শীতকালে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে সুমন। পুবের লম্বা বারান্দায় সকালের রোদ্দুর ভারী মিষ্টি লাগে। উঠবার সময় সূর্য বাগানের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে অনেক রোদ্দুরের বর্শা ছুঁড়ে দেয়। বই থেকে মুখ তুলে সমু এক-একবার দেখে নেয়।
এখন কিন্তু বর্ষাকাল। পড়ার ঘরে বসেই পড়ছিল সুমন। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে টেবিলে বই রেখে পড়ছিল। সেই খাটেই অন্য পাশে রুনি বসেছে। বাচ্চা মেয়ে তো। এখনো স্বরবর্ণ কাহাকে বলে, ব্যঞ্জনবর্ণ কাহাকে বলে- এই সব পড়ে। বর্ষায় বারান্দা স্যাঁতসেতে হয়ে থাকে বলে ঘরে পড়তে বসলেও খোলা দরজা দিয়ে পুবের বাগানের অনেকখানি দেখা যায়। তাই তেমন খারাপ লাগে না সুমনের।
সুমন পড়ছিল- উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত সব থেকে দ্রুতগামী যান ছিল ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। তারপর এল ট্রেন। এই লাইন দুটো পড়তে পড়তেই কাণ্ডটা ঘটে গেল। ট্রেনের হুইসেল শুনে বাগানের দিকে তাকাল। বাগানের ওপারে রেললাইন।
সুমন বাগানের গাছ আর ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল, সকাল সাড়ে নটার ট্রেন যাচ্ছে এবং তার ইঞ্জিনের কয়েক হাত মাত্র সামনে দিয়ে ছুটছে দাদার ঘোড়াটা। একবার বাগানের গাছের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে ঘোড়াটা, আবার তখনই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। রেল লাইনের মধ্যিখান দিয়ে চওড়া কাঠের ধাপ, বড় বড় পাথরের টুকরো আর খাঁজ-খোঁজ মাড়িয়ে ঘোড়াটা ছুটছে। ট্রেন থামাচ্ছে না ড্রাইভার। কেবল তীক্ষ্ন, কর্কশ, বাঁশি বাজাচ্ছে ঘনঘন।
ছোট কাকা ছিল অন্য ঘরে। পুবের বারান্দায় লাফিয়ে পড়ে একটা খালি বালতি পায়ের ধাক্কায় উলটে দিল। তারপর উঠোন পেরিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গেল রেললাইনের দিকে। সুমন, রুনি এবং বাড়ির অন্য সবাই এসে দাঁড়াল পুবের বারান্দায়। সবাই বুঝতে পারল, কী হয়েছে। সবার মন খারাপ হয়ে গেল।
উঁচু রেললাইনের দুপাশের ঢালু জমিতে কচি ঘাস। মাঠে জল আসায় ঘোড়াটা ভাল ঘাস খেতে পায় না। তাই আজ খুব সকালে রেললাইনের ঢালে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে এসেছিল ছোট কাকা। ঘোড়ার পায়ে দড়ি বাঁধা ছিল। দড়ির অন্য প্রান্তে বাঁধা একটা খোঁটা মাটিতে পুঁতে দিয়ে এসেছিল। আশা করেছিল, ঘোড়াটা পেট ভরে কচি ঘাস খাবে। ঘোড়াটাকে ওখানে রেখে বাড়ি ফিরে এসে ছোট কাকা বলেছিল, ট্রেন এলে ঘোড়াটা ভয় পাবে না তো!
ছোট কাকা যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। ভীষণ গর্জন করে ট্রেন আসছে দেখে ঘোড়াটা ভয়ে পাগলা হয়ে গেছে। দড়ি ছিঁড়ে বোকার মতন লাফিয়ে উঠে গেছে রেললাইনের ওপর। এখন ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতন ট্রেনের ইঞ্জিনের আগে-আগে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ওর জীবনে এটাই সম্ভবত দ্রুততম দৌড়।
লম্বা লাফ দিয়ে ঘোড়াটা ডাইনে অথবা বাঁয়ে ঢালু জমিতে গিয়ে পড়তে পারে। তাহলে রেললাইনের মধ্যিখানে মুখ থুবড়ে পড়ে ট্রেনের তলায় যাবে না। কিন্তু ট্রেনটার গতি, গর্জন, ঝাঁঝালো বাঁশি-সব মিলে ঘোড়াটাকে খেপিয়ে তুলেছে। মাথা ঠান্ডা করে কিছু করতে পারছে না। শুধু ছটছে, ছুটছে।
দাদার ঘোড়াটা বুড়ো। মোটেই তেজী নয়। তবে ঠাকুরদাকে পিঠে বসিয়ে দূরে-দূরে নিয়ে যায়। দাদা তো প্রায় অন্ধ। আবছা আলো ছানা প্রায় কিছুই দেখতে পান না। অথচ অন্য গ্রামে প্রজাদের বাড়ি যান দাদা। ঘোড়াটা ঠিক জানে, কোথায়-কোথায় যেতে হবে। সন্ধের দিকে দাদাকে পিঠে করে বাড়ি ফিরে আসে। আস্তে-আস্তে চলে, ছোটাছুটি করে না। অথচ আজ ঘোড়াটা ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ছুটে গেল, যেন পক্ষীরাজ।
দাদা ঘর থেকে উঠে এসে পুবের বারান্দায় একটা মোড়ায় বসেছেন অসহায়ের মতন। রুনি তার কোলের মধ্যে সেঁধিয়ে আছে। সুমনের স্কুলে যাওয়া হল না আজ। সূর্য মাথার ওপর উঠে পশ্চিমে খানিক ঢলে পড়ল। তখন ফিরে এল ছোট কাকা। ঘোড়াটা সঙ্গে আছে। ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে মরে যায়নি। তবে সামনের একটা পা ভেঙে গেছে।
ছোট কাকা জানাল, মাইল দুই ইঞ্জিনের আগে-আগে দৌড়ে ঘোড়াটা এক সময় লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। ঢালু জমি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় পাশের ঝিলের মধ্যে। বর্ষায় রেল লাইনের পাশের ঝিল কানায়-কানায় জলে ভরে গেছে। ছোট কাকা সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, ঘোড়াটা ঝিলের জলে সাঁতার কাটছে, হাবুডুবু খাচ্ছে।
সুমন দেখল, ছোট কাকারও পায়ের কয়েক জায়গা ছড়ে গেছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে। গেঞ্জিটা না ছিঁড়লেও কাপড় ছিঁড়ে ফালাফালা।
সামনের ডান পা উঁচু করে রেখেছে ঘোড়াটা। মাটিতে ছোঁয়াচ্ছে না। আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে খড় বিছিয়ে ছোট কাকা তাকে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিছুতেই শুলো না। দাঁড়িয়েই রইল এক পা তুলে। দাদা এসে অনেকক্ষণ পিঠে গলায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর একটু চেষ্টা করতেই ঘোড়াটা শুয়ে পড়ল বিছানো খড়ের ওপর। সামনের ডান পা গুটোনোই রইল। বাকী তিন পা ছড়িয়ে দিল। ভাঙা পা এর মধ্যেই ফুলে উঠেছে। রক্ত চোয়াচ্ছে না অবশ্য। ঘোড়াটা দারুণ হাঁপাচ্ছিল, নিশ্বাস টানছিল খুব জোরে-জোরে, পেট ফুলে-ফুলে উঠছিল।
সুমন বুঝতে পারছিল, ঘোড়াটার খুব কষ্ট হচ্ছে। মুখের কাছে বিচালি দেওয়া হয়েছিল। খেল না। কয়েকবার শুধু বিচালিতে মুখ ঘষল।
সারাদিন সবাই বারবার আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়াটাকে দেখে আসছিল। রুনিকে নিয়ে সুমনও গেল কয়েকবার। একবার তাদের মনে হল, ঘোড়াটা ঘুমিয়ে আছে। তবে ঘুম না-ও হতে পারে, হয়ত বেহুঁশ।
সন্ধের খানিক আগে ছোট কাকা দূর থেকে পশুর ডাক্তার নিয়ে এল। ডাক্তারবাবু ঘোড়াটার ভাঙা গুটোনো পা জোরে টেনে সোজা করে দিলেন। যন্ত্রণায় এত ছটফট করছিল ঘোড়াটা যে, তখনই মরে যাবে মনে হল। ভাঙা পায়ে কাঠের টুকরো বেঁধে ব্যাণ্ডেজ করে দিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর ইঞ্জেকশন দিলেন। আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে বাহিরে বসে দাদার সঙ্গে গল্প করলেন আধ ঘন্টা। আবার আস্তাবলে ঢুকে বিচালির সঙ্গে কী-সব মিশিয়ে ঘোড়াটাকে খেতে দিলেন। ঘোড়াটা প্রথমে মুখ সরিয়ে নিলেও পরে আস্তে-আস্তে খেতে শুরু করল।
যাবার সময় ডাক্তারবাবু জানিয়ে গেলেন, দাদার ঘোড়া মরবে না, সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে সামনের ডান পায়ে আগের মতন আর জোর পাবে না। তেমন ছুটতে পারবে না। ভাবনা কমে গেল সবার। যাক, মরবে না তো! জোরে দৌড়তে না-ই বা পারল। দাদাকে পিঠে নিয়ে ছোটাছুটির দরকার কী?
ডাক্তারবাবু চলে যাবার অল্প পরেই বৃষ্টি নামল। ডাক্তারবাবু সাইকেলে চেপে এসেছিলেন। ফিরবার পথে নিশ্চয়ই ভিজে যাবেন। সাইকেলের রডের সঙ্গে ছাতা বাঁধা ছিল, সুমন দেখেছে। ছাতা খুললে উলটে যাবে। যা জোর হাওয়া দিচ্ছে!
সুমন খাটে পা ঝুলিয়ে বসে। সামনের টেবিলে ভূগোলবইয়ের খোলা পাতা। সকাল থেকে বইখানা খোলা রয়েছে। আলো জ্বালা হয়েছে ঘরে। বাদলা পোকা উড়ে এসে পড়েছে বইয়ের পাতায়। ভূগোলের মাস্টার মশাইয়ের কথাটা হঠাত্ মনে পড়ে গেল সুমন। উনিশ শতকের আগে সব থেকে দ্রুতগামী যান ছিল ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। স্টিম ইঞ্জিন সব বদলে দিল। ঘোড়া প্রথম হেরে গেল ট্রেনের কাছে।
রুনি ঘরে এল। পড়তে বসবে। রুনিকে দেখেই সুমন মরুব্বী-চালে বলল, “দাদার ঘোড়ার পা কে ভেঙেছে জানিস?” রুনি চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল, “কে?” “জর্জ স্টিফেনসন। স্টিফেনসন রেলগাড়ি না বানালে কি আজ ঠাকুরদার ঘোড়ার পা ভাঙত?”