ক্যামেরা

ক্যামেরা

এবারে জাপান যাবার সময় আমাদের কাগজের ফোটোগ্রাফার রজত সেন বলেছিল, “সুবীরবাবু, অনেক দিন ধরে আমার শখ একটা জাপানী শিকন ক্যামেরা। তা আপনি যখন জাপান যাচ্ছেন, তখন যদি আমার জন্য একটা ক্যামেরা নিয়ে আসেন।”
আমি বলেছিলাম, “যদি একসচেনজে টান না পড়ে, নিশ্চয়ই আনব।”
রজত সেনকে আমি খুব পছন্দ করি। ফোটোগ্রাফিতে দারুণ হাত। সেবার পাকিস্তান-যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে গাছে উঠে খান-সেনাদের ছবি তুলেছিল। বছর দুয়েক আগে প্রেস ফোটোগ্রাফির প্রদর্শনীতে ওর ফার্স্ট প্রাইজ-পাওয়া ছবিটা নিয়ে বিদেশের কোনও কাগজে একটা প্রবন্ধও বেরিয়েছিল।
রজত বলেছিল, “আমি রোলিফ্লেকস ক্যামেরা ব্যবহার করি। কিন্তু সেবার বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় খান-সেনাদের তাড়া খেয়ে পালাবার সময় লেন্সটা একটু চোট খেয়েছিল। সারিয়ে নিয়ে অবশ্য চলছে। কিন্তু একটা শিকন পেলে আর কথা নেই। আপনি একটু বিশেষভাবে চেষ্টা করবেন সুবীরবাবু।”
বলেছিলাম, “আচ্ছা করব।”
তামাম মারকিন মুলুক ঘুরে জাপানের টোকিওতে যখন এলাম, তখন পকেটে রীতিমত টান পড়েছে। জাপান খুব ব্যয়বহুল জায়গা। রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম আমেরিকার দ্বিগুণ। আমাদের হোটেল নিউওটানি চারজ নিচ্ছে দিনে প্রায় আড়াশো টাকা। আমার নিজের কিছু জিনিস কেনার আছে। ক্যামেরার কথা মনে ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, বারোশো টাকার কমে একটা শিকন ক্যামেরা পাওয়া খুব মুশকিল।
তবু ক্যামেরার দোকান দেখলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। কাচের জানলা দিয়ে দেখি, সারি-সারি ক্যামেরা সাজানো রয়েছে। তলায় দাম লেখা। টোকিওর চৌরঙ্গী হল গিঞ্জা। চৌরঙ্গীর সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। অন্তত গোটা ছয়েক চৌরঙ্গী এক করলে যা হয়। বিরাট-বিরাট চওড়া রাস্তা, আর পাশে সারি-সারি জমকালো দোকান। এক-একটা দোকান আবার পাঁচ ছ’তলা। রাস্তার দু’ধারে আলোয় আলো ওই গিঞ্জা মেন স্ট্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে এসে পড়লাম গিঞ্জা ক্র্যাফট নামে এক ক্যামেরা দোকানে। ওখানে শিকন ক্যামেরার ছড়াছড়ি। আমি ঘুরে-ঘুরে দেখছি, এমন সময় দোকানীদের একজন এসে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজীতে বললেন, “আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। ধন্যবাদ।”
লোকটি বললেন,“ক্যামেরা কিনবেন কি?”
আমি বললাম, “কেনার তো ইচ্ছে ছিল, কিন্তু যা দাম শিকন ক্যামেরার। ভাবছি হংকং থেকেই কিনব।”
“একই দাম পড়বে সার। আমাদের এটাও ডিউটি ফ্রি দোকান।”
“আচ্ছা, এখানে সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা পাওয়া যায় কোথায় বলতে পারেন?”
লোকটি বললেন, “সেকেন্ড হ্যান্ড একটি ক্যামেরা এখানে আছে। নেবেন? আমরা পুরনো ক্যামেরা রাখি না। তবে এটার একটা ইতিহাস আছে। যদি নিতে চান, বলতে পারি।”
বেশ অবাক লাগল। ক্যামেরার আবার ইতিহাস! বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। বললাম, “বলুন না ইতিহাসটা। কী শুনি।”
ভদ্রলোক ভেতর থেকে একটি ক্যামেরা নিয়ে এলেন। একেবারে স্ট্র্যাপসুদ্ধ। স্ট্র্যাপ খুলে ক্যামেরাটি বার করলেন। বললেন, “বছরখানেক আগে এই ক্যামেরাটি আমরা বিক্রি করেছিলাম একজন জাপানী ভদ্রলোকের কাছে। ভদ্রলোকের বাড়ি ওসাকায়। তিনি ক্যামেরাটি কিনে নিয়ে যাওয়ার সাতদিনের পরে আমাদের এখানে ছুটে আসেন। তাঁর মতে ক্যামেরার লেন্সে গলদ আছে। কারণ কোন কিছু ছবি তুলতে গেলে ছবির চারপাশে কতকগুলি ছায়ার মত স্পট পড়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক প্রথমে ভেবেছিলেন ফিল্মের গণ্ডগোল। কিন্তু ফিল্ম পালটানোর পর নতুন ফিল্ম দিয়েও গলদ দূর হল না। উনি তখন ক্যামেরাটা এনে আমাদের ফেরত দিলেন। সঙ্গে ছবিগুলোও এনেছিলেন। আমরাও দেখলাম, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলাম না। কতগুলো আবছা ফিগার। ঠিক মানুুষের মত অথচ মানুষ নয়। ফিগারের সংখ্যা কোথাও এক, কোথাও একাধিক।
“আমরা ক্যামেরাটি ফেরত নিয়ে ওঁকে বললাম, ওটি আমরা ফ্যাকটারিতে পাঠাচ্ছি কোন গলদ ধরা পড়ে কিনা দেখতে। যদি দেখি যান্ত্রিক কোন গোলমাল, আমরা ঠিক করে দেব। সাত দিনের মধ্যেই, ওটা আমরা নিজের খরচে ওসাকায় পাঠিয়ে দেব। আপনি ঘাবড়াবেন না।

“কিন্তু আশ্চর্যের কথা, কারখানায় ক্যামেরার কোন ত্রুটি চোখে পড়ল না। আমাদের মেকানিক ওটাকে ভাল করে অয়েলিং করে আমাদের দিয়ে গেল। আমরা লোক দিয়ে ওসাকায় ডেলিভারি দিতে গিয়ে শুনি ভদ্রলোক দুদিন আগে একটা অ্যাকসিডেনটে মারা গেছেন। তাঁর ওয়ারিশানও তেমন কাউকে পাওয়া গেল না। সেই থেকে ক্যামেরাটা এখানেই আছে। প্রায় এক বছর পরেও যখন কেউ দাবিদার এল না, তখন ওটাকে সেকেন্ড হ্যান্ডের দরে আমরা বিক্রি করব ঠিক করেছি।”
আমি বললাম, “কিন্তু ছবিতে যদি গলদ থাকে, তা হলে ও ক্যামেরা নিয়ে কী হবে?”
ভদ্রলোক বললেন, “অয়েলিংয়ের পর আর কোন গলদ পাওয়া যায়নি। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এই দেখুন ছবি খুব স্বাভবিক।”
ভদ্রলোক কতগুলো ছবি দেখালেন। খুব স্বাভাবিক ছবি সেগুলো।
“কত দাম?” এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“একেবারে জলের দাম-ষাট ডলার। একশ সত্তর ডলার নতুন দাম। ষাট ডলারে দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। ডলারেই বললাম, ইয়েনে বললে বুঝতে অসুবিধে হবে।”
ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। লেন্সের উপরে ভিউ ফাইন্ডারের গায়ে লেখা আছে ঃ শিকন। বেশ মোটা লেন্সের মুখটা। টেলিস্কোপিক লেন্স লাগিয়ে নিলে এ-ক্যামেরা দিয়ে দিগ্বিজয় করা যাবে। খুব হ্যান্ডি ক্যামেরা, ভারী নয়। আমি কী মনে করে কিনেই ফেললাম।
কলকাতায় ফিরে রজত সেনকে ক্যামেরাটা দিলাম কিন্তু বললাম না, ওটা সেকেন্ড হ্যান্ড।
অত শস্তা দামে এমন ভাল একটা ক্যামেরা এনেছি বলে রজত ভারী খুশী হল। বলতে লাগল, “আমার যা উপকার করলেন সুবীরবাবু, এর আর কোন প্রতিদান নেই।”
দিন তিনেক পরে রজত আমার কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। “সুবীরবাবু, আপনার ক্যামেরাটা ডিফেকটিভ।”
আমি চমকে উঠলাম। তাহলে কি ক্যামেরাটা আবার ট্রাবল দিতে শুরু করেছে? মুখে বললাম, “কেন, কী হয়েছে?”
রজত বলল, “এই দেখুন, প্রথম ছবি তুলতে গিয়েই কী বিপত্তি। প্রত্যেক ছবিতে এই সব কালো স্পট। এরা কারা? কুড়ি বছর চাকরি করছি, আমার ক্যামেরায় কখনও বাজে ছবি ওঠেনি।”
আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু মুখে কোন ভাব না ফুটিয়ে বললাম, “দেখি ফোটোগুলো। এটা কার ফোটো?” দেখলাম একটি কিশোর ছেলের ছবি। ক্রিকেট খেলছে। নানান পোজে। খুব সপ্রতিভ চেহারা। কিন্তু প্রত্যেকটি ছবির পিছনে কালো-কালো সিলুয়েট-মূর্তি। মনে হচ্ছে যেন কোন ছায়া-মূর্তি। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না।
মুখে প্রাণপণে হাসি আনবার চেষ্টা করলাম। তারপর শুকনো হাসি হেসে বললাম, “ও কিছু না। হয়ত কোন কিছুর শেড এসে পড়েছে। নতুন ক্যামেরা বলে এখনও ধাতস্থ হননি।”
রজত সেন দু-একটা কথা বলে অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল। কিন্তু একটা বিরাট ভয় আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগল।
ওগুলো কি সেই একই ধরনের ছায়া-মূর্তি? এই ক্যামেরায় জাপানী মালিকের মৃত্যুর আগেও তার ছবিতে এমন ছায়া-মূর্তি ফুটে উঠেছিল।
তাড়াতাড়িতে জেনেও নেওয়া হয়নি ছেলেটি কে। কিন্তু কেন যেন মনে হতে লাগল ওই ফুটফুটে কিশোর ছেলেটির সামনে একটা বিরাট বিপদ।
সারারাত ঘুমোতে পারলাম না। পরদিন সকালে উঠেই চলে গেলাম রজত সেনের বাড়ি। গিয়ে শুনলাম রজত সেন বাড়ি নেই।
“কোথায় গেল এত সকালে?”
একজন বৃদ্ধা সম্ভবত রজতের কোন নিকট-আত্মীয়া, চোখ মুছতে-মুছতে বললেন, “রজতের ছোট শালাটি আজ ভোরে স্কুলে যাবার সময় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। খবর পেয়ে বাড়ির সবাই ভবানীপুর চলে গেছে।”
আমি বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
মাস দুয়েক পরে শোকটা সামলে ওঠার পর রজতকে বললাম, “রজতবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না।”
“না না, বলুন না।”
“ওই ক্যামেরায় কোন ছবি আর তুলেছেন?”
রজত মৃদু হেসে বলল, “হঁ্যা সুবীরবাবু, রোজই এখন ওই ক্যামেরাই ব্যবহার করি।”
“আর কোন কালো স্পট?”
“না না। এখন একেবারে ভাল ছবি উঠছে। আপনার একটা ছবি তুলে দেব?”
“না না।” আমি সভয়ে যেন আর্তনাদ করে উঠলাম।
“সে কী সুবীরবাবু, ছবি তোলার নাম শুনে আঁতকে উঠলেন কেন?”
আমি বললাম, “না না, তেমন কিছু নয়। ছবি তুলতে আমার ভাল লাগে না। এই তো টেকো চেহারা।”
রজত হেসে উঠল বলল “আচ্ছা, তাহলে থাক। আপনার ভাগ্নীর বিয়ে তো আসছে মাসে। আমি ছবি তুলে দেব।”
আমি এড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিয়ের দিন রজত একেবারে বিয়ের আসরে ক্যামেরা নিয়ে এসে হাজির। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বিয়ের ছবি তুলল প্রায় গোটা চারেক রীল। বরযাত্রীরা খুব খুশি। তারা রজত সেনের নাম জানে। অতবড় ফোটেগ্রাফার তাদের ছবি তুলছে, এতেই তারা খুশী।
মনটা আমার অজানা আশঙ্কায় একেবারে নিস্তেজ হয়ে ছিল। রজতকে নেমন্তন্ন না-করলেই হত। কিন্তু আবার উপায়ও ছিল না। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি পাড়াতেই রজতেক বাড়ি। আমার ভাগ্নীকে ছোটবেলা থেকে চেনে। ওরাও মামা মামা করে। কিন্তু সেদিন অফিসে রজত আমাকে ছবি দেখাতে আমি আঁতকে উঠলাম। রজত বলল, “আবার সেই কালো স্পট সুবীরবাবু। দেখুন, ক্যামেরাটা আবার বিগড়োতে শুরু করেছে।”
দেখি নতুন জামাইয়ের ছবির ঠিক পিছনে একটা কালো আবছা মূর্তি। ঠিক যেমন দেখেছিলাম রজতের শালার ছবির পিছনে।
আমি থাকতে না-পেরে বললাম, “রজতবাবু, বড় অলুক্ষনে এই কালো স্পট।”
রজতের মুখ কঠিন হয়ে গেল। বলল, “কেন বলুন তো?”
আমি আগের ঘটনা চেপে গিয়ে বললাম, “কেন যেন মনে হচ্ছে- আপনার শালার ছবিতে এমন কালো স্পট পড়েছিল। তারপরই সেই অ্যাক্সিডেনট্টা হল…।”
রজত সেন বলল, “সুবীরবাবু আপনি না বিদেশে ঘুরে এসেছেন? এসব ঘটনায় বিশ্বাস করেন? এ-সব স্পট আসলে মেকানিক্যাল ডিফেক্ট ছাড়া কিছুই নয়।”
মনে মনে প্রার্থনা করলাম, হা ভগবান, তাই যেন হয়। কিন্তু তার চারদিন পরে এক সর্বনাশা ঘটনা ঘটল আমার জীবনে।
আমার ভাগ্নী মমতা আর জামাই রঞ্জন গোপালপুরে হনিমুন করতে গিয়েছিল। টেলিগ্রাম পেলাম, সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গেছে রঞ্জন। দু’দিন পর পনেরো মাইল দূরে তার ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
পাগলের মত আমরা বাড়ির সবাই গোপালপুরে ছুটে গেলাম।
গোপালপুর থেকে যখন ফিরলাম, তখন মমতা প্রায় পাগল হয়ে গেছে। এক নিমেষের মধ্যে কী সর্বনাশ নেমে এল আমার জীবনে। আমার বোন ভগ্নীপতিতে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমি খুঁজে পেলাম না। অথচ সমস্ত-কিছুর জন্য আমার নিজেকে দায়ী মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল, ওই ক্যামেরা, ওই ক্যামেরাই সবকিছুর জন্য দায়ী।
রজত সেনের খোঁজ করলাম অফিসে গিয়ে। শুনলাম ও ট্যুরে বেরিয়ে গেছে। আমি একমাসের ছুটি নিয়ে মমতাকে নিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে চলে গেলাম।
হরিদ্বারে হর কি প্যারীর সামনে বেড়াতে বেড়াতে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। ভদ্রলোক চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নাম ডঃ হরবংশ সিং। কথায়-কথায় বললেন যে, উনি আত্মা নিয়ে গবেষণা করছেন। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা যা বললেন, সেটা এই যে শক্তিশালী কোন ক্যামেরার সাহায্যে কখনও-কখনও নাকি প্রেতাত্মার ছবি তোলা যায়।
আমি বললাম, “তাও কি হয়?”
উনি বললেন, “এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছি। আমেরিকাতে সত্যি সত্যি এমন অনেক ছবি উঠেছে।”
আমি তখন ক্যামেরার ঘটনাটা বললাম। শুনে উনি বললেন, “কী আশ্চর্য, ঠিক এমন এক ক্যামেরার কথা বার্লিন প্যারাসাইকোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে বার হয়েছিল। সে-ক্যামেরা দিয়ে এভাবে নানান প্রেতাত্মার ছবি তোলা যেত। অবশ্য জাপানে ও ক্যামেরা আসার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে হয় যে-কোন কারণে হোক, ওই লেন্সটটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এইজন্যই প্রেতাত্মাদের ছবি ধরা পড়ছে। অনেক সময় কারও মৃত্যুর আগে দুষ্ট প্রেতাত্মা তার সঙ্গে নেয়। সেই সময় ছবি তুললে ওই প্রেতাত্মার ছবি উঠে যাওয়া স্বাভাবিক। যাইহোক আমি আপনার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে ক্যামেরাটি আর ছবিগুলি একবার পরীক্ষা করব। হয়ত এটা থেকে বিরাট গবেষণার সূত্র পেয়ে যেতে পারি।”
হরবংশ সিং সত্যি-সত্যি আমার সঙ্গে কলকাতা চলে এলেন। পরদিন অফিসে গিয়ে রজতের খোঁজ করে জানতে পারলাম, রজত সেইদিনই সকালে কায়রো চলে গেছে।
“কায়রো?”

“একটি প্লেন-কোম্পানির প্রথম ফ্লাইট শুরু হচ্ছে। জন দশেক সাংবাদিককে নিয়ে যাচ্ছে। রজত তার মধ্যে জায়গা পেয়েছে। আজ রাতে দিল্লি থেকে ফ্লাইট। এই প্লেন কোমপানির সৌজন্যে আমাদের কাগজে একটি সাপলিমেনটও বার হবে। রজত দিল্লি থেকে তার কিছু ছবিও পাঠাবে।”
হরবংশ সিংয়ের কাছে ক্ষমা চাইলাম। এতদূর ছুটে এলেন ভদ্রলোক, অথচ রজতকে পাওয়া গেল না। রজত আবার কায়রো থেকে লন্ডন যাবে। মাসখানেকের প্রোগ্রাম।
রাতে অফিসে বসে কাজ করছি। আমাদের সাব-এডিটর মুকুন্দবাবু টেলিপ্রিন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাত্‌ তিনি চিত্‌কার করে উঠলেন। আমরা ছুটে গেলাম। দেখি টকটক করে খবর আসছেঃ কায়রোগামী নতুন বিমানটি দিল্লি থেকে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বিমানের যাত্রীদের কেউ বাঁচেনি। ত্রিশজন সাংবাদিক ছিলেন ওই প্লেনে। প্রথম দিল্লি-কায়রো রুটের উদ্বোধনী ফ্লাইটেই এই দুর্ঘটনা ঘটল। সারা অফিসে শোকের ছায়া নেমে এল। তারপর শোক শান্ত হলে আমাদের নিউজ এডিটর শম্ভুবাবু বললেন, “যাত্রীদের কোন ছবি পাওয়া যায় না? রজতের না একটা ফিলমের রোল পাঠাবার কথা ছিল? দেখ তো ফোটোগ্রাফির ঘরে গিয়ে। ওদের খবরটা এখন দিও না।”
কিন্তু আমাকে যেতে হল না। একটু পরেই তিন-চারটে ফোটো নিয়ে এসে হাজির হল চীফ ফোটোগ্রাফার চঞ্চল ঘোষ। চঞ্চল এসে বলল, “শম্ভুদা, কী ছবি পাঠিয়েছে রজত- প্রত্যেকটা ছবিতে কালো স্পট।”
“স্পট?”
“হঁ্যা, এই দেখুন না।”
বলে চঞ্চল ফটোগুলো টেবিলে রেখে দিল। দিল্লি-কায়রো ফ্লাইটের যাত্রী-সাংবাদিকদের রিসেপশনের একটা ছবি। হোটেলের লনে তোলা। ছবিতে সকলের চেহারা স্পষ্ট। কিন্তু ছবির মধ্যে সেই কালো কালো কতগুলি আবছা মূর্তি। ঠিক আগে প্রত্যেকবার যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমনি।
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার মাথা ঘুরে উঠল। সারা পৃথিবী দুলতে লাগল। আমি জ্ঞান হারালাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত