কর্নেল রিড

কর্নেল রিড

কর্নেল রিড-এর ঘুম হারামের গল্প-

এবারের ঘটনাটা সম্ভবত ১৯২৪ এর দিকে। সে বৎসর নাকি রোজা হয়েছিল প্রচন্ড গরমের মধ্যে, মে মাসে। আর দিল্লির মত জায়গায় গরমের যে তীব্রতা, তা বোধ করি উপমহাদেশীয় কাউকেই বলার প্রয়োজন হবে না। লে কর্নেল রিচার্ড রিড, ব্রিটিশ আর্মির একজন অফিসার হিসেবে প্রায় দুই দশকের মত ভারতে কর্মরত। দিল্লি ক্যন্টনমেন্টে পোষ্টেড। অলস দুপুরে নিজের অফিসে বসে ঘামছেন। সামনে বিরাট এক প্যারেড গ্রাউন্ড দেখা যাচ্ছে,সেদিকেই মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছেন, আবার টেবিলের উপরে রাখা ফাইলটার উপরে একটু একটু করে নজরও বুলিয়ে নিচ্ছেন। আসলে তিনি কোন কাজেই মন বসাতে পারছেন না।

একে তো গরম, আর তার উপরে সেই সকাল থেকে একটা বিষয় দেখে তিনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা আগ্রহ নিয়েই বার বার তাকাচ্ছেন, সামনের ঐ প্যারেড গ্রাউন্ডটার দিকে। মে মাসের প্রচন্ড রোদের মধ্যে এক ভারতীয় সৈনিক, মিলিটারি পোষাক, গা এ একটা মিলিটারি গেন্জি, পিঠে মাঝারি সাইজের একটা বস্তা নিয়ে প্যারেড গ্রান্ডটার এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে যাচ্ছে আর আসছে। পেছনে পেছনে যাচ্ছে এক শিখ সুবেদার। বোঝাই যায়, কোন কারণে সৈনিকটির শাস্তি হয়েছে, মিলিটারি মার্শাল কোর্টে শাস্তি হিসেবে প্রাপ্ত দন্ড খাটছে সে।

সেই সকাল থেকে প্রায় কুড়ি কেজি বালু ভর্তি একটা বস্তা পিঠে নিয়ে পুরো প্যারেড গ্রাউন্ডটার এদিক থেকে ওদিক। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হলে বা গতি একটু শ্লথ হলেই পেছন থেকে সেই শিখ সুবেদারটা সৈনিকের প্রতি হাঁক মেরে উঠছে, কখনো কখনোবা হাতের ছড়িটা দিয়ে পা’র পেছনটায় একটা বাড়িও মারছে। প্রতি ঘন্টায় পনেরো মিনিটের মত বিরতি দেয়া হচ্ছে। সেই বিরতির সময়টুকু লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে গ্রাউন্ড মাঠের শেষ মাথায় একটা বড় গাছের নীচের টিউব ওয়েলের কাছে চলে যাচ্ছেন। কল চেপে পানি দিয়ে হাত মুখ ধুচ্ছেন, কুলি করছেন, এর পরে পাশে শুকনো ঘাসের উপরে বসে জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছেন। আর কখনোবা বসে, আবার কখনও দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে।

ইন্ডিয়ান মোহামেডানদের তিনি নামাজ পড়তে দেখেছেন, ক্যন্টনমেন্টের ভেতরেই ছোট একটা টিনের ছাউনী বিশিষ্ঠ মসজিদও আছে, সেখানেও দেখেছেন মোহামেডান সৈন্যদের নামাজ পড়তে। তা হলে লোকটা মুসলমান! সময় শেষ হলে সেই সুবেদার তার উদ্দেশ্যে বাঁশি বাজালে সে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে ধীরে ধীরে, পিঠে তুলে নিচ্ছে বালুর বস্তাটা, আবার শুরু হচ্ছে সেই দৌড়, একই ধারা। এভাবে সেই সকাল থেকেই দেখছেন কর্নেল রিড। দুপুরের দিকে একটা বিষয় দেখে তার উৎসাহ বেড়ে গেল। দুপুরে খাবারের বিরতিতে লোকটা সেই কলের কাছে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিল বটে, তবে এবারে সে বসলো না, ঐ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল, নামাজে। এভাবে প্রায় সারাটা দিনই চললো। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটার আগে তার সাজা খাটা শেষ হলে, শিখ সুবেদারটা চলে গেল, আর সাজা খাটা লোকটা গিয়ে কলের পাশে বসে হাঁপাতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পরে উঠে হাত মুখ ধুয়ে, কুলি করে আবারও এসে গাছের ছায়ায় বসলো। আহা, লোকটা এই প্রচন্ড গরমে আসলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কর্নেল রিডের মনের কোথায় যেন একটু মায়া হলো। তিনি তার আর্দালিকে ডেকে, হাতের ইশারায় লোকটাকে দেখিয়ে তাকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলেন। আর্দালির মুখে কর্নেল রিডের ডাক শুনে সেই বেচারার গলা শুকিয়ে গেল যেন! কর্নেল রিড একজন অতি উচ্চপদস্থ সিনিয়র অফিসার, তা ছাড়া একজন কড়া ও রাশভারী অফিসার হিসেবে সবাই তাকে চেনে, যমের মত ভয়ও করে। ভয় আর আতংক মেশানো ক্লান্ত শরীর নিয়ে সৈনিকটি এসে দাঁড়ালো কর্নেল রিডের সামনে। রিড তাকে আপাদমস্তক একবার খুব ভালো করে দেখে নিলেন। তার নাম, ইউনিট, ইত্যাদি সব জেনে নিয়ে শেষে জানতে চাইলেন, অপরাধটা কি ছিল, কেন তাকে সাজা খাটতে হলো? কর্নেল রিডের প্রশ্নের উত্তরে সৈনিকটা বলতে বাধ্য হলো; তার নাম, মির্যা আসিফ বেগ। একজন সাধারণ সৈনিক। আজ পর পর দুই দিন তার অফিসে আসতে দেরি হয়েছে, এর আগেও তাকে সতর্ক করা হয়েছে, আজও দেরি হয়েছে তারপরেও, এ কারণেই তাকে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে। কর্নেল জানতে চাইলেন দেরি হবার কারণ কি? আসিফ বেগ জানালেন, তার স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা, এর উপরে অসুস্থ।

তদুপরি আজ দু’দিন ধরে তার চার বৎসর বয়সী ছোট ছেলেটাও অসুস্থ, সেই ছেলেটার জন্য কবিরাজ ডাকতে গিয়েছিল খুব ভোরে উঠে। সেই কবিরাজকে বাড়িতে ছেলের কাছে পৌছে দিয়ে, এর পরে অফিসে আসতেই তার দেরি হয়ে গেছে। কর্নেল রিড শুনলেন, তবে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জানতে চাইলেন, দুপুরের খাবারের বিরতিতে তিনি মেসে গেলেন না কেন? উত্তরে আসিফ বেগ জানালেন, যে তিনি রোযাদার। রোযা আছেন। রিডের মনে পড়লো, এটা তো মুসলমানদের রমাদ্বান মাস চলছে। এই জন্যই বুঝি তুমি বার বার নামাজে দাঁড়াচ্ছিলে? কর্নেলের প্রশ্ন। স্যার, আমার ফরজ নামাজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরেও নামাজ পড়ছিলাম, একে তো এটা রোজার মাস, আর তা ছাড়া আমার ছেলেটা অসুস্থ। আল্লাহর কাছে ওর সুস্থতা চেয়ে দোওয়া করছিলাম, আমি তো বাবা! শেষের কথাটা শুনে কর্নেলের চোখদুটো জ্বালা করে উঠলো। ছোটকালে বাবা মারা গেছে, মুখটা ঠিকমত মনেও পড়ে না। সেটুকু সামলে নিয়ে বার বার ঢোক গিলতে থাকা আসিফ বেগের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, তোমার গলা দিয়ে তো আওয়াজই বের হচ্ছে না, এ গরমে খাবার খেলে না, রোযা আছো, কাল আবার ঠিকমত অফিসে আসতে পারবে তো? আসিফ বেগ কোন কথা না বলে চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইলো।

তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কর্নেল রিড আবার বলে উঠলেন; খাবার না খাও, বার বার হাত মুখ ধুচ্ছিলে, সামান্য একটু পানি মুখে দিলে কি হতো? গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলেই তো পারতে। স্যার, আমি রোজাটা ভাংতে চাচ্ছি না। এক ফোটা পানি হয়তো কুলি করার ছলে গিলে নিতে পারতাম, কিন্তু আল্লাহর কাছে তো লুকাতে পারতাম না, তিনি তো সবই দেখছেন! কর্নেলের মুখে কোন কথা নেই। হাতের ইশারায় আসিফ বেগকে যেতে বললেন। আসিফ বেগ একটা স্যালুট ঠুকে হাঁটা দিল। গেল ক’দিন কর্নেল রিডের মন ভালো নেই কেন যেন।

চুপ চাপ সময় কাটাচ্ছেন তিনি। অফিসার্স ক্লাবেও যাচ্ছেন না। অফিসে আসেন, কাজ সেরে নীরবে বের হয়ে যান। তাকে সবাই রাশভারী বলেই জানে। কিন্তু তাই বলে তিনি এতটা অসামাজিক কখনই ছিলেন না যে, বিকেলে অফিসার্স ক্লাবের আসরটাও মিস করবেন। কি যে হয়েছে, রিডের, সেটা তার কাছের মানুষগুলোও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শুক্রবারের দুপুর, ক্যন্টমেন্টের মধ্যে টিনের ছাউনীওয়ালা অস্থায়ী মসজিদটায় জুমার নামাজের জন্য এক এক করে মুসল্লিরা এসে হাজির হচ্ছে। এখনও খুতবা শুরু হয়নি। ঠিক এমন সময়ে একটা সাদা পাঞ্জাবী, মাথায় একটা জিন্নাহ ক্যাপ পরে লাল গাত্রবর্ণের একজন লম্বা ইংরেজ এসে ঢুকলেন। মুসল্লীদের চোখ সেদিকে পড়তেই তারা বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লো। এ যে কর্নেল রিড! কর্নেল রিড কে দেখে ইমাম সাহেব এগিয়ে এলেন, তার হাত ধরে নিয়ে সামনে বসালেন, কারো বুঝতে বাঁকি নেই, রেড কেন এসে মসজিদে এ সময়ে, এ বেশে এসে হাজির। তার পরেও রিড নিজমুখে ইমামকে অনুরোধ করলেন তাকে শাহাদা পড়াতে।

রিড সেদিন সবার সম্মুখে শাহাদা পড়ে মুসলমান হলেন। ছোট্ট মসজিদ ভরা মুসল্লীরা আবেগে হেঁকে উঠলো আল্লাহু আকবর। ইমামের অনুরোধে রিড সেদিন দুটো কথা বলেছিলেন উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে। বলেছিলেন যে দর্শন আর শিক্ষা গোপনে, নিভৃতে, সবার অলক্ষ্যেও আল্লাহকে ভয় করে তার অবাধ্য হতে বিরত রাখতে পারে, সেই দর্শনের কাছে আত্মসমর্পণ না করাটা নিছক বোকামি!

তিনি এই বোকাদের দলে থাকতে চান নি বলেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। তুরস্কে নিযুক্ত ইংরেজ রাষ্ট্রদূত Sir Thomas Shirley’র কথাই সত্যি, তিনি তার সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, লিখেছিলেন; Islam overcame the English more by its sophistication and power of attraction than by sword. ইসলামের এই sophistication আর attraction বা আকর্ষণ ক্ষমতা আসিফ বেগের মধ্যে ছিল। এই আকর্ষণেই আকৃষ্ঠ হয়েছিলেন কর্নেল রিড। আর এর বিপরিতে এই ‘আধুনিক’, ‘আলোকিত’ আমরা আজ এমন এক ইসলাম ধরে বসেছি যে, আমাদের মধ্যে না আছে ইসলামের সেই sophistication আর না আছে সেই attraction; আকর্ষণ। আমরা নিজেরই আজ বিজাতীয়, বিধর্মী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ঠ এক পরগাছা ইসলামের ঘাড়ের উপরে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত