অন্তীর বিয়ে

অন্তীর বিয়ে

অসহ্য গরম। চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। বাড়িটাকে কেমন যেন রেল স্টেশনের মত লাগছে। সবার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য। যেন খুব তাড়া। এখনি ট্রেন ছেড়ে দেবে, এটাই শেষ ট্রেন, ধরতে না পারলে আর বাড়ি যাওয়া হবে না। একটা ঘোর লাগা পরিবেশ। অনেকে আবার দেখি গরম কাপড়ও পড়েছে। এরা কি পাগল টাগল হয়ে গেছে নাকি। এদিকে আমি ঘামছি আর ঘামছি। আচ্ছা এটা কি শীতকাল!! না না তাহলে আমি এত ঘামছি কেন?

বাড়িটাকে এমন সাজিয়েছে কেন? ছবির মত লাগছে। কি সুন্দর বাতি গুলো জ্বলছে নিভছে। অদ্ভুত ছন্দময়তা!! চারদিকের সব মানুষগুলোও সেজেগুজে রং মেখে ঢং সেজেছে।

ও আচ্ছা বলাই তো হয়নি, সবাই মিলে আমাকে একটা স্টেজ এ বসিয়ে দিয়ে গেল মাত্র। আমাদের বড় দহলিজের একপাশে আমার পছন্দের নীল অর্কিড আর লাল টকটকে গোলাপ দিয়ে খুব সুন্দর একটা স্টেজ সাজিয়েছে, ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আমি তো কখনো আম্মু আব্বুকে বলিনি আমার এমনটা পছন্দ, ওরা কিভাবে বুঝে গেল! মা বাবাদের মনে হয় অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়।।

আমি কে তাইতো বলা হল না!! আমি অন্তী। আমি মা বাবার বড় মেয়ে। আসলে শুধু মা বাবার বড় মেয়ে বললে ভুল হবে, আমি এই বাড়ির বড় মেয়ে এবং একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকে এতো আদরের ফাঁকে কখন যে এত বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। আমাকে কেউ বুঝতেই দেয়নি। সবার এত এত ভালবাসার মাঝে আমাকেই আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সারাক্ষণ আহ্লাদে আবদারে কেটে যেত সময়গুলো। বন্ধুমহল থেকে শুরু করে সব জায়গায় শুনতে হত, অন্তী মেয়েটা এত Immature আর আহ্লাদি!!!!

কে একজন এসে বলে গেল আজ নাকি আমার বিয়ে। এজন্যই চারদিকে এত আলোর ছটা। সকাল সকাল পার্লারে নিয়ে অনেক সাজালো। সবুজ পাড়ের লাল বেনারসী আর আমার পছন্দের সব গয়না দিয়ে। তারপর স্টেজটাতে বসিয়ে দিয়ে গেল। কি আজব! আমিও পুতুলের মত বসে আছি!! সদা ছটফটে আমি আজ চুপসে গেছি। আমাকে নাকি বিয়ের সাজে অপ্সরী লাগছে। আচ্ছা আমি কি এত সুন্দরী?! সবাই আমার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমিও গোমরামুখে ছবি তুলছি। ছিঃ ছবিগুলো বিশ্রী হবে,গোমরামুখের ছবি কি ভাল হয়!! কিন্তু আমি তো হাসতে পারছি না….

বড় রাস্তাটার পাশে দেখলাম খুব সুন্দর একটা গেট সাজিয়েছে। সবাই হঠাত্ গেট এর দিকে ছুটছে,’বর এসেছে বর এসেছে ‘। আমার পাশের মানুষগুলোর এবার বর দেখার পালা। আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছে বর দেখার। সোনালি শেরওয়ানী মাথায় টোপরে কেমন লাগছে আমার বরটাকে?? মিটিমিটি হাসছে নাকি আমার মতই গোমরা মুখে বসে আছে?? আরে ওইতো বর চলে এসেছে। ঐতো অন্তীর বর অয়ন। অয়ন,হ্যাঁ অয়ন; যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ওই একটি নামেরই আরাধনা করেছি। পাতার পর পাতা চিঠি লিখে জমিয়েছি। কত পূর্ণিমায় কল্পনায় ওর হাত ধরে ভিজেছি। বৃষ্টিতে আনমনে ভিজেছি…. আমাদের বাসা থেকে তিন রাস্তা পরই অয়নদের বাসা। অগোছালো এলোমেলো একটা ছেলে। বয়সে কিছুটা বড় হলেও সামনের মাঠের খেলার সঙী হওয়ায় ছোট থেকেই অয়ন আমার বন্ধু। খেলার সাথীই একসময় ভালবাসার মানুষ হয়ে ওঠে।

ভালবাসার ঐ মানুষটার সাথেই আজ আমি স্বপ্নের রাজ্যে পাড়ি দেব। এই দিনতো আমার বহু কাঙ্খিত। দুই কপোত কপোতির ভালবাসায় ঝলসে যাবে চারপাশ। তবে কেন আজ আমি এত আনমনা। কেন এক অজানা ভয়ে বার বার শিউরে উঠছি?? বার বার কেন অন্তরাত্মা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে?? অজানা শঙ্কায় কনকনে শীতের রাতেও আমি ঘেমে একাকার!! বিয়েবাড়ির কোলাহল কোথায় যেন খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে!! মা বাবা দাদা দাদু আর সবার মুখগুলো থেকে থেকে মনে পড়ছে।

আজ আমি আমার হাজার বছরের চেনা পরিচিত মুখগুলো ছেড়ে বহুদূর চলে যাচ্ছি। অতি চেনা এক বরের সাথে অজানার পথে পাড়ি জমাবো একটু পরই। এই বাড়ি, উঠোন আমার অচেনা হয়ে যাবে। মানুষটা বড় চেনা কিন্তু পথটাযে তেমনি অচেনা অজানা…… এভাবেই অন্তীরা অয়নদের হাত ধরে অচেনা পথের যাত্রী হয়…..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত