অভিশপ্ত ক্যামেরা

অভিশপ্ত ক্যামেরা

নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যেস আমার নেই। তবে কখনো কোনও ঘটনা তেমনভাবে নাড়া দিলে বিশদ বিবরণ দিয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখি। এ অভ্যেস বহুদিনের। ১৯৯০ সালে যখন আমার বাবা মারা গেলেন, তখন ডায়েরি লিখেছিলাম। ভীষণ একা লাগত তখন। আমার দিদি সরমা’র ১৯৮৭ সালেই বিয়ে হয়ে যায় দিল্লীতে। কালেভদ্রে কলকাতায় আসে। ঠাকুরদার তৈরি এই বিশাল বাড়িটায় এখন শুধু আমি আর আমার কাজের লোক রাধারমণ। মাত্র দুটি প্রাণী! মাঝেমাঝে বাড়িটার হাঁ করা ক্ষুধার্ত মুখটা আমায় যেন গিলতে আসে। যতটা সম্ভব নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখি। মডেলিং অ্যাসাইনমেন্টের ছবিগুলো বাড়িতে বসেই ঝাড়াই বাছাই করি। এতে দিব্যি সময় কেটে যায়।

কিন্তু হঠাৎই গত শুক্রবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনার অপ্রত্যাশিততায় এতটাই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম যে এ ক’দিন ডায়েরীই লিখতে পারিনি। সেদিন সকাল থেকেই আকাশের অবস্থা ভাল ছিল না। কখনও মুষলধারে আবার কখনো বা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছিল। দশটা নাগাদ স্নান সেরে , খাটের তলা থেকে ডাকব্যাকের জলনিরোধক জুতো জোড়া বের করে পায়ে পরলাম। ক্যামেরার ব্যাগটা গোছাতে গিয়েই মাথার ব্যথাটা টের পেলাম। সারা কপাল জুড়ে একটা চিনচিনে ব্যথা। তার সঙ্গে শুরু হল চোখের জ্বালা। বুঝলাম, জ্বর আসছে। থার্মোমিটারটা ভাল করে ধুয়ে জিভের তলায় মিনিটখানেক রাখতেই দেখলাম শরীরের টেম্পারেচার ১০২ ডিগ্রি উঠেছে। অফিস যাওয়ার চিন্তাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, জামা প্যান্ট ছেড়ে, পাঞ্জাবিটা পরে নিলাম। তারপর লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাধারমণকে বলে দিলাম, আমায় কোনওভাবে যেন বিরক্ত না করে। দুপুরেও কিছু খাব না। এখন শুধু বিশ্রাম চাই আমার।

বেশি জ্বর হলে লক্ষ্য করেছি নাক-মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোতে থাকে। কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, যখন ঘুম ভাঙল, বেডসাইড টেবিলটার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম দুপুর দুটো বেজে পাঁচ। এর মধ্যেই বৃষ্টিটা ধরে এসেছিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা। তার ভেজা ডালপালা থেকে বৃষ্টির জল পাতা বেয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছিল। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
নিচে রাস্তায় লোক চলাচল কমে এসেছে যদিও জল জমেনি। মাঝেমাঝে এক আধটা গাড়ি, ভেজা পিচে হুড়–ড়–ড় শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে। দু একটা রিকশা এই ঝিমধরা দুপুরের শান্তিতে, ঢকর ঢকর শব্দ তুলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ঠিক এমনি সময়ে আমার বাবার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল ডায়েরিটার কথাও।
বাবার ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। উনি নিয়মিত ডায়েরি মেইন্টেন করতেন। শুনেছি ঠাকুর্দাও নাকি ডায়েরি মেইন্টেন করতেন। আমার দিদিকেও ডায়েরি লিখতে দেখেছি সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে বিয়ের আগে পর্যন্ত। এখন আর তার সে অভ্যাস আছে কিনা, জানি না।

গতমাসে দোতলার স্টোররুমটা পরিষ্কার করাচ্ছিলাম। তখনই বাবার লেখা চারটে ডায়েরি দেখতে পাই। ১৯৬৩-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত লেখা। চার বছরের এক একদিনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আমার জন্ম ১৯৬৩ সালেই। যখন আমি মাতৃগর্ভে, তখন থেকে শুরু করে আমার জন্মের মূহুর্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিনের লিপিবদ্ধ করা প্রতিটি কথা পড়েছি। বাবার স্বপ্ন, আশা আশঙ্কার স্পষ্ট ছবি, মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। ‘৬৩, ‘৬৪ আর ‘৬৫ সালের লেখা ডায়েরি পড়া হয়ে গিয়েছিল। ‘৬৬ সালের মার্চ পর্যন্ত লেখা ডায়েরিটা পড়েছিলাম। তারপর আর যে কোনও কারণেই হোক আর সেই ডায়েরিটা পড়া হয়নি। এখন এই বৃষ্টিভেজা, অলস দুপুরে হঠাৎ করে কেন জানি না সেই ‘ ৬৬ সালের ডায়েরিটা পড়তে ইচ্ছে করল।

জ্বর হয়েছে বুঝে ক্রোসিন ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। এখন আর গায়ে জ্বর নেই, শরীরটাও ঝরঝরে লাগছে। চোখেও জ্বালা নেই। শুধু মাথাটা একটু ধরে আছে। মাথার দুটো রগে সামান্য ব্যথা আছে। দেরাজ থেকে স্টোররুমের চ্যাপটা পেতলের চাবিটা বের করে দোতলায় নেমে এলাম। দরজাটা খুলতেই সেই পুরনো চাপা গন্ধটা নাকে এসে লাগল। বহুদিনের ধুলো আর বদ্ধ পরিবেশে যেরকম গন্ধ হয়, সেরকম গন্ধ। স্টোররুমের আলোটা জ্বাললাম। একসঙ্গে দুটো একশো ওয়াটের বালব জ্বলে উঠল, সবুজ শেডে। ঘরটা আসলে আমার বাবার ‘স্টাডিরুম’ ছিল। ঠাকুর্দার মতো ব্যবসায় মাথা ছিল না ওনার, তবে ডাক্তারি করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন বাবা। বিলেত থেকে এফ.আর.সি.এস পাশ করে এসেছিলেন। দেশে ফিরে পসার জমে ওঠে ভালই। প্রথমে কলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালে, তারপর প্রাইভেট প্রাকটিস।

স্টোররুমের তিনটে দেওয়াল জুড়ে কাঁচের পাল্লা দেওয়া আলমারি। বইয়ে ঠাসা। মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো নানা রঙের ও আকারের কাঠের বাক্স, স্যুটকেস আর গাদাগুচ্ছের মেডিকেল জার্নাল। ঘরে দুটো জানলা। রঙিন সার্সি বসানো। জানলাদুটো বছরভর বন্ধই থাকে। সেই জানলার পাশেই বড় টেবিলটার ওপর বাবার সেই ১৯৬৬ সালে লেখা ডায়েরিটা রেখেছিলাম। সার্সিগুলো খুলে দিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলাম। বাইরে থেকে গাড়িঘোড়া চলাচলের মৃদু শব্দ আসছে। খোলা জানলা দিয়ে মেঘলা দিনের আলো এসে পড়েছে ঘরে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়াও যেন আসছিল।
ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম সেই ‘৬৬ সালের ১৮ ই মার্চ থেকে। বাবা তাঁর নিজের জবানীতে ডায়েরিতে যা যা লিখেছেন, হুবহু সেটাই তুলে ধরছি।
বাবা লিখছেন………

।। ১৮ ই মার্চ, ১৯৬৬।।
আজ সকালে হঠাৎ বীরেন ফোন করেছিল। বলল আগামীকাল নাকি পার্ক স্ট্রিটের ‘ ওয়াল্টার্সে’ নীলামে যাবে। আমি তো প্রত্যেক রবিবারই যাই। বীরেন জিজ্ঞেস করছিল, ও সরাসরি যাবে না কি আমি ওকে তুলে নিয়ে যাব? আমি বললাম, ওকে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে যাব আমি। আগামীকাল ভুবনবাবুর সাথে কথা বলতে হবে। ওঁর ছেলের অপারেশনটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিয়ে ফেলব আমি। সেন্ট আর্থার্স চ্যারিটি ফান্ড থেকে বোধহয় অপারেশনের জন্য অর্ধেক টাকা যোগাড় করতে পারবেন তিনি। এজন্য তাঁর ছেলের ফটো দরকার। ওদের দপ্তরে জমা দিতে হবে। আবেদনপত্র সমেত। ভুবনবাবুর মতো একটা নীলামের দোকানের কেরানীর পক্ষে দশ হাজার টাকা যোগাড় করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ঠিকই। এরকম মানুষদের সাহায্যের জন্যই সেন্ট আর্থার্সের মতো সংস্থা রয়েছে।

।। ১৯ শে মার্চ, ‘৬৬।।
একটু আগে নীলাম থেকে ফিরলাম। বীরেন একটা উনিশ শতকের ফরাসী কলম কিনেছে, ষাট টাকায়। তেমন সস্তা নয়। তবুও ও খুশিই হয়েছে। প্রথমদিন নীলামে এসে পটাপট দর চড়িয়ে ভেবেছে, ‘আমি কি যেন একটা করলাম!’ আরও বারকয়েক ওখানে গেলে বোধকরি ও আরও বিবেচনা করে দর হাঁকবে। ফেরার পথে বীরেনকে নামিয়ে দিয়ে এলাম। বাড়িতে এসে স্টাডিতে ঢুকে হাতের মোড়কটা খুললাম। আজ নীলাম থেকে একটা ক্যামেরা কিনেছি। বেশ পুরনো জার্মান ক্যামেরা। ১২০ ফরম্যাটের – ‘ ফিশার’। এই কোম্পানি শুনেছিলাম, কয়েক বছর ব্যবসা করেই উঠে যায়। তবে ক্যামেরার সুনাম আছে। আজ নীলামের টেবিলে এটাকে দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি। একশো পঁচিশ টাকায় কিনে ফেললাম। মনে তো হয় সস্তাতেই কিনেছি। ছবি তোলার নেশা আমার বহুদিনের। আমার বাড়িতে অবশ্য অলরেডি একটা ‘জাইসাইকন’ আছে। তবু আরও ক্যামেরা কেনার ইচ্ছে। যেটা আজ নীলাম থেকে কিনলাম, এই ক্যামেরাটি বেশ ভারী। সম্পূর্ণ কালো রঙের, লম্বায় প্রায় ইঞ্চি সাতেক, চওড়ায় প্রায় ইঞ্চি চারেক। লম্বাটে চেহারা। অনেকটা ‘ ইয়াশিকা-৩০’ এর মতো। আগামীকালই একটা ফিল্ম কিনে ভরতে হবে। অজিতের বছর তিনেক বয়স হলো। ওর ছবি তুলেই এটার ওপেনিং করব।
কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল ঘটনাটা…….

।। ২০ মার্চ, ‘ ৬৬।।
আজ হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে হঠাৎই রাস্তায় ভুবনবাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি তখন ছেলের সঙ্গে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে হাঁটছিলেন। আমি ড্রাইভারকে ওঁদের পাশে গাড়িটাকে দাঁড় করাতে বললাম। আমায় দেখে একগাল হেসে তিনি বললেন, ” আপনার বাড়ির ওদিকেই যাচ্ছিলাম। অন্নদা স্টুডিয়োতে। কাল যে বললেন ছেলের ছবি তোলাতে হবে! দেখি ভুবনবাবুর ছেলে পলাশ মুখ টিপে হাসছে। যেন ছবি তোলার কথায় খুব মজা পেয়েছে। আমি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ওঁদের ভেতরে ডাকলাম। বললাম, ” স্টুডিয়োতে ছবি তুলতে হবে না আর। তার চেয়ে বরং আমিই আপনার ছেলের ছবি তুলে দিচ্ছি। বাড়িতে চলুন”।
গাড়িতে বসেই কথাবার্তা বলতে বলতে জানতে পারলাম ভুবনবাবুরা শ্যামপুকুরে থাকেন।
বাড়িতে এসে গতকাল নীলামে কেনা ‘ ফিশার’ ক্যামেরাটা বের করলাম। আর আমার পুরনো ‘ জাইসাইকন’টাও। দুপুরে ওয়ার্ডবয় নবীনকে দিয়ে একটা ‘ইলফোর্ড’ ফিল্ম কিনে আনিয়েছিলাম। সেটাই ভরে ফেললাম নতুন ‘ ফিশার’টায়। জাইসাইকন’টাতেও ফিল্ম ভরা আছে। উদ্দেশ্য, যদি নীলাম থেকে কেনা ‘ ফিশার’টায় ভাল ছবি না ওঠে, তাহলে জাইসাইকনে তোলা ছবিতেই কাজ চালানো যাবে।

ভুবনবাবু আর ওনার ছেলে পলাশকে নিয়ে ছাদে উঠে এলাম। এখনও অনেক আলো আছে দিনের। চৈত্র মাসের শেষ বিকেলের রোদ ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্ব চরাচরে। আকাশ একেবারে পরিষ্কার। পলাশকে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে পর পর দুটো ছবি তুললাম। একটা ছবি তুললাম নতুন ফিশারে, আর একটা ছবি জাইসাইকন’টায়।
ভেবেছিলাম, অজিতের ছবি তোলা দিয়ে নতুন ক্যামেরাটার ওপেনিং করব কিন্তু শেষমেশ ভুবনবাবুর ছেলের ছবি তোলা দিয়েই এর ওপেনিং করলাম।
ছবি তোলার পর ওঁরা বাড়ি চলে গেলেন।

।। ২১ শে মার্চ, ‘৬৬।।
কোত্থেকে যে কি হয়ে যায় বলা যায় না। হঠাৎই আজ সকালে ভুবনবাবু ছুটে এলেন আমার কাছে। কারণ জানতে চাওয়ায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
জানতে পারলাম, আজ ভোরে হঠাৎই ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অসাবধানতাবশত পা পিছলে পড়ে গিয়ে পলাশ গুরুতর আহত হয়েছে। মাথাটা একেবারে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আর.জি.করের এমার্জেন্সিতে ভর্তি করেই আমার কাছে এসেছেন ভুবনবাবু। কি করবেন, বুঝতে পারছেন না!
দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা করেও পলাশকে বাঁচানো গেল না। মাথাটা ফেটেছিল ঠিকই। তবে স্টিচ আর ইঞ্জেকশনগুলো পড়ার পর কন্ডিশনটা স্টেবল হওয়া উচিত ছিল! কিন্তু না, তা আর হলো না! ঠিক দুটো দশে পলাশ মারা গেলো।

আমার আজ আর বেশী কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি বলতে কি পলাশের মৃত্যুর কোনও সঠিক এক্সপ্লানেশন আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু এখন বোধহয় একটু একটু করে বুঝতে পারছি। আমি ডাক্তার হলে কি হবে, সর্বজ্ঞ নই। আমি জানি, পৃথিবীতে সর্বজ্ঞ কেউই হয় না। তাই আমি ডাক্তার হলেও মনে মনে ভূতপ্রেত, কালাযাদু, ডাকিনীবিদ্যা-য় বিশ্বাস করি। পৃথিবীতে সবকিছু যে বিজ্ঞানের আওতায় আসে না, তা আমি জানি এবং মানি।
যাই হোক, বেলা তিনটের মধ্যে পলাশের ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসি। পুত্রহারা ভুবনবাবুর মুখটা দেখার মতো কলিজার জোর আমার ছিল না। আমি নিজেও দুই সন্তানের পিতা। তাই কি করে আরেক পিতার নির্মম দু:খটাকে………..
বাড়িতে ফিরে এসে স্টাডিরুমে ঢুকে নীলাম থেকে সদ্য কেনা সেই ‘ফিশার’ ক্যামেরাটাকে নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম পলাশের কথা। ওর শেষ তোলা ছবি এই ক্যামেরাতেই বন্দি হয়ে রয়েছে! মাত্র তো বারো’টা বসন্ত কাটাল ছেলেটা। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কি খুব দরকার ছিল?…..

স্ক্যালপেল ( অপারেশনের ছুরি) হাতে পেলেই যেমন কাটাছেঁড়া করতে মন চায়, তেমনিই হাতে একটা ক্যামেরা থাকলেই ডান হাতের তর্জনীটা ছটফট করে ওঠে একটা ছবি তোলার জন্য। অজিতের ডায়েরিয়া হয়েছে, বেচারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। তাই ওর ছবি আর তুললাম না। মেয়েটাও এখন স্কুলে। ওরও ছবি তোলা গেল না।
কিন্তু একটা ছবি এই মূহুর্তে তুলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কার ছবি তুলি? ভাবতে ভাবতেই দেখি, একটা পায়রা উড়ে এসে বসল জানলার কার্নিশে। দুধসাদা গায়ের রঙ, ডানায় একটা ধূসর দাগ। এরা দলবেঁধে এই বাড়িরই তিনতলার কোনও একটা ঘরে থাকে। দিনমানে এদের বকম বকম ডাকও শুনতে পাই। হাতের সামনে এমন একটা লিভিং সাবজেক্ট পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পট করে একটা ছবি তুলে নিলাম নতুন সেই ‘ ফিশার’ ক্যামেরাটায়। কেমন ছবি উঠবে কে জানে? পায়রাটা কিছুক্ষণ ডানা ঝাপটে তারপর উড়ে চলে গেল। বোধহয় পাশের বাড়ির কার্নিশে গিয়ে বসল।

পরের দিন হাসপাতালে একটা জটিল অপারেশন ছিল। মোটামুটি সফল হয়েছে। বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে, ফ্রেশ হয়ে নিয়ে একটু ছাদে এলাম বিকেলের হাওয়া খেতে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ছাদের এককোণে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। আরে, ওটা ওখানে কি পড়ে আছে? কাছে গিয়ে দেখি, একটা পায়রা মরে পড়ে আছে। ডানাগুলো ছেঁড়া, মরে কাঠ। ভাল করে কিছুক্ষণ দেখার পর চিনতে পারলাম। ঠিক সেইরকম দুধসাদা পালকগুলো, ডানা’র মাঝখানে একটা ধূসর দাগ! গতকালের সেই পায়রাটা না? যার ছবি তুলেছিলাম! সেটা আজ এইভাবে মরে পড়ে আছে!! আশ্চর্য হলাম। বেড়ালের কাজ কি? কিন্তু তিনতলা বাড়ির ভেতর ছাদে বেড়াল আসবে কোত্থেকে? এখানে বেড়াল আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই। নিচে উঠোনে পড়ে থাকলেও না হয় কথা ছিল। তাছাড়া, বেড়াল এইভাবে গোটা পায়রাটাকে মেরে এখানেই ফেলে রেখে যাবে না। মনে হচ্ছে, কেউ যেন স্রেফ মারবার জন্যই অত সুন্দর পায়রাটার অমন দশা করেছে। আচমকা একটা আশঙ্কা আমার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ঠাণ্ডা একটা স্রোত। ঐ নতুন ক্যামেরাটা দিয়ে পলাশের ছবি তুললাম, পলাশ অমনভাবে মারা গেল!……ঐ একই ক্যামেরা দিয়ে পায়রাটার ছবি তুললাম…..সে’ও এইরকম রহস্যজনকভাবে মারা গেল!…তবে…তবে কি….মন থেকে দূর করতে চাইলাম আশঙ্কাটাকে কিন্তু মনটা কু-ডাক ডেকেই চলল। মনটা আমার জোর করে বলতে চাইল, ‘ না…ওই ক্যামেরাটার নিশ্চয়ই কোনও দোষ আছে…..ভুবনবাব
ুর ছেলে পলাশ সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে মারা যায়নি, কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল…..এই পায়রাটাকেও সে-ই হত্যা করেছে…..এই ক্যামেরাটার নিশ্চয়ই কোনও দোষ আছে…..নইলে পরপর দুজনের ছবি তোলা হল আর দুজনেই অদ্ভুতভাবে মারা গেল! তা কি করে হয়! নিশ্চয়ই ক্যামেরাটার কোনও দোষ আছে……দোষ আছে……ক্যামেরাটার নিশ্চয়ই কোনও দোষ আছে…!’

সারারাত ঘুম হলো না নানারকম দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায়। বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করেছি। ক্যামেরাটার ইতিহাস কি? কোত্থেকে এসেছে ওটা? এই প্রশ্নই বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পুরোপুরি শিওর না হলেও, কেবলই আমার মন বলতে লাগল, ‘ ক্যামেরাটা ভূতুড়ে…. ক্যামেরাটা ভূতুড়ে…. ‘!
ওটাকে কিছুক্ষণ আগে বি.ও.এ.সি’র সবুজ এয়ারব্যাগটায় খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে তুলে রেখে দিয়েছি। ওটাকে আর কোনওদিন ব্যবহার করব না। কোনওদিনও না।

।। ২৩ শে মার্চ, ‘৬৬।।
হাসপাতালে ডিউটি সেরে আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়েছিলাম। ড্রাইভার রামরতনকে গাড়িটা একটু জোরে চালাতে বললাম। গন্তব্য ওয়াল্টার্সের নীলামের দোকান। ‘ ফিশার’ ক্যামেরাটার ইতিহাস না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। ওই ক্যামেরার পেছনে কি কাহিনী থাকতে পারে? আর.জি.কর হাসপাতাল থেকে সোজা পার্ক স্ট্রিট। বেশ অনেকটা পথ। যখন ওয়াল্টার্সের দোকানে ঢুকছি, দিনের আলো প্রায় মরে এসেছে। রাস্তার উল্টোদিকে ফ্লুরিসের কেক পেস্ট্রির দোকান। দোকানের রঙিন সাইনবোর্ডে ছোট ছোট আলো নেচে নেচে যাচ্ছে। দোকানে ঢুকে ভুবনবাবুকে দেখতে পেলাম না। উনি ক’দিনের ছুটি নিয়েছেন কে জানে? একমাত্র ছেলের মৃত্যুশোক কি এত তাড়াতাড়ি ভোলা যায়? ঠিক কতদিন লাগে কারো অস্তিত্বকে মন থেকে মুছে ফেলতে? কে বলতে পারে? দোকানের মালিক রাজন মালহোত্রা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আমি ওনার পুরনো খদ্দের। আমার শুকনো মুখ দেখে উনি কারণটা জানতে চাইলেন। সবিস্তারে সব বললাম ওনাকে। ততক্ষণে টেবিলে এলাচ দেওয়া চা এসে গেছে। ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। রাজনবাবু চিন্তিত মুখে কাপটা তুলে নিয়ে একটা লম্বা চুমুক দিলেন। তারপর বললেন, ” এরকম ব্যাপার! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?”
আমি কোনও জবাব না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলায় রাজনবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর টেবিলের দেরাজ খুলে একটা পুরনো কালো খাতা বের করে, তার থেকে একটা পেজ ছিঁড়ে নিয়ে সামনে রাখা ছোট প্যাডে খসখস করে কি যেন লিখলেন। কাগজটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। বললেন, ” ক্যামেরাটা এই ভদ্রলোকেরই ছিল, যাঁর ঠিকানা দিচ্ছি আপনাকে। ”
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি, লেখা আছে :
‘ পিটার লরেন্স, ১৩২ নং পেমান্টেল স্ট্রিট ‘।
রাস্তাটা চেনাই ছিল। আমার এক বুড়ো গোয়ানিজ পেশেন্ট থাকতেন সান্ডেল স্ট্রিটে। পেমান্টেল স্ট্রিটের ঠিক পাশেই সান্ডেল স্ট্রিট। এলাকাটা নোংরা, ঘিঞ্জি আর গোলকধাঁধার মতো। রাজ্যের সরু সরু গলি এসে মিশেছে একটা আরেকটার সঙ্গে। জায়গাটা রিপন স্ট্রিটের দক্ষিণে, যত রাজ্যের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বাস।
রাজনবাবু বললেন, ” মি: পিটার লরেন্সের বয়স প্রায় আশি। ওনার একমাত্র মেয়ে জোসেফিনা গত বছর একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার পর বাড়ি থেকে তেমন বড় একটা বের হন না। দিন পনেরো আগে পিটার সাহেব হঠাৎই একদিন বিকেলে এসে ওই ক্যামেরাটা আমাদের দিয়ে যান। একটা ছোট কাগজে আমার উদ্দেশ্যে কয়েকটা লাইন লিখে গিয়েছিলেন। এত আঁকাবাঁকা হাতের লেখা, যে পড়তে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘ ক্যামেরাটা বেচে দিন। যা দাম পাবো তাতেই আমি খুশি’।
চিঠিটা পড়ে ভেবেছিলাম, ওনার অবস্থা বোধহয় অত্যন্ত খারাপ। তাই যত তাড়াতাড়ি পেরেছিলাম ক্যামেরাটাকে বেচে ওনাকে সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু এখন আপনি যা ঘটনা শোনালেন, তাতে তো আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। সত্যিই যদি ক্যামেরাটার পেছনে কোনও কাহিনী থেকে থাকে, তাহলে সেটা একমাত্র পিটার সাহেবই জানতে পারেন।”
রাজনবাবু থামলেন।
রাজনবাবুর সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি। ওনার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী চলে গেলাম পিটার লরেন্সের বাড়ি। যিনি ক্যামেরাটার আসল মালিক ছিলেন। ঠিকানা দেখে, লোককে জিজ্ঞেস করে করে ওনার বাড়ি এসে পৌঁছলাম। ভাঙাচোরা একটা পোড়োবাড়ির দোতলায় উনি থাকেন। অপরিষ্কার কামরা। অপর্যাপ্ত আলো আর অসহ্য একটা নাম না জানা জান্তব দুর্গন্ধ পরিবেশটাকে ভারী করে রেখেছে । সারা ফ্ল্যাটটায় আর কারোর সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। বোধহয় ভদ্রলোক একাই থাকেন। বৃদ্ধ পিটার লরেন্স একটা তুলো ওঠা, রঙচটা সোফায় বসে আমায় লক্ষ্য করছিলেন। আমার কাছে সব ঘটনা শুনে তিনি বললেন :
” আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আপনার জীবনে বিপদ ডেকে এনেছি। স্বার্থপরের মতো কাজ করেছি নিজেকে বিপদমুক্ত করতে। ক্যামেরাটা আসলে আমার দাদার ছিল। ডেরেক লরেন্সের”।

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন পিটার লরেন্স। তারপর ফের থেমে থেমে তিনি বলতে লাগলেন, ” আমার দাদা ডেরেক লরেন্স খুব একটা স্বাভাবিক মানুষ ছিল না। চার্চে যেতো না, বাইবেল ছুঁতো না। যখন দাদা’র প্রায় পঁচিশ বছর বয়েস, তখন সে চুপিচুপি একটা ‘ স্যাটানিক ‘ গ্রুপের মেম্বার হলো। গ্রুপটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করত। পরিবারের সকলে দাদা’কে ফেরাবার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। এই ক্যামেরাটা ছিল দাদার ভীষণ প্রিয়। বীভৎস সব বলি’র ছবি তুলেছিল ও ঐ ক্যামেরাটা দিয়েই। শুনেছি, সেই ‘স্যাটানিক ‘ গ্রুপটায় মানুষ, পশুপাখি – সবকিছুর বলি হতো।
স্যাটানিক গ্রুপে যোগ দেবার পর থেকে দাদা আরও বেশী চুপচাপ, আরও বেশী শান্ত হয়ে গেল। এক একসময় মনে হতো বড় বেশী শান্ত! ঝড় উঠবার আগে যেমন সবকিছু শান্ত থাকে।

একদিন ওই শয়তানের ঘাঁটিতে পুলিশ হানা দিল। ডেরেক’কে অ্যারেস্ট করা হলো। ওই গ্রুপটার এগেইনস্টে কেউ একজন পুলিশকে রিপোর্ট দিয়েছিল।”
একটানা বলার পর ক্ষণিকের বিরতি নিলেন পিটার লরেন্স। তাঁর কথা নিষ্পলক দৃষ্টিতে গিলছি আমি। একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ” দাদা’কে ছাড়ানো গেল না। শত চেষ্টাতেও না। অবশেষে কোর্টে কেস উঠল। বিচারে তার ফাঁসির হুকুম হলো। গলায় দড়ি পরানোর ঠিক আগে দাদার সেই কথাটা আজও ভুলিনি। সে বলেছিল – ‘ আমার শরীরের মৃত্যু হতে চলেছে ঠিকই, কিন্তু আমার আত্মা থাকবে। কোনও না কোনও বস্তুর মধ্যে দিয়ে আমি আবার ফিরে আসব। আবার’ও খুন করব। প্রাণনাশের আনন্দের কোনও বিকল্প নেই!”

এইটুকু বলে আবার বিরতি নিলেন পিটার লরেন্স। ওনার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। পাশের র্যাক থেকে জলের জগটা পেড়ে, এক নিশ্বাসে অনেকটা জল খেয়ে নিলেন তিনি। নোংরা, মলিন শার্টের হাতায় ঠোঁট দুটো মুছে নিয়ে বললেন – ” আপনি ওসবে বিশ্বাস করেন কি না জানি না, তবে টু টেল ইউ দ্য ট্রুথ, আই থিঙ্ক দ্যাট ক্যামেরা ইজ পোজেজড। ডেরেকের প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা ওই ক্যামেরায় রয়েছে। আমি ওটা দিয়ে কোনওদিন কারোর ছবি তুলিনি। বাড়িতে এমনিই পড়েছিল। গত বছর হঠাৎই একদিন আমার মেয়ে জোসেফিনা ওর এক বান্ধবীকে দিয়ে নিজের ছবি তোলায় ঐ ক্যামেরা দিয়ে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। পরে জোসেফিনা মারা যাবার পর আমি ওর সেই বান্ধবীর কাছ থেকে কথায় কথায় সেটা জানতে পারি। তাই তারপরেই আমি ক্যামেরাটা নীলামের দোকানে দিয়ে দিই…….”
সেদিন রাতে পিটার লরেন্সের বাড়ি থেকে ফিরে আর স্টাডিরুমে ঢুকিনি। সবুজ বি.ও.এ.সি’র এয়ারব্যাগটার দিকে তাকাবার ইচ্ছে ছিল না আমার। তবে ক্যামেরাটা আমি বেচব না। অন্য কারো জীবনে কালো ছায়া নেমে আসুক, আমি চাই না।
আমার লেখা এই ডায়েরী সরমা এবং অজিত বড় হয়ে পড়বে আশা করি। তখন ওরাও ক্যামেরাটার সম্পর্কে জানবে। সব পড়ার পর আমার মনে হয় ওরা ক্যামেরাটাকে নিছক কৌতূহলে ব্যবহার করবে না, জোসেফিনার মতো।
বাবার লেখা ১৯৬৬ সালের সেই ডায়েরি এখানেই শেষ।

এই পর্যন্ত পড়ে আমি থামলাম। মাথার দুপাশটা আবার দপদপ করছে। ক্রোসিনের প্রভাব কি তবে কমে এলো? কপালে হাত দিয়ে দেখলাম ঘাম জমেছে কপালে। আমি অবাক হয়ে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবছিলাম অনেক কথা – ওই ক্যামেরাটা কি তাহলে এখনো রয়েছে এই ঘরে ? বাবা কেন ক্যামেরাটাকে নষ্ট করে ফেললেন না? বাবা কি ভয় পেয়েছিলেন? এতগুলো ভাবনা চিন্তা আর প্রশ্ন মনে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই পেছন ফিরে মেঝের দিকে তাকাতেই সেই কবেকার পুরনো সবুজ বি.ও.এ.সি’র এয়ারব্যাগটা চোখে পড়ল। ওর মধ্যেই কি এখনো রয়েছে সেই ক্যামেরাটা?
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে এগিয়ে গেলাম ডাঁই করা পুরনো জিনিসপত্রগুলোর কাছে। সবুজ বি.ও.এ.সি.’র ব্যাগটা ওগুলোর মাঝেই পড়ে ছিল। ব্যাগটায় তালা লাগানো ছিল না। চেন টেনে খুলতেই বেশ কিছু ওষুধের বিজ্ঞাপনের বোর্ডের নিচে একটা লম্বাটে প্যাকেট দেখতে পেলাম। পুরনো ছেঁড়া খবরের কাগজে মোড়া। জিনিসটা তুলতে গিয়ে টের পেলাম বেশ ভারী। প্যাকেটটা খুললাম। খুলতেই চোখে পড়ল জিনিসটা। একটা ‘ ফিশার’ ক্যামেরা। দেখলে তো মনে হয় এখনও দিব্যি চলে। হঠাৎই মাথায় প্রশ্নটা এলো, ডায়েরীর ঘটনাগুলো বাবার’ই মনের ভুল নয়তো? পলাশের মৃত্যু, পায়রাটার মৃত্যু – সবটাই হয়তো কাকতালীয়। জোসেফিনার মৃত্যুটাও নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল হয়তো!
কিন্তু বাবা তো বেশ কম কথার মানুষ ছিলেন। মনগড়া ঘটনার কোনও মূল্য ওনার কাছে ছিল না। তবে কি……..
মাথায় একটা বুদ্ধি বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল। একটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ক্যামেরাটাকে আমার শোবার ঘরে নিয়ে এলাম। ফিল্ম ডায়ালে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ‘ দুই’ লেখা রয়েছে। অর্থাৎ সেই ১৯৬৬ সালে তোলা সেই ভুবনবাবুর ছেলে পলাশ আর সেই পায়রাটার ছবি রয়ে গেছে ভেতরে। ফিল্মটা বোধহয় অকেজো হয়ে গেছে। সেই দুটো ফটো তোলার পর আর ব্যবহারই হয়নি ক্যামেরাটা।
ক্যামেরাটাকে খাটের ওপর রেখে নিকনের ব্যাগটা থেকে স্টিলজ-এর স্ট্যান্ডটা বের করলাম। ক্যামেরাটাকে তার ওপর বসিয়ে সেলফ-টাইমারের বোতামটায় দম দিয়ে দিলাম। আর তারপরে শাটারটা টিপলাম। এভাবে, ফটোগ্রাফার ছাড়াই আপনা আপনিই ছবি ওঠে।
হঠাৎ কানে এল কির-র-র-র-কির-র-র-র শব্দ। শাটারটা পড়তে আর বড়জোর সেকেন্ড ছয়েক বাকি! যেন র্যাটল স্নেকের গা হিম করা ঝুমঝুমির শব্দ। লেন্সটা সোজা, নিজের নিরেট কালো শরীরের দিকেই তাক করা অবস্থায় রাখা। ক্যামেরাটা যেন নিজেই নিজের ছবি তুলছে – এই অবস্থায় রাখলাম ওটাকে। ক্যামেরাটাকে বসিয়েছি আয়নার সামনে যাতে ওর প্রতিবিম্বটা আয়নায় পড়ে। নিজে দাঁড়িয়ে গেলাম ঘরের এক কোণায়। মন বলছে আজ যদি এই হতচ্ছাড়া শয়তানের যন্ত্রটার মনে প্রতিহিংসা জাগে, হত্যার নেশা জাগে, তো ব্যাটা নিজেই নিজেকে মারুক!
খুট! চিড়-বিড়-বিড়-ড়-ড়-ড়-ড়! দুম! তিনটে শব্দ পরপর হলো। অবিশ্বাস্য কান্ড!
খুট শব্দ করে শাটারটা পড়ল।
চিড়-বিড়-ড়-ড়! আয়নায় আড়াআড়িভাবে একটা চিড় ধরল! ফেটে গেল!
দুম! বিস্ফোরনের শব্দটা এল ক্যামেরার ভেতর থেকে। জানি, হয়তো কান পাতলে মরে ভূত হয়ে যাওয়া ডেরেকের চাপা আর্তনাদও শুনতে পেতাম। ঠিক তারপর……
ক্যামেরার লেন্সটায় ফাটল ধরল। এক্সপোজার, ফোকাস রিং খসে পড়ল মাটিতে। পেছনের ডালাটা খুলে গিয়ে ফিল্মটা বেরিয়ে পড়ল – পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়ার মতো। মৃত্যু হলো যেন ওটার। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার।

ঘটনার কয়েকদিন পর একটা ফ্যাশন অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। নিকনের ব্যাগটা খুলেই আঁতকে উঠলাম। আমার সাধের দামী স্টিলের স্ট্যান্ডটা একেবারে বেঁকেচুরে গেছে। স্ক্রুগুলোতেও মরচে পড়েছে। ঝকঝকে, এই সেদিন কেনা ক্রোমিয়াম স্টিলের এই মজবুত স্ট্যান্ডটা যে কিভাবে………
আসলে সেদিন ভুলটা ছিল আমারই। এবার মনে পড়ল আমার। সেই ভূতুড়ে ক্যামেরাটাকে এই স্ট্যান্ডের ওপরে তুলেই মরণ শাটারটা টিপেছিলাম। ক্যামেরাটা তো নষ্ট হলোই – সেই সাথে আমার ওই সাধের স্ট্যান্ডটাও অকেজো হয়ে গেল। চিরকালের জন্য। কারণ, শাটারটা পড়ার সময়, আয়নায় ক্যামেরার সাথে সাথে স্ট্যান্ডটারও প্রতিবিম্ব পড়েছিল। তাই ক্যামেরায় ওটারও ছবি উঠে গিয়েছিল আর যার ফল, এখন দেখতেই পাচ্ছি!!!
( সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত