ঝুনুমাসী একদম বিড়াল পছন্দ করতেন না। বিড়ালরা নাকি বড্ড নোংরা হয়। তারা যখন-তখন ছাদে যায়, ছাইগাদার ওপর ঘোরে, আবার সুযোগ পেলেই টুক করে বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে। বিড়ালরা এমনই আদুরে যে, বিছানায় না শুলে তাদের ঘুমই আসে না। একদিন তো ঝুনুমাসী তাঁর বিছানার ওপর কোথাকার একটা উটকো বিড়ালকে দেখে একেবারে কেঁদেই ফেলেছিলেন।
সেই বিড়ালই একদিন ঝুনুমাসীকে জব্দ করে দিল। বাড়ির কাজের লোকদের ঝুনুমাসী হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন বিড়াল না আসে। বিড়াল দেখলেই তাড়াতে হবে। একটা গোঁফওয়ালা হাঁড়িমুখো বিড়াল প্রায়ই জানলা দিয়ে উঁকি মারে, আমরা হৈ-হৈ করে সেটাকে তাড়া করে যাই!
এত পাহারা-টাহারা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু করা গেল না। এর মধ্যেই একদিন সকল বেলা কী করে যেন একটা বাচ্চা-বিড়াল ঢুকে গেল। ফুটফুটে সাদা রং, টুলটুলে দুটি চোখ, ছোট্ট সেই বিড়ালটা প্রায় একটা উলের বলের মতন ঝুনুমাসীরই খাটের কাছে লাফালাফি করছে।
ঝুনুমাসী একেবারে আঁতকে উঠলেন। চঁ্যাচামেচি করে ডাকলেন সবাইকে। বললেন, “এক্ষুনি তাড়াও, এক্ষুনি বিদেয় করো হতভাগাকে!”
আমরা হ্যাট হ্যাট, হুশ হুশ করলাম। বিড়ালটা যাবার নামই করে না। আমাকে হাততালি দিতে দেখে সে ভাবলো বুঝি সেটা একটা খেলা। অমনি হাততালির সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি দিতে লাগলো। তাই দেখে ঝুনুমাসীর ছেলে পল্টু হেসে ফেলতেই ঝুনুমাসী তার দিকে কটমট করে তাকালেন। তারপর বললেন, “হাসছিস কী! তোর হাসি দেখলে ও লাই পেয়ে যাবে না? সুখন, বিলু, জটার মা, তোমরা বিড়ালটাকে তাড়াতে পারছো না?”
বিড়ালকে তো ভয় দেখালেই পালায়। কিন্তু এই বিড়ালছানাটা যে একটুও ভয় পাচ্ছে না। আমরা যতই তাড়া করি, ততই সে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা দেখায়। ও বোধহয় এখনো ভয় পেতেই শেখেনি। সুখনের হাতে মস্ত বড় একটা ডান্ডা, কিন্তু ঐটুকু বিড়ালকে তো আর মারা যায় না। সুখন লাঠিটা নিয়ে ওর পাশে ঠুকতে লাগলো। তাতেও ভয় পায় না। ফুড়ুত ফুড়ুত করে তালে তালে লাফায়।
ছোটমাসী বললেন, “উসকো কান পাকাড়কে বাইরে ফেলে দাও।”
বিড়ালকে হাতে করে তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কে তুলবে। সবাই তাই ভাবছে। এমন সময় বিড়ালটা ধপাস করে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজে একেবারে স্থির হয়ে গেল।
ঝুনুমাসী ভয় পেয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, “ওমা, বিড়ালটা মরে গেল নাকি? বাড়িতে বিড়াল মরলে যে ভীষণ পাপ হয়। এই সুখন, তুই ঐটুকু প্রাণীটাকে লাঠি দিয়ে মারলি?”
সুখন জিভ কেটে বললো, “না মাইজী, মা কালীর দিব্যি, আমি একবারও ওকে মারিনি। শুধু ভয় দেখিয়েছি!”
“তা হলে মরে গেল কী করে? অত বেশি ভয় দেখালি কেন, নিশ্চয়ই হার্ট ফেল করেছে।”
পল্টু বললো, “মরেনি মা, চোখ পিটপিট করছে।”
ঝুনুমাসী ধমক দিয়ে বললেন, “মরেনি, কিন্তু মরতে কতক্ষণ! কী অলুক্ষুনে কাণ্ড! বাড়িতে বিড়াল মরে যাবে? কত পাপ হবে!”
আমি বললাম, “মরবে কেন? এতক্ষণ খেলা করে হাঁপিয়ে গেছে, তাই জিরিয়ে নিচ্ছে।”
ছোটমাসী তক্ষুনি হুকুম দিলেন, “জটার মা, শিগগির এক বাটি দুধ নিয়ে এসো। দুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে নিক, তারপর ওকে ভালোয়-ভালোয় বাড়ির বাইরে রেখে আসবে।”
জটার মা একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা দুধ নিয়ে এলো। ঝুনুমাসী সেটা দেখেই আবার বকুনি দিয়ে উঠলেন, “ঐটুকু দুধে বিড়ালের পেট ভরে? বিড়াল কি তোমার-আমার মতন ভাত খায়? তোমাকে কিপ্টেমি করতে কে বলেছে?”
আবার বাটি ভরে আনা হলো। দুধের গন্ধ পেয়েই বিড়ালছানাটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তারপর দুধ খেতে লাগলো চুকচুক চুকচুক শব্দ করে। আমরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
সবটা দুধ শেষ করে সে খুব আরাম করে জিভ চাটলো কিছুক্ষণ। পল্টু বললো, “মা, এবার আমি ওকে রাস্তায় ফেলে আসবো?”
ঝুনুমাসী বললেন, “রাস্তায় নয়, ফুটপাথে। দেখিস খুব সাবধানে, যেন গাড়ি-টাড়ি চাপা না পড়ে।”
কিন্তু তার আগেই বিড়ালটা এক কাণ্ড করলো। সে এক দৌড়ে গিয়ে ঝুনুমাসীর পায়ে মাথা ঘষতে লাগলো। এবং এই প্রথম সে খুব মিষ্টি করে আস্তে ডাকলো মিউ-উ!
তখনই আমরা বুঝে গেলাম। ওটা মোটেই বিড়ালছানা নয়। ছদ্মবেশী কোনো মহামানব। ও নিশ্চয়ই মানুষের ভাষা জানে। না হলে কী করে বুঝলো যে, ঝুনুমাসীই ওকে তাড়াতে চাইছে!
ততক্ষণে ঝুনুমাসী একেবারে গলে জল হয়ে গেছেন। পা সরিয়েও নিলেন না। নরমভাবে বললেন, “আহা রে, মা ষষ্ঠীর জীব, বড্ড মায়া লাগে। রাস্তা ঘাটে কোথায় গিয়ে মরবে! থাক, এখন থাক।”
সেই থেকে বিড়ালছানাটা থেকেই গেল। ঝুনুমাসীর সব ঘেন্না চলে গেছে। এখন তিনি উল বুনতে বসলেই বিড়ালটা লাফিয়ে এসে তাঁর কোলে বসবে। পল্টুর চেয়েও তার আদর অনেক বেশী।
প্রথম কদিন তার অনেকগুলো নাম রাখা হয়েছিল। মিনি, পুষি, বিধুমুখী, পুঁচকি, গুলগুলি, ভুলভুল, দুষ্টু, মিষ্টি- এইসব। শেষ পর্যন্ত তার নাম হলো ফ্লসি। ইংরিজি নামটা ঝুনুমাসীরই বেশি পছন্দ। লোকে কুকুর পুষলেই ইংরিজি নাম দেয়, বিড়ালেরই বা কেন ইংরিজি নাম হবে না? বিড়াল কি কুকুরের চেয়ে কম?
ফ্লসি সারা বাড়ি তুরতুর করে ঘুরে বেড়ায়। সে খুব শৌখিন, কক্ষনো নোংরা থাকে না। সব সময় সেজে-গুজে ফুটফুটে। ঝুনুমাসী তাকে মাছের কাঁটা খাওয়াবার অভ্যেস করাননি। মাছের কাঁটা ওরা মুখে করে এখানে-সেখানে নিয়ে গিয়ে নোংরা করে। তাই ফ্লসিকে শুধু দুধ খাওয়া অভ্যেস করানো হলো। কখনো-সখনো এক-আধ টুকরো মাছ তাকে দেওয়া হয় বটে, তাও কাঁটা বেছে, যাতে সেটা খাওয়ার টেবিলের নীচেই শেষ করে।
ফ্লসি সত্যিই মানুষের কথা বোঝে। বাড়িতে লোকজন এলে ঝুনুমাসী যেই বলেন, “ফ্লসি, একটু নাচ দেখাও তো!” অমনি সে দু হাত তুলে দাঁড়ায়। তারপর টেবিলের একেবারে পাশে একটা বিস্কুট রেখে দিলে সে লাফিয়ে উঠে সেটাকে মুখে করে নেয়। সকলেই অবাক হয়ে যায়। ঝুনুমাসী গর্বের সঙ্গে বলেন, “এত সুন্দর বিড়াল থাকতে কেন যে লোকে কুকুর পোষে, তাও তো বুঝি না।”
প্রথম-প্রথম সে যেখানে-সেখানে, এমনকী দরজার সামনে হিসি করে দিত। ঝুনুমাসী একদিন তার কান ধরে ছাদে নিয়ে গিয়ে একটা কোণ দেখিয়ে বলেছিলেন, “এইটা তোর বাথরুম, বুঝলি পোড়ারমুখী! ফের যদি অন্য জায়গা নোংরা করবি…”
কী আশ্চর্য, তারপর থেকে ফ্লসি ঠিক ছাদেই বাথরুম করতে যায়।
এক বছরের মধ্যেই ফ্লসি বেশ বড় হয়ে উঠলো। দারুণ সুন্দর হয়েছে চেহারা। রাজকুমারীর মতন সে সগর্বে বারান্দার রেলিংয়ের ফুটোয় মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখে। কক্ষনো সে রাস্তার বাজে বিড়ালদের সঙ্গে মেশে না। সবচেয়ে মজার হচ্ছে তার চোখ দুটো। তার দুটো চোখ দু’রকমএকটা নীল, আর একটা হলদে। তোমরা বিশ্বাস করছো না? সত্যি এরকম হয়। আমার নিজের চোখে দেখা।
সেবার পুজোর ছুটিতে বাইরে বেড়াতে যাবার সময়ও ঝুনুমাসী ফ্লসিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে একা-একা সে কার কাছে থাকবে? ঝি-চাকররা যদি যত্ন না করে? প্রথমে কথা ছিল দার্জিলিং যাবার। কিন্তু বিড়াল কি অত ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে? বেশী শীতে যদি ফ্লসির লোম উঠে যায়? তাই মত বদলে ঝুনুমাসী দার্জিলিং না গিয়ে ঘুরে এলেন পুরী থেকে।
ঝুনুমাসীরও এক মাসী আছেন। তাঁর নাম টুনুমাসী। ইনিও কিন্তু খুব বড় নন। ঝুনুমাসীরই প্রায় সমান বয়েসী। এই টুনুমাসী অনেক দিন ধরে থাকেন দিল্লিতে, কয়েকদিনের জন্য এসেছেন কলকাতায়। একদিন বেড়াতে এলেন ঝুনুমাসীর বাড়িতে। অনেক দিন পরে এসেছেন তো, তাই সকলেরই খুব আনন্দ। কথা বলতে বলতে তিনি বসবার ঘরের সোফার ওপর বসে পড়েই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে বাবারে, একী?”
কেউ লক্ষ্য করেনি, ফ্লসি শুয়ে ছিল সোফার এক কোণে। এ বাড়ির সব জায়গায় তার অবাধ অধিকার। টুনুমাসী না দেখে বসে পড়েছেন ফ্লসির গায়ের ওপর। ফ্লসিও ভয় পেয়ে ডেকে উঠেছে ম্যা-অ্যা-ও!
টুনুমাসী তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “ এ ম্যাগো! একটা বিড়াল এলো কোত্থেকে! অঁ্যা? দেখলেই ঘেন্না লাগে। এই যা, যাঃ!”
ফ্লসি যাবে কেন? তার জ্ঞান হবার পর কেউ তো কখনো তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। সে গঁ্যাট হয়ে বসে রইলো। টুনুমাসী তখন ফ্লসির ঘাড় ধরে তুলে বেশ জোরে ছুঁড়ে দিলেন মাটিতে। বললেন, “যা, বেরোঃ। দূর হ।”
আমরা সবাই আড়ষ্ট হয়ে রইলাম। ফ্লসির এরকম অপমান! কেউ কোনোদিন তাকে ছুঁড়ে ফেলেনি। ঝুনুমাসীর মুখখানা থমথমে।
টুনুমাসী বললেন, “কলকাতাতে বড্ড বেশী বিড়াল। আমাদের দিল্লিতে এ উত্পাত নেই। বিড়াল দেখলেই আমার এমন ঘেন্না করে!”
ঝুনুমাসী বললেন, “তুমি অত জোরে ছুঁড়ে দিলে? যদি পা-টা ভেঙে যায়!”
“ওদের আবার পা ভাঙবে। ছাদ থেকে ফেলে দিলেও মরে না। সারা বাড়ি নোংরা করে, অসুখ-বিসুখ ছড়ায়।”
এক বছর আগে ঝুনুমাসীরও ঠিক এই মতই ছিল। সেটা যে এর মধ্যে বদলে গেছে সেটা আর টুনুমাসী জানবেন কী করে! সুতরাং তিনি আরও কিছুক্ষণ বিড়ালের নিন্দে করে গেলেন। ঝুনুমাসী শুধু একবার বললেন, “সব বিড়াল এক রকম হয় না!”
যাই হোক, একটু বাদেই টুনুমাসী দিল্লির গল্প শুরু করতেই বিড়ালের কথা চাপা পড়ে গেল। আমরা সবাই রাত দশটা পর্যন্ত গল্পে মশগুল হয়ে রইলাম।
সে-রাত্রে আর ফ্লসিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। টুনুমাসী তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর সে দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আর তাকে দেখা যায়নি। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ফ্লসিকে খোঁজাখুঁজি করলাম। ঝুনুমাসী কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।
পরের দিনও ফ্লসি ফিরে এলো না। তার পরের দিনও না। একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
বিড়ালেরও কি অভিমান হয়? আমাদের সকলের সামনে, এমন কী ঝুনুমাসীর সামনেই একজন তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তক্ষুনি তো আমরা কেউ তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করিনি। সেই অভিমানে ফ্লসি চিরদিনের মতন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল?
আমরা পাগলের মতন খোঁজাখুঁজি করলাম কয়েকদিন। ঝুনুমাসী সব সময় কান্নাকাটি করছেন। আমাদের মধ্যে একমাত্র পল্টুই তেমন ভালোবাসতো না ফ্লসিকে। এখন তার মায়ের অবস্থা দেখে সে নিজেও ফ্লসিকে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতেই পাওয়া গেল না।
দিন সাতেক বাদে ঝুনুমাসী আমাদের কারুকে না জানিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন।
ফ্লসি, ফিরে এসো।
তোমায় আর কেউ কোনোদিন মারবে না।
তুমি যা যাও তাই পাবে
তোমার জন্য আমি শয্যাশায়ী।
ইতি তোমার মা
ঝুনু
সেই বিজ্ঞাপন পড়ে সবচেয়ে বেশী হাসলেন ঝুনুমাসীর বর। আমাদের ছোটমেসো। তিনি ঝুনুমাসীকে বললেন, “তুমি তো তোমার বিড়ালকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিলে জানি। তাকে কি খবরের কাগজ পড়তেও শিখিয়েছিলে নাকি? তার চেয়ে বলো, পুলিশের মধ্যে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের খবর দেবো?”
এই সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কি ঝুনুমাসীর একদম ভালো লাগে না। তিনি কান্নায় ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন, “জানি, তুমি তো ফ্লসি মরে গেলেই খুশী হও। সে কি রাস্তায়-ঘাটে হাঁটতে শিখেছে কখনো। না জানি এতদিনে তার কী হয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত ছোটমেসোই লিখে দিলেন খবরের কাগজে আর একটা বিজ্ঞাপন:
হারাইয়াছে! হারাইয়াছে!
একটি ফুটফুটে সাদা রঙের বিড়াল
কপালে শুধু টিপের মতন একটি কালো দাগ
ল্যাজ ঠিক আড়াই ইঞ্চি মোটা
বয়েস এক বছর এক মাস
খুব শান্ত স্বভাব, মাছের কাঁটা খায় না
কেহ সন্ধান দিলে একশো টাকা পুরস্কার!
সেই বিজ্ঞাপন পড়ে দলে দলে লোক আসতে লাগলো। প্রত্যেকেরই কোলে একটি বা দুটি বিড়াল, কেউ কেউ থলেতে ভরে অনেকগুলো বিড়ালছানাও আনে। গেটের কাছে আমি, পল্টু আর সুখন মিলে একটা কমিটী বসালাম। সব বিড়াল পরীক্ষা করে দেখি। ফ্লসির মতন সুন্দর একটাও নয়।
ঝুনুমাসীকে নিয়ে হলো মুশকিল। উনিও আমাদের কমিটীতে থাকতে চান। তার ফল হলো সাঙ্ঘাতিক।
দুপুরের দিকে তিনটে ছেলে এলো, সঙ্গে একটা জাঁদরেল খয়েরী রঙের বিড়াল। মুখখানা দারুণ রাগী রাগী। তাকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে।
একটি ছেলে ঝুনুমাসীকে দেখেই বললো, “মাসীমা, আপনার বিড়াল হারিয়েছে? এই নিন্।”
ঝুনুমাসী তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘এটা তো আমার বিড়াল নয়।”
“তাতে কী হয়েছে! বিড়াল তো সবই এক!”
“না, না, আমি আমার সেই বিড়ালটাই শুধু চাই।”
“নিন না, শস্তা করে দিচ্ছি। আপনি একশো টাকা পুরস্কার দেবেন বলেছিলেন তো? পঞ্চাশ টাকা দিন, তা হলেই এটা ছেড়ে দেবো!”
“না, অন্য বিড়াল আমার চাই না।”
“তা হলে পঁচিশ টাকা দিন। আচ্ছা, দশ টাকা?”
“বলছি তো, অন্য বিড়াল নেবো না আমি।”
ছেলেটি এবার নিরাশ ভাবে বললো, “নেবেন না? ঠিক আছে, তা হলে এটাকে লেকের জলে ডুবিয়ে মারবো।”
ঝুনুমাসী ভয় পেয়ে বললেন, “কী করবে?”
“জলে ডুবিয়ে মারবো।”
“কেন, মেরে ফেলবে কেন?”
“এটা সাঙ্ঘাতিক বদমাস! যেখানেই ছেড়ে দিই, ঠিক বাড়ি ফিরে যাবে! একবার হাওড়ায় ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। একবার ব্যারাকপুরে। তাও রাস্তা চিনে ফিরে এসেছে! উঃ! এ পর্যন্ত সাতাশখানা মাছ ভাজা চুরি করে করেছে। একে মারবো না?”
ঝুনুমাসী ধমক দিয়ে বললেন, “না, মারবে না। ভগবানের জীবকে কেউ কখনো এমনি-এমনি মারে?”
দশ টাকা দিয়ে সেই বিশ্রী বিড়ালটা রাখতে হলো আমাদের।
এর পরে এলো একজন বুড়ো-মতন লোক। সঙ্গে দুটো বিড়াল। তার মধ্যে একটাকে দেখতে প্রায় ফ্লসিরই মতন। আমরা খুব উত্সাহী হয়ে উঠলাম। কপালে সেই কালো রঙের দাগটা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু পল্টু সেই জায়গাটায় আঙুল দিয়ে ঘষতেই দেখা গেল রং উঠে আসছে। ওটা এঁকে আনা হয়েছে। তা ছাড়া ফ্লসি কখনো আমাদের দেখে ফঁ্যাচফ্যাঁচ করে?
ধরা পড়ে যাওয়ায় বুড়ো লোকটি একটু দুঃখিত ভাবে বললেন, “যাঃ, তাও মিললো না! সারা শহর খুঁজে খুঁজে সাদা বিড়াল ধরে আনলাম।”
তারপর তিনি বিড়াল দুটোকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “যাঃ, যা!”
আমরা বললাম, “এ কী! এখানে বিড়াল ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? এখানে ছাড়া চলবে না।”
লোকটি এবার রেগেমেগে বললেন, “তা হলে কি আমি ফেরত নিয়ে যাবো নাকি? বিড়াল কি কেউ কখনো ফেরত নেয়? কোনোদিন শুনেছেন?”
সে বিড়াল দুটোও রয়ে গেল এ বাড়িতে। সন্ধের মধ্যে দশ বারোটি বিড়াল জমে গেল। অনেকেই বিড়াল নিয়ে এসে আর ফেরত নিয়ে যায় না। একশো টাকার পুরস্কারের লোভে রাস্তার ছেলেরা এক-একটা বিড়াল ধরে আনছে রাস্তা থেকে। পুরস্কার না পেয়ে রাগের চোটে সে-বিড়াল ছেড়ে যাচ্ছে এ-বাড়িতেই। দু-একটা অবশ্য এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল। কিন্তু ঝুনুমাসী সব কটার জন্য দুধ বরাদ্দ করে দিলেন। তিনি নিজে থেকে কোনো বিড়ালই তাড়াবেন না!
সন্ধেবেলা দুজন প্যান্টপরা লোক একটা টেমপো ভর্তি করে নিয়ে এলো একশো পঁচিশটা বিড়াল। শাড়ির দোকানে যেমন একটা শাড়ি পছন্দ না হলেই সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা শাড়ি বার করে দেখায়, ওরাও তেমনি এক-একটা বিড়ালের ঘাড় ধরে তুলে জিজ্ঞেস করে, “এটা আপনাদের? এটা নয়? তা হলে এটা?”
এক-এক করে একশো পঁচিশটা বিড়ালই দেখা হলো। কোনোটাই ফ্লসি নয়। লোক দুটো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “তা হলে আর কী হবে! চলো হে গঙ্গাচরণ।”
ঝুনুমাসী জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা এত বিড়াল পেলেন কোথা থেকে? এগুলো নিয়ে কী করবেন?”
একটা লোক বললো, “আমরা লেবরেটরিতে সাপ্লাই দিই!”
“লেবরেটরিতে? সেখানে কী হয়?”
“সেখানে বিড়ালের ওপর নানা রকম ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এদের কেটে কুটে দেখা হয়। আমরা পার পীস তিন টাকা করে বিক্রি করি।”
“পার পীস মানে?”
“এক-একটা তিন টাকা। ভাবলুম, আপনারটা যদি মিলে যায়, তা হলে একশো টাকা পাওয়া যাবে।”
“তার মানে এতগুলো বিড়ালকে আপনারা মারতে পাঠাচ্ছেন? নামান! গাড়ি থেকে নামান সবগুলোকে!”
সে এক প্রায় পাগলের কাণ্ড। সারা বাড়িতে প্রায় দেড়শো বিড়াল। ঝুনুমাসীর ধারণা, তাঁর ফ্লসিকেও নিশ্চয়ই কেউ লেবরেটরিতে চালান করে দিয়েছে। তিনি আমাদের বলতে লাগলেন, “যা, সব লেবরেটরি দেখে আয়। যেখানে যত বিড়াল দেখবি কিনে নিয়ে আয়।”
ছোটমেসো রাত্তিরে বাড়ি ফিরে প্রায় নাচতে লাগলেন। কোথাও পা ফেলার উপায় নেই। সব জায়গায় বিড়াল। তিনি ঝুনুমাসীকে বললেন, “তুমি পাগল হয়েছো, না আমি চোখের ভুল দেখছি? এ কখনো হয়? এটা বাড়ি, না চিড়িয়াখানা? হঠাও, সব কটাকে হঠাও!”
ঝুনুমাসী বললেন, “আমি যদি থাকি, তা হলে বিড়ালও থাকবে।”
সারা বাড়িতে ম্যাও মিয়াঁও ক্যাঁও কিঁও চিঁউ ওয়াঁও এইরকম নানারকম ডাক। কত রকম সাইজের কত রকম রঙের বিড়াল। এর মধ্যে মানুষের থাকা সত্যি অসম্ভব। আমরা ভাবলুম, ঝুনুমাসীর জন্য ডাক্তার ডাকবো কি না।
রাত্তিরে খেতে বসারও উপায় নেই। খাবার টেবিলের চার পাশে দেড়শো বিড়াল। অনেকগুলোই লাফিয়ে টেবিলে উঠে আসছে। সুখন একটা লাঠি নিয়ে সেগুলো তাড়াতে গেলেও যায় না।
হঠাত্ ঝুনুমাসী চেঁচিয়ে উঠলেন, “ঐ তো! চুপ, ঐ তো, শোন্!”
সেই চিত্কারে সবাই চুপ করে গেল। এমনকী বিড়ালগুলো পর্যন্ত। আমরা শুনতে পেলাম, বন্ধ সদর দরজার বাইরে কে যেন মিষ্টি গলায় ডাকছে, মিঁউ!
ঝুনুমাসী ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। অমনি ফ্লসি ভেতরে এসে ঝুনুমাসীর পায়ে মাথা ঘষতে লাগলো। ঝুনুমাসী তাকে কোলে তুলে নিয়ে একেবারে কেঁদে ফেললেন। তাকে আদর করে বলতে লাগলেন, “ওরে সোনা, তুই কোথায় গিয়েছিলি, তুই মায়ের ওপর রাগ করেছিলি? আহা তোর বুঝি খুব লেগেছিল সেদিন?”
ঠিক মনে হচ্ছে মা মেয়ের অভিমান ভাঙাচ্ছে।
অন্য বিড়ালগুলো ফ্লসির এই আদর মোটেই ভালো চোখে দেখলো না। কয়েকটা বিচ্ছিরি চেহারার হুলো বিড়াল রীতিমতন রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো।
ছোটমেসো বললেন, “যাক, পেয়েছো তো! তোমার আদরের বেড়ালকে পেয়েছো তো? এবার বাকিগুলো সব তাড়াও!”
কিন্তু বিড়াল তাড়ানো কি সহজ? যে-বাড়িতে বিড়ালকে একবার আদর করে খাবার দেওয়া হয়েছে, সে-বাড়ি ছেড়ে তারা কিছুতেই যাবে না। ঝুনুমাসীর কোলে চেপে ফ্লসি খুব ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে। এত বিড়াল সেও সহ্য করতে পারবে না।
আমি, সুখন আর পল্টু তিনটে লাঠি নিয়ে বিড়ালগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে পাঠাই। একটু বাদেই তারা ঠিক ফিরে আসে। এক সঙ্গে অত বিড়ালকে আটকানো অসম্ভব। জানলা দিয়ে, ছাদ দিয়ে ফিরে আসবেই।
আরও দুটো দিন এরকম অবস্থায় কাটাবার পর বোঝা গেল, একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে এ-বাড়িতে থাকাই অসম্ভব। রাস্তায় ঘাটে এক সঙ্গে এত বিড়াল ছেড়ে আসা যায় না। লোকেরা আপত্তি করবে। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি মেসোমশাই-ই বার করলেন। রং তুলি নিয়ে অনেকগুলো কাগজে পোস্টার লেখা হলো:
প্রদর্শনী, বিরাট প্রদর্শনী
অভূতপূর্ব বিড়াল প্রদর্শনী
ধর্মতলা কার্জন পার্কে আজ সন্ধ্যা ছটায়
আপনার গৃহপালিত বিড়াল আনুন
প্রথম পুরস্কার এক হাজার টাকা
আরও অন্যান্য অনেক পুরস্কার!
এই পোস্টারগুলো মেরে দেওয়া হলো কার্জন পার্কের কাছাকাছি সব রাস্তায়। তারপর এ-বাড়ির সবকটা বিড়ালকে ধরে তোলা হলো একটা লরিতে। ভোরবেলা সেই লরিভর্তি বিড়াল এনে ছেড়ে দিলাম কার্জন পার্কে। আমরা আর কেউ লরি থেকে নামলাম না পর্যন্ত। যদি কোনো বিড়াল পায়ে এসে আবার লুটিয়ে পড়ে!
লরিটা ছাড়বার পর ছোটমেসো বললেন, “কার্জন পার্কে অনেক ইঁদুর আছে, বিড়ালগুলো ভালো থাকবে। তা ছাড়া প্রদর্শনীতে পুরস্কার পাওয়ার লোভে কেউ কেউ ওদের কটাকে পুষ্যিও নিতে পারে। মোট কথা, ব্যবস্থাটি বেশ ভালোই হয়েছে, কী বলো?”
বাড়ি ফিরে ঝুনুমাসীকে সব শোনাতে হলো। ফ্লসি তার কোলের কাছে শুয়ে। অন্য বিড়ালগুলো তাড়াবার জন্য ঝুনুমাসী খুব খুশী নন। সব শুনে-টুনে তিনি ফ্লসির গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “সত্যি-সত্যি একটা বিড়ালের প্রদর্শনী যদি হতো, তাহলে আমার ফ্লসিই নিশ্চয়ই ফার্স্ট হতো! তাই না?”
আমরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করলাম না।