– ভাইয়া আপনার নাম কি আরমান? ইউটিউবে we don’t talk anymore গানটা দেখছিলাম।
ভিডিওটা দেখতে ভালই লাগছিল। হঠাৎ করেই কাবাবে হাড্ডির মত হয়েই একটা মেয়ে উপরের কথাটা বলে উঠলো। চোখ তুলে তাকালাম মেয়েটার দিকে। মেয়েটাকে চিনি, তবে নাম জানিনা। আমাদের ইউনিতেই পড়ে। মনে হয় আমার দুই ইয়ারের জুনিয়র হবে। আমার নাম জানতে চাইছে মেয়েটা। আমি কিছুক্ষন গম্ভীর দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর বললাম ” নাহ আমার নাম আবির, আরমান নয়।”
এইকথা শুনে মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি মেয়েটার কথার উত্তর দিয়ে আবারো মোবাইলের দিকে নজর দিলাম। – সত্যিই আপনার নাম আরমান না? আমি আবারো মেয়েটার দিকে তাকালাম। তারপর বললাম “নাহ।”
মেয়েটা উদ্ভ্রান্তের মত আমার দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন আমি মেয়েটাকে ডেকে বললাম ” আমার নাম আরমান, এবার বলো কি বলতে চাও? ” মেয়েটার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে কোন কথা না বলে তার ব্যাগ থেকে একটা নীল খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। এই নিয়ে দশম বারের মত আমার কাছে এই নীল খাম এলো। কোন এক অজানা মানুষ প্রতিদিন আমাকে একটি করে নীল খামে চিরকুট পাঠাচ্ছে। তবে সে ব্যাক্তি নিজে আসে না, লোক মারফতে পাঠায় চিরকুটগুলো। কে এই মহান কাজটা করছে তা ধরতে পারছি না। হাতের লেখা দেখে অনুমান করতে পারছি উনি একজন মেয়ে। তবে আমার অনুমান ভুল হতে পারে। নীল খামটা পকেটে রেখে দিলাম।
বাসায় গিয়ে পড়ে দেখবো। .. ইউনিতে আমার বন্ধু খুব একটা নেই। যারা ছিল তারাও এখন প্রেম নিয়ে মহাব্যস্ত। প্রেম নামক কোন পরীক্ষা থাকলে তারা এই বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাস করতো। আর আমি সর্বনীম্ন নাম্বার নিয়ে ডাব্বা মারতাম। জীবনের চব্বিশটা বসন্ত কেমন করে গায়েব হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। তবে এখন পর্যন্ত জীবনে প্রেম নামক বস্তুর ছোঁয়া পাইনি। আর কোনদিন পাবো কিনা তাও সন্দেহ। যাক গল্পের মোড় অন্য দিকে না ঘুরিয়ে সোজা রাস্তায় চলতে থাকি। ইউনি থেকে বাসায় আসলাম। বাইরের গরমের কারনে নিজেকে কেমন যেন সেদ্ধ সেদ্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে আমি একটা ডিম। আমাকে সেদ্ধ করা হয়েছে, একটু পরেই কেউ একজন এসে হালকা লবনের ছিটা দিয়ে আমাকে টপ করে গিলে ফেলবে। এত গরমে মানুষ বাঁচে কেমনে?
তাড়াতাড়ি জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করতে ঢুকলাম। সেখানেও আরেক ফ্যাসাদ। সাবান মাখার মাঝামাঝি অবস্থায় পানি শেষ হয়ে গেল। আম্মুকে ডেকে বললাম পানি ছাড়তে। আম্মু তো আমাকে সেই এক ঝাড়ি মেরে চলে গেল। বোধহয় আম্মুর মেজাজ খারাপ। এখন পানি ছাড়বে কিনা সন্দেহ। তাই সাবান গায়ে মেখে চুপচাপ বসে রইলাম। হঠাৎ সেই নীল খামের চিরকুটের কথা মনে পড়ে গেল। কি লেখা আছে তাতে কে জানে! গতকালের চিরকুটে লেখা ছিল ” যতনে রেখেছি তোমার হৃদ মাঝারে, চাইলেও যেতে পারবে না আমায় ছেড়ে”। শুধু এতটুকুই লেখা ছিল চিরকুটে। আজ কি লেখা থাকতে পারে? .. আধাঘন্টা পর গোসল সেরে বেরিয়েই আগে চিরকুটটা হাতে নিলাম।
ধীরে ধীরে চিরকুট খুলে দেখলাম সেখানে দুইটা লাইন লেখা, ” তোমার ওই চশমার ফ্রেম হয়ে থাকতে চাই, যাতে সবসময় তোমার পাশে পাশে থাকতে পারি।” ওরে বাপস!!! আমি যে চশমা পরি এটাও জানে? কে এই মেয়ে? নাকি আমারই কোন বন্ধু আমার সাথে ফাজলামো করছে? নাহ কালকে গিয়ে ব্যাপারটা ভাল মত দেখতে হচ্ছে। .. পরদিন যথারীতি ইউনিতে গিয়ে শহীদমিনারের সিড়িতে বসে আছি। এমন সময় একটা মেয়ে এসে বললো ” ভাইয়া এইটা আপনার জন্য।” মেয়েটাকে আমি চিনি।
ওর ভাই আমাদের পাশের এলাকাতেই থাকে। আমার মাথায় হঠাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। আমি খপাং করে মেয়েটার হাত ধরে বললাম, – এই মেয়ে তোমার নাম মিতু না? আমার এমন আচরনে মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছে। ঘাবড়ানো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। আমি আবারও বললাম, – তোমার ভাইয়ের নাম আবির না? মেয়েটা এবার ভয়ার্ত গলায় উত্তর দিল ” হ্যা।” আমি তখন একটা অট্টহাসি দিয়ে বললাম, – এই খাম তোমার হাতে কে পাঠিয়েছে নাম বলো।
নয়তো তোমার ভাইকে বলবো যে তুমি আমায় প্রেমপত্র দিয়েছ। আমার এই কথা শুনে মেয়েটা এবার বুঝি কেঁদেই দেয়। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, – প্লীজ ভাইয়া একথা বলবেন না। তাহলে আমার ভাইয়া আমাকে মেরেই ফেলবে।
– হুম তাহলে বলো কে দিয়েছে এই চিরকুট? – নাম বলতে নিষেধ করেছে তো। – ঠিক আছে নাম বলার দরকার নেই। আমি বরং আবিরকে ফোন দিচ্ছি। – না না ভাইয়া বলছি বলছি। – হুম জলদি বলো।
– ইরা আপু পাঠিয়েছে আমাকে। .. ইরার নাম শুনেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। ইরা আমাকে প্রতিদিন চিরকুট পাঠায়? নাহ তা কি করে সম্ভব? আমাদের এই ইউনির সবচেয়ে সুন্দরী হচ্ছে ইরা। শতশত ছেলেরা লাইন ধরে আছে ইরার পেছনে।
আর ইরা আমাকে চিরকুট পাঠাবে? নাহ বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। সোজা চলে গেলাম পুকুর পাড়ের কদম গাছের নীচে। আমার জানামতে ইরা এখন ওখানে ওর বান্ধবীদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। আসলে আমি ইরাকে পছন্দ করতাম। প্রথম দেখায় ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে ওর সৌন্দর্য দেখে ওর প্রেমে পড়িনি। পড়েছি ওর মায়াবী চোখদুটো দেখে। ওই চোখে একটা আলাদা টান আছে। ওই টান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এই অধমের ছিল না। কিছুদিন ইরাকে ফলো করেছিলাম। তারপর হাল ছেড়ে দেই।
কারন আমার চেয়ে হাজারোগুনে ভাল ছেলেরা ইরার পেছনে লাইন মারছে। তাদেরকেই পাত্তা দেয়না সেখানে আমি কোন ক্ষেতের মূলা? .. হুম যা ভেবেছিলাম তাই, ইরা তার বান্ধবীদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ইরার বান্ধবীরাও একেকটা আগুনের গোলা। এইসব সুন্দরীদের সামনে যেতে কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলাম। যাবো কি যাবো না ভাবছিলাম। এমন সময় ইরার এক বান্ধবী আমাকে দেখে ফেললো। তারপর সে ইরাকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিল। ইরাও চোখের ইশারায় তাদেরকে কি যেন বললো। তারপর ইরা বাদে সবাই উঠে চলে গেল আমার সামনে দিয়ে। .. আমি ধীর পায়ে ইরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার চোখদুটো নীচে নামিয়ে রাখলাম।
কারন ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললে হয়তো আমি অজ্ঞান হয়েও যেতে পারি। প্রথমে কি বলে শুরু করা যায় ভাবছিলাম। মাথায় কিছুই আসছে না। তখনই ইরা বলে উঠলো, – আরমান কিছু বলবে? ওর কন্ঠ শুনে হার্টবিট বন্ধ হওয়ার জোগাড়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, – এসবের মানে কি? – কিসের মানে? – এইযে প্রতিদিন চিরকুট পাঠাচ্ছো এসবের মানে কি?
আমার কথা শুনে ইরা গুম হয়ে গেল। প্রায় পাঁচমিনিট ধরে আমরা নীরবতা পালন করলাম। তারপর আস্তে করে ইরা বলে উঠলো,
– ও তাহলে জেনে গেছো সব? – তাহলে সত্যিই তুমি চিরকুট পাঠাচ্ছিলে?
– কেন তোমার কি সন্দেহ হচ্ছিল? – হুম কিছুটা হয়েছিল। কিন্তু কেন পাঠাচ্ছো এসব?
– কেন বুঝো না কিছু? ন্যাকা নাকি তুমি? – কি বুঝবো হুমম? – চিরকুট পড়ে কিছুই বুঝোনাই?
– উহু – আসো তোমাকে বুঝাই। একথা বলেই ইরা আমার হাত ধরলো। আমি চরম পরিমানে অবাক খেলাম। ইরা আমার হাত ধরেেছে? তারপর ইরা আমাকে টানতে টানতে একেবারে পুকুরের ঘাটে এনে বসালো।
– সত্যিই তুমি কিছু বোঝো নাই? – উহু বুঝি নাই। এবার ইরা রেগে গেল। ওর ফর্সা গালে লাল আভা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
– ন্যাকা সাজো হুম? ক্লাসে বসে আমার দিকে তো ঠিকই তাকিয়ে থাকতে পারো। আমি কোথাও গেলে আমার পেছন পেছন ঠিকই যেতে পারো। আর এখন কিছুই বুঝো না হুমম? ইরার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সত্যিই তো ক্লাসে আমি ইরার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে ইরাকে ফলো করতাম। কিন্তু অতি সাবধানে। ইরা এসব টের পাওয়ার কথা না।
– ইরা তোমার বোধ হয় কোথায় ভূল হচ্ছে। একথা শুনে ইরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
– মেরে তোমার হাড় গুড়ো করে দেব। আমাকে বোকা পাইছো তুমি? আমার ভূল হচ্ছে হুমম?
– হতেও তো পারে। – এতো কথা বুঝি না। আমি তোমাকে ভালবাসি। এখন যদি আমার দেখার ভূল হয়েও থাকে I don’t care. আমাকে ভালবাসতেই হবে। নয়তো……….
এতটুকু বলেই ইরা থেমে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন অবাক দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে আছি। ওর মায়বী চোখের গভীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছি। এই প্রথম ইরাকে এত কাছ থেকে দেখছি, ওর মায়বী চোখদুটো দেখছি। এভাবে তাকিয়ে আছি থেকে ইরা হয়তো কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– এই এভাবে হা করে কি দেখ? – কিছুনা। কি যেন বলছিলে? পুরোটা শেষ করো।
– বলছিলাম আমাকে তোমার ভালবাসতেই হবে। আমাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসা তো দূরের কথা, কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালে চোখদুটো উঠিয়ে মার্বেল খেলবো।
– তার দরকার নেই ইরা। এত তাড়াতাড়ি অন্ধ হওয়ার ইচ্ছা নেই। অন্ধ হলে যে তোমার ওই মায়াবী চোখের সুধা পান করতে পারবো না। .. ইরা এখন আমার বাহুডোরে। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কানে কানে বলছে ” সত্যি ভালবাসো তো? নাকি আমার হুমকির ভয়ে জড়িয়ে ধরেছো? ” আমি তখন হেসে বললাম ” জড়িয়ে কি আমি ধরেছি নাকি তুমি?” একথা শুনে আমার ইরা আবারো লজ্জায় লাল হয়ে আমার বুকে মুখ লুকিয়েছে।