শেষ যে বার আমি আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলাম, তখন আমি এ কাহিনিটা শুনেছিলাম আমার এক সহযাত্রীর মুখে।
এক রাত্তিরে, তখন আমাদের ডিনার সদ্য শেষ হয়েছে, কে একজন বলে উঠল আমরা এখন যে জায়গাটা পেরোচ্ছি, ঠিক সেখানেই লুসিটানিয়া নামের জাহাজটা ডুবেছিল। ঘটনাটা সত্যি হোক আর না হোক, শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই চুপ মেরে গেলাম। গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলাম সেই সব লোকজনের কথা, যারা বুঝেছিল আর কোনও আশা নেই, জাহাজ ডুবছে, তাদেরও জাহাজের সঙ্গেই ডুবে মরতে হবে সমুদ্রের অতল গভীরে।
তবে তারপরেই কথাটা অন্যদিকে ঘুরে গেল। আমরা বলাবলি শুরু করলাম, যারা ডুবে গেল, তাদের কি কপাল, কারণ যুদ্ধে গিয়ে তিলে তিলে মরার থেকে একবারে ডুবে মরা অনেক ভাল। তারপর এক মহিলা, তিনি স্কটল্যান্ডের মানুষ, খুব সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলেন যারা ডুবে যায়, তাদের ভূত কি জলের ওপরে, এমনকি জাহাজেও উঠে আসতে পারে? মানে ওঁর বক্তব্য হল, ওঁর কেবিনের আলোটা রাত্তিরে নিভিয়ে দিলে ‘তেনাদের’ দেখা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা। এটা শুনে, বলাই বাহুল্য, প্রায় সবাই এমন খ্যাকখ্যাক করে হাসতে শুরু করল যে কি বলব! প্রায় সবাই বললাম, কারণ একটা লোক হাসেনি, বরং মন দিয়ে শুনছিল। ছোটখাটো চেহারা, মুখের চেহারা দৃঢ়, গায়ের রঙ ধূসর। মহিলা ব্যাপারটা খেয়াল করে তাঁর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
‘এই যে – আপনি – আপনি বোধহয় আমার মতই – ভূতে বিশ্বাস করেন?’
লোকটা একটু ইতস্তত করল, কিছু ভাবল বোধহয়। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ভূতে বিশ্বাস? না, তা বোধহয় নয়। এ ব্যাপারে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আমি কোনোদিনও ভূত দেখিনি। আপনারা কেউ দেখেছেন নাকি?’
এর উত্তরে অবশ্য বেশিরভাগ লোকই হাসল, তবে সেটা কাষ্ঠহাসি।
‘ব্যাপারটা হল, জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে, যার কোনও ব্যাখ্যা করা যায় না বা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মানে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার জীবনে এরকম কোনও ঘটনা ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত হাসাহাসি করাই যায়। কিন্তু হলে আর হাসি পায় না। যেমন ধরুন কোনও গাড়ি –’
লোকটার কথায় বাধা পড়ল, কারণ জাহাজের বাঁশি বেজে উঠেছে। সবাই ছুটে গেলাম ডেকে। বাঁশি থেমে গেলে দেখলাম আমাদের চারধারে ঘন কুয়াশা। আপার ডেকে সেই লোকটাকে দেখলাম, পায়চারি করতে করতে চুরুট টানছে। সামান্য কিছু কথার পর আবার আমাদের কথাবার্তা শুরু হল সেইখান থেকে, লোকটা যেখানে শেষ করেছিল। আমাদের হাসিঠাট্টা লোকটার মনে আছে দেখলাম।
‘অনেক ঘটনাই ঘটে, যা আমাদের কল্পনার বাইরে’, ভদ্রলোক শুরু করলেন, ‘আমরা এটা-ওটা- সেটা নিয়ে হাসাহাসি করি ঠিকই, তারপর হঠাৎই এমন কোনও ঘটনা ঘটে যায়, যা আমাদের একেবারে চুপ করিয়ে দেয়। আমি অবশ্য সাধারণ মানুষ, তবে আমার জীবনেই একবার এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যেটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। হয়ত ঘটনাটা অন্যান্য লোকেরা বিশ্বাস করবে না, বা তাদের মত করে ব্যাখ্যা দেবে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। আপনি শুনতে চাইলে চলুন, ওই ধারে গিয়ে বসি, ওখানে হাওয়া-টাওয়াগুলো কম।’
আপত্তির অবশ্য কোনও কারণ ছিল না। বসার পর ভদ্রলোক শুরু করলেন।
‘কয়েক বছর আগে আমি উত্তর ইংল্যান্ডে মাস কয়েকের জন্য গেছিলাম। একটা কোর্ট কেসে জড়িয়ে পড়েছিলাম, কেসটা কি এখন আর ঠিকঠাক মনে নেই, অনেকদিন হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে চলেছিল মামলাটা, তখন আমার বয়স বছর কুড়ি হবে। যাই হোক, ম্যানচেস্টারের কোর্টরুমে বসে আমি ভাবছিলাম, যদি সব কিছু ঠিকঠাক চলে, যদি মামলাটা আমার পক্ষে যায়, তবে আমি তক্ষুনি কোথাও চলে যাব খোলা হাওয়ায় বিশ্রাম নিতে। এবং তার ফলে হল কি, পরদিন সকালেই আমি উত্তরের একটা ট্রেনে চড়ে বসলাম।
‘সময়টা তখন হেমন্তের প্রথম দিক। আমি যখন গিয়ে নামলাম, তখন রাত হয়ে গেছে, চারদিক বেশ ঠান্ডা। গ্রামের চারধারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোনও লোকজন নেই। আসলে ওসব জায়গায় লোকে সন্ধ্যের পর রাস্তাঘাটে বিশেষ বেরোয় না, আর ওখানকার পাহাড়ি ঠান্ডা হাওয়ায় বেরোনোর ইচ্ছেও কারোর থাকে না। হোটেল আছে বটে, তবে সে হোটেলের চেহারা আর কহতব্য নয়। সেখানে থাকলে মনে হতে বাধ্য যে বেড়ানো-টেড়ানো নয়, বাড়িই হচ্ছে আসল আরামের জায়গা। বাড়িওলা রাত্তিরের খাবার বলে যে বস্তুটা দিল, সেটা খাবারের পর্যায়ে পড়ে কিনা সন্দেহ। টুপি মাথায় পাইপ টানতে টানতে ঘর দেখিয়ে দিল লোকটা। কনকনে ঠান্ডা ঘর। আমি আগুন চাইতে লোকটা নির্বিকার মুখে বলল এত রাতে তার পক্ষে কাঠশালায় গিয়ে কাঠ এনে আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়, যা হবে সকালে হবে। কি আর করব, ভাবলাম বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে শরীর গরম করে আসি, তাতে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য ঘরের আলোর বিচ্ছিরি তেলের গন্ধটার থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।
‘যদিও জায়গাটা চিনতাম না বলে বেশি দূর না যাওয়াই ঠিক করলাম। আকাশ মেঘে ঢাকা, জোরালো হাওয়া বইছিল উত্তর-পূর্ব দিক থেকে, মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল, আকাশে চাঁদ থাকলেও সে চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়ে গেছিল, তবুও চারদিকে একটা হালকা আলোর আভাস ছিল, ধূসর গোধূলির মত, সে আলো পরিষ্কার চন্দ্রালোকের মত না হলেও কিছুদূর পর্যন্ত দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এই কারণেই, হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম থেকে অনেক দূর চলে এলাম। গ্রামের মতই সে জায়গাটাও অসম্ভব নির্জন। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ আর আগাছা, নিচে একটা পাহাড়ি ঝরনা। হাওয়াতে দুলছিল গাছের পাতাগুলো, আওয়াজ হচ্ছিল শনশন করে, নিচের ঝরনার জল পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল কুলকুল আওয়াজ করে, সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছিল কারা যেন কথা কইছে। কখনও কখনও গাছের শাখাপ্রশাখা এত ঘন হয়ে যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন গুহার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। নিবিড় অন্ধকারে নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না। আরও খানিকক্ষণ হেঁটে সেই গাছের গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম, আবার চারদিক ছেয়ে গেল সেই ধূসর গোধূলির মত আলোয়, কিছুদূর পর্যন্ত দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।
‘সব মিলিয়ে মিনিট পঁয়তাল্লিশ হেঁটেছিলাম মনে হয়, তারপর এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, একটা নিচের দিকে নেমে প্রায় ঝরনাটার সমতলে চলে গেছে, আর একটা উঠে গেছে সোজা হয়ে সামনের খাড়া পাহাড়টায়। খানিকক্ষণ ভেবে-টেবে আমি ওপরে ওঠাই ঠিক করলাম। প্রায় আধমাইল মত ওঠার পর যখন আমি ভাবছি কোনওক্রমে দিকভুল হয়ে গেলে মহাবিপদে পড়ব, তখন পায়ে চলা পথটা – হ্যাঁ, তখন আর ওটাকে রাস্তা বলা যায় না, হঠাৎ করে বেঁকে একটা মালভূমিতে এসে দাঁড়াল। সেখানেই দেখলাম একটা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি, তিনতলা সমান উঁচু, দুপাশে বারান্দা এবং যেখানে বাড়িটা রয়েছে, সেখান থেকে দুপাশে বহুদূর থেকে দেখা যায়। বাড়িটা থেকে কিছুটা দূরে কয়েকটা বিশাল গাছ এবং এর ঠিক পেছনে ঘন ঝোপের জঙ্গল। তবে দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো কিন্তু জোরাল হাওয়ার হাত থেকে বাড়িটাকে রক্ষা করতে পারবে না।
‘যাই হোক, আমি প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশিই হলাম, কারণ বাড়ি যখন একটা পাওয়া গেছে, তখন রাস্তা হারালেও চিন্তার কিছু নেই, ওখানে আশ্রয় পাওয়া যাবে, বা বাড়ির লোকজন ঠিকঠাক রাস্তা বাতলে দিতে পারবে।
‘কিন্তু আমি বাড়িটার কাছাকাছি গিয়েই বুঝতে পারলাম, ওখানে কেউ থাকে না। সব কটা জানলা বন্ধ আর কোথাও কোনও আলোর চিহ্নমাত্র নেই। কেন জানি না, গা-টা শিরশির করে উঠল, অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। আপনি যদি ভাবেন আপনি জাহাজের রেলিং টপকে নিচে পড়ে গেলে কি হবে, বা ধরা যাক এমন একটা ঘরের সামনে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, যে ঘরের ভেতরে আপনি জানেন একটা মড়া পড়ে আছে, তখন আপনার যে অনুভূতি হবে, এর সঙ্গে তার তুলনা করা যায়। তখন আপনার মনে হবে যেখানে আছেন, সেটাই ভাল। আমারও তখন বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছিল। যদিও আমি ভয় পাইনি। আমি লোকালয়ের থেকে বহুদূরে চলে এসেছি ঠিকই, আশেপাশে কেউ নেই, সাহায্য করলে করতে পারে ওই বাড়ির বাসিন্দারাই, যদি অবশ্য কেউ থেকে থাকে, তবুও আমার মনে হচ্ছিল আমি এখানেই সম্পূর্ণ নিরাপদ। শিরশিরে ভাবটা হচ্ছিল স্রেফ চারপাশের আদিম প্রকৃতি আর এরকম একটা বিজন জায়গায় আচমকা একটা বাড়ি দেখে। এরকম ভেবে-টেবে, রাস্তা দিয়ে আরও এগোনোর বদলে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে একটা পাথরের দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেয়ালের ওপর হাত রেখে দেখতে লাগলাম সামনে। এখান থেকে বাড়িটা আড়াইশো গজের বেশি দূরে নয়।
‘দূরে পাহাড়ি অধিত্যকায় ছড়ানো ছিল একটা অদ্ভুত আলো, প্রথম ভোরের আলো বা শেষ বিকেলের আলো যেরকম হয়, সেরকম। পাহাড় আর আমার মাঝখানে একটা বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা। আমার ডানদিকে রয়েছে একটা আপেল বাগান, আর দেখলাম দেয়ালের গায়ে একটা পাথরের সিঁড়ি, যাতে বাড়ির লোকজন এদিক-ওদিক যেতে পারি।
‘বেশ খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ দেখলাম একটা লোক বাগানের দিক থেকে আমার দিকে আসছে। চলার ভঙ্গি স্বাভাবিক আর কাছে আসার পর দেখলাম লোকটা বেশ লম্বা, ভাল চেহারা, বয়স পঁচিশ-তিরিশ, পরিষ্কার কামানো মুখ, মাথায় টুপি, গায়ে গাঢ় উলেন শার্ট। যখন সে সিঁড়ির কাছে এসে উঠতে শুরু করল, আমি তাকে গুডনাইট জানালাম, কারোর সঙ্গে দেখা হলে আমরা যেরকম করি। কিন্তু তার কোনও উত্তর না দিয়ে সে সোজা আমার দিকে তাকাল, সেই চাহনি দেখে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। মুখটা কিন্তু ভয়াবহ কিছু নয়, বরং রীতিমত সুদর্শন, কিন্তু সেই মুখে যে কিসের ছাপ ছিল, তা আমি বোঝাতে পারব না। কোনও ভয়াবহ তাগিদ কাজ করছিল ওর মনের গভীরে, তাই ও এগিয়ে যাচ্ছিল সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে একমাত্র সেই লক্ষ্যেই। আমার মনে হল ও হয়ত আমাকে খেয়ালও করেনি।
‘কয়েক সেকেন্ড পর, আমি যখন ঘুরে দেখতে গেলাম লোকটা কোনদিকে গেল, দেখলাম লোকটা নেই। কোত্থাও নেই। সামনেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। আমার ব্যাপারটা অসম্ভব লাগল, কারণ যদি ও দারুণ জোরে দৌড়োয়ও, তাহলেও কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকে পড়া সম্ভব নয়। অবশ্য সামনে লোকটা নেই মানেই যে সে অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মেনে নেব, আমি সে জাতের লোক নই। আমার মনে হল আমি ঠিকমত খেয়াল করিনি। লোকটা নির্ঘাত দেয়ালের কোনও ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাগানেই ফিরে গেছে অথবা এত কম আলোতে আমার দেখতেই কোনও ভুল হয়েছে।
‘কিন্তু আমি যখন দেয়ালের দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকে বাড়িটা দেখছিলাম, তখন খেয়াল করলাম জানলার শাটারের ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। আলোটা কখনও বাড়ছিল, কখনও কমছিল, এমনভাবে, যেন আগুন জ্বলছে। এবং আর একটু দেখেই আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, বাড়িটায় আগুন লেগেছে। কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল ছাদ দিয়ে, বাতাসে উড়ে আসছিল আগুনের ফুলকি। আর তখনই বারান্দার ওপরে ছাদের দিকের একটা জানলা খুলে গেল, আর শুনলাম এক মহিলা চিৎকার করছে। যত জোরে পারি সেদিকে ছুটলাম। কাছে গিয়ে মহিলাকে পরিষ্কার দেখতে পেলাম।
‘একেবারে কমবয়সি একটা মেয়ে। হাওয়ায় উড়ছে তার এলোমেলো চুল সাদা রাতপোশাকের ওপর দিয়ে। দুহাত ছড়িয়ে সে চিৎকার করছে। দেখতে পেলাম তার পেছনে একটা লোক এসে তার হাত ধরল, কিন্তু পালাতে পারল না। তখন জানলায় আগুন ধরে গেছে, ধোঁয়ায় তাদের দম আটকে আসছে। তাদের চারধারেই এখন আগুনের বলয়।
‘চোখের সামনে এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম ওদের পরিণতি কি হতে পারে, তবুও আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এটাও ভাবছিলাম ওরা যদি কোনওক্রমে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে, তাহলে হয়ত আমি ওদের ধরে ফেলতে পারব। আমি চিৎকার করে ওদের তাই বলছিলাম, আমি তখন আগুনের একেবারে কাছে চলে গেছি, ঠিক সে সময়েই আমি থমকে গেলাম একটা আশ্চর্য জিনিস খেয়াল করে – আগুনের কোনও উত্তাপ নেই।
‘আমি আগুনের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কোনও উত্তাপ টের পাচ্ছি না। আগুনের ফুলকি ছুটছে, আমার গায়ে এসে পড়ছে, কিন্তু গা পুড়ছে না। আরেকটা ব্যাপার, ধোঁয়া উড়ছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, কিন্তু সে ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে না, এমনকি ধোঁয়ার কোনও গন্ধ পর্যন্ত আমি টের পাচ্ছি না। আর আগুনের হলকায় আকাশও আলোকিত হয়ে ওঠেনি।
‘হতভম্ব হয়ে যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এ জিনিস কি করে সম্ভব, তখন বিরাট এক আগুনের কুণ্ডলী গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটা ধ্বসে পড়ল আমার চোখের সামনে একটা লাল ধ্বংসস্তুপ হয়ে।
‘চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখার পর আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না, দৌড়তে শুরু করেছিলাম সেই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে, কোথায় যাচ্ছি না জেনেই, সমানে চিৎকার করছিলাম সাহায্যের জন্য। দৌড়তে দৌড়তে চলে এসেছিলাম একটা ছোট কাঠের ব্রিজের কাছে, ব্রিজটা ছিল সেই জলস্রোতের ওপর, জায়গাটা রাস্তাটা যেখানে দুভাগ হয়ে গেছে, তার একদম কাছে। দেখলাম সেখানে খানিকটা আলগা দড়ি পড়ে আছে। দড়িটার একটা দিক ব্রিজের রেলিঙের সঙ্গে বাঁধা, বাকি অংশটা নিচের দিকে ঝুলে আছে। আমি ঝুঁকে দেখতে গেলাম সেখানে কি আছে।
‘সেখানে, ব্রিজ আর জলের মাঝখানে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে একটা মানুষের দেহ। আমি ঝুঁকে পড়ে ভাল করে দেখলাম এবং চিনতেও পারলাম। এটা সেই লোকটার দেহ, যে আপেল বাগান থেকে বেরিয়ে এসেছিল। লোকটার টুপি খুলে পড়ে গেছে, আর জুতোর ডগাটা জলের ওপরটা একটুখানি ছুঁয়ে আছে।
‘নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না এই দৃশ্য, কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি। কিছুক্ষণ আগে যাকে দেখলাম, সেই লোকটা এখন ঝুলছে এখানে। হোঁচট খেতে খেতে ব্রিজের পাশ দিয়ে নিচে নেমে আমি দেহটাকে ধরতে গেলাম, হাত বাড়ালাম ওর আলগা হয়ে থাকা জামাটা ধরার জন্য, মনে হল ধরতে পারলামও, তারপর দেখলাম আমি কিছুই ধরিনি, যা ধরেছি, তা খানিকটা হাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমার চোখের সামনেই দেহটা গলায় ফাঁস এঁটে ঝুলছে!
‘এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আতঙ্কে আমি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব, তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমি দৌড়তে শুরু করলাম হোঁচট খেতে খেতে সেই অন্ধকার রাস্তা দিয়ে, তখন আমার একমাত্র লক্ষ্য কোনওক্রমে লোকালয়ে পৌঁছে লোকজনের সান্নিধ্য পাওয়া, তবে যে মুহূর্তে আমি গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভাবছিলাম, এখানে আমাকে কেউ চেনে না। আমি সদ্য ম্যানচেস্টার থেকে এখানে এসেছি একটা বিচ্ছিরি মামলার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে, আর গ্রামের লোকেরা, ওরা সাধারণত সরল সাধাসিধেই হয়, ওদের যদি কোনও সন্দেহ হয়, তাহলে হয়ত ঝামেলা করতে পারে, এমনকি হয়ত কোনও কারণ ছাড়াই পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। তার থেকে বুদ্ধিমানের কাজ হল বাড়িওলাকে আভাসে ইঙ্গিতে ব্যাপারটা জানানো, তারপর দেখা যাক উনি কি করেন।
‘দেখলাম আমি বেরোনোর সময় লোকটা যেখানে ছিল, সেখানেই বসে বসে পাইপ খাচ্ছে, সেই জামাকাপড়ে, মাথায় টুপি চড়িয়ে। আমাকে দেখে বলল, ‘যাক, ফিরেছেন তাহলে। ভাবছিলাম আপনাকে আবার কোথায় খুঁজতে যাব।’
‘‘এই একটু হাঁটতে গেছিলাম আর কি’, বললাম আমি। তারপর খুব ক্যাজুয়ালি সেই রাস্তার দুভাগ হওয়া, সেই পাহাড়, সেই মালভূমির কথা বলে যেন কিছুই হয়নি, সেভাবে বললাম, ‘আচ্ছা, ওই বাড়িটায় কে থাকে বলুন তো? পাহাড়ের মাথায় ওই বাড়িটায়?’
‘লোকটা আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ‘বাড়ি? ওখানে তো কোনও বাড়ি নেই। ও জায়গাটা ছিল বুড়ো জো স্নেডেকারের, ও একবার বলেছিল বটে ওখানে বাড়ি করবে, যাতে ছেলে বিয়ে করে ওখানে থাকতে পারে। কিন্তু ও তো বাড়ি করা শুরুই করেনি, আমাদের ধারণা, করবেও না।’
‘‘কিন্তু মনে হল যেন আমি ওখানে একটা বাড়ি দেখলাম’, আমি মিনমিন করে বললাম বটে, কিন্তু ভাবছিলাম অনেক কিছুই। আগুনের কোনও আঁচ লাগছিল না, দেহটা ধরতে পারলাম না। কাজেই বাড়িটা দেখেছি এটা জোর গলায় বলার মত সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না।
‘‘ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন’, বাড়িওলার গলা বেশ নরম, ‘শুয়ে পড়ুন বরং।’
এতক্ষণ পরে থামল লোকটা। খানিকক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। শুনছিলাম জাহাজের ইঞ্জিনের গুঞ্জন, তারের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, জাহাজের গায়ে লেগে ঢেউ ভাঙার আওয়াজ। নিচের ডেকে কারা যেন গান গাইছিল। মনে হল লোকটাকে কিছু বলা দরকার।
‘আমার মনে হয়’, বললাম আমি অবশেষে, ‘আপনার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছিল, যাকে বলে হ্যালুসিনেশন। আসলে ওই মামলায় ফেঁসে গিয়ে আপনাকে এত চাপ নিতে হয়েছিল যে তার ফলেই আপনি নানারকম কল্পনা করে ভুল দেখেছিলেন।’
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম’, লোকটা বলল, ‘যখন আমি পরের দিন সকালে আবার ওই মালভূমিতে গেলাম এবং দেখলাম সেখানে কোনও বাড়ি নেই এবং কোনওদিন সেখানে কোনও বাড়ি ছিল বলেও মনে হয় না।’
‘আর ব্রিজেও নিশ্চয়ই কোনও মড়া ছিল না?’ আমি হেসে বললাম।
‘না, ছিল না।’
লোকটা আরেকটা চুরুট ধরানোর চেষ্টা করল। হাওয়ায় ধরানো যাচ্ছিল না, কিছুক্ষণ চেষ্টার পর যখন ধরানো গেল, লোকটা চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে তাকাল।
‘শুনুন। আমি বলেছিলাম যে ঘটনাটা বহু বছর আগের এবং আমি ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। আপনি যদি কোনও ঘটনাকে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন যে ওটা কাল্পনিক, তাহলে সেটা মন থেকে মুছে যেতে বেশি সময় লাগে না, কারণ কাল্পনিক ছবির এমন কোনও ক্ষমতা নেই যে সেটা দীর্ঘদিন মনের মধ্যে জেঁকে বসে থাকবে। যখনই ওটা মনে হত, আমি ভাবতাম সত্যিই ওই দিন আমি কিরকম আগড়ুম বাগড়ুম খেয়ালই না দেখেছি। এইই, আর কিছু না।
‘ব্যাপারটা হল, গত বছরই আমি ওই গ্রামে আবার গেছিলাম। আমি সেই বাড়িটাতেই উঠেছিলাম, বাড়িওলাও আমাকে একবারেই চিনতে পেরেছিল, বলেছিল, ‘আপনি তো সেই লোক, যিনি ওখানে একটা বাড়ি দেখেছেন ভেবেছিলেন। আপনার ঘটনাটা মনে আছে নিশ্চয়ই’, সে বলল।
‘আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। বাড়িওলা বলল, ‘যদিও ওখানে সত্যিই একটা বাড়ি ছিল।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ মশাই। বুড়ো স্নেডকার ছেলের জন্য বাড়িটা বানিয়েছিল। দারুণ বাড়ি মশাই, দুধারে বারান্দা সমেত। ছেলে, ইয়ং জো, বিয়ে করেছিল উইন্ডমেয়ারের মেবেল এলটিং নামের একটা মেয়েকে। মেয়েটা লিভারপুলের একটা দোকানে চাকরি করত। এখন, এখানকার একটি ছেলে, নাম জিম ট্র্যাভারস, তার সঙ্গে এই মেয়েটির সম্পর্ক ছিল। জিম মেয়েটাকে পাগলের মত ভালবাসত, এমনকি এখান থেকে লিভারপুলে গিয়ে দেখাও করত। কিন্তু মেয়েটি শেষ পর্যন্ত এই ছেলেটাকে ছেড়ে জো-কে বিয়ে করে। সেটা, আমার ধারণা, জো-র এত বড় বাড়ি আর ওর বাবার টাকাপয়সা দেখেই। বেচারা জিম রাগে, দুঃখে, অপমানে পাগলের মত হয়ে যায় এবং বিয়ের দিন রাতেই, নবদম্পতি যখন ওই বাড়িতে, জিম বাড়িটাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওরা বাড়িশুদ্ধুই পুড়ে মারা যায়। জিম কিন্তু খুব ভাল ছেলে ছিল। মনে হয় সে সময় ও মদ খেয়ে সম্পূর্ণ বেহুঁশ ছিল, না হলে সুস্থ মাথায় এ জিনিস চিন্তাও করা যায় না।’
‘না, মদের ঘোরে ছিল না’, আমি বললাম।
বাড়িওলা অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল।
‘কি বললেন?’
‘না, কিছু না।’
‘আপনি ঘটনাটা জানেন নাকি?’
‘না, আপনি বলুন।’
‘ও বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর জিম চলে যায় আধমাইল দূরের একটা কাঠের ব্রিজে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে সেখান থেকে ঝুলে পড়ে। মনে আছে, যেখানে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে? সেই জায়গাটায়। আমি নিজে পরদিন সকালে গিয়ে বডি দেখে এসেছিলাম। ওর জুতোর ডগাটা জলের সঙ্গে লেগেছিল।’
………………………………………………….. (সমাপ্ত) …………………………………………………..