রাস্তার পাশে একটা বাড়ি, বাড়িটির একতলায় জানলার ধারে বসে ডোডোবাবু ভূগোল পড়ছেন। জানলার ওপারে রাস্তায় ফুটপাথের উপরে একটি সাদা কুকুর থুতনি রেখে অনিমেষ নয়নে ডোডোবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ডোডোবাবু পড়তে পড়তে যদি কখনো চোখ তুলে কুকুরটির দিকে তাকাচ্ছেন, কুকুরটি সঙ্গে সঙ্গে মৃদু লেজ নাড়াচ্ছে। কুকুরটির নাম তুষারকণা, তার রঙ সম্পূর্ণ সাদা বলে এই নাম দেওয়া হয়েছে। তুষারকণা সম্ভবত লোভী, ডোডোবাবুর হাতে দু’টো বিস্কুট রয়েছে, ভূগোল পড়তে পড়তে বিস্কুট খাচ্ছেন, দুই-এক খণ্ড যদি খেতে খেতে ছুঁড়ে দেন এই আশায় তুষারকণা বসে রয়েছে।
এই সময় বাড়ির ভিতর থেকে ‘ডোডো ডোডো’ ডাক শোনা গেলো। ডোডোবাবুর মা ডোডোবাবুকে ডাকলেন। ভূগোলের বইয়ের উপর অবশিষ্ট বিস্কুটটুকু রেখে ডোডোবাবু জানলার উপরে বইটি ফেলে বাড়ির ভিতরে গেলেন। লোভী তুষারকণা একটু ইতস্তত করে তারপর বঠাত্ সামনের পা দু’টো জানালার দিকে বাড়িয়ে বিস্কুটশুদ্ধ ভূগোল বইটা মুখে তুলে নিলো।
ফুটপাথ দিয়ে তাতাইবাবু যাচ্ছিলেন, তিনি এই দৃশ্য দোখে চীত্কার করে উঠলেন, ডোডোবাবুও বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এলেন। বেগতিক দেখে তুষারকণা ভূগোল বইটা মুখ থেকে ফেলে বিস্কুটটুকু নিয়ে ছুট দিলো, দুঃখের বিষয় বিস্কুটের সঙ্গে ভূগোলের দু’টো পাতাও তুষারকণার সঙ্গে চলে গেলো।
ডোডোবাবু-তাতাইবাবু দু’জনেই পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানেন তুষারকণার সঙ্গে এখন ছুটে লাভ নেই। দু’জনেই পলায়মান তুষারকণার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে জানালার তাকে বসে পাশাপাশি বসলেন।
ডোডোবাবু (বিমর্ষ স্বরে): সর্বনাশ হয়ে গেল।
তাতাইবাবু: এতো সামান্য। এতে হতাশ হচ্ছেন কেন? জানেন বিড়ালে আমার পুরো অঙ্ক খাতাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।
ডোডোবাবু: সেতো আপনি ইচ্ছে করে বিড়াল দিয়ে ছিঁড়িয়েছেন, সে আমি সব জানি। কিন্তু আমি কি করি এখন?
তাতাইবাবু (রেগে গিয়ে): আমি ইচ্ছে করে বিড়াল দিয়ে অঙ্ক খাতা ছিঁড়িয়েছি? কি বলছেন আপনি?
ডোডোবাবু: ঠিকই বলেছি, আমি সব দেখেছি, সেদিন সন্ধ্যাবেলা অঙ্ক কষতে কষতে আপনি যতবার অঙ্ক মিলছে না বারবার বিড়ালটার দিকে খাতা ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন আর সে খেলা ভেবে আঁচড়াচ্ছিলো, আমি সব দেখেছি। আপনি মাকে তারপর বললেন, বিড়ালে খাতা ছিঁড়ে দিয়েছে। আর আপনার জন্যে নির্দোষ বিড়ালটা মার খেলো। আপনি ভাবছেন, আমি কিছু জানি না। এরদিন দেবো আপনার মাকে সব বলে।
তাতাইবাবু (ভয় পেয়ে): আরে আপনার কাছে আমার কি কিছু গোপন আছে? সে যা হোক, আপনার ভূগোলের কি করা যায় বলুন তো?
ডোডোবাবু: কি আর করা যাবে? দু’টো পাতার উপর দিয়ে গিয়েছে এই যথেষ্ট।
তাতাইবাবু (একটু ভেবে): দু’টো পাতা মানে চারটে পৃষ্ঠাতো মাত্র।
ডোডোবাবু: মাত্র চারটে পৃষ্ঠা ঠিকই, কিন্তু সেই চার পৃষ্ঠা এখন কোথায় পাই?
তাতাইবাবু: কোন চার পৃষ্ঠা? খুলুন না ভূগোল বইটা, কোথায় পাতা খোয়া গেছে একটু দেখাই যাক না।
ডোডোবাবু (ভূগোল বইটা খুলে একটু দেখে নিয়ে): এশিয়ার শেষ আর আফ্রিকার শুরু। চীন, জাপান, ব্রহ্মদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এর পরে এখানে কি একটা দেশ ছিলো।
তাতাইবাবু: ঠিক আছে।
ডোডোবাবু: কি ঠিক আছে?
তাতাইবাবু: এত দেশের বিবরণ এতকাল পড়ছি, আরেকটা দেশের বিবরণ নিজেরা তৈরী করতে পারবো না।
ডোডোবাবু: করুন দেখি।
তাতাইবাবু: দেশটার খুব সুন্দর নাম দিতে হবে। বর্ণনাও সুন্দর করতে হবে।
ডোডোবাবু: কি নাম দেবেন?
তাতাইবাবু: তাই ভাবছি।
ডোডোবাবু: তাই ভাবুন।
তাতাইবাবু (একটু থেমে উত্তেজিত কণ্ঠে পাঠ্যপুস্তকের ভাষায়): যেখানে এশিয়া মহাদেশ শেষ হইয়াছে আফ্রিকার শুরু হইয়াছে সেইখানে মরুভূমির প্রান্তে একটি ছোট সুন্দর দেশ আছে, স্থানীয় অধিবাসীরা দেশটির নাম বলে মানুমানু।
ডোডোবাবু: আপনার বিড়াল ছানাটার নাম না মানু-মানু?
তাতাইবাবু: তাতে কি হয়েছে? জানেন ভারত সরকার নামে কত লোক আছে।
ডোডোবাবু: জানি। কিন্তু তারপর।
তাতাইবাবু: তারপর। (একটু থেমে।) মানু-মানু রাজ্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতীব মনোরম। ইহার একদিকে বিশাল পর্বত অপরদিকে গভীর সমুদ্র আর দুই দিকে ধূ ধূ মরুভূমি এবং গহন জঙ্গল। এখানে কয়েকটি সুন্দর নদী আছে, তাহার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর নদীটির নাম রিয়ামিয়া।
ডোডোবাবু: এবার আমি বলি। রিয়ামিয়া নদীর তীরে একটি শহর আছে তাহার নাম থরহরি। এই শহরটির এইরূপ নামকরণের কারণ মাঝে-মধ্যে এখানে ভূ-কম্পন অনুভূত হয়।
তাতাইবাবু: অবশ্য এই ভূ-কম্পনে কোনোদিন কোনোরূপ ক্ষতি হয় না, শুধু শিশুদের দোলনাগুলি একটু বেশি পরিমাণে দোলে।
ডোডোবাবু: রিয়ামিয়া নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে প্রচুর কুল, জলপাই এবং চিনাবাদাম উত্পন্ন হয়। মানু-মানু দেশ রবারের জন্য বিখ্যাত। এখানে বালকদের খেলিবার রবারের বল প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
তাতাইবাবু (একটু বিরক্ত হয়ে): আপনি খালি একা-একা বলে যাচ্ছেন।
ডোডোবাবু: ঠিক আছে এবার আপনি বলুন।
তাতাইবাবু: মানু-মানু দেশের জীবজন্তুর মধ্যে হলুদ শৃগাল এবং ট্যাঁচু পাখি অতি প্রসিদ্ধ।
ডোডোবাবু: হলুদ শৃগাল, ট্যাঁচু পাখি এসব আবার কি বলছেন।
তাতাইবাবু: আরে মশায় যা বলছি শুনুন আগে, এ দু’টো এই মাত্র বানালাম।
মানু-মানুর হলুদ শৃগালের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের শৃগালের প্রধান তফাত্ এই যে অন্ধকার হইলে এই জাতীয় শৃগালগুলি ডাকে না। ফলে গ্রামাঞ্চলে শিশুরা রাত্রিতে শৃগালের ডাক শুনিয়া ভয় পায় না।
ট্যাঁচু এক ধরণের ঘন কালো রঙের চড়ুই-এর আকারের পাখি, ইহারা মশা খাইয়া জীবনধারণ করে, রাত্রিবেলা ইহাদের কালো রঙ অন্ধকারে সম্পূর্ণ মিশিয়া যায়, ফলে মশারা ইহাদের দেখিতে পায় না। মানু-মানু দেশে কোনো মশার উত্পাত নাই।
ডোডোবাবু: এবার আমাকে বলতে দিন, মানু-মানুর আবহাওয়া চমত্কার, সত্যিকারের নাতিশীতোষ্ণ, সমস্ত বত্সর ধরিয়া প্রতিদিনই যাহাকে বলে শীত ও গ্রীষ্ম সমান-সমান।
এখানে বৃষ্টিপাত সাধারণ, কিন্তু সরস্বতীপূজা, দুর্গাপূজা, ফুটবল খেলার দিন কখনো একটু বৃষ্টি হয় না।
তাতাইবাবু: আবহাওয়ার কথা যখন বললেন, এবার তাহলে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলুন।
ডোডোবাবু: (যেন মুখস্থ বলছেন ক্লাশের পড়া বলার মত গড়গড় করে): এখানকার অধিবাসীরা অতি শান্ত স্বভাবের, তাহারা শিশু বা বালকদের কখনো মারধোর করে না। কিন্তু তাহারা স্বাধীনচেতাও বটে, শিশু বা বালকদের কার্যকলাপে কখনো হস্তক্ষেপ করে না।
তাতাইবাবু (হাততালি দিয়ে): চমত্কার। আপনার দেখি মাথা খুলে গেছে। এবার আমার কাছে শুনুন।
এখানকার শহরগুলি চমত্কার কখনো আলো নেভে না। শহরের সর্বত্র ছেলেমেয়েদের খেলিবার জন্য যথেষ্ট বন্দোবস্ত আছে।
ইহা ছাড়া ছেলেমেয়েরা যে সকল পথে খেলাধূলা করে, সেখানে কোনো গাড়িঘোড়া যাতায়াত করে না।
ডোডোবাবু: আইসক্রিমের গাড়ি-ও না?
তাতাইবাবু: ভূগোল বইয়ে আবার আইসক্রিমের গাড়ি কি মশায়?
ডোডোবাবু: ট্যাঁচু পাখি, হলুদ শৃগাল, থরহরি শহর থাকতে পারে আর আইসক্রিমের গাড়ি থাকতে পারে না?
তাতাইবাবু: পারে, কিন্তু মানু-মানু রাজ্যের আসল কথাটাই এতক্ষণ আপনাকে বলা হয়নি।
ডোডোবাবু: আসল কথা? সেটা কি?
তাতাইবাবু: আসল কথাটা হলো, এই দেশে ভূগোল বইয়ের পৃষ্ঠা হারাইয়া গেলে বা কুকুরে লইয়া গেলে তাহা আবার রাস্তায় কুড়াইয়া ফেরত্ পাওয়া যায়।
ঐ দেখুন (একটু দূরে আঙুল দিয়ে দেখালেন।)
(সত্যিই দেখা গেলো একটু দূরে ফুটপাথের পাশ ঘেঁষে ভূগোলের পাতা দুটি পড়ে রয়েছে, ডোডোবাবু দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিলেন, তারপর হাততালি দিয়ে উঠলেন, তাতাইবাবুও হাততালি দিলেন। হাততালির শব্দ শুনে তুষারকণাও কোথা থেকে ছুটে এসে লেজ নাড়তে লাগলো।)