মাস্টারমশাই এসে বসে আছেন সেই কখন থেকে। টুটুলকে গণিত করাবেন। কিন্তু ছাত্রের দেখা নেই। ওকে সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান সকলে। অবশেষে বাধ্য হয়ে বাবা মাস্টারমশাইকে বললেন, “ইয়ে মানে স্যার, টুটুল আজও উধাও হয়ে গেছে। আপনি বরং আগামীকাল আসুন। আমি কথা দিচ্ছি কাল ঠিক হাজির করবো বাঁদরটাকে আপনার সামনে।”
কথা শুনে মাস্টারমশাইয়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। নাকের ডগায় এসে ঝুলে থাকা চশমাটা ঠেলে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিলেন। বললেন, “আপনার ছেলে, আপনিই ভাল বোঝেন কী করা উচিত! আমি শুধু বলব, সময় থাকতে ছেলেকে সামলান। পড়াশোনায় মনযোগ নেই ওর একদম। আমার অবস্থানে থেকে যতটুকু করার আমি করেছি। বাকিটা আপনাদের হাতে। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে অভিভাবকের অবদান সবচেয়ে বেশি। সামান্য হেলাফেলায় আপনার ছেলেটা বখে যেতে পারে। আজ আসি তাহলে, কাল আবার দেখা হবে। আসসালামু আলাইকুম।”
সেই থেকে টুটুলের বাবা হাসান সাহেব রেগে টং হয়ে আছেন। আজ আর নিস্তার নেই টুটুলের, এর একটা বিহিত করতেই হবে!
টুটুলের মাকে আদেশ দিলেন, “মমতা, ছাগলটার ব্যাগ গোছাও, কালই ওকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। ওর আর পড়াশোনার দরকার নেই। বরং গ্রামে গিয়ে চাষবাস করুক। গরুর সাথে গোয়ালঘরে থাকুক, শিক্ষা হয়ে যাবে।”
এদিকে মাস্টারমশাই চলে যেতেই টুটুল চুপিচুপি ঘরে এসে ঢুকলো। দরজার আড়াল থেকে বাবার সব কথাই শুনলো সে। গ্রামে যাবে! এটা ভেবেই মনটা খুশিতে নেচে উঠলো ওর। আহ্! আর পড়াশোনা করতে হবে না! টুটুলের ইচ্ছে হলো বাবাকে একটু আদর করে আসে। এই সিদ্ধান্তটা যদি আরো আগে নিত বাবা, তাহলে টুটুলকে এত কষ্ট করে পড়তে হতো না। সারাদিন পড়ার জন্যে মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিও শুনতে হতো না। পড়াশোনার মতো বিরক্তিকর কাজ সম্ভবত এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই!
সেই রাতে পাহাড় সমান আনন্দ চোখে নিয়ে টুটুল ঘুমাতে গেল।
ঝিকঝিক শব্দে ছুটে চলছে ট্রেন। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাস ধরার চেষ্টা করছে টুটুল। সাঁইসাঁই করে ছুটে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছপালা। বেশ মজা লাগছে টুটুলের।
শেষপর্যন্ত বাবা টুটুলকে গাঁয়ে পাঠালেন। ওকে নেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে মুরাদ চাচা এসেছিল। গম্ভীর মুখে বাবা টুটুলকে চাচার হাতে তুলে দিলেন। বিদায়বেলা বলে দিলেন, “ছেলেটাকে দেখে রাখিস!”
মা কাঁদছিল ভীষণ। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “এত পাষাণ বাবা তুমি! ছেলেটাকে এভাবে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছ! এইটুকুন ছেলে আমার, একা একা কীভাবে থাকবে!?”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাবা তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
টুটুল মাকে জড়িয়ে ধরেছিল শেষবারের মতন বুক ভরে টেনে নিয়েছিল মায়ের শরীরের ঘ্রাণ। ঘ্রাণটুকু জমা করে রেখেছে ওর ছোট্ট বুকের মধ্যে। যখন মায়ের কথা মনে হবে, একটু একটু করে ঘ্রাণ টেনে নেবে।
“এসে গেছি আমরা, ব্যাগ হাতে নে, নামতে হবে ভিড় ঠেলে।”- মুরাদ চাচা জোরে বললেন।
টুটুল কাঁধে ব্যাগ তুলে নিল চাচার কথামত। ট্রেন থামছে ধীরে ধীরে। এবার নামার পালা। চাচার পেছন পেছন এগোলো ও। নামার সময় এক লোক পা মাড়িয়ে দিল টুটুলের। ব্যথায় “আঁউ” বলে উঠল টুটুল। ঠোঁট কামড়ে ব্যথার ধাক্কা সামলালো।
টুটুলদের গাঁয়ে যেতে হয় ভ্যানে চড়ে। কিন্তু সময় লাগে বেশি। আরেকটা রাস্তা আছে, যেটা দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। তবে ওই রাস্তা বেশি সুবিধের না। একে তো কর্দমাক্ত, তার উপর ঘনজঙ্গল। চাচার সাথে তাই ভ্যানে চড়ে বসলো টুটুল। পা নাচিয়ে নাচিয়ে যেতে লাগলো। মুরাদ চাচা অনেক কথাই বলছেন। কিছু টুটুলের কানে ঢুকছে আবার কিছু ঢুকছে না।
“বুঝলি টুটুল, এবার জমিতে বেশ কয়েকটা নতুন জাতের চারা লাগাবো। খুব উন্নতমানের চারা। শহর থেকে বীজ আনিয়েছি। জমিটা প্রস্তুত করতে হবে। তুই এসেছিস যখন, দুজনে মিলেই করে ফেলব। চাচা-ভাতিজা, দারুন জমবে!”
চাচার কথা শুনে রোমাঞ্চিত হল টুটুল। টিভিতে কত দেখেছে ক্ষেতে কাজ করার দৃশ্য। এবার হাতেকলমে সে নিজেই করবে! খুব খুশি লাগলো টুটুলের।
বাড়িতে এসে টুটুল দেখলো চাচী ধান ভানছেন উঠানে। পাশেই বালু দিয়ে খেলছে টুটুলের চাচাতো ভাইবোন, মনির আর রেশমা। টুটুলকে দেখেই দৌঁড়ে এলো ওরা। বড় বড় চোখে দেখতে লাগলো টুটুলকে। মনির ওকে চিনতে পারলেও রেশমা চিনতে পারছে না।
চাচীও এগিয়ে এলেন। মুখে মায়াবী হাসি নিয়ে বললেন, “টুটুল বাবা! এতদিন পর মনে পড়লো চাচীর কথা! তোমার আব্বা-আম্মা আসেন নাই?”
চাচীকে কদমবুসি করে টুটুল জবাব দিল, “তারা পরে আসবেন, চাচী। আমি বেশ কয়েকদিনের জন্য থাকতে এসেছি আপনার এখানে।”
“তোমার যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকো, বাবা। কোন সমস্যা নাই।”
মুরাদ চাচা বললেন, “এবার খাবারের বন্দোবস্ত করো, জমিলা। পেট চোঁ চোঁ করছে খিদেয়।”
“ভাত তো সবে চুলোয় দিলাম। আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসেন, আমি ব্যবস্থা করছি।”- বলেই চাচী চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
মুরাদ চাচা রেশমাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পিছুপিছু টুটুলও চলল। ঘরের আসবাবপত্র দেখে কিছুটা দমে গেল টুটুল। ওর সেই তুলতুলে বিছানার বদলে এখানে পাতা আছে একটা চৌকি। বেহাল দশা সেটার। তেল চিটচিটে বালিশ আর কাঠের মতন শক্ত তোষক। পাশে ছোট্ট টেবিল, তার উপর রাজ্যের যত জিনিস। ঘরের মাঝ বরাবর তার টাঙানো, সবার কাপড়চোপড় এখানেই রাখা হয়। দুটো চেয়ার আছে ঘরের কোণায়। সেখান থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো টুটুল।
“বুঝলি টুটুল, এবারের বন্যায় বেশ ক্ষতি হয়েছে আমাদের? সামলে-সুমলে উঠতে সময় লাগবে একটু। অনেকেই সাহায্য করতে চাইছিল, এমনকি তোর আব্বাও। কিন্তু আমি কারো সাহায্য নিতে চাই না। যা করার নিজেই করব।”
“আমি তোমার সাথে আছি চাচা”- টুটুল অভয় দিয়ে বলল।
কথা শুনে টুটুলের পিঠ চাপড়ে দিলেন চাচা। বললেন, “এখন তাহলে চল; চান করে আসিগে। বেলা পড়ে এলো…।”
শহর থেকে দূরে, গাঁয়ের পরিবেশে বেশ ভাল সময় কাটালো টুটুল। নিজেকে মনে হলো মুক্ত স্বাধীন পাখি। পড়াশোনার চাপ নেই, বাবার ধমক, মার চোখ রাঙানো, শিক্ষকের বকুনি, কিছুই নেই। সেই রাতে খেয়ে-দেয়ে বেশ গভীর এক ঘুম দিল টুটুল।
“এই টুটুল ওঠ, মাঠে যাবি না?”
সবেমাত্র সূর্যটা উঁকি দিয়েছে। কয়েকটা পাখি মিষ্টিস্বরে ডেকে যাচ্ছে একটু পরপর। একটা মোরগও চেঁচিয়ে উঠলো।
কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল টুটুল। চাচার কন্ঠ তার কানে পৌঁছাল না। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে।
“কিরে টুটুল উঠবিনে? এই দেখ সকাল হয়ে এসেছে।”- আবারো ডাকলেন চাচা।
এতক্ষণে চাচার স্বর কানে গেল টুটুলের। চোখটা বন্ধ রেখেই বলল, “আমি আরেকটু ঘুমাই চাচা, তুমি যাও!”
“নাহ্! তুই তো দেখি মহা আলসে! তাড়াতাড়ি আয়, জমির কাজটা আজকেই শেষ করতে হবে।”
পিটপিট করে চোখ মেলল টুটুল। মাথার উপর ফুটো হয়ে যাওয়া টিনের ফোঁকড় দিয়ে আলো আসছে। মায়ের মুখটা মনে পড়লো টুটুলের। এত সকালে মা কি উঠেছে আজকে? নিশ্চয় উঠেছে! মায়ের কাজই হচ্ছে ভোরে উঠে রান্নাবাড়া সেরে ফেলা। ৭ টার মধ্যে টুটুলকে রেডি করে স্কুলে পাঠাতে হয় যে!
“কই রে! কি ভাবছিস? জলদি কুলি করে নিয়ে আমার সাথে আয়। দেরি হয়ে গেল!”
টুটুল দেখলো এক হাতে নিড়ানি আর কাঁধে লাঙল নিয়ে চাচা দাঁড়িয়ে আছে। ফের ঘুমাতে যাবার প্রশ্নই আসে না!
“হেই! চল্ চল্! হুরর্!”
মুখে শব্দ করতে করতে গরুর পিঠে এক ঘা লাগিয়ে দিলেন চাচা। টুটুলও লাঙল ঠেলছে চাচার সাথে। শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে তার। রোদের তাপ বেড়ে গেছে কয়েক ঘন্টাতেই। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। দু’হাত ব্যথায় টনটন করছে। এত সহজ কাজ হুট করে কঠিন হয়ে যাবে কে জানতো!
টুটুল তাল মিলাতে পারছে না চাচার সাথে। হোঁচট খাচ্ছে একটু পরপর।
“আরে টুটুল! এত ঢিলে হলে কি চলে? হাত চালা জলদি। এই জমিটা আজ শেষ করে ফেলব। এরপর ধরব পূবদিকের ক্ষেত।”
বিশাল ক্ষেত দেখে টুটুল দমে গেল ভেতরে ভেতরে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না, হাত এবং পা, দুটোই দ্রুত চালালো।
একটু পরেই চাচী খাবার নিয়ে এলেন। খেতে বসে টুটুল লক্ষ্য করলো হাতটা মুঠো করতে পারছে না। কেমন অবশ অবশ লাগছে। ওর মনে পড়লো বাসায় স্কুলের এসাইনমেন্ট করতে করতে যখন হাত ব্যথা হয়ে যেত, তখন মা মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিতো। টুটুল টিভি দেখতে দেখতে ভাত খেতো।
“বাবা খাচ্ছ না যে! চাচীর রান্না বোধহয় ভাল হয়নি, তাই না?”
“না না চাচী, অনেক মজা হয়েছে।”- তাড়াতাড়ি বলল টুটুল। এরপর কোনমতে দু’লোকমা মুখে দিয়ে উঠে পড়লো।
গাঁয়ে আসার পর প্রথমবারের মতো মনটা খারাপ হলো তার।
দূরের মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসছে। সন্ধ্যে হতে না হতেই কয়েকটা শেয়াল ডেকে উঠলো। বড় অস্থির সেই ডাক।
চাষের সরঞ্জামাদি নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে টুটুল। চাচা অনেক এগিয়ে আছেন টুটুলের চেয়ে। মাঝেমাঝে পিছন ফিরে তাড়া দিচ্ছেন দ্রুত হাঁটার জন্য।
টুটুল এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে ঢলে পড়ে যাবে এখনই।
ঠিক তখনই বাতাসে একটা ঘ্রাণ ভেসে এলো। যেন গন্ধরাজ ফুল ফুটেছে কোথাও। টুটুল আশেপাশে তাকিয়ে কোন ফুলের গাছ দেখতে পেল না। ওর মনে হলো ঘ্রাণটা আসলে আসছে মায়ের শরীর থেকে। মা যেন টুটুলের কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন! বুক ভরে সুবাস টেনে নিল টুটুল!
মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো হঠাৎ করে।
উঠোনে পা দিয়েই টুটুল দেখলো মনির পাটি বিছিয়ে পড়ছে। রেশমা এখনো ছোট, তাই স্লেট আর চক নিয়ে “অ আ” লেখার চেষ্টা করছে। সামনেই টিমটিম করে আলো দিচ্ছে ছোট্ট একটা কুপি বাতি।
ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো টুটুল। হাতেপায়ে কাদা শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। সেগুলো ধুতেও ইচ্ছে করছে না। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। খিদে লেগেছে প্রচণ্ড। বেড়ায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো টুটুল।
কতক্ষণ এভাবে ছিল বলতে পারবে না। চাচার কথায় হুঁশ ফিরলো।
“পরীক্ষার কিন্তু আর বেশি দেরি নাই। মন দিয়ে পড়িস।”
সাথে সাথে টুটুলের মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়লো, “এত পড়াশোনা করে লাভ নাই, শুধু শুধু সময় নষ্ট।”
চাচা মনে হয় কয়েক ভোল্টের শক খেলেন। টুটুলের কথা শুনে মুখ হা হয়ে গেছে তার।
“কী বললি রে টুটুল?”
“বলেছি, পড়াশোনা করে লাভ নাই, শুধু শুধু সময় নষ্ট”- নির্বিকারভাবে টুটুল জবাব দিল।
“কথাটা কিন্তু একদম ঠিক বললি না!”- কিছুটা আহতকন্ঠে চাচা বললেন।
টুটুল জবাব দিল না, নখ দিয়ে খুঁচিয়ে পায়ের শক্ত কাঁদা তোলার চেষ্টা করতে লাগলো।
মুরাদ চাচা এক মগ পানি নিয়ে বসে গেলেন হাত-পা ধুতে। মনে হয়তো টুটুলের কথার জবাব খাড়া করছেন।
রাতে খেতে বসে চাচী যখন বড় কাতল মাছের মাথাটা মনিরের পাতে তুলে দিলেন, তখন টুটুলের আরেকদফা মন খারাপ হল। বাসায় যতবার বড় মাছ রান্না হয়, প্রত্যেকবারই টুটুল সেটা খায়। মা নিজেই ওর পাতে তুলে দেন।
মুখে কিছু বলল না টুটুল। একবার ভাবলো না খেয়ে উঠে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালো। সব মায়েরাই নিজ সন্তানের কথা আগে চিন্তা করেন। চাচীও তাই করেছেন। এটাতে দোষের কিছু নেই।
হাতে ব্যথা নিয়েও কোনমতে রাতের খাবারটা খেয়ে নিল টুটুল। খাওয়া শেষে চাচী এঁটো বাসন নিয়ে চলে গেলেন। রেশমা বিছানায় গিয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। এক খিলি পান মুখে নিয়ে মুরাদ চাচা উঠোনে এসে বসলেন। পিছন পিছন টুটুল আর মনিরও এগিয়ে এলো।
আকাশে বিশাল থালার মতো এক চাঁদ। অসম্ভব সুন্দর আলো চারদিকে।
পিচিক করে পানের পিক ফেলে প্রথম কথা বললেন মুরাদ চাচা, “টুটুল, বাড়ির কথা মনে হয় না?”
“হুম চাচা।”- ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল টুটুল।
“এখানে ভালো লাগছে তোর?”
“হুম চাচা।”
“এত “হুম.. হুম..” করছিস কেন? ভালো না লাগলে বল, তোকে বাড়ি দিয়ে আসি।”
“না চাচা, বাড়ি যাব না”
মুরাদ চাচা কি যেন ভাবলেন। তারপর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মানুষ বড় অদ্ভুত জীব রে, টুটুল। এদের বোঝা বড় দায়… আমি জানি, কেন তুই সব ছেড়েছুঁড়ে গায়ে চলে এসেছিস। হাসান ভাই সব বলেছে আমাকে।
“আজ তোকে কয়েকটা কথা বলব, মনযোগ দিয়ে শুনবি।”
“তুমি যতই বোঝাও, আমি কিছুতেই বাড়ি যাচ্ছি না।”- টুটুল তাড়াতাড়ি বলল।
“আরে, তোকে বাড়ি যেতে কে বলেছে! আমার কথা শোন তো আগে!”
“তুই কি জানিস, আমি ছোটবেলায় খুব জেদি আর চঞ্চল ছিলাম? কারো কথাই শুনতাম না। সারা গাঁ টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম। এর গাছের ফল পেড়ে খেতাম। ওর চালে ঢিল ছুঁড়তাম। সাঁতারে আমার সাথে কেউ পারতো না। পানিতে এক ডুব দিয়ে চলে যেতাম বহুদূর। হাসান ভাই আমার চেয়ে বছর তিনেক বড় ছিল। প্রায়ই সে বই হাতে নিয়ে ঘুরতো। এমনও হয়েছে স্কুলের প্রয়োজনীয় বই না পেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে ধার এনে সেটা পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে। সারাক্ষণ বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকতো। আমি তাকে দেখে হাসতাম। বলতাম, ‘ওরে ভাই, বাইরে আয়। একটু আনন্দ করি চল। এত পড়ে তোর মাথাটাই যাবে একদিন।’ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসত। সেই হাসির মানে সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝি।
ফলাফল স্বরূপ, আমি মেট্রিকে ফেল করলাম আর ভাই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে উতরে গেল। আব্বা ভাইকে শহরে ভাল কলেজে ভর্তি করে দিলেন। আর আমি, দস্যিপনা করেই দিন কাটাতে লাগলাম।
পরেরবার মেট্রিক দিলাম, সেবারও ফেল। এবার আব্বা খুব রেগে গেলেন। আমাকে হুকুম দিলেন বাড়ি ছাড়তে। আমিও জেদ দেখিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। ওই জেদই আমার কাল হলো। আমি যেখানে আস্তানা গেড়েছিলাম সেখানে একদিন খবর পেলাম, আব্বা অসুস্থ। খুব খারাপ অবস্থা। এই খবরেও আমি বাড়ি যেতে রাজি হলাম না। রাগ আমার তখনও কমেনি। শেষতক আম্মা চিঠি লিখলেন আমাকে। সেই চিঠি পড়ে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বাক্স পেটরা গুছিয়ে বাড়ি রওনা হলাম। কিন্তু যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে সব শেষ। আব্বা অনেক দূরে চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে। অনেক অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন আব্বা। পরে শুনেছিলাম, আব্বা আমাকে দেখার জন্যে খুব অনুনয় করেছিলেন। হাসান ভাইয়ের এক হাত ধরে আরেক হাতে আমাকে খুঁজছিলেন আর বলছিলেন, ‘দস্যি ছেলেটা কই গেল আমার! ওরে কেউ ডাক, একটু ডেকে বল ওর আব্বা ওর জন্যে আকুল হয়ে আছে। কেউ একবার ডাক ওকে…’ “
কথার এই পর্যায়ে এসে চাচা চোখ মুছলেন। বহুদিন পর পুরনো স্মৃতি আবার তাকে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো করে কাঁদিয়ে দিল। টুটুল নিজেও জানে না কখন ওর চোখ ভিজে উঠেছে।
“সেই থেকে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি নাই। শুধু মনে হতো আব্বার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। তারপর অনেককাল পেরিয়ে গেছে। একদিন শুনলাম হাসান ভাইয়ের চাকরির খবর। ভাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সারাদেশে চৌদ্দতম হয়েছেন। বেশ ভাল বেতনে তার সরকারি চাকরি হয়ে গেল। আর আমাকে দেখ! আমি এখনো সেই আগের মতোই রইলাম। ইচ্ছা করলে শহরে গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করতে পারতাম। কিন্তু আমার ক্ষতবিক্ষত অনুতপ্ত মন আব্বার কবরের কাছ থেকে সরতে চাইলো না। আব্বার জমি দেখাশোনার দায়িত্ব নিলাম। চাষবাস করে অবস্থার অনেক উন্নতি এনেছিলাম। কিন্তু গেল বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আবার শুরু করব সব। আবার ভাঙবে, আবার গড়ব। এইতো বেশ চলছে জীবন!
তবে সত্যি কথা কি জানিস? আমার সন্তানকে আমি কখনই এই কষ্ট করতে দেব না। আমি যেটা পাই নাই আমার জীবনে, আমি চাই ওরা সেটা পাক। যত কষ্টই হোক আমি ওদের উচ্চশিক্ষিত করব।”- মনিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মুরাদ চাচা।
টুটুল মাথা নিচু করে আছে। কিছু বলছে না। কী বলবে? কীইবা বলার আছে তার?
“সময় খুব মূল্যবান জিনিস রে, টুটুল। একবার গেলে সেটা আর ফেরত আসে না। যেদিনগুলো আজ হেলায় নষ্ট করছিস সেই দিনগুলোতে তুই কত ফসল ফলাতে পারতিস, তা জানিস? আমি এখন কত আফসোস করি, হায়! তখন যদি আরেকটু পড়তাম! আব্বার কথা যদি শুনতাম!
যাদের আব্বা-আম্মা নাই তারা সবচেয়ে বড় দুঃখী এই দুনিয়ায়। কিন্তু এরচেয়েও বড় দুঃখী কারা জানিস? যারা বাপ-মা বেঁচে থাকতে তাদের দূরে ঠেলে দেয়। কারণে অকারণে কষ্ট দেয়। তারা প্রত্যেকে জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে এমন মর্মপীড়ায় ভুগবে যার সাথে কোন ব্যথারই তুলনা হয় না।
কিন্তু ওই যে, বললাম না! মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। এদের বোঝা বড় দায়… বিষ খেলে মরণ হবে জেনেও এরা বিষ খায়।”
“কীরে টুটুল, তুই কাঁদছিস! কাঁদতে হবে না রে বোকা, চোখ মুছ। রাগ করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিস তো কি হয়েছে! আবার মায়ের কোলে ফিরে যা। দুনিয়ার সব মানুষ পর হয় কিন্তু বাপ-মা কখনো পর হয় না রে। তুই যতবড় অন্যায়ই করিস না কেন তারা ঠিক তোকে বুকে টেনে নেবে। অনুতপ্ত সন্তানকে ফেরানোর ক্ষমতা তাদেরকে দেয়নি আল্লাহ!
এখন যা, ব্যাগ গোছা। আমি সকালে তোকে বাড়ি দিয়ে আসব।”- একটু হেসে মুরাদ চাচা বললেন।
টুটুল উঠে দাঁড়ালো রোবটের মতো। হেঁটে হেঁটে অন্ধকার ঘরটায় চলে গেল। তারপর টের পেল, মায়ের গায়ের চাপা গন্ধটা এখন একটু বেশি বেশিই নাকে লাগছে!
মাস্টারমশাই চশমাটা আবার নাক থেকে ঠেলে উপরে তুলে দিলেন। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে গেছে তার। পাটিগণিতের দশটা অংক দিয়েছিলেন টুটুলকে। ছেলেটা সবগুলোই ঠিকঠাক ভাবে করলো! খাতা দেখতে দেখতে হাসলেন তিনি। সেই হাসি হাসান সাহেবের চোখ এড়ালো না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সব। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে গালে হাত দিলেন। ওমা! গালটা ভেজা ভেজা!
তবে কি তিনি কাঁদছিলেন! তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলেন হাত দিয়ে।
সবাই দেখতে পেলে কি লজ্জার ব্যাপারটাই না হবে!
গল্পের বিষয়:
গল্প