মা দুর্গা কৈলাসে ভাঁড়ার ঘরের সামনে বসে পান সাজছিলেন। জয়া-বিজয়া কাছে বসে খয়ের সুপুরি কুচিয়ে দিচ্ছিল; তা দিক, পান সাজাটি মা কারো হাতে দিতে রাজী নন, ভোলা মহেশ্বরের জিনিস বলে কথা! কে চূণ বেশী দিয়ে ফেলবে, কে খয়ের বেশী দিয়ে ফেলবে, বেচারী ভোলানাথের গাল পুড়বে, জিভ তিতোবে।
শত কাজের মধ্যে তাই মা দুর্গার নতুন এই এক কাজ বেড়েছে। গত বছর মর্তলোক থেকে এই পানের নেশাটি ধরিয়ে এসেছেন ভোলা মহেশ্বর।
অবিশ্যি চিরটাকালই তো তিনি বছরে বছরে ওই মর্তভূমিতে শ্বশুরবাড়ির দেশে যাচ্ছেন আসছেন। তিনদিন ধরে খানাপিনা, বাজনা বাদ্যি, আলো রোশনাই, আর জগঝম্পয় ঝালাপালা হয়ে, দশমীতে কৈলাসে এসে বাঁচছেন, আর এসে মা দুর্গার কাছে তার বাপের বাড়ির দেশের লোকেদের বাড়াবাড়ির নিন্দে মন্দ করছেন, শিখে টিখে তো কিছু আসছেন না কখনো। হঠাত্ গত বছরেই কি হল?
তাহলে খুলেই বলতে হয় ব্যাপারটা। চিরকালই পুজোয় কাঁচা চালের নৈবিদ্যির চুড়োর ওপর ফাঁকা পানের খিলি বসানো থাকে, পুরুত ঠাকুর তাই ‘নমঃ নমঃ’ করে নিবেদন করে সারেন, কিন্তু গতবারে ‘খেজুর বাগান সাইকেল ক্লাবের সর্বজনীন পুজোয় চোঙাপ্যান্ট আর নামাবলী শার্ট পরা ভক্তরা হঠাত্ এ দৃশ্য দেখে বলে উঠেছিল, ‘এ কী ঠাকুর মশাই, পানের খিলি ফাঁকা কেন? ঠাকুর দেবতার সঙ্গে ফাঁকির কারবার? মশলা কই?’
পুরুত বললেন, ‘পুজো করে চুল পাকালাম বাবা, নৈবিদ্যির পানে তো কখনো মশলা থাকতে দেখিনি, ফাঁকাই থাকে।’
চোঙা প্যান্টরা বলল, ‘না, না, ছি ছি; ওটা ঠিক নয় স্যার, এনে দিচ্ছি মশলা।’
সামনের পানের দোকান থেকে মশলা টশলা তো এনে দিলই, তার সঙ্গে আবার দিলীপের জর্দাও। বেশ তোয়াজি পান হল। কিন্তু মা দুর্গার তো ওসবের অভ্যেস নেই। একটা খেয়েই মাথা বন্বন্। তাড়াতাড়ি বাকি পানগুলো মহাদেবকে দিয়ে বললেন, ‘আপনি খান ঠাকুর, আপনার ভাঙ খাওয়া মাথা, দেখুন যদি না ঘোরে।’
খেলেন ঠাকুর, আর সেই ঘুরলই মাথা।
মানে খেয়ে মাথাটি যাকে বলে একেবারে ‘ঘুরে গেল,’ ভাবলেন, আহা হা, এ কী জিনিস! এমন মধুর জিনিস থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলাম! সিদ্ধি খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। মিঠে পানের সঙ্গে দিলীপের জর্দা! আহা! অতুলনীয়।
চুপি চুপি বললেন, ‘দুর্গা এই পান বানানোর ফরমূলাটা শিখে যেতে পার?’
মা দুর্গা বললেন, ‘ফরমূলা শিখে কী হবে? কৈলাসে পানপাতা পাওয়া যাবে?’
‘পুঁতলে হয়না?’
দুর্গা হাসলেন, ‘এ কী লেবুগাছ, পেয়ারা গাছ যে, পুঁতলেই হল? ওর চাষ আছে, তার নানান ঝঞ্ঝাট আছে, তবে বলেন যদি তো বস্তাকয়েক নিয়ে যেতে পারি নন্দী ভৃঙ্গীর মাথায় চাপিয়ে।’
শিব বললেন, ‘ওরা দু’জনে আর কত পারবে? তোমার জয়া বিজয়াকেও লাগিয়ে দাও।’
দুর্গা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না ওদের হাতে অন্য জিনিস থাকবে। নন্দী ভৃঙ্গী গন্ধমাদন বইতে পারে।’
ব্যাপার এই, মা দুর্গাও বছর দুই হল মর্তলোক থেকে একটি বদভ্যাস করে বসে আছেন, সেটি প্রকাশ করেননি। রান্নাঘরের কোণে বসে সেরে নেন, জয়া বিজয়া পেসাদ পায়।
তা তারও একটা ইতিহাস আছে। বসন্তপুরের বিখ্যাত মুখুয্যে বাড়িতে হচ্ছিল মায়ের পুজো, খুব রমরমা। কিন্তু মুখুয্যে কর্তার সেবছর শরীর খারাপ, ডাক্তার বলেছে ‘উপোস চলবে না, অন্তত একটু চাও খাবেন।’
বরাবর কর্তা মহাষ্টমীতে উপো
স করে আসছেন, এবার খেতে হবে, মন খারাপ। ছেলের বউ একটা বড় পাথরের গেলাসে করে চা দিয়ে গেছে, বিশুদ্ধ চা খেলে যদি উপোসের দোষ কিছুটা কাটে। মুখুয্যে কর্তা সেটি নাড়াচাড়া করছেন, মুখে তুলতে হাত উঠছে না, ছেলে বকাবকি করে গেল, কী বাবা এখনো খাননি?’
মুখুয্যে কর্তা তখন দেবীর সামনে গেলাশটা বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘তবে মা তুই আগে পেসাদ করে দে।’
অগত্যাই মাকে অলক্ষ্যে সেই চায়ে চুমুক দিতে হল, ব্যস তারপরেই অস্থির! ঘোরতর চিন্তা, ‘জয়া, খোঁজ নে এ জিনিস কোথায় পাওয়া যায়, কী করে বানাতে হয়।’
অতঃপর চুপি চুপি মর্ত থেকে টিন কয়েক কৈলাসে নিয়ে এলেন! এবছরেও এনেছেন।
তা’ রেখে রেখে না খেলে, ও আর ক’দিন? নন্দীভৃঙ্গীর চোখে পড়ে গেলে তো মিনিটে মিনিটে উনুনে কেটলী চাপাবে।
এই যে বস্তা বস্তা পান এল, তাও তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তবু তো জয়া হিমালয়ের এক গভীর গহ্বরে, মানে প্রায় ‘ডীপ ফ্রীজে’ তুলে রেখে দিয়েছে পলিথিনের ঠোঙায় মুড়ে, তাই না পচে টচে যায়নি!
কিন্তু আর ক’দিন চলবে?
যতই মা দুর্গা গুনে গুনে খরচ করুন, সামনের পুজো পর্যন্ত কি আর পৌঁছবে? শিবঠাকুরের তাই মন খারাপ। ভাবছেন, বলবেন, ‘দুর্গা, কাল থেকে, দুটোর বেশী পান খাব না’, এমন সময় শিবের আসন টলে উঠল। চমকে বলে উঠলেন, ‘নন্দী, দেখ তো কে কোথায় ডাকছে।’
নন্দী কৈলাসের উঁচু চুড়ো থেকে দেখে বলল, ‘একটা লোক আপনার এক মন্দিরে হত্যে দিচ্ছে।’
‘সেরেছে! আবার কার কী হল রে বাবা! …নন্দী, কোন মন্দিরে?’
নন্দী আরো বুক ঝুঁকিয়ে দেখল।
‘কী চায় লোকটা?’‘আজ্ঞে জৈ গ্রামে জল্পেশ্বরের মন্দিরে।’
‘প্রভু কী আর বলব? মামলায় জিততে চায়।’
শিবঠাকুর নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আচ্ছা নন্দী, এদের নিয়ে কী হবে? মামলা জিততে চায় তাও আমার মন্দিরে হত্যে?’
‘তা, কি আর করবে? আপনি ছাড়া গতি কোথায়? জিততে তো হবে?’
‘বলি লোকটা ভাল না মন্দ?’
নন্দী মাথা চুলকে বলে, ‘প্রভু আপনি তো সর্বজ্ঞ।’
‘হুঁ, তার মানে তুমি একটু এনকোয়ারি করে দেখতেও পারবে না। তা’ করে কি লোকটা তা’ জানো?’
‘জানলাম আজ্ঞে, মানে অবলোকন করে দেখছি, লোকটা পানের কারবারি।’
‘অ্যাঁ!’
মহাদেব চাঙ্গা হয়ে বসলেন, ‘কিসের কারবারি?’
নন্দী উদাস গলায় বলল, ‘আজ্ঞে পানের। পানের ব্যবসা করে, নিজের পানের বরজও আছে’
শিবঠাকুর ভাঙের নেশা ছেড়ে সোজা হয়ে বললেন, ‘বল কী নন্দী? আর এই লোক অসুবিধেয় পড়েছে? হত্যে দিচ্ছে? যাও চটপট চলে যাও, স্বপ্নাদেশ দাও গে ‘ভয় নেই’। আর এই নিয়ে যাও আমার একটু বিভূতি। এর মধ্যেই আমার একটু শক্তি মিশিয়ে দিলাম, দেখবে এই লোক যেন কিছুতেই না হারে। নামটা কী ওর?’
নন্দী আবার পৃথিবীতে উঁকি দিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে নাম বিরিঞ্চি ঘোড়েল।’
‘বেশ, বেশ। মামলাটা কিসের?’
‘ওই যা হয় প্রভু! জমিজায়গা বিষয় সম্পত্তি নিয়ে জ্ঞাতির সঙ্গে।’
‘ঠিক আছে। ওই জ্ঞাতিটাকে গোহারান হারিয়ে দিবি। চটপট চলে যা।’
মর্তে যাবার নামে তো নন্দী এক-পায়ে খাড়া। আহা ওখানে কত মজা, কত আমোদ! পোড়া কৈলাসে সিনেমা আছে? সার্কাস আছে? মেলা আছে? রাতদিন বাজী বাজনা, সভা ফাংশান আছে?…হুঁঃ। তাড়াতাড়ি সেজে গুজে মা দুর্গাকে প্রণাম করতে যাচ্ছে, ভৃঙ্গী ধরল, ‘বেশ মজায় আছিস দাদা! ক’দিন থাকবি?’
‘কি জানি, ক’দিনে কাজ মেটে!’
‘এন্তার সিনেমা দেখবি তো?’
নন্দী একটু হেসে ভৃঙ্গীর পিঠ চাপড়ে বলে যায়, ‘মন খারাপ করিসনা, পরের চান্সে তুই যাস।’
ভৃঙ্গী বেজার গলায় বলে, ‘যাবনা কেন? মর্তে যখন মড়ক মহামারি হয়ে, বাবার আসন টলবে, তখন বাবা আমাকে পাঠাবেন।’
গোঁজ হয়ে বসে থাকে।
নন্দী মা দুর্গার অন্দরের দিকে এগোয়। কিন্তু ওখানেও এক কাণ্ড!
ওখানেও পৃথিবীর এক ভক্ত আকুলি বিকুলি প্রার্থনায় মা দুর্গার আসন টলিয়েছে।
বিজয়া এন্কোয়ারি করে জেনেছে জৈগ্রামের পঞ্চু ঘোড়েল নামের এক লোক মা দশভূজার মন্দিরে মাথা খুঁড়ছে, আর মোটা মোটা মানত করছে মামলা জিতিয়ে দিতে হবে।
মা দুর্গা প্রথমে ভারী রেগে উঠে ছিলেন, ‘উঃ কী জ্বালা! জগতে এত জীব সৃষ্টি করলাম, এই মানুষগুলোর মত এত আবদেরে বায়নাবাজতা আর একটা দেখলাম না। বাঘ সিংহী হাতী উট সাপ ব্যাং মাছ, সবাই তো আমার সন্তান, তারা কে কবে আবদার করছে, ‘মা আমার এই করে দাও, ওই করে দাও, তাই করে দাও!’…আর ওই মানুষ, রাতদিন ডাকাডাকি, আর ‘দাও দাও। মা আমার অসুখ ভাল করে দাও, আমার বাড়ি করে দাও, গাড়ি করে দাও, ছেলেমেয়েকে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দাও, বড় চাকরী করে দাও, ভাল বিয়ে দিয়ে দাও, আমায় মান দাও, যশ দাও রাজা করে দাও, মন্ত্রী করে দাও, লিস্টি ফুরোবে না। আবার মামলা মকদ্দমাতেও জিতিয়ে দাও? উঃ!’
বিজয়া গোমড়া মুখে বলেছে, তা’ যাকে যা শিখিয়েছ মা, সে তাই শিখেছে। অন্য সব জীব জন্তুকে ‘ডাক’ ছাড়া আর কিছুই শেখাওনি, তারা সেই ডাকই ছাড়ে, ঘৌ ঘৌ, মিউ মিউ যিঁহি হিঁহি, হাম্বা হাম্বা! মানুষকে তুমি ডাকতে শিখিয়েছ, সে তাই করছে। রাতদিন ডাকছে। শুধু শুধু কি আর ডাকবে, তাই ‘দাও দাও’ করছে।’
মা দুর্গা রেগে বলেছেন, ‘খুব যে কথা শিখেছিস? বছর বছর পৃথিবীতে গিয়ে এইটি হয়েছে, তা’ যে ডাকছে, সে করে কী?’
বিজয়া খড়ি পেতে বলে, ‘চায়ের ব্যবসা।’
মা দুর্গা চমকে বলেন, ‘অ্যাঁ, বলিস কী?’
‘হ্যাঁ মা, শুধু ব্যবসাই নয়, তিন চারটে চায়ের বাগানও আছে তার।’
মা দুর্গা রেগে বলেন, ‘আর এই লোককে তুই অগ্রাহ্য করছিস? ওকে জিতিয়ে দিতে পারলে জীবনে আর তোকে পৃথিবী থেকে চা বয়ে নিয়ে আসতে হবে না। যাগিয়ে স্বপ্নাদেশ দিবি, ভয় নেই, তোকে জিতিয়ে দেব, তুই শুধু নিয়মিত আমায় চা সাপ্লাই করবি। মানে চায়ের পাতা দিয়ে পূজো দিবি।’
এতক্ষণে বোধহয় বুঝতেই পারছ, মা দুর্গা ওই চায়ের অভ্যাসটিই করে মরেছেন।
বিজয়া যখন মা দুর্গার শক্তি কণিকা নিয়ে মর্তে নামতে যাচ্ছে, নন্দীর সঙ্গে দেখা। এ বলে ‘কী ব্যাপার?… ও বলে কী ব্যাপার?’
তারপর বোঝা গেল ব্যাপার, লড়াইটা শেষ পর্যন্ত শিবের সঙ্গে দুর্গার গিয়েই ঠেকছে!
বিরিঞ্চি ঘোড়েল হয়েছে শিবাশ্রিত, পঞ্চু ঘোড়েল দুর্গাশ্রিত। দুই জ্ঞাতি ভাই। একখানা তালুক নিয়ে লড়ালড়ি। এ বলে, ‘ও তালুক আমার সাত পুরুষের,’ ও বলে, ‘ও তালুক আমার সাত পুরুষের।’… অথচ মিথ্যে কেউই বলেনা,
সাত পুরুষ আগের সেই চন্দ্রবিন্দু হয়ে যাওয়া ভদ্রলোক? যিনি গাঁটের কড়ি খরচা করে কিনেছিলেন ওই জমিটি, সেই ঁরজনী ঘোড়েল? তিনি এই পঞ্চু ঘোড়েলেরও ঠাকুর্দ্দার ঠাকুর্দ্দা, আর বিরিঞ্চি ঘোড়েলেরও ঠাকুর্দ্দার ঠাকুর্দ্দা অতএব এদের দু’জনেরই সমান দাবি।…ঁরজনী ঘোড়েলের দুই ছেলের বংশ দু’ দিকে ছড়িয়ে এখন জ্ঞাতি শত্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইজমিটার অধিকার নিয়ে ঘোর মকদ্দমা।
এ বলে, ‘পানের চাষ আরো বাড়ানো দরকার ওই জমিটায় ভাল হবে।’
ও বলে, ‘শুধু পাহাড়ে দেশেই চা বাগান হয়, বদ্ধর্মান েজলার মাটিতে বাগান হওয়ানো যায় কিনা, তার পরীক্ষা করব। জমি না হলে কোথায় পরীক্ষা? পুকুরের জলে?’ দু’জনেরই যুক্তি আছে।
রাত্তিরে যে যার বাড়িতে ঘুমোচ্ছে হঠাত্ বিরিঞ্চি ঘোড়েলের মাথার কাছে দেববাণী, ‘ওরে, বিরিঞ্চি, নির্ভয়ে থাক, স্বয়ং বাবা ভোলানাথ তোর সহায়। তোর জিত্ মারে কে?’
ওদিকে পঞ্চু ঘোড়েলের মাথার কাছে তেমনি দেববাণী, শুধু হেঁড়ে গলায় নয়, মধুর কণ্ঠে, ‘বাছা পঞ্চু, নির্ভয়ে থাক্, তোর জয় মারে কে? আমি তোর জয়ের জন্যে আমার অনুচরী বিজয়াকে পাঠিয়েছি, আমার শক্তি দিয়ে। শুধু একটি শর্ত।
পঞ্চু ধরফড়িয়ে উঠে বসে দিশেহারা হয়ে বলে, ‘কী শর্ত মা, কী শর্ত?’
‘পরে বলব, আগে জেত্।’
ব্যস! পরের দিন দুই জ্ঞাতি ভাই পুকুর ধারে তড়পাচ্ছে, এ বলে, ‘মা স্বপ্নে আমায় ভরসা দিয়ে গেছেন, আমার জেতা মারে কে?’
ও তড়পাচ্ছে, ‘বাবার ওপর কথা নেই, বাবা মায়ের গুরুজন, বাবা আমায় স্বপ্নে আশ্বাস দিয়ে গেছেন না জিতিয়ে ছাড়বেন না। ও জমি আমার হকের ধন মদন মোহন।’
দুর্গাশ্রিত পঞ্চু বলল, ‘দেখা যাক কার হকের ধন।’
চলছে লড়ালড়ি।
দিনের পর দিন শুনানি চলছে উকিল ব্যারিস্টার হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, জজ মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকছেন। কারুর হারজিত্ নেই, কারুরই কেস দুর্বল নয়, দু’জনেরই সাত পুরুষের জমি।
কোট কাছারি নাস্তানাবুদ।
একদিকে বাবার বিভূতি, অন্যদিকে মায়ের শক্তি। নন্দী আর বিজয়া দুজনেই যে যার মালিককে নিয়মিত ট্রাঙ্ককলে খবর দিচ্ছে, মামলার অবস্থা কি, কিন্তু হেলা দোলা নেই কারুর!
রেগে গিয়ে শিব বলেন, ‘দুর্গা, এটা কী হচ্ছে? তোমার শক্তি সংবরণ কর। আমার ভক্তকে জিতিয়ে না তুললে নরলোকে আর প্রেস্টিজ থাকবে আমার?’
দুর্গাও জেদ ধরে বলেন, ‘সে আমি জানি? আমারই বুঝি প্রেস্টিজ রাখবার দরকার নেই? চিরটাকাল আমি শরণাগত দীণার্ত, পরিত্রাণ পরায়ণেতা জানো না?’
শিব দুর্গার তর্কাতর্কির রোল কৈলাস থেকে স্বর্গে গিয়ে ওঠে, তেত্রিশ কোটি দেবতা ছুটে এসে হাজির হন। কী হয়েছে?
ওঁরা তো তখন উত্তেজিত, শিবঠাকুর আর মা দুর্গা! জয়া আর ভৃঙ্গী, ঘটনার আদ্যন্ত রিপোর্ট দেয়, এবং নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ব্যাপার মিটবে কী করে? মা বাবা দুজনেই সমান, কেউ তো কম যান না? আজ যদি এ জিতবো জিতবো করে, কাল ও তেড়ে ওঠে। রোজ নতুন নতুন উকিল আনছে।’
‘এত সব টাকা কড়ি পাচ্ছে কোথায়?’
‘ওরাই জানে!’
তাইতো!
তেত্রিশ কোটির এক আলোচনা সভা বসে, কী করে ‘মা বাবা’ দু’জনেরই মান বজায় থাকে। কারণ মা দুর্গা বলেছেন, ‘আমার ভক্ত হারলে আমরণ অনশন করব।’ আর শিব ঠাকুর বলেছেন, ‘আমার ভক্ত না জিতলে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড লণ্ডভণ্ড করে ছাড়ব।’
দুটোই সমান ভয়ের।
তেত্রিশ কোটি ভেবে হিমসিম, এমন সময় যমরাজের প্রবেশ। ডিউটিতে ছিলেন, আসতে দেরী হয়ে গেছে। বিবরণ শুনে স্রেফ্ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই কথা? সব সমস্যার সমাধান আমার হাতে। মা বাবা দুজনেরই মান বজায় থাকবে। কালই আমার মোষটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি’
‘কোথায়? কোথায়?’
‘কেন পৃথিবীতে, আদালতের সামনের রাস্তায়!’
দেবতাদের কথা অমোঘ, পরদিনই হয়ে গেল সমস্যার সমাধান। বিরিঞ্চি আর পঞ্চু দু’জনে একই সঙ্গে আদালত থেকে বেরিয়ে দু’জনে দুজনকে কলা দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে, হঠাত্ চোখে অন্ধকার, কোথা থেকে যেন কালো মেঘের চাঁইয়ের মত বিশাল এক মোষ ছুটে এসে দু’জনের ওপর দিয়েই ‘পাস’ করে চলে গেল। দুজনেই স্রেফ্ কাদা!
রাস্তার লোকে তুলে হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বুঝে পায়না কোনটা কার হাত পা।
গভীর অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে যখন আলোয় চোখ মেলল বিরিঞ্চি পঞ্চু, কিছুই চিনতে পারেনা।…কী এ? আদালত? বাড়ি? হাসপাতাল? উঠে বসতে যেতে দেখল পঞ্চুর মাথার কাছে মা দশভুজা, বিরিঞ্চির মাথায় কাছে জল্পেশ্বর শিব।
শিব বললেন, ‘বাবা বিরিঞ্চি, কোনো কষ্ট হচ্ছে?’
‘বুঝতে পারছিনা প্রভু।’
‘তুমি কে মনে আছে?’
‘কী আশ্চর্য মনে থাকবেনা? আমি বিরিঞ্চি ঘোড়েল, পানের কারবারি, দেশে বরজ লাগাব বলে জমি নিয়ে’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সামান্য নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়ায় কাজ কি? এই দ্যাখো, অগাধ অফুরন্ত জমি পড়ে আছে, সব তোমার। শত শত পানের বরজ লাগাও।’
বিরিঞ্চি রেগে বলে, ‘বললে তো ঠাকুর, এত জমির খাজনা দেব কোথা থেকে?’
‘আহা খাজনা টাজনা তোমায় দিতে হবেনা, তুমি শুধু প্রতিদিন আমার ওখানে কিছু করে পান পাঠিয়ে দেবে’
বিরিঞ্চি উপুড় হয়ে পড়ে বলে, ‘সে আর বলতে, সে আর বলতে!…কিন্তু প্রভু এই জায়গাটা কী?’
‘কী আশ্চর্য! বুঝতে পারছনা, কৈলাস।’
‘বুঝবো আর কী করে? কৈলাসে তো হরঘড়ি আসা যাওয়া নেই। তা’ হঠাত্ এখানে এসে পড়লাম কী করে?’
বাবা মৃদু হেসে বলেন, ‘সে কথা জিগ্যেস কোরোনা বত্স! তবে তোমার কারবারের বাড়বাড়ন্ত করতে একটি বুদ্ধি দিইতোমার ওই পান থেকে একদিন ছত্রিশ কোটি খিলি পান ভাল করে সাজিয়ে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে দুটো দুটো করে খাইয়ে দিও। তারপর দেখো।’
ওদিকে পঞ্চু ঘোড়েলের সঙ্গেও মা দুর্গার কথাবার্তা চলছে। মা দুর্গাও বলেছেন, ‘ওই কৈলাস শিখরে অফুরন্ত জায়গা পড়ে আছে, যত পারিস চা বাগান কর বত্স, শুধু একটি শর্তআমায় নিয়মিত চা সাপ্লাই করবি। রান্নাঘরের কোণে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে আর ইচ্ছে নেই। ভাল চায়ের জোগান দিবি, মাঝে মাঝে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে ডেকে টী পার্টি দেবো। বুঝুন ওঁরা আমার বাপের বাড়ির দেশের খাওয়া দাওয়াটি কেমন।’
পঞ্চু মহোত্সাহে বলে, ‘ভাল চা যদি বলেন মা, এক্ষুণি টী পার্টি লাগিয়ে দিতে পারেন। শুধু যদি একটা ইয়া লম্বা আঁকশি পাই।’
‘আঁকশি!’
মা দুর্গা আকাশ থেকে পড়েন, ‘আঁকশি কী হবে।’
পঞ্চু ঘোড়েল একটু ঘোড়েল হাসি হেসে বলে, ‘উ-ই নীচুতে দার্জিলিঙেআমার দু’ দুখানা চা বাগান পড়ে রয়েছে, ও দুটোকে টেনে তুলে আনবো। বিস্তর দেনাপত্তর করে এসেছি, শেষে আবার পাওনাদারেরা বেচে নিয়ে নেবে। তার আগেই রাতারাতি’
মা দুর্গা অবাক হয়ে বলেন, ‘আঁকশি দিয়ে গোটা দুটো বাগান তুলে আনতে পারবি?’
পঞ্চু গলবস্ত্রে বলে, ‘তোমার দয়া আর আমার আঁকশি, এ পেলে গোটা পৃথিবীখানাই তুলে আনতে পারি মা, তা তুচ্ছ দু’খানা বাগান?…নাও বারকর আঁকশি, আজই লাগিয়ে দাও টী পার্টি।’
যে কথা সেই কাজ, লম্বা এক আঁকশি লাগিয়ে চা বাগান দুখানা তুলে আনল পঞ্চু। একেবারে কুলি কামিন, মায় তাদের ঝুড়ি চুবড়ি সমেত।… নিজের বাগান নিজের লোকজন, চিনতে ভুল হয়না। তাছাড়া কৈলাসের একেবারে সরাসরি নীচেই তো দার্জিলিং, অসুবিধে হল না টেনে তুলতে।
টী পার্টি দিলেন মা দুর্গা, খেয়ে তেত্রিশকোটি দেবতা একেবারে বিভোর। ঝপাঝপ টন টন চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেললেন পঞ্চুকে।
ওদিকে বাবা ভোলানাথও বসে নেই, তিনি বিরিঞ্চিকে তাতাচ্ছেন, ‘বিরিঞ্চি, আবারও যে সেই হারা জেতা!…পঞ্চু জিতে যাচ্ছে’
বিরিঞ্চি মুচকি হেসে বলে, ক্ষ্যাপা ঠাকুর, ক্ষেপেছেন? পঞ্চার চাল আমি টের পাইনি? আগেই নন্দী ভৃঙ্গী দুই দাদাকে পিঠিয়ে আমার বারুইপুরের তিনখানা বরজই উপড়িয়ে অনিনি?…ছত্রিশ কেন একেবারে বাহাত্তর কোটি খিলি পান মজুত রেখেছি, টী পার্টির শেষে মুখশুদ্ধির জন্যে। দেবতা পিছু এক গণ্ডা করে পান ধরে দেব।’
যে কথা সেই কাজ!
পানও ফেলনা হলনা। সে নিয়েও দেবদেবী মহলে কাড়াকাড়ি, আর অর্ডার দেওয়া দিইর হুড়োহুড়ি।
তদবধি কৈলাসে চা আর পানের চলন। মরে অমর হয়ে যাওয়া পঞ্চু আর বিরিঞ্চি, সমস্ত কৈলাস ক্ষেত্র জুড়ে চায়ের বাগান, আর পানের বরজ করে ফেলে অবিরত তাদের তদ্বির করে চলেছে, আর যাঁরা খাবার, তাঁরা খেয়ে চলেছেন।