নিশি, আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভাবছে এই অদ্ভুত নামটা তার মা – বাবা কেন রেখেছেন ! নিশি মানে রাত্রি। আর রাত্রি আঁধার ঘেরা। আর আঁধার তো কালো হয়। কিন্তু সে ফর্সা। কোন ভাবেই মেলাতে পারছে না সে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, চিরুনি হাতে নিল সে। মাঝ বরাবর সিঁথি করে তার লম্বা চুলগুলো আঁচড়ালো। তারপর পড়ার টেবিল এর কলমদানি থেকে কেচি টা নিয়ে, একবার একটি মুঠো করে দু’পাশ থেকে কাধ বরাবর ধরে কেটে দিল। আয়নার সামনে কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে থেকে লাইট টা অফ করে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয় কাঁদতে লাগলো। তার শখের বড় চুলগুলোর জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার এখন। অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুমিয়ে নিশি স্বপ্নের দেশে গেল। এক বিরাট মাঠ। সে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে তার সববয়সী কিছু ছেলে মেয়ে। সবাই তের -চৌদ্দ বছর এর। সবার পেছনে একটি করে ডানা। নিশি একটু তাকিয়ে বুঝল সে পরীর দেশে। সবাই নিশি কে ইশারায় ডাকছে। সে এক পা দু’পা করে আগাল। এরপর সবার সাথে উড়তে শুরু করল। সে মহা আনন্দে উড়ছে।
হঠাৎ কিসের শব্দে তার স্বপ্ন ভেঙে গেল। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো সে কোথায়। সে অনুভব করল সে তার বিছানায়। কলিং বেলটা বেজে চলেছে। হুরমুর করে উঠে দৌঁড় দিল। আজ সে নিশ্চিত বকা খাবে, মা এসেছে।
দরজা খুলে দিতেই নিশির মা সালমা বেগম ঘরে ঢুকে চোখ বড় বড় করে নিশির দিকে তাকিয়ে আছেন। নিশি বুঝতে পারছে না মা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
সালমা বেগম বললেন, পার্লারে গেলে কার সাথে তুমি?
মার কথায় তার হুশ ফিরে আসল। সে যে চুল কেটেছে বিকেলে সে ভুলেই গিয়েছে। সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মাথা নিচু করে রুমে চলে গেল।
সালমা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তিনি সোজা রুমে চলে গেলেন। মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছেন আর ভাবছেন মেয়ের সাথে কিভাবে গুছিয়ে কথা বলবেন। মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। নিজের একটা জগৎ হচ্ছে। কার সাথে মিশছে কি করছে খোঁজ খবর রাখতে হবে।
আজ অফিসে অনেক ধকল গেছে। শরীরটাও ভাল নেই তেমন। বয়স হচ্ছে তার একটা প্রভাব তো আছেই। আগের মত চাইলেই সব করা যায় না। এসব ভেবে তিনি বের হলেন। নিশিকে নাস্তা করতে আসতে বললেন।
দুজন মুখোমুখি ডায়নিং টেবিল- এ।
নিশির বাটিতে নুডুলস দেয়া হয়েছে। এটা তার খুব পছন্দের খাবার। সে নুডুলস খাচ্ছে আনমনে।
সালমা বেগম নিয়েছে চিনি ছাড়া বিস্কুট আর গ্রিন টি। তিনি স্বাস্থ্য সচেতন। বয়সের কারণে এমনি-ই ওজন বেড়ে যাচ্ছে। একটু সচেতন না হলে কাজ করা যায় না। ওজন ধরে রাখা যায় না। ওজন বাড়লে হুহু করে রোগ সব শরীরে এসে ভর করে।
সালমা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। শান্ত প্রকৃতির মেয়ে নিশি। কিন্তু আজ হঠাৎ তাকে কেমন জানি লাগছে! নিরবতা ভাঙলেন তিনি।
– নিশি
– জ্বী,মম।
– মম নয় মা। তোমাকে না কতবার বলেছি মম নয় মা বলবে।
– আমার ওটাতে অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করব। স্কুলের সবাই তো তাই বলে।
এবার সালমা বেগম মূলকথা তুলতে পারবেন বলে মনে মনে খুশি হলেন।
– আজ কার সাথে পার্লারে গিয়েছিলে? আমি না বলেছি তোমাকে,আমাকে না বলে কোথাও যাবে না। দরকার হলে আমাকে বলবে আমি নিয়ে যাব।
– আমি তো পার্লারে যাই নি,মম।
– পার্লারে যাওনি!
– হুম।
মেয়ে মিথ্যে ও বলা শিখে গেছে দেখে তিনি বুঝতে পারছেন না কি করবেন। রাগ টাকে ঢোক করে গিলে,স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন।
-তাহলে চুল কেটে দিল কে?
নিশি এবার চুপ করে আছে দেখে তার রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে । কিন্তু কোন ভাবেই রাগারাগি করা যাবে না।
এই জায়গায় যদি তিনি হতেন আর তার মা হত এতক্ষণে মার খেতেন নিশ্চিত। কিন্তু এখন কার বাচ্চাদের সাথে তা করা যাবে না ।সে তো দূরের কথা রাগারাগিও করা যাবে না। স্কুলের কড়া নিষেধ। তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। অপেক্ষা করছেন নিশির উত্তর এর জন্য।
নিশি খাওয়া শেষ করে মার আঙ্গুল ধরে নিয়ে আসলো। সালমা বেগম শিহরিত হলেন। সেই কবে সে তার মেয়ের আঙ্গুল এভাবে ধরেছে ভুলে গেছেন। তার খুব মায়া হল। অতীত এসে সামনে পড়ল।
ততক্ষণে নিশি রুমে পৌঁছে গেছে। রুমে রাখা ছোট “বিন” এর দিকে ইশারা করলো নিশি। সালমা বেগম হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি ফিরে এলেন নিশির ইশারায়। কি দেখাতে চাইছে মেয়ে! তিনি ভয় পেলেন। বিন এর ঢাকনা খুলে দিল নিশি। তিনি দেখতে পেলেন মেয়ের সুন্দর চুল গুলো এলোমেলো পড়ে আছে।
মেয়ে নিজে নিজে চুল কেটে ফেলেছে!! তিনি আর কিছু এই মুহূর্তে ভাবতে পারছেন না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন।
তিনি ভাবতে লাগলেন তার মা প্রতি বৃহস্পতি বার তার চুলে তেল লাগিয়ে বেনী করে দিতেন। তিনি শেষ করে আদর করে মেয়েকে তেল দিয়ে দিয়েছেন? কবে চুল আচরিয়ে দিয়েছেন? নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্চে তার।
এত ব্যস্ত এই নগর জীবন নিজেদের জন্য কি সময় মেলা ভার?
তার মাথাটা দুলে দুলে উঠছে।
তিনি ভাবছেন আর নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছেন……
এভাবেই কি হারিয়ে যাচ্ছে নগরের কৈশোর বেলা? স্কুলে বড় মাঠ নেই, বাবার সময় নেই, মার চাকরি-সংসার,ব্যস্ততা, পাড়ায় বন্ধু নেই, খেলার মাঠ নেই। তিনি কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।
২.
আনসার সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাতে।তখন দেয়ালের ঘড়ির কাঁটাটা বারটার ঘন্টা বাজাচ্ছে। আনসার সাহেব ঘরে ঢুকে সু রেক টার পাশে রাখা সোফায় বসে মুজা খুলতে খুলতে বললেন,নিশি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
সালমা বেগমঃ হু ,ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে স্কুল, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।এটি এখন নিয়ম হয়ে গেছে। ইদানিং আনসার সাহেব এর সাথে মেয়ের দেখা হয় একবার , সকালে।
ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলেন আনসার সাহেব। সালমা বেগম তার সকালের অফিসে যাবার ব্যাগ গুছাতে গুছাতে, শোন আজ কি করেছে মেয়ে! আসনার সাহেব মাথা হেলে ল্যাপটপ এ কাজ করছিলেন। মাথা তুলে বললেন, কি করেছে?
– আজ বাসায় এসে দেখি সে তার চুল কেটেছে।
– কে কেটে দিল?পার্লার এ গেল কার সাথে?
– এটাই তো বিষ্ময়ের বিষয়। সে পার্লার এ যায় নি।
– তবে ?
আনসার সাহেব বিষ্মিত হলেন।
– সে চুল নিজে নিজে কেটে ফেলেছে।
– কি বলছ এসব !
তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
– কেন এমন কি হলো? তোমাকে আসার পর বলতে পারতো চুল কাটা দরকার।
– সেটাই তো আমার প্রশ্ন।
– তুমি জিজ্ঞেস করনি?
– করেছিলাম।
– কি বলেছে?
– বলেছে সে জানে না। আমি আর কথা বাড়াইনি আজ। মনের ভেতর ঝড় গিয়েছে মনে হচ্ছে। ঘুম পারিয়ে দিয়েছি। কাল জিজ্ঞেস করবো।
– জানতে হবে। স্কুলে কোন সমস্যা হলো কিনা? কেউ কিছু বলেছে কিনা। তুমি কি কাল সময় পাবে? কাল একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসবে?
– চিন্তা করছি সেটাই। লাঞ্চ টাইমের ব্রেকে ঘুরে আসবো।
– মাজেদা খালা আসবে কবে?
– আরও দু দিন নাকি লাগবে। জমি জমার কাজ সময় লাগছে।
দুজন-ই খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন।
নিশি দেখছে সে একটা বিশাল সমুদ্র তটে দাঁড়িয়ে। মন তার খুশিতে ভরে উঠলো।সামনে বিশাল সমুদ্র হাত ছানি দিচ্ছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে গতকালের ডানাওয়ালা পরীরা খিলখিল করে হাসছে। তাকে ডাকছে। নিশি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। আস্তে আস্তে সবার সাথে সেও উড়তে শুরু করেছে। বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলেছে। নিচে নীল পানি। ঠিক যেমনটি পড়েছে বই এ। তারা উড়ছে আর উড়ছে …সবাই হাসছে , গান করছে। ভেসে চলেছে হাওয়ায়। আস্তে আস্তে মেঘের মাঝে ঢুকে পড়লো সবাই। সাদা সাদা মেঘ কেটে কেটে উড়ছে সবাই।
ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা প্লেন তাদের পাশ দিয়ে উড়ে গেল,গভীরে অনেক গভীরে চলে গেল। নিশি তাকিয়ে দেখছে। এক সময় প্লেনটা মিলিয়ে গেল অনেক উপরের মেঘে। আর দেখা যাচ্ছে না।
সবাই ফেরার তাগিদ দিল বেলা হয়ে এসেছে। তারা নিচে নেমে আসছে। পড়ন্ত বিকেল নিশি দেখল সূর্যটা গাঢ় লাল হয়ে তাদের সাথেই যেন নিচে নামছে। আস্তে আস্তে সূর্যটা টুপ করে সমুদ্রে ডুবে গেল। গোধূলি শেষে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিশির ভয় হতে লাগলো। পরীরা মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে তাদের আর দেখতে পাচ্ছে না নিশি।
হতাৎ নিশি শুনতে পেল কে যেন তাকে ডাকছে, নিশি, নিশি।
নিশি ঘুরছে কিন্তু শব্দ টা কোথা থেকে আসছে সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কে যেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে ধপ্ করে চোখ খুলে ফেলল।
নিশি তাকে আকাশে নয় সমুদ্র তটে নয় খাটের উপর আবিষ্কার করল।
রুমে লাইট জ্বলছে আর পাশে মা দাঁড়িয়ে। নিশির তন্দ্রা ভাঙ্গল। সে বুঝল সে স্বপ্ন দেখছিল।
মা: ওঠো বেলা কত হলো স্কুলের সময় হয়ে গেছে। নিশি চোখ কচলাতে কচলাতে, “উঠছি মা”।
সালমা বেগম খেয়াল করলেন নিশি আজ তাকে মা বলেছে। তিনি খুশি হয়ে মেয়ে কপালে আদর করে দিলেন।
সবাই ডাইনিং টেবিল এ। নিশি রেডি হয়ে গেছে। নাস্তা করছে।
বাবা:শুভ সকাল।
নিশি:শুভ সকাল, বাবা।
আনসার সাহেব খেয়াল করলেন মেয়ে চুল ছোট হয়ে গিয়েছে। আর আকাঁবাকাঁ। কতগুলো ছোট কতগুলো বড়। তার কপালে ভাঁজ পড়লো। তিনি চিন্তিত মুখে কফি খাচ্ছেন আর ভাবছেন কেন এমন করল মেয়েটি!
সালমা বেগম: নিশি ….
– জ্বী, মা।
– আজ লাঞ্চ টাইমে আমি তোমার স্কুলে যাব। তোমার টিচার এর সাথে আমার কথা হয়েছে।
নিশির বুক ধক করে উঠলো।
-টিচার কি নালিশ করেছে নাকি?? মা কেন যাবে? কিন্তু সে তো কিছু করে নি তাহলে। ভাবছে সে।
বাবা: নিশি মা ….
– জ্বী বাবা….
– তোমার সাথে তো কাল দেখা হয়নি রাতে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তোমার কি শরীর খারাপ মা?
– না তো বাবা। আমি ঠিক আছি, কেন?
– তোমার চুল কি হলো? এগুলো এত ছোট করে ফেলেছো কেন?
নিশি ভয়ে ভয়ে সত্যি বলবে নাকি কাটিয়ে দিবে ভাবলো।
-এমনি বাবা, বড় চুল আর ভালো লাগছিল না তাই। হঠাৎ মনে হলো কেটে ফেলি।
– কিন্তু মা এটা তো ভাল কাজ হয়নি। তোমার মাকে বলতে পারতে। তোমাকে নিয়ে গিয়ে কাটিয়ে আনতো। দেখ তো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। এরকম আর করবে না কেমন।
– জ্বী বাবা।
মা: নিশি তোমার গাড়ি আসার সময় হয়ে গিয়েছে। নেমে পড়। স্কুলে দেখা হবে।
নিশি নেমে গেল।
আনসার সাহেব: মেয়ের কি হলো বলতো!!
সালমা বেগম: সেটাই ভাবছি। মা চলে যাবার পরই এরকম হয়ে গেল মেয়েটি। আমরাও ব্যস্ত এটা হতে পারে একটি কারণ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
আনসার সাহেব: শুধু এ কারণে এত পছন্দের চুল গুলো কেটে ফেলবে! ওর কথা শুনে মনে হলো কিছু একটা এড়িয়ে গেল।
সালমা বেগম: আজ স্কুলে যাই। দেখি ওখানে কোন সমস্যা হলো কিনা।
আনসার সাহেব: সেই ভাল হবে।
৩.
নিশি শহরের একটি নামিদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। স্কুলে ঢুকতেই মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে ব্যাগ, প্রয়োজনীয় জিনিস সব চেক করে নেয়া হয়। কোন প্রকার মোবাইল,ট্যাব,ইবুক সহ যে কোন অবৈধ জিনিস বহন করা নিষেধ।
নিশির বান্ধবী নেহা। দুজন সব সময় স্কুলে পাশাপাশি বসে। স্কুলের নিয়ম ইংরেজী তে কথা বলতে হবে। কিন্তু তারা দুজন বাংলায় কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। তাই তাদের মাঝে ভাব হয়ে যায়।
নেহা: নিশি তোর চুল কেটে ফেলেছিস! কি সুন্দর চুল ছিল। কাটলি কেন?
নিশি: এমনি।
টিচার চলে এসেছেন।
লাঞ্চ টাইম-এ সালমা বেগম স্কুলে আসলেন।
টিচার এর সাথে কথা বললেন ।স্কুলের প্রতিটি রুমেই সিসি ক্যামেরা লাগানো। আসা যাওয়ার করিডোর বারান্দা সব খানেই সিসি ক্যামেরার অন্তর্ভুক্ত। সালমা বেগম গত রাতেই ফোনে সব জানিয়েছেন। রাতেই সব সিসি ক্যামেরা চেক করা হয়ে গেছে। তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। স্কুলে সব ঠিক আসে। নিশির ক্লাসের জন্য বরাদ্দ বাসটির সিসি ক্যামেরা ও চেক করা হয়ে গেছে। সব খানেই পজেটিভ রেজাল্ট-ই পাওয়া গেছে। সালমা বেগম কথাটা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচালেন। ধন্যবাদ দিয়ে নিশির সাথে কথা বলে আবার অফিস এ চলে গেলেন।
নিশির স্কুল শেষে বাসায় চলে এসেছে।
এসে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে ভেতর থেকে লক করা। নিশি ভাবলো মা বুঝি আজ তার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। সে মনে মনে খুশি হলো। কলিং বেল দিয়ে খুশি মনে অপেক্ষা করছে নিশি। দরজা খুলে গেল। নিশির মুখ টা কালো হয়ে গেল। যেন আকাশের সব মেঘ এসে জমেছে। চোখ ছলছল করে উঠলো।
– নিশি বুজান…..
– মাজেদা বুবু! তুমি কখন এলে?
মুখে হাসি এনে বলতে চাইল নিশি কিন্তু তার কন্ঠটা ধরে আসছে।
– কিছুক্ষণ আগে আইছি বুজান। ড্রাইভার দিয়ে চাবি পাঠায় দিছে সালমা মায়ে। আপনে ভাল আছেন বুজান?
– ভাল আছি। তুমি ভাল আছো?
– আছি ভালাই। আপনাদের জন্য পরানটা কান্তেছিল।
নিশি হাসল।
– আপনে ফ্রেশ হই আসেন আমি খাবার দিতেছি।
– ঠিক আছে।
এই মাজেদা বুবুই তাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। সে যখন পৃথিবীতে আসবে বাবা, মায়ের দেখার জন্য কাউকে আনতে বাড়িতে গেলেন।
বাড়ি গিয়ে দেখেন মাজেদা বুবুর স্বামী মারা গেছেন। দুই মেয়েকে সেই ছোটতেই বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ছিল একটা সেও নাকি পুকুরে ডুবে মরে গেছে। বাবা বুবু কে বললেন, যাবে আমার সাথে? শুনে নাকি কেঁদে দিয়েছিল। এক কথায় চলে এসেছিল। কোন পিছু টান নাই। থেকে কি করবে কে ভাত কাপড় দিবে? সে থেকে আজ অবধি নিশিকে দেখা শোনার ভার তার। বছরে এক বার যান বাড়িতে স্বামীর কবর জিয়ারত করতে। আর ভিটে টা দেখতে।
নিশি বাথরুমে ঢুকে গিজার টা ছেড়ে দিল। আজ তার একটু শীত শীত করছে।
সে ভাবতে লাগলো কেন এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে সে। এ স্বপ্নের মানে কি?
বের হয়ে খেতে খেতে সে মাজেদা বুবু কে তার স্বপ্নের কথা বললো। মাজেদা বুবু হা করে তার গল্প শুনছে।
গল্প শেষ হলে বলতে লাগলো, ওরে বুজান আমার মনে হয় আপনারে আছর লাগছে। এ জন্যই তো আপনি চুল কেটে ফেলেছেন!
নিশি: আছর কি মাজেদা বুবু?
-সে অনেক খারাপ জিনিস। একবার যাকে ধরে তার রক্ষা নেই। আপনাকে হুজুর এনে ঝাড়ফুঁক করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিশি ভয় পেল।
– মা কখন আসবে তুমি জানো?
– দেরি হবে আজ। দুপুরে নাকি কাজ ছিল। আপনাকে খেয়ে ঘুমাতে বলেছে। সন্ধ্যায় ম্যাডাম আসবে পড়াতে।
নিশির চোখে আজ ঘুম নেই। সে তার স্বপ্নের কথা ভাবছে, মানুষ কি কখনও উড়তে পারে!? এটা কি সম্ভব?
তার নানুমনির কথা খুব মনে পড়ছে। নানুর হাতের নানা পদের পিঠা,পায়েস, সন্দেশ,নারকেলের নাড়ু। তার জন্মদিনে নানুর বানানো সব কিছুতেই ছিল অন্য রকম ভালো লাগা।
এইতো এইবারও তার জন্মদিন হলো শহরের নামিদামি ওয়েস্টিন হোটেলে। কত কিছুর আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু নানুর হাতের জিনিসের সাথে এসবের কোন তুলনা চলে না।
কত রকমের খেলনা উঠেছে। কিন্তু নানুর সাথে দাবা খেলার মজাই ছিল আলাদা। নানু তাকে দাবা খেলা শিখিয়েছেন। নানু নাকি দাবা খেলা শিখেছেন তার ভাইয়ের কাছে। পাড়ার কেউ নাকি সেই নানা কে কোন দিন হারাতে পারে নি।
মা ও দাবা খেলা পারে কিন্তু মার সময় কোথায়!
ভেবে তার চোখে পানি চলে আসল।
দেয়ালে টাঙ্গানো নানুর ছবিটা নামিয়ে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, আমাকে কেন ছেড়ে গেলে, তোমার কি আমার জন্য এত টুকু মায়া হল না।
দাদা কে দেখেনি। দাদির কথা কিছু মনে পড়ে না। নানার কথা একটু একটু মনে পড়ে। দুবার গিয়েছে সে নানু বাড়িতে।এক বার খুব ছোট থাকতে আর একবার নানা ভাই যখন অসুস্থ হল তখন।সাত দিন থেকেছিল সে বার।ও বার নানা আর কথা বলেন নি।
নানাকে ওরা নিয়ে চলে গেল।
ছোট মামা বিদেশে পড়তে গিয়েছে। নানু চলে আসল আমাদের সাথে।
ভাবতে লাগলো নিশি ছবিটা বুকে জড়িয়ে।
কি সুন্দর নানু বাড়ি তার। সামনে “খলা” সবাই বিকেল হলেই খেলে সেখানে এক সাথে। তার সামনে বিশাল দীঘি। বাড়ির পেছনে বড়ই, আমলকী,চালতা, জলপাই, আম, কাঁঠাল এর বাগান। দীঘির পাড়ের চারপাশে খেঁজুর গাছ আর একটা বিরাট জাম গাছ।
দীঘিতে সে গোসল করেছে কিন্তু সে সাঁতার পারত না। ছোট ছোট বাচ্চারা কি সুন্দর সাঁতার কাটতে পারে। দীঘির মাঝখানে চলে যেত সাঁতার কেটে। অবাক হয়ে দেখেছিল নিশি। সেবার ফিরেই সাঁতার শেখার বায়না ধরে সে। ভর্তি করানো হয় নামিদামি এক সুইমিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
নানুকে এসে বলল, কি পচা সুইমিং পুল জানো নানু! এতটুকু ওই যে নানু বাড়ির পেছনে ডোবা টা আছে না ওটার সমান।
নানু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,” যেখানে যেমন নানুমনি।শ হরে এমনি। সাঁতার শেখ তোমাকে আবার নানু বাড়ি বিয়ে যাবো কেমন। তখন গিয়ে ইচ্ছে মত দীঘিতে সাঁতার দিবে।”
– শহর অনেক পঁচা তাই না নানু?
– তা কেন হবে? শহরে কত কিছু আছে যা গ্রামে নেই।
তাকে শান্ত্বণা দিতে একথা বললেন তিনি। ওর যাতে মন খারাপ না হয়ে যায়।
-ছাই আছে সব পঁচা।
একথা শুনে নানু শুধু একটু করে হেসেছিলো।
গ্রামে যাবার সাঁধ, সাঁতার কাটবার সাঁধ অপূর্ণ রেখে নানুই তাকে ছেড়ে গেল।
বুকের ভেতর একটি অচীন পাখি ঢুকরে কেঁদে চলে ,কেউ দেখবার নেই, কেউ বুঝবার নেই। নানুর ছবিটা বুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে নিশি।
৪.
নিশি হোম টিচার এর কাছে পড়ছে।
– নিশি….
– জ্বী টিচার …
– তুমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে এত সুন্দর করে বাংলা পড় আর লেখ আমি অবাক হয়ে যাই। আমার বাকি স্টুডেন্ট গুলো তো বাংলা পড়তেই পারে না। আর অন্যদের কাছে যা শুনেছি বেশি ভাগেরই একি অবস্থা। কিন্তু তোমার বাংলা পড়তে কোন জড়তা নেই। লেখা স্বচ্ছ, বানানেও ভুল নেই।
– আমার নানু মনি আমাকে ছোট বেলা থেকেই বাংলা শিখিয়েছেন। নানু ছোট মামাকে কি বলেছেন জানেন?
– কি?
– মামা যাতে বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে দেশে আসেন। দেশের জন্য কাজ করেন। মামা নানুর কথা রেখেছে। মামা দেশের জন্য কাজ করতে দেশে চলে এসেছেন।
টিচার দেয়ালের দিকে তাকালো কিন্তু ছবিটা দেখতে পেল না।
-ছবিটা কোথায়?
নিশি বিছানার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো।
একটা অজানা কষ্ট বয়ে গেল তার হৃদয় জুড়ে ।
নিশি জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে উদাস দৃষ্টিতে। সে মনে মনে ভাবল, এ শহরে ঘোর অন্ধকার নিয়ে রাত আসেনা। নিয়ন আলো ছেয়ে রাখে সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি। গভীর রাত যাকে বলে এ শহরে তার দেখা মেলা অসম্ভব বটে। ঘরে রাত এসেছে লাইট বন্ধ না করলে বোঝাই যায় না। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে আইপিএস-এ আলো জ্বলে ওঠে। মাঝেমাঝে নিশি তাই জানালার পর্দা সরিয়ে লাইট অফ করে বসে থাকে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে সে খুব খুশি হয়। দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়। চাঁদ টাকে তখন পরিপূর্ণ ভাবে দেখা যায়। দেখা যায় জ্যোৎস্না। অথবা ঘোর অন্ধকার। যে অন্ধকারে হাসনাহেনা সুবাস ছড়িয়ে ভালোলাগায় মাতাল করে দেয়। আজও সে ইলেকট্রিসিটি চলে যাবার অপেক্ষা করছে।
এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো।
মা এসেছে। নিশি পড়তে বসে গেল।
সালমা বেগম বাসায় ঢুকলেন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
নিশির ঘরে ঢুকলেন।
– পড়ছো…বেশ। এই তো লক্ষী মেয়ি। টিচার এসেছিস?
– জ্বী।
– কেমন পড়ালো?
– ভালো।
নিশি মাথায় হাত বুলিয়ে,”পড়… ফ্রেশ হয়ে আসছি” বলে রুমে চলে গেলেন।
মায়ের চলে যাবার দিকে আনমনে তাকিয়ে নিশি। চোখ ভিজে উঠলো তার। সে কান্না টাকে চাপিয়ে পড়তে লাগলো…
সালমা বেগমের মাথাটা আজ ভীষণ ধরেছে। সারাদিন কি ধকল গেছে!! আজকের পত্রিকাও দেখবার সময় পাননি।
সালমা বেগম টিভি ছেড়ে খবর দেখতে বসলেন।
মাজেদা বুবু কাছে মোড়া নিয়ে বসলো। তিনি বারবার সালমা বেগমের দিকে তাকাচ্ছেন।
– কিছু বলবেন খালা?
– হ, একটা কথা আছিলো।
– বলেন।
– আজ কে নিশি বুজান আমাকে ওনার দেখা অদ্ভুত স্বপ্নের কথা আমারে কইছে। স্বপ্নে বোলে কি জিন পরী আসে ওনার কাছে। আকাশে নিয়ে যায় উনি নাকি তাদের সাথে উড়াল দেয়। এজন্যই তো চুল কাইটা ফেলছে বুজান। মাথায় ভর করছিল মনে হয়।
আমার তো ভাল ঠেকতেছে না। আসরটাসর ধরলো নাকি আবার। আমি জানলে তো গ্রামের হুজুর থাইকা পানি পরা আনতাম লগে করি। আপনি কন তো আননের ব্যবস্থা করতে পারি। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলেন তিনি।
সালমা বেগম ভাবছেন মেয়ে তাকে কিছুই বলেনি এসব। দিন দিন তাহলে দূরে চলে যাচ্ছে মেয়েটা!! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
– কি যে বলো খালা তুমি এসব! নিশিকে বলেছো নাকি এসব?
– আরে মা, মাথা খারাপ নাকি! ছোট পোলাপাইন রে এসব কইতে নাই। ডরায় রাইতের বেলা। এত বয়স হইছে এই টুকু কাঁচা বুদ্ধি নাকি।
বিজ্ঞের মত ভাব নিয়ে বললেন তিনি।
-খুব ই ভালো করেছো খালা ওকে এসব বল নি।
আপনারা শিক্ষিত মানুষ আপনারা এসব বিশ্বাস করতে চান না জানি। কিন্তু পানি পরা ঝাড়ফুঁক এসবই কাজ হয়।
-এখন ই কিছু করতে হবে না তোমার খালা। ওর বাবা আসুক দেখি কথা বলে কি করা যায়।
সালমা বেগম রাতে আনসার সাহেব কে সব খুলে বললেন। তারা দুজন ই সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে সাইক্রিয়েটিক্স দেখাবেন।
সিদ্ধান্ত হলো আনসার সাহেব এর বাল্যকালের বন্ধু ডাঃ তুতুল এর কাছে যাবেন। বাসাতেই যাবেন। আগেই ফোন করে আনসার সাহেব ডাক্তার বন্ধু কে সব খুলে বলবেন তারপর সালমা বেগম নিশি কে নিয়ে বাসায় যাবেন। যেদিন তিনি বলবেন সে দিন যাবেন।
৫.
নিশির স্কুলে আজ “সাহিত্য চর্চা প্রতিযোগিতা” এর ফলাফল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নিশি বাংলা বিভাগে লেখা জমা দিয়েছিল। ফলাফল ঘোষণা চলছে।
দু’হাত একসাথে মুঠো করে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো সে।
সে প্রথম হয়েছে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। নেহা পাশ থেকে তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে, এই চোখ খোল তুই প্রথম হয়েছিস। চোখ খুললো সে। সবাই হাততালি দিচ্ছে।
মঞ্চে উঠে তাকে কিছু বলতে অনুরোধ করা হলো।
নিশি মঞ্চে উঠলো, তার বুক ধুকধুক করছে। মাইক্রোফোনে হাত কাঁপছে।
সে তার নানুকে স্বরণ করল।বা বা-মা, নানুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। শিক্ষক,শিক্ষিকা,বন্ধু সবার তাকে অনুপ্রেরণার দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
শেষ করল তার লেখার শেষ লাইন দিয়েঃ
“এই পৃথিবী আমাদের দিয়েছে সব,
তাকে করবো সুন্দর এ হবে আমাদের পণ। ”
সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো আবার। অভিনন্দন জানালো সাবাই।
তার হাতে তুলে দেয়া হল পুরস্কার। সুন্দর মোড়কে বাঁধানো দুটো বই।
বাসায় এসে আর অপেক্ষা সইছে না নিশির। সে খেয়েই মোড়ক খুলে ফেলল।
কি সুন্দর দুটি বই।
হুমায়ূন আজাদ এর “লাল নীল দীপাবলী” আর অ্যানা ফ্রাঙ্কের বিখ্যাত সেই বই -” দ্য ডায়েরি অফ অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক। যা “আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি” নামে পরিচিত। এটির ইংলিশ অনুবাদ দিয়েছে স্কুল তাকে। মূল ডায়েরি ওলন্দাজ ভাষায় লেখা। অনেক শুনেছে সে এই বইটির নাম।
টেলিফোন করে মা, বাবা, মামা, ফুফু সবাইকে সুখবরটা দিল নিশি ।সবাই তাকে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু বই হাতে নিয়ে তার খুব মন খারাপ হলো। আজ নানু মনি থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। যিনি তাকে লেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন। তাকে প্রতি জন্মদিনে এক একটি ডায়েরি কিনে দিতেন। আর সে প্রতিদিন সেগুলোতে মনের কথা লেখে। তার রুমের দেয়ালের ছবিটির দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে নানুকে খুশির খবর টা জানালো। দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা বইছে তার। নিঃশব্দে ছবিটাতে হাত বুলাতে লাগলো।
চোখ মুছে বই এ মুখ গুজে পড়তে শুরু করলো।
মাজেদা বুবু তাকে নাস্তা দিয়ে গেলেন। তাকে রেডি হয়ে থাকতে বললেন। কিন্তু আজ তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
রাস্তায় জ্যামে আটকে আছে হাজার খানেক গাড়ি। মনে হচ্ছে গাড়ির মেলা বসেছে। সামনে পেছনে যেদিকে তাকাও শুধু গাড়ি।
নিশি গাড়ির আলোতে মুখ গুজে বই পড়ছে।
মুখ তুলে মাকে জিজ্ঞেস করলো, মা আমারা কোন আঙ্কেল এর বাসায় যাচ্ছি?
– তুতুল আঙ্কেল এর বাসায়।
– পাগলদের ডাক্তার আঙ্কেল এর বাসায়?
বলেই ফিক করে হেসে দিল।
– পাগলদের ডাক্তার নয় মা,উনি মনোচিকিৎসক।
– উনি কি মন পড়তে পারে মা?
– কিছুটা তো পারে।
– আমার কিন্তু ওনাকে অনেক ভালো লাগে। কি সুন্দর-সুন্দর গল্প বলেন।আমার কেন যাচ্ছি মা?
– গল্প করতে।
– তাই মা! কি মজা হবে আজ অনেক গল্প করবো।
সিগন্যাল পড়ে গেছে। তারা চলে এলো ডাঃ তুতুল এর বাসায়।
তুতুল সাহেব নিশিকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসেছেন। নিশির আম্মুকে ভেতরে নিয়ে গিয়েছেন তার ওয়াইফ। ডাঃ তুতুল গল্প করছেন নিশির সাথে। তার পুরস্কার পাওয়া দিয়ে শুরু করেছেন।
আস্তে আস্তে গল্পের ছলে তার স্বপ্ন থেকে শুরু করে চুল কাটা সব কিছুই জেনে নিলেন।
আনসার সাহেব এসে পড়েছেন ততক্ষণে।
নিশিকে তার মেয়ের সাথে খেলতে পাঠিয়ে তাদের সাথে বসলেন।
ডাঃ তুতল: তুই সারাদিন কি করিস আনসার? খালি কাজ আর কাজ। বাসায় ফিরিস রাত বারো টায়। মেয়ের সাথে দেখাই তো হয় না তোর বেশির ভাগ দিন। কথা বলার সময় কই!
ছুটির দিনেও তোর কাজ লেগে থাকে।
আনসার সাহেব: কি করবো বল। চাকরি আর ব্যাবসা তো এক জিনিস নয়।
ভাবি আপনি ও কম সময় দিচ্ছেন মেয়েকে।
তার নানু তাকে চুলে তেল দিয়ে দিত বেণী করে দিত, লম্বা চুল নানুর ছিল খুব পছন্দ। অভিমানে মেয়ে চুল কেটে ফেলেছে, নানু নেই এই দিয়ে আর কি হবে! এই অভিমানে। মেয়েকে একটু সময় দিন ভাবি।
দুজন মাথা নিচু করে থাকলেন।
আর স্বপ্নটা কিছু নয় একটা আক্ষেপ থেকে দেখছে। সে যা চায়। এই শহরে সে তা পাচ্ছে না। খেলার সাথী, বড় মাঠ, সাঁতার কাটবার পুকুর, লেক।
সালমা বেগমের প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল। তিনি তাই ভেবেছিলেন।
দুজন-ই একটু রিলেক্স হলেন।
– তোরা সবাই মিলে এই ছুটিতে ঘুরতে যা নিশি যেখানে চায়। মাঝে মাঝে মেয়ে কে নিয়ে বের হবি।
নিশিরা বাসায় চলে আসল।
নিশির মা-বাবা দু’জন কথা বলছেন।
আনসার সাহেব: আসলেই নিশির আম্মু আমরা কত দিন বাড়ি যাইনা দেখেছো!
– শ্বশুর বাড়ি তো কবে গিয়েছি ভুলে গিয়েছি। মা-বাবা চলে গেল। সেই শেষ যাওয়া। তুমি গেলে জমি জমার কাজে তখন নিশি ছোট এদিকে আমার অফিস আর যাওয়া হলো কই? আর এদিকে বাবা চলে গেলেন এরপর শুরু হল নিশির স্কুল। আর সময়ই হয়ে উঠলো না। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাই চলো সবাই মিলে।
– আমিও তাই ভাবছি। ছোটন কে বল সব আয়োজন করতে।
৬.
নিশিকে দেখতে নিশির ফুফু এসেছেন। সাথে ছেলে সায়ান। সালমা বেগম আজ ছুটি নিয়েছেন।
সন্ধ্যায় আবার একটি পার্টি আছে।
নিশি বই পড়ছে।
সায়ান: তোমার ইবুক নেই।
– আছে। কিন্তু আমার বই থেকে পড়তে ভাল লাগে। নতুন বই এর সুন্দর একটা গন্ধ আছে।
– তোমার ট্যাব টা দাও?
– গান শুনবে?
– না, গেমস খেলবো।
– আমার ট্যাবে কোন গেমস নেই।
সায়ান মুখটাকে বেঁকিয়ে নিশিকে ভেংচি কেটে এক দৌঁড়ে পালালো।
সায়ান: মা মা তোমার মোবাইলটা দাও নিশি আপুর ট্যাবে কোন গেমস নেই।
ফুফু: না সায়ান আপুর সাথে গিয়ে খেল। আপু কি গল্প লিখেছে শোন গিয়ে যাও।
তিনি নিশি কে ডাক দিলেন।
: নিশি, নিশি ….
-জ্বী ফুফু, আসছি।
– সায়ান কে নিয়ে যাও। গল্প শোনাও।
সায়ান কান্নার সুরে বলতে লাগলো, “না আমি শুনবো না আমি খেলবো মোবাইল দাও”
সালমা বেগম: আমাদের লক্ষী সায়ান বাবা, সারাক্ষণ মোবাইল এ খেলে না। যাও আপুর সাথে।
বাধ্য হয়ে সে আসলো।
মুখ ভার করে বসে আছে সায়ান।
নিশি দাবার ছক টা বের করলো আলমিরা থেকে।
সায়ান চোখ বড় বড় করে , কি এটা?
নিশি: দাবার বোর্ড। খেলছিস কখনও?
– ল্যাপটপ এ খেলেছি।
– বেশ ভাল করেছিস। আয় শিখিয়ে দেই।
নিশি সায়ান কে দাবা খেলা শেখাচ্ছে। সায়ান খুব মনোযোগ দিয়ে শিখছে।
দুজন মিলে খেলছে। কিন্তু সায়ান হেরে যাচ্ছে আর উহ্ বলে চুল গুলো এলোমেলো করছে। বেশ মজা পাচ্ছে সে।
দুপুর হয়ে এল।
সায়ান খুবই অস্থির আর চঞ্চল ছেলে। সারা না পেয়ে সায়ানের আম্মু আর সালমা বেগম দেখতে এলেন, এসে দেখলেন মনোযোগ দিয়ে সায়ান আর নিশি খেলছে।
দুপুর গরিয়ে গেল। খাবার পর দুজন আবার খেলতে বসেছে। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল টেরই পেল না তারা।
এদিকে যাবার সময় হয়ে গেছে। বিদায় দিতে গিয়ে নিশি সায়ান দুজনের ই মন খারাপ।
সালমা বেগম ননদ কে বললেন, ছুটির দিন চলে এস। এদের সময় ভালো কাটবে।
সায়ানরা চলে গেল।
– নিশি রেডি হয়ে নাও।
– কোথায় যাবে মা?
– রেডিসনে এ একটি পার্টি আছে আজ তোমার বাবার।
– আমি না গেলে হয় না মা?
– তা কি করে হয়! তুমি আমাদের এক মাত্র মেয়ে। তোমাকে ছাড়া কি করে যাব! তোমার বাবা রাগ করবে।
নিশি রেডি হলো।
পুরো পার্টিতে তার মন খারাপ হয়ে রইল। এসব তার একদম ভালো লাগে না। বদ্ধ একটি জায়গায় এসে খাওয়া-দাওয়া করা ছবি তোলা। অসহ্য বললো সে । তবুও সৌজন্য সাক্ষাৎ এ হায়-হ্যালো করতে হলো মুচকি হেসে।
বাসায় এসেই বই হাতে মুখ গুজে বসলো।কাল থেকে ছুটি। কিন্তু তার মন খারাপ হলো। নেহার সাথে দেখা হবে না অনেক দিন। কার সাথে কথা বলবে এই ভেবে। পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়লো।
৭.
ছোট মামা বাসায় এসেছে। দুজন মিলে দাবা খেলছে। সে বারবার হেরে যাচ্ছে।
নিশি।: তুমি এত পার কেন, মামা?
মামা হেসে বললেন, “তুই আরও বড় হ খেলতে খেলতে তুই ও পাকা হবি।
– আমি কিভাবে হবো আমার তো খেলার কেউ নেই। তুমিও তো আস না।
মামা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এখন থেকে আসব রে পাগলি।
নিশি খুশি হলো।
সবাই দুপুরে খেতে বসেছে।
মামা: আজ সবাই কে এক খানে বেড়াতে নিয়ে যাব।
নিশি: কোথায় মামা?
মামা: সেটা তো বলা যাবে না।
– কেন মামা?
– সারপ্রাইজ।
– কখন যাবো?
– রাত দশটায় রওনা দিব আমরা।
মাজেদা খালাকে বলে দাও সব গুছিয়ে নিতে।
মাজেদা খালা আর নিশি ব্যাগ গুছালো।
রাত দশটা। গ্যারেজে গাড়ি দাঁড়ানো। সবাই গ্যারেজে চলে এসেছে।
সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো।
সায়ানরাও চলে এসেছে। এসেছে ছোট খালা-খালু আর তাদের মেয়ে সিমিন।
বাচ্চারা সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করলো তারা কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু কোন বাচ্চা ই জানেনা। বড়রা এমন ভাব করলো তারাও কিছু জানে না। সব মামা একা জানে।
নিশি, সায়ান, সিমিন মাজেদা বুবু আর মামা এক গাড়িতে। বাকিরা অন্য গাড়িতে।
রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি। দুপাশে সারি সারি গাছ। পাল্লা দিয়ে তারাও ছুটে চলেছে বলে মনে হচ্ছে নিশির। সবাই গান করছে। মামা মজার মজার কৌতুক বলছেন আর সবাই হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। রাত বাড়ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
বুক ভরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে নিশি মুক্ত বাতাসে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
মামা ড্রাইভার কে জানালার গ্লাসটা লাগিয়ে দিতে বললেন।
৮.
মামার ডাকে সবার ঘুম ভাঙ্গল।
নিশি আঁধো আঁধো চোখ মেলেই পাখির ডাক শুনতে পেল। কোথায় সে!
গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার দিল সবাই এক সাথে “নানুবাড়ি”!
নিশি খুশিতে কেঁদে দিল। মা কে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মা মাথার হাত বুলিয়ে দিলেন। সবার চোখে খুশির অশ্রু।
মামা: সব কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছি।
নানু বাড়িতে এখন থাকে রহমত মামা আর মামি। বাড়ি দেখবার জন্য তাদের রাখা হয়েছে।
মাজেদা বুবু কাজে লেগে গেলেন।
নাস্তা করে সবাই একটু বিশ্রাম নিয়েই দশটায় বেড়িয়ে পড়ল। সবার সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করল। পাড়ার ছেলে মেয়েরা তাদের ঘিরে রেখেছে। সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেল সবার।
বাচ্চারা ছুটি পেল। তারা খেলছে। মামা এসে তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
নিশি: কখন দীঘিতে নামবো মামা?
মামা: এই তো আর একটু পর।
রহমত মামা ডাব পারবেন গাছ থেকে, ডাব পাড়া হয়ে গেলেই আমরা দীঘিতে নামবো।
সালমা বেগম, ছোট খালা, ফুফু, আনসার সাহেব, খালু, ফুফা সবাই বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছেন।
কতটা সময় কাটিয়েছ তারা এখানে। এখন কেমন দূরে চলে গেছে সব স্মৃতি। সালমা বেগম বললেন। খালা সায় দিল।
– কি দিন ছিল আপা! সবাই এক সাথে। গাছে উঠে কত আম পেরে খেয়েছি। মনে আছে আপা? আজ সব স্মৃতি।
– সে সব কি ভোলা যায় রে। ভুলে থাকার জন্য দূরে দূরে থাকা। তবুও কি ভোলা যায়!
রহমত মামা ডাব গাছে উঠছেন আর সবাই হা করে তালিয়ে আছে। কিভাবে পই পই করে উঠে গেল তা দেখে! সায়ান গিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু পড়ে যাচ্ছে তার কান্ড দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি।
সবাই ডাব খেয়ে একটু জিরিয়ে নিল।
ছোট বড় সবাই নেমে গেল পুকুরে। সায়ান আর সিসিম সাঁতার জানে না। তারা ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকল।
সালমা বেগম: নিশি বেশি দূর যাবে না।
নিশি: আচ্ছা মা।
কিন্তু মামা আর সে অনেক দূর চলে গেল। ফিরে এসে হাঁপাতে লাগলো।
নিশির একটুও পানি থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও বাবার নির্দেশ মানতে হলো।
পুরো বিকেল খেলল সবাই।
কবুতর পালেন রহমত মামারা। সারা উঠোন জুড়ে নানা মিশ্র রঙ্গের কবুতর উড়ছে।
সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ে বাঁশ দিয়ে বাঁধানো মাঁচায় বসে গল্প করছে সবাই।
কি মিষ্টি বাতাস। মন পাগল করে দেয়া বাতাস।
ফুফু আর খালা গান ধরলেন। সাথে সবাই যোগ দিল।
নিশি: মা এ দীঘিতেই কি পনের,বিশ কেজি মাছ হতো? নানু বলেছে তাকে।
– হ্যাঁ এই দীঘিটায়। আমরা দেখেছি অনেক বড় বড় মাছ।
– নানু বলতো মাছের তেলেই মাছ ভাজা হতো। এ কিভাবে সম্ভব মা?
– বড় বড় মাছে অনেক তেল হতো সেই তেল দিয়েই মাছ রান্না হয়ে যেত। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই দিন গুলো। সেই দিন কি আর আছে।
– এখনও কি এত বড় মাছ হয়?
– না রে মা।
– কেন হয়না মা ?
– দেখার মানুষ নেই তেমন। পানি শুকিয়ে গেছে অনেক। নিচে পলি জমে গভীরতা কমে গেছে। এসব নানা কারণ।
রহমত মামা: পাঁচ কেজির একটা কাতল মাছ পাইছি আপা কাল। আজ রাতে রান্না হবে।
রাতের বেলা খাওয়া শেষে খোলা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে গল্প করছে সবাই।
নিশি: আমরা কত দিন থাকবো?
মামা: তিন দিন।
সবাই এক সাথে বলে উঠলো, মাত্র তিন দিন!
সায়ান পাশ থেকে, স্কুল তো সাত দিন বন্ধ।
খালা: সবার চাকরি আছে যে সোনা মনিরা। “চলো ওঠো সবাই, অনেক রাত হয়েছে” খালু তাড়া দিলেন। সবাই উঠে পড়লো।
নিশি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো আর যদি ফিরতে না হতো! ঐ বদ্ধ শহরটাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
৯.
দেখতে দেখতে স্বপ্নের মত তিনটি দিন কেটে গেল কোন দিক দিয়ে, কেউ টের পেল না ।
এবার বিদায়ের পালা।
সবাই তৈরি হচ্ছে।
সব জিনিস গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
সবাই ডাব নিয়ে যাচ্ছে সাথে করে। তাজা ডাবের লোভ সামলাতে পারেনি কেউ।
সালমা বেগম দীঘির পাড়ের মাঁচাটাতে গিয়ে বসলেন। তার সামনে তার শৈশব ভেসে উঠলো। কি দূরন্ত দিন ছিল তাদের! এখন এর বাচ্চারা কি পেয়ে বড় হচ্ছে তিনি ভেবে পাচ্ছেন না।
মা-বাবার কথা মনে পড়ে মন টা হু হু করে উঠলো তার। তিনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
পেছন থেকে নিঃশব্দে নিশি এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি টের পেলেন না।
নিশি পাশে এসে বসল। মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো। চোখের পানি মুছে দিল।
মা তার হাতটি ধরলেন।
– মা, আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না।
– আমারও না।
– আমরা তাহলে এখানেই থেকে যাই?
– সব চাইলেই কি হয় মা!
– ওই শহরটা একটা খাঁচা মা, আমার নিজেকে সেখানে খাঁচার বন্দি পাখি মনে হয়। এ শহরটাকে তোমরা এভাবে গড়েছ কেন? শুধু দালান আর দালান, রাস্তা, ফ্লাইওভার আর কিছু নেই। আমার সেখানে দম বন্ধ হয়ে আসে মা…।
– আমরা যা পারিনি তোরা সেটা পারবি না? এই নগর টাকে সুন্দর করে গড়তে, তোদের মনের মত গড়তে? পারবি না?
– পারব মা, আমাদের পারতেই হবে!
বুকে মায়া আর হাজার খানেক স্মৃতি সাথে নিয়ে চলেছে সবাই ।
রাতের গাঢ় আঁধারে ছুটে চলেছে গাড়ি, নিয়ে তার যাত্রী, তার আপন মহিমায়।
রাত বাড়ছে আর একটু একটু করে শহুরে সকালের কাছে নিয়ে চলেছে তাদের।