ধকার ভেদ করে l বুক টা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে l কুকুরগুলোর সমস্বরে ডাক…আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে মাজারেও পৌঁছেছিল l কেননা ওরা গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছিল l
এক মিনিটের হেরফেরে পৌঁছে গেলাম l বাবা আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালো l ￰রফিকও এগিয়ে এলো l হাঁফাতে হাঁফাতে পিছু ফিরে দেখলাম , শুধু ওই কালো কুকুরটা ! বাকি গুলো নেই l কিন্তু আমি এখানে আসার আগে পর্যন্ত শুনেছি , চার পাঁচটার মিলিত ডাক !
পীর বাবার চোখ দুটো জ্বলন্ত হয়ে উঠলো l কুকুরটা বেড়া দেওয়া গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ! চোখে আক্রমণাত্মক ভাব l ￰লকলকে জিভ বার করে আমাদের দেখছে l…যেকোন সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে l বাবার মুখ থেকে দুর্বোধ্য মন্ত্র বেরোতে লাগলো l উনি কি ভাবছেন , এটা কুকুর নয় ? বাবার ধারণা যে কত সঠিক , এক মিনিটের মধ্যে দেখতে পেলাম l
কালো কুকুরটা ধীরে ধীরে আয়তনে বড়ো হচ্ছে ! রফিক হারিকেন হাতে কুকুরটার কাছাকাছি l তাই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার রূপ পরিবর্তন l যা প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে …l প্রথমে কুকুর থেকে শিয়াল , তারপর নেকড়ে , শেষে কালো বাঘ ! সব কিছুর মিশ্রনে এক অপ্রাকৃতিক জন্তুর রূপ ধরলো !
পীর বাবার শরীরটা শক্ত হয়ে গেছে l ইশারায় আমাকে পিছু হটতে বললো l জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হলো l আচমকা সেই নরকের হিংস্র শ্বাপদ , রফিক কে আক্রমণ করলো l এক লহমায় বাবার শরীরে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলো ! স্বল্প আলোয় , সাদা গোঁফ দাড়িওয়ালা বাবাকে মনে হচ্ছে ….এক পিশাচ সিদ্ধ মহা তান্ত্রিক ! চোখ মুখ থেকে রাগ যেন আগুনের মতো ফুটে বেরোচ্ছে ! পুরো শরীরটা যেন ইস্পাত পেটানো l
এক ঝটকায় রফিকের ঘাড় থেকে সেই নরক থেকে উঠে আসা জীবটাকে জাপটে ধরে, মাটিতে আছড়ে ফেললো ! আমার চোখের সামনে যেন কোন বীভৎস ভৌতিক সিনেমা পরিদর্শিত হচ্ছে l ￰সবিস্ময়ে দেখলাম , আছড়ে পড়া কিম্ভুতকিমাকার জন্তুটা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে l এবার আলখাল্লার পকেট থেকে উনি মুঠো করে কিছু সর্ষে ওটার গায়ে ছুঁড়ে মারলো l …সঙ্গে সঙ্গে ওর লালায় ভরা মুখ থেকে আকাশ ফাটানো এক আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ! যে আর্তনাদ শুনলে অতি বড়ো সাহসীও আতঙ্কে শিহরিত হবে !
পুনরায় কুকুরের আকার ধারণ করে এক নিমেষে , অন্ধকারে আলুর ক্ষেতের মধ্যে মিলিয়ে গেলো l বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললো ” বড়জোর বেঁচে গেছিস l আজ রাত টা এখানে কাটিয়ে যা l ” বাড়ি যাবো কি ? আমার সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা ! রফিকও অল্প আতংকিত …l পীর বাবার শান্ত গলা ভেসে আসছে l
” ভেবে পাচ্ছি না , ওই সাংঘাতিক প্রেতটার কোথা থেকে আবির্ভাব হলো ? ওর শক্তি সাময়িক হ্রাস পেলেও দু দিনে আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে ” আমার শরীরের ক্ষমতা কিন্তু ক্রমশ কমছে ! চিন্তিত মুখে উনি বলে চলেছেন …” আপাতত ও নাগালের বাইরে চলে গেছে l কিন্তু আমার মন বলছে , দ্বিগুন শক্তি নিয়ে ও ফিরে আসবে..” l
পীর বাবার কথা সত্যি হয়েছিলো l ও ফিরে এসেছিলো l এবং সে কাহিনী শুধু রোমহর্ষক নয়, আতঙ্কের বিভীষিকা ! ..আগেই বলেছি , অন্য কখনও সে কাহিনী সময় সুযোগ করে শোনাবো ll

•••••••••• •••••••••• ••••••••
শুরু করছি নতুন ঘটনা l ওখান থেকে ফিরে এসে পড়লাম জ্বরে l দিন বারো হতে চললো , জ্বর আর ছাড়ছে না l সারাদিন বেশ সুস্থ থাকি l কিন্তু সূর্য ডুবলো কি , গা গরম হতে শুরু হলো l ডাক্তারের ওষুধেও কোন লাভ হচ্ছে না l ব্লাড রিপোর্টেও কিছু পাওয়া গেলো না l স্ত্রীও বেশ চিন্তিত l ছেলে মুম্বাই থেকে খবর নিচ্ছে l
আমি জানি, আর কয়েকটা দিন কাটলেই ,ডাক্তার বলবে টাইফয়েড l আর একটা ব্যাপার ঘটছে — যেটা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারছি না ! সেটা হলো , রাতে জ্বর থাকাতে ঘুমটাও ভালো হচ্ছে না l আর কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব উপলব্ধি করছি l তন্দ্রা মতো এলেই , নানা রকম ভূতের স্বপ্ন দেখছি l কখনো মনে হচ্ছে , মশারির পাশ দিয়ে কে হেঁটে বেড়াচ্ছে l
রিতাকে আর জাগাই না l এমনিতেই আমার শরীরের চিন্তায় পাগল ! তবে কি সেদিনের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিফলন ? এর আগে এইসব দুর্বলতা আমার ছিল না l পীরবাবার ওখানকার ঘটনা রিতাকে বলিনি l এদিকে অফিসে অনেকদিন কামাই হয়ে যাচ্ছে l ঠিক করলাম , সোমবার থেকে বেরোবো l কেননা সকালের দিকে কোন টেম্পারেচার থাকে না l বেশ দিব্যি সুস্থ মানুষ l কিন্তু মানুষ ভাবে এক , আর হয় এক !
শনিবার রাত্রেই ঘটনাটা ঘটলো….যা আমাকে বাধ্য করলো পীর বাবার শরণাপন্ন হতে l

…রাত দশটা নাগাদ মশারির ভেতর ঢুকলাম l রাত্রে ভালো ঘুম হচ্ছে না বলাতে , ডাক্তার হালকা ডোজের ঘুমের বড়ি দিয়েছে l তাই একটা মুখে ফেলে , বিছানায় আশ্রয় নিলাম l ￰রিতাও পাশেএসে শুয়ে পড়লো l
ঘুমের ঘোরে — পুরোনো ঘটনাটা চোখের মাঝে ফিরে এলো l মাজার থেকে ফেরার পথে কালো কুকুরটার আক্রমণ l সেই কালান্তক যমের মতো কালো কুকুরটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি l একতলা থেকে পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে ! কুকুরটার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি l
অন্ধকারে ওর চোখ দুটো নীলকান্ত মনির মতো জ্বলছে …l লাল টকটকে লম্বা জিভ থেকে লালা ঝরে পড়ছে ! ওঃ কি বীভৎস চাউনি তার চোখে ! আমার গলা মরুভূমির মতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে l ওই পিশাচ রূপী শ্বাপদ একেবারে মশারির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ! ওর গরম নিশ্বাস আমার গায়ে পড়ছে l
ধড়মড় করে উঠে বসলাম l ঘরের ছোট্ট রাত আলোতে — মশারির বাইরে ওর নীলচে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না ! অন্ধকারের জীব , অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছে l এক পলক দেখলাম , স্ত্রী অকাতরে ঘুমোচ্ছে l
এই অসম্ভব ব্যাপারটা ঘটলো কি ভাবে ? সত্যি যদি ওটা কুকুর হয় ? নিজের হাতে সদর দরজার চাবি লাগিয়ে এসেছি , এতো বড়ো কুকুরটা ঢুকলো কি করে ? এই সময় দেখলাম , সামনের পা দুটো বিছানার ওপর তুলে দিয়েছে ! ওর সরু সরু দাঁত দিয়ে মশারিটা ফালা ফালা করছে l চাইছে ভেতরে ঢুকতে l ওর টার্গেট যে আমি — তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না !
জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম l পরক্ষনেই রিতার হাতের স্পর্শ পেলাম l উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ” কি হয়েছে ? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছো ? ” ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগলো l স্বপ্ন ? এতো জীবন্ত ? সেই সময় পীরবাবার কথাটা মাথা জুড়ে বেজে উঠলো ” …পিশাচ টা এই মুহূর্তে পালিয়ে গেলো , কিন্তু ও কিছুদিন বাদে আরও বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে l ” সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো l বেশ শীত শীত লাগছে l কিন্তু এটা চৈত্রের শেষ l ভালোই গরম l তবে কি জ্বরটা আবার আসছে ?
” তুমি একটু জল খাবে ? ” গায়ে হাত দিয়ে ও চমকে উঠলো l ” একি তোমার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে l ” তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে থার্মোমিটারটা নিয়ে এলো l ঘড়িতে দুটো কুড়ি l গায়ের তাপমাত্রা তিন ছাড়িয়েছে l
শুকনো মুখে বললো ” এতো জ্বর তো কোনদিন আসে নি ! ”
কোনও রকমে বললাম ” জ্বর কমাবার ট্যাবলেট আর জল দাও ” l ….আধ ঘন্টার মধ্যে , জ্বর একটু কমলো …l তারপর বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম l
সকালে ঘুম থেকে উঠে , ভালোই বোধ করলাম l মোবাইলটা নিয়ে , পীর বাবার সহকারী রফিককে ফোন করলাম l অনেক চেষ্টাতেও লাইন পেলাম না l এই এক হয়েছে টাওয়ারের প্রব্লেম l ￰রিতা আগেই উঠে পড়ে নিচে নেমে গেছে l কাল রাতের স্বপ্নটা এখনও ভুলিনি ! একদম সত্যি মনে হচ্ছিলো l
￰মশারি তুলে বেরোতে যাবো , বিষম খেলাম ! মশারিটা কে যেন ফালা করে ছিঁড়েছে l মনের মধ্যে আবার ভয়টা দ্রুত গতিতে ফিরে আসছে l আজকেই যে ভাবে হোক মাজারে যেতেই হবে l নিছক যে স্বপ্ন নয় , হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি l স্ত্রী কে কি বলবো কে জানে ? রাতের স্বপ্ন আর কিছুদিন আগেকার ঘটনা বললে …ও নিশ্চয়ই মূর্ছা যাবে l খাট থেকে নামলাম l
পায়ে ঘরে পরার চটিটা গলাতে যাবো ….ভয় আমাকে সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস করলো ! হাওয়াই চটির ওপর কালো লোমের ছড়াছড়ি ! বুঝতে পারছি , পা দুটো কাঁপছে l ওই অবস্থায় লোমগুলোকে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করলাম l কেননা চাই না …..ও দেখুক , আর সব শুনে ভয় পেয়ে যাক… l
এরপর পায়ে পায়ে নিচে নেমে এলাম l ….আমাকে দেখে রিতা এগিয়ে এলো ” উঠে পড়েছো ? শরীর কেমন ? ” কপালে হাত দিয়ে বললো ” না , জ্বর নেই l কি মুশকিল হলো বলতো ? ম্যালেরিয়া নয় তো ? ” মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলাম l আবার একবার রফিকের নম্বর চেষ্টা করলাম l একই উত্তর — নট রিচেবেল l ও চা নিয়ে এলো l
” কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছিলে ? যে অত জোর চেঁচালে ? ”
” ভূতের ! ” চায়ে চুমুক দিলাম l ভাবছি কি বলে বেরোনো যায় ? ওই সুযোগ করে দিলো l
” আজকে বরং আর একবার ডাক্তারের কাছে যাও “l
” ঠিকই বলেছো l ড্রাইভার খোকন কে ডাকি l ” ফোন করলাম l স্ত্রীকে বললাম ” চিন্তা করবে না l কেননা দেরী হতে পারে “l ….গাড়ি নিয়ে যখন বেরোলাম , তখন ঘড়িতে আট টা বাজছে l যাবার আগে রিতা বললো l
” একটা খবর দিও, চিন্তায় থাকবো ” l আমার হয়ে খোকন উত্তর দিলো ” আমি আছি , ভাববেন না ” l খোকনকে গাড়িতে বললাম , কোথায় যাবো l ও এর আগেও আমার সঙ্গে হরিপালের মাজারে গেছে l গাড়িতে বসে আবার একবার চেষ্টা করলাম রফিককে ফোনে ধরার l বৃথা চেষ্টা l ভয় হচ্ছে , এতটা পথ গিয়ে যদি শুনি …বাবা নেই l কোন ভক্তের কাছে গেছে ! তাহলেই সব্বোনাশ l কেননা মন বলছে , ওই পিশাচটাই আবার ফিরে এসেছে l নাহলে আমার এইরকম অনুভূতি লাগবে কেন ?
সত্যি , অন্যদের ভূত ছাড়ানো …কবজ পরানো ….জলপড়া , তেলাপোড়া দেওয়া দেখেছি l কিন্তু আমাকেও যে কোনদিন এইরকম অবস্থায় পড়তে হবে ভাবিনি l খোকনকে বললাম ,” দেখিস , বাড়িতে যেন আবার বলে ফেলিস না ” l ও হেসে মাথা নাড়লো l শেওড়াফুলি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফোন মেলালাম l কেননা কালিপুর ছাড়িয়ে ওদের দরগার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে , টাওয়ার পাওয়া দুস্কর হয়ে যাবে l বলে দিলাম , ডাক্তার আসেনি l সাঁইত্রিশ নম্বরে নাম পেয়েছি l অনেক দেরী হবে l এখানে কিছু খেয়ে নেবো l
গাড়ি কালিপুর অটো স্ট্যান্ডে এসে থামলো , সাড়ে নটার সময় l এর পর আর গাড়ির রাস্তা নেই l আলপথ ধরে পায়ে হেঁটে যেতে হবে l খোকন এখানেই গাড়িতে থাকবে l পা বাড়ালাম ঈশ্বরের নাম করে l কারণ এই পথটাই এখন আমার কাছে বিভিষিকাময় l এখানেই সাক্ষাৎ হয়েছিল , নরকের শ্বাপদটার সঙ্গে l ও যে আমার কাছাকাছি আছে , সেটা মস্তিস্ক জানান দিচ্ছে l তাই আমি এতো অধীর হচ্ছি পীর বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে l
…এই সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র উনি l নির্জন আলপথ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটা l চারিদিকে শুধু আলু ক্ষেত আর সবজি ক্ষেত l দুদিকে জনমনিষ্যি নেই l এর মধ্যেই কোথাও ওৎ পেতে রয়েছে সেই দানব l এখন মনে হচ্ছে , বন্ধু সুমঙ্গলকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো হতো l ওর এইসব অতীন্দ্রিয় ব্যাপারে কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে l বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছি l
এই সময় সামনেই সবজি ক্ষেতের ভেতর থেকে , একটা কালো কুকুর আলপথে উঠে এলো l আতঙ্কের একটা কালো ছায়া , শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ! ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ! এই প্রথম মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখলাম !

আমি এক মিনিট ভাবলাম , এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত ? কেননা কুকুরটা সামনেই দাঁড়িয়ে l কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে , কুকুরটা কি জানি কেন ? লেজ গুটিয়ে আবার সবজি জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলো l মুখে কেঁউ কেঁউ করে একটা ভয় পাওয়ার আওয়াজ তুললো l
একটু আশ্চৰ্য্য হলাম ! ও আমাকে দেখে এতো ভয় পেলো কেন ? এতো উল্টোটা হলো l যাক , আবার কোন বিপদের মুখে পড়ার চেয়ে পা চালানো ভালো l
মাজারে এসে ঢুকতেই রফিক বললো ” বাবা , জানতো আপনি আসছেন l ” প্রতি মুহূর্তেই অবাক হচ্ছি ! দেখলাম , দু একজন সমস্যা নিয়ে এসেছে l তাদের সঙ্গেই বাবা কথা বলছিলো l ￰আমায় দেখে এগিয়ে এলো l
” কাল রাতে দেখা পেয়েছিলিস ?” উনি কি অন্তর্যামী ! সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়লাম l
” ভয় পাবি না l তোকে সেদিন থেকেই ওই আত্মাটা ছুঁয়ে রয়েছে ! ” গা টা শির শির করে উঠলো l
” এখানেও দেখা পেয়েছেন নাকি ? ” শুকনো কণ্ঠে বললাম l
” দেখা না পেলেও , গন্ধ পেয়েছি ” l এবার রফিকের দিকে তাকিয়ে বললো ” ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা ! দেখি কতখানি গিলেছে ওকে ? ” কথা শুনে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে l কিন্তু ওনার শক্তির ওপর বিশ্বাস আছে l কেননা এর আগের কয়েকটা ঘটনায় আমার বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়েছে l এই ঘটনাগুলো , নানা সময়ে আপনাদের বলেছি l ভূতে ধরা …ও একা এইসব কাহিনীর মাধ্যমে l তাছাড়া কয়েকদিন আগেই , ঐরকম বুক কাঁপানো অবস্থা থেকে আমায় বাঁচায় l কিন্তু একটাই ব্যতিক্রম , সেইসব ঘটনায় ছিলাম আমি প্রত্যক্ষদর্শী ! আর আজ ??
আধো অন্ধকার ছোট ঘরটাতে ঢুকে রফিকের কথামতো একটা মাদুরের আসনে বসলাম l উনি একটু বাদেই এসে আমার মুখোমুখি বসলেন l
গম্ভীর স্বর ” আমার চোখের দিকে তাকা ..” l কেন জানিনা ওর চোখের দিকে তাকাতে একটা অস্বস্তি হচ্ছে l বাজখাঁই গলায় বললো ” এবারে বুঝতে পারছিস , তোর শরীরে ও দিব্যি বসে আছে ! তাই আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিস না ” ! কিন্তু আমার তো কোন বোধ হচ্ছে না l মস্তিস্ক তো ভালোই কাজ করছে l এবার আমার মাথাই মনে পড়িয়ে দিলো , একটু আগেকার ঘটনাটা ! রাস্তার মাঝে কুকুরটা আমাকে দেখে ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলো !
বাবা নির্দেশ দিলো সহকারীকে ” কয়েকটা কাঠ নিয়ে আগুন জ্বালা ” l নির্দেশ অনুযায়ী রফিক ছোট ছোট কয়েকটা কাঠের টুকরো নিয়ে , টিনের বড়ো পাত্র টাতে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত হলো l এই সময় একটা পোড়া পেট্রোলের গন্ধ নাকে এসে লাগলো l কিন্তু ও তো এখনও আগুন জ্বালায় নি ! নাকটা টেনে বললাম l
” একটা পেট্রোল পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি… ” l বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ” কালিপুর রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে , তার গন্ধ পাচ্ছিস ” l বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম l এখান থেকে রাস্তা এক কিলোমিটারের ওপর দূরে ! কোনদিন এখানে এসে গন্ধ পাইনি l আর আজ…?
” বুঝতে পারছিস , তোর ঘ্রাণ শক্তি মানুষের চেয়ে কতখানি বেড়ে গেছে ? কুকুরের ঘ্রাণশক্তির মতো ! তোকে কত পাকে শয়তানট ঘিরে নিয়েছে ! এরপর তুই অন্ধকারেও দেখতে পাবি ! কিছুক্ষনের মধ্যেই তোর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়ে যাবে ! আমরা যা দেখতে পাই না , তুই খালি চোখে সেইসব আত্মা , প্রেতাত্মাদের দেখতে পাবি ” l
কথাগুলো কানের ভেতর ঢুকে , ভয়ের অতলে আমাকে ঠেলে দিলো l বুঝতে পারছি, আমি ভয়ে হাঁফাচ্ছি…জিভটাও মনে হচ্ছে বেশ কিছুটা বেরিয়ে এসেছে ..l ￰কতোদূরের রাস্তায় গাড়ির হর্ন আমার কানে আসছে l আমি কি সত্যিই ধীরে ধীরে সারমেয়তে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি ?
ভয়ার্ত মুখে পীর বাবার দিকে তাকালাম l ইতিমধ্যে রফিক আগুন জ্বেলে ফেলেছে l …ঐটুকু আগুন দেখে , এতো ভয় লাগছে কেন ? মনে হচ্ছে , এক লাফ মেরে এখান থেকে পালিয়ে যাই…সামনের ওই সবজির জঙ্গলে !
আচমকা কানে ঢুকলো …বাবার উচ্চস্বরে আওড়ানো দুর্বোধ্য মন্ত্রের শব্দ ! সারা শরীরে শুরু হয়েছে এক তুমুল আলোড়ন l কি এক অসহ্য জ্বালা…যা বোঝানো যাবে না l ঠিক মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে কে যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে ! পাশে বসা রফিকের গলার টুঁটিটা কামড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ! কোন মানুষের এই রকম ভয়ঙ্কর ইচ্ছে জাগতে পারে ?
এইসময় বাবা একমুঠো লাল সিঁদুর আগুনে ছুঁড়ে দিলো l গায়ের জ্বলুনিটা সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আকার ধারণ করলো ! ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে l মুখটা কুকুরের মতো উঁচু করে কেঁদে উঠলাম ! নিজের কানে সেই কান্নার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম l মনে হচ্ছে , অনেকগুলো কুকুর আর নেকড়ে মিলিত স্বরে ও – উ – উ – উ করে কান্নার স্বরে ডাকছে l
যে ডাক , কোন মানুষই বেশিক্ষন সহ্য করতে পারবে না l মনে হবে নরক থেকে উঠে আসা কোন পিশাচের রক্ত হিম করা আহ্বান …..ll
আমার মানব সত্ত্বা কখন যেন হারিয়ে গেছে l নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কখন যেন খুইয়ে বসেছি ! চারিদিকে শুধু অন্ধকারের মধ্যে ছায়া ছায়া সাদা কিছু শরীর চোখে পড়ছে ! তাদের ফিসফিসানি …শিহরণ জাগানো হাসি , মনটাকে ভেঙ্গে ￰খন্ড বিখন্ড করে দিচ্ছে l
হঠাৎ শিউরে উঠলাম …….মনে হলো আমার কপালে কে যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো চেপে ধরলো ………ll

…কপালের জ্বলুনি কমার সাথে সাথে , মনে হলো একটা কালো পর্দা চোখের সামনে পড়ে গেলো l চারিদিকে শুধু তাল তাল কালো অন্ধকার ! ওই ভয়াল কালো অন্ধকার দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে চলেছি l এ কোন অন্তহীনের পথে আমি চলেছি ? কিসের লক্ষ্যে ?
এই ভয়ঙ্কর আঁধার থেকে প্রাণ মুক্তি চাইছে l …দূরে চোখে পড়ছে..এক বিন্দু আলো ! আলোটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ! চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম l ￰এতদূর থেকে চোখে পড়ছে , হারিকেন জ্বলছে একটা ছোট বাড়ির ঘরে l আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি , ঘরের ভেতরকার দৃশ্য এতদূর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার জন্যে !
তবে কি এখনও আমার ভেতরে শ্বাপদের সত্ত্বা কাজ করছে ? …ঘরে একটা লোক , একজন বউ কে গলা টিপে ধরছে l ￰যন্ত্রনায় মেয়েটা ছটফট করছে l চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে l লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি l কিছুক্ষনের মধ্যে মেয়েটার শরীর শিথিল হয়ে পড়লো l লোকটার মুখে জান্তব হাসি l
খুব সম্ভবত মেয়েটার চিৎকারে, আশপাশের কিছু লোক বেরিয়ে এসেছে l …খুনিটা বুঝে গেলো , পালাবার পথ বন্ধ l এবার ওর মুখে ভয় বাসা বাঁধলো l এদিক ওদিক তাকালো….আলো হাতে আরও কয়েকজন চলে এসেছে l কিছু লোক দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে l ও পালাবার জন্যে পাগলের মতো ছোটা ছুটি শুরু করলো l শেষে বুঝলো , ওকে ধরা পড়তেই হবে l
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো l রান্নাঘরের কোণ থেকে , ধারালো আঁশ বঁটি টা তুলে …সজোরে নিজের গলায় কোপের পর কোপ বসিয়ে চললো l ￰ফিনকি দিয়ে টকটকে লাল গরম রক্ততে ও স্নান করতে শুরু করলো l পর পর দুটো বীভৎস মৃত্যুর ছবি , আমাকে স্থবির করে দিলো l
আচমকা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কে বলে উঠলো l ” বড়ো কষ্ট ! সন্দেহের বশে নিজের বৌকে খুন করলাম l তারপর নিজে আত্মহত্যা ! আমার থেকে বড়ো আর কে পাপী আছে ? তুই পীর বাবাকে দিয়ে মুক্তির পথ করে দে l নাহলে , তোর মরণও আমার হাতে l”
সভয়ে ঘাড় ঘোরাতে , একদম চোখের সামনেই , রক্ত স্নান করা লোকটাকে দেখলাম l মাথাটা দেহের ওপর কয়েকটা দড়ির মতো শিরা উপশিরা দিয়ে আটকানো l যে কোন মুহূর্তে দেহ থেকে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে যাবে ! ভয়ে আর্তনাদ করার আগেই সেই মৃত শরীরটা বললো l
” আমাকে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দে l তোর ওই পীর বাবাকে বলে , মুক্তির ব্যবস্থা করে দে l সেই জন্যেই তোর শরীরে বাসা বেঁধেছি l ” বারবার একই কথা বলে চললো l এতো কাছ থেকে ঐরকম ভয়ঙ্কর মূর্তির উপস্থিতি বোধ হয় আমার স্নায়ু সহ্য করতে পারলো না l জ্ঞান হারালাম l
একটা ক্ষীণ শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগলো , যেন মহা সিন্ধুর ওপার থেকে কেউ ডাকছে ! সেই ডাকে সাড়া দিয়ে চোখ খুললাম l পীর বাবা কপাল থেকে আঙ্গুলটা সরিয়ে নিলেন l শরীরটা হালকা আর ঝরঝরে লাগছে l
বাবার শান্ত গলা ” একটু বোস , এবার তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবি l ” ময়ূরের লম্বা লম্বা পালক দিয়ে তৈরী একটা ঝাঁটার মতো জিনিস , মাথায় আর দুই কাঁধে ঠেকালো l এরপর এক গোছা ধূপ কাঠি জ্বালিয়ে কপাল আর সারা মুখে , বুকে বুলিয়ে দিলো l ￰আশ্চর্য্য , একটুও গরম বা ছ্যাঁকা লাগলো না l
” এবার নিশ্চিন্তে বাড়ি যা l যা জানার আমি জেনে নিয়েছি , বাকি কাজটুকু আমার l ” আমি বলতে যাচ্ছিলাম সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা l হাত তুলে আমাকে থামিয়ে বললেন l ” তোর মনের মধ্যে থেকে সেই প্রেতাত্মার মুক্তির প্রাথর্না জেনেছি l আর নতুন করে বলতে হবে না “l
উঠে দাঁড়ালাম সুস্থ শরীরে l প্রণাম করে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি , পীরবাবার গলা কানে এলো l এই ঠিক দুপুর বেলা যাচ্ছিস , আলপথ টুকু সাবধানে যাবি l পিছু থেকে আমিও যদি ডাকি ? ফিরবি না বা সাড়া দিবি না l আর কোন চলন্ত ছায়া মাড়াবি না l ”
একটু থমকালাম l তবে কি বিপদ সম্পূর্ণ কাটেনি ? বাবা বুঝলো l ” ভয় নেই l বুঝিস তো এইসব , অতৃপ্ত আত্মা ঘোরাফেরা করে একটু মুক্তির আশায় l তাই কখনো সখনো ওরা ভর করে l তোকে আমি বেঁধে দিয়েছি l কিছু সময় এর শক্তি থাকবে l ক্ষমতা হবে না কিছু করবার l তবু সাবধানের মার নেই l ”
সাহস ফিরে এলো মনে l বাইরে বেরিয়ে এলাম l অনেক দর্শনার্থীর ভিড় l কালিপুর রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম ….l যেখানে খোকন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে l

………………………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত