জনার্দন রায় এমন ঝামেলায় আগে পড়েননি। ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে নিরিবিলিতে অনেকটা জায়গা নিয়ে তাঁর অনাথ হোম ‘উৎসব’। নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হোমটির যথেষ্টই নামডাক। প্রচুর ডোনেশন আসে। বিদেশ থেকে মাঝে মধ্যেই আসেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সেই দৌলতে খ্যাতি রয়েছে বিদেশেও। রয়েছে উঁচু মহলেও যোগাযোগ।
তা চলছিল এই ভাবেই। সমস্যার শুরু বলা যায় হঠাৎ। প্রথমে বিদেশের এক পত্রিকায় ছোট এক খবর। তারই সূত্র ধরে কলকাতার প্রথম সারির পত্রিকা ‘সুপ্রভাত’–এর প্রথম পাতায় বড় এক নিউজ স্টোরি। তাতেই জনার্দন রায়ের কপালে গোটা কয়েক ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। খবর বের হয়েছে‚ গত এক মাসে নামী অনাথাশ্রম ‘উৎসব’ থেকে চারটি ছেলে নিরুদ্দেশ। তাদের শেষেরটির নাম অনাথ। নিখোঁজ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। বয়স মাত্রই আট বছর।
যে কোনও হোমে এমন ব্যাপার বড় ভয়ানক। বিশেষ করে ‘উৎসব’–এর মতো নামী অনাথাশ্রমের জন্য। তাই জনার্দন রায়কে হুঁশিয়ার থাকতে হয়। এমন ঘটলে সাথে সাথে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা। থানায় নিখোঁজ ডায়েরিই শুধু নয়‚ খবরটা যাতে পাঁচকান না হয়‚ নিতে হয় সেই ব্যবস্থাও। আসলে এত বড় একটা হোম। নয় নয় করেও শ’দেড়েক নানা বয়সের ছেলে। তাদের স্বভাব–চরিত্রও সমান নয়। পুলিশ তো পৌঁছে দিয়েই খালাস। তারপর তাদের সামলে রাখা সহজ কাজ নয়! চারদিকে উঁচু পাঁচিল। গেটে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা। তবু মাঝে মধ্যেই এমন ঘটে যায়। সব দিক সামাল দিতে জনার্দনবাবুর কাজ বাড়ে তখন। ব্যতিক্রম হয়নি এবারেও। সব ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন। কিন্তু কী করে যে খবরটা বাইরে পাচার হয়ে গেল‚ বিশেষ করে বিদেশে‚জনার্দন রায়ের কাছে সেটাই এক রহস্য।
হোমে কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়। তাদের কয়েকজনকে নিজের কাজের বাইরেও ছেলেদের উপর গোপনে নজর রাখতে বলা আছে। এজন্য অতিরিক্ত মাইনের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিছু অন্যরকম মনে হলেই সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর জনার্দনবাবুর কানে পৌঁছে দেয় তারা। শেষ ঘটনাটির পরে যে কয়টি নাম তাঁর কানে এসে পৌঁছেছে‚ তার প্রথমেই রয়েছে রামু ওরফে রামচন্দ্র পাল ছেলেটা। আশ্রমের সবাই রামু বলেই ডাকে। বছর কয়েক আছে এই আশ্রমে। অন্য কেউ হলে জনার্দনবাবুর হাত থেকে সহজে ছাড়া মিলত না। কিন্তু রামু বলেই বেশি দূর এগোতে পারেননি।
আসলে রামু ছেলেটার কিছু অন্য গুণ আছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি ছিল ওদের। বাবা–মা মাটির প্রতিমা গড়ত। ছোট হলেও রামুও তাতে বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছিল। তারপর গত আয়লার বানে ভেসে গিয়েছিল ওদের গ্রাম। রামুকে নিয়ে ওর বাবা–মা পাড়ি দিয়েছিল কলকাতায়। গঙ্গায় ভাঁটার সময় মহাজনের নৌকোয় কুমোরটুলির প্রতিমার জন্য মাটি কাটার কাজে লেগেছিল।
কাজটা সহজ নয়। ভাল মানের এঁটেল মাটি জমা হয় মাঝ–গঙ্গার চড়ায়। ভাটায় জল সরে চর জেগে উঠলে ঘণ্টা দুয়েক সময় মেলে মাটি কাটার। সময় কম। দ্রুত মাটি কেটে জমা করতে হয় নৌকোয়। অন্য দিকে হুঁশ থাকে না। সেবার বর্ষার অমাবস্যার রাতে মহাজনের ডিঙি-নৌকো নিয়ে মাঝ গঙ্গার চরে বাবা–মা সেই কাজে গিয়েছিল। রামুও ছিল সঙ্গে। অথচ সেই রাতে গঙ্গায় বান আসার হুঁশিয়ারি ছিল। সামনেই পুজো‚ কুমারটুলিতে প্রতিমা গড়ার মাটির চাহিদা তুঙ্গে। মহাজন তাই চেপে গিয়েছিল ব্যাপারটা। ওরাও জানতে পারেনি। তারপর যা ঘটবার তাই ঘটেছিল। রাতের অন্ধকারে আচমকা সেই বানে ভেসে গিয়েছিল সবাই। কপালজোরে পাশ দিয়ে ভেসে যেতে দেখে এক নৌকো তুলে নিয়েছিল রামুকে। পরে বাবা–মার দেহ দুটোই শুধু মিলেছিল।
কাগজে তাই নিয়ে দিন কয়েক হইচই হয়েছিল। তারপর থিতিয়ে যেতেও দেরি হয়নি। মহাজনের টিকিও ছুঁতে পারেনি কেউ। অনাথ রামুকে পুলিশ তুলে দিয়ে গিয়েছিল এই হোমে।
শান্ত স্বভাবের ছেলেটির যে অন্য গুণ আছে‚ তা টের পাওয়া গিয়েছিল অল্প দিনের মধ্যেই। চমৎকার পুতুল গড়তে পারে ছেলেটা। অসাধারণ হাতের কাজ। ইদানীং দেশ–বিদেশে অনাথাশ্রম ‘উৎসব’–এর খ্যাতির আরও একটা কারণ এই রামুর হাতের কাজ। হোমের অফিস ঘরের সাজানো রয়েছে রামুর হাতে গড়া বেশ কয়েকটি পুতুল। কেউ এলে জনার্দনবাবু তাঁদের সেসব দেখান। মুগ্ধ হয়ে তাঁদের অনেকে সাগ্রহে তার কিছু সংগ্রহ করে নিয়ে যান। কাগজে ছাপা হয়। হোমের খ্যাতি বাড়ে।
এই সময় একবার এক ব্যাপার হয়েছিল। বিদেশ থেকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর অফিসে এসেছিলেন। ভদ্রলোক আসবেন বলেই রামুর সাম্প্রতিক একটি কাজ তিনি টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দাঁড়ে বসা একটি প্রমাণ আকারের টিয়া পাখি। সামনে বাটিতে গুটি কয়েক ভিজে ছোলা। ভিজে ছোলা তো বটেই‚ এমনকি টিয়া পাখিটাও যেন জীবন্ত‚ এখনই নড়ে উঠবে‚ এমন নিখুঁত। একবাক্যে প্রশংসা করেছেন সবাই। বড় এক দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় সেই পাখির ছবিও ছাপা হয়েছিল। ভদ্রলোককে বসিয়ে কী কাজে সামান্য পাশের ঘরে গিয়েছিলেন। মিনিট কয়েক পরে ফিরে এসে দেখেন তিনি গুম হয়ে বসে আছেন। জনার্দনবাবু ঘরে ঢুকতেই বিরক্ত হয়ে বললেন‚ ‘ম্যান‚ এমন রসিকতা তোমার না করলেও চলত।’
‘ক–কেন‚ স্যার?’ থতমত খেয়ে জনার্দনবাবু বললেন।
‘তুমি একটা জ্যান্ত পাখি টেবিলে ওইভাবে রেখে গেছ! হাত বাড়াতেই উড়ে পালিয়ে গেল!’
ভদ্রলোকের ওই কথায় সেই মুহূর্তে কোনও উত্তর জোগায়নি জনার্দনবাবুর মুখে। তাকিয়ে দেখলেন টেবিলে দাঁড় খালি। ভিজে ছোলার বটি তেমনই রয়েছে। শুধু টিয়া পাখিটা নেই। অন্য কেউ হলে হয়তো তখনই সার্চ করতেন তাঁকে। সঙ্গের ব্যাগ। ব্যাটা ধাপ্পা দেবার জায়গা পায়নি! সন্দেহ নেই‚ চমৎকার পাখিটা দেখে লোভ সামলাতে পারেননি। গায়েব করে ফেলেছেন। কিন্তু একে ফরেনার‚ তায় বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাই কিছুই করতে পারেননি। ভদ্রলোকের কথায় সায় দিয়ে সামান্য মাথা নেড়েছিলেন মাত্র। সেই থেকে অফিসে কেউ এলে সতর্ক থাকেন।
এহেন রামুর উপর ব্যবস্থা নেওয়া জনার্দন রায়ের পক্ষে যে সহজ নয়‚ তা বলাই বাহুল্য। বাইরের অনেক কাগজ থেকেই রিপোর্টার আসেন। তাঁদের অনেকেই কখনো কথা বলেন রামুর সঙ্গে। সুতরাং খবরটা রামুর মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। তাই কয়েক দিন কৌশলে নানাভাবে বাজিয়ে দেখেছেন ছেলেটাকে। কিন্তু তেমন কিছুই পাননি। তবু চেষ্টা ছাড়েননি। কোথা দিয়ে খবরটা বাইরে পাচার হল‚ সেটা গোড়াতেই জানা দরকার। ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। আগে সপ্তাহে এক আধ দিন রাউন্ডে বেরুতেন। এখন প্রতিদিনই করছেন কাজটা। তারই ফাঁকে মাঝে মধ্যেই চোখ বুলিয়ে যান রামুর উপর।
সেদিন এমনই রাউন্ডে বের হয়েছেন‚ রামুর খুপরির ভেজানো দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন‚ ছেলেটা অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে কী বকতে বকতে ঝুঁকে পড়ে মাটি দিয়ে কিছু করছে। সন্তর্পণে দরজা সামান্য ফাঁক করে শোনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারলেন না। শেষে নিরাশ হয়ে বললেন‚ ‘ওটা কী করছিস রে?’
রামু যখন পুতুল গড়ার কাজ করে‚ বাহ্যজ্ঞান থাকে না। আজও ছিল না। জনার্দন রায়ের কথায় ধড়মড়িয়ে উঠলেও সামলে নিল মুহূর্তে। ‘তেমন কিছু নয় বাবু। নতুন একটা পুতুল।’
‘সে তো গত দু’দিন ধরেই দেখছি। শুধু মাটিই ঘেঁটে যাচ্ছিস!’
‘কী করব বাবু।’ রামুর মুখ আরও কাঁচুমাচু‚ ‘নতুন কিছু করার ইচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না যে!’
‘না–না‚ সেজন্য ব্যস্ত হবার দরকার নেই।’ জনার্দনবাবু মাথা নাড়লেন‚ ‘সেবার দাঁড়ে বসা টিয়াপাখি তৈরির সময়তেও তোকে এমন দেখেছিলাম। পাখিটা দারুণ হয়েছিল রে। তোকে বলিনি। অনেকেরই লোভ ছিল ওটার উপর। শেষে হতচ্ছাড়া এক সাহেব চুরি করে কেটে পড়ল। তা তেমনই কিছু কর না।’
‘তেমন একটা টিয়াপাখি করব বাবু?’
‘করতে পারিস। তবে নতুন কিছু করলেই ভাল হয়। আরও দারুণ। দেখে সবার তাক লেগে যাবে। তা হ্যাঁ রে রামু‚’ সামান্য ইতস্তত করে জনার্দনবাবু বললেন‚ ‘বিড়বিড় করে সমানে কী বকছিলি রে?’
‘বিড়বিড় করছিলাম!’ রামু অবাক হয়ে সামনে জনার্দনবাবুর দিকে তাকাল‚ ‘কখন বাবু?’
রামুর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও থই পেলেন না জনার্দন রায়। তবে হাল ছাড়লেন না‚‘হ্যাঁ রে রামু‚ অনাথের কথা খুব মনে পড়ে তাই না?’
‘তা পড়ে বাবু।’ রামুর দুই চোখ হঠাৎ ছলছল হয়ে উঠল। মুছে নিল জামার হাতায়।
হোম থেকে সর্বশেষ নিখোঁজ এই অনাথ ছেলেটা। দু’জনের বেজায় ভাব ছিল। সারাদিন অনেকটা সময় একসাথে কাটত। মন খারাপ হবারই কথা। রামুর সেই মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে জনার্দনবাবু বললেন‚ ‘তোদের দু’জনকে প্রায়ই একসাথে দেখতাম। কিছু বলত না?’
‘বলত তো বাবু।’
‘কী বলতো রে?’ জনার্দন রায়ের গলা প্রায় খাদে নেমে এল।
‘বলতো নিজের বাবা–মার কথা। আমার বাবা–মার মতো ওরাও গঙ্গার চড়ায় প্রতিমা তৈরির মাটি কাটত। আমার বাবা–মার মতো ওরাও ভেসে গিয়েছিল গঙ্গার বানে। কী কাণ্ড দেখুন‚শেষে কিনা একই অনাথ হোমে ঠাঁই হল দু’জনের! অনাথ যে এভাবে পালিয়ে যাবে একবারও যদি বলত!’
‘পেটে বদ বুদ্ধি থাকলে কী আর বলে রে।’ জনার্দন রায়ের কুঁচকে ওঠা ভুরু কিছুটা যেন স্বাভাবিক হল এবার। ‘যাকগে‚ অনাথের কথা ভেবে অকারণ আর মন খারাপ করিসনি। বরং একটা খবর দেই। দারুণ খবর।’
‘কী খবর বাবু?’
‘এই হোমে তোকে বোধহয় বেশিদিন আর থাকতে হবে না? খুব চেষ্টা করছি তোর জন্য একটা ভাল ব্যবস্থা করার। যা হাতের কাজ তোর‚ ভাল কোথাও একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে আর ভাবতে হবে না।’
রামুর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল সেই কথায়। মুখে কথা যোগাল না। জনার্দনবাবু অবশ্য অপেক্ষা করলেন না। রামুর পিঠটা সামান্য চাপড়ে দিয়ে বের হয়ে পড়লেন নিজের অফিসের দিকে। মানুষটির মাথায় একরাশ চিন্তা তখন সমানে পাক খেয়ে চলেছে।
আজ রামুর সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছেন‚ আর দেরি করা যাবে না। ব্যবস্থা একটা নিতেই হবে। খুব দ্রুত। কিন্তু কী সেই ব্যবস্থা‚ সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। রামুকে আসল কথা বলেননি তিনি। ক্রাফটস অ্যাকাডেমি অফ ইন্ডিয়া অনেক দিন আগেই জানিয়েছে‚ তারা রামুর দায়িত্ব নিতে চায়। তিনিই নানা অছিলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। রামুকে সেখানেই পাঠিয়ে দেবেন‚ না অন্য কোথাও‚ গভীরভাবে তাই ভাবছিলেন।
কিন্তু মনস্থির করার আগেই অন্য এক ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হল। অফিসে পৌঁছেই শুনলেন‚ আগামী কাল পুলিশ অফিসার রণেন গুহ হোমে আসছেন। দেখা করতে চান তাঁর সঙ্গে।
খোদ পুলিশ কমিশনার বা মিনিস্টার আসছেন শুনলেও জনার্দন রায় এতটা ব্যস্ত হতেন না। রণেন গুহ লালবাজারে ডিডি সেকশনে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। পদমর্যাদায় বিরাট কিছু না হলেও সেকশনে প্রতিপত্তি যথেষ্ট। কাজের মানুষ বলে খ্যাতি আছে। খোদ সি.এম নিজেও নানা সময় ডেকে পাঠান। এহেন ব্যক্তি হঠাৎ তাঁর হোমে আসছেন‚ ব্যস্ত হবারই কথা। খবরটা শুনেই জনার্দন রায় অন্য কিছু আর ভাবার সময় পাননি।
পরের দিন রণেন গুহ যথাসময়েই হোমে এসে পৌঁছুলেন। এসব ব্যাপারে তিনি সময়ের নড়চড় করেন না। তবে জনার্দন রায় তৈরি হয়েই ছিলেন। গাড়ি থেকে নামতেই ব্যস্ত হয়ে যথাযোগ্য সমাদরে নিজের অফিস ঘরে এনে বসালেন।
ঝকঝকে সোফাসেট। দামি পর্দায় সাজানো ঘর। মস্ত টেবিলে ঝকঝকে প্লেটে রকমারি খাবার। ফিস ফ্রাই। ছুরি‚ কাঁটা–চামচসহ প্লেট ভরতি মস্ত এক কবিরাজি কাটলেট। রকমারি মিষ্টি। সেদিকে তাকিয়ে রণেন গুহ প্রায় হাঁ–হাঁ করে উঠলেন।
‘এ কী করেছেন মি. রায়! এসব কিন্তু একেবারেই পছন্দ করি না আমি। সামান্য কাজে এসেছি। দু’চার মিনিটে শেষ করে চলে যাব। কাজ রয়েছে আরও কয়েক জায়গায়। এখনই সরিয়ে নিন ওগুলো।’
জনার্দন রায় বেকুব নন। কোন দেবতা কিসে তুষ্ট‚ ভালই জানেন। জিব কেটে হা–হা করে হাসলেন। ‘জানি‚ স্যার। ওগুলো কিন্তু খাবার জন্য নয়। সব মাটির তৈরি।’
‘বলেন কী! জনার্দনবাবুর কথায় পুলিশ অফিসার রণেন গুহ প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন। ‘এ তো দারুণ হাতের কাজ মশাই! পেলেন কোথায়?’ সামনে টেবিলের দিকে তাকিয়ে চকচক করে উঠল তাঁর চোখ দুটো।’
‘তা বলতে পারেন‚ স্যার।’ জনার্দন রায় বিগলিত। ‘আপনার জন্যই আনিয়ে রেখেছি। তবে দোকানের জিনিস নয়। আমাদের এই হোমেই তৈরি। কষ্ট করে এলেন। হোমের তরফ থেকে সামান্য উপহার। না নিলে দুঃখ পাব স্যার।’
‘আপনার হোমে…!’ বলতে–বলতে পুলিশ অফিসার রণেন গুহ থেমে গেলেন হঠাৎ। ‘ও হো! তাই বলুন! কী নাম যেন ছেলেটার?’
পুলিশ অফিসার রণেন গুহর কী উদ্দেশ্যে এখানে আসা‚ বুঝতে বাকি থাকেনি জনার্দন রায়ের। অনেক ভেবেই ব্যবস্থাটা করেছিলেন। খোঁজ নিয়েছেন‚ রণেন গুহর গৃহিণীর এসব জিনিস দিয়ে ঘর সাজাবার শখ। একগাল হেসে বললেন‚ ‘আজ্ঞে স্যার রামু। রামচন্দ্র পাল।’
‘হ্যাঁ‚ মনে পড়েছে। তা একবার ডাকুন দেখি। এলামই যখন‚ কথা বলে যাই।’ রণেন গুহ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ‘নাহ্‚ আজ থাক বরং। হাতে একেবারেই সময় নেই!’
‘ভাববেন না স্যার। রামুকে বলেই রেখেছি‚ এসে পড়বে এখনি। আসলে গত দু’দিন ধরে নতুন এক পুতুল নিয়ে খুব ব্যস্ত রয়েছে। আপনি আসবেন শুনে ওকে বলে রেখেছি‚ স্যার আসার আগেই যেন তৈরি করে রাখে। স্যারের জন্য বড় এক সারপ্রাইজ। তা খানিক আগেও দেখে এসেছি‚ প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। রং চাপানোর কাজ চলছে।’
‘আমি কিন্তু মি. রায়‚ বেশি দেরি করতে পারব না। অনেক কাজ রয়েছে।’
‘খুব দেরি হবে না‚ স্যার।’ ভিতরের খুশি যথাসম্ভব দমন করে জনার্দন রায় কাউকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিলেন‚ ‘ওরে‚ স্যারের পুতুলগুলো ভাল করে প্যাক করে দে। আর রামুকেও তাড়াতাড়ি আসতে বল। সময় নেই ওনার।’
সত্যিই বেশি দেরি হল না রামুর। মিনিট তিনেকের মধ্যেই হাজির হল ঘরে। হাতে মাটির তৈরি বড় এক কাঁকড়াবিছে। বাঁকানো লেজটা মাথার উপর খাঁড়া হয়ে রয়েছে। আলতো করে রামু সেই কাঁকড়াবিছে সবে রণেন গুহর সামনে টেবিলের উপর নামিয়ে দিয়েছে‚ আতঙ্কে চেয়ার সহ প্রায় ছিটকে উঠলেন তিনি। জিনিসটা যে মাটির তৈরি পুতুল‚ সত্যিকারের কাঁকড়া বিছে নয়‚ হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই। পুলিশ অফিসারকে তাই দোষ দেওয়া যায় না।
রণেন গুহর অবস্থা দেখে ভালই মজা পেলেন জনার্দন রায়। কোনও কথা না বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন কাঁকড়াবিছেটার লেজের দিকে। উদ্দেশ্য‚ পুলিশ অফিসারের ভয় ভাঙ্গিয়ে ফের একটু মজা করবেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলেন না। হাত কাছে নিতেই এক অদ্ভূত ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ যেন নড়ে উঠল কাঁকড়াবিছেটার লেজ। মুহূর্তে তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ডগায় কাঁকড়াবিছেটা নিমেষে হুল ফুটিয়ে দিয়েছে।
অদ্ভূত এই ঘটনায় দু’চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে জনার্দন রায় তাকিয়ে ছিলেন টেবিলে কাঁকড়াবিছেটার দিকে। তীক্ষ্ণ হুলসহ লেজটা এখন স্থির। প্রাণ রয়েছে কিনা বোঝার উপায় নেই। পুলিশ অফিসার রণেন গুহ ধীর গলায় বললেন‚ ‘ওটা কিন্তু পুতুল নয় জনার্দনবাবু। দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম এক আফ্রিকান কাঁকড়াবিছে। একবার হুল ফোটালে আর রেহাই নেই। আপনার আক্রান্ত বুড়ো আঙুলটা কিন্তু কেটে বাদ দিতে হবে।’
হতভম্ব জনার্দনবাবুর মুখ দিয়ে কোনও শব্দই বের হল না। হেঁচকি তুলে দুই চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইলেন শুধু‚ ‘আঁ।’
‘হ্যাঁ জনার্দনবাবু।’ ঠাণ্ডা হিমশীতল কণ্ঠ রণেন গুহর‚ ‘শুধু তাই নয়। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রথম অ্যান্টি ভেনম ইনজেকশন পুশ না করলে তিলে তিলে মৃত্যু হবে আপনার। পচে ফুলে উঠবে সারা শরীর। তারপর…।’
‘প্লিজ স্যার‚ বাঁচান আমাকে। এখুনি হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করুন। আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলেন জনার্দন রায়।’
রণেন গুহ অবশ্য কান দিলেন না। পকেট থেকে মুখ খোলা মাঝারি আকারের একটা কালো রঙের প্লাস্টিকের কৌটো বের করলেন। তারপর কৌটোটা উলটে ধরে খোলা মুখ দিয়ে সাবধানে কাঁকড়াবিছেটাকে ঢাকা দিয়ে বললেন‚ ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় মি. রায়। তবে চিন্তার কারণ নেই। হাজার হোক পুলিশ অফিসার তো। হরেক ঝক্কি নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই সাধারণ একটা অ্যান্টিভেনামের একটা ডোজ আমার সঙ্গেই থাকে।’ বলতে–বলতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ আর একটা অ্যাম্পুল বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। ‘কিন্তু তার আগে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাই। আমাদের কাছে খবর আছে‚ কয়েকদিন আগে এই হোমেই অনাথ নামে একটা ছেলেকে খুন করেছেন আপনি। লাশ গায়েব করা হয়েছে। চাইলে আগেই আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারতাম। কিন্তু আপনার মতো মানুষের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা সহজ হবে না জেনেই সেই পথে যাইনি।’
‘মিথ্যে কথা‚ মিথ্যে কথা!’ ওই অবস্থার মধ্যেও জনার্দনবাবু চিৎকার করে উঠলেন। তারপর মুহূর্তে মিইয়ে গিয়ে বললেন‚ ‘প্লিজ‚ প্লিজ স্যার‚ আগে আমার প্রাণটা বাঁচান।’
‘কিন্তু তার আগে যে সত্যি কথাটা শুনতে চাই আপনার মুখ থেকে।’ জনার্দন রায়ের আক্রান্ত আঙুলের প্রথম পর্ব ইতিমধ্যে ফুলে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে ফের হিমশীতল কণ্ঠ কমিশনারের।’
‘সত্যি কথাই তো বলছি স্যার। অনাথকে খুন করে আমার স্বার্থ কী? ওরা আমার নিজের সন্তানের মতো। বিশ্বাস না হয়‚ ওদেরই জিজ্ঞেস করুন।’
‘না—আ—আ—আ।’ জনার্দন রায় থামতেই পাশে দাঁড়িয়ে রামু প্রায় চিৎকার করে উঠল।‘একটুও ঠিক বলছেন না বাবু। সব মিথ্যে। হোমের ছেলেদের সবদিন পেট ভরে খেতেও দেওয়া হয় না। মারধোরও করেন। সুযোগ পেলে অনেকেই তাই পালিয়ে যায়। সেদিন দুপুরে অনাথকে দিয়ে আপনি গা–হাত–পা টেপাচ্ছিলেন। বেচারা তাই করতে করতে ঘুমে ঢলে পড়েছিল। রেগে লাথি মেরেছিলেন ওকে। সেই লাথি খেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়েছিল ও। বেচারার নাক–মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল। ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। অনাথকে তারপর আর দেখতে পাইনি। ঠিক কিনা বলুন বাবু?’
‘তুই—তুই বেইমান! মিথ্যে কথা বলছিস!’ দারুণ যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে চিৎকার করে উঠলেন জনার্দনবাবু।
‘তাহলে এইভাবেই আপনি সময় নষ্ট করতে চাইছেন!’ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার রণেন গুহর হিমশীতল কণ্ঠ। ‘তিন মিনিট কিন্তু পার হয়ে গেছে। প্রাণে বাঁচার জন্য আপনার হাতে সময় মাত্রই আর দুই মিনিটের মতো।’
ইতিমধ্যে জনার্দনবাবুর ডান হাতের বুড়ো আঙুল ভয়ানক ফুলে উঠেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা। তাকিয়ে দেখলেন উলটো দিকে বসে রণেন গুহ হাতে অ্যাম্পুলটা নিয়ে মুখটা ভাঙলেন। সিরিঞ্জে ওষুধটা টেনে নিয়ে মুখ তুলতেই জনার্দনবাবু আগ্রহে বাড়িয়ে দিলেন হাতটা। ‘বাঁচান‚স্যার। বাঁচান আমাকে।’
‘বাঁচাতে চাই বলেই তো সিরিঞ্জটা রেডি করে নিলাম।’ রণেন গুহ বললেন‚ ‘হাতে সময় কিন্তু একদমই নেই। লাশটা কোথায় গায়েব করেছেন‚ বলে দিলেই আপাতত বাঁচার সুযোগটা পাবেন।’
‘বলছি‚ বলছি।’ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে জনার্দনবাবু বললেন। ‘লাশটা সেই রাতে ফেলে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। এবার স্যার‚ আপনার কথা রাখুন।’
‘চিন্তা নেই।’ রণেন গুহ বললেন‚ ‘হাতে কয়েক সেকেন্ড সময় এখনো আছে। তাহলে স্বীকার করছেন‚ অনাথ ছেলেটাকে আপনিই খুন করেছেন?’
‘স্বীকার করছি। স্বীকার করছি‚ স্যার‚ খুন করেছিলাম ওকে। দুপুরে হাত–পা টেপাতাম ছেলেটাকে দিয়ে। প্রায় দিনই ফাঁকি দিত। সেদিন আর রাগ সামলাতে পারিনি। বুকে লাথি কশিয়ে দিয়েছিলাম। হতভাগা সামলাতে পারেনি। দেওয়ালেও ঠুকে গিয়েছিল মাথা।’ অল্প থামলেন জনার্দনবাবু। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন‚ ‘এবার‚ এবার আপনার কথা রাখুন স্যার।’
প্রত্যুত্তরে রণেন গুহ উঠে দাঁড়িয়ে অল্প হাসলেন। ‘বাহ্‚ এই কথাটা আগে বললে এতটা সময় নষ্ট করতে হত না।’ বলতে–বলতে হাতের ওষুধ সমেত সিরিঞ্জটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন তিনি।’
‘ও—ও কী করলেন‚ স্যার!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন জনার্দন রায়।
‘তেমন কিছু নয় জনার্দনবাবু। আসলে সিরিঞ্জে অ্যান্টিভেনম নয়‚ ছিল নির্ভেজাল ডিসটিলড্ ওয়াটার।’ কথা শেষ করে মুচকি হাসলেন রণেন গুহ। টেবিলে ওলটানো কালো রঙের কৌটোটা হঠাৎই তুলে ফেললেন। নীচের কাঁকড়াবিছেটা সেই আগের মতোই স্থির। পুলিশ অফিসার রণেন গুহ এবার সেটার লেজ ধরে খানিক উঁচুতে ছুঁড়ে দিতেই সশব্দে টেবিলের উপর পড়ে দু’টুকরো হয়ে ভেঙে গেল।
বিস্মিত জনার্দনবাবু হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। সেদিকে এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে রণেন গুহ বললেন‚ ‘সেদিন বিদেশি সাহেব বোধ হয় নাটক করেননি। রামুর পুতুলের কিছু ব্যাপার আজ নিজের চোখেই তো দেখতে পেলেন! সামান্য নাটক বরং আমাকেই করতে হয়েছে। নইলে আপনার মতো স্বনামধন্য ব্যক্তির স্বীকারোক্তি আদায় এত সহজ হত না। আপনার হাত তো আবার হাই লেভেলে অনেক দূর লম্বা।’
প্রায় বজ্রাহতের মতো জনার্দন রায় কয়েক মুহূর্ত থম মেরে রইলেন। ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল মুখের ভাব। চোখ কটমট করে একবার রামু তারপর পুলিশ অফিসার রণেন গুহর দিকে তাকালেন। দু’চোখের দৃষ্টি তখন আহত বাঘের মতো। দাঁত কড়মড় করে বললেন‚ ‘লাশ না পেলে আপনাদের এই নাটকের এক বিন্দু মূল্য নেই‚ স্যার। বড়ো জোর দু’এক মাস হাজতে আটকে রাখতে পারবেন।’
‘মূল্য আছে জনার্দনবাবু।’ রণেন গুহ ফের হাসলেন‚ ‘লাশ গঙ্গায় নয়‚ সেই রাতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল এই হোমের ভিতর বাগানে। ইচ্ছে ছিল‚ পরে গঙ্গায় ফেলে দেবার। কিন্তু পুলিশ গোপনে হোমের উপর নজর রেখেছে বুঝে সেই সুযোগ আর হয়নি। যে কর্মচারীদের দিয়ে কাজটা করিয়েছিলেন‚ তাদের একজন আমাদের কাছে স্বীকারও করেছে। তবে ইচ্ছে করেই কাউকে এখনো অ্যারেস্ট করিনি। সুতরাং ছাড়া আপনি পাচ্ছেন না।’
দরজার বাইরে ইতিমধ্যে দু’জন উর্দিপরা পুলিশ এসে হাজির হয়েছে। পুলিশ অফিসার রণেন গুহ থামতেই তারা ঘরে ঢুকে জনার্দনবাবুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।