জায়গাটা একটা ত্রিমোহিনীর মতো। এঁকেবেঁকে যাওয়া নদীর সাথে দুদিকের বিল থেকে নেমে আসা দুটি বড় বড় খাল মিশেছে। এখানে বর্ষায় প্রচুর স্রোত হয়। ভারী বর্ষণে দুই খালের মুখ দিয়ে নেমে যাওয়া পানির তোড় নদীর স্রোতে পড়তে গিয়ে প্রচন্ড ঘুর্ণি তোলে। তখন ঘুর্ণিতে পড়ে নৌকা ডুবি হয়। লোকজন মারা যায়। ঘাটে সব সময়ই সারি সারি নৌকা থাকে। একটা ঘাট ছেড়ে যায় তো আর দুটো ভিড়ে। লোকজনের চিৎকার হাঁকডাকে সবসময়ই মুখর থাকে পরিবেশ। মঞ্জুর এসব কথা তার বন্ধুর মুখ থেকে অসংখ্যবার শুনেছে।
ঘাটের কাছে বাস থেকে নেমেই মঞ্জুরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাড়া নিয়ে ঝগড়ার জেরে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তার গন্তব্যে পৌঁছাতে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘন্টা দেড়েক লাগে। এখন নদীর পাড় ধরে ঘুর পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়ই নেই।
এখন ফাল্গুন মাস। নদীটায় পানি থাকলেও খাল দুটি শুঁকিয়ে গেছে। ও দুটির তলানিতে সামান্য পানি। লোকজন হাঁটু অবধি কাপড় গুছিয়ে নিয়ে অনায়াসে তা পায়ে হেঁটে পারাপার হচ্ছে।
বেশ কয়েকটা চায়ের টং দোকান আছে। কলা, রুটি, সস্তা বিস্কুট বিক্রি করছে। গন্ডগোলের কারণেই হয়ত এখন ওসব দোকানে কোন খরিদদার নেই। অন্যসময় হলে মঞ্জুর ফিরে যেত। কিন্তু তার বিক্ষিপ্ত মন কেন জানি দীর্ঘ পথ হাঁটার কষ্টটাকেই আপন করে নিতে চাইছে। সে পায়ের কাছে প্যান্টের কিছুটা গুঁটিয়ে নিয়ে চপ্পল জোড়া ছোট্ট ব্যাগটার সাইড পকেটে ভরে নিয়ে ঢালু পাড় বেয়ে নিচে নেমে গেল।
খালে নেমে মঞ্জুর দেখল একটা ক্ষীণ স্রোতধারা খালের উপরের দিক থেকে নদীর দিকে বয়ে যাচ্ছে। হয়ত বিলের জমির সেচের পানি চুইয়ে খালে নেমে আসে। টলমলে পানি কাঁচের মত স্বচ্ছ। নীচে বালুকণা চিক্চিক্ করছে। সে সাবধানে পা ফেলে সামনে এগোতে থাকে।
খালের মাঝখান অবধি যাওয়ার পর পিছনে একটা ছলাৎ করে উঠা শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরাতেই মঞ্জুরের উপর একজন হুড়মুড় করে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল। অপ্রস্তুত মঞ্জুর চমকে উঠে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল।
ব্যাগটা আমার কাছে দিন- মঞ্জুর হাত বাড়াল।
না। আমি পারবো, ঠিক আছে- তরুণীটির মুখে লজ্জার আভা ছাড়িয়ে পড়েছে।
ততক্ষণে মঞ্জুর অপরিচিতার ঢাউস ব্যাগটায় হাত রেখে ফেলেছে। তার বাম হাতের বগলে আরও একটা ব্যাগ রয়েছে। দুটো ব্যাগ একজন মেয়েমানুষের জন্য একটু বেশি জুলুমই হয়ে যায়। তাছাড়া পরনের কাপড়চোপড় সামলানোও কম জক্কির ব্যাপার না। তাই তরুণী অপরিচিত হলেও লোকটার লৌকিকতায় আর আপত্তি না করে ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল।
পানিটুকু পার হয়ে মঞ্জুর নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিল- ধরুন, নয়ত এই খাড়া পাড় বেয়ে উঠতে পারবেন না।
তরুণী আরেকবার লজ্জায় লাল হয়ে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। তার মুখ থেকে কোন শব্দ বেরুল না। খালের পাড় বেয়ে নিচে নামার সময় তার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। কাজেই ঢালু বেয়ে উপরে উঠার কাজটাও যে খুব কঠিন হবে তা সে বেশ বুঝতে পারছে।
পাড়ে উঠেই তরুণীর হাতটা মঞ্জুর ছেড়ে দিল। শীত কাটিয়ে নতুন গরম পড়তে শুরু করেছে। ঋতু পরিবর্তনের ধাক্কায়ই বোধ হয় তার হৃদপিন্ডটা যেন একটু বেশিই চঞ্চল হয়ে পড়েছে। সে অস্থির হৃদয়কে সামাল দেয়ার জন্য খুব সাবধানে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতে নামাতে তরুণীর মুখের দিকে চোখ রেখে বলল- কোন্ দিকে যাবেন?
আমি শিমুলতলী যাব- তরুণী ব্যাগের জন্য হাত বাড়াল।
মঞ্জুর ব্যাগটা দিল না। ওটা নিজের কাঁধে তুলে নিতে নিতে বলল- চলুন যাওয়া যাক। আমিও ওই গ্রামেই যাচ্ছি।
ব্যাগটা আমাকেই দিন না!- তরুণী লজ্জিতভাবে বলল।
ভয় পাবেন না। আপনার ব্যাগের মালিকানা বদল হবে না। দুটো ব্যাগ নিয়ে আপনার খুব কষ্ট হবে। একই পথে যখন যাচ্ছি। আমি একটু নিই। নিন এবার হাঁটুন তো- মঞ্জুর পা বাড়াল।
– এতোটা পথ, আপনি…!
– হ্যাঁ, আমি মঞ্জুর আলম!
এবার দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠে সামনে পা বাড়ায়।
আমি তিন্নী- তরুণী নিজের নামটা বলল।
তিন্নী-তিনু! বাহ্ বেশ সুন্দর নাম- মঞ্জুর স্বগতোক্তির মত করে বলল।
তিনু- তিন্নী চমকে উঠে নিজেও নিজের বিশেষণটি একবার উচ্চারণ করে মঞ্জুরের মুখের দিকে তাঁকাল। এত সুন্দর করে কেউ কোন দিন তার নামটা উচ্চারণ করেনি। তার বুকে যেন এক আজলা ভালো লাগা ছলাৎ করে উথলে উঠে।
মঞ্জুরের হাঁটতে ভালই লাগে। অচেনা গ্রাম- অপরিচিত লোকজন, বাড়িঘর সবই আগে অদেখা। অদেখা অজানাকে দেখার মাঝে জানার মাঝে মানুষের খুব আনন্দ থাকে।
একবার দ্রুত কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মঞ্জুরের খেয়াল হল তিন্নী খুব পিছিয়ে পড়ছে। একটা গাছের ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে কতটুকু হাঁটা হয়েছে তার একটা আন্দাজ লাগানোর চেষ্টা করে সে। সময়ের হিসেবে তার কাছে মনে হয় না তারা দুই কিলোমিটার পথ হেঁটেছে। তিন্নী কাছে চলে এসেছে। সমান তালে চলতে না পারায় সে মনে হয় একটু লজ্জিত। মঞ্জুর তাকে স্বাভাবিক করার জন্যই বলল- আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
না, আসলে হাঁটার অভ্যাস নেইতো!- তিন্নী আরও লজ্জায় পড়ে যায়।
আচ্ছা, একটু বসুন। খানিকটা জিরিয়ে নিলে একটু ভাল লাগবে।
তিন্নী আর কথা বাড়ায় না। সত্যি সে খুব কাহিল হয়ে পড়েছে। একটু জিরোতে পারলে মন্দ হয় না। মঞ্জুর থেকে সামান্য একটু দুরত্ব বজায় রেখে সে ঘাসের উপর বসে পড়ে।
শিমূলতলীতে আপনার নিজের বাড়ি বুঝি?- মঞ্জুর আবার তিন্নীর মুখের দিকে তাঁকায়।
না, ওখানে আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছি- তিন্নীর কথার সাথে বুক থেকে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
কী অদ্ভুত ব্যাপার আমিও ওইগ্রামে আমার এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি!- মঞ্জুর কাকতালীয় ব্যাপারটার কথা ভেবে মনে মনে সত্যি খুব অবাক হয়।
তাই বুঝি!- তিন্নীর হাসির সাথে ওর নড়ে যাওয়া হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ যোগ হয়ে যায়।
আচ্ছা, চলুন ওঠা যাক। এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে।- মঞ্জুর উঠে দাঁড়ায়।
তিন্নী উঠে দাঁড়াতেই খেয়াল করে মঞ্জু তার ডান হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়েছে।
আপনার ওই ছোট সাইড ব্যাগটাও দিন। ওটার ওজনও নেহায়েৎ কম মনে হচ্ছে না।- মঞ্জুর তিন্নির দিকে সামান্য সরে আসে।
না, কী বলছেন আপনি! আপনার নিজের একটা ব্যাগ আবার আমার একটা অতবড় ব্যাগ নিয়েছেন। এখন আবার আরও একটা নিতে চাইছেন। আপনিতো আচ্ছা মানুষ!- তিন্নী সত্যি সত্যি খুব অবাক হয়।
মঞ্জুর তিন্নীর কথার কোন উত্তর দিল না। হাতটা বাড়িয়ে ব্যাগটা তিন্নীর কাঁধ থেকে টেনে নিল। তিন্নী আর কোন বাঁধা দিতে পারল না। অপরিচিত মানুষটার অদ্ভুত ব্যবহার, ব্যক্তিত্বের কোথায় জানি কেমন একটা জোর আছে। নয়ত অপরিচিত একটা জায়গায় একজন অপরিচিত মানুষের সাথে এভাবে পথ চলা যায় এমনটা সে কোনদিনই ভাবেনি।
হয়ত অর্ধেকটা পথ পাড়ি দেয়া হয়েছে। তিন্নী আরও একবার লজ্জার হাসি হাসল। মঞ্জুর দেখল একটা বাড়ির পাশে বড় একটা আম গাছ ওটার নীচে ছোট্ট একটা বাঁশের বেঞ্চি পাঁতা আছে। মঞ্জুর ব্যাগগুলি বেঞ্চিটার উপরেই রেখে দিল। তিন্নী বেঞ্চিটার একপাশে বসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সত্যি পায়ে হাঁটা যে কত কষ্টের তা আজ সে মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে।
মঞ্জুর বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে স্বরটা একটু চড়িয়ে নিয়ে বলল- বাড়িতে কেউ আছেন?
কে গো?- বলেই একজন মহিলা দৌঁড়ে এসে মঞ্জুর সামনে পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে মাথায় কাপড় তুলে দিল।
একটু পানি চাইছিলাম, প্লীজ!- মঞ্জুর হাসতে চেষ্টা করল।
গৃহকর্ত্রী শ্রেণীর মহিলা মুখ বাড়িয়ে একবার তিন্নীর দিকে একনজর দৃষ্টি বুলিয়েই বাড়ির ভিতরে চলে গেল। পরক্ষণেই চিৎকার করে বলল- ফরিদা, কই গেছস্! মা, জগটা গেলাসটা ভাল কইরা ধুইয়া কল থাইকা ঠান্ডা পানি দে ত! বাইরে দেখ্ সাহেবের বৌ পানি খাইব!
কথাগুলি দুজনেরই কানে গেল। কী অদ্ভুত ব্যাপার মঞ্জুর কি বলেছে এই তিন্নী নামের মেয়েটা তার বউ! একটু পরেই একটা সিলাভারের জগ ভর্তি পানি নিয়ে বছর দশেক বয়সী মেয়েটাকে এগিয়ে আসতে দেখে মঞ্জুর বুঝতে পারল মেয়েটার নাম ফরিদা।
ফরিদার হাত থেকে জগটা নিয়ে অনেকটা সংকুচিতভাবে মঞ্জুর গ্লাসে পানি ভরে তিন্নীর দিকে এগিয়ে দিল। তিন্নি গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানিটুকু প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল। সত্যি তার খুব তেষ্টা পেয়েছিল।
একটা কথা না বলেও তারা আবার ওরা চলতে শুরু করে। মহিলার কথাগুলি মঞ্জুরের কানে বাঁজতে থাকে। সে ভেবে পায় না তিন্নির মনেও কি কথাগুলি ঘুরছে? সে কি মনে মনে অনেক রাগ হয়েছে? নানা অগোছালো কথা ভাবতে ভাবতেই তার মুখ থেকে যেন ফস্ করে একটা প্রশ্ন খসে পড়ে- আপনার মন খারাপ?
নাতো, কেন?- তিন্নি ছোট্ট করে জবাব দিল।
না, মনে হল আপনি কিছু ভাবছেন।
সত্যি, ভাবছিলাম। ভাবছিলাম- আপনার সাথে কেন আরও আগে আমার দেখা হল না!- তিন্নি হেসে ফেলে।
তাতে কী হত?- মঞ্জুর অবাক হয়।
জানেন, আমার একটা তিক্ত অতীত আছে- তিন্নী কষ্টের ছাপ মুখে নিয়ে মঞ্জুরের চোখের দিকে তাঁকাল।
আমারও একটা অসুখী গতকাল আছে। আমাকে ডিভোর্স দিতে হয়েছে।- মঞ্জুর সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
আবার দুজন নিঃশব্দে পা ফেলে সামনে এগোতে থাকে। হঠাৎ করে মঞ্জুর তিন্নির সামনে ঘুরে দাঁড়ায়। তার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল- আমরা কি ফিরে যেতে পারি না?
কোথায়?- তিন্নি চোখ কপালে তুলে ফেলে।
আমরাতো মুক্ত। আমাদের কোথাও যেতে কোন বাঁধা নেই। নাকি বল তিনু!- মঞ্জুর গভীরভাবে তিন্নীর চোখের দিকে তাঁকায়।
তিন্নী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মঞ্জুর থেকে দু পা পিছিয়ে আসে। তারপর মাথা দুদিকে দুলিয়ে সায় দেয়ার মত করে বলে-চলুন, যাওয়া যাক!
মঞ্জুর জিজ্ঞাসুনেত্র মেলে তিন্নীর দিকে তাঁকিয়ে থাকে। তিন্নী মুখে কিছু বলে না। তবে এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। দু’জন আবার পথ চলা শুরু করে। অতি-নাটকীয়ভাবে গন্তব্য পরিবর্তন করে ফিরে চলে নতুন পথের উদ্দেশ্যে। পাশাপাশি পা ফেলে ওরা হাঁটতে থাকে।