ছেড়া পাতা

ছেড়া পাতা

আকাশের রং নীল কেনো হয়? আমরা তো জানি নীল বেদনার রং। তাহলে কি আকাশ কি কষ্টে থাকে? এই বিশালতম আকাশের আবার কেমন বেদনা? চোখে চশমা, ছাদে দাড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে তাকিয়ে আছি ঐ নীল আকাশের দিকে। আজ দক্ষিনা বাতাস,, নীল আকাশ মন ভালো করার এক অবিরাম পরিবেশ। কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে এই বিশাল মনকে সৌন্দর্যের দরজাতে ভালো লাগার কড়া নাড়াতে যে আমি পারছি না। পারছি না আমি সব নিরবতাকে ফেলে নতুন ভাবে উন্মোচিত হতে। বারবার পড়তে হচ্ছে এক নির্মমতার বাস্তবতার গর্তে। যে গর্তে আমার নিঃশ্বাস ও চলাচল করতে হিমশীম খাচ্ছে।

– পাপা…(ইবনাত)
ইবনাতের ডাকে পিছনে ফিরলাম। কি মিষ্টি দেখতে আমার মেয়েটা। এই মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে ইচ্ছে করে শত দিনের সেই কষ্টময় স্মৃতিগুলো। মিশে যেতে ইচ্ছে করে ইবনাতের মিষ্টিময় চেহারার মধ্যে।
– ও পাপা..
– হ্যাঁ আম্মু..
– পাপা আমি চলে গেলে তোমার কষ্ট হবে না??

ইবনাতের মুখের দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে রয়েছি। ওর ঠোটের কোনে লেগে আছে এক বিষান্নতার প্রতিচ্ছবি। খুব ইচ্ছে করছে দুঃসাহসী হয়ে ওর বিষান্নতাকে দূর করে দিই। কিন্তু আমি যে এক অচল মানব। হ্যা অচল, কারন আমি যে এক ছন্নছাড়া মানব। এ অচল অক্ষমতার নয় বাস্তবতার।

– বলো না পাপা..তোমার কষ্ট হবে কিনা?
হাটুগেড়ে বসে ইবনাতকে বাহুডোরে জড়িয়ে নিলাম। এক অপরুপ ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো হৃদয়।
– হবে মামনি খুব হবে (আমি)
তখনি বুক থেকে সরে আমার মুখটা আলতো করে ধরে ইবনাত বললো..
– তাহলে রেখে কেনো দিচ্ছো না আমায়? আমার যে তোমাকে ছাড়া খুব কষ্ট হয়। বুঝো না তুমি?

ইবনাতের মাথায় হাত রেখে নিরবে কেঁদে উঠলাম। নিরবে কেদে উঠা যে কতটা কষ্টের সেটা তারাই জানে যারা এটা করে।
ইবনাতকে কোলে তুলে নিলাম। পরিবেশটাকে দুজনে মিলে উপভোগ করবো। তখনি স্মৃতির পাতায় শুকনো স্মৃতিগুলো খসখস করতে লাগলো।

***

– আবির এভাবে আর কতদিন? (জেরিন)
– কেনো? তোমার কি হয়েছে আবার? (আমি)
– বুঝতে পারছো না আর কি বলছি?
জেরিনের কথা শুনে চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি জেরিন কি বলতে চাচ্ছে। পাশে ইবনাত জেরিনের শাড়ির আঁচল ধরে শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– কিছু বলো? এভাবে আর কতদিন থাকবো?
– জেরিন এমন কেন করছো তুমি? আমি তো চেষ্টা করছি নাকি?
– ঘোড়ার ডিম করছিস তুই, তোর মত লোকটার সাথে আমার বিয়ে করাটাই ভুল হয়েছে। আগে যদি জানতাম তুই এমন করবি কখনই তোকে বিয়ে করতাম না।
জেরিনের কথাগুলো মাথাটা নিচু করে শুনলাম। কারণ, জেরিন যা বললো একদম সত্য।
– জেরিন থামো, ইবনাত আছে। সে বাচ্চা, তার সামনে এমন রুঢ় আচরন কেন করছো?
– ঐ চুপ কর তুই। ব্যাপারটা যদি আগেই বুঝতাম তাহলে আর এতদুর আসতো না।
– দেখো আমি চাকরি করতে পারবো না। লেখালিখি আমার স্বপ্ন। লেখা আমার সত্বা। সেই ছোট থেকেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি লেখার মাঝে। তবে চিন্তা করো না একদিন না একদিন আমি বড় রাইটার হবোই।
– বা** হবি তুই। এই একই কথা রোজ শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। আমি আর পারছি না আবির এসব নিতে।
– চিন্তা করো না জেরিন, বললাম তো সব ঠিক হয়ে যাবে।
– কিচ্ছু ঠিক হবে না। যা হবার তা হয়ে গেছে এখন প্লীজ আমাকে মুক্তি দাও।
– কি বলছো এসব?
– হুমম আমি আর পারছি না, আমাদের মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে দেখেছো? চাল চুলোহীন ব্যর্থ লেখক একটা।
– জেরিন প্লীজ আমার লেখা নিয়ে কিছু বলবে না। কারণ লেখা আমার স্বপ্ন তুমি সেটা জানোই।
– তা তুই থাক তোর এই লেখা নিয়ে। নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে আবার লেখালিখি করবে। এতদিনে তো বই বের হওয়ার কথা। তো কি এমন লিখছেন যে একটা বই বের হলো না? কেন যে তোমার মত একটা বা** লেখকের প্রেমে পড়েছিলাম? আর কেনই বা বিয়ে করলাম? এই সব লেখা ছাড়বি তো আমার কাছে আসবি।
– ঠাসসসসস… ঠাসসসসস

কথাগুলো শুনে জেরিনের গালে চড় দেয়নি। দিয়েছি আমার লেখাগুলোকে অসম্মান করার জন্য। আমার লেখার খাতাটি টেনে ফেলে দেয়ার জন্য।

– তুমি আমাকে মারলে? (জেরিন)
– হুমম মেরেছি…
– মারবেই তো..এখন তো আমরা কিছুই না তোমার এই লেখাই সব। ইবনাত দেখে নে তোর পাপাকে। সে কত নিষ্ঠুর..তুমি থাকো তোমার এই লেখা নিয়ে আমি চলে গেলাম। সাথে ইবনাতকেও নিয়ে গেলাম। কারন এখানে সে থাকলে তার ভবিষ্যৎ তার বাপের মতই হবে। চল ইবনাত..

সেদিন জেরিন ইবনাতকে নিয়ে চলে গেছিলো। আজ দুই বছর হল আমি জেরিনের সাথে কথা বলি না। শুনেছি সে নাকি এখন একটা চাকরি করে। সেদিন বিশাল কষ্টের মাঝে কেটেছিলো সময়। খুব ভালোবেসেছিলাম বলে তাকে দেয়া কষ্টগুলো আজো মেনে নিতে পারিনি।
– পাপা..চলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে তো। (ইবানাত)
ইবনাতের কথায় বাস্তবে ফিরলাম। কখন যে কেঁদে ফেলেছি বুঝতেই পারলাম না। নোনতা স্বাদটা যখন দাড়ি ভেদ করে ঠোটে এসে পড়লো তখনি বুঝলাম।
– হুমম মামনি চলো..
রুমে এসে ভাবছি কাল চলে যাবে ইবনাত। সেদিনের পর থেকেই ইবনাত মাসে ৭ দিন করে থাকে আমার কাছে।
– পাপা তখন কাঁদছিলে কেনো?
ইবনাতের কথায় আবার ওর দিকে তাকালাম। ছোট্ট ৯ বছরের মেয়েটা কত কথায় না বলে।
– ও কিছু না আম্মু।
– আচ্ছা পাপা তুমি আম্মুকে কেন আনছো না? তোমাদের ছাড়া আমার ভালো লাগে না। আমি তোমাদেরকে একসাথে চাই।
– হুমম মা ঠিক আছে।
– মিথ্যে বলছো? এই একই কথা সবসময় বলো। আচ্ছা তুমি তো এখন দেশের একজন বড় লেখক তাহলে কেনো তুমি আম্মুকে ফিরিয়ে আনছো না? আমার যে খুব কষ্ট হয়।।তোমাদের অভিমানে আমার যে সব হাসি খুশি চলে গেছে পাপা সেটা কি বুঝোনা তোমরা?

ইবনাতের কথাগুলো পরাজিত এক সৈনিকের মত মাথাটা নিচু করে চুপচাপ শুনলাম। সে তো ঠিকই বলেছে। আমাদের অভিমানে তার ভবিষ্যৎটাই নষ্ট করে দিচ্ছি।

তবে আমি আজ পেরেছি, হুমম পেরেছি সকল বাধা পিছনে রেখে সফলতা ছিনিয়ে আনতে। পেরেছি খারাপ সময়টাকে দূরে ঠেলে ভালোতে পৌছাতে। আজ যে আমি বড় রাইটার। দেশের দশজন আমার নাম জানে। চেনে আমাকে। সেদিনের জেরিনের কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেলো।

মুচকি হেসে উঠলাম। সে বলেছিলো কিছুই পারবো না আমি। কিন্তু না আমি আজ পেরেছি। আজ ২১শে পদক পুরষ্কার, একাডেমি পুরস্কার সব আছে আমার কাছে। তবুও আমি যে নিঃস্ব, ছন্নছাড়া।

তবে ইবনাতের কথাগুলো সব সত্য। আজ সব আছে কিন্তু সুখ নামের কোনো সফটওয়্যার নেই আমার ঘরের এন্ড্রয়েড ভারশোনে। শত চেষ্টা করেও সেটা মনের মধ্যে ডাউনলোড করতে পারছি না। তাই কাল জেরিনকে আনতে যাবো। আসবে কি সে ফিরে? বাসবে কি সে আবার ভালো? যদি ফিরিয়ে দেয় সে? যাইহোক কাল আমি যাবোই তার সামনে।

– ইবনাত মামুনি চলো খাবে। আর কাল তোমার আম্মুকে নিয়ে আসতে যাবো।
– সত্যিই পাপা??
– হ্যাঁ মা সত্যিই।
– তুমি খুব ভালো পাপা।
ইবনাত জড়িয়ে ধরলো দৌড়ে এসে।

– ইবনাত জানালার পর্দাটা কেনো সরালে? (ঘুম ঘুম চোখে)
খুব যে রোদ আসছে মা…
– সরানোই থাক, এত ঘুমাতে কে বলেছে?

কথাটি শুনেই আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। বোঝার চেষ্টা করছি আমি এখন কোথায় আছি, নাকি স্বপ্নে বিভোর আছি?
কারণ, এ যে সেই পরিচিত কন্ঠ। সেই চিরচেনা মিষ্টি সুর।
– লেখক সাহবের তাহলে ঘুম ভাংলো?
কথাটি শুনে জেরিনের দিকে তাকালাম আমি। সেই আগের মতই আছে সে। একটুও বদলায়নি। অবাক হয়ে পাশে থেকে চশমাটা চোখে লাগিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
– তুমি এখানে??
– কেনো আসা বারন আছে?
– নাহ তা হবে কেনো?
– তাহলে..
– এমনি…
কিছু সময নিরবতা। জেরিন আমার পাশে এসে বসলো। আমার মাথার চুলে তার আংগুল গুজে এলোমেলো করে দিয়ে বলতে লাগলো..
– জানি তুমি আমাকে স্বার্থপর বলবে। এটাও বলবে যে তুমি বড় রাইটার হয়েছো বলে আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু তুমি যা বলবে বলো তবে সেটা তোমার একমাত্র ভুল ধারনা।
-……. (নির্বাক হয়ে শুনতে লাগলাম)
– আমি আবার ফিরে এসেছি ইবনাতের কথা ভেবে। কারন, সে তার পাপাকে অনেক ভালোবাসে। আর আমি চাইনা লোকে বলুক ইবনাতের পাপা নেই। এখন যান ফ্রেশ হয়ে আসেন।

মুচকি হেসে ইবনাত চলে গেলো রান্না ঘরের দিকে। আর আমি চললাম ফ্রেশ হতে।

মনে মনে বললাম..
– স্বার্থছাড়া যদি না আসো তাহলে এতদিনে কেনো আসনি? তবে এসেছো ভালোই করেছো আমি নিজে থেকেই তোমার কাছে যেতাম। কারণ তোমাকে যে বড্ড ভালোবাসি। তাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলাম শুধু তোমার জন্য, নিজেকে মানিয়ে নিলাম আমাদের মেয়ের জন্য। ঠিক সেসময় শুনতে পেলাম মা মেয়ের হাসির শব্দ। বলে উঠলাম, ‘তুমি যতবারই আমাকে ছেড়ে চলে যাওনা কেন, আমি তোমাকে ভালোবাসবো ততবারই। গ্রহন করবো তোমায় শতবার। তোমাকে ঠাই দিবো আমার বাহুডরে বহুবার।’

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত