ভরা থাক স্মৃতি-সুধায়

ভরা থাক স্মৃতি-সুধায়

পাড়ার ছেলেরা পিকনিক করছে, পঞ্চাশোর্ধ বিল্বপাড়ার ন্যাপাদা ওরফে নেপাল সাহা সে খবর কেমন করে যেন পেয়ে যেতেন । তিনি ছেলেদের সামনে উপস্থিত হতেন এক-মুখ হাসি নিয়ে । বলতেন, ”আমাকে কিন্তু লিস্টে রাখবি । যা বলবি তোরা করে দেব । পয়সা দিতে পারব না কিন্তু । জানিসই তো ।” প্রথম প্রথম ছেলেরা খুব বিরক্ত হত তার কথা শুনে । সেটাই স্বাভাবিক । ন্যাপাদা তাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় । কাকু বা জেঠুর মতো । কি করে তারা তার সামনে নিজেদের মধ্যে মস্করা করতে পারে ? তার চেয়েও বড় কথা হল,বিনা পয়সায় পিকনিক হয় ? তার খরচ কে বইবে ?

শেষমেশ কেউ কেউ বলত, ”কাকু, সব বুঝলাম । কিন্তু বিনা পয়সায় পিকনিক কি করে করবে ? আমরা কত কষ্ট করে পয়সা জোগাড় করি, জানো তো ?” ন্যাপাদার মুখ শুকিয়ে যেত সে কথা শুনে । শুকনো মুখে বলতেন, ”আমি পয়সা কোথায় পাব ? সেই কবে থেকে ল্যাংড়া হয়ে পড়ে আছি । কাজ করতে পারি না । ছেলের কাছ থেকে পয়সা চাইতে লজ্জা লাগে । খেতে দেয়, এই কত ।” তার কথা শুনে অনেক ছেলের মন কেঁদে উঠত । শেষে সবাই মিলে বলত, ”বেশ কাকু, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো । আমাদের বুদ্ধি দিও ।”

ন্যাপাদার ছেলেদের সঙ্গে পিকনিকে যোগদান নিয়ে বেশ হাসাহাসি হত তার সমবয়সী বা তার চেয়ে কিছু ছোটদের মধ্যে । ন্যাপাদাকে ডেকে অনেকেই বলত, ”তুমি আর কত ছোট হবে গো ? বয়সটাকে মানো । লজ্জা বলে কিছু রাখো । ওরা সব বয়সে তরুণ । ওদের নিজেদের মধ্যে কত কথা থাকতে পারে । তুমি বুঝি ওদের কথাগুলো গেলো ?” ন্যাপাদা হাসতে হাসতে জবাব দিতেন, ”ওরা আমাকে খুব মানে । অন্যরকম কিছু বলেই না । একদিন একটা ছোকরা রসালো প্রেমের গপ্পো বন্ধুদের মধ্যে ফাঁদতে গিয়েছিল, কিন্তু আমাকে দেখে আর বলেনি । ওকে বলেছি, তোমার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি । সব জানি । বলতে পারো । আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখব । আমার কথা শুনে বেশ মজা পেয়েছিল সবাই ।”

সেবার ২৫শে ডিসেম্বর পাড়ার ছেলেরা পিকনিক করবে বলে মনস্থ করল । ন্যাপাদা ছেলেদের মধ্যমণি । পিকনিকের প্রায় সমস্ত দায়িত্ব তার । ন্যাপাদা পিকনিকের কয়েকদিন আগে থেকেই নানা পরিকল্পনা করতে লাগলেন । ছেলেরা মহা খুশী । এই না হলে আমাদের প্রিয় কাকু ? কিন্তু পিকনিকের দু’দিন আগে তাদের প্রিয় কাকু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন । অসুস্থতার মধ্যে ন্যাপাদা তাদের এক-গাল হেসে আশ্বস্ত করলেন, ”আরে ভাবিস না । আমি কালকেই সুস্থ হয়ে যাব । তোরা হাসি-মুখে সব ব্যবস্থা কর ।” ছেলেরা বুকে সাহস পেল । কিন্তু এর পরেরদিন ন্যাপাদাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল । অনেক ছেলে বুক-ভরা ব্যথা নিয়ে তার কাছে ছুটে গেল । ন্যাপাদা বুকের অসহ্য ব্যথা নিয়েও ছেলেদের আশার বাণী শোনালেন, ”আরে মল, এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে ? আমি রাতের দিকেই বাড়ি ফিরছি । তোরা ওই দিকটা দেখ গে ।” ছেলেদের বিশ্বাস একটু কমে গেলেও চোখের জল গোপন করে পাড়ায় ফিরে এল ।

কিন্তু না, ন্যাপাদা সে রাতে পাড়ায় ফেরেননি । ছেলেরা তার অপেক্ষা করে করে পিকনিক বাতিল করে দিতে বাধ্য হয় । ছেলেরা সবাই বলল, ”সময় তো বয়ে যাচ্ছে না । কাকু আসলেই হবে ।” আরও চারদিন হাসপাতালে থাকার পর ন্যাপাদা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন । শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এল পাড়ায় । ছেলেরা কেঁদে সব আকুল । ওদের দেখে সবাই যারপরনাই অবাক । অনেকেই ভাবতে থাকলো।, এ মানুষটা এত কাছে চলে এসেছিল এদের ? এও সম্ভব ? ন্যাপাদার ছেলের কান্নাকে সব ছেলে ছাড়িয়ে গেল সবার চোখের সামনে দিয়ে ।

ছেলেরা ঠিক করল এক সন্ধ্যায় তারা পিকনিকের মাঠে আলো জ্বালিয়ে তাদের প্রিয় কাকুকে শ্রদ্ধা জানাবে । পাড়ার বড়রা সব ব্যবস্থা করে দিল । ন্যপাদার ছবি একটা চেয়ারে বসিয়ে তার ছবিতে মালা পরান হল । ফুল আর ধুপকাঠির সুবাসে তখন চারদিক ম-ম । সবার চোখে জল । হঠাৎ একটা ছেলে বলে উঠল, ”ওই দেখো সব কাকু এসেছে ।” সবাই অবাক হয়ে চারদিক তাকাল । অবশেষে দেখল ন্যাপাদার ছেলে বাসুকে । ধড়াচূড়া পড়ে কাঁদো-কাঁদো মুখে বাবার ছবির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে । ছেলেরা বলল, ”আরে এ বাসু দা তো । একদম কাকুর মতোই দেখতে, কিন্তু ওর চেয়ে ঢের ভাল মানুষ ছিল আমাদের কাকু ।” শুনে কেঁদে উঠল বাসু, ছেলেরা আর উপস্থিত সবাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত