ভালোলাগা ভালোবাসা

ভালোলাগা ভালোবাসা

হলুদ সন্ধ্যা। বাড়ির পুরো চত্তরে লাল,নীল রঙের আলো। মানুষের গমগম শব্দ সেই সাথে সাউন্ড বক্সের উচ্চ ধ্বনি। এছাড়াও রয়েছে একেকজনের বাহারি সাজসজ্জা। মুরুব্বিদের হৈ – হট্টগোল,শিশুদের হৈ-হুল্লোড়। কেউ কেউ আবার যখনই সময় পাচ্ছে মুখ ভর্তি পান চিবুচ্ছে। আবার সেই পানের পিক থু থু করে ফেলছে এদিক-সেদিক। কেউ কেউ ফল দিয়ে নানা কারুকার্য করছে। আর এই সব কিছুর মধ্যে বড্ড বিরক্ত লাগছিলো আমার। আমি বরাবরই একটু সেকেলে টাইপের এসব জাঁকজমক অনুষ্ঠান কখনওই ভালো লাগতো না। ওদিকে মায়ের একমাত্র ভাইয়ের ছেলের বিয়ে বলে কথা। সাথে আমাকেও আসতে হলো। না এসেও উপায় নেই। এত বড় মেয়েকে একা বাড়িতে রাখা মোটেও ঠিক হবে না। সারাটা সময় নাক কুঁচকে বসে ছিলাম। এর মধ্যেই মায়ের ডাক পড়লো,
–কী রে মিমি? আয় ভাইয়াকে হলুদ লাগিয়ে দে।”

মেজাজটা প্রচুর খারাপ হলো। মা জানে আমি এসব পছন্দ করি না তবুও কী দরকার ছিলো ডাকাডাকি করার? মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে নতুন দুলার গায়ে হলুদ মাখাতে গেলাম। হুট করেই কারও সাথে এক জোর ধাক্কা খেলাম। বিরক্তি নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। কিন্তু এই বিরক্তিকর ভাবটা নিমেষেই উবে গেল। হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। এটা কী আমার ভ্রম! নিজের হাতেই নিজে চিমটি কাটলাম। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলাম আমি। লোকটা বার কয়েক স্যরি বললো। অথচ আমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিলাম। একটু ভদ্রতা দেখিয়ে বললামও না, “ইটস ওকে!”

লোকটা নির্ঘাত আমাকে পাগল ভেবেছিলো। সেই এক দেখাতেই লোকটা হারিয়ে গেল। এত খুঁজলাম কিন্তু একবারও আর চোখের দেখা দেখলাম না। সেদিন রাতে মামার বাড়ি থেকে চলে এলাম ঠিকই কিন্তু মনটা সেখানেই পড়ে ছিলো। বিয়ে হয়ে গেল তবুও আর সেই ছয় ফুটের লম্বা, শ্যাম বর্ণের, গভীর কালো চোখের লোকটার সাথে আমার আর দেখা হলো না।
কাকে জিজ্ঞেস করবো? আর কী বা জিজ্ঞেস করবো? তার মানটাও তো জানা ছিলো না।

কত রাত যে তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছি তারও হিসাব নেই। যখন স্বপ্ন বুনতাম তখন মনে হতো উনি আমার খুব কাছে আছেন। শুধু আমি তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারছি না। মাঝে মাঝে কান্না করতাম। সে কী কান্না আমার, বালিশের অনেকখানি ভিজে যেত। নিজেকেই প্রশ্ন করতাম এটা কেমন ভালোলাগা? এই ভালো লাগার নাম কী? আদৌ কী এই ভালো লাগার কোনো নাম আছে? অনেক ভাবলাম। ভেবে ভেবে শেষমেশ এই ভালোলাগার নাম আবিস্কার করলাম। সেই ভালো লাগার নাম দিলাম; ‘ভালোবাসা!’

নিজেই অবাক হলাম। এ কেমন ভালোবাসা? এক ধাক্কায় কখনও কী ভালোবাসা হয়? মনকে অনেক বুঝালাম। কিন্তু না, মনের একই কথা এটা ভালোবাসাই। না পেড়ে মনের কথাই মেনে নিলাম। আমার একলা মনে তার জন্য ভালোবাসার ঘর বুনতে লাগলাম।

আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। পুলিশের বড় অফিসার। একরকম চলছিলো আমার দিনগুলি আর রাত চলছিলো নতুন নতুন স্বপ্ন বুনে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম তারপর অনার্সে ভর্তি হোলাম অর্থনীতি নিয়ে। বাবা চাইতেন বিয়ে করে ফেলি। আমি অনেক বুঝালাম বাবাকে। অন্তত অনার্স শেষ হওয়া অব্দি যেন বাবা বিয়ের কথা না বলেন। বাবাও মানলেন। আর দুইটা বছর পেরিয়ে গেল। তৃতীয় বর্ষে উঠলাম। বাঁধলো আরেক নতুন বিপত্তি। বাবা ট্রান্সফার হয়ে ঢাকাতে বদলি হয়েছেন। সেই সূত্রে আমাকেও কলেজ থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকার একটা কলেজে ভর্তি হতে হলো। নতুন কলেজ, নতুন সব বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে নিজেকে কেমন মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। একদিন এক নতুন টিচারের আগমন ঘটলো। তাকে দেখা মাত্রই আমার মাথা ঘুরতে লাগলো, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ করছিলো, হাত-পা কাঁপছিলো, চোখে ঝাপসা দেখালাম। শেষমেশ জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফেরার পর আমি তাকে খুঁজতে লাগলাম। মা জিজ্ঞেস করলো,

–কাকে খুঁজছিস?”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। বুঝলাম আমি বাড়িতে কলেজে নেই। নিজের কপালে নিজেই চাপড় দিলাম। এরপর প্রতিদিন কলেজ যেতাম শুধু ওনাকে দেখতে। কতবার যে চেয়েছিলাম ওনাকে আমার মনের কথাগুলো বলতে। কিন্তু সাহস হয়নি। একদিন উনি সবাইকে ওনার বউয়ের কথা বললেন। খুব প্রশংসা করলেন বউয়ের। আমি ক্লাসে বসেই কেঁদে ফেললাম। সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এত বড় মেয়ে কী করে এভাবে কাঁদে? উনি এসে আমাকে জিজ্ঞেসও করলেন,
–কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?”
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
–আমার মাথাব্যথা করছে।”

আমি বলতে পারলাম না, জীবনের প্রথম ধাক্কায় আমার পুরো পৃথিবীটাই পাল্টে গেছে। হ্যাঁ, আপনিই সেই,যাকে ঘিরে প্রতিরাত স্বপ্ন বুনেছি। যার জন্য চোখের জল ফেলেছি। যাকে এক দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। নাহ্, পারলাম না আমি। এমন কিছুই বলতে পারলাম না। তবে ওনাকে একটা প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছে জাগছিলো,
–আপনি কী আমাকে চিনতে পারেননি…?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত