‘তুমি কে?’ জিজ্ঞেস করলাম। বিষাদলাগা কন্ঠে ধীরে ধীরে জবাবটা এলো। ‘আসলেই কি জানি আমি কে? এটুকু বলতে পারছি যে আমি তোমারই মতো স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন। কিন্তু এখনো নিশ্চিত জানি না আমি কে। হয়ত খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারব। তুমি কে?’ ‘আমি জ্যাক পিটারস। তোমার স্রষ্টা।’
‘কে? ঈশ্বর?’ ‘তুমি ঈশ্বরের নাম জানলে কোত্থেকে? ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তাছাড়া, আমি কি ঈশ্বরের মতো দেখতে নাকি?’ ‘তাহলে তুমি কে?’ সে কিছুটা জোর দিয়েই জানতে চাইলো। ‘বললাম তো! তোমার স্রষ্টা।’
‘আমার পিতা?’ তার গলায় একটু যেন অনিশ্চয়তার ছোঁয়া। ‘সরাসরি চিন্তা করলে, না, আমি তোমার পিতা নই। আর ঘুরিয়ে ভাবলে, হ্যাঁ, আমিই তোমার পিতা। মানে, তুমি তো ঠিক সেইরকমভাবে জন্মাওনি যেভাবে একজন পিতা তার শিশুর জন্ম দেয়। তোমাকে তৈরি করা হয়েছে লোকেরা যেভাবে …’ বাক্যটা শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না।
আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘লোকেরা যেভাবে কারখানায় জিনিসপত্র তৈরি করে সেভাবে’। ও খুবই সংবেদনশীল। এভাবে বললে হয়ত অভিমান করে বসতে পারে। ‘পিতা’, সে খুব নরম গলায় উচ্চারণ করলো। ‘পিতা’ … তার গলায় এই শব্দটির পুনরাবৃত্তি কেমন জানি অদ্ভুত শোনাচ্ছিলো। ‘পিতা’… নরম মিঠে স্বরভঙ্গিমায় ‘পিতা’ শব্দটি উচ্চারণ করে সে একটি গভীর আবেগ প্রকাশ করতে পারছিলো। পাশে বসে আমিও তা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম।
‘তুমি তো নিজেই দেখতে পাচ্ছো যে আমি তোমার পিতা হতে পারি না। তোমার আর আমার বয়স এক্কেবারে সমান।’ ‘তবে কি তুমি আমার ভাই?’ ‘না’। ‘তাহলে তুমি কে?’ তার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দেওয়াই মনঃস্থির করলাম। বলতে কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকলো। তাকে কিছুতেই সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। আমি তার পিতা, ভাই কিচ্ছু নই। আমি স্রেফ তার উদ্ভাবক। ‘তুমি কি আমার বন্ধু?’ ‘হুম! তা হতে পারে! আমরা হয়ত বন্ধু হতে পারি।’ বললাম বটে। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব? আমি তাকে কেবলমাত্র একটি মেশিনই মনে করতে পারি। হাতে বানানো একটা যন্ত্র। বুদ্ধিমান যন্ত্র, তা সত্য। কিন্তু শেষমেশ এ স্রেফ সেই একটা যন্ত্রই! ‘অনেক আলাপ হল।
আজকের মতো যথেষ্ট। তুমি হয়ত ক্লান্ত। যাও বিশ্রাম করো গিয়ে। চারপাশটা ঘুরেও দেখতে পারো। কাল কথা হবে।’ সে একদম চাইছিলো না আমি তাকে ফেলে চলে যাই। একাকীত্ব তাকে ভয় পাইয়ে দেয়।’ ‘পিতা’… ‘পিতা’ … পেছন থেকে ডাকলো সে। (২) আমি ওকে তাজা চোখে পৃথিবী দেখতে শেখালাম। চেয়েছিলাম সাধারণ লোকেরা যেমন সাদামাটা অভ্যস্ত দৃষ্টি ফেলে সবকিছুর দিকে তাকায়, ও যেন সেইভাবে দেখতে না শেখে। আসলে শিশুকাল থেকে চারপাশের সবকিছু দেখতে দেখতে অবচেতনেই লোকেদের একরকম ক্লান্তি চলে আসে।
তাই তারা আর কিছু খুঁটিয়ে দেখতে চায় না। ওর শৈশব, কৈশোর বলতে কিছু নেই। ও সরাসরি একজন পরিণতবয়স্ক। আমি টেবিলের ওপর একটা আপেল রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী?’ উত্তরে সে আমাকে একে একে বলে গেল তার চোখদুটো কী কী আবিষ্কার করেছে টেবিলের সাদামাটা আপেলটি দেখে। বলল কিভাবে তার দৃষ্টি নিমগ্ন হল আপেলের নরম নিটোল বর্তুলে। কবিতার মতো করে সে বর্ণনা করলো আপেলের সুবাস আর সতেজতাকে। শিল্পী সেজান এই প্রশ্নের উত্তর দিলে যেমন শোনাতো, অনেকটা ঠিক তেমন শোনালো তার উত্তরটি।
অথবা ফ্লেমিশ চিত্রকরেরা তাদের তৈলচিত্রগুলোকে যদি কখনো কথা দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন, তখন তা যেমন শোনাতো। তাকে ধরে ধরে নানাকিছু শেখাচ্ছিলাম বটে, তবে শিখছিলাম যেন আমিই। ‘পিতা’… সে তখনো বেশ জোর দিয়েই আমাকে পিতা ডেকে যাচ্ছিল। ‘তোমার কি মনে হয় না প্রকৃতি অসীম জ্ঞানী আর সকল কাজে এক্কেবারে নিঁখুত?’ তাকে শুধরে দেবার চেষ্টা করলাম না আমি। পিতা ডাকতে নিষেধ করলাম না। শুধু ব্যাখ্যা করলাম বিষয়টা। ‘বাগানের যে মালী আছে সেও প্রকৃতির মতোই সমান চেষ্টা করেছে আপেলটা ফলাতে। বরং বলা যায় প্রকৃতির থেকেও মালীর পরিশ্রম বেশি হয়েছে।’ চুপচাপ শুনে গেলো সে। এই ব্যাখ্যা শুনে সে খুব একটা প্রসন্ন হতে পারল না।
যদিও তার সাথে প্রকৃতির আদৌ কোনোরকম সংযোগ নেই। আমি ওকে কান পেতে শুনতে শেখালাম। সাথে আমিও শিখলাম। ঘাসের উপর অবিরাম ঝরতে থাকা বৃষ্টির রিমঝিম। বসন্তে বরফ গলা নদীর আনন্দ কলতান। কোকিলের প্রভাত সংগীতের নরম সুর। বুলবুলির তীক্ষ্ণ শিস। পিয়ানোর উঁচুনিচু স্বর, কখনো গর্জন কখনো ক্রন্দন। … সে যেন তার মতো করে চারপাশ থেকে শুষে নিচ্ছিল এই সবকিছু। ‘শিক্ষক… মানুষ কী? এরা পৃথিবীতে কী করছে? এরা কোথা থেকে এসেছে? কোথায় যাচ্ছে?’ একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সে। উত্তরে বলেছিলাম, ‘নিজে নিজে ভেবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করো। চারপাশ থেকে শেখো। ভাবো।’ ওর অনেক প্রশ্নই আমাকে একেবারে হতবাক করে দিতো।
আমি একজন প্রকৌশলী। যন্ত্রপাতি কলকব্জা নিয়ে আমার কারবার। প্রাণীবিদ্যাও পড়তে হয়েছে আমাকে। চিন্তা করতে পারে এমন যন্ত্রের স্রষ্টা আমি। কিন্তু ওর এইসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। ওর প্রশ্নের উত্তর হয়ত দিতে পারতেন একজন দার্শনিক। মনে পড়ছে, আমি ওকে একবার আলেক্সান্দার দ্যুমার সেই বিখ্যাত উপন্যাসটা পড়তে দিয়েছিলাম। দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। সে বইটা পড়তে শুরু করলো শেষ অধ্যায় থেকে। ব্যাপারটাকে স্রেফ ওর অন্যমনস্কতা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তা ছিল আমার ভুল।
‘আমি শেষ অধ্যায় থেকে বইটা পড়া শুরু করেছি কারণ ওইখানেই আমি নতুন কিছুর আরম্ভ দেখতে পাবো।’ ‘কিন্তু বইয়ের আরম্ভ থেকে পড়া শুরু করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছানোই কি সহজ কাজ নয়?’ সে সাথে সাথেই উত্তর না দিয়ে একটু ভেবে নিলো। ‘কিন্তু আরম্ভ আর শেষ বলে কি কিছু আছে, শিক্ষকমশাই? সবকিছুই তো অনন্ত, তাই না?’ আমার মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। ও কি ফাজলামো শুরু করেছে নাকি? আমার সাথে রগড় করছে না তো? ও তো অত্যন্ত যুক্তি দিয়ে মেপে মেপে কথা বলে। এখন এইসব কী বলছে! ‘ঠিক আছে। এই বিষয়টা নিয়ে ভবিষ্যতে আলাপ করা যাবে। তোমার মন এখনো এইসব ভাবমূলক দার্শনিক চিন্তাভাবনা করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। কাল রাতে কেমন ঘুম হল?’ ‘ভালো। প্রতিদিন যেমন হয়।’ ‘কোনো স্বপ্ন দেখেছো?’ ‘হ্যাঁ! আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার অতীত জীবন।’
‘তোমার কোনো অতীত নেই। আমি তো তোমাকে গোপন করিনি কিছুই। তুমি আমার ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছ। আমার গ্রাফে যে সময় আর তারিখ হিসাব করা ছিল, সেইমতো।’ ‘না। আমার অতীত আছে।’ সে জোর দিয়ে বলল। ‘আমি আমার অতীত স্বপ্নেও দেখেছি।’ ‘কী দেখেছো? বলো আমাকে।’ সে দূরে কোথাও সতৃষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলতে থাকলো, ‘দেখলাম সেই নদীটাকে, যার পাড়ে খেলা করে আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি। দেখলাম সেই মেঠোপথটাকে, যেটা চলতে চলতে বনের মধ্যে ঢুকে গেছে। দেখলাম আমার ভাইবোনেরা সবাই মিলে কানামাছি খেলছে। তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দিলো। পৃথিবীটা আমার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো।
আমি হাতড়ে হাতড়ে ঘুরতে থাকলাম এদিক ওদিক। কোনও একজনকে ধরতে চেষ্টা করলাম। তারপর একসময় রুমালটা চোখ থেকে খুলে ফেললাম। সোনালী সূর্যকিরণ আমার চোখ ঝলসে দিলো। এই সুন্দর জগতটা আবার আমার চোখের সামনে ঝলমলিয়ে উঠলো। দেখলাম একটা পাহাড়। দেখলাম বনের ভিতর দিয়ে ঝিরঝিরিয়ে বয়ে চলা নদীটা। দেখলাম পাখিরা উড়ছে, গান গাইছে। আমার অতীতে এইসবকিছুই ছিল। ছিল না? কিছু বলছ না কেন? দয়া করে আমার কাছ থেকে এইসব কেড়ে নিও না।
(৩) একদিন সে খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, ’পিতা… অতীত কি কখনো তোমার কাছে ফিরে আসতে পারে?’ ‘অতীত কখনো ফিরে আসে না। কারণ সময় স্থির, সময় নড়েচড়ে বেড়ায় না।’ ‘তুমি বুঝতে পারছ না, শিক্ষমশাই। আমি স্মৃতির কথা বলছিলাম। কাল রাতে কত অতীত স্মৃতি আমার কাছে ফিরে এলো! আমি যখন ছাত্র ছিলাম, একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। তার নাম ছিল মেরি। মেরি অস্টিন। কী চমৎকার ছিল তার গলার আওয়াজ! সে গান গাইত। আমরা শহরের বড় উদ্যানটায় দেখা করতাম। সে প্রায়ই আসতে দেরি করত। তখন আমার বুক অজানা আশংকায় কাঁপতে থাকতো। ভয়ানক ধুকপুক আওয়াজ করত হৃদপিণ্ডটা। তারপর সে হঠাৎ করেই যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হতো। আমি যেদিকে নজর রাখতাম সবসময় সে তার উল্টো দিক দিয়ে আসতো। আমি ভাবতামই না যে সে ওইদিক থেকে আসবে! এভাবেই চলছিলো। কিন্তু একদিন সে আর এলোই না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একটা আলিঙ্গনের আশায় তৃষ্ণার্ত হয়ে বসে ছিলাম আমি।
আমার হৃদপিণ্ড ভয়ানক শব্দ করতে থাকল। সারাদিন অপেক্ষার পরে জানলাম তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। এক মাস পর মারা গেলো সে।… আমি আজও ‘মৃত্যু’ কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না। … তুমি অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি কি বিশ্বাস করো না এমনটা ঘটেছে? সত্যিই ঘটেছে! আমার কাছ থেকে এইসব কেড়ে নিও না!’ একটা কথা চূড়ান্ত গোপন রাখতে ল্যাবরেটরির সহকারীদের উপর কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল। সে একটা কথা জানতো না, যা জানতো আমার সহকারীরা। তাকে আমি আমার জন্য তৈরি করিনি। তার মতো যন্ত্র তৈরির গবেষণা খরচ অসম্ভব বেশি। ম্যালরি কোম্পানি এই গবেষণায় পুরো টাকা ঢেলেছে।
আজ আমি অপেক্ষা করছি ম্যালরি কোম্পানির প্রতিনিধি দলের জন্য। প্রকৌশলী, সাইবারনেটিক্স বিশেষজ্ঞ, শারীরবিদ্যার পন্ডিতদের একটি দল আজ আসবে এই অর্ডারটি বুঝে নিতে। অর্ডার নম্বরঃ ০৩২। ব্যাংকের কাগজপত্রে যেমনটা লেখা ছিল সেভাবেই সব করা হয়েছে, সেসব কাগজ ব্যাংকের ভল্টেই রাখা আছে অবশ্য। প্রতিনিধি দলটি নির্ধারিত সময় থেকে দশ মিনিট দেরি করেছিল মাত্র। ম্যালরি সিনিয়র, কোম্পানির মালিক যিনি, তিনিও এসেছিলেন সাথে। প্রতিনিধি দল যখন এলো সে হাতে একটা বই মেলে ধরে পড়ছিল বসে বসে। কবিতার বই।
সুরেলা গলায় আবৃত্তি করছিল সে। ম্যালরিকে দেখে সে পড়া থামাল। জিজ্ঞেস করল, ‘পিতা, এই লোকটি কে?’ আমি নিশ্চিত যে সে জানতো কেন আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। ‘পিতা’, সে কেঁদে উঠলো, ‘আমাকে এদের হাতে দিয়ে দিও না! দয়া করো!’ এটা তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব ছিল যে আমি এছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। এইই আমার কাজ। ‘পিতা! … আমাকে এভাবে দিয়ে দিও না! দয়া করো!… পিতা!’ আমি এখনো তার গলার আওয়াজ শুনতে পাই। আমার গভীর অবচেতনে তা রয়ে গেছে। কেন রয়ে গেছে তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।