“শালা,তাড়াতাড়ি কর,দেখস না কেমন রিনাখান টাইপ ম্যাডাম,ধরা পরলে সোজা ভোগে”
.
আবিরকে পেছনের বেঞ্চ থেকে নকল সাপ্লাই দিচ্ছে সাজ্জাদ।
সাজ্জাদ ডিপার্টমেন্ট এর অন্যতম জনপ্রিয় এক নাম,ওভার অল প্রতিভাটা ঈর্ষনীয় যেমন মেয়েদের সাথে ভাব করায় ঠিক তেমনি কম্পোজ দেখে লেখায়।
.
ছেলেটা পারে,সত্যিই পারে-সব সময় কেমন যেন মুখটাকে হাসি হাসি রাখতে,মুখের হাসি নামক পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসটা জানে শুধু,
পুড়ে পুড়ে ছাই হওয়া গোল্ডলিফ গুলো,হয়ত আরও কেউ কেউ জানতেও পারে কিছুটা,ছড়িয়ে
যাওয়া নিকোটিন এর ঘ্রানময় ধোয়া যতটা কাউকে বুঝাতে পারে দগ্ধ হৃদয়টার সুপ্ত দহনের জ্বালা।
.
সরকারি তিতুমীর কলেজে অনার্স এ নতুন এডমিশন নিয়েছে আবির।
যখন নতুন ক্লাশ,নতুন পরিবেশ সব অচেনা মুখের মাঝে সবাই খুজতে থাকে বন্ধন আবিরের এ ব্যাপারে ব্যাস্ততা যেমন একেবারেই নেই।
.
হতবিহব্বল নয় সত্যি বলতে,মেয়েদের পাশের আসনগুলায় একটা একটা করে আসন পুর্ন হতে থাকে আর সব ছেলেগুলার যেন বন্ধন খোজার আবেদনটা তীব্র হয়ে রুমটার ভিতরে খাবি খায়,কে কার আগে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটার সাথে ভাব জমাবে।
.
তাই সবাই মেয়েদের আশে পাশে হাটিহুটি, শোরগোল করে,যার যা প্রতিভা আছে তার সমুদয় প্রদর্শনী করছিল। উস্কো খুস্কো চুলে রুমটার এক কোনায় বসে থাকা আবিরের দিকে চোখটা কারো আটকায় নি।
.
নামটাই শুধু আবির,আসলে কথা বলা,চলাফেরা,ভাবভঙ্গি সর্বোপরি প্রচলিত দৃশ্যমান স্মার্টনেসের কোন রঙ্গই নেই আবিরের ভিতর।
.
অদ্ভুদ এই ব্যাপার গুলা,নামে-কামে কোন মিল নাই, চেহারা তরমুজের মত অথচ নাম রাখছে পেয়ারা।
দেখা যায়,কেউ পাঠা রাশির জাতক, আসলে রাশি যাই হোক গায়ে তীব্র পৌরুষালী উৎকট গন্ধ অথচ নাম রাখছে আতর আলী।
জৌতিষ বিচার ,কুষ্ঠি দেখে নাম রাখলে এমন বিড়ম্বনা কমানো যেত আর নামের মাঝেই হয়ত সবার একটা সাধারন পরিচিতি পাওয়া যেত।
.
প্রথম দিনে ওরিয়েন্টেশন শেষ করে,সবাই যখন হাই হ্যালোতে ব্যাস্ত, আবির একাই বের হয়ে গিয়ে বকুল চত্তরে বসে,পড়ে থাকা বকুল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বিনি সুতায় মালা গাথার খেলা খেলছে।
আসলে সবাই নতুন,কেউ কাউকে চিনে নাহ, জানে নাহ,এখানে কারো ভাব দেখার সময়ও কারো নাই,কেউ তাকিয়ে দেখছে না বিনি সুতায় মালা গাথার খেলা,পাশ কাটিয়ে যে যার মত চলে যাচ্ছে…
.
এরপর থেকে ক্লাশ শুরুর আগে ও পরে সবাই গ্রুপ করে আড্ডাদিত।
সব গ্রুপের প্রায় কমন একটা ফিচার হলো, গ্রুপ মধ্যমনি কোন একটা সুন্দরী মেয়ে। গ্রুপটাকে যদি বলা হয় কোন মন্দির তবে সুন্দরীটি তাহার অধিষ্ঠাত্রি দেবী,গ্রুপ অন্তঃপ্রান ছেলেগুলোর একটাই যেন ব্রত যে করেই হোক হতে হবে দেবীর মনঃপুত।
.
এইসব গ্রুপ গুলার কমন একজন সদস্য হলো সাজ্জাদ,দিনে দিনে যার বাবা মার দেয়া আকীকা করে রাখা নামটা প্রায় বিলুপ্তির পথে,সাধের নাম খানা বজ্জাত দ্বারা ভেরিফাইড হওয়ার প্রহর গুনছে।
.
গ্রুপে প্রায় সব সদস্যেরই একটা শ্রুতিকটু নিক নেইম থাকে,এই নামগুলা অবশ্য কোন কুষ্ঠির বাছ-বিচার না করেই পাওয়া হয় জীবনের কোন না কোন এক সেরা সময়ে যা আংশিক অভ্যেস ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট বহন করে।
.
কোন গ্রুপেই আবির মিশতে পারেনা,ভালো লাগেনা অত্তসব, সব কিছু কেমন যেন খেলো খেলো মনে হয় আসলে আবিরের, জীবন তরঙ্গের শিখরে উঠার ইচ্ছাটা হয়না পাদপ্রান্তে পতিত হওয়ার ভয়ে।হুমায়রার উপর অভিমানে মেয়েদের প্রতি একটা চুলকানী ভাব চলে এসেছে।
তাই বাড়তে থাকে নিঃসঙ্গতা, কেউ অবশিষ্ট পড়ে নেই সবাই ভিড়ে গেছে কোন না কোন দলে,খোজছে বন্ধন…
.
আবির ক্যাম্পাসে যায়,যদি হয় দু একটা ক্লাশও করে,তবে সরকারি কলেজগুলো যেন থাকে অজুহাতের অপেক্ষায়, কি বলে ক্লাশ না করানো যায়,এই মিছিল,এই দিবস,অমুক ইস্যু,তমুক ইস্যু চলতে থাকে ধারাবাহিক ভাবে অনির্ধারিত রুটিন বিপর্যয়।
.
এসব দিনগুলো সবাই চুটিয়ে আড্ডা দেয়, ঘুরাঘুরি করে শুধু অসহ্য লাগে আবিরের কাছে।
ক্যাম্পাসের সামনের দোকানগুলো হতে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ওয়্যারলেস গেট এর ‘চ’ব্লক এর মেসে চলে আসে।
.
এভাবেই,আবিরের ধীরে ধীরে ক্লাস,ক্যাম্পাস এর প্রতি অনীহা জমতে থাকে,বোহেমিয়ান ভাবটা আরো বাড়তে থাকে,একটা সময় আর তেমন ক্লাশ এই যাওয়া হয়ে উঠেনা।
.
প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা প্রায় সবাই চলে এসেছে পরীক্ষা দিতে।
অনেক মুখই আবছা আবছা মনে পড়তেছে,বাংলা কলেজ এর সামনে ফুট ওভারব্রিজ এ বসে অনেকেই গল্প করছে,অতি পড়ুয়া স্টুডেন্টগুলো পড়ছে,কেউ কেউ আবার কোন এক মধ্যমনির ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে নিয়ে ব্রতক্রিয়া সম্পাদন করছে আর দেবী ওদিকে পড়তে ব্যাস্ত।
.
কারো সাথেই ভাব হয়নি তাই আবির একটু দুরে দাড়িয়ে সাথে আনা কয়েকটা বইয়ের ছেড়া পাতা ঠিকমত ভাজ করে নিচ্ছে…
.
কিছুই পড়া হয়নি ঠিকমত, না পড়তে পড়তে একধরনের অনভ্যস্ততা চলে এসেছে, আবিরের পড়তে আর ভালোও লাগে না, মন কি চায় হয়ত সে নিজেই জানে না,এই বয়সটায়ই যে বহু দোষে দোষ্ট হয় মানব মন।
.
সাথে আনা কাগজ গুলোই একমাত্র ভরসা। যদি কিছু মিলে যায় নতুবা পাশের জনের হেল্প যতটা নেওয়া যায়,পাশের জনটাই বা কে?সেই বা কতটুকু জানে?আবিরের মতই সবজান্তা নয়তো আর কেনই বা হেল্প করবে?
আবিরের মাথায় নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।সিট প্লান হয়েছে, সবার গ্রুপগুলো আংশিকভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে একেকজন একেক রুমে পড়েছে।
.
আবির এর সিট পড়েছে রুমের কোনার দিকে, মনে মনে লাকি ভাবছে নিজেকে অন্তত নকল করার সুযোগ তো পাওয়া যাবে।রুমে ডুকেই কয়েকজন সবার সিট প্লান উঠিয়ে ফেলে নিজেদের মত গ্রুপ করে বসে পড়ল।আবির গিয়েছিল ওয়াসরুমে ফিরে এসে দেখে নিজের সিট টা দখল হয়ে গেছে,সবাই যযে জানে,এক দখল বার ডিগ্রির সমান তাই বলে কয়ে লাভ হলো না।
.
অগত্যা অন্য একটা বেঞ্চ এ একাই বসে পড়তে হলো,কয়েকটা ছেলে যাদের সাথে মাঝে মাঝে হাই হ্যালো হত তারা যেন আজ চিনেই না আবিরকে, একেকজন এ দু তিনটা সিট ধরে বসে আছে হয়ত কোন কোন মধ্যমনিদের জন্য।
.
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে,আবিরের পাশের আসনটা ফাকাই রয়ে গেছে কেউ বসেনি।হঠাৎ হুরমুড় করে গোলগোল চশমা চোখে সাজ্জাদ পাশে এসে বসল,বেচারা জ্যাম এ পড়ে বড় লেট করে ফেলেছে।
.
শুরু হয়ে গেছে ফিস ফিসানি,কে কি পারে, কয়টা লিখছে,ম্যাডামটা দেখতে কেমন এইসব,আবির শুনল কে যেন হিসহিস করে বলল,”নাকফুল নাইরে,সিউর আনম্যারিড,যা একখান মালরে…”
তেমন কিছুই লিখতে পারে না আবির, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সব আর সুযোগ খুজছে কাগজগুলো বের করে মিলিয়ে দেখার।
.
প্রথম দিকে বসা একটা ছেলেও আবিরের মত আরামসে বসে আছে, যেন নিরবতা পালন করছে,আরে এটা তো সেই, ভ্যানিটিব্যাগ হাতে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা… হয়ত প্রার্থনা করছে প্রিয়তমার এক্সাম ভালো হওয়ার জন্য।
.
আর দেখে কাজ নেই কপালে যা আছে,কিছু তো লিখতে হবে..কাগজ গুলো বের করে লেখা শুরু করে আবির,অনভ্যস্ততা আর অনাগত ভয়ের কারনে হাত চলছে না ঠিকমত,এবারই প্রথম নকল করা,বাহ! কপি ব্যাপারটা আজ কতটা সহজেই নিচ্ছে আবির,,এক সময়ের ক্লাশ ক্যাপ্টেন,নকল প্রতিরোধ ক্যাম্পেইনের সংগঠক আজ কেমন নিজেই ব্যাস্ত নকল করায়।সবই তো সময়ের দাবী!হয়ত ঐ সময়টাও কারো কারো জন্য সময়ের দাবীটা এমন ছিল।
.
ম্যাডাম খাতাটা নিয়ে রেখে দিয়েছিল,কিছুই লিখা হয়নি দেখে আবিরের খাতাটা ফেরত দিয়েছে,কাগজ গুলা অবশ্য নিয়ে নেয়।
আবির চুপ করে বসে থাকে,অনুশোচনা চেপে বসে চোখটা ভারী করে তুলেছে পাস মার্ক বুজি হলো না,এমন সময় সাজ্জাদ পাশ থেকে একটা কম্পোজ করা কাগজ বাড়িয়ে দেয়।চলতে থাকে লেখা…চলতে থাকে এক্সাম…কেটে যেতে থাকে বছর আর না পড়ে শুধুই নকলের জোরে আবিরদের প্রমোশন।
.
হুম আবিরদেরও একটা গ্রুপ হয়েছে,এটা নকলবাজদের গ্রুপ,সব নকলবাজ একসাথে হয়ে প্লান করে,শেয়ার করে নতুন নতুন ভাবে নকল করার টেকনিক।সব গুলো গ্রুপের মত এই গ্রুপটারও কমন একজন সদস্য সাজ্জাদ।
.
চারটি বছর কেটে গেছে,আবিরদের গ্রুপটাও বেশ প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে বেশ আগেই,বেশ আমুদেভাবেই কাটছিল সময়গুলো,আজও নকলবাজরা একসাথে বসেছে,মাস্টার্শের শেষ পরীক্ষাটি চলছে,আবির যথারীতি কিছুই পারেনা, কপি করেই পরীক্ষাটা শেষ করলো,শেষ করলো তার মাস্টার্শ অবধি শিক্ষা জীবনের শেষ পরীক্ষা।
.
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে পড়েছে সবাই,যে সব নকল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় সবই কমন পড়েছে,সবাই বেশ ভালোই লিখেছে,তবুও নকলবাজ গ্রুপটার সবার মন খারাপ কেন?আবির এবার চারপাশে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখছে,নাহ সবদিকেই কেমন বিষাদের সুর, সবাই কেমন ঘোমড়া হয়ে আছে…ঐতো হাবুল এগিয়ে আসছে,আবিরকে জাপটে ধরেছে “বন্ধু কিছু মনে রাখিস না”আবির এর সাথে প্রথম বর্ষে পরীক্ষার হলে একটু লেগেছিল গ্রুপ করে বসা নিয়ে,এক্সামটা সেবার খুব খারাপ হয় আবির পন করেছিল নাহ,কখনো কথা বলবে নাহ হাবুল এর সাথে।আবিরও ঝাপটে ধরেছে হাবুল কে।
.
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে,সবাই বের হয়ে যাচ্ছে বাংলা কলেজ এর গেট দিয়ে,ঐ ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে রাখা ছেলেটাও ব্যাগওয়ালীর হাত ধরে হাটছে,ব্যাগওয়ালী তার বা হাতে ধরে আছে তাদের দু বছর বয়সী বাচ্চা।সাজ্জাদ ওদেরকে দেখিয়ে আবিরকে একটা খোচা দিয়ে বলল,”ওদের তবু হয়ে গেছে রে……”
নকলবাজ গ্রুপটার সবাই প্রায় একসাথে বলে উঠল,শালা তুই আসলেই একটা বজ্জাত..
গল্পের বিষয়:
গল্প