হত্যা বা আত্মহত্যা

হত্যা বা আত্মহত্যা

একটা লোক জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। এমন সময় সে একটা ডাক শুনল : থামো। – লোকটা পেছন ফিরে দেখল, দাড়িওলা মুখের আর একটা লোক তার হাত ধরে টানছে। দ্বিতীয় লোকটা বলল, ‘তুমি কী করতে যাচ্ছো, আমি জানি; কিন্তু কেন তুমি মরতে চাও?’

আত্মঘাতী-হতে-যাওয়া লোকটা বাধা পেয়ে বেশ বিরক্ত হয়েছিল। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, ‘আমার আর বাঁচার কোনো ইচ্ছে নেই। ব্যাস, শুনলে তো!’

শুনে দ্বিতীয় লোকটা বলে উঠল, ‘এই জীবন এতো সুন্দর, তাকে তুমি ত্যাগ করতে চাও! ছিঃ ছিঃ!’ – এই বলে সে থুথু ফেলল, অবশ্যই সুন্দর জীবনটার গায়ে নয়, আত্মহননের বেয়াড়া ইচ্ছের ওপর। বুভুক্ষু চেহারার সেই জীবনপ্রেমী লোকটাকে একবার দেখে নিয়ে প্রথমজন বলল, ‘জীবন আমার কাছে সুন্দর নয়।’

শুনে দ্বিতীয় লোকটা তার খয়েরি মাড়ি বের করে একটু হাসল। তারপর বলল, ‘কতটুকু দেখেছো তুমি জীবনের?’ আবছা আলোয় তার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছিল না। তবু প্রথম লোকটার মনে হলো, ওর চোখের পাতা টেনে ধরলে ভেতরে শুধুই ফ্যাকফ্যাকে সাদা ছাড়া আর কোনো রং পাওয়া যাবে না। দাঁত চেপে কঠিনস্বরে সে বলল, ‘আমি জীবনকে আখের মতো দু-হাতে নিংড়ে দেখেছি – একফোঁটা আনন্দও পাইনি।’

শুনে দ্বিতীয় লোকটি এবার খিকখিক করে একটু হেসে নিল। তারপর প্রথমজনের হাত টেনে ধরে বলল, ‘আনন্দ বলতে কী বোঝো তুমি? বোসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

মর্তুকাম লোকটার এবার বেজায় রাগ  হলো। তাকে এখন জীবনের পাঁচালি শুনতে হবে নাকি এই চিমড়ে লোকটার কাছ থেকে! আত্মহত্যার তাড়না কী, ও জানে না। সেই তাড়না একবার শান্ত হয়ে এলে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। জীবনের গল্প শোনার সময় তার এখন নেই। কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা ততক্ষণে কথা শুরু করে দিয়েছে। যেন সে তার ঝোলা থেকে জীবনের পুঁথি বের করে পড়ে শোনাচ্ছে। প্রথম লোকটার আর সহ্য হলো না। সে ওই রোগা লোকটাকে দু-হাতে তুলে নিয়ে ঝপাং করে ছুড়ে দিলো পুকুরের জলে। তারপর সে নিজে যখন ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে, তার কানে এলো, যাকে সে জলে ফেলে দিয়েছে, সেই লোকটা হাহাকার করে বলছে, ‘এ কী করলে তুমি। আচ্ছা পাগল তো।’

লোকটার আর ঝাঁপ দেওয়া হলো না। সে পরিষ্কার দেখতে পেল, দ্বিতীয় লোকটা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। সে ভীষণ অবাক হয়ে বলছে, ‘আশ্চর্য, অতো ভারী জিনিসটা তুমি তুললে কী করে?’

শুনে প্রথম লোকটার আর বুঝতে বাকি রইল না – যা সে জলে ছুড়ে দিয়েছে, তা বেশ বড়োসড়ো একটা কংক্রিটের চাঙড়। পুকুরের ধারেই সেটা পড়ে ছিল। লোকটা বুঝতে পারল, তার সব হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সে আর একমুহূর্তও দেরি না করে জলে ঝাঁপ দিলো; আর তলিয়ে যাওয়ার আগে শুনতে পেল, কে যেন চিৎকার করে বলছে : আঃ।
ধ্বনিটা কার মুখ থেকে বেরিয়েছিল, আন্দাজ করা যায়। তবে ২৪ ঘণ্টা পরে আত্মঘাতী লোকটির দেহ ভেসে ওঠার পর অনেক লোক জড়ো হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু জীবনের ফেরিওলা সেই লোকটাকে আর দেখা যায়নি। এরপরের কাজকর্ম তো পুলিশের হাতে। সেসবও মিটে গেল; শুধু সমস্যা রয়ে গেল একটা জায়গায়।

পুকুরটা খুব সাজানো-গোছানো না হলেও প্রায় একটা সুইমিংপুলই হয়ে গিয়েছিল। সকাল-বিকেল ছেলেরা সাঁতার কাটত। একটা সাঁতার ক্লাব করার কথাও ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু কৃতিত্বটা কে নেবে, তাই নিয়ে দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাওয়ায় উদ্যোগটা থমকে গিয়েছিল। ঠিক এই সময়ে শহরে পুরনির্বাচন হয়ে গেল। নতুন মেয়র গদিতে বসার পর স্থানীয় প্রতিনিধি তাঁর কানে এই কথাটা তুলে দিলেন যে, তাদের এলাকায় একটা পুকুর, যা সুইমিংপুল হতে পারত, এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে। ওই পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে একটা লোক আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকে লোকের ধারণা, জল বিষিয়ে গেছে। কেউ আর সেখানে সাঁতার কাটতে যায় না।

নবনির্বাচিত পুরসভা খুব তাড়াতাড়ি কিছু কাজ করে কর্মতৎপরতার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছিল। মেয়র তাই নির্দেশ দিলেন, পুকুরের সব জল পাম্প করে ফেলে দিয়ে নতুন জল ছাড়া হবে। তারপর পাড় বাঁধিয়ে কিছু গাছ লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে একটা সাঁতার-ক্লাব। মেয়রের নির্দেশে পরের সপ্তাহ থেকেই কাজ শুরু হয়ে গেল।

আর পুকুরটাকে শুকিয়ে ফেলার পর দেখা গেল, তার নিচে পড়ে আছে একটা ভারি কংক্রিটের চাঙড় – পাথরের স্ল্যাবের মতোই দেখাচ্ছে সেটাকে। মোটা কাছি দিয়ে বেঁধে সেই জিনিসটাকে টেনে ওপরে তুলতে মজুরদের যে-মেহনত করতে হয়েছিল, তা আর বলার নয়। চাঙড়টাকে পুকুরধারে ফেলে রেখেই তারা চলে গেল; কারণ তাদের ডিউটি শেষ। এবার আসবে জল-ভরার দল।

স্বচ্ছ জলে পূর্ণ সেই পুকুরটি অবশেষে একটি সুইমিংপুল হয়ে উঠল। উদ্বোধনের দিন মেয়র ঘোষণা করেছিলেন, পুলের চারধার রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে। সেই কাজ অবশ্য এখনো হয়নি; তবে সাঁতার-ক্লাব চালু হয়ে গেছে। সারা বিকেল ছেলেমেয়েরা ঝাঁপায় আর জল ছিটিয়ে কলকল করে। তারপর সন্ধে হয়ে এলে জায়গাটা যখন বেশ কিছুটা নির্জন আর অন্ধকার হয়ে যায়, সেই চাঙড়ের ওপর এসে বসে একজোড়া যুবক-যুবতী।

অন্ধকার আর নির্জন একটা জায়গা পেয়ে গিয়ে তারা মাঝেমাঝে হয়তো একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলে; কিন্তু কেউ তা দেখতে পায় না। তাদের নিবিড়তম মুহূর্তে অনেক মালমশলা জমিয়ে তৈরি নিরেট সেই চাঙড়টাকে ঘিরে থাকে কুয়াশার মতো একটা কালো ছায়া।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত