কিছুমিছু – বাংলাদেশের লোককাহিনী

কিছুমিছু – বাংলাদেশের লোককাহিনী

বড় ভাই হরি শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখানে কত খাতির-আদর। এটা-ওটা খাইয়া আসিয়া নানারকম গাল-গল্প করে। ছোট ভাই নেপাল শুনিয়া মুখ কাচুমাচু করে। তার তো বিবাহ হয় নাই। কে তাহাকে খাতিরযত্ন করিবে ?

সেদিন নেপাল যাইয়া বড় ভাই হরিকে বলিল, “দাদা, প্রতিবার পূজায় তুমি শ্বশুরবাড়ি যাও। কত কি খাইয়া আস, এবার তোমার বদলে আমি যাব।” বড় ভাই বলিল, “আচ্ছা আমি এবার যাব না। তুই-ই আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াইয়া আসিস ।” শুনিয়া ছোট ভাই ভারি খুশি।

যাইবার সময় মা বলিয়া দিল, “দেখ, তুই তো তোর দাদার শ্বশুরবাড়ি যাবি। সেখানে বউমা আছে। খালি হাতে কেমন করিয়া যাবি। এই পাঁচটা টাকা নে। একটা কিছুমিছু কিনিয়া নিস।” মা মনে করিয়াছিল, ছেলে বাজার হইতে কোনো কিছু কিনিয়া লইয়া যাইবে। সন্দেশ, রসগোল্লা বা অন্য কিছু। কিন্তু নেপাল ভাবিল, কিছুমিছু না জানি কি একটা নতুন জিনিস, বাজার হইতে কিনিয়া লইতে হইবে। সে বাজারে যাইয়া এ দোকানে যায় সে দোকানে যায়। মনোহারী দোকানে কত রঙ-বেরঙের জিনিস সাজানো রহিয়াছে। সে যাইয়া দোকানীকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমার কাছে কিছুমিছু আছে ?”

দোকানী বুঝিতে পারে না কিছুমিছু কি। তাই উত্তর করে, “না, নাই।” মনোহারী দোকান ছাড়িয়া সে মিষ্টির দোকানে যায়, হাড়ি পাতিলের দোকানে যায়, চাল-ডালের দোকানে যায়। “তোমাদের কাছে কিছুমিছু আছে ? তোমরা আমাকে পাঁচ টাকার কিছুমিছু দাও।”

“এমন বোকা তো কোথাও দেখি নাই। কিছুমিছু আবার দোকানে বিক্রি হয় ?” তাহারা কেহ তাহার গায়ে ধুলি ছিটাইয়া দিল, কেহ তাহার মাথায় কেরোসিন তেল মালিশ করিতে আসিল, কেহ তাহাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিল । মনের দুঃখে সে খালি হাতেই ভাই-এর শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা হইল। পথে যাইতে যাইতে দেখা হইল এক পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে । তিনি গামছায় কিছু ধান-দুর্বা, তুলসী পাতা, বেলপাতা, আর শাখাসিন্দুর বাঁধিয়া চলিয়াছেন যজমান বাড়িতে শ্রাদ্ধের কাজ করিতে। চুপ করিয়া পথ চলিতে হয়রান হইতে হয়। ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে গল্প করিয়া পথ চলিলে পথের কষ্ট মনে পড়িবে না। সে ঠাকুর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর মহাশয়, গামছায় বাঁধিয়া কি লইয়া যাইতেছেন ?”

ঠাকুর উত্তর দিলেন, “কিছুমিছু লইয়া যাইতেছি।” ছোট ভাই ভাবিল, এবার তবে সে কিছুমিছুর খোজ পাইয়াছে। সে ঠাকুর মহাশয়ের পায়ের ধূলি মাথায় লইয়া বলিল, “আপনি দয়া করিয়া আমাকে এই কিছুমিছু দান করিয়া যান।” ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন, “তাহা কেমন করিয়া হইবে, এগুলি তো আমার কাজে লাগিবে।” ছোট ভাই তখন আরো অণুনয়-বিনয় করিয়া বলিল, “এই পাঁচটি টাকা লন, কিছুমিছু আমাকে দিতেই হইবে।”

পুরুত ঠাকুর ভাবিলেন, যজমান বাড়িতে পূজা করিয়া বড়জোর পাচ আনা পাইব । আর এই ছেলেটি পাঁচ টাকা সাধিতেছে। গামছায় বাঁধা ফুল, বেলপাতা তো যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়। পথ হইতে তুলিয়া লইলেই হইবে। কিন্তু গামছায় কি বাধা আছে এই বোকা ছেলেটি যদি বুঝিতে পারে, তবে আর টাকা দিবে না। তাই প্রকাশ্যে তাহাকে বলিল, “এগুলির আমার দরকার ছিল, কিন্তু তুমি যখন এমন করিয়া বলিতেছ তোমাকে বেজার করিতে চাহি না। এই গামছা ধরিয়াই কিছুমিছু লইয়া যাও। পথে কোথাও খুলিও না। বাড়িতে লইয়া গিয়া তুলসী তলায় রাখিয়া দিও।”

মনের সুখে সেই গামছা সমেত ফুল বেলপাতা লইয়া ছোট ভাই খুব তাড়াতাড়ি পথ চলিতে লাগিল। বড় ভাই-এর শ্বশুরবাড়িতে আসিয়া সে পুটলিটি তুলসী তলায় রাখিয়া চুপটি করিয়া বসিযা রহিল। তার ভাই-এর বউ একাজে, সেকাজে আসিয়া দেখিল, দেবর তুলসী গাছের তলায় বসিয়া আছে।

“ওকি ! তুমি এখানে বসিয়া আছ কেন? বাড়িতে সকলে কেমন আছে?” মাত্র আসিয়াও জিজ্ঞাসা করিল, “এই যে পুত্রা যে, তোমার দাদার তো আসার কথা ছিল। তা সে আসিল না কেন?”

ছোট ভাই তো দাদাকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করিয়া তাহার বদলে কুটুম্ব বাড়িতে আসিয়াছে। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না। সে কোনো উত্তর না করিয়া তুলসী তলায় রাখা সেই পুটলিটি দেখাইয়া দিল। পুটলিটি খুলিয়া দেখিয়া শাশুড়ী ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল।

হায়! হায়! তার জামাই তো মরিয়া গিয়াছে, তাইতো পুত্রা ফুল-বেলপাতা আর শাকা-সিন্দুর লইয়া সেই খবর ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি দিতে আসিয়াছে। মায়ের কান্না দেখিয়া মেয়েও আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদিতে লাগিল। তারপর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন সকলে মিলিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। কেহ তলাইয়া দেখিল না কি হইয়াছে। ছোট ভাই আসিয়াছিল দাদার শ্বশুর বাড়ি এটা-ওটা খাইতে, সে খাওয়ার কপালে ছাই। সকলে মিলিয়া কান্না জুড়িয়াছে। অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া সে বাড়ি ফিরিয়া আসিল ।

বাড়ি আসিলে মা আসিয়া জিজ্ঞাসা করে, বড় ভাই আসিয়া জিজ্ঞাসা করে-“সেখানে গেলি আর ফিরিয়া আসিলি, তারা সব ভালো আছে তো?”

ছোট ভাই বলিল, “সে বাড়িতে মানুষ মরিয়াছে। তারা সব কান্নাকাটি করিতেছে। তাই দেখিয়া আমি চলিয়া আসিয়াছি।”

“কে মরিয়াছে?” জিজ্ঞাসা করিতে ছোট ভাই বলিল, “তা আমি কি করিয়া বলিব? আমাকে দেখিয়া সকলে কাঁদিয়া উঠিল । তাই আমি বাড়ি চলিয়া আসিলাম।”

বড়ভাই বলিল, নিশ্চয়ই তার বউ মরিয়াছে। তাই ভাইকে দেখিয়া সকলে কাঁদিয়া উঠিয়াছে। সে তখন কাঁদিতে কাঁদিতে শ্বশুরবাড়ি ছুটিল। শাশুড়ী ও বউ তাহাকে দেখিয়া ঘিরিয়া ধরিল, “আমরা তো জানিতাম তুমি মরিয়া গিয়াছ!” বড় ভাই বউকে বলিল, “আমিও তো ভাবিয়ছিলাম তুমি মরিয়া গিয়াছ!” তখন সকলেই বোকাভাইয়ের কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইল।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত