এক মাস পরে জটা ফিরে এল। টিপুকে দেখে হাসল দাঁত বের করে। জটার পুরো নাম জটাধারী।
টিপু বলল, “আর মধু খাবি?”
জটা হাসতে-হাসতে বলল, “খাবই তো। চাক ভাঙবার আসল কায়দাটা শিখে নিয়েছি।”
টিপু হাত নেড়ে বলল, “থাক, ঢের হয়েছে। তোর আসল কায়দাটা বনে-জঙ্গলে গিয়ে দেখাস। বাড়ির বাগানে আর নয়।”
জটা কাজ করে টিপুদের বাড়িতে। টিপুদের তিনটে গরুকে জাবনা দেয়, মানে বিচালি কেটে খইল মিশিয়ে খেতে দেয়। তাদের স্নান করায়, মাঠে নিয়ে গিয়ে ঘাসও খাওয়ায়। বাজারে যায় কেরোসিন তেল, নুন ইত্যাদি আনতে। এই সব জটার কাজ। হাতে কাজ না থাকলে নানা রকম কীর্তি করে। মাইনে পায় দশ টাকা। খায়, দায় রাত্তিরে ঘুমায় কাছারি-ঘরে।
অসুখ করায় একমাসের ছুটি নিয়ে জটা বাড়ি চলে গিয়েছিল। অসুখটা অবশ্য বাধিয়েছিল নিজেইয় সেই এক মাস টিপুদের খুব অসুবিধে গেছে। টিপুদের বাড়িটা তো ফাঁকা। সবাই থাকেন কলকাতায়। গ্রামের বাড়িতে শুধু মা। তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। সব থেকে ছোট ছেলে টিপু তাঁর সঙ্গে থাকে। টিপুর দশ চলছে, জটা তার থেকে পাঁচ বছরের বড়। জটার কোঁকড়ানো চুল, সে টিপুর থেকে অনেক বেশী ফরসা।
জটা না থাকলে ভারী অসুবিধে। টিপু তো আর গরুকে খেতে দিতে পারে না।
তাদের চিতি গাইয়ের একটা কমলা রঙের বাছুর হয়েছে। সেটাকে আদর করতে অবশ্য টিপুর ভাল লাগে। বাছুরটা খুব মজা করে। মেজাজ এসে গেলে লেজটা আকাশের দিকে তুলে লাফায়। কাজ না-থাকলে জটা খেলা দেখায়। একটার নাম সন্দেশের খেলা। একটি ছানার সন্দেশ পেলে খেলাটা দেখায়। বাগান থেকে একটা কলাপাতা কেটে এনে উঠোনে পাতে। তার ওপর মালার মতন করে সাজায় গোবর-দিয়ে-বানানো আট দশটি সন্দেশ। ছানার সন্দেশটি রাখে মালার ঠিক মাঝখানে। তারপর জটা তার দু পা ওপরে তুলে দেয় কমলা রঙের বাছুরটার মতন। হাত দুটোর ওপর শরীরের ভার, মাথা নীচের দিকে। ফরসা মুখ লালচে হয়ে যায়। এইভাবে জটা ময়ূর সাজে। তখন হাত দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে কমলা রঙের বাছুরটার মতন জিভ বের করে কলাপাতা থেকে ছানার সন্দেশটা তুলে নিয়ে যায়।
একবার এই খেলাটা দেখাবার সময় জেট-প্লেনের মতন উড়ে এসে একটা মশা জটার গালে বসেছিল। মশাটাকে তাড়াবার উপায় ছিল না, কারণ পা আকাশের দিকে, হাতের ওপর শরীরের ভার। পরে সন্দেশ খেতে-খেতে জটা নিজের গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিল।
সেবার জটা জামগাছের ডালভেঙে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। হাড় ভাঙেনি, মাথা ফাটেনি। তবে ডান হাতটা মচকে যায়। তারপর থেকে আজকাল আর সন্দেশের খেলাটা দেখাতে চায় না! একটার বদলে দুটো সন্দেশ দিলেও না।
একমাস আগের এক বিকেলে টিপু সবে স্কুল থেকে ফিরেছে। বইটই রেখে, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়েছে। এখন বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে যাবে অন্য ছেলেদের সঙ্গে। উঠোনে জটার মুখোমুখি।
জটা বলল, “মধু খাওয়ার খেলা দেখবি, টিপু?’’
টিপু বলল, “নতুন শিখেছিস বুঝি?”
“নতুন শিখব কেন? আগে থেকেই জানি।”
“দেখি কেমন খেলা।”
“তুই এখানে দাঁড়া। দেখবি কেমন মজা করে মধু খাই।”
জটার দু হাতে দুটো বড় পাথর। তাই নিয়ে বাগানের দিকে চলে গেল। জটার খালি গা, কাপড়টা হাঁটুর অনেক ওপরে এঁটে পরেছে। উঠোনের পশ্চিমের বাগান। বিকেলবেলায় গাছের ছায়া পূব দিকে লম্বা হয়ে পড়েছে উঠোনে। বাগানের এক আমগাছের ডালে মস্ত একটা মৌচাক হয়েছে। সবাই জানে। টিপুও দেখেছে দূর থেকে।
এখন জটা সেই আমগাছের তলায় গিয়ে মৌচাকে পরপর দুটো পাথর ছঁুড়ে মারল দারুণ জোরে। ভয়ে টিপু উঠোন থেকে বড় টিনের ঘরের বারান্দায় উঠে গেল।
পাথর ছঁুড়ে জটা আমগাছের গোড়ায় গিয়ে বসল। মুখ ওপরে তুলে হাঁ করে রইল। চাক থেকে টপটপ করে মধু পড়বে আর চেটে-চেটে খাবে। খেলাটা বুঝতে পারল টিপু, কিন্তু ভয় পেল।
মৌচাকের একটা পাশ ভেঙে গিয়েছিল। মধু পড়ল টপ-টপ করে। এক ফোঁটা জটার কোঁকড়ানো চুলে, এক ফোঁটা বুকে। সঙ্গে-সঙ্গে হাজার-হাজার মৌমাছি রেগে গিয়ে উড়ে এসে জটাকে ছেয়ে ফেলল। দূরের বারান্দা থেকে এসব স্পষ্ট দেখতে পেল না টিপু, কিন্তু তখনই জটার চিত্কার শুনতে পেল। আমগাছতলায় ছটফট করতে-করতে জটা চেঁচাচ্ছিল‘ওরে ঠামা রে, আমায় খেয়ে ফেললে রে!’
চিত্কার শুনে টিপুর মা ঘর থেকে বারান্দায় এলেন। আমগাছের গোড়ায় জটাকে ওই অবস্থায় দেখে হয়ত সবই আন্দাজ করলেন, তবু কী করা উচিত চট করে বুঝতে পারলেন না।
জটা বাগান থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে চিত্কার করতে করতে ছুটে গেল দিঘির দিকে। টিপু দেখল, জটা যেন টুকটুকে ফরসা গায়ে কুচকুচে কালো জামা পরেছে। শেষ বিকেলের অল্প আলোতেও চকচক করছে সেই কালো জামা। আসলে হাজার হাজার কালো মৌমাছি তার গায়ে সেঁটে আছে, হুল ফোটাচ্ছে। আরো এক ঝাঁক উড়ছে ছুটন্ত জটার সঙ্গে সঙ্গে। একটুক্ষণ টিপুর চোখে পলক পড়ল না। মা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে একখানা চাদর এনে জোর পায়ে এগোলেন দিঘির দিকে, সঙ্গে টিপু। চিত্কার শুনে পাশের বাড়ির নন্তুকাকু এবং আরো কয়েকজন ছুটে এল।
দিঘির পাড়ে এসে টিপু দেখল, জটা জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ডুব দিয়ে থাকছে জলের তলায়, দম ফুরিয়ে গেলে ভেসে উঠছে, আবার ডুব দিচ্ছে। ডুব দিয়ে থাকলে সেই জায়গাটায় জলের ওপর একঝাঁক মৌমাছি উড়ছে। নিশ্বাস নিতে জটা ভেসে উঠলেই মৌমাছিরা তার মুখে-মাথায় হুল ফোটাচ্ছে। মৌমাছিদের এমন রাগ।
ডুব-সাঁতার কেটে জটা অন্যদিকে সরে গেল। রাগী মৌমাছিরাও উড়ে গেল সেই দিকে। এইভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ।
নন্তুকাকু চিত্কার করে জটাকে ডাকতে লাগলেন- ঘাটের কাছে চলে আয়, শেষে ডুবে মরবি!
ডাক শুনে জটা ডুব সাঁতার কেটে ঘাটের কাছে এলে নন্তুকাকু প্রায় কোমর জলে নেমে তাঁকে টেনে তুললেন। কয়েকটা মৌমাছি নন্তুকাকুর গায়ে হুল ফোটাল। টিপুর মা ঘাটের সিঁড়ির দুটো ধাপ নেমে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন জটাকে। মৌমাছিরা জটার আর কিছু করতে পারল না, কিন্তু দু-তিনটে উড়ে এসে হুল ফুটিয়ে দিল টিপুর মার হাতে।
সন্ধের পর জটার ভীষণ জ্বর হল। ভুল বকতে শুরু করল। কাঁপুনি থামছিল না। ডাক্তার ডাকা হল, খবর দেওয়া হল জটার ঠাকুমাকে। এই গ্রামেই অল্প দূরে জটাদের বাড়ি। তার ঠাকুমা তখনই চলে এলেন। জটার মা-বাবাকে কখনও দেখেনি টিপু, তার ঠাকুমাকেই দেখে আসছে। ঠাকুমার বয়েস বেশী হয়ে গেলেও শরীর খুব শক্ত। ধাই মা’র কাজ করেন।
ডাক্তারবাবু জটার হাতে আরও একটা হুল ফোটালেন, একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। খাবার ওষুধও দিলেন। সারারাত ঠাকুমা জটাকে নিয়ে রইলেন কাছারি ঘরে। পরদিন সকালে অত বড় একটা ছেলে তার ঠাকুমার কোলে উঠে বাড়ি চলে গেল। তখন জ্বর কমেছে। ঠাকুমার কোলে ওঠার আগে জটার গায়ে ভাল করে চাদর জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। টিপু এক ঝলক দেখতে পেল তার খালি গা। দেখেই কদম ফুলের কথা মনে পড়ল। কদম ফুলের রোঁয়ার মতন জটার সারা গায়ে মৌমাছির সাদাটে হুল ফুটে আছে।
সেই জটাধারী এক মাস পরে ফিরে এসে টিপুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। জানিয়ে দিল নতুন কায়দায় মৌচাক ভেঙে আবার মধু খাবে।