কথায় আছে, বিদেশে বাঙালি সজ্জন। কিন্তু রুদ্রনাথ লাহিড়ী ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমী মানুষ। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। নামি এক কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে নতুন চাকরি নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছি। তখন অবশ্য নাম ছিল বোম্বাই। এই কাহিনিতে সেই নামটিই ব্যবহার হয়েছে। যাই হোক। পরিচিত পরিবেশ থেকে ছিটকে আমার তখন ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবস্থা। যে সংস্থায় চাকরি, সেখানে আমিই একমাত্র বঙ্গসন্তান। আর যেখানে থাকতাম, সেই সাকিনাকাতেও একই অবস্থা। না, সামান্য ভুল হল। আমার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রথমেই নজরে পড়ত বড় রাস্তা থেকে সামান্য উঁচুতে এক পাথুরে টিলার উপর ছোটমতো এক পুরোনো বাংলো বাড়ি। মিনিট পাঁচেকের পথও নয়। রুদ্রনাথ লাহিড়ী ওই বাড়িতেই থাকতেন। উনি যে নির্ভেজাল বাঙালি, তা জানতেই আমার বছর খানেক লেগে গিয়েছিল।
বাংলোটা বেশ নিরিবিলিতে। চারপাশ ফাঁকা, নির্জন। প্রায়ই দেখতাম, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বাংলোর হাতায় আরাম কেদারায় বসে একমনে পাইপ টানছেন। নয়তো নিবিষ্ট মনে কাগজ পড়ছেন। এছাড়া আকাশ ভাল থাকলে প্রতিদিন সকালে মর্নিং ওয়াকে বের হতেন। বয়স হলেও ছ”ফুটের উপর দীর্ঘ বলিষ্ঠ শরীরে সামান্য মাত্র ভাঁজ পড়েনি। প্রশস্ত কপাল। মাথার চুলে সামান্য পাক ধরেছে। ঠোঁটের উপর কাঁচাপাকা ভারী একজোড়া গোঁফ। ডান হাতটা সর্বদা প্যান্টের পকেটে ঢোকানো। পরে বুঝেছিলাম, হাতটা আর্টিফিশিয়াল। বাঁ হাতে ছোট একটা ছড়ি নিয়ে যখন মর্নিং ওয়াকে বেরুতেন, দু-এক দিন সামনে পড়ে গেছি। কিন্তু মানুষটির গম্ভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপ করতে ভরসা হয়নি। কোনও দিন রাস্তায় কারো সঙ্গে কথা বলতেও দেখিনি তাঁকে।
যাই হোক, এরপর যেদিন ভদ্রলোকের নাম কানে এল, প্রায় চমকে উঠেছিলাম। প্রথমে তো বিশ্বাস করতেই পারিনি। যে ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতাম, তার সর্বক্ষণের চৌকিদার ছিল প্রমোদ কামলে। সবাই কামলে বলে ডাকত। সদর ফটকের পাশে এক খুপরিতে আস্তানা। নিরীহ ভালোমানুষ। প্রয়োজনে ছোটখাটো ফাইফরমাশ নীরবেই করে দিত। এখানে শুরু থেকেই আছে জেনে একদিন ভদ্রলোকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওকে। উত্তরে কামলে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে দু”হাত কপালে ছুঁইয়ে বলল, “শেঠ, উনি রুদ্রদেব। স্বয়ং ভগবান।”
বলা বাহুল্য, এমন উত্তর একেবারেই আশা করিনি। থতমত খেয়ে বললাম, “প্রায় দিনই তো দেখতে পাই ওনাকে। কিন্তু তোমাদের কাউকে তো ওনার কাছে দেখিনি! বরং সামনে পড়ে গেলে দ্রুত সরে পড়তেই দেখেছি!”
উত্তরে কামলে সামান্য ঘাড় ঝোঁকাল। দু”হাত ফের কপালে ঠেকিয়ে বলল, “আমরা গরীব মানুষ শেঠ। ইচ্ছে করলেই কি ভগবানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়? উনিও চান না। তাই দূর থেকে সালাম জানাই।”
নিরক্ষর মানুষ প্রমোদ কামলেকে সেই মুহূর্তে ঘাঁটাইনি। তবে কৌতূহল দমন করাও সম্ভব হয়নি। পরবর্তী দিন কয়েক নানাভাবে প্রশ্ন করে ওর কাছ থেকে যা জানতে পেরেছিলাম, তা অবশ্য যথেষ্টই চিত্তাকর্ষক। তাতে কৌতূহল কমার বদলে বরং আরও বাড়ল।
বছর পনেরো আগের কথা। বোম্বাই শহরের প্রান্তে এই সাকিনাকা অঞ্চল তখন যথেষ্টই ফাঁকা। পাহাড়ি টিলার ফাঁকে বড় এক নালা। রুক্ষ পাথুরে জমি, ঝোপঝাড়। খানিক দূরে পাওয়াই লেকের দিকে নতুন বসতি গড়ে উঠলেও, এদিকটা তখনও বেশ খালি। বসতি বলতে কিছু গরিবগুরবো মানুষের ঝুপড়ি।
কিন্তু অবস্থা হঠাৎই পালটাতে শুরু করল। স্বাধীনতার পরে এদেশে যে শহরগুলির জাঁকজমক আগে বেড়েছে, বোম্বাই তাদের মধ্যে প্রথম। নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রি আর অফিস। দেশের নানা জায়গা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ বোম্বাই শহরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল। সবার দরকার মাথা গোঁজার আস্তানা। শহরের ভিতর যেখানে যা ফাঁকা জমি ছিল, ভরতি হয়ে যাবার পরে নজর পড়ল আশপাশে। বাদ গেল না সাকিনাকাও। আগেই বলেছি, আন্ধেরীর কাছে এই অঞ্চলে ছোট পাহাড়ি টিলার মাঝে তখন বিস্তর ফাঁকা জায়গা। সামান্য কিছু গরিবগুরবো মানুষের বাস। তাদের হটিয়ে একের পর এক বাড়ি উঠতে শুরু করল। জমির দখল নিয়ে কিছু ঝামেলাও হয়েছে। কিন্তু পুলিশ আর প্রমোটারদের মস্তান বাহিনীর সঙ্গে গরিবগুরবো মানুষ পেরে ওঠেনি। প্রাণও গেছে কয়েকজনের। পুলিশের সামনেই। কোনও প্রতিকার হয়নি। গোড়ার দিকে তাই বাধা দেবার চেষ্টা হলেও, পরে নিজেরাই ঘরবাড়ি ফেলে চলে গেছে অন্য কোথাও। এই সময় একদিন এক ব্যাপার ঘটল। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির কাছেই ঝুপড়ি বেঁধে বাস করত প্রমোদ কামলেরা কয়েক ঘর মানুষ। হঠাৎই এক সকালে ট্রাক বোঝাই একদল গুণ্ডা–মস্তান চড়াও হল ওদের উপর। ঘরবাড়ি ভেঙে তুলে নিয়ে যাবে।
কানাঘুষো কদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অন্য ব্যবস্থা তখনও কেউ করে উঠতে পারেনি। অগত্যা কাকুতি–মিনতি, আর কয়েকটা দিন যেন সময় দেওয়া হয় ওদের। কিন্তু অন্য পক্ষ সেসব শুনতে আসেনি। আজ ঝুপড়ি ভেঙে একেবারে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাবে। অযথা সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। কয়েকজন ইতিমধ্যে ঝুপড়ির ভিতর ঢুকে জিনিসপত্র তুলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করেছে। টেনে নামাচ্ছে একের পর এক ঝুপড়ির চাল। এক ঝুপড়ির ভিতরে খাটিয়ায় ঘুমোচ্ছিল কোলের এক শিশু। মাত্রই মাস দুয়েক বয়স। একজন তাকে তুলে ছুঁড়ে দিয়েছিল বাইরে। পাথুরে মাটি, নীচে পড়লে হয়তো মৃত্যু ঘটত তৎক্ষণাৎ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শিশুর দেহটি দরজা দিয়ে ছিটকে এসে খানিক দূরে এক বস্তিবাসীর কোলে এসে পড়ল। যেন কেউ আলতো করে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল কোলের মাঝে। অদ্ভুত ব্যাপারটা যাদের চোখে পড়েছে, তারা থমকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে। ওই সময় ভারি গলায় কেউ হেঁকে উঠল।
“হেই, স্টপ ইট।”
অদূরে পথের উপর দাঁড়িয়ে রুদ্রনাথ লাহিড়ী। সম্ভবত মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছিলেন। কণ্ঠস্বর তাঁরই। অদ্ভুত কাণ্ড দেখে মস্তান বাহিনীর যারা থমকে গিয়েছিল, ততক্ষণে খানিকটা সামলে নিয়েছে। পালটা হেঁকে একজন বলল, “কেও রে?”
লম্বা পা ফেলে রুদ্রনাথবাবু ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছেন। স্থির দৃষ্টিতে লোকটির দিকে খানিক তাকিয়ে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বললেন, “আমি বলছি।”
মানুষটির পোশাক, গলার আওয়াজে প্রতিপক্ষ খানিক থতমত খেয়ে গেলেও খানিক দূরে কোট–প্যান্ট পরা একজন লক্ষ্য রাখছিল। সম্ভবত মালিক পক্ষের কেউ। কাজের তদারকির জন্য এসেছে। ব্যাপার দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে কেয়া দেখ রহে বিরজু। ল্যাংড়াকো হঠা দে।”
বিরজু নামে বিশাল চেহারার লোকটা এরপর মুহূর্তে হাত তুলেছিল রুদ্রনাথবাবুকে লক্ষ্য করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তারপর। উদ্যত হাত রুদ্রনাথবাবুর উপর পড়ার আগেই সে ছিটকে পড়ল হাত কয়েক দূরে। বিরজু বাউন্সার মানুষ। মাসলম্যান। এসব কাজে অভ্যস্ত। স্বভাবতই খেপে গিয়েছিল তারপর। মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এল রে–রে করে। কিন্তু কাছে পৌঁছোবার আগেই তার বিশাল দেহ শূন্যে ছিটকে উঠে লুটিয়ে পড়ল ফের। পাথরে মাথা ঠুকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।
বিরজু মস্তান বাহিনীর সর্দার। তার এই অবস্থা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সবাই। ব্যাপারটা কী হল, তখনো যেন কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। মালিক পক্ষের সেই লোকটা হেঁকে উঠল, “আরে মারো হারামজাদেকো। খতম কর দো।”
ব্যাপার দেখে উপস্থিত বাউন্সারের দল তখন ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েনি। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তারই মধ্যে রুদ্রনাথবাবু গটমট করে এগিয়ে গেলেন সেই কোট–প্যান্ট পরা লোকটার কাছে। মুহূর্তে বাঁ হাতে সপাটে একটা চড় কশিয়ে দিলেন গালে। সেই চড়ে হাত কয়েক দূরে ছিটকে পড়ল লোকটা। রুদ্রনাথবাবু কিন্তু ফিরেও তাকালেন না। ঘাড় ফিরিয়ে অদূরে বস্তিবাসী মানুষগুলির দিকে হাত তুলে নাড়লেন সামান্য। তারপর চলে গেলেন নিজের পথে।
সেদিনের সেই ঘটনার জের যে সহজে মেটেনি, তা বলাই বাহুল্য। কোটপ্যান্ট পরা মানুষটি বিনোদ জয়সোয়াল। জাঁদরেল প্রমোটার। ধুরন্ধর মানুষ। হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সেদিন সবার সামনে ওই ভাবে হেনস্তা হয়েও মাথা গরম করেননি। দলবল নিয়ে তখনকার মতো ফিরে গেলেও কাজে লেগে পড়েছিলেন সেই দিনই। প্রথমেই বিস্তারিত খোঁজখবর। তারপর দিন কয়েকের মধ্যেই যখন জানতে পারলেন, রুদ্রনাথ লাহিড়ী নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। হাত বেশিদূর না বাড়লেও চলবে। যোগাযোগ করেছিলেন লোকাল থানায়। ওসি সঞ্জয় ঘোড়পোড়ে করিৎকর্মা মানুষ। দিন দুয়েকের মধ্যে গোটা কয়েক খুন আর মারদাঙ্গার কেসে জড়িয়ে রুদ্রনাথ লাহিড়ীর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বের করে ফেলেছিলেন। বছর দশেকের জন্য শ্রীঘর বাঁধা।
পরের দিন বের হয়ে পড়েছিলেন নিজেই। নিজস্ব জিপে ওসি সাহেব আগে। পিছনে পুলিশ ভরতি বড় এক প্রিজন ভ্যান। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে অপেক্ষাকৃত সরু এক রাস্তায় বাঁক নিয়ে অল্প এগোলেই পথের পাশে টিলার উপর রুদ্রনাথ লাহিড়ীর বাংলো। প্রিজন ভ্যান কিছু পিছিয়ে পড়েছিল। বাঁক নিয়ে ওসি সঞ্জয় ঘোড়পোড়ের জিপ সেই টিলার সামনে এসে দাঁড়াতে তিনি অপেক্ষা করছিলেন প্রিজন ভ্যানের জন্য। অদূরে বড় রাস্তা এখান থেকে ভালই দেখা যায়। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, প্রিজন ভ্যান বাঁ দিকে নির্দিষ্ট পথে না ঢুকে সোজা বেরিয়ে গেল। এমন নয়, প্রিজন ভ্যানটা অনেক পিছনে ছিল, ওসির জিপ দেখতে পায়নি। তাছাড়া, এসব অঞ্চল থানার ড্রাইভারদের হাতের তালুর মতো চেনা। ভুল হবার কথা নয়। ব্যাপারটা কী হল জানবার জন্য,
জিপে ওয়্যারলেসের হ্যান্ডসেট সবে হাতে নিয়েছেন তিনি, টিলার উপর থেকে মড়মড় শব্দে আচমকা বিশাল একটা বোল্ডার তীব্র বেগে গড়িয়ে এসে পড়ল জিপের উপর। বিকট আওয়াজে আরোহীসমেত গাড়িটা ছিটকে উঠল। হঠাৎ ওই ঘটনায় যারা কাছে ছিল, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। দারুণ আঘাতে গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও আরোহী ওসি, ড্রাইভার এবং দু”জন পুলিশ কর্মীর তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লেও কারও তেমন চোট লাগেনি।
অদ্ভুত ওই ঘটনায় ওসি এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, সেদিন কিছুই আর করতে পারেননি। পরের দিন লম্বা ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে চলে গিয়েছিলেন সাতারা, দেশের বাড়িতে। থানায় সেই ওয়ারেন্টেরও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। এজন্য মাস কয়েক সাসপেন্ড হয়ে থাকতে হয়েছিল।
যাই হোক, সেই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ কিন্তু কোনও সুরাহাই করতে পারেনি। অত বড় পাথর উপর থেকে গড়িয়ে দেওয়া দু”একজন মানুষের কাজ নয়। অথচ তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছিল, সেই সময় টিলার উপর কেউ ছিল না। রুদ্রনাথ লাহিড়ীর বাংলোও ফাঁকা ছিল। তিনি কী কাজে বাইরে বেরিয়েছিলেন। চেষ্টা তারপরেও কম হয়নি। নতুন কেস ইস্যু হয়েছিল পুলিশের তরফে। কিন্তু নানা অদ্ভুত ঘটনায় রুদ্রনাথ লাহিড়ীর কেশাগ্রও স্পর্শ করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল রুদ্রনাথ লাহিড়ীর বিরুদ্ধে যাবতীয় কেস তুলে নিতে।
প্রমোটার বিনোদ জয়সোয়াল অবশ্য সেই কারণে দমে যায়নি। তিনি এরপর পুলিশ দিয়ে বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিলেন। ততদিনে শুধু স্থানীয় থানাই নয়, শহরের পুলিশ দপ্তরেও ব্যাপারটা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। তবু কোর্টের অর্ডার আর উপর মহলের চাপে একদিন কমিশনার মর্যাদার এক অফিসারের তত্ত্বাবধানে বাছাই করা বড় এক পুলিশবাহিনী পাঠানো হয়েছিল।
সেদিন কমিশনার সাহেবের জিপ ছিল সবার পিছনে। সামনে চার গাড়ি সশস্ত্র পুলিশ। যথাস্থানের কাছে এসে কমিশনার সাহেব হঠাৎ খেয়াল করলেন, সামনে পুলিশের অন্য গাড়িগুলো বাঁ দিকে টার্নিং না নিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে। দেখে তৎক্ষণাৎ ওয়্যারলেসে ধরলেন তাদের। প্রত্যেকের জবাব, গলির মোড়ে পৌঁছে চেষ্টা করেও ড্রাইভার স্টিয়ারিং ঘোরাতে পারেনি। কমিশনার সাহেবের চোখের সামনেই এক এক করে চারটে ভ্যানই নির্দিষ্ট দিকে টার্নিং না নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল। তাই দেখে কমিশনার সাহেবেরও মনে হয়েছিল, তাঁর নিজের গাড়িও হয়তো ঘোরানো যাবে না। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে যখন দেখলেন, ড্রাইভার স্টিয়ারিং ঘোরাতেই গাড়ি দিব্যি বাঁ দিকের নির্দিষ্ট গলিতে বাঁক নিয়েছে। অদূরে পথের পাশে রুদ্রনাথ লাহিড়ীর টিলার দিকে তাকিয়ে তিনি প্রায় আঁতকে উঠে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে মানা করেছিলেন। ড্রাইভারও মুহূর্তে উলটো দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দ্রুত পার হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা।
বস্তির মানুষের কাছে এর কোনও কথাই চাপা থাকেনি। একদিন সবাই দল বেঁধে হাজির হয়েছিল রুদ্রনাথ লাহিড়ীর বাংলোয়। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রস্তাব করেছিল, সাহেবের বাড়িতে যখন কোনও কাজের মানুষ নেই, ওরা সেই দায়িত্ব নিতে পারে। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে।
কিন্তু সেকথায় একেবারেই পাত্তা দেননি তিনি। বরং তাদের প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বলা যায়।
শুধু বস্তির মানুষ কেন। এসব চাপা থাকেনি অন্যদের কাছেও। বিভিন্ন কাগজের রিপোর্টার হানা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু রুদ্রনাথ লাহিড়ী তাদের কারো সঙ্গেই দেখা করেননি। হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েকটি কাগজ সত্য-মিথ্যা মনগড়া কিছু খবর ছেপেছিল অবশ্য। তারপর সব থিতিয়ে গেছে ক্রমে। তবে এত কিছুর পরেও প্রমোটার বিনোদ জয়সোয়ালকে দমানো যায়নি। প্রমোদ কামলেদের বস্তিও রক্ষা পায়নি। চিরাচরিত পথে কাজ হচ্ছে না দেখে লোকটা এরপর অন্য পথ ধরেছিল। নগদ টাকার থলি নিয়ে হাজির হয়েছিল কামলেদের কাছে। গোড়ায় দু”চারজনের বেশি রাজি হয়নি। কিন্তু নগদ টাকার লোভ সামলাতে পারেনি কেউ। টাকা পেয়ে চলে গেছে একে একে। প্রমোদ কামলেও ব্যতিক্রম হয়নি।
এসব অনেক দিন আগের কথা। প্রমোদ কামলেদের মতো কয়েকজন ছাড়া ভুলে গেছে সবাই। তবে এসব শোনার পরে আমার কৌতূহল যে আরও বেড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। কামলে বলতে না পারলেও ততদিনে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমার অনুমানে ভুল নেই। মানুষটি আদি ও অকৃত্রিম বঙ্গ–সন্তান। অতঃপর এক ছুটির দিনে সাহস করে ঢুঁ মারলাম ওঁর বাংলোয়। পাথুরে টিলার গায়ে ধাপকাটা সিঁড়ি। সামান্য উঠলেই বাংলোর হাতা। যথাস্থানে আরামকেদারা খালি পড়ে আছে। সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হল, ভদ্রলোক ভিতরেই রয়েছেন। এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করলাম।
গোড়ায় সাড়া না পেলেও বার কয়েক টোকা দেবার পরে ভিতর থেকে ভারি গলায় আওয়াজ ভেসে এল, “কৌন?”
উত্তর দেবার আগেই সশব্দে ভারি দরজাটা খুলে গেল। ওধারে দাঁড়িয়ে রুদ্রনাথ লাহিড়ী ভীষণ বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। তাড়াতাড়ি হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে নির্ভেজাল বাংলায় বললাম, “স্যার, আমি আপনার প্রতিবেশী। আপনার পরিচয় জেনে——।”
আমার কথা শেষ হতে পেল না। তার আগেই ভদ্রলোক আমার মুখের উপর দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলেন। ভিতর থেকে কোনও সাড়াই আর পাওয়া গেল না। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে এলাম। তবে সেজন্য রাগ হয়নি মানুষটির উপর। কাগজের বাঘা বাঘা রিপোর্টারই যখন ঘোল খেয়ে গেছে, সেখানে আমি তো খড়কুটো। বলা বাহুল্য, এরপর রুদ্রনাথবাবুর বাংলোর দিকে আর যাইনি। তবে কখনও রাস্তায় মুখোমুখি পড়ে গেলে চলার গতি কমিয়ে অপেক্ষা করেছি, যদি উনি মুখ খোলেন। কিছু বলেন। কিন্তু প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। মানুষটি আপন মনে পার হয়ে গেছেন পাশ দিয়ে।
এর প্রায় বছর খানেক পরের কথা। সেও এক ছুটির দিন। বিকেলে সামান্য কেনাকাটা করতে ম্যারোল বাজারের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখোমুখি। অভ্যাস মতো চলার গতি কমিয়ে দিয়েছি। যদিও জানি, ভদ্রলোক যথারীতি পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটে গেল। উনি আমার সামনে প্রায় পথরোধ করে দাঁড়ালেন, “নমস্কার ভাই।”
প্রায় থতমত খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ভদ্রলোকের কৃত্রিম ডান হাতটা যথারীতি প্যান্টের পকেটে ঢোকানো থাকলেও বাঁ হাতটা তখনো কপাল ছুঁয়ে রয়েছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে উঠল। মাত্র কয়েক মাসের ভিতর মানুষটির বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। জ্যা–মুক্ত ধনুকের মতো সেই শরীর অনেকটাই ন্যুব্জ। মুখমণ্ডলে সেই গাম্ভীর্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
তাড়াতাড়ি দু”হাত তুলে নমস্কার করে তাকিয়ে আছি। উনি হাত নামিয়ে বললেন, “সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত প্রশান্তবাবু। পরে খুব খারাপ লেগেছিল। আজ চলুন না আমার ওখানে। কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে। কফি চলে তো? নইলে চলার পথেই অল্প চা নিয়ে নেব। নো প্রব্লেম।” মানুষটির দু”চোখে আন্তরিকতার ছাপ সুস্পষ্ট।
ভদ্রলোকের এই ব্যবহারে অবাক হয়েছিলাম অবশ্যই। কিন্তু তার চাইতেও বেশি অবাক মানুষটির মুখে আমার নাম শুনে। ফস করে বলে ফেললাম, “কী আশ্চর্য, আমার নাম কার কাছে জানলেন? প্রমোদ কামলে?”
“প্রমোদ কামলে?” উনি অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর অল্প চোখ নাচিয়ে বললেন, “ওহ্, আপনাদের হাউজিংয়ের চৌকিদার ছেলেটা? না ভাই। তবে ওর কাছে ভগবান রুদ্রদেবের অনেক খবর যে পেয়েছেন, তা জানি। গরিব বেচারা। ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি অবশ্য। তা যাকগে, চলুন না আজ।”
ভদ্রলোকের কথায় কৌতূহল যে বেড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। তবু ভদ্রতার খাতিরেই বললাম, “স্যার, কোথাও গিয়েছিলেন হয়তো। সবে ফিরছেন। সামনেই যখন রবিবার। বরং ওইদিন আপনার ওখানে যাব। কখন থাকবেন?”
কিন্তু উনি শুনলেন না। হাত ধরে বললেন, “সে তো ভাই সেই পরশু। হয়তো না–ও থাকতে পারি। দেখা যখন পেয়েছি, ছাড়ছি না।”
এরপর আর আপত্তি করা যায় না। তা ছাড়া বাজারে তেমন জরুরি কিছু নেই। ততক্ষণে উনি অবশ্য হাত ধরে প্রায় টানতে শুরু করেছেন।
ছোট আকারের বাংলো। একটাই বড় ঘর। গোটা কয়েক বেতের চেয়ার। একটা বড় গোলাকার টেবিল। একপাশে নিপাট বিছানা পাতা খাট। আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকলেও যত্নের ছাপ রয়েছে। টাইলস বসানো ঝকঝকে মেঝে। নিয়মিত পরিচর্যার ছাপ সুস্পষ্ট। একপাশে চমৎকার পর্দা ফেলা সরু দরজা। পরে বুঝেছিলাম, ওটা কিচেন।
ভিতরে বসিয়ে অল্প দু”চার কথার পরে উনি উঠে গেলেন হঠাৎ। পর্দা সরিয়ে কিচেনে ঢুকে মিনিট খানেকের মধ্যে ট্রেতে কফির সরঞ্জাম নিয়ে ফিরে এলেন। সঙ্গে মিল্ক–পট। সুগার–কিউব। এত কম সময়ের মধ্যে কী করে তৈরি করলেন, বুঝে উঠতে পারলাম না। তারই মধ্যে উনি যখন পট থেকে ধূমায়িত কফি কাপে ঢালতে শুরু করলেন, গন্ধেই বুঝলাম, জিনিসটা ইনস্ট্যান্ট নয়। ফোটানো অরিজিনাল কফি–বীন। মনে হল, হিটারে চাপিয়ে রেখে বাইরে বেরিয়েছিলেন। একটা কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে উনি বসতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, “ওই দেখুন, কফি খান কিনা, সে তো আর জানা হয়নি!”
সত্যি কথা বলতে কী, আমি একেবারেই কফির ভক্ত নই। তবু আজকালের ইনস্ট্যান্ট কফি এক-আধ কাপ চলে। ফোটানো কফি বিনের কড়া স্বাদ একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু আমি কিছু বলবার আগেই উনি বলে উঠলেন, “দাঁড়ান তাহলে চা”ই নিয়ে আসছি।”
সেই কথায় প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠলাম, “সে কী স্যার, এখন আবার দোকানে ছুটবেন নাকি!”
“কেন?” উনি অবাক হলেন যেন।
“তখন যে দোকান থেকে চা নেবার কথা বললেন।”
“বলেছিলাম বুঝি!” ভুরু কুঁচকে অল্প হাসলেন উনি। তবে এখন মনে হচ্ছে, চা বোধ হয় ঘরে রয়েছে। একটু বসুন।”
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনি ফের কিচেনের দিকে চলে গেলেন। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যে পর্দা ঠেলে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এলেন। কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে উলটো দিকে বেতের আরাম কেদারায় বসলেন।
ভদ্রলোক কীভাবে এত দ্রুত চা করে নিয়ে এলেন, যখন ভাবছি, কফির কাপে ছোট একটা চুমুক দিয়ে উনি তাকালেন আমার দিকে।
“সেদিন আপনার সঙ্গে ওই ব্যবহারের পরে খুব খারাপ লেগেছিল। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। তারপর রাস্তায় দেখা হলে আপনার মনের ইচ্ছে বুঝেও কিছু করতে পারিনি। শেষে ভাবলাম, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কেন আর একজনের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।” মানুষটির কণ্ঠস্বর ক্রমশ ভারি হয়ে আসছিল। সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, “না—না, এতে অপরাধী মনে করার কী আছে! সেদিন কোনও কারণে আপনার মন নিশ্চয় ভাল ছিল না। অসময়ে এসে ভুলটা আমিই করেছিলাম হয়তো।”
রুদ্রনাথবাবু ম্লান হাসলেন। “সত্যি আমি অসামাজিক মানুষ। কুড়ি বছরের উপর এখানে আছি। অথচ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া একজন মানুষের সঙ্গেও সেভাবে আলাপ হয়নি।” থামলেন উনি। আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত সিলিংয়ের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, “অথচ সার্ভে দপ্তরের ডাকসাইটে ইঞ্জিনিয়ার রুদ্রনাথ লাহিড়ী চিরকাল এমন ছিল না। সেই স্কুল–কলেজ থেকে শুরু করে অফিস, বন্ধুর সংখ্যা কম ছিল না কোথাও। তারপর হঠাৎ একদিন সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলাম।” বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন উনি। কেদারায় সোজা হয়ে বসলেন।
“আপনাকে আজ ডেকেছি, একটা গল্প শোনাব বলে। হ্যাঁ, গল্পই। শুনলে তেমনই মনে হবে। কিন্তু ঘটনা হল, এই গল্পের প্রতিটি অংশ সত্যি। ঘটেছিল আমার জীবনেই।” থামলেন উনি। সামান্য বিরতি দিয়ে বললেন, “তবে তার আগে একটা জিনিস আপনাকে দেখাব।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ হাতের কাপ নামিয়ে উঠে গেলেন উনি। ঘরের একধারে দেরাজের ভিতর থেকে কী একটা নিয়ে ফিরে এলেন। কাছে আসতে বুঝলাম, একটা ধাতব আংটি। দেখেই চিনতে পারলাম। এর আগে ভদ্রলোকের বাঁ হাতের মধ্যমায় পাথর বসানো বড়সড় আংটিটা দেখেছি। সন্দেহ নেই, সেই কারণেই আজ প্রথম থেকে ভদ্রলোকের হাত কেমন খালি মনে হচ্ছিল। তবে আংটির কথা মনে আসেনি। ইতিমধ্যে ফের কেদারায় বসে রুদ্রনাথবাবু আংটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। “ভাল করে দেখুন তো এটা।”
হাতে নিয়ে আংটিটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বড় ব্যাসের আর পাঁচটা আংটির মতোই। তবে বেশ ভারি। রং কালচে হলেও মনে হল, লোহা বা ওই জাতীয় কোনও ধাতু নয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। মেটালার্জির উপর কিছু পড়াশুনাও রয়েছে। তবু ভাল করে দেখেও বুঝে উঠতে পারলাম না। মাঝারি আকৃতির একটা পাথর বসানো। বেশ উজ্জ্বল। বললাম, “এই আংটিটাই তো আপনার আঙুলে দেখেছি। তাই না?”
সামান্য মাথা নাড়লেন উনি, “মাত্র গত সপ্তাহে খুলে রেখেছি। ওই যে পাথরটা দেখছেন, বছর কয়েক আগে ঔজ্জ্বল্য আরও বেশি ছিল। এখন কিছুটা হলেও, ঝাপসা হয়ে গেছে। ভাল করে দেখুন তো, পাথরটার ভিতরে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?”
রুদ্রনাথবাবুর কথায় ফের আলোর সামনে এনে পাথরটা দেখলাম। কিন্তু তেমন কিছুই নজরে পড়ল না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় সেটা বুঝতে পারলেন উনি। বললেন, “দুটো রঙের বিন্দু।”
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তেমন কিছু নজরে পড়ল না। আমি নীরবে সামান্য মাথা নাড়তেই রুদ্রনাথবাবু আগ্রহে কেদারা ছেড়ে উঠে ঝুঁকে পড়লেন আংটির উপর।
“কিছু দেখতে পাচ্ছেন না!” মানুষটির কণ্ঠস্বরে চাপা উচ্ছ্বাস। প্রায় ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে আংটিটা নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখ দুটো মুহূর্তে কেমন নিবে গেল। বিষণ্ণ গলায় বললেন, “দেখতে পেলেন না! সামান্য ধারের দিকে। খানিক আগে মাঝখানে ছিল। সরে এসেছে। আসলে ওই বিন্দু দুটো আংটির চোখ। ব্যাপারটা বুঝতে অবশ্য আমার কয়েক বছর সময় লেগেছিল।”
ভদ্রলোকের ওই অদ্ভুত কথায় হাঁ করে তাকিয়ে আছি। রুদ্রনাথবাবু অল্প হাসলেন। “গত চল্লিশ বছরে আংটিটা আমি অনেককেই দেখিয়েছি। লক্ষ করেছি, ভিতরের ওই বিন্দু দুটো কেউ দেখতে পেলেও অনেকেই পাননি। তবে বিশেষজ্ঞ যাঁদের দেখিয়েছি, তাঁরা সকলেই স্বীকার করেছেন, আংটিটা যে ধাতু দিয়ে তৈরি, তা আমাদের চেনা কোনও ধাতু নয়। আমার এক জিওলজিস্ট বন্ধুর অনুমান, আংটির ধাতু পৃথিবীতে ছিটকে পড়া কোনও মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড থেকে পাওয়া। রহস্যময় ওই আংটি আমার গোটা জীবনটাই পালটে দিয়েছে।”
উপর্যুপরি গোটা কয়েক চুমুকে কফির কাপ শেষ করে নামিয়ে রাখলেন রুদ্রনাথবাবু। “আপনার চা কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
সামনে চায়ের কাপের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি সেটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। বড় কাপ। দ্রুত চুমুক দিয়েও শেষ হতে সময় লাগল। রুদ্রনাথবাবু নিঃশব্দে পাইপে তামাক ভরলেন ততক্ষণ। তারপর মুখে নিয়ে অগ্নি সংযোগ করে গোটা কয়েক মৃদু টান দিয়ে বললেন, “আংটিটা পেয়েছিলাম অদ্ভুতভাবে। সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। মণিপুরে এক দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সার্ভে করতে গিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে কুলি, ভারবাহী অশ্ব আর অশ্বতর নিয়ে এক বিশাল টিম। যার উপর দায়িত্ব ছিল, তিনি স্থানীয় কুলি জোগাড় করতে না পারায় আনতে হয়েছিল বাইরে থেকে। তাই যথাস্থানে পৌঁছোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার উপর বর্ষা একটু আগেই শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য বাধাবিপত্তির মধ্যেও কাজ চলছিল যথাসম্ভব দ্রুত গতিতেই। আসলে তখন ব্রিটিশ আমল। কাজে ফাঁকি ছিল না।
সেদিন একটা পাহাড়ের ঢালে জরিপের কাজ চলছে। ঢালের গায়ে খানিকটা সমতল জায়গা দেখে সেখানেই জরিপের যন্ত্রপাতি বসাতে বললাম। কাজে নেমে কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। মস্ত এক পাথর সেই সমতলের ঠিক মাঝখানে পড়ে রয়েছে। উপায় না দেখে জনা কয়েক কুলি লাগিয়ে সেই পাথর ঠেলে নীচের খাদে গড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম। পাথরটা দেখে যেমন মনে হচ্ছিল, তুলনায় অনেক ভারি। তাই যথেষ্টই বেগ পেতে হল। জনা কয়েক কুলি দিয়ে শুরু হয়েছিল। ব্যাপার দেখে একে একে টিমের প্রায় সবাইকেই কাজে লাগাতে হল। অনেক কসরতে সেই পাথর যখন সরানো হল, বেলা পড়ে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। হাতে সময় তেমন নেই। অগত্যা সেদিনের মতো বিরতি দিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম।
পরের দিন সকালে যথাসময়ে সবাই কাজে বেরিয়ে গেছে। কোনও কারণে আমার বেরোতে দেরি হয়েছিল। তাঁবু থেকে অকুস্থল দূরে নয়। তবু তখনো সেখানে পৌঁছোতে পারিনি। হঠাৎ দেখি সহকারী জগবীর প্রায় ছুটতে ছুটতে তাঁবুর দিকে আসছে। মুখোমুখি হতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তাজ্জব ব্যাপার স্যার! গতকাল যে পাথরটা গড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সেটা ফের সেই আগের জায়গাতেই পড়ে আছে। যন্ত্রপাতি কিছুই বসানো যায়নি।”
শুনে প্রায় ধমকে উঠলাম, “কী বাজে বকছিস!”
“বাজে কথা নয় স্যার। দেখবেন চলুন।” দু”হাত তুলে মাথা ঝাঁকাল জগবীর।
প্রায় ছুটতে ছুটতে অকুস্থলে পৌঁছুলাম। জগবীর কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলেনি। গতকাল যে পাথরটা ইউনিটের প্রায় সমস্ত কুলি নীচে গড়িয়ে ফেলতে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল, সেটা যথাস্থানে পড়ে আছে। প্রায় পাঁচশো ফুট গভীর খাদে ফেলে দেওয়া পাথরটা ফের কীভাবে এখানে এল, অনেক ভেবেও কিনারা করা গেল না। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আলতো করে তুলে এনে ফের যথাস্থানে রেখে দিয়ে গেছে। এমন কাজ যার পক্ষে সম্ভব, সে মানুষ না অন্য কিছু! একবার মনে হয়েছিল, কাকতালীয় ভাবে উপর থেকে একই আকৃতির অন্য কোনও পাথর হয়তো গড়িয়ে এসেছে। কিন্তু অচিরাৎ সেই ধারণা বাতিল করতে হল। এতবড় একটা পাথর উপর থেকে গড়িয়ে এলে যেসব চিহ্ন থাকে, তার কিছুই নেই।
আসামের এদিকে ফিল্ডওয়ার্ক এই প্রথম নয়। কিন্তু এমন কখনও হয়নি। সবাই হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইউনিটের প্রধান হিসেবে আমার নির্দেশের অপেক্ষায়। ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে খানিক দূরে পাথরের এক ভগ্ন দেয়ালের অংশ নজরে পড়েছে। সম্ভবত পরিত্যক্ত কোনও গৃহের অবশেষ। মনস্থির করে পাথরটা আবার সরিয়ে দিয়ে জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে বললাম।
পাথরটা সরাতে সময় লাগলেও খুব বেশি খুঁড়তে হল না। সামান্য মাটি-পাথর সরাতেই একটা নরকঙ্কালের অংশ বিশেষ নজরে পড়তে বোঝা গেল, পুরোনো এক কবর। বেজায় ঘাবড়ে গেলেও কুলিরা কাজটা শেষ করল অবশ্য। বেরিয়ে এল একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের কঙ্কাল। যথেষ্ট পুরোনো হলেও তখনো বেশ ভাল অবস্থায়। ডান হাতের উপরের সামান্য অংশ ছাড়া বাকিটা নেই। দেখে বোঝা যায়, কোনও দুর্ঘটনায় কাটা গেছে। তাকিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল, কঙ্কালের বাঁ হাতের মধ্যমায় একটা আংটি। কৌতূহলে তুলে নিলাম।
বড় ব্যাসের আংটি। বোঝা যায়, মানুষটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। আরও দুটো ব্যাপার বুঝেছিলাম। প্রথমত, আংটিটা সম্পূর্ণ অচেনা কোনও ধাতুর। দ্বিতীয়টি আংটির পাথর। মসৃণ ডিম্বাকৃতি পাথরটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। প্রায় হীরের মতো। কাটাই না হলে হীরের ঔজ্জ্বল্য আসে না। এটা কিন্তু তেমন নয়, মসৃণ। সেই মুহূর্তে এই দুটি জিনিসই আমাকে আংটিটার ব্যাপারে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তাই স্থির করলাম, নিজের কাছে রেখে দেব। কোথায় রাখা যায়, ভাবতে গিয়ে নিজের আঙুলের কথাই আগে মনে পড়ল। পরতে গিয়ে দেখি, ডান হাতের অনামিকায় দিব্যি মানিয়ে গেছে।
Created with Microsoft Fresh Paint
আমার কাণ্ড দেখে ইউনিটের সবাই তখন প্রায় সিটিয়ে রয়েছে। কুলিদের সর্দার কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, “এটা ঠিক হল না হুজুর। জিনিসটা যেমন ছিল, সেখানেই রেখে দিন। জায়গাটা ভাল নয়।”
কুলিসর্দার কী ভেবে অমন কথা বলেছিল, জানি না। আমি কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সেদিন কাজ শেষে সন্ধেয় টেন্টে ফিরে কফির কাপ হাতে লণ্ঠনের আলোয় আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম। লণ্ঠনের মৃদু আলোতেও আংটির পাথর থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ এক অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ল। দুটি অতি ক্ষুদ্র কালো বিন্দু সেই পাথরের ভিতর নড়ে বেড়াচ্ছে। খুব ধীর গতিতে। গোড়ায় মনে হয়েছিল, চোখের ভুল। কিন্তু অচিরেই বুঝলাম, দেখায় কিছুমাত্র ভুল হয়নি। খুব ধীরে হলেও বিন্দু দুটো সচল। তবে দুটির মধ্যে আপেক্ষিক দূরত্ব বদলাচ্ছে না। একই থাকছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, উজ্জ্বল পাথরটার ভিতর দুটো জীবন্ত চোখ যেন চারপাশে নজর রেখে চলেছে। ভাবনাটাকে সেই মুহূর্তে তেমন গুরুত্ব দেইনি অবশ্য। তবে পরে বুঝেছিলাম, সেদিনের সেই প্রাথমিক অনুমানে ভুল ছিল না।
সকাল থেকে পরপর যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে ওই আংটি এরপর কেউ হাতে রাখত কিনা সন্দেহ। কিন্তু স্বভাবে বরাবরই ছিলাম কিছুটা ডাকাবুকো। তখন তো বয়স আরও কম। একটু ঘাবড়ে গেলেও পরোয়া করিনি। ভাবলাম, দেখাই যাক না কী হয়। সুতরাং আঙুলেই রইল সেটা।
এরপর দিন কয়েক কাজ হল প্রায় ঝড়ের গতিতে। এছাড়া উপায় ছিল না। আকাশের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। রেডিওতে যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, দিন কয়েকের মধ্যেই হয়তো মনসুন শুরু হয়ে যাবে। এসব পাহাড়ি অঞ্চলের বর্ষা বড়ো ভয়ানক। তার আগেই যতটা সম্ভব কাজ শেষ করে ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলতে হবে। কাজের চাপে আংটির কথা তাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই এক রাতে আশঙ্কা সত্যি হয়ে হঠাৎই মনসুন শুরু হয়ে গেল।
এসব অঞ্চলে বর্ষা কখনও যে কী ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তাদের বোঝানো মুশকিল। অভিজ্ঞতা আমাদেরও তেমন ছিল না। থাকলে আগেই হয়তো ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলতাম। বৃষ্টি শেষ রাতে শুরু হয়েছিল, পরের দিনটাও অবিশ্রান্তভাবে চলল। শুধু কাজকর্ম নয়, রান্নাবান্নাও বন্ধ। শুকনো খাবার খেয়ে সারাদিন কাটালাম। সন্ধেয় তাঁবুর ভিতরে ক্যাম্পকটে বসে লণ্ঠনের আলোয় যখন একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছি, বাইরে তখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। তাঁবুর ভিতর দিয়ে স্রোতের মতো জল বইছে। জলের তোড়ে ভিতরের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। ভয় হচ্ছে, ক্যাম্পকটও ভেসে না যায়। ওই অবস্থায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। সেই ঘুম ভাঙল পরের দিন ভোরে। ঝড়বৃষ্টি একদম থেমে গেছে। ঝকমকে মিষ্টি রোদ তাঁবুর চিলতে ফাঁক দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা। ভারতের পূর্ব প্রান্তে এসব অঞ্চলে সূর্যোদয় অনেক আগে হয়। অর্থাৎ, রোদ ইতিমধ্যে অনেকটাই চড়ে উঠেছে। শিয়রের কাছে লণ্ঠনটা তখনও জ্বলছে। কী আশ্চর্য, কুলি, চাপরাশিরা সব গেল কোথায়! এত বেলা হয়েছে, অথচ কেউ ডেকে দেয়নি! লণ্ঠনটাও নেবায়নি!
বাইরে কারও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছিল না। বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে আসতেই মুহূর্তে কেঁপে উঠল বুকটা। এ কোথায় দাঁড়িয়ে আছি! চারপাশে শুধু প্রকৃতির করাল তাণ্ডবলীলার চিহ্ন। একটা পাহাড়ের ঢালে ক্যাম্প করা হয়েছিল। পাশাপাশি গোটা কয়েক তাঁবু। একমাত্র আমার তাঁবু ছাড়া বাকি একটিরও চিহ্নমাত্র নেই। সর্বনাশা পাহাড়ি ধ্বসে সব ভেসে গেছে। চারপাশে এই ভয়ানক ধ্বসের মাঝে কীভাবে একমাত্র আমার তাঁবু রক্ষা পেয়ে গেল, অনেক ভেবেও কিনারা পেলাম না। শুধু তাঁবু কেন, চারপাশে কোনও গাছপালারও চিহ্নমাত্র নেই। মাটি সরে গিয়ে শুধু এবড়ো খেবড়ো পাথর। রাতে এতবড় প্রলয় ঘটে গেছে, বিন্দুমাত্র টের পাইনি!
প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে কীভাবে ফিরে এলাম, সে কথা এই কাহিনির জন্য অবান্তর। আমাদের পুরো ইউনিট সেবার সেই সর্বনাশা ধ্বসে তলিয়ে গিয়েছিল। দিন কয়েক পরে উদ্ধারকাজ শুরু হলে ছিন্নভিন্ন কিছু গলিত দেহাবশেষ আর ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের কিছু টুকরো শুধু উদ্ধার করা গিয়েছিল।
আকস্মিক সেই ঘটনার প্রভাব সামলে উঠতে সময় লেগেছিল। ইম্ফল হয়ে গৌহাটি পৌঁছেই কলকাতায় ট্রান্সফার চেয়ে আবেদন পাঠালাম। সেই সাথে মাস দেড়েকের ছুটিও নিয়ে নিলাম। এই সময় এক বিকেলে গৌহাটির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। শহরের প্রান্তে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা পথটা বেশ নিরিবিলি। আমার মতোই দু”চারজন পদযাত্রী ছাড়া অন্য কেউ নেই। হঠাৎ তাদের ভিতর জটাজূটধারী এক সাধু উলটো দিকে থেকে বড় বড় পায়ে আমার সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার ডান হাতের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি ফেলে মুখের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বললেন, “বেটা, এটা কোত্থেকে পেয়েছিস তুই?”
সাধুজির প্রশ্ন গোড়ায় ঠিক ধরতে পারিনি। আশপাশে অন্য কাউকে করছেন ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি, উনি আমার হাত চেপে ধরলেন। প্রায় নির্জন রাস্তায় ওই অবস্থায় পড়ে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। সাধুজির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। উনি আমার হাতের আংটির দিকে আঙুল তুলে সেই একই প্রশ্ন করলেন।
ইতিমধ্যে কিছুটা সামলে নিয়েছি। আংটিটা সেই থেকে হাতে থাকলেও অবস্থার কারণে তেমন আর নজর দিইনি। হঠাৎ ওই প্রশ্নে চমকে উঠলাম। মনে হল, পথের মাঝে অচেনা মানুষকে আসল কথা না বলাই ভাল। শুধু বললাম, “কেন সাধুবাবা?”
“বেটা, এ রুদ্রভৈরবের আংটি। এ জিনিস সংসারী মানুষের জন্য নয়। এটা তুই আমাকে দিয়ে দে।”
লোভে চকচক করছিল তাঁর চোখ। সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, সাধুজি ভড়কি দিয়ে জিনিসটা বাগিয়ে নিতে চাইছেন। বললাম, “মাফ করবেন সাধুবাবা।”
ভেবেছিলাম, সাধুজি সহজে ছাড়বেন না। কিন্তু তেমন কিছু হল না। শুধু বললেন, “বেটা, ভাল করলি না কিন্তু। এ জিনিস তোর জন্য নয়। দিতে না চাস, যেখান থেকে পেয়েছিস, যত তাড়াতাড়ি পারিস, তাকে ফিরিয়ে দিস।”
কথা শেষ করে হনহন করে চলে গেলেন উনি। এত সহজে ছাড়া পেয়ে আমিও হাঁফ ছাড়লাম। ব্যাপারটা ঘটল তার পরের দিন। আংটিটা আঙুলে রয়েছে সেই প্রথম দিন থেকে। এতদিন সেভাবে আর লক্ষ্য করিনি। সেদিন সাধুর ওই ঘটনার পরে কিছুটা বাড়তি কৌতূহল নিয়ে রাতে আংটিটা খুলে দেখছিলাম। থাকতাম গৌহাটির সার্কিট হাউসে। রাতে খাবার সময় আর ডাইনিং রুমে যেতাম না। খানসামা ছোকরাকে বলা ছিল। খাবার পৌঁছে দিয়ে যেত। সেদিন আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি, খানসামা ট্রেতে ডিনার নিয়ে এল। তাকে দেখেই মনে পড়ল, আজ সন্ধেয় সার্কিট হাউসে ঢোকার সময় রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, রাতে আপাতত গেস্টদের ঘরে ডিনার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকক্ষণ হল ন”টা বেজে গেছে। অনেক আগেই রেডি হয়ে গেছে ডিনার। কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “আজ রুম সার্ভিস পাওয়া যাবে না শুনেছিলাম!”
টেবিলে ডিনার নামিয়ে ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে বলল, “স্যার, সবাই খেয়ে গেছেন, আপনি আসছেন না, তাই নিয়ে এলাম।”
রাতে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যাস। খিদেও পেয়েছে। অযথা কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে গেলাম। খানসামা ছোকরা চলে গেল।
পরের দিন খানিক বেলায় ট্রেনে রিজার্ভেশনের জন্য বের হয়েছি। স্টেশনের আগে লেভেল ক্রসিং। পার হাবার আগে দু”দিকে তাকাবার জন্য ঘাড় ফিরিয়েছি, চোখে পড়ল, অদূরে লাইনের পাশে পড়ে রয়েছে একটা আস্ত কাটা হাত। সম্ভবত অল্প আগে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখনও মাছি বসতে পারেনি। ওই দৃশ্য দেখে চোখ ফিরিয়ে পার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ততক্ষণে সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখ প্রায় স্থির হয়ে গেছে। কাটা হাতটার আঙুলে আমার সেই আংটি! খানিক দূর থেকেও জ্বলজ্বল করছে পাথরটা। মুহূর্তে হাতের দিকে তাকালাম। আংটি নেই। ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, গত রাতে যখন ওটা খুলে নিয়ে দেখছিলাম, সেই সময় খানসামা ডিনার নিয়ে আসতে তাড়াতাড়িতে আর আঙুলে পরা হয়নি। টেবিলে নামিয়ে রেখে খেতে বসে গিয়েছিলাম। তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম।
সেই আংটি লাইনের পাশে পড়ে থাকা এই ছিন্ন হাতের আঙুলে কীভাবে এল যখন ভাবতে শুরু করেছি, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, অজান্তেই কখন পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেই ছিন্ন হাতের আঙুল থেকে আমি খুলে নিয়েছি সেটা। তারপর যখন সংবিৎ ফিরে এসেছে, মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছিলাম কয়েক পা। ওই সময় তাকিয়ে দেখি, ছিন্ন হাতের কব্জির কিছু উপরে জোড়া ত্রিশূল আঁকা একটা উল্কি। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, গত কাল সেই সাধু যখন আমার হাত ধরেছিলেন, এই উল্কি তাঁর হাতে দেখেছিলাম। তবে কী এটা সেই সাধুবাবার হাত! ছিন্ন হাতের কব্জিতে জড়ানো রুদ্রাক্ষও সেই সাধুর হাতে দেখেছি।
রিজার্ভেশনের জন্য আর স্টেশনের দিকে যাওয়া হল না। দ্রুত সার্কিট হাউসে ফিরে এলাম। ম্যানেজারের কাছে সেই খানসামা ছেলেটির খোঁজ করতে তিনি জানালেন, সাবির নামে খানসামা ছেলেটি আগের দিন দুপুরে হঠাৎ মায়ের অসুস্থ হবার খবর পেয়ে বাড়ি চলে গেছে।
এই কারণেই যে গত রাতে গেস্টদের ঘরে ডিনার পৌঁছে দেওয়া যায়নি, ততক্ষণে বুঝতে বাকি নেই। তবু রহস্যে ভরা বাকি অংশের কথা ম্যানেজারের কাছে আর বলা গেল না। তাতে লাভও হত না। তাই দ্রুত ঘরে ফিরে এলাম। সন্দেহ নেই, খানসামা সাবিরের মতো দেখতে অন্য কেউ রাতে ডিনার নিয়ে এসেছিল। আমার অসাবধানতার সুযোগে টেবিলে রাখা আংটিটা তুলে নিয়ে গেছে। তারপর কোনও ভাবে পৌঁছে গেছে সেই সাধুর কাছে। কলকাতায় ফেরার ট্রেন ধরেছিলাম এই ঘটনার দিন কয়েক বাদেই।”
রুদ্রনাথ লাহিড়ীর পাইপ ইতিমধ্যে নিবে গিয়েছিল। গল্প থামিয়ে সেটা টেবিলের উপর নামিয়ে পরিষ্কার করে সুদৃশ্য পাউচ থেকে সযত্নে নতুন তামাক ভরলেন। তারপর মুখে নিয়ে অদ্ভুত কায়দায় এক হাতে দেশলাই জ্বেলে অগ্নি সংযোগ করে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ টানবার পরে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমার জীবনে দ্বিতীয় ভয়ংকর ঘটনা সেই রাতে। ওই ট্রেনে।”
সিট পেয়েছিলাম দুই বার্থের এক কূপে। বাকি সিট খালি থাকায় অন্য কেউ ছিল না। তবু আরামে শুয়েও ঘুম আসছিল না। কদিন আগের সেই ভয়ানক ঘটনা তখনও প্রায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। ঘুরেফিরে সমানে পাক খেয়ে যায় মাথায়। ইউনিটের অনেকেই খুব কাছের মানুষ ছিলেন। অনেক দিনের পরিচয়। তাদের এই ভয়ানক মৃত্যু সহজে মন থেকে দূর হবার নয়। রাত তখন প্রায় একটা। প্রচণ্ড গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধুই অন্ধকার। ঘণ্টা খানেক এপাশ-ওপাশ করে মনে হল, চোখেমুখে জল দিয়ে এলে মন্দ হয় না। কামরার শেষ প্রান্তে বেসিন। উঠে গিয়ে ঘাড়ে, চোখেমুখে জল দিয়ে কিছুটা যেন আরাম বোধ হল।
রাতের ট্রেন। কামরার প্রায় সমস্ত জানলাদরজা বন্ধ। বেসিনের পাশে দরজাটা সামান্য খুলে দিলাম। এক ঝলক টাটকা বাতাসে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল। বোধহয় আরামে চোখ দুটো সামান্য বুজে এসেছিল, হঠাৎ ট্রেনটা ভয়ানক দুলে উঠল। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম। মনে হল, কেউ যেন ছুঁড়ে ফেলল আমাকে। তারপর কিছুই আর মনে নেই।
ব্যাপারটা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, এমন কিন্তু পরে মনে হয়নি। হঠাৎ খেয়াল হতে দেখি চারপাশে শুধুই অন্ধকার। তারপর কিছুটা সংবিৎ ফিরে আসতে টের পেলাম, গাঢ় অন্ধকারের ভিতর কোথাও শুয়ে আছি। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম বটে, তবে মাথাটা সাফ হতে সময় লাগল। সম্ভবত মিনিট দুয়েক ওই ভাবেই ছিলাম। তারপর ঘোর কাটতেই একে একে মনে পড়ল সব কথা। ততক্ষণে অন্ধকার চোখে কিছুটা সয়ে এসেছে। তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, এক ধানখেতের ভিতর বসে রয়েছি। সামনে খানিক দূরে আবছা রেল লাইন। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, হঠাৎ সেই ঝাঁকুনিতে সম্ভবত ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে গেছি। কিন্তু ওই প্রচণ্ড গতির ট্রেন থেকে ছিটকে পড়েও কীভাবে এমন বহাল তবিয়তে রয়েছি, ভাবতে গিয়ে ফের ধন্দে পড়ে গেলাম। অন্ধকারেই সামান্য হাত-পা খেলিয়ে নিয়ে বুঝলাম, সামান্যতম চোট-আঘাত কোথাও নেই।
ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি আর মাথা ঘামানো যায়নি। হঠাৎ খেয়াল হল, যাই হোক না কেন, এই জনমানবহীন প্রান্তরে খোলা আকাশের নীচে এভাবে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। অল্প আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটি, ধানের পাতা ভিজে সপসপে। আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সওয়া একটা। অর্থাৎ, ইতিমধ্যে মাত্র পনেরো মিনিট পার হয়েছে। রাতের জন্য একটা আস্তানা অন্তত চাই। চারপাশে তাকিয়ে কোথাও আলোর চিহ্ন পেলাম না। অবশ্য এই রাতে কাছে যদি লোকালয় থাকেও, আলো জ্বেলে কে আর জেগে থাকবে? অগত্যা রেল লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বোধহয় আধ ঘণ্টার মতো হেঁটেছিলাম। হঠাৎ দেখি দূরে লাইনের উপর গোটা কয়েক আলোর বিন্দু। সম্ভবত টর্চের। দেখে প্রায় ছুটতে শুরু করলাম। অন্ধকার তখন চোখে আরও সয়ে এসেছে। অনেকটা চলার পরে দেখি অন্ধকারে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। গোড়ায় সেভাবে বুঝতে পারিনি। আরও এগোতে পিছনের কোচসহ গার্ডের কামরা নজরে পড়ল। গাঢ় অন্ধকারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার গার্ডের কামরায় কেউ নেই। কিন্তু ট্রেনটা আমাদেরই।
অন্ধকার রাতে সেই বিজন প্রান্তরে প্রায় অযাচিতভাবে ট্রেনের দেখা পেয়ে মনটা নেচে উঠলেও সন্দেহে দুলে উঠল ফের। গাড়ি এইভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ল কেন! অন্ধকার কামরার ভিতর মানুষের সাড়া পাওয়া গেলেও দরজা বন্ধ। আলোর বিন্দুগুলো ট্রেনের সামনের দিকে ঘোরাফেরা করছে। কাউকে আর ডাকাডাকি না করে এগিয়ে গেলাম সেই দিকে।
পুরো ট্রেনটাই অন্ধকার। কোনও কারণে ব্যাটারি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম, টর্চ হাতে দু”একজনের কৌতূহলী মুখ। জিজ্ঞাসা করতে কেউ কিছু বলতে পারল না। শুধু এইটুকু জানা গেল, ট্রেন স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। তারপরে হঠাৎই সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে গতি ক্রমশ কমতে কমতে থেমে গেছে। সেও বেশ কিছুক্ষণ আগে। গার্ডের সঙ্গে কয়েকজন সামনে ইঞ্জিনের দিকে গেছে। এখনো ফেরেনি। অযথা কালক্ষেপ না করে লাইনের পাশ দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আমার কামরা ওই সামনের দিকে। ইঞ্জিনের একটা কোচ পরেই।
দূর পাল্লার মেল ট্রেন। কোচের সংখ্যা এসব ট্রেনে বেশিই থাকে। তবু যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। বোধহয় বেশ জোরেই হাঁটছিলাম। সামনে কয়েকজন মানুষ প্রায় উদভ্রান্তের মতো টর্চ হাতে ছুটোছুটি করছে। তাকিয়ে দেখি, গাড়িটা হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে। সামনে ইঞ্জিনের চিহ্নমাত্র নেই। কাপল ছেঁড়া। আতঙ্কে মাথার চুল মুহূর্তে খাড়া হয়ে উঠল।
সেই সময় আসাম থেকে কলকাতার ট্রেন আসত ইস্ট বেঙ্গলের উপর দিয়ে। নদীনালার দেশ। অন্ধকারে তাকিয়ে দেখি সামনে বড় এক নদী, ভাঙা ব্রিজের অবশেষ। গোটা কয়েক স্প্যানের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। ট্রেনের ইঞ্জিন সহ সামনের গোটা কয়েক কোচ কোথায় গিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। তলিয়ে গিয়েছে নদীর জলে। সামান্য চিৎকার, সাড়াশব্দ কোথাও নেই। শুধু বর্ষার দুরন্ত নদীর কলকল আওয়াজ। একটি প্রাণীও বেঁচে নেই।
হঠাৎ ওই দৃশ্য দেখে প্রায় হিম হয়ে গিয়েছিল সারা শরীর। ট্রেন থেকে ওইভাবে ছিটকে না পড়লে, এতক্ষণ কী অবস্থা হত, ভাবতেই হিম হয়ে আসছিল বুকের ভিতর। ওই অবস্থায় অদূরে ছোট এক জটলার দিকে ছুটলাম। ট্রেনের গার্ডকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন। মানুষটি নিজেও তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন ভয়ানক দুর্ঘটনা ভাবাও যায় না। তাঁর কাছেই জানা গেল, সম্ভবত জলের তোড়ে ব্রিজটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ড্রাইভার অন্ধকারে বুঝতে পারেননি। কাছে আসার পরে ব্যাপারটা বুঝে ব্রেক চাপলেও গাড়ির গতি পুরো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ইঞ্জিন সহ সামনের তিনটি কোচ নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে।
ওই তিনটি কোচের একটায় আমি ছিলাম, ভাবতে গিয়ে মাথাটা ফের ঝিমঝিম করে উঠলেও হঠাৎ অন্য এক ব্যাপার মাথার মধ্যে খেলে গেল। এর আগেরবার ওই রকম অদ্ভুতভাবে রক্ষা পাওয়ার পরে তেমন চিন্তা মাথায় আসেনি। মনে হয়েছিল, প্রকৃতির খেয়ালেই আমার তাঁবু ধ্বসের কবলে পড়েনি। তাই বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রথম অনুভব করলাম, কোনও এক অদৃশ্য শক্তি অলক্ষ্যে আমার পিছনে কাজ করে চলেছে। তা না হলে দুর্ঘটনার অব্যবহিত আগে ওইভাবে ট্রেন থেকে ছিটকে গেলাম কী করে! শরীরে সামান্য আঘাতও লাগল না! ভয়ানক এই দুর্ঘটনা ঘটবে বলেই কি আমাকে ট্রেন থেকে সরিয়ে দেওয়া হল? সেই প্রথম সন্দেহ হল, এসব ওই আংটির জন্যই নয়তো?”
রুদ্রনাথ লাহিড়ী থামলেন আবার। পাশের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। প্রায় রুদ্ধশ্বাসে গল্প গিলছিলাম। শুকনো গলা সামান্য ঝেড়ে নিয়ে বললাম, “তারপর?”
ওই সময় বাইরে হঠাৎ ঝিঁঝিঁর কোরাস শুরু হল। বেশ জোরাল। এতদিন আছি, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ কখনও শুনিনি। তাও এত জোরাল! রুদ্রনাথবাবু হঠাৎ উঠে গিয়ে জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালেন। বিকেলের আলো ইতিমধ্যে অনেকটাই মরে এসেছে। নিঃশব্দে কয়েক মিনিট অপেক্ষার পরে ফিরে এসে বললেন, “প্রশান্তবাবু, আজ থাক বরং। অন্য আর একদিন শুনবেন।”
অদ্ভুত গল্পে এতটাই মজে গিয়েছিলাম, মানুষটির সেই কথায় প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম। কিন্তু উপায় ছিল না। হয়তো কোনও দরকার আছে ওনার। বললাম, “ঠিক আছে স্যার। আগামী কাল শনিবার। তবু অফিস থেকে বেরোতে হয়তো সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়ি ফেরার পথে চলে আসব।”
“সন্ধেয়!” কতকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাল রুদ্রনাথ লাহিড়ীর কথা। তারপর গলাটা সামান্য ঝেড়ে নিয়ে বললেন, “নাহ্, আজই বলি তাহলে। অনেক কথা বাকি হয়ে গেছে এখনো। তবে একটু সংক্ষেপেই সারব এবার।”
হয়তো অন্য কোনও কাজ আছে ভদ্রলোকের। ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না বুঝেও গল্পের লোভে চুপ করে রইলাম। উনি শুরু করলেন আবার, “বদলির আবেদন মঞ্জুর হবে কিনা, তা নিয়ে কলকাতায় ফিরে কিছু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমাদের যা চাকরি, কলকাতায় পোস্টিং সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু অবাক করে দিয়ে ছুটি ফুরুবার আগেই কলকাতায় বদলির অর্ডার এসে গেল। খবর জেনে বাড়ির সবাই খুব খুশি। দিন কয়েক পরে মা একদিন বললেন, “রুদ্র, এতকাল তো বাউণ্ডুলের মতো বনেজঙ্গলে ঘুরে কাটালি। এবার বিয়ে করে একটু সংসারী হ বাপু। দেখে যাই।”
আপত্তির কারণ ছিল না। দাদা আর ছোট বোনের বিয়ে আগেই হয়ে গেছে। দাদার পোস্টিং বাইরে। বাড়িতে মা একা। রাজি না হবার কারণ ছিল না। মা পাত্রী পছন্দ করেই রেখেছিলেন। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল।”
রুদ্রনাথ লাহিড়ী ফের অল্প থামলেন। পাইপে মৃদু কয়েকটা টান দিয়ে জানলা দিয়ে অদূরে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক। তারপর শুরু করলেন আবার, “আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্বের শুরু এখান থেকেই। পরে কতদিন আপসোস করেছি, কলকাতায় যদি ট্রান্সফার না নিতাম, জীবনটা হয়তো কিছু অন্য রকম হতেও পারতো।
আগে বলিনি, কলকাতায় এসে যখন তখন আংটির দিকে তাকিয়ে থাকা প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের সেই ঘটনার পরে জিনিসটিকে তখন অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছি। বিয়ের দিন দুই আগের কথা। সেদিন আনমনে আংটির দিকে তাকিয়েছি। চমকে উঠলাম। এ কী! এমন তো আগে হয়নি! আংটির সবই ঠিক আছে, শুধু ভিতরের কালো বিন্দু দুটোর রং আমূল পালটে গেছে। কালোর বদলে টকটকে লাল। দুটো রক্তবিন্দু যেন জমাট বেধে আছে ভিতরে। কেন এমন হল, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। বিয়ের দিন এসে গেল। এর মধ্যে অনেকবার আংটির দিকে নজর করেছি, রং সেই লাল–ই রয়েছে। পরিবর্তন হয়নি।
পাত্রীপক্ষের বাড়ি কলকাতার বাইরে। বিহার সীমান্তের কাছে। রিজার্ভ বাসে ঘণ্টা কয়েকের পথ। বাবা গিয়েছিলেন বরকর্তা হয়ে। সঙ্গে দাদা, বউদি, বোন আর ভগ্নীপতি। এছাড়া ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়–স্বজন। সব মিলিয়ে জনা কুড়ি মানুষ। অনেকটা পথ। তাই বিয়ের রাতে বরযাত্রীদের ফেরা সম্ভব নয়। ঠিক ছিল, পরের দিন নবদম্পতিসহ সবাই এক সাথে ফিরবে।
পরের দিন নানা স্ত্রীআচার সামলে রওনা হতে কিছুটা দেরিই হয়ে গিয়েছিল। সন্ধের মধ্যে নাকি বাড়ি ফেরা চাই। বাবা খুব তাড়া লাগাচ্ছিলেন। হাইওয়ে ধরে কলকাতার পথে বাস তখন প্রায় উড়ে চলেছে। সামনে একটা মালবোঝাই ট্রাক অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত করছিল। চেষ্টা করেও আমাদের ড্রাইভার ওভারটেক করার জন্য সাইড পাচ্ছিল না। ওদিকে বাবার তাগাদা। সামান্য সাইড পেয়ে প্রায় মরিয়া হয়ে ড্রাইভার গিয়ার বদলে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিল। প্রচণ্ড গতিতে আমাদের বাস সামনের ট্রাককে পাশ কাটালো। তারপরেই আচমকা দুলে উঠল গাড়ি। চারপাশে আর্তনাদ। কিছু বুঝবার আগেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সিট থেকে ছিটকে গেলাম। তারপর কিছুই আর মনে নেই।
জ্ঞান যখন হল, তখন হাসপাতালে। মাথাটা প্রচণ্ড ভারি, যেন হাজার মণ বোঝা চাপানো রয়েছে। পরে শুনেছিলাম, ওই অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে ছিলাম পুরো বাইশ দিন। আচমকা উলটো দিক থেকে আসা একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রায় বিশ ফুট নীচে জল ভরতি খাদে ছিটকে পড়েছিল বাস। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একমাত্র আমি ছাড়া বাসের আর কেউ রক্ষা পায়নি। আশ্চর্য ব্যাপার, প্রায় ঘণ্টা দুই পরে স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় যখন জলের তলায় সেই অভিশপ্ত বাস থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়, তখনও নাড়ির গতি অতি ক্ষীণ হয়ে এলেও সচল। প্রায় দু”ঘণ্টার উপর জলের তলায় থেকেও কীভাবে এটা সম্ভব, ডাক্তারদের কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। ভয়ানক থেঁতলে যাওয়ার কারণে ডান হাতটা অবশ্য কনুইয়ের উপর থেকে বাদ দিতে হয়েছিল।
আরও মাস দেড়েক পরে সামান্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। শরীর ভীষণ দুর্বল। কোনও মতে চলে বেড়াতে পারি। তার উপর ডান হাত হারিয়ে তখন নিতান্তই এক পঙ্গু মানুষ। বিধবা মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। মা অবশ্য যথাসাধ্য নজরে রাখতেন। কিন্তু আমি নিজেই ভিতরে ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। মাস ছয়েক কেটে গেলেও শরীরে সামান্য উন্নতিও হল না। ওই অবস্থা দেখে মা ঠিক করলেন, আমাকে নিয়ে কোথাও চেঞ্জে যাবেন। দেওঘরে যাওয়ার সব ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় একদিন বড়মামা আমাকে দেখতে এসেছিলেন। হঠাৎ পকেট থেকে সেই আংটি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “রুদ্র, তোর ডান হাতের সেই আংটি। রিলীজের দিন হাসপাতাল থেকে দিয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম। রেখে দে।”
সত্যি কথা বলতে কী, আংটির কথা এর মধ্যে আর মনেই পড়েনি। অবস্থার বিপাকে পড়ে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বড়মামার হাতে জিনিসটা দেখে মুহূর্তে মনে পড়ে গেল সেই লাল বিন্দু দুটোর কথা। দ্রুত হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিলাম। কী বলব, আংটিটা হাতে নিতেই ভিতরে যেন এক অন্য অনুভূতি টের পেলাম। মনে হল, একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ শরীরের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল। মুহূর্তে অনেক হালকা হয়ে গেল শরীর। ব্যাপারটা অবশ্য বলিনি কাউকে। বড়মামাকে দিয়েই সেটা বাঁ হাতের আঙুলে পরে নিলাম। মধ্যমায় বেশ সেট হয়ে গেল। ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছি, পাথরের সেই ক্ষুদ্র বিন্দু দুটোর রং আর লাল নেই। আগের মতোই ফের কালো হয়ে গেছে।
দেওঘরে চেঞ্জে যাবার ব্যাপারটা মাকে বলে পরের দিনই বাতিল করে দিলাম। কারণ, সেদিন আংটি হাতে নেবার পরেই বুঝেছিলাম, অযথা চেঞ্জে যাবার আর দরকার নেই। সত্যিই তাই। আংটি হাতে পরার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই প্রায় মিরাকল ঘটে গেল। এই অল্প সময়ের মধ্যে শরীর শুধু আগের অবস্থায় ফিরে এল না, অনভ্যস্ত বাঁ হাতটাও ডান হাতের মতো কর্মক্ষম হয়ে উঠল। লেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজই দেখলাম বাঁ হাতে চমৎকার করতে পারছি। অথচ অন্য আর পাঁচ জনের মতো কোনও দিনই বাঁ হাতে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলাম না। মিরাকল ছাড়া একে আর কী বলা যায়? আমার সেই উন্নতি দেখে ডাক্তারও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
অবশ্য আমার কাছে ব্যাপারটা তখন আর তেমন ছিল না। হাতের ওই আংটির রহস্য আমার কাছে তখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বুঝতে তখন আর বাকি নেই, গৌহাটির রাস্তায় সেই জটাজূটধারী সাধুবাবা জিনিসটা ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। এ জিনিস সংসারী মানুষের জন্য নয়। আগের দু”বার নিজের কিছু হয়নি। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেই অনতিবিলম্বে খোয়াতে হয়েছে একটা হাত। হারাতে হয়েছে নিজের একান্ত আপনজনদের। বাবা, দাদা–বউদি, বোন আর ভগ্নীপতিকে।
এর আগে জিনিসটা কখনও তেমন ভীতিপ্রদ বলে মনে হয়নি। কিন্তু এবার তাই হল। ক্রমে আংটিটা আমার কাছে প্রায় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াল। চোখ পড়লেই সারা শরীর প্রায় সিটিয়ে যেত। অথচ খুলে রাখার কথা ভাবতেও পারতাম না। মনে হত, ওটা খুলে ফেললেই সেই আগের মতো পঙ্গু হয়ে পড়ব। এভাবেই কাটল আরও মাস কয়েক। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও আংটির ভীতি কিন্তু বাড়তেই থাকল। শেষে ঠিক করলাম, যাই ঘটুক, আংটিটা যেখান থেকে এনেছিলাম, সেখানেই রেখে আসব। সেই কবরের ভিতর কঙ্কালের আঙুলে। গৌহাটির রাস্তায় সাধুবাবা তেমনটাই বলেছিলেন।
দিন কয়েক পরে একদিন মণিপুরের পথে রওনা হয়ে পড়লাম। বাড়িতে মাকে ঘুণাক্ষরেও জানাইনি ব্যাপারটা। সেই সময় বন–জঙ্গলে ভরা মণিপুরের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। অনেকটাই হাঁটা পথ। গাইড, মালপত্র বইবার কুলি ছাড়া এক পা”ও চলা সম্ভব নয়। আগের বার ইম্ফলে সদানন্দ থিয়ামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিছু সাহায্যও করেছিল আমাদের। প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। ইম্ফলে পৌঁছে সেই সদানন্দ থিয়ামের কথাই মনে পড়ল আগে। সদানন্দ ঠিকেদারের কাজ করে। ভেবেছিলাম সহজেই কাজটা হয়ে যাবে। কিন্তু গন্তব্যস্থানের কথা শুনে তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, “স্যার জায়গাটা ভাল নয়। ওদিকে যাবার লোক পাওয়া মুশকিল।”
সদানন্দের কথায় মনে পড়ল, আগের বার চেষ্টা করেও স্থানীয় কুলি জোগাড় করা যায়নি। তবে সেবার দায়িত্বটা আমার উপর ছিল না। তাই তেমন মাথা ঘামাইনি। অধীর হয়ে বললাম, “মি. থিয়াম, ওসব শুনতে চাই না আমি। দু”চারজন কুলি জোগাড় করে দিতেই হবে। খুব দরকার।”
আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে সদানন্দ থিয়াম অল্প সময় কী ভাবলেন। তারপর এক টুকরো কাগজে কয়েক লাইনের একটা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “স্যার, এই ব্যাপারে কেউ সাহায্য করতে পারলে একমাত্র হাওবিজন সিংহ”ই পারবে। ও কৈরাঙের দিকে থাকে। এই চিঠি নিয়ে একবার দেখা করুন।”
কৈরাঙে হাওবিজন সিংহর সঙ্গে সেই দিনই দেখা করলাম। যথেষ্ট বয়স্ক মানুষ। তিনি আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে শেষে বললেন, “স্যার, শুনেছেন নিশ্চয়, পাহাড়ের ওই অঞ্চলে মণিপুরের মানুষ বড়ো একটা যায় না। এড়িয়ে চলে। তবু সদানন্দ যখন আপনাকে পাঠিয়েছেন, ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। তবে তার আগে জানা দরকার, ঠিক কী কাজে ওই দিকে যেতে চাইছেন?”
সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে অসুবিধা হল না, কোনও কথাই মানুষটির কাছে গোপন করা ঠিক হবে না। সামান্য ঢোঁক গিলে বললাম, “সব বলব। তবে তার আগে যদি বলেন, কী কারণে ওদিকে কেউ যেতে চায় না।”
অনেক দিন আগের কথা স্যার।” হাওবিজন সিংহ বলতে শুরু করলেন, “কতদিন আগে, কেউ বলতে পারে না। একরাতে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে আকাশ থেকে স্বয়ং রুদ্রদেব নেমে এসেছিলেন ওই পাহাড়ে। রাতের মধ্যেই সেখানে এক মন্দির গড়েছিলেন। ওদিকের ওই পাহাড়ে তখন প্রচুর জনবসতি ছিল। দলে দলে মানুষ তাঁর শিষ্য হতে লাগলেন। এভাবে হয়তো সারা মণিপুরের মানুষ ভগবান রুদ্রদেবের অনুগামী হয়ে যেতেন। কিন্তু কোনও এক কারণে ভয়ানক বিরূপ হয়ে তিনি এক রাতে হঠাৎই স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই মন্দিরও ভেঙে পড়েছিল। এর অল্প দিনের মধ্যেই পাহাড়ে নানা অঘটন ঘটতে শুরু করল। ঘন ঘন ধ্বস আর ভূমিকম্পে মারা পড়ল বহু মানুষ। প্রাণভয়ে একে একে পালিয়ে এল সবাই। অল্প দিনের মধ্যেই জনশূন্য হয়ে পড়ল। রুদ্রদেবের অভিশাপে সেই থেকে নানা অঘটন আজও ওই অঞ্চলে ঘটে চলছে।”
হাওবিজন সিংহের ওই কথায় প্রমাদ গুনলেও কিছুই গোপন না করে সব খুলে বললাম ওকে। সব শুনে বৃদ্ধ মানুষটি চিন্তিত মুখে বললেন, “যা বললেন, মনে হচ্ছে, সেই রুদ্রদেবের মন্দির থেকেই আপনি আংটিটা পেয়েছেন! এখন ফিরিয়ে দিতে গেলে মনে হয়, আরও বড় বিপদে পড়তে পারেন। ভগবান রক্ষা করুন।” বলতে বলতে বার কয়েক কপালে হাত ছোঁয়ালেন উনি।
“হয়তো ঠিকই বলেছেন।” মাথা নাড়লাম আমি। “কিন্তু বুঝতেই পারছেন, এই অবস্থায় অন্য কোনও পথ আমার কাছে আর খোলা নেই। ওই আংটি কাছে রাখলে শুধু মা নয়, আত্মীয়স্বজন অন্য যাঁরা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাঁদেরও এরপর হারাতে হবে।”
“আমি, আমি চেষ্টা করব যথাসাধ্য।” বৃদ্ধ মানুষটি অল্প মাথা নাড়লেন। “আপনি দুটো দিন অপেক্ষা করুন।”
হাওবিজন সিংহ দুটো দিন সময় চেয়ে নিলেও একদিনের মধ্যেই তিনজন নাগা পোর্টার জোগাড় করে দিয়ে বললেন, “মাফ করবেন স্যার, চেষ্টা করেও তেমন ভাল কোনও মণিপুরি গাইড জোগাড় করতে পারলাম না। ওদের কেউ থাকলে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। তবে কুলিদের সর্দার সুমি আও বিশ্বস্ত মানুষ। যথাসাধ্য লক্ষ্য রাখবে।”
প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র নিয়ে পরের দিনই রওনা হয়ে পড়লাম অকুস্থলের উদ্দেশ্যে। যদিও অল্প দিন আগের কথা। তবু পাহাড়, বন–জঙ্গলের ভিতর কোনও বিশেষ জায়গা খুঁজে বের করা সহজ নয়। আগেরবার কাগজপত্র সব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অক্ষাংশ–দ্রাঘিমাংশ সংক্রান্ত কোনও তথ্যও ছিল না। কিন্তু সুমি আও সত্যিই কাজের মানুষ। বলা যায়, তার চেষ্টায় দিন কয়েক পরে খুঁজে বের করলাম সেই কবর। তারপর মাটি খুঁড়ে কী দেখলাম জানেন?”
বলতে বলতে রুদ্রনাথ লাহিড়ী হঠাৎ থামলেন। নিঃশব্দে শুনছিলাম। ঢোঁক গিলে কোনওক্রমে বললাম, “কী?”
“সেই অত বড় কঙ্কালটা, মাত্র মাস কয়েক আগেও যেটিকে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় দেখে গেছি, তার কিছুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। গুঁড়িয়ে ছাতু হয়ে রয়েছে। যেন ভারি জাঁতায় ফেলে পেষাই হয়েছে হাড়গুলো। খানিকটা সাদা গুঁড়ো শুধু মিশে রয়েছে মাটিতে। সাধুজি বলেছিলেন, আংটিটা যার কাছ থেকে আনা হয়েছে, তাকেই ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু এই অবস্থায় তা কীভাবে সম্ভব, ভেবে উঠতে পারলাম না। কঙ্কালের কিছুই যে আর অবশিষ্ট নেই! তবু অনেক ভেবে সেই কবরের মধ্যেই আংটিটা রেখে দিলাম।
অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল তারপর। অযথা দেরি না করে পরের দিন ভোরেই ফেরার পথ ধরেছিলাম। সকাল থেকে শরীরটা তেমন জুত মনে হচ্ছিল না। সামান্য জ্বরও ছিল। কিন্তু তেমন গা করিনি। মনে হয়েছিল, একটানা পাহাড়ি পথে চলার কারণেই হয়েছে। সেদিন ওই অবস্থার মধ্যেও চলে এসেছিলাম অনেকটা পথ। সন্ধেয় তাঁবু ফেলা হতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর কিছুই আর মনে নেই। পরে কুলিদের কাছেই শুনেছি, দারুণ জ্বরে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে কেউ টের পায়নি। সকালে আমার ওই অবস্থা দেখে সঙ্গীরা ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিল। তবু ফেলে পালায়নি। নিজেদের মতো করে যথাসম্ভব সেবা শুশ্রূষা করেছিল। পরের দুটো দিন সেই তাঁবুর মধ্যেই কোমায় পড়ে ছিলাম। সেই অবস্থা দেখে ওরা যখন আমাকে ফেলে চলে যাবে কিনা ভাবছে, সেই সময় সুমি আওয়ের মাথায় এসেছিল ব্যাপারটা। কুলিদের একজনকে আমার কাছে রেখে অন্যজনকে নিয়ে ফের চলে গিয়েছিল সেই কবরের ভিতর রেখে আসা আংটির খোঁজে। অনেকটাই পথ। ফিরতে পরের দিন বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তারপর সুমি আও সেই আংটি পরিয়ে দিয়েছিল আমার আঙুলে। আমার জ্ঞান ফিরে আসে তার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। সন্ধের আগেই একদম সুস্থ।
এই ঘটনার পরে বুঝতে বাকি থাকেনি, আংটিটা আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। চাইলেও আর ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা টের পাবার পরে কর্তব্য ঠিক করে নিতে আর দেরি করিনি। বাকি জীবনটা কারো সংস্পর্শেই আর থাকব না। অযথা অন্যের বিপদের কারণ আর হতে চাই না।
গৌহাটি ফিরেই প্রথমে মাকে চিঠি লিখলাম। তারপর রেজিগনেশন পাঠিয়ে দিলাম অফিসে। এরপর চলে এলাম পুনায়। ছিলাম প্রায় কুড়ি বছর, তারপর এই বোম্বাই শহরে। নয় নয় করে এখানেও তো প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল।”
“পুনা ছাড়লেন কেন?” প্রশ্ন করলাম আমি।
“সে আর এক ইতিহাস। পুনা থেকে কখনও যে চলে যেতে হবে, সত্যিই ভাবিনি। পাহাড়–ঘেরা ছিমছাম শহরটা ভালও লেগে গিয়েছিল। কিছু বাঙালিও ছিলেন ওখানে। বেশ ভালই ছিলাম। তারপর——।”
বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেলেন ভদ্রলোক। বাইরে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ ইতিমধ্যে আরও জোরাল হয়েছে। সেই সাথে তীব্র বেগে বাতাস আছড়ে পড়লে যেমন শব্দ হয়, তেমন দমকা একটা আওয়াজ। অথচ বাইরে জোরাল বাতাস বইছে, এমন মনে হল না। জানলার পর্দা স্থির। রুদ্রনাথবাবু কেদারায় বসেই সেই পর্দার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখ দুটো সামান্য কুঁচকে উঠল। মনে হল, কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টাও করছেন। তারপর নড়ে উঠে বললেন, “আজ থাক সেকথা। শুধু বলি, ততদিনে রহস্যময় ওই আংটির অনেক কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বুঝতে বাকি থাকেনি, গৌহাটির পথে জটাজূটধারী সেই সাধুবাবার চোখও সেদিন কেন লোভে চকচক করে উঠেছিল। কিন্তু আমি তো সাধু–সন্ন্যাসী বা স্বামীজি নই। হবার ইচ্ছেও ছিল না। তাই হঠাৎই একদিন চলে আসতে হল। এই সাকিনাকায় যখন আসি, প্রায় ফাঁকাই ছিল এদিকটা। প্রমোদ কামলেদের কিছু ঝুপড়ি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। বেশ নিরাপদ মনে হয়েছিল। কিন্তু সেও তো ভরে উঠল দেখতে দেখতে। প্রমোদ কামলেদের কাছেও তো হয়ে গেলাম ভগবান রুদ্রদেব। হয়তো এইভাবেই বহু বছর আগে আমার মতোই অন্য কোনও রুদ্রনাথ মণিপুরে সেই পাহাড়ের মানুষের কাছেও ভগবান হয়ে উঠেছিলেন। তবু প্রমোদ কামলেরা সরল, সহজ মানুষ। কখনও সমস্যার কারণ হয়নি। কিন্তু যাক সে কথা। বরং যে জন্য আপনাকে আজ ডেকেছি, সেটাই বলি।”
রুদ্রনাথবাবু অল্প থামলেন। মুখের পাইপ ইতিমধ্যে নিবে গেছে। টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “ওই প্রমোদ কামলেরা ছাড়া সবাই আমাকে দাম্ভিক বদমেজাজি বলেই জানে। আমিও সেটাই চেয়েছি। বিশ বছর আছি এখানে, হাটে বাজারে প্রয়োজনীয় দরকার ছাড়া বিশজন মানুষের সঙ্গেও আলাপ হয়নি। সেজন্য অনেকেই ক্ষুব্ধ। তবু আসল কারণ কাউকেই বলিনি। হয়তো আপনাকেও শোনাতাম না। কিন্তু হঠাৎই ঘটেছে ব্যাপারটা। সপ্তাহ খানেক আগে হঠাৎ এক সকালে দেখি, আংটির কালো বিন্দু দুটো আবার লাল হয়ে উঠেছে। সেই যে বিয়ের আগে একবার হয়েছিল, তারপর দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে এই প্রথম। সেবার একটা হাতের উপর দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এবার আরও ভয়ানক কিছু ঘটবে বলেই মনে হয়। আংটির চোখ দুটো সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অবশ্য এসবে এখন আর ভিতরে তেমন প্রতিক্রিয়া হয়না। তাই সেই দিনই খুলে রেখেছি ওটা।”
থামলেন ভদ্রলোক। ভেবেছিলাম, হয়তো আরও কিছু বলবেন। কিন্তু খানিক অপেক্ষার পরে তেমন সম্ভাবনা নেই বুঝে বললাম, “স্যার, মনে হচ্ছে, আরও অনেক কিছুই বলার আছে আপনার। সে যাই হোক, একটা কথা বলি, আপনি আংটির পাথরের ভিতর লাল বিন্দুর কথা বলছেন, আমি কিন্তু তেমন কিছু দেখতে পাইনি। অযথাই চিন্তা করছেন।”
বাইরে ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। টেবিল ল্যাম্পটা আগেই জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল, রুদ্রনাথবাবু উঠে গিয়ে ঘরের বাতিগুলো জ্বেলে দিলেন এবার। আংটিটা সেই থেকে টেবিলের উপরেই রয়েছে। কেদারায় ফিরে এসে সেটা হাতে নিয়ে মিনিট কয়েক ঘরের জোরালো আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ফের নামিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “হয়তো তাই। তবে লাল বিন্দু দুটো কিন্তু রয়েছে। মৃদু নড়ছেও। আগের জায়গা থেকে কিছু সরেও গেছে।”
ভদ্রলোকের কথায় ইচ্ছে হল আংটিটা ফের হাতে নিয়ে দেখব। টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়েছি, প্রায় হিমশীতল গলায় ভদ্রলোক বললেন, “সন্ধে হয়ে গেছে প্রশান্তবাবু। ভিতরে বিন্দু দুটো যখন আপনি দেখতে পাননি, এই রাতে আর টাচ করতে যাবেন না।”
“কেন?” অবাক হয়ে বললাম।
“বলেছি তো, ওই আংটির সব রহস্য এখনও পরিষ্কার না হলেও কিছু কিছু এখন বুঝতে পারি। বিপদ হতে পারে আপনার।”
এসবে একেবারেই বিশ্বাস নেই। ভদ্রলোকের গল্পটা শোনার জন্য দারুণ হলেও তার বাইরে অন্য কিছু এই বিংশ শতাব্দীতে ভাবা যায় না। তবু ওই কথার পরে কী ভেবে শেষ মুহূর্তে হাত সরিয়ে নিলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্রনাথবাবু বললেন, “আপনার জায়গায় আমি হলেও তাই ভাবতাম প্রশান্তবাবু।”
“ক—কী!” ভদ্রলোকের কথায় প্রায় চমকে উঠলাম। মনের কথা উনি জানলেন কী করে!
“আজ থাক ওসব।” প্রসঙ্গ পালটে রুদ্রনাথ লাহিড়ী বললেন, “বরং চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
সামান্যই পথ। সবে সন্ধে হয়েছে। ভদ্রলোককে অকারণে ব্যস্ত করা হবে। আপত্তি জানালেও উনি একেবারেই কান দিলেন না। এগিয়ে দিলেন আমার ফ্ল্যাটবাড়ি গেট পর্যন্ত। অনুরোধ করেছিলাম, একবার ঘরে আসতে। রাজি হলেন না। ফিরে যাবার আগে বললেন, “অনেক দিন পরে আজ আপনার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পেরে ভাল লাগল। চলি এবার।”
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “ভাল লাগল আমারও স্যার। আপনার আপত্তি না হলে সামনের রবিবার ফের যেতে পারি।”
“না না, আর আপত্তি করব না। খুশিই হতাম বরং।” অল্প হাসলেন উনি। “তবে মনে হয়, আপনারই হয়তো সময় হবে না।” আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।
পরের রবিবার সত্যিই কিন্তু ওনার কাছে যেতে পারিনি। পরের দিন শনিবার অফিসে যেতেই আদেশ এল, নাগপুরে নতুন যে প্রজেক্ট শুরু হয়েছে, আমাকেই যেতে হবে সেখানে। অগত্যা রবিবার সকালেই জরুরি ব্যাগ গুছিয়ে ছুটতে হল ট্রেন ধরতে।
তেমন বড় কাজ নয়। ভেবেছিলাম মাস দেড়েকের মধ্যেই সেরে ফেলা যাবে। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে শেষ হতে প্রায় মাস তিনেক লেগে গেল। এর মধ্যে এক–আধ দিনের জন্য বোম্বাই আসাই যেত। কিন্তু দূরত্বের কারণে ইচ্ছে হয়নি। তবে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও রুদ্রনাথ লাহিড়ীর কথা ভুলিনি। ভেবে রেখেছিলাম, ফিরেই দেখা করতে যাব। ভি.টি থেকে ট্যাক্সিতে বাসায় পৌঁছেই তাকিয়েছিলাম রুদ্রনাথ লাহিড়ীর বাংলোর দিকে। ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল। কী ভয়ানক! টিলার মাথায় বাড়িটা প্রায় লণ্ডভণ্ড অবস্থায় পড়ে আছে। সামান্য জিরিয়ে নিয়েই বোম্বাইয়ের অফিসে ছুটতে হবে। তার আগে ফাইনাল রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে নেব ভেবেছিলাম। কিছুই হল না। হাতের মালপত্র নামিয়ে রেখেই ছুটলাম প্রমোদ কামলের খোঁজে।
প্রমোদ কামলে কোথাও বেরিয়েছিল তখন। পেলাম না। কিন্তু তার জন্য সমস্যা হয়নি। ব্যাপারটা যথেষ্ট আলোড়ন ফেলার কারণে জানা ছিল অনেকেরই। আমি যেদিন বোম্বাই শহর ছাড়ি, তার পরদিন রাতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে রুদ্রনাথবাবুর বাংলোর উপর ভয়ানক শব্দে বাজ পড়েছিল। তাতেই বাড়িটার ওই অবস্থা হয়েছে। সেই রাতেই ফায়ার ব্রিগেড আর পুলিশ ছুটে এসেছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের ভিতর রুদ্রনাথবাবু বা তার দেহের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুলিশের ধারণা, ভদ্রলোক সম্ভবত তখন বাড়িতে ছিলেন না। অন্য কোথাও গিয়েছিলেন।
পুলিশের তরফ থেকে তাই আশা করা হয়েছিল, রুদ্রনাথবাবু অচিরেই ফিরে আসবেন একদিন। কিন্তু তাঁদের সেই ধারণা এখনও পূর্ণ হয়নি।
গোড়ায় আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু এক এক করে আরও কয়েক মাস কেটে গেল, রুদ্রনাথ লাহিড়ী আর ফিরে আসেননি। গোড়ায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে আলোচনা হত তাই নিয়ে। তারপর ক্রমে পুরোনো হয়ে যেতে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। শুধু পুলিশের খাতায় রয়ে গিয়েছিল কেসটা। এমনকী ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলাম আমিও। ততদিনে অবশ্য আমার ধারণা কিছু পালটেছে। সেদিন রুদ্রনাথবাবুর অনেক কথাই কেমন হেঁয়ালির মতো ছিল। জিজ্ঞাসা করলেও ভাঙেননি। খুলে না বললেও, সম্ভবত এই ভাবেই উনি একদিন পুনা থেকে পাট গুটিয়েছিলেন। সেদিন সামান্য আভাসও দিয়েছিলেন, লোকবসতি বেড়ে যাওয়ায় সাকিনাকা অঞ্চলও তেমন আর পছন্দ নয় এখন। হয়তো সেই কারণেই হঠাৎ পাট গুটিয়ে চলে গেছেন। ব্যাপারটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
রুদ্রনাথবাবুর ব্যাপারটায় এখানেই হয়তো দাঁড়ি পড়ে যেত, যদি না নিজেই একদিন জড়িয়ে পড়তাম ব্যাপারটার সঙ্গে।
বছর দুই পরের কথা। সাকিনাকার ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি তখন চেম্বুরে। প্রচুর বাঙালির বাস ওই অঞ্চলে। রাস্তায় বা হাটে-বাজারে হামেশাই দেখা মেলে। বাঙালিদের নিজস্ব দুর্গাপুজোও হয়। দিনগুলো তাই বেশ কাটছে। রুদ্রনাথবাবুর কথা প্রায় ভুলেই গেছি। হঠাৎ সাকিনাকা অঞ্চলে আমাদের সংস্থা নামী এক কোম্পানির অফিস এবং কোয়ার্টার তৈরির বরাত পেতে দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। যথেষ্ট বড় প্রজেক্ট। প্রচুর লোকলশকর নিয়ে যথাসময়ে কাজ শুরুও হয়ে গেল। পুরোনো জায়গায় ফের আসতে হলেও কাজের চাপে রুদ্রনাথবাবুর কথা সেভাবে আর মনে পড়েনি। যদিও সেই টিলার দিকে চোখ পড়লে রুদ্রনাথবাবুর সেই ভাঙাচোরা বাংলোটা নজরে পড়ত। ওই সময় একদিন ফিল্ডে কাজ করছি, হঠাৎ দেখি সামনে দাঁড়িয়ে প্রমোদ কামলে।
“আরে কামলে যে! কেমন আছো?”
উত্তরে কামলে সেলাম ঠুকে হাত কচলে বলল, “ শেঠ, একটা অনুরোধ করব?”
“কী?”
“শেঠ।” ফের হাত কচলাল প্রমোদ কামলে। “রুদ্রদেবের বাড়িটা বড্ড অযত্নে পড়ে আছে। তাকালে মনটা বড়ো খারাপ হয়ে যায়। একটু পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করলে খুব ভাল হয়। মনে শান্তি পাই।”
“সে তো তোমরাও পারো!” একটু অবাক হয়েই বললাম।
“পারতাম তো।” কামলে ফের হাত কচলাল। “কিন্তু উনি যে আমাদের বারণ করে গেছেন।”
প্রমোদ কামলেকে বিলক্ষণ চিনতাম। তাই আর কথা বাড়াইনি। সম্মতি জানিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম। কিন্তু জায়গাটা আমাদের প্রজেক্টের বাইরে। ইচ্ছে করলেও তাই সম্ভব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ সুযোগ এসে গেল। প্রজেক্টের কাজ তখন অনেকটাই এগিয়েছে। একদিন বড় সাহেবকে নিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইনস্পেকশনে এসেছেন। সুযোগ পেয়ে বড় সাহেবকে বললাম ব্যাপারটা। এতবড়ো একটা অফিস, হাউজিং। অথচ পাশেই পোড়ো ভাঙা বাড়িটা যথেষ্টই দৃষ্টিকটু। প্রয়োজনীয় অনুমতি পেলে সাফ করে দেওয়া যায়।
প্রস্তাবটা বড় সাহেবের মনে ধরেছিল। তক্ষুনি তিনি ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিলেন। পুলিশ কেস হয়ে রয়েছে। তার উপর মালিক নিখোঁজ। অনুমতি পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু এদেশে ঠিক জায়গায় মাথা গলাতে পারলে কোনও কিছুই অধরা নয়। উপর মহলে যোগাযোগের পরে অনুমতি এসে গেল মাস খানেকের মধ্যে। তারপর একদিন পুলিশের তদারকিতে কাজ শুরু হল।
আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম সেদিন। ভাঙাচোরা চারটে দেয়াল ছাড়া বাড়িটার তখন কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। দুপুরের আগেই চারপাশ সাফ করে মজুরের দল ভিতরে প্রবেশ করে জমা ইটপাথর সরাতে শুরু করেছে। নজরে পড়ল ঘরের মেঝেতে বিশাল আকারের এক বোল্ডার। এতবড় পাথরের চাংড় ঘরের মেঝেতে কীভাবে এল বলতে পারল না কেউ। এমন কী পুলিশও। রুদ্রনাথবাবু নিখোঁজ হবার পরে থানা থেকে যাঁরা তদন্তে এসেছিলেন তাঁরা না থাকলেও সেই সময়ের “কেস ডায়েরি” সঙ্গে ছিল। তা থেকেও তেমন কোনও রিপোর্ট পাওয়া গেল না। যাই হোক, লোকজন লাগিয়ে সেই বোল্ডার সরিয়ে দিতে যা নজরে পড়ল তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। পাথরটা যেখানে ছিল তার নীচেই বাঁধানো মেঝের টালিগুলো বেশ আলগা। সন্দেহ হতে তৎক্ষণাৎ খুঁড়ে ফেলা হল জায়গাটা। ফুট তিনেক মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল। ডান হাতটা নেই। কনুইয়ের নীচ থেকে কাটা। বাঁ হাতের আঙুলে রয়েছে একটা আংটি। স্থানীয় যারা রুদ্রনাথবাবুকে দেখেছে, তারা সবাই এক বাক্যে জানাল, কঙ্কালটা রুদ্রনাথবাবুরই। ওই আংটি তাঁর আঙুলে সর্বদাই দেখা যেত। একই স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম আমিও।
খুনের কেস সন্দেহে ফের তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ। কিন্তু একটুও এগোতে পারেনি। অনেকদিন মনে হয়েছে, রুদ্রনাথবাবুর সেদিনের সেই গল্পের কথা পুলিশ দপ্তরে জানাব। কিন্তু আমি নিজেই সেদিন যা বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি তা কি অন্য কেউ বিশ্বাস করবে? তাই আর বলা হয়নি। সেই আংটি হয়তো এখনো পড়ে রয়েছে থানার মালখানার কোথাও। প্রমোদ কামলেদের ভগবান রুদ্রদেব তাই পুলিশ দপ্তরে আজও এক রহস্য।
…………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………