মাঠপথের অলৌকিকতা

মাঠপথের অলৌকিকতা

সকাল বেলা বউ এর সাথে ঝামেলা করে বেড়িয়েছিলাম অফিসে….ঝামেলা হবেনা নাকি..ভাত রান্না করতে করতে
৯.০০ টা বাজাবে। আর প্রত্যেকদিন কাজে যেতে গিয়ে লেট হয় আমার। আর এদিকে ধার করে ডুবে গেছি
বাজারে..এইজন্য কাজ থেকে ফিরে আবারো অন্য একটা কাজে যেতে হয় আমাকে..অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও
আমার টাকার অভাব পূরণ হয়ে যায়। যাইহোক দিন-টা ছিলো বুধবার..শীতের সন্ধ্যা..দুপুরে কাজ শেষ করে
আবারো অন্য জায়গাই কাজে চলে গেলাম….দিনে দুইবার দুই রুটের ট্রেন পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। তো যখন কাজ শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা দেবো তখন ট্রেন ধরে প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখি রাত তখন ৮.০০ টা বাজে.. দুইজায়গা কাজ করে আর এনার্জি পাইনা আমি, কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে লেপের তলায় ঢুকবো সেটাই
মাথায় চলতে থাকে। আর শরীর পেরেও উঠেনা। তো সেদিন কি মনে হলো বাড়ি যাওয়ার জন্য রেললাইন-টাকেই বেছে নিলাম। আর সেদিন আমার প্রচণ্ড ধকল গেছিলো..তো আমি লাইন ধরে হাঁটা শুরু করলাম। বেশিক্ষণ না….দুই মিনিট হাঁটা পথ তারপর এক নম্বর লাইনের পাশ থেকে রাস্তা বেড়িয়ে গেছে মাঠের দিকে। আর সেই মাঠ অনেক বড়ো। আশেপাশে বাড়িঘর নেই, অনেক দূরে আছে..অন্যদিন বাড়িঘর গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি কিছু কিছু বাড়িতে
আলো জ্বলে কিন্তু আজ দেখি জ্বলছেনা আলো। তারমানে এই শীত কালেও লোডশেডিং। আমি মাঠের রাস্তাটার দিকে নেমে গেলাম..এবার মাঠ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই একটা তীব্র পোড়া ও ভ্যাপসা গন্ধ আমার নাকে আসতে লাগলো..এই গন্ধ-টা অনেক-টা রেললাইন দিয়ে মাঝেমধ্যে পাই দুপুর বেলায়। আমি আস্তে আস্তে যতো এগোচ্ছি ততোই দেখি গন্ধ-টা তীব্র হচ্ছে। আমার দেহ-টা ধীরেধীরে ভারি হয়ে যাচ্ছে….এদিকে শীতকাল রাস্তায় জনমানব নেই..তারপর আশেপাশে বাড়িঘর তো দেখাই যাচ্ছেনা কুঁয়াশাই ভরে গেছে রাস্তা- টা। হঠাৎ একটা গোঙানির আওয়াজ শুনলাম পেছন থেকে ভেসে এলো..আমি মনের ভুল বলে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আবারো একটা গোঙানির আওয়াজ কানে এলো পেছন থেকে, এবার আমি স্পষ্ট শুনলাম একটা ভারি গলায় গোঙানির আওয়াজ পেলাম। আমি হাঁটা বন্ধ করে দিলাম। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো অজান্তেই….আমি আস্তে আস্তে করে ঘাড়-টা পেছনের দিকে ঘোরালাম, একসময় পুরো-টা পেছন ঘুরে দেখলাম
আমার থেকে ৬-৭ হাত দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে..চাঁদের আলোয় সবদিকে কুঁয়াশায় ঘেরা পরিবেশ সৃষ্টি হলেও সেই কুঁয়াশা কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক-টাকে ঢেকে দিতে পারেনি….কিরকম এক অদ্ভুত চাহনি দিয়ে আমার দিকে উনি তাকিয়ে আছেন….চাঁদের আলো-টা স্পষ্ট হওয়াই ওই লোক-টাকে পুরো পুরি ভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন..
আমি জিজ্ঞেস করলাম – কিছু বলবেন দাদা? বুকের ভেতর-
টা কেমন একটা ছ্যাঁত করে উঠলো।
ওই লোক-টা বললো – তোর টাকার দরকার তাইনা?
আমি মনে মনে ভেবে উঠতে পারছিনা, কি বলবো। আমি
বললাম – সে তো সব মানুষের-ই কমবেশি টাকার দরকার হয়,
আমার তো অনেক দেনা।
ওই লোক-টা বললো – তুই ভয় পাস।
আমি বললাম – আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন? বলুন তো?
উনি বললেন – এই রাস্তা দিয়েতো বাড়ি যাবি
তাইনা..যাসনা বাড়ি। আমার সাথে আই। আমাকে সাহায্য কর। আমি তোকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবো।

ওই লোক-টার গলা এতো মায়াবী ছিলো যে আমি ওনাকে আর না বলে থাকতে পারিনি। আমি উনার পেছন পেছন
অনুসরণ করে এগোতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, না যাচ্ছি কোনো প্রশ্ন করতে পাচ্ছিলাম না মনে হচ্ছিলো মুখ-টা
কেউ যেন চেপে রেখেছে। আর কুঁয়াশার মধ্যে ভালোভাবে দেখতেও পাচ্ছিলাম না। তবে আন্দাজ করতে পারছি এটা
একটা নদীর পারের সামনা সামনি কোনো জঙ্গল। হঠাৎ উনি বললেন আমাকে
– এই দেখ, এইঝোঁপের মধ্যে একটা বস্তা আটকে আছে..বস্তা-টা নিয়ে আয় আমার কাছে..আমি কোনো কথা
না বলে বস্তা-টা আনতে চলে গেলাম। তারপর আমার মাথায় এলো আমি কেন? এসব করছি..আমার এর পেছনে কি
স্বার্থ আছে..আমি চলে আসবো বলে ঠিক করলাম হঠাৎ কি যেন মনে হলো আমি বস্তা খোঁজার কাজে লেগে পড়লাম।
অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে জায়গার মধ্যে আমি বস্তা খুঁজছি। কিন্তু এতক্ষণ খোঁজার পর কিছুই পাচ্ছিনা..আর আমার টর্চ
লাইটে ব্যাটারিও শেষ হয়ে গিয়েছিলো তখন অন্ধকারে গরু খোঁজার মতন খুঁজেও কিছু না পেয়ে শেষমেশ যখন চলে
আসবো তখন দেখতে পেলাম চাঁদের আলোয় আবছা কুঁয়াশার ভেতর দিয়ে..সামনের গাছের ঝোঁপ গুলোর দিকে। ওখানে গিয়ে বেশ কিচ্ছুক্ষণ খুঁজলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। এইবার যেই আমি ওখান থেকে বেড়িয়ে আসবো। তখন
আমার পায়ের কাছে কিছু একটা বিঁধে যায়..আমি নীচু হয়ে দেখি এটা একয়া ইঁট। এই অন্ধকারে শীতের মধ্যে ইঁট
পেলাম তবুও বস্তা পেলাম না, রাগের চোটে ইঁট-টা তুলে ফেলতে যাবো তখন দেখি ইঁট-টা দঁড়িতে বাঁধা..আমি ওই ইঁট-
টা উঁচু করে ধরামাত্র দেখলা। আরও অন্য একটা ইঁট উঁচু হয়ে এলো, ইঁট গুলো যেন দঁড়ি দিয়ে সাজানো। একেবারে ওই দঁড়ির শেষ মাথা-টা একটা বস্তার কাছে গিয়ে বিঁধলো। আমি বস্তা-টা পেয়ে টেনে – হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলাম।

ওই লোক-টা তখনো দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো।
উনি আমাকে বললেন – তুই ভয় পাস না তো?
আমি বললাম কেন বলুন তো?
উনি বললেন – তুইযে কতবড়ো উপকার করলি বাপ
আমাকে..তোর কাছে ঋণী হয়ে থাকবো।
আমি – মানে? কি বলছেন।
উনি আনান্দে এবার কেঁদে ফেললেন, কাঁদো গলায় বলে
উঠলেন – আমার দুইছেলে, ছোটোছেলে প্রেম করে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে, আর বড়ো ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলাম নিজের দেখা পাত্রীর সাথে। ভেবেছিলাম বৌমা ভালো হবে..নাতিপুতির সাথে খেলা করে বাকি
জীবন-টা আনান্দে কাটিয়ে দেবো। উনি নিজের জামা-টা খুলে আমাকে ইশারা করে বললেন দেখ..নিজের ছেলেটা,
নিজের বাবাকে কিভাবে কুপিয়েছে দেখ। সারাজীবন কস্ট করে দুটো বাড়ি বানিয়েছিলাম। আমার বড়ো ছেলের বৌমা দিন-রাত অশান্তি করতো..ওই সম্পত্তির জন্য। আমি দুইছেলে কেই একটা একটা করে বাড়ি দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু বড়ো বৌমা দুটো বাড়িই নেবে। সেদিন তো বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলো। এর আগে আমাকে তো
হাতা-খুন্তি যাই পেতো মারতো সেদিন জানিস শিলনোড়া ছুঁড়ে মেরেছে। একটু থেমে উনি আবারো বললেন – এই
বস্তার ভেতর আমার লাশ আছে। ওরা আমাকে মেরে বস্তায় ভরে ইঁট চাপা দিয়ে গভীর রাতে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে
গেছে। আর এইদিকে কেউ আসেনা জানিস। আজ এক সপ্তাহ ধরে অনেক যন্ত্রণায় আছি। ভয় পাস না। এখানে কেউ
আসবেনা। আর তুই কোনো মিথ্যা কেসে ফাঁসবিনা। আমার কোমরে একটা সোনার চেন আছে, ওটা খুলে নিয়ে আমার লাশ-টাকে ভাসিয়ে দে নদীতে। জোয়ারের সময় প্রচণ্ড জলের স্রোতে এখানে আটকা পড়েছিলাম আমি
কয়েকদিন। তুই পাড়লে আমাকে ওই বস্তা থেকে বের করে মুক্তি দে। আর আমার ওই সোনার চেন ছাড়া আমার লুঙ্গির ভাঁজে আমার বউ এর এক জোড়া কানের দূল আছে, আমার বউ ওটা আমাকে দিয়ে বলেছিলো..তোমার যতো দুঃখ হোক বেচবেনা এটা, আমার বউ এর স্মৃতি এই দূল গুলো। তুই আমাকে মুক্ত কর তাড়াতাড়ি। এই উঠো, উঠো বলছি। আমার চোখ-টা দ্রুত খুলে যায়। আমি দেখি বিছানায় শুয়ে
আছি।

আমার বউ বললো – তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও..আমার ভাত, রান্না হয়ে গেছে। এইবলে ঘর থেকে চলে গেলো,
তারমানে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। ধরররর….এই বলে আমার ডান-হাত-টা দিয়ে মাথার চুল বোলাতে যাবো ওমনি দেখি আমার ডান হাতের মধ্যে এক জোরা কানের দূল, আর একটা সোনার চেন। আমি সাথেসাথে মোবাইল বের করে দেখলাম আজকের দিন-টা বৃহস্পতিবার। এটা কিভাবে সম্ভব, তারমানে কাল রাতে আমার সাথে কি হয়েছিলো..কেন হয়েছিলো..আর সবথেকে বড়ো কথা পুরো ব্যাপার-টা আমার মনে নেই কেন? আর যদি আমি স্বপ্নও দেখি তবে স্বপ্ন-টা এমন অর্ধেক কেন? আর আমার হাতের দূল জোড়া ও চেন-টা এর ব্যক্ষা?

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত