হিমু এবং তার লালচূড়া

হিমু এবং তার লালচূড়া

রাত দুটোর কাছাকাছি। খালি রাস্তায় আমি হাটছি নিশাচরের মতো। দাড়িগোঁফ ভর্তি মুখ, গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি আর কাধে একটা শান্তি নিকেতনি ব্যাগ। চৈত্র মাসের রাত দুটোয় কারো বাড়ি যাওয়া কোনো উৎকৃষ্ট সময় নয়। তবুও যাচ্ছি কারণ অসময়ে কারো বাড়ি উপস্থিত হওয়ার মধ্যে এক অন্যরকম মজা আছে। আমি যাদের বাড়িতেই যাই অসময়ে উপস্থিত হই।

একবার খালার বাড়িতে রাত ৩ টায় উপস্থিত হয়েছিলাম। তখন প্রায় আমার সে বাড়িতে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম কলিংবেলের শব্দেই খালু তড়িঘড়ি করে দরজা খুললেন। আমি জানতাম দরজাটা উনিই খুলবেন। কারণ এসময় তার মদ্যপানের সময়। খালু হতভম্ব ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এই অসময়ে কেন? তোমাকে না এ বাড়িতে আসতে মানা করেছি?

বিনীত ভাবে বললাম, বাদলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
খালু উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললো ‘বাদলের সাথে তোমার দেখা করা হবে না।’
তারপর কিছুটা নিরব হয়ে বললেন, আজ রাতটা থেকে যেতো পারো তবে বাদলের সাথে দেখা না করেই কাল সকালে চলে যেতে হবে। কারণটা আশা করি তুমি জানো। ইউ জাস্ট কনভিন্সড হিম।

তার কথা গুলো শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি নেশার ঘোরে পড়েছেন। তাই তিনি কথা বাড়াতে চাচ্ছেন না। মানুষ নেশার ঘোরে পড়লে কথা না বাড়িয়ে প্রতিপক্ষের দাবিও নিঃশব্দে মেনে নেয়। খালুও তাই করলেন আমাকে থাকার অনুমতি দিয়ে। ভিতরে ঢোকার পর মাতাল খালু দরজা লাগাতে লাগাতেই মাথা ঝাকিয়ে উঠলেন। তারমানে তিনি এখন বমি করবেন। আমি একটু সরে দাড়ালাম। করলেনও তাই। বমি করে দরজার চারপাশ ভাসিয়ে দিলেন।

তার ওয়াক ওয়াক শব্দে খালা ছুটে এলেন। ঘরের এমন অবস্থা দেখে তিনি স্তম্ভিত। তারপর ছি ছি করে বড় মেয়ে শাহিদাকে ডাকতে শুরু করলেন। আর রাগে চিৎকার করে বলতে লাগলেন এই লোকটার জন্য আমি মরে যাবো রে। মাতালের বমিতে আজ পর্যন্ত কেউ মারা গেছে শুনি নি। সেদিন খালার কর্মকাণ্ড আর আহাজারি দেখে হেসে ফেলেছিলাম।

কথা গুলো ভেবে এখনো আমি হেসেই শেষ। হঠাৎ একলোকের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখছি এক পুলিশ আমার দিকে দৌড়ে আসছে। এতোরাতে আমার মতো অদ্ভুত বেশে লোক দেখলে যে কারোরই সন্দেহ হবে। পুলিশ তো আরো বেশি সন্দেহকারী। তার ওপরে আবার টহলদার পুলিশ।

আমি দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলো, এতোরাতে এখানে কি করছেন?
আমি বললাম, বন্ধুর বাসায় যাচ্ছিলাম।
‘তো এতোরাতে কেন? খারাপ কি মতলব?’
‘জ্বি না, আমার গন্তব্য সবসময় রাতে হয়। দিনে কোলাহলের মধ্যে গন্তব্যের কোনো মানে থাকে না।’
পুলিশসাহেব চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আপনার গন্তব্য তো এখন হবে জেল’
: কেন?
: এমন একটা এক্সট্রা সিকিউরিটির এলাকায় এতোরাতে চলাফেরা করা কোনো স্বাভাবিক কাজ না। কাজেই আপনাকে এখন থানায় যেতে হবে।

আগে পুলিশরা ছোট বাঁশি ব্যবহার করতো। এখন আধুনিক পুলিশেরা ব্যবহার করে ওয়াকিটকি। পকেট থেকে ওয়াকিটকি বের করতেই জিপ হাজির অবিকল বাংলা সিনেমার মতো। থানায় পৌছতেই পুলিশটা আমাকে একটা মোটা সোটা লোকের সামনে বসিয়ে দিলেন। দেখে মনে হচ্ছে থানার এস আই। পান চিবুচ্ছেন, ফরসা চেহারায় পান খাওয়া ঠোট গুলো বেশিই লাল দেখাচ্ছে। ফরসা মুখে টকটকে লাল ঠোট একেবারে জাপানের পতাকার মতো লাগছে।

তিনি আমাকে একেবারে আপাদ মস্তক দেখে নিলেন। তারপর মুখটা বাকা করে পানের পিক ময়লার ঝুড়িতে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি?

: জ্বি, হিমু।
: আসল নাম?
: হিমালয়।
আমার এই অদ্ভুত নামের প্রতি কোনো কৌতুহল না দেখিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে? : সম্ভবত কর ফাকি দেয়ার জন্য।
: মানে?
: গভীর রাতে এক্সট্রা সিকিউরিটি এলাকায় ট্যাক্স না দিয়ে হাটার কারণে আমাকে ধরে আনা হয়েছে।
: ইয়ারকি বন্ধ করুন।
: জ্বি আচ্ছা।
: দূরে ওই বেঞ্চে গিয়ে বসুন।
: জেল বা হাজত কিছু হবে না?
: আপনি তো বড় ফাজিল মানুষ দেখছি। যান, ওখানে বসুন। আপনার ব্যাগটা এখানে রেখে যান। তল্লাশি করতে হবে।

দীর্ঘক্ষণ একজায়গায় বসে থাকা অনেকের কাছে কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমার কাছে পানিভাত। মাথাটা একটু হেলান দেয়ার মতো জায়গা হলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি। চোখ বুজে হালকা ঝিমালেই আমি আবছা আমার লালচূড়াকে দেখি, ঘুমালে দেখি স্পষ্ট। লালচূড়া ব্যাপারটা বোধ হয় খটকা লাগলো আপনাদের কাছে।

ছোটবেলার কথা, যেদিন বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম সেদিন রাতেই আমি আমার লালচূড়াকে স্বপ্নে দেখতে পাই। এর পরে প্রায়ই দেখি। একটা পাহাড় যার চুড়ায় আছে কিছু শুকনো গাছ যার পাতা গুলো শুকিয়ে বাদামী হয়ে আছে, সাথেই আছে অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল আর শুকনো পাতা নিয়েই আমার লালচূড়া। সেই চুড়ার ঢালু থেকে লালশাড়ি পড়া এক নারী দৌড়ে নেমে যাচ্ছে কিছুদূর নেমেই পিছনে তাকিয়ে আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। এই নারীটি আমার মা, তখনই এক মায়া জড়ানো শ্লেশ্মা যুক্ত পুরুষালী কন্ঠে কেউ আমার পিছন থেকে ডাকে হিমু বলে। যখনই পিছনে তাকাই আর বাকিটা দেখা হয় না। স্বপ্নটা আমার আরো দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নসিবে থাকে না। স্বপ্নের মধ্যেও আমি বুঝতে পারি আমি স্বপ্ন দেখছি, তাই আরো দেখতে চাই স্বপ্নটি।

একটা মোটা কর্কশ কন্ঠের ডাকে আমার তন্দ্রা কাটে। কাল রাতের পুলিশটি আমাকে ডাকছে। এবারও দেখা হলো না আমার লালচূড়ার পিছনের লোকটিকে।

: এই যে নবাবসাহেব অনেক ঘুমিয়েছেন, এখন বাড়ি যান।’
: আমার সাজা শেষ?
: সাজাই বা পেলেন কোথায়, এখন যান। আর কোনোদিন গভীর রাতে রাস্তায় ঘুরবেন না।

চারপাশের পরিবেশ দেখে মনে হয়েছে সকাল হয়ে গেছে। ঝিমুতে ঝিমুতে বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নেইয়া গেলো। থানা হতে ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বের হলাম। গরমের সকাল তাই রোদটাও জলদি উঠেছে। এসময় ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট খাই। কিন্তু খালি পেটে আমি সিগারেট খাই না। কাজেই এখন কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে আমার সকালের খাওয়া শেষ করতে হবে।

সকালের ব্যস্ত রাস্তায় মানুষ চাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে পৌছতে আর আমি খুজঁছি চায়ের দোকান। গলির মুখে এক বড় সড় চায়ের দোকানে ঢুকলাম। বুড়ো দোকানি আমার দিকে বারবার আড় চোখে তাকাচ্ছে। আমি খানিকটা হেসে বললাম, চাচামিয়া আমি আপনার মতোই মানুষ। লোকটা এবার মাথাটা নিচে নামালো। দোকানির সাথে থাকা একটা ছোকড়াকে বললাম, এ ভাই তোর টেপে একটা গান বাজা দেখি।

ছোকরা ছেলেটা আমার কথা মতো গান ছাড়লো। ভেবেছিলাম বাউল গান হবে কিন্তু চলছে নজরুল সঙ্গীত “অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত দেহা”। গানটা আমার বেশ পছন্দের। টান গুলো কেমন অপরিচিত লাগে প্রতিবারই।

এক কাপ চায়ের মধ্যে পাউরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছি আর গান শুনছি। একটার পর একটা নজরুল সঙ্গীত চলছে। সকালের নাস্তাটা বেশ চলছে এককাপ চা, একটা পাউরুটি আর একথালা নজরুল সঙ্গীত। সম্ভবতো একথালা না হয়ে একঝুড়ি বললে ভালো হবে। এতোগুলো গান কোনো থালায় ধরবে বলে মনে হয় না।

খাওয়া শেষে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে ব্যাগে ঢুকালাম। এখন আর সিগারেট খাবো না। ইচ্ছে করছিলো আরো কিছুক্ষন গান শুনি, কিন্তু সময় পড়ে গেছে আমার যেতে হবয়

দোকান থেকে বেরোনোর পর বুঝলাম সকাল ৯-১০ টা হবে। দোকানের ভিতর থেকে মনে হচ্ছিলো ৮ টার বেশি হবে না। এখন খালার বাসায় রওনা দিলে পৌছবো দুপুর ১২ টা বাজে। তখন কারো বাড়ি যাওয়া মোটেও ভদ্রতা নয়। তবে আমি যাবো। হঠাৎ কাউকে বিভ্রান্ত করতে বেশ মজা লাগে। খালার বাড়ি এলিফ্যান্ট রোডে। বাসে যাবো না। প্রচন্ড মানুষের গায়ের গন্ধে বমি চলে আসে। কাজেই আমার গন্তব্য হবে পায়ে হেটে। চৈত্রের এ রোদে হেটে চলাটাও যে মজার তা সবাই বোঝে না।

পুরোনো রাস্তা, তাই ভাঙা কাকর গুলো স্যান্ডেলের সামনে থেকে ঢুকে পেছন থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভালোই লাগছে কাকর গুলো যেনো আমার স্যান্ডেলের ভিতরে তাদের চলার পথ খুঁজে পেয়েছে। পায়ে কিছুটা ব্যাথা হচ্ছে তবুও কারো চলার পথ আটকানোর অধিকার আমার নেই। আমার বাবা তার মোটা চামরার ডায়েরিতে অনেক বানী লিখে গেছেন তার মধ্যে একটি “এ পৃথিবীতে সবার চলার অধিকার আছে, তুমিও চলবে দূর হতে বহুদূর। কোনো বাধা মানবে না। কারো চলার পথে বাধা দেবে না। কারণ সেই অধিকার তোমার নেই। মানুষ চলতে চলতে তার পথকে চিনতে পারে।”

গরমের দুপুরে রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটি শরবতের দোকান দেখা যাচ্ছে। তারমধ্যে একটি আখের রসের দোকান। দোকানি একটা অল্প বয়সী ছেলে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার চেয়ে সেই বেশি তৃষ্ণার্ত। কারণও আছে বেশ, সব দোকানে ভীড় হলেও ওর দোকানে মোটেও নেই। আমি দোকানের সামনে গিয়ে দাড়াতেই জিজ্ঞেস করলো, স্যার শরবত দিমু?

যাক বাবা স্যার বলে ডাকছে। অন্তত সামাজিক উচ্চ মর্যাদাটা পাওয়া গেলো। জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকা?
:একগ্লাস দশ টাকা তয় আপনে যদি নেন তয় দুই গ্লাস পনেরো টাকা দিয়েন।
:তাহলে দুই গ্লাসই বানা।

শরবত বানানোর কায়দা বেশ জটিল। একটা ইক্ষুকে চিপে, নিংরে ওর ভেতরের সব জল বের করে আনছে। মানুষও এমন করে সব কিছু উজার করে দেয়। ছেলেটা দুই গ্লাস শরবত বানিয়ে আমার সামনে রাখলো।
একগ্লাস খেলাম আরেক গ্লাস বললাম ওকে খেতে। ছেলেটা চোখ নামিয়ে বললো
‘না স্যার, আপনেই খান।
‘আরে বেটা নে, আজকে তুই আমাকে অফার দিলি তাই তুই আমার মেহমান।’
ছেলেটা গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে গ্লাসটা ফাকা করে দিলো। যে মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার এতো তৃষ্ণা থাকাটা বেশ কৌতুহলী ব্যাপার।

মানিব্যাগটা ঘেটে শুধু একটা একশ টাকার নোটই দেখা যাচ্ছে। এমাসে এখনো খালা টাকা পাঠায়নি তাই পকেট ফাকা। একশ টাকার নোটটা ছেলেটার হাতে দিতেই ছেলেটা ভাংতি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি বললাম, পুরোটা রেখে দে।
‘না স্যার, শরবতের দাম ১৫ টাকা।
আমি খানিকটা হেসে বললাম, এতো গরমে শরবত খাওয়ালি তাই তোর বখশিশ। ছেলেটার মুখে থাকা একটা বিষন্নের ভাব তখন প্রায়ই কমে গেলো। আমিও হাটা শুরু করলাম হেলে-দুলে যেমনটা মহাপুরুষেরা হাটে।

খালার বাসায় কলিংবেল চাপতেই বাদল দরজা খুললো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে তার মাকে ডাকতে লাগলো। খালাও আমাকে দেখে কান্না শুরু করে দিলেন। বলতে লাগলেন “তোকে না বলেছি আমাদের সাথে থাকবি, তা না কে শুনে কার কথা। এতোদিন ধরে কোনো খবরও পাইনি তোর।’

খালার কথা গুলো আমার কানে ঢুকছে না। ক্ষিদে লাগলে ইন্দ্রিয় গুলোও বোধ হয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়। খালাকে বললাম, খালা খুব ক্ষিদে পেয়েছে, খাবার থাকলে দাও। খালা তড়িঘড়ি করে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে টেবিলে খাবার দিতে লাগলো। খাবারের আয়োজন বেশ ভালোই ভাতের সাথে গরুর গোস্ত। আমি খাচ্ছি আর খালা বসে বসে কথা বলেই যাচ্ছেন। তবে সে সব কথা আমার কানে যাচ্ছে না। খাবার চিবানোর সময় পাশে থাকা কারো কথা শোনা যায় না। খালা হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বললো, কিরে কিছু বলছিস না যে।

: বলো খালা।
: তোকে তো বললাম আমাদের সাথে থাকতে, কয়েকমাস কোনো খোজঁ খবর রাখিস না। বলি আমাদের সাথে থাকতে তোর সমস্যা কোথায়?’
: খালা জানোই তো খালু মানা করে দিয়েছে, আর তাছাড়া আমার পরিবারের সাথে থাকতে ভালো লাগে না।
: তোর পাগলামি নিয়ে তুই থাক, মা মরা ছেলে আমার কোনো কথাই শুনিস না। তবুও দুপুরের খাবারটা তো এসে খেয়ে যেতে পারিস।’
: আচ্ছা খালা আসবো।’

খালা জানে যে আমি আসবো না। তাই আবার কাঁদছে। তার কান্নার শব্দে আমার আর পেট পুরে খাওয়া হলো না। খাবার শেষে হাত ধুয়ে খালার কাছে বললাম টাকা দিতে। বেশ মোটা পরিমান টাকা আছে ৬-৭ মাস অনায়াসে চলে যাবে। টাকাটা নিয়ে রহনা দেবার জন্যে তৈরী হই, বিকেল হয়ে যাচ্ছে তাই আমার যেতে হবে।

ব্যাগ ঠিক করতে করতে বেরোনোর সময় বাদলটা ছুটে এসে হাত ধরে বললো ‘ হিমু ভাই আজকের দিনটা থেকে যাওনা।’
আমি কোনো উত্তর দেই না। মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলা শুরু করি। খালা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সে কান্না আমায় মোটেও দ্রবীভূত করেনি। বাবা আমায় মহাপুরুষ হতে বলেছে। আর মহাপুরুষদের কোনো আবেগ কাবু করতে পারে না।

আত্মীয় স্বজন বলতে আমার খালার সাথেই মাঝে মাঝে যোগাযোগ করি। এক চাচা আছে তাকে আমার দেখতেও ইচ্ছে করে না। আমাকে তাদের কাছে রাখতে চাইলেও আমি থাকি না। আমার অপছন্দের মানুষদের মধ্যে একজন আমার চাচা।

আজ আমাকে আরো একজনের সাথে দেখা করতে হবে। রুপার সাথে। আজ পর্যন্ত আমি যতোবারই রুপাকে দেখা দিয়েছি অসময়ে দেখা দিয়েছি। একবার মেসের পাশের দোকান থেকে রুপাকে ফোন করে একটা কথাই বলেছিলাম ‘রুপা কেমন আছো?’ তারপর চুপ হয়ে ছিলাম। রুপা উত্তর দিয়ে আর কিছু না শুনে আমাকে সহস্র বকাঝকা শুনিয়ে দিলো। আমিও লাইনটা রেখে দিয়েছিলাম।

প্রায় ছয়মাস পর রুপার সাথে দেখা করছি। আজকে হয়তো ওকে নীল শাড়ি আর খোপায় কদম ফুলে দেখবো না। ও থাকবে খুবই সাধারণ সাজে। রুপাকে সাধারন সাজেও অসাধারন লাগে। মাঝে মধ্যে ওর নাম দিতে ইচ্ছে করে সাধা-অসাধারন মানবী।

রুপা বেলকনিতে ইজি চেয়ারে বসে বই পড়ছে। ওকে আমি এর আগে কখনো বই পড়তে দেখেনি। হয়তো আগের চেয়ে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সাধারন মানুষ গুলোর এই বৈশিষ্ট্য থাকে। মানুষ মরনশীল কথাটার সাথে সাথে এটাও বলা উচিত মানুষ পরিবর্তনশীল।

আমাকে দেখে রুপা নিচে নেমে এলো। দোতলার বারান্দা হতে মানুষ এতো তারাতারি নিচে নেমে আসতে পারে জানতাম না। ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ক্রোধ ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন নিরব থেকে জিজ্ঞেস করলো
: তুমি কি কখনো শুধরোবে না?
: মানুষ শুধরোয় কি করে তা আমার জানা নেই।
: সব সময় হেয়ালিপনা করো না। তুমি এমন কেন করছো? তুমি কতবার আমাকে নীল শাড়ি পড়ে কদম ফুল খোপায় পড়ে সাজতে বলো তুমি আসবে বলে। কিন্তু তুমি একবারো আসোনা। কিন্তু তুমি কি জানো আমি প্রত্যেকবারই তেমনটাই সেজে তোমার জন্য অপেক্ষা করি।
: হ্যা, জানি।
ও উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো ‘ তোমার সাধারন কোনো গুনই নেই। আছে পাগলামি।
: আমার পাগলামি আছে কি না জানি না। তবে একটা পাহাড় আছে নাম লালচূড়া। আমি যাইনি কখনো। তবে তোমাকে একবার নিয়ে যাবো।’
রুপার চোখে আমার পাহাড়ের জন্য কোনো উৎসাহ দেখলাম না। কিন্তু কিছুটা রাগ কমলো বোধ হয়। তবে ওর চোখে পানিও দেখা যাচ্ছে।
‘তোমার কাছে আমি হাতজোড় করে বলছি এসব পাগলামি বন্ধ করো। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। তুমি কি আমাকে তোমার সমস্যা বলতে পারো না। প্লিজ!

আমি কি রুপাকে আমার সব কিছু বলতে পারি। আমার জীবন গল্পের ব্যাপারে, যেখানে জন্মের কয়েক বছর পরে মা মারা যায়। পুরোনো শত্রুতার জেরে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে আমার আপন চাচা। নাকি বলবো আমার লালচূড়ার কথা যেখানে শিশিরস্নাত ঘাসের উপরে দাড়িয়ে আমার মা আর এক আগন্তুক হয়তো আমার বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করে। নাহ ওকে কিছুই বলা যাবে না। কারণ হিমু থাকবে অব্যক্ত অপ্রকাশিত, সবার কাছে এক কৌতুহলী অসাধারন মানুষ।

রুপার কথার উত্তর না দিয়ে আমি হাটছি। বুঝতে পারছি রুপা কাঁদছে। কিন্তু কারো আবেগে আমাকে জড়ালে হবে না। হিমুর আবেগ থাকতে নেই। এই হিমুকে যেতে হবে দূর হতে বহুদূর। যেখানে পথ সীমানাহীন। বহুদূর হাটতে হাটতে রুপার সাথে দেখা হবে বহুদিন পর। আমি জানি ও তখনো থাকবে আমার প্রতীক্ষায়।

বাবার ইচ্ছে আমি মহাপুরুষ হবো। তাই আমাকে আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধারণ। আমি চলতে থাকি অবিরাম, সেখানে আমার পথের কোনো শেষ নেই। গন্তব্যহীন যে যাত্রা সেখানে পথের শেষ থাকার কথাও না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত