গুপি ভাল করে পথ বাত্লে দেয়নি। বেলা দশটায় পানু যখন ছোট্ট স্টেশনটাতে নামল, কোন দিকে দিয়ে যাবে ভেবে পেল না। বড় একটা শিমুল গাছতলায় পুরনো এক গাছের গুঁড়িতে বসে দু’-জন লোক চা খাচ্ছিল। পানু তাদের গুপির দাদুর নাম বলতেই বুড়ো লোকটাস্টেশন মাস্টার হয়তো–দু’হাতে গরম চায়ের ভাঁড় ধরে, চোখের তারা ঘুরিয়ে ডান দিক দেখিয়ে বলল, “ওর সঙ্গে যাও। ও ঐদিকেই যাবে।”
সেদিকে তাকিয়ে পানুর চক্ষুস্থির। এই বড় একটা সবুজ রঙের ড্র্যাগন-ফ্লাই, দু’-জোড়া পাতলা ডানা মেলে, মাটি থেকে দেড় মানুষ উঁচুতে একেবারে স্থির হয়ে আছে। তা হলে এর-ই সঙ্গে যেতে হবে। এ তো এদিকে নড়ে চড়ে না। আজ পানু প্রথম লক্ষ্য করল ড্র্যাগন-ফ্লাইটার কাচের মতো পাতলা ডানায় মিহি জালি কাটা রয়েছে। সকালের রোদে মাটির ওপরে ড্র্যাগন-ফ্লাইয়ের ছায়া পড়েছে, তাতে অবধি জালি দেখা যাচ্ছে। ওর গায়ে রোদ পড়ে সবুজ রঙের ছটা বেরুচ্ছে।
এর-ই সঙ্গে যেতে হবে তাহলে। কখন যাবে কে জানে। হঠাত্ ড্র্যাগন-ফ্লাই এক ঝলক আলোর মতো সেখান থেকে কুড়ি হাত দূরে সরে, আবার শূন্যে স্থির হয়ে ভেসে রইল। পানুও সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে পৌঁছল। মনে হল, ড্র্যাগন-ফ্লাই কিছু চিবুচ্ছে। আশ্চর্যের কথা যে, এতদূর সরে এল অথচ এতটুকু ডানা নাড়া দেখা গেল না।
চিপ্-চিপ্ শব্দ করতে করতে একটা বুলবুলি পাখি কোথা থেকে ছোঁ মারল। ধরতে পারলেই হয়েছিল আর কি! পথ-প্রদর্শকের দফাগয়া হলেই তো পানুরও হয়ে গেছিল! কিন্তু পারেনি ধরতে। ড্র্যাগন-ফ্লাই শূন্যে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। অদৃশ্য হবে আবার কি! এ কি পরী নাকি? ভাল করে চেয়ে দেখে পানু বুনো রঙ্গন গাছের পাতা থেকে এক আঙুল ওপরে রয়েছে ড্র্যাগন-ফ্লাই আর দু’ হাতে এক বেচারা পাচ-কামড়াকে ধরে, তাকে বিস্কুটের মতো কামড়ে খাচ্ছে। নাকি এর সঙ্গেই যেতে হবে। এর তো যাবার বিশেষ তাড়া দেখা যাচ্ছে না।
চোখ দু’টো বেজায় বড়। মনে হল দু’টো চোখ নয়, মাছির মতো দু’ গোছা চোখ। রোদ লেগে সমুদ্রের মতো নীল দেখাচ্ছিল। কি সরু কোমরটা, ছিঁড়েটিঁড়ে যাবে না তো? লম্বা সবুজ গাটাতে মিহি দাগ কাটা। পানুর মনে হল পরী না হলেও পরীর চেয়ে কিছু কম যায় না।
এক ঝলক বিদ্যুতের মতো বনের মধ্যে ঢুকে ড্র্যাগন-ফ্লাই। কাঁটার খোঁচা লেগে ডানাতে ছ্যাঁদা হয়ে গেলেই তো হয়ে গেলেই তো হয়ে গেল পানুর আজ গুপির দাদুর বাড়িতে যাওয়া। ভালো পথ-প্রদর্শক দিয়েছে ঐ লোকটি। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠল পানুর।
সামনে প্রকাণ্ড মাকড়সার জাল! তাতে একটা বেশ বড় হলদে প্রজাপতিও ঝুলছে। হয়তো এখনো মরেনি, একটু একটু নড়ছে মনে হল। জালের পাশে গাছের ডালের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে একটা সুপুরির মতো মাকড়সা প্রজাপতির দিকে চেয়ে আছে। তার চোখ জুলজুল করছে। ভাগ্যিস ড্র্যাগন-ফ্লাইটাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু ড্র্যাগন-ফ্লাই-ও কি ওকে দেখতে পায়নি?
চিড়িক্ করে সরে ড্র্যাগন-ফ্লাই মাকড়সার মাথার ওপর এসে শূন্যে ভাসতে লাগল। পানুর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে ড্র্যাগন-ফ্লাই প্রায় মাকড়সার পিঠে নামল। তারপর কুট কুট করে দেখতে দেখতে মাকড়সার আটটা ঠ্যাং একে একে কেটে ফেলে দিয়ে ঢোলের মতো শরীরটাকে মুখে নিয়ে শোঁ করে বনের আরো অনেক ভিতরে ঢুকে পড়ল। আগত্যা পানুও বনের মধ্যে ঢুকল।
অমনি সূর্যের আলোর রঙ বদলে সবুজ হয়ে গেল। রোদেতে ছায়াতে সোনালীতে সবুজে মিলে ড্র্যাগন-ফ্লাই প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল। বনের মধ্যে থেকে কত রকম শব্দ উঠতে লাগল। কটর-কটর! গুপি বলে ওটা ব্যাঙের ডাক। বাস্তবিকই তাই। সামনে একটা টলটলে জলে ভরা পুকুর। তাতে গাছের ছায়া পড়েছে। সেই জলের ওপর নিশ্চল হয়ে ভেসে আছে ড্র্যাগন-ফ্লাই। মাকড়সা খাওয়া সারা হয়ে গেছে মনে হল। জলের ধারে তেঁতুল গাছের গোড়ায় একটা ব্যাঙ সতৃষ্ণ নয়নে ড্র্যাগন-ফ্লাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। ভালো করে চেয়ে দেখল পানু, একেবারে নিশ্চল হয়ে নেই ড্র্যাগন-ফ্লাই, জলের ওপর ছোট্ট ছোট্ট মশার মতো যে-সব পোকা উড়ছিল, কাচের মতো পাতলা ডানা আর পান্নার মতো সুন্দর সবুজ গা রোদে মেলে দিয়ে, খুদে খুদে পোকাগুলোকে ধরে মশলার মতো চিবিয়ে খাচ্ছে!
তাই দেখে ধপ্ করে বসে পড়ল পানু। শুকনো পাতার মতো দেখতে একটা লোক ঐ পুকুরে মাছ ধরছিল, পানু এতক্ষণ দেখতে পায়নি। সে মুচকি হেসে বলল, “শুধু তাই নয়। শূন্যে বাস করে, ডাঙ্গার জিনিস ধরে খায়, জলের গাছে ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চারা জলের মধ্যিকার সব পোকা মাকড়, কুচো চিংড়ির ছানা, মায় আমার ছিপে বাঁধা টোপটা সুদ্ধু খাবার তালে থাকে। ঐ বুঝি তোমাকে নিতে এসেছে। শুনে আঁত্কে উঠেছিল পানু। ফিরে দেখে ড্র্যাগন-ফ্লাই নয়, গুপিদের চাকর গুটে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।
ড্র্যাগন-ফ্লাইটা বোধ হয় জলের বড় বেশি কাছে নেমে এসেছিল। সড়াত্ করে ব্যাঙের জিব বেরিয়ে এল, তারপরেই হতভম্ব পানু দেখল ড্র্যাগন-ফ্লাইয়ের মাথাটা ব্যাঙের মুখের এক পাশ দিয়ে বেরিয়ে আছে, সবুজ রঙের ল্যাজের ডগাটা অন্য পাশ দিয়ে ঝুলছে। তারপর তাও দেখা গেল না। পানু বলল, “স্টেশন-মাস্টার তো আচ্ছা লোকের সঙ্গে যেতে বলছে আমাকে!”
গুটে বলল, “তা বললে হবে কেন? তেনা বলেছিল আমার সঙ্গে যেতে, তা তুমি তো বোঁ করে কোথায় পেলিয়ে গেলে! সেই ইস্তক খুঁজে বেড়াচ্ছি।”