এক নজরে নীলুর ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি।আজ সে অনেক দূরে, যে কিনা একদিন সব ছেড়েই আমার কাছে ছুটে এসেছিলো।আবার তুম্পাকে আমার কাছে রেখে আমাকেও ছেড়ে চলে গেলো।নীলুর জীবনের বিনিময়ে তুম্পা এই দুনিয়ার আলো দেখলো। তুম্পা যখন নীলুর গর্ভে তখন বলেছিলাম, শোনো তোমার গর্ভে যে বাচ্চাটা আছে, ওটাই আমার পৃথিবী। তোমার কাছে আর কিছু চাই না শুধু ওই বাচ্চাটা ছাড়া। নীলু আমার কথা রেখেছিলো। কিন্তু নিজের জীবনটাকে কুরবানী করে।
ডাক্তার যখন নীলুকে অপারেশন থ্রিয়েটারে নীলুকে বলেছিলো, হয় বাচ্চা বাচবে না হয় আপনি, তখন বাচ্চাটাকেই আমার কাছে রেখে চলে গেলো।
বড্ড অভিমান ওর আমি আমার পৃথিবী চলেছিলাম কিন্তু নীলু ছিলো আমার সেই পৃথিবী দেখার আলো। সেটা বোঝলো না আমার কথা রাখতে নিজেই চলে গেলো।
“আব্বু আব্বু ও আব্বু”
দৌড়ে এসে ডাকতে ডাকতে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
-আব্বু আব্বু ছবিটা কার?
ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমার গলা জড়িয়ে আলতো আলতো কণ্ঠে বললো।
-ওটা?ওটা তোমার মামুনি আম্মু
আমি তুম্পার গালে চুমু দিয়ে বললাম।
-মামুনি কোথায় আব্বু? আমাকে তো একটুও দেখতে আসে না।
জানো আব্বু সবার মামুনি আসে কিন্তু আমার মামুনি আসে না।
মামুনি কি আমার উপর রাগ করেছে আব্বু?
তুম্পা আমার গলা ধরে আল্লাদি কণ্ঠে বললো।
-না আম্মু তোমার মামুনি রাগ করে নি ঠিক একদিন আসবে তোমার কাছে।
তোমার মত লক্ষি মেয়ের কাছে না এসে কি পারে বলো?
জানি আসবে না, ওর খুব অভিমান হয়েছে আমার উপর।
চলে গেছে অনেক দুরে।
তবুও মিথ্যা সান্তনা দিলাম মেয়েটাকে।
-না আসবে না! আব্বু মামুনি খুব পচা আমাকে একটুও ভালোবাসে না।
আমার সাথে খেলা করে না। তুমি অনেক ভালো আমাকে কত্তো ভালোবাসো, আমাকে আদর করো, কিন্তু মামুনি করে না। মামুনি খুব পচা।
>ঠিক বলেছে তুম্পা তুমি অনেক পচা। আমাকে আমার পৃথিবী দিতে গিয়ে নিজেই চলে গেলে। একটা বারও ভাবলে না তোমাকে ছাড়া আমি আমার পৃথিবীকে দেখবো কি করে?
তুমি যে আমার পৃথিবী দেখার আলো।
কি করে দেখবো আমি আমার পৃথিবী?
কই উওর দেও নীলু?
নীলুর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম মনে মনে।
-মামুনি এখন তুমি ঘুমাও অনেক রাত হয়েছে।
মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বললাম।
-না আমি ঘুমাবো না!
প্রতিবাদী সুরে বললো।
-কেন মামুনি?
-আমি ঘুমিয়ে দিয়ে তুমি ঘুমাও না সারারাত মামুনির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকো।
>ওর কথা শুনে একটু অবাকই হলাম।
তার মানে তুম্পাও ঘুমায় না।
বোঝলাম ছোট হলেও বুন্ধিটা বেশ হয়েছে।
-মামুনিকে এতোই ভালোবাসো তাইলে মামুনি নিয়ে আসো না কেন আব্বু? যাও না মামুনিকে নিয়ে এসো।
আমার না খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
মামুনির আদর খেতে ইচ্ছে করে।
বলেই ঠোট বেকিয়ে কাদতে শুরু করলো। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ
-আমার লক্ষি মামুনি কাদে না সোনা।
আমি ওকে আদর করতে করতে বললাম।
-তাইলে দেও না আব্বু মামুনিকে এনে।
>ওর কথা শুনে নিজের চোখে পানি আবিষ্কার করলাম। যদি পারতাম ঠিক এনে দিতাম রে তোকে তোর মামুনি কে!
কিন্তু…………
মেয়েটাকে কোলে করে ঘুমিয়ে দিলাম। অঝোর নয়নে পানি ঝড়ছে চোখের কিনার দিয়ে।
তুম্পা আমার পৃথিবী।
যাকে নিয়েই আমার বেচে থাকা।
বয়স মাএ ৬ বছর।সব বোঝে এই বয়সেই, ঠিক নীলুর মত। আমার সাথে রাগ,জগড়া,অভিমান সব সব করে। ওকে আকড়েই বেচে আছি আমি।
ঘুমাচ্ছে!!!!!!!!
সকালে উঠেই বায়না ধরবে,
আব্বু আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো না।
ওকে যদি না নিয়ে যাই সে কি অভিমান আমার উপর।
সারাদিন মুখটা হাফ ফুলে বসে থাকে।
যেমনটা আমার নীলু করতো।
>মোয়াজ্জিম মসজিদের মাইকে ফজরের আজান দিলো। অজু করে নামাজে দাড়াবো তখনি কে যেন পান্জাবীর পিছনটায় টানছে।
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তুম্পা।
-মামুনি তুমি উঠে পড়েছো?
-তুমি আমাকে ডাকলে না কেন?
আমার দিকে অভিমানের নজরে তাকিয়ে বললো।
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে বললাম,
তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে মামুনি।
>বোঝলাম খুব রাগ করেছে।
মেয়েটা সারারাত ঘুমায়নি।রাতে যখন আমি ওকে কোলে করে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম, তখন তুম্পা ঘুমানোর ভান করে ছিলো আমার কোলে।
মাঝে মাঝে চোখমিটমিট করে দেখছিলো।
এমন একটা ভাব নিয়ে ছিলো মনে হবে যে ও ঘুমিয়েই আছে।
ওর এই পাগলামি দেখে খুব হাসি পাচ্ছিলো।
ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
জানি না আবার কখন উঠেছে।
মনে হয়, আমি যখন অজু করতে গেছিলাম তখনি উঠছে।
>নামাজ শেষ করে রি রিকশা নিয়ে বের হবো তখনি পিছন থেকে ডেকে বললো,
“আব্বু ”
আমি জানি ও কি বলবে প্রতিদিনের মত আজকেও বলবে,
“আব্বু আব্বু আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে? ”
তাই ওর প্রশ্নটা না শুনেই বললাম,
না মামুনি, তোমার যাওয়া হবে না ”
আমার কথা শুনে তুম্পা দাদির কাছে চলে গেলো।
গিয়ে বললো,
“দাদি দাদি আব্বু না খুব খুব পচা।
আমাকে আব্বু সাথে নিয়েই যায় না। ”
ওর কথা শুনে মা ওকে আদর করে দিলো।
আমি হাসতে হাসতে বেড়িয়ে পড়লাম!
শহুরের ইট পাথরের রাস্তায়, যেখানে কেউ কারও না! সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে।
এটাই আমার জীবিকা নির্বাহের চাবিকাঠি।
কথায় আছে,
“অর্থ চলবে তো পেটে ভাত পড়বে,অর্থ নেই পেটে ভাত পরবে না ”
আমারও ঠিক তেমনি
>সময়ের সাথে সাথে মেয়েটাও বড় হতে লাগলো।
ইস্কুলে (স্কুলে)ভর্তি করে দিলাম।
১ক্লাশ পাশ করলো।
একদিন মাষ্টার মশায় ডাকলো।
মনে মধ্যে কেমন যেন করলো।
তুম্পা কোন ভুল করে নি তো?
মাষ্টার আমাকে ডেকে চেয়ারে বসিয়ে বললো।
-সজীব মিয়া।
-জ্বি স্যার।
-এইবার পরিক্ষায় রচনা এসেছিলো “মা-বাবা”
তোমার তুম্পা কি লেখেছে জানো?
-স্যার কোন ভুল করেছে?
আসলে খুব ছোট তো তাই ভুল করেছে ওকে কিছু বলবেন না!
-আরে আগে তো শুনবে! ভালো করে শোনো!
“”বইয়ের লেখা রচনাটা পড়েছি। কিন্তু আমার তো মা নেই মাকে নিয়ে লেখবো কি করে?আমার মামুমি আমাদের উপর রাগ করেছে।
তবে আমার বাবা আছে।
খুব পচা।আমাকে এত্তোগুলা ভালোবাসে।
তবে আমাকে নিয়ে বের হয় না।
আমার মামুনি অনেক পচা। তাকে কখনো দেখি নি শুধু ছবিতে দেখেছি।
আমাকে একদিনও দেখতে আসে না, আমাকে আদর করে না।
খুব ইচ্ছা করে মামুনির আদর খেতে।
আমার আব্বু প্রতিদিন বলে, তোমার মামুনি আসবে সোনা।
তবুও আসে না কেন?
আমাকে আব্বু সারারাত কোলে করে নিয়ে থাকে।
খুব ভালোবাসে তো তাই।
তবে আমি আব্বুকে একটুও ভালোবাসি না।
আব্বু আর আম্মু দুইজন দুইজনাকে অনেক ভালোবাসতো। তাইতো অভিমান করে চলে গেছে আম্মু।
এখন যদি আব্বুকে আমি খুব ভালোবাসি তখন যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন?
তাই আমি আব্বুকে ভালোবাসি না, আব্বুই আমাকে ভালোবাসে।
আব্বুর সব কষ্ট আমি বুঝি, আমি যে আব্বুর মা!
আমাকে মা বলেই ডাকে।”_______________ তুম্পা”
>>তুম্পার লেখা রচনাটা শুনে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।
মুছতে মুছতে বাইরে আসলাম।
দুর থেকে দেখলাম সবাই খেলছে, কিন্তু তুম্পা রুমে বসে আছে একা!
আমাকে দেখা মাএ দৌড়ে এসে কোলে উঠলো।
-আব্বু আব্বু তুমি কখন এলে?
আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো তাই না আব্বু?
জানো আব্বু তোমাকেও খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো।
চলো না আব্বু তোমার সাথে যাবো।
বলেই শক্ত করে ধরলো।
-হুমমম মামুনিটাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো তাই তো আসলাম।
-আব্বু আব্বু তুমি কাদছো কেন?
চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।
-কখনো কাদবে না তুমি বুঝলে?
আমার দিকে শাসনের চোখে তাকালো, যেমনটা নীলু তাকাতো।
.
>>>রাতে প্রচুর জ্বর আসলো। রোদ আর বৃষ্টি শরীরের বসে গেছে।
তাই…….
রিকশাটা নিয়ে বের হবো তখনি,
-আব্বু আজকে না গেলে হয় না?
-না মামুনি না গেলে হবে না!
বলেই ওকে আদর করে দিলাম।
-তোমার তো অনেক জ্বর।
-কিছু হবে না রে মা।
বের হলাম।
>যাওয়ার একটুর ইচ্ছা ছিলো না। যদি না বের হই মা আর বাচ্চাটা না খেয়েই থাকবে। ঘরে একমুটো চাল নেই।
শরীরে শক্তি পাচ্ছি না।
রাতে টলতে টলতে কোন……..
-জ্ঞান ফিরে দেখি পাশে তুম্পা।
কান্না করছে।
-কি হইছে রে মা?
-একটা কথাও বলবে না তুমি একটুও ভালো না খুব পচা অনেক পচা, এত্তো গুলো পচা।
তোমার কাছে থাকবো না, মামুনির মত আমিও চলে যাবো।
কথাটা শুনেই ওর মুখ চেপে ধরলাম।
-এমন কথা বলে না মা।
তুই যে আমার পৃথিবী তোকে ছাড়া কি নিয়ে থাকবো রে?
বলেই কেদে দিলাম।
তুম্পাও কাদছে আর আমিও।
-তুমি সকালে আমার কথা শুনলে না কেন?
কান্না কণ্ঠে বললো।
-না গেলে খাবি কি?
-একদিন না খেয়ে থাকলে কি হবে?
নাক টানতে টানতে বললো।
তোমার কিছু হলে আমি কি নিয়ে থাকবো?
-আমার কিছু হবে না, তুই তো আছিস!
>>তুম্পা আমার বুকে মাথা রেখে আছে।
বয়স মাএ ১৩ এই বয়সেই সব বোঝতে শিখেছে।
আমি দেখে কষ্ট পাই বলে নীলুর ছবিটা লুকিয়ে রেখেছে।
যখন বলি একটু দেখবো
তখন তুম্পা বলে, আমাকে তোমার ভালো লাগে না? আমাকেই দেখো বলেই মুখটা বেকিয়ে নেয়।
রাতে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমায়।
মাঝে মাঝে দেখি বুকটা ভিজে গেছে। সাধারণ পানিতে নয় ওর চোখের পানিতে।
ও আমার বেচে থাকার অহংকার।
আমার পৃথিবী !
ওকে ছাড়া কোন কিছু ভাবলে সেটা শুধুই আমার মরণ।
গল্পের বিষয়:
গল্প