মৃত্যুচ্ছেদ

মৃত্যুচ্ছেদ

লাইয়া ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশন করছে। একটু পরেই সাবাব খেতে আসবে। খেতে বসে সব ঠিকঠাক না থাকলে আবার রেগে যাবে। তারপর আবার আজ শুক্রবার। আজকে এমনিতেই সাবাবের রাগ বেশি থাকবে। বিয়ের পরদিন থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। তার অবশ্য একটা অদ্ভূত কারণও আছে। সাবাবের মুখে শোনেছে কিন্তু লাইয়া বিশ্বাস করতে পারে না। লাইয়া আর সাবাব এর বিয়ে হয়েছিল গতবছর ফেব্রুয়ারী মাসের সাতাশ তারিখ। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। সেই যে বিয়ের পরে এ বাসায় আসা এরপর আর বাবার বাড়ি যেতে পারেনি লাইয়া। মফস্বলের ছয়তলা বাড়িটার পাঁচতলায় তাদের একটা ছোটখাটো ফ্লাট। সাবাব একটা সরকারী চাকুরী করে। আর লাইয়া সাংসারিক জীবনে অভস্ত্য হতেই ব্যস্ত। বেশ ভালোই চলছে তাদের জীবন।

সাবাব ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বিড়বিড় করে মেয়েটিকে ডেকে যাচ্ছে আর মেয়েটির জন্যে অপেক্ষা করছে। যদিও সে জানে একটু পরেই তার সাথে কি ঘটবে তবুও ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। একটানা সে মেয়েটিকে ডেকেই চলছে। – আমি এসে গেছি। (ভারী একটা কন্ঠ শুনতে পেল সাবাব) — কেন আসো তুমি? – তুমিই তো ডাকো। — আমি ডাকলেও আর আসবা না। – আচ্ছা! এবার আমাকে বিদেয় কর। বলেই মেয়েটি সাবাবের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। এবার সাবাব আগের মতই মেয়েটির গলা টিপতে শুরু করল। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে মেয়েটির গলা টিপেই চলছে। মেয়েটিও কিছু বলছে না। তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। সারা শরীর ঘেমে যেতে লাগলো। এবার সাবাব পকেট থেকে তার ছ’ ইঞ্চি ছুরিটা বের করেই এলোপাথারি মেয়েটার ঘাড়ে-গলায় অনেকগুলো আঘাত করলো। সাবাবের হাত রক্তে লাল হয়ে গেছে। কিছু রক্ত তার পরনে থাকা পাঞ্জাবীতে ছিটকে পড়লো। মেয়েটির নি:শ্বাস বন্ধ হওয়ার পরেই সাবাব মেয়েটিকে ছাদ থেকে ফেলে দিল। ছুরিটা পাঞ্জাবীর পকেটে রেখে সাবাব ছাদ থেকে নামতে লাগলো। সাবাব রক্তবর্ণ চোখ আর রক্তাক্ত হাত নিয়ে ঘরে ঢুকল। সাবাবকে দেখে লাইয়া চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। সাবাবকে এ অবস্থায় গত এক বছর প্রতি শুক্রবারে দেখতে দেখতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে লাইয়ার।

আজ বৃহস্পতিবার। কাল ফেব্রুয়ারীর সাতাশ তারিখ। মানে সাবাব-লাইয়া’র প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কালকের দিনে ছোট একটা পার্টির আয়োজন করছে ওরা। লাইয়ার বাবা-মাও আসবে কাল। এই নিয়ে লাইয়া খুব ব্যস্ত। একা হাতে বাসার সব কাজ করতে হচ্ছে তাকে। কালকের দিনটা নিয়ে লাইয়ার আনন্দের চেয়ে চিন্তাই হচ্ছে বেশি। কারণ, কাল শুক্রবার। আর কাল যদি সাবাব আগের শুক্রবারগুলোর মত কান্ড ঘটিয়ে বসে তাহলে তো সব শেষ। এমন কান্ডের কথা তো আর সবাইকে বলা যায় না। আর বললেও সবাই পাগল ছাড়া কিছু বলবে না। এই ব্যাপার নিয়ে সাবাবের সাথে গত কয়েকদিন ধরেই কথা কাটাকাটি চলছে লাইয়ার। লাইয়ার কথা সাবাব শুক্রবার ছাদে যেতে পারবে না। আর যদি শুক্রবারে ছাদে যায় তাহলে লাইয়াও সাথে যাবে। নিজের চোখে দেখতে চায় আসলে সাবাব যা বলে তা ঠিক কিনা। সাবাব বলে সে নাকি ইচ্ছে করে ছাদে যায় না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়াও হয়ে গেছে অনেকবার। লাইয়া তো কয়েকবার বিচ্ছেদ হওয়ার হুমকিও দেয়। তবে তা আর করা হয় নি। লাইয়া নিজের নামের মতই ধৈর্যশীলা। কিন্তু আর না! কালকের মত বিশেষ একটা দিনে যদি সাবাব ছাদে যায় তাহলে সোজা বিচ্ছেদ। মনে মনে এমনটাই সিদ্ধান্ত নেয় লাইয়া।

শুক্রবার সন্ধ্যা। লাইয়ার বাবা-মা এসে গেছেন বিকেলেই। সাবাবের কলিগরা আসতে শুরু করেছেন। লাইয়া-সাবাব একসাথেই আছে। লাইয়া সাবাবকে চোখে চোখে রাখছে। এক মুহূর্তের জন্যেও সে সাবাবকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না। তবে সাবাব সুযোগ খোঁজছে কিভাবে লাইয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে যেতে পারে। একবার সুযোগ পেতেই সাবাব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি ছাদে চলে গেল সাবাব। একটু পরেই লাইয়া খেয়াল করল সাবাব ঘরে নেই। সেও তার কথামতই ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে দেখল সত্যিই সাবাব অন্ধকারে কাকে যেন ডাকছে। লাইয়া সাবাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সাবাব কারো উপস্থিতি টের পেল। পার্টির তাড়াহুড়ো থাকায় সে আর কিছু না বলে দুই হাতে লাইয়ার গলা টিপতে শুরু করলো। লাইয়া চিত্কার করে সাবাবকে থামতে বলছে। কিন্তু সাবাব যেন কিছুই শুনছে না। সে এবার পকেট থেকে ছুরি বের করে এলোপাথারি লাইয়ার ঘাড়ে- গলায় আঘাত করতে লাগলো। লাইয়ার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। এরপর সাবাব তাকে ফেলতে যাবে তখন সে বুঝতে পারল আজকে তার শরীর ঘামছে না। সে লাইয়ার দিকে ভালোভাবে তাকালো। না, তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না সে নিজেই লাইয়ার সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলল। তারপর সাবাব তার হাতের ছুরিটা দিয়ে নিজের ঘাড়ে-গলায় অনেকগুলো আঘাত করলো।

পরিশিষ্ট: এ ঘটনার পরে টানা কয়েকবছর ফেব্রুয়ারীর ৪র্থ শুক্রবারে ওই বাড়ির ছাদে দম্পতির লাশ পাওয়া যায়। অত:পর বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত