ওরোসাম্বাদের শেষ বংশধর

ওরোসাম্বাদের শেষ বংশধর

অরুণদাদু একটা কালো রুমাল বের করে খুলে দেখিয়ে দিলেন তার মধ্যে কিছুই নেই। শুধু মাঝখানে একটা মানুষের খুলির ছবি। রুমালটা নাড়িয়ে গোঁফের নিচে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বললেন, “এই রুমালটা পয়সা খায়, বুঝলি?” বলে দু’হাত তুলে আমাদেরকে দেখিয়ে দিলেন যে ওনার হাতে আর কিছু নেই। এরপর রুমালের ভেতরে ডানহাতটা ঢুকিয়ে আঙুল দিয়ে বাটির মতো করে বাঁহাত দিয়ে রুমালের উপর থেকে একটা গর্ত তৈরি করলেন। তারপর চোখদু’টো গুলি গুলি করে কী একটা মন্ত্র পড়ে আমাকে বললেন, “একটা কয়েন এর মধ্যে দিয়ে দে।”

আমি ঝিন্টু আর চঞ্চলদার মুখের দিকে একবার চোখটা বুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে একটা দু’টাকার কয়েন বের করে রুমালের গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। অরুণদাদু দেখিয়ে দিলেন পয়সাটা রুমালের গর্তের মধ্যেই রয়েছে। তারপর রুমালটা মুড়ে মুঠোর মধ্যে নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে আরও কিছু মন্ত্র পড়লেন। তারপর একটা কোণ ধরে উড়িয়ে দিলেন রুমালটাকে। চোখের সামনে কয়েনটা ভ্যানিশ! খোলা হাত তুলে দেখিয়ে দিলেন, হাতেও কিছু নেই। আশ্চর্য!

আমরা তিনজনে চোখ গোল গোল করে বসে আছি। সত্যিই তো, পয়সাটা গেল কোথায়! তিনি রুমালটা আবার বাঁহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আঙুলগুলো নাচিয়ে ফুঁ দিলেন তিনবার। এরপর পুনরায় রুমালটা ঝাড়তে বেরিয়ে কয়েনটা লাফ দিয়ে মেঝেতে পড়ে টং করে আওয়াজ হল। গড়িয়ে গেল বুক সেলফের নিচে।

“দাদু, ম্যাজিকটা শিখিয়ে দাও প্লিজ!”

তিনি বললেন, “খুব সহজ এটা। আমার বাঁহাতের অনামিকায় যে আংটিটা আছে, তার নিচে আগে থেকে একটা কালো গার্ডার লুকিয়ে রেখেছিলাম। রুমালের তলায় যখন গর্তটা বানিয়েছিলাম, গার্ডারটা ছিল ওর চারপাশে। তারপর পয়সাটা গার্ডারের মধ্যেই আটকে ছিল রুমালের সাথে। তোরা নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দু’একবার চেষ্টা করবি। তাহলেই হবে।”

ভেবে দেখলাম, ব্যাপারটা খুবই সহজ। না পারার কোনও কারণই নেই। অরুণদাদু বললেন, “তবে মনে রাখবি ম্যাজিক চমকদার হয় যে দেখাচ্ছে তার অঙ্গভঙ্গির গুণে।”

গতকাল পঞ্চমী ছিল। আজকে থেকে স্কুল ছুটি। খুলবে সেই লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কানে এল গান বাজতে শুরু করেছে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে। একটা পুজো পুজো গন্ধ ম ম করছে। সকালে মায়ের হাতের গরম গরম ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা আর আলুর দম সবে শেষ করে প্লেট চাটছি, বাইরে থেকে আওয়াজ এল।আমার নাম ধরে ডাকছে ঝিন্টু, আর চঞ্চলদা। ঝিন্টু আর আমি একই ক্লাসে পড়ি। চঞ্চলদা দু’ক্লাস উঁচুতে। কিন্তু আমরা তিনজনেই খুব ভালো বন্ধু। দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে বললাম, “প্যান্ডেলে গিয়ে বস। আমি আসছি।”

তারপর প্যান্ডেলে এসে দেখি ঠাকুরের মুখ তখনও ঢাকা। আজ সন্ধ্যায় ফিতে কাটতে আসবেন এক টিভি সিরিয়ালের নায়িকা। সেজন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। আমাদেরকে কেউ পাত্তাই দিল না। তখন চঞ্চলদা বলল, “ম্যাজিকদাদুর কাছে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। আজকে একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়?”

যেমন কথা তেমনই কাজ। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে। আধঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। পুরনো বাগান ঘেরা বড়ো বাড়ি। ম্যাজিকদাদুর আসল নাম অরুণ ঘোষ। এনাকে ভূপর্যটক হিসাবে অনেকে চেনেন। জোয়ান বয়েসে পড়াশোনার গণ্ডি পার করে একসময়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে। পঁচিশ বছর পর দেশে ফেরেন। তাঁর অফুরন্ত অভিজ্ঞতা আর রোমহর্ষক গল্পের স্টক। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে উনি প্রচুর ম্যাজিকও শিখেছেন। সে সব স্টেজে দেখানো যান্ত্রিক কৌশলের চোখ ধাঁধানো ম্যাজিক নয়। বেশিরভাগই হাত সাফাইয়ের কাজ। একবার দেখলে সারাজীবনেও কেউ ভুলতে পারবে না। তাই আমরা যখনই সময় পাই ঢুঁ মারি। আজ পর্যন্ত কোনওদিন হতাশ করেননি আমাদের।

যেমন আজকে সকালে এসেই আমরা ওনাকে চেপে ধরেছিলাম। বায়না, একটা নতুন ম্যাজিক শেখাতে হবে।

দাদু বললেন, “পয়সাটা বুক সেলফের নিচে গড়িয়ে চলে গেছে। কুড়িয়ে নিয়ে আয়।”

আমি বড়ো বই আলমারির সামনে শুয়ে পড়ে হাত গলালাম। ভেতরটা অন্ধকার। হাতে একটা বড়ো কিছু ঠেকল। ঠাণ্ডা ধাতব অনুভূতি। টেনে বের করে আনতে দেখি একটা ক্রিকেট বলের মতো গোল কিন্তু চ্যাপ্টা একটা কালো রঙের ভারি ধাতব চাকতি। ধুলো আর ঝুলে ভর্তি। ঝেড়ে মুছে দেখি তার উপর কিছু আঁকিবুঁকি করা। অচেনা ভাষায় কিছু লেখা মনে হল। দু’দিকে দু’টো ফুটো। কালো শক্ত দড়ি বাঁধা সেখানে। আর আমার কয়েনটা আটকে রয়েছে সেই চাকতির গায়ে। তার মানে কি এটা একটা চুম্বক!

দাদুর সামনে এনে প্রশ্ন করলাম, “কী এটা? আলমারির তলায় পেলাম। চুম্বক মনে হচ্ছে, পয়সাটা আটকে ছিল এর গায়ে।”

চঞ্চলদা আর ঝিন্টু এগিয়ে এসে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল হাতে নিয়ে দেখার জন্য। দাদু চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসে চশমাটা নাকের উপর বসিয়ে বললেন, “আরে, এটা ঐখানে পড়েছিল! কত খুঁজেছি ব্যাটাকে। বুক সেলফের মাথায় রেখেছিলাম হয়ত। কখন পেছন দিয়ে পড়ে গেছে। কাজের লোক ভাল করে পরিষ্কারও করে না নিচেটা।”

আবার প্রশ্ন করলাম, “এটা কী দাদু?”

“এটা ওরোসাম্বাদের গুপ্তধনের চাবি।”

“ওরোসাম্বা! সেটা কী জিনিস?”

“জিনিস নয় রে পাগল! একটা প্রজাতির চার হাত বিশিষ্ট দৈত্যাকৃতি গুহামানব। তবে এখন আর তারা পৃথিবীতে নেই। ওদের শেষ বংশধর আমারই হাতে গুলি খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল।”

কথাটা কানে যেতেই আমি ধপাস করে সোফায় বসে পড়লাম। জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে রেখে দিলাম টেবিলে ঠকাস করে।

“কেসটা কী? খুলে বলবে?” চঞ্চলদা সবসময়ে ডিফেন্সিভ খেলে।

দাদু পানের চৌকো বাক্স থেকে একটা বাছাই করা পান বের করে মুখে পুরে বেশ কিছুক্ষণ চিবোলেন। আমরা সোফায় পা তুলে আরাম করে বসলাম। কিছুক্ষণ সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “সে গল্প শুরু করলে সারাদিন লেগে যাবে।”

ঝিন্টু বলল, “তা লাগুক। শুনে মনে হচ্ছে জমজমাট কিছু একটা হবে।”

“তাহলে একটা কাজ কর। আমাদের বাড়িতে আজকে খিচুড়ি হচ্ছে। দুপুরে এখানেই খেয়ে নিবি তোরা। বাড়িতে বলে দে ফোন করে।”

উত্তম প্রস্তাব। আমরাও বাড়িতে জানিয়ে দিলাম ফোনে। তিনি শুরু করলেন –

ঘটনাটা বছর চল্লিশ আগের। তখন আমি সিঙ্গাপুরের একটা জাহাজে ইঞ্জিন-ম্যানের কাজ করি। আসলে পৃথিবী দেখার ভূত মাথায় চেপে বসেছিল। কোনও কাজ বা টাকাপয়সা তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সেটা ছিল মালবাহী ছোট জাহাজ। নাম ‘বেরুন-তং’। ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় এর মানে ‘ভাগ্যবান’। জাভা, সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সের বিভিন্ন ছোট বড়ো দ্বীপে মাল দেওয়া নেওয়া হত। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে জাভা সাগর পর্যন্ত আমাদের যাতায়াত ছিল। একবার ইন্দোনেশিয়ার মাকাসার থেকে মাল ভর্তি করে সিঙ্গাপুর ফিরছিলাম। রাত্রিবেলা মাঝপথে সামুদ্রিক ঝড় উঠল প্রচণ্ড। এরকম ঝড়ের অভিজ্ঞতা আমার আগেও বহুবার হয়েছে। তেমন ভাবনার কিছু নয়। শুধু গা গুলিয়ে বমি হওয়ার ভয়। সমুদ্রের জল ঝপাস ঝপাস করে ডেকের উপর উঠে আসছে। জাহাজ ঢুকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে সমুদ্রের পেটের ভেতরে, আবার উঠে আসছে উপরে। এই চলল প্রায় তিন-চারঘণ্টা ধরে।

হঠাৎ ডেকের ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, “সমুদ্রের মধ্যে কিছু একটা ভাসছে।” সার্চ লাইট ফেলা হল সেদিকে। ঢেউয়ের মধ্যে একটা লোক টিউব বাঁধা অবস্থায় ডুবছে আর উঠছে। আমি আর বুরান কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে দৌড়ে গেলাম। ডেক থেকে একটা মোটা কাছি ছুঁড়ে দিলাম লোকটার দিকে। জাহাজ যে হারে ঝটকা দিচ্ছে, কোমরে দড়ি বাঁধা না থাকলে আমরাই ছিটকে চলে যেতাম সমুদ্রে। যাই হোক, লোকটাকে টেনে তোলা হল অনেক কষ্টে। ধরাধরি করে কেবিনে নিয়ে এসে শোয়ানো হল। আলোর নিচে ভালো করে লক্ষ করলাম, শীর্ণকায় লোকটার বড়ো বড়ো সোনালী রঙের চুল, দাড়ি। তার রোদে পোড়া সাদা চামড়া দেখে বোঝা যাচ্ছিল এ খাঁটি ইউরোপিয়ান। বয়েস চল্লিশের আশেপাশে হবে। সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। হার্টবিট চলছে এটাই আশার কথা। বুরান তার মুখ ফাঁক করে অল্প অল্প করে ব্রান্ডি খাইয়ে দিল। গা, হাত-পা মুছে ভিজে পোশাক পালটে দিতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ধাতস্থ হল সে।আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করল, “উনডি স্টো? উনডি স্টো?”

আমরা সে ভাষা কিছুই বুঝলাম না। শেষে বুরান গিয়ে ক্যাপ্টেনকে ডেকে নিয়ে এল। তিনি অনেকগুলো দেশের ভাষা জানেন। শুনে বললেন, “মনে হচ্ছে পর্তুগিজ। ও কোথায় আছে জানতে চাইছে।”

আমি পর্তুগিজ ভাষা তো জানতাম না। তবে স্প্যানিশ শিখেছিলাম কিছুদিন কলেজে পড়ার সময়ে। সেই ভাষাতেই বললাম, “উস তেরেস তায় নুনো বেহা।” মানে তুমি একটা জাহাজে আছ। কথাটা শুনেই লোকটার চোখদু’টো চকচক করে উঠল। বুঝলাম ও স্প্যানিশ জানে। নাম বলল ‘আরমান্দো কাভালিরো’। বেচারার খিদে পেয়েছিল খুব। রেড মিট আর ওয়াইন এনে দিতে পেট ভরে খেয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুম দিল। আমরাও আর বেশি বিরক্ত করলাম না সেদিন।

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে ডেকে এসে বলল, “বোয়েনোস দিয়াস!”

আমি গরম কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললাম “সুপ্রভাত!”

সে স্প্যানিশ ভাষায় জানাল, “আমি ইংরাজিটা খুব ভালো জানি না। তুমি কি আমার সাথে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারবে?”

বললাম, “স্বচ্ছন্দে!”

“বেশ! তাহলে এখন বল, আমরা কোথায় যাচ্ছি।”

“সিঙ্গাপুর।”

“বাহ! ওখানে নিশ্চয়ই পর্তুগালের দূতাবাস পেয়ে যাব। আসলে আমার পাসপোর্ট, টাকাপয়সা সব জলে চলে গেছে। বাড়িতে যোগাযোগ করতে পারলে ওরা কিছু টাকা পাঠাবে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে হল এটা? তুমি কোথায় এসেছিলে এদিকে?”

প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেল সে। মনে হল কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে। চারিদিকে তখন ঝকঝকে রোদ। আকাশের সাথে সমুদ্র মিশে গেছে দিগন্তে। মৃদু ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে ‘বেরুন-তং’। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমরা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি সব বলব। তবে আমাকে কিছুটা সময় দাও। আগে সিঙ্গাপুর পৌঁছই।”

এরপর আরমান্দোকে আমি আর কোনও প্রশ্ন করিনি।

সিঙ্গাপুর পৌঁছনোর পর মাস ছয়েক কেটে গেছে। মাঝে আরও অনেকগুলো দিন কেটেছে জলে ঘুরে ঘুরে। দু’দিন হল বাসায় ফিরেছি। শিফট এখন ক’দিন বন্ধ। আরমান্দোকে তখন প্রায় ভুলতেই বসেছি। তা হঠাৎ একদিন চলে এল আস্তানায়। দেখি, চুলদাড়ি সব ছোট করে কেটেছে। পরনে নতুন পোশাক। বেশ স্মার্ট লাগছে দেখতে। খেয়াল হল জাহাজ থেকে নামার সময়ে আমার কোয়ার্টারের ঠিকানাটা নিয়ে রেখে ছিল সে। বলল, “বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম।চলো একটা ভালো হোটেলে আজ খাওয়াব তোমাকে।”

ইস্ট কোস্ট পার্কের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল আমাকে। কথা বলে বুঝলাম, সে কোনও সাধারণ বাড়ির ছেলে নয়। যাকে বলে পর্তুগিজ ব্লু ব্লাড। পুরুষানুক্রমে অগাধ সম্পত্তির মালিক। ওর পূর্বপুরুষ নাকি নাইট ছিল। অদ্ভুত একটা গল্প শোনাল সে। যার ফলে আগামী কয়েকমাসের জন্য আমার জীবনের গতিপথ পালটে গেল অদ্ভুতভাবে।

আরমান্দো জানাল, “আটল্যান্টিক মহাসাগরের তীরে পর্তুগালের ‘ভাগোস’-এ আমাদের একটা চারশো বছরের পুরানো ক্যাসেল আছে। বছর পাঁচেক আগে ক্যাসেলের নিচে চোরা কুঠুরি থেকে একটা পুরনো ডায়েরি আর ম্যাপ খুঁজে পেয়েছিলাম। জিনিসগুলো যাঁর ছিল তিনি আমার পূর্বপুরুষ, নাম ফিদালগো কাভালিরো। আঠারোশ শতকের শেষের দিকে তিনি পর্তুগালের নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে ক্যাপ্টেন হয়ে ছিলেন। নৌবহর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। জলদস্যুদের সাথেও যুদ্ধ করেছেন বহুবার। একবার বোর্ণিওর পূর্বপ্রান্তে মাকাসার প্রণালীতে একদল ফিলিপিন্সের জলদস্যুদের জাহাজকে কামানের গোলার মুখে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেইসব জলদস্যুদের ভাঙা জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া লোকেদের আবার কুলি মজুরের কাজে লাগানো হত। সেরকমই একজনের কাছ থেকে উদ্ধার হয় একটা কাপড়ে আঁকা ম্যাপ। তাঁর ডায়েরি পড়ে জানতে পারি যে এটা কোনও সাধারণ ম্যাপ নয়। ওরোসাম্বাদের মন্দিরে যাওয়ার ম্যাপ।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওরোসাম্বা কারা?”

আরমান্দো বলল, “এরা ছিল একটা পাহাড়ি উপজাতি। আল্পসের গুহার ভেতরে মাটির নিচে এরা বাস করত। খ্রিস্টপূর্ব তিনশো শতাব্দীতে ইউরোপে ‘লিউকট্রার’ যুদ্ধে গ্রীক স্পার্টানরা পরাজিত হয়েছিল ‘বোয়িওটিয়ান’ আর ‘থিবান’দের কাছে। যুদ্ধবাজ স্পার্টানদের হারাতে সম্রাট ‘ইপামিনোনডাস’ তাঁর সৈন্যবাহিনীতে যোগ করে ছিলেন ‘ওরোসাম্বা’দের। ভয়ঙ্কর নৃশংস আর শক্তিশালী গুহামানব। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদেরকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে বলেন এরা পৃথিবীর প্রাণী নয়। কারণ, তাদের আকৃতি অনেকটা মানুষের মত হলেও হাতের সংখ্যা ছিল চার।”

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতে সে বলল, “ইউরোপের একটা উপকথায় ওরোসাম্বাদের বিবরণ আছে। আর অনেক উপকথার মতো এতেও কিছু সত্যতা ছিল। এই গল্পের আনুমানিক সময় চারশো থেকে পাঁচশো খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি। ‘ফ্রাঙ্কিস কিংডম’ বা ‘ফ্রান্সিয়া’র সম্রাট প্রথম ক্লভিসের রাজধানী ছিল ‘তুরনাই’। বর্তমানে সেটা বেলজিয়ামের একটা শহর। ফ্রান্সিয়া ‘সোইসন্স’-এর যুদ্ধে রোমানদের পরাজিত করার পর ক্লভিসের এক পুত্র ব্লোথার একদিন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তাঁর পছন্দের জঙ্গল হল আল্পসের পশ্চিমে ‘লিমান’ লেকের পাশে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। লেকের পাশে শিকারের তাঁবু ফেলা হয়েছিল। তখনকার দিনের শিকারের অস্ত্র ছিল তীরধনুক আর বর্শা। বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার ছিল খুব গর্বের বিষয়। তবে রাজপুত্র ব্লোথারের পছন্দ ছিল ঝাঁকড়া শিংওলা সোনালী বলগা হরিণ। ঘোড়ায় করে দলবল নিয়ে বেরিয়েছিলেন হরিণের খোঁজে। বর্শা দিয়ে হরিণ শিকার করা ছিল সিংহ মারার থেকেও অনেক কঠিন কাজ। দূর থেকে বুঝতে পারলেই ওরা তীরবেগে পালায়। আর দূর থেকে বর্শার নিশানা ঠিক রাখাও মুশকিল। বেশ কয়েকবার চেষ্টাও করলেন সকলে মিলে। কিন্তু প্রতিবারই বর্শার নাগাল থেকে তারা পালিয়ে যায়। এমনি করে বেশ কিছুদিন বৃথা পরিশ্রম হল। একদিন ব্লোথার ঠিক করলেন, তিনি একা যাবেন শিকারে। সঙ্গে লোকজন থাকলে আরও দ্রুত সতর্ক হয়ে যাচ্ছে হরিণগুলো। সেইমতো ভোর ভোর উঠে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়লেন আল্পসের দিকে। পাহাড়ের শানুদেশে এসে ঘাসের জমিটা পেরিয়ে ঘোড়াটাকে বেঁধে দিলেন একটা গাছের সাথে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণায় একপাল হরিণ জল খাচ্ছিল। চুপিসাড়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। কিন্তু বর্শা ছোঁড়ার আগেই কীভাবে বুঝতে পেরে গেল হরিণগুলো। তারা ছুটতে শুরু করল। ব্লোথারও ছুটতে শুরু করলেন পেছন পেছন। হঠাৎ লক্ষ করলেন উলটোদিক থেকে কয়েকটা বর্শা উড়ে এসে অব্যর্থ নিশানায় পর পর তিনটে হরিণকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। চমকে উঠে একটা পাথরের পেছনে আশ্রয় নিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গল ফুঁড়ে পাহাড় থেকে নেমে এল তিনটে প্রাণী। তামাটে গায়ের রং। বড়ো বড়ো চোখ, দু’পায়ে হাঁটছে, কিন্তু হাতের সংখ্যা চার। চেহারা আর মাংসপেশির আকৃতি দেখে বোঝা যায় মানুষের থেকে তারা অনেক শক্তিশালী। হরিণগুলোকে কাঁধে ফেলে তারা হেলতে দুলতে চলে গেল গুহার দিকে। রাজকুমার ব্লোথার ভাবলেন, এই প্রাণীগুলোকে জীবিত বা মৃত রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারলে তাঁর শৌর্য আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে। তিনি তাঁবুতে ফিরে গিয়ে সঙ্গীদের বললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। তারপর একদিন লোকজন নিয়ে গিয়ে সেই গুহার কাছে বসে রইলেন ওত পেতে। কিন্তু বেশ কিছুদিন বসে থাকার পরেও প্রাণীগুলোর দেখা পাওয়া গেল না। তখন তিনি ভাবলেন গুহার মধ্যেই ঢুকে দেখা যাক।

“ব্লোথার সমেত যারা ঢুকেছিল সেই গুহায় তাদের কেউ জীবিত ফেরেনি। তিনদিন পর সবার কাটা মুণ্ডু গুহার বাইরে তাদেরই বর্শার মাথায় গেঁথে মাটিতে পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল প্রাণীগুলো। রাঁধুনি শুধু প্রাণ নিয়ে ফিরেছিল সেখান থেকে। সম্রাট ক্লভিস সব শুনে সেনাপতি মারকুরালকে দায়িত্ব দিলেন ওরোসাম্বাদের খতম করার জন্য। বিশাল সৈন্যবাহিনী রওনা হল। প্রথমে দশজন, তারপর কুড়িজন, এরকমভাবে যত সৈন্য গুহায় প্রবেশ করল, ফিরে এল না কেউ। শেষে গুহার ভেতর ভয়ে কোনও সৈন্য প্রবেশ করতে চাইল না। আর বহু প্রতীক্ষার পরেও গুহার বাইরে বের হল না ওরোসাম্বারা। শেষে সম্রাটের নির্দেশে গুহার মুখে লোহা গলিয়ে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। তারপর এঁটে দেওয়া হল বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে। এরপর থেকে ইউরোপে ওদের আর কেউ কোনওদিন দেখেনি।”

“তারপর?” আমরা তিনজনে একসাথে প্রশ্ন করলাম। উত্তেজনার পারদ তখন চড়তে শুরু করেছে।

অরুণদাদু আমাদের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে আবার শুরু করলেন –

আরমান্দো বলল, “ফিলিপিন্সের সেই জলদস্যুদের সর্দার ফিদালগো কাভালিরোকে বলেছিল বোর্ণিওর ঘন জঙ্গলের মধ্যে কালিমান্থানের কাছে দুর্গম পাহাড়ের গুহায় একটা মন্দির আছে। সেখানে পাথরের দেয়ালে চার হাত বিশিষ্ট অসুরদের মূর্তি রয়েছে। জলদস্যুদের সর্দার দলবল নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। আর তিনি ছাড়া কেউ ফিরে আসতে পারেননি। তিনি নিজেই বানিয়েছিলেন এই ম্যাপ। এরপর উনিশশো শতকের গোড়ায় সেই ম্যাপের সাহায্যে ফিদালগো কাভালিরো বোর্ণিওর জঙ্গলে অভিযান করেছিলেন। কিন্তু বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে আর ম্যালেরিয়ার প্রকোপে তাঁর দলের বেশিরভাগ লোক মারা যায়। তিনি যদিও অনেক কষ্টে পৌঁছেছিলেন ওরোসাম্বাদের মন্দিরে। খোঁজ পেয়েছিলেন বিশাল গুপ্তধনের। তবে উদ্ধার করতে পারেননি। ওরোসাম্বাদের ভগবান জেনুমরিসের মূর্তির নিচে ছিল খনিজ হিরের স্তূপ। নমুনা স্বরূপ তুলে এনেছিলেন দু’এক টুকরো। সেটা আমি পেয়েছিলাম ঐ ডায়েরির সাথে। ওরা হয়ত ইউরোপ ছেড়ে তুর্কি, পার্সিয়া, হিন্দুকুশ পর্বত, তিব্বত, হিমালয় পেরিয়ে সিয়াম প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চল টপকে সমুদ্রপথে বোর্ণিওয় এসে পৌঁছেছিল। ফিদালগো কাভালিরো ভেবেছিলেন, একবার যখন গুপ্তধনের ঠিকানা পাওয়া গেছে তখন পরে আবার লোকলস্কর নিয়ে নতুন উদ্যমে আসা যাবে। কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর দেশে ফিরে তিনি শয্যা নিলেন। আসলে তখনই তাঁর বয়স হয়েছিল সত্তরের উপরে। আর বিষাক্ত অর্কিডের রস লেগে তৈরি হওয়া ঘা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শরীরে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। ওরোসাম্বাদের শেষ বংশধর মন্দিরের রক্ষী তখনও নাকি বেঁচেছিল। অনেক কষ্ট করে একটা গুহার মধ্যে দিয়ে পৌঁছেছিলেন সেখানে। মন্দিরের বাইরে গাছপালা কেটে একটা ফাঁকা জায়গায় তাঁরা তাঁবু ফেলেছিলেন। একটা বড়ো পাহাড়ের ভেতরে আছে ওরোসাম্বাদের মন্দির। তার সাথে আরও পাঁচজন ছিল। দু’জন পর্তুগিজ আর তিনজন স্থানীয় কুলি। সেখানে যেদিন প্রথম জেনুমরিসের মূর্তিটা দেখতে পেয়েছিলেন, আর বিশেষ ধরনের এক চাবির সাহায্যে সিন্দুক খুলে ঐ হিরের টুকরোগুলো সংগ্রহ করেছিলেন, সেদিন রাতে পাঁচজন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখেন গুহার মুখে পাঁচটা বর্শার মাথায় পাঁচজনের কাটা মুণ্ডু গেঁথে রেখে গেছে কেউ। ভয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান ত্যাগ করেন।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরমান্দো আবার বলল, “ঐ ডায়েরি আর ম্যাপ পাওয়ার পর আমি ঠিক করি বোর্ণিওর জঙ্গলে যাব। কাভালিরো বংশের বাউণ্ডুলে রক্ত বইছে শরীরে। সেইমতো আমি প্রথমে সিঙ্গাপুর এসে পৌঁছই। তারপর এখান থেকে যাই জাহাজে পশ্চিম কালিমান্থানের বন্দর শহর ‘পন্টিয়ানাক’। সেখানে স্থানীয় এক গাইডকে পেলাম। নাম সোরেন মাঙ্গো। ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ বলতে পারে। ও নাকি ছোটবেলায় এক ফরাসী সাহেবের কাছে পড়াশোনা শিখেছিল। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তবে তার কালো পেটানো শরীর দেখলে বয়েস আন্দাজ করা মুশকিল।

“অক্ষাংশ ১ ডিগ্রী ১৫ মিনিট উত্তর, আর দ্রাঘিমাংশ ১১৩ ডিগ্রী ৫৮ মিনিট পূর্ব। ডায়রিতে আনুমানিক এই হিসেব দিয়েছিলেন জায়গাটার। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মাপার জন্য নিজস্ব একটা ‘সেক্সট্যান্ট’ যন্ত্র ছিল ফিদালগোর। যাই হোক, জায়গাটা পন্টিয়ানাক থেকে প্রায় ৬৮০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কালিমান্থানের দুর্গম পাহাড়ের মধ্যে বোর্ণিওর ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের ঠিক মাঝামাঝি। সোরেন বলল, প্রথমে ‘পুটুসিবাউ’ পৌঁছতে হবে। এই রাস্তা পর্যন্ত প্রথম চারশো কিলোমিটার গাড়ি করে যাওয়া যাবে। তারপর ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে। ‘পুটুসিবাউ’ থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটাপথে বোর্ণিওর সবথেকে বড়ো নদী ‘কাপুয়াস’-এর উৎসস্থল হল আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য। এই নদীটা প্রায় ৭১০ মাইল লম্বা। আর এর তীরেই ‘পুটুসিবাউ’ হল শেষ জনপদ। আমাদের যাত্রাপথে ‘নাগা সিলেট’ থেকে ঘোড়া নেওয়া হল। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচদিন লাগল ‘পুটুসিবাউ’ পৌঁছাতে। সেখানে খোঁজ করে জানা গেল একমাত্র ‘ডায়াক’ আদিবাসীরাই জঙ্গলের রাস্তা জানে। সোরেন আমাকে ডায়াকদের গ্রামে নিয়ে গেল। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট কুঁড়েঘর। গোটা পঞ্চাশেক পরিবারের বাস। মাথায় পাখির পালক গোঁজা, হাতে, গলায়, পায়ে বিভিন্ন প্রাণীর হাড়ের তাবিজ কবজ বাঁধা বন্য প্রজাতির মানুষ এরা। এই ধরনের জনগোষ্ঠীগুলো তাদের সর্দারের কথাতেই ওঠে বসে। সেজন্য সর্দারের জন্য আমি কিছু শহুরে উপঢৌকন নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর সামনে রেখে বললাম, আমি অনেক দূরদেশ থেকে আসছি। কালিমান্থানে যাব কিছু ঔষধি গাছের খোঁজে। এমন কয়েকজন সাথী চাই যারা জঙ্গলের রাস্তা চেনে। ইচ্ছে করেই আসল উদ্দেশ্য আমি জানাইনি। সোরেনকেও এই কথাই বলেছিলাম। সর্দার আমার দেওয়া বিদেশী স্কচটা পেয়ে খুব খুশি হলেন। পাঁচজন জোয়ান ছেলেকে দিলেন আমার সাথে। শুরু হল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে পথ চলা। চৌদ্দ কোটি বছরের পুরনো বোর্ণিওর এই বিচিত্র বিষুবীয় জঙ্গলকে যে না নিজের চোখে দেখেছে, তাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয় এর সৌন্দর্য। আর তেমনই ভয়ংকর পরিবেশ। পনেরো হাজার প্রজাতির গুল্মফুলের গাছ, প্রায় তিনহাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, দুশো কুড়ি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, চারশো কুড়ি প্রজাতির পাখি। এরা সবাই শান্ত নিরীহ প্রকৃতির, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এখানে এমন অনেক পোকামাকড় আছে, যার বিষাক্ত কামড়ে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। ফিদালগো কাভালিরোর বহু সঙ্গীসাথী কীভাবে মারা গিয়েছিল সেটা ডায়েরিতে পড়েছিলাম। যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ করার ওষুধপত্র ইউরোপ থেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। বিষুবরেখার উপর অবস্থানের জন্য এখানে প্রায় সারাবছরই বৃষ্টি হয়। এত ঘন সবুজ বন পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে।”

এই পর্যন্ত বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আরমান্দো। চোখ বন্ধ করে মনে হল গভীর চিন্তায় মগ্ন। আমিও কিছুটা চুপ থেকে তার গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল?”

সে চোখটা খুলল। রক্তপলাশের মতো লাল তার চোখ। আবার প্রশ্ন করলাম, “কী হয়েছে তোমার? চোখ অমন লাল কেন?”

“কালিমান্থানের দুর্ভেদ্য জঙ্গলে একটা বিষাক্ত অর্কিডের বনে ঢুকে পড়েছিলাম। জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম এক গাছের গোড়ায়। সোরেন না থাকলে হয়তো প্রাণে বাঁচতাম না। সেদিন কাপুয়াস নদীর উৎস থেকে কিছুটা দূরে আমাদের তাঁবু ফেলা হয়েছিল দিনের আলো থাকতে থাকতে। তখন প্রায় মাসখানেক হয়ে গেছে ঘুরছি আমরা। একটা সুড়ঙ্গ খুঁজছিলাম। এতদিনে সোরেনও মনে হয় বুঝে গিয়েছিল যে আমি কোনও ঔষধি গাছের খোঁজে আসিনি। এসেছি অন্য কোনও গোপন দরকারে। মাঝে মাঝে আমি ব্যাগ থেকে একটা পুরনো কাপড়ের ম্যাপ বের করে কীসব হিসাবনিকাশ করি, সেটা লক্ষ করেছে ও। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেনি যদিও কোনওদিন। ম্যাপে পাহাড়ের মধ্যে একটা তারাচিহ্ন দেওয়া আছে। আর ডায়েরিতে উল্লেখ আছে যে ওখানে একটা জলের উৎসের মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গ চলে গেছে প্রায় চার কিলোমিটার। উলটোদিকের মুখটা যেখানে বেরিয়েছে সেখানেই ওরোসাম্বাদের মন্দির। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম কাপুয়াস নদীর উৎস মুখটাই হয়তো সেই সুড়ঙ্গ। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই মুখ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার কোনও রাস্তা পেলাম না। তারপর কাছাকাছি ছোট বড়ো যত ঝর্ণা আর জলের উৎস আছে সবক’টা তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করলাম। মুশকিল হচ্ছে বোর্ণিওর জঙ্গলে এত বৃষ্টি হয় যে ছোটখাটো জলের উৎস অগুনতি। এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে ডায়াক কুলিরা কাঠকুটো কেটে রান্নার তোড়জোড় শুরু করল। মাংসের জোগান দেওয়ার জন্য অসংখ্য ওরাংওটাং আছে জঙ্গলে। ঠ্যাংগুলো ছাল ছাড়িয়ে আগুনে সেঁকে খেতে খারাপ লাগে না। আর সবথেকে বড়ো কথা প্রতিটা গাছের ডালেই ওদের খুঁজে পাওয়া যায়। আর আছে লম্বা নাকওয়ালা হালকা বাদামী রঙের বাঁদর। ভারী অদ্ভুত দেখতে এদের। উঁচু গাছের একডাল থেকে অন্য ডালে লাফ দিয়ে প্রায় উড়ে বেড়ায়। ডায়াকরা এদের ‘বিকান্তান’ বলে ডাকে। এছাড়া ধূসর রঙের ‘গিবন’ আর বাদামী ‘স্লো লরিস’ও চোখে পড়ে মাঝে মাঝে। তবে এরা সংখ্যায় কম। আমি প্রথম প্রথম রাইফেলের গুলি খরচ করতাম এদের মারার জন্য। কিন্তু সোরেনের বর্শার অব্যর্থ নিশানায় নিঃশব্দে শিকার করা দেখে ওকেই দায়িত্ব দিয়েছি ঐ কাজের। ডায়াকরাও এই ব্যাপারে বেশ পটু। একধরনের ব্লো পাইপ ব্যাবহার করে ওরা শিকারের জন্য। সরু বাঁশের ফাঁপা টুকরোর মধ্যে পালকের ডগায় বিষাক্ত অর্কিডের রস মাখিয়ে জোরে ফুঁ দিলে সেটা গিয়ে শিকারের গায়ে বিঁধে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত মৃত্যু। তবে আমি ঐ বিষে মরা প্রাণী খাওয়া পছন্দ করি না। সেদিনও একটা ওরাংওটাং শিকারের পর সোরেনকে বললাম, খাবার তৈরি কর, আমি ঘুরে আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে বনের মধ্যে একটা ছোট জলাশয় পড়ল। বনবাদাড় ঠেলে তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম। এইরকম ঘন জঙ্গলে ঘোরার নিয়ম হচ্ছে, ছুরি দিয়ে কিছুটা ছাড়া ছাড়া গাছের গায়ে চিহ্ন করে যাওয়া। আর অতি অবশ্যই কম্পাস সঙ্গে রাখা। না হলে প্রতিমুহূর্তে রাস্তা হারিয়ে ফেলার প্রবল সম্ভাবনা। পথে ঝোপের মধ্যে জলাজমিতে চোখে পড়ল লালচে খয়েরি রঙের রাক্ষুসে ফুল, ‘রাফ্লেসিয়া আরনল্ডি’। পাঁচটা বিশাল বিশাল পাপড়ি সমেত প্রায় একমিটার ব্যাস। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো ফুল এরা। সেগুলো পেরিয়ে জলাশয়ের পূর্বপ্রান্তে সেগুনগাছের জঙ্গল। একটা খুব বড়ো লম্বা আর মোটা সেগুনগাছের পেছনে পাহাড়ের ধাপে গুল্ম লতাপাতায় ঢাকা একটা গুহার মুখ চোখে পড়ল আচমকা। আসলে ঝোপের মধ্যে বোর্ণিওর বিখ্যাত খুদে কাঠবেড়ালির একটা দল চোখে পড়তে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। হাতের তালুর মধ্যে বাদাম রেখে অনেক সময়ে এদের খাবার খাওয়াতাম।বেশ মজার দেখতে এদের। যাই হোক, ওরাই আমার দৃষ্টিটা প্রথম আকর্ষণ করল গুহার মুখের দিকে। আর একটু এগিয়ে টর্চ মেরে দেখলাম ভেতরটা পুরো অন্ধকার। ফিরে গিয়ে আবার সোরেনকে ডেকে আনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। কিন্তু উত্তেজনায় মস্তিষ্কবিভ্রম হয়েছিল হয়তো। একাই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। হিংস্র প্রাণী বলতে এ জঙ্গলে ‘ক্লাউডেড লেপার্ড’ আছে। দেখতে অনেকটা বেড়ালের মতো হলেও আকারে বেশ বড়ো। গায়ে পাথরের মতো ছাপ দেওয়া। দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করলে বিপজ্জনক হতে পারে। তবে এতদিনে সেরকম ঘটনা একবারও ঘটেনি। বড়ো বাঘ নেই, আর চিতারা রাতের অন্ধকার ছাড়া বের হয় না। সবথেকে বড়ো কথা এরা মানুষের মাংস খাওয়া কেউই পছন্দ করে না।

“গুহার মুখে সরু একটা জলের রেখা। ভেতর থেকে তিরতির করে বয়ে আসছে। চারপাশে পাথরের উপর ঘন শ্যাওলা। আমি সাবধানে তার উপর পা রেখে মাথা নিচু করে এগোলাম। টর্চের আলোয় কিছুটা দূরে একটা বাঁক দেখা যাচ্ছে। একঝাঁক নাক থ্যাবড়া বাদুড় ঝুলছে ছাদ থেকে। কালচে বাদামী রং। আমাকে দেখে সম্ভবত পছন্দ হল না তাদের। চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল উচ্চৈঃস্বরে। তারপর ডানা ঝাপটে হৈহৈ করে উড়ে গেল বাইরের দিকে। আমি ততক্ষণে মাথা নিচু করে বসে পড়েছি। ওরা চলে যেতে আবার ধীরে সুস্থে উঠে হাঁটা শুরু করলাম। সেই বাঁকটা পেরোতেই গুহাটা হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেল। আর যা দেখলাম হৃৎপিণ্ড দাঁড়িয়ে গেল গলার কাছে এসে। সামনে বসে বিশালকায় এক কালো ভাল্লুক। আমি তাকে দেখে যত না আঁতকে উঠেছি, তার থেকেও বেশি শোচনীয় মানসিক অবস্থা হয়তো তার হয়েছে। ফলে একটা প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। এবং হলও তাই। প্রথমে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে গরগর করে একটা আওয়াজ। তারপর আমার দিকে তেড়ে আসা। কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে গুলি করারও সময় নেই তখন। একটাই রাস্তা, দৌড়। কিন্তু শ্যাওলায় পা পড়ে পিছলে যাচ্ছে বারবার। একবার ও যদি আমাকে নাগালের মধ্যে পায় তাহলে তীক্ষ্ণ নখযুক্ত ভারি থাবার একটা আঁচড়ে গোটা শরীর ফালা ফালা হয়ে যাবে। কোনওরকমে গুহা থেকে বেরিয়ে পড়িমরি করে ছুট। সে দৈত্যটাও অনেকক্ষণ আমার পিছনে পাল্লা দিয়ে ছুটল। তারপর রাইফেলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করতে শেষ হল দৌড়োদৌড়ি।

“কিন্তু এই এলোপাথাড়ি ছুটতে গিয়ে ফেরার রাস্তাটা গুলিয়ে গেল। কম্পাস দেখে দিক ঠিক করব ভাবছি তখন। হঠাৎ চারপাশের পরিবেশ দেখে থমকে গেলাম। একধরনের অদ্ভুত বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুল ফুটে রয়েছে চারিদিকে। মোটা মোটা সেগুন আর শালগাছের গোড়ায়, ঘাসের মধ্যে, গাছের গুঁড়িতে। সেখানে লম্বা লম্বা বৃক্ষরাশির নিচে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। বিকালের পড়ন্ত আলো নিবু নিবু হয়ে এসেছে ততক্ষণে। অন্ধকারের মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ শ্যাওলার উপর জবাফুলের মতো বড়ো বেগুনি ফুলগুলো ফোঁস ফোঁস করে যেন নিঃশ্বাস ফেলছে। ফুলের গর্ভদণ্ডগুলো জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে আর নিভছে। কাঁপছে তিরতির করে। চোখে যেন একটা ঘোর লেগে গেল। নাকে এল কী মিষ্টি একটা গন্ধ! একটা গাছের গোড়ায় একথোকা বেগুনি ফুল। সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেলাম সেদিকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

“তিনদিন পর হুঁশ ফিরল। চেয়ে দেখি তাঁবুতে শুয়ে আছি। গায়ে ধুম জ্বর। সারা শরীর ফুলে লাল চাকা চাকা দাগ হয়েছে। মনে হল, এ একধরনের এলার্জি। ফিদালগোর ডায়েরিতে পড়েছিলাম, তাঁরও এইরকম একটা বিদঘুটে অসুখ হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। ভাবতেই ভয়ে জিভ শুকিয়ে গেল। সোরেন জানাল, সেদিন গুলির আওয়াজটা অনেকদূর থেকে শুনে তৎক্ষণাৎ দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল আমার খোঁজে। কিন্তু সারারাত জঙ্গলে ঘুরে, তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমাকে দেখতে পায়নি। পরেরদিন দুপুরে দেখতে পায় একটা ঝোপের মধ্যে থেকে শুধু জুতো সমেত পাটা বেরিয়ে ছিল। ঐ ফুলগুলোকে ডায়াকরা বলে ‘কেমাতিয়ান বুঙ্গা’ অর্থাৎ মৃত্যুর ফুল। ঐ ফুলের ধারে কাছে ওরা যায় না। আমার গায়ে ফুল হাতা জামা, মাথায় টুপি, ফুল প্যান্ট আর পায়ে লং শ্যু ছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেছি। না হলে একদিনেই ভবলীলা সাঙ্গ হত।

“টানা একমাস জ্বরে শরীর কাহিল। যেন মনে হচ্ছিল এখান থেকে আর বেঁচে ফিরব না। বেশিরভাগ সময়েই বেঘোরে ভুল বকেছি। কখনও মনে হচ্ছিল ফিদালগো আবছা অন্ধকারে আমাকে ডাকছে। সেই ভাল্লুকের গুহাটাই ম্যাপে দেখানো সুড়ঙ্গের মুখ। টর্চের আলোয় সেদিন একপলক চোখ পড়েছিল পেছনের দেয়ালে একটা বড়ো তারাচিহ্ন। ঠিক যেরকম আঁকা ছিল ম্যাপটাতে। কিন্তু আবার যে ফিরে যাব সে শক্তি নেই। শেষে সোরেন কুলিদের সাহায্যে কাঁধে করে আমাকে পুটুসিবাউ নিয়ে এল। তারপর একটা নৌকা ভাড়া করে কাপুয়াস নদী ধরে সপ্তাহখানেক ধরে ভেসে ফিরে এলাম পন্টিয়ানাকে। সেখানে দু’মাস ভর্তি রইলাম হাসপাতালে। সে যাকে বলে যমে মানুষে টানাটানি। শেষে ডাক্তাররাই জিতল। আরও কিছুদিন ঐ শহরে কাটিয়ে একটা জাহাজে করে ভেসে পড়লাম সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেদিন রাতেও দুর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়েনি। প্রবল সামুদ্রিক ঝঞ্ঝায় জাহাজটা ডুবে গেল। একটা টিউব আঁকড়ে ভেসেছিলাম জ্ঞান হারিয়ে। তোমরা আমার প্রাণ বাঁচালে।”

এই পর্যন্ত শুনে আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা, এখন কী ভাবছ? আবার যাবে সেই মন্দিরের খোঁজে?”

আরমান্দোর চোখের লালচে ভাব অনেকটা মিলিয়ে গেছে ততক্ষণে। তার চোখেমুখে ভেসে উঠল অদ্ভুত একটা হাসি। বলল, “ওরোসাম্বাদের গুহাতে যাওয়ার সেই গুহাটা খুঁজে পেয়েও বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হল। সে যে কী কষ্ট তোমাকে বোঝাতে পারব না। তাছাড়া, পুটুসিবাউ থেকে অভিযান শুরুর আগে ডায়াকদের গ্রামে এক ওঝাকে হাত দেখিয়েছিলাম আমি। সে বলেছিল, এই জঙ্গলে প্রবেশ করলে আমার পক্ষে আর বেঁচে ফেরা সম্ভব নয়।”

“সেই কথা তুমি বিশ্বাস করনি নিশ্চয়ই?”

“কে বলল বিশ্বাস করিনি? হয়তো কালিমান্থানেই আমার মৃত্যু লেখা আছে। তা সত্ত্বেও আমি আবার যাব। শুধু কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর প্রয়োজন। ধনরত্নের লোভ আমার নেই। বিয়ে-থাও করিনি। পরিবারের টানও নেই। মৃত্যু তো কতরকমভাবেই হতে পারে। তাই না? কিন্তু এই অজানাকে জানা, ভয়কে জয় করার প্রবল আকর্ষণ আমাকে আবার টেনে নিয়ে যাবে সেই জঙ্গলে। তার সুতীব্র টান আমি মনে মনে সর্বক্ষণ অনুভব করি।”

এর মাসখানেক পরে আমরা আবার সমুদ্রে ভেসে পড়লাম। সিঙ্গাপুর থেকে পন্টিয়ানাক। আরমান্দো, আমি আর আমার সহচর বুরান। এই ছেলেটি আদপে ইন্দোনেশিয়ান হলেও দু’তিনটে দেশের ভাষা জানে। বয়েস তিরিশের কিছু কম। মনে অফুরন্ত স্ফূর্তি আর মাথায় দুর্দান্ত উপস্থিত বুদ্ধি। এককথায় এরকম অভিযানের জন্য একেবারে আদর্শ।

সিঙ্গাপুর ছাড়ার আগে আমরা বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল দু’টো জবরদস্ত রাইফেল। আরমান্দোই পছন্দ করেছিল ওগুলো। উইনচেস্টার ডবল ব্যারেল ম্যাগাজিন, মডেল ‘মারলিন-৩৩৬’, এক মিটারের কাছাকাছি লম্বা, ওজন তিন কেজির সামান্য বেশি। সাড়ে চারশো মিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়।ম্যাগনাম .৪১০ বোরের বুলেট যেকোনও শক্তিশালী প্রাণীকে যমের দুয়ারে পৌঁছে দেবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এছাড়া .৪৪ ক্যালিবারের তিনটে ‘স্মিথ এণ্ড উইসন’ কোম্পানির রিভলভার, পর্যাপ্ত কার্তুজ আর তিনটে বড়ো ড্যাগার। এসব অস্ত্রগুলো দুর্গম অরণ্যে আমাদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছিল।

সিঙ্গাপুর ছাড়ার তিনদিন পরে আমাদের জাহাজ গিয়ে ভিড়ল পশ্চিম কালিমান্থানের বন্দর শহর পন্টিয়ানাকে।তোরা শুনলে অবাক হবি, এই শহরের নাম একটা ভূতের নামে। পন্টিয়ানাক হল ইন্দোনেশিয়ার একটা পেত্নী। যাকে বলে ফিমেল ঘোস্ট। এখানের স্থানীয় উপকথায় এর উল্লেখ আছে। দুর্বল হৃদয়ের ট্যুরিস্ট এখনও এ শহর এড়িয়ে চলে। মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় নাকি ঘুরে বেড়ায় চুড়েলরা। তবে আমরা যে দু’দিন ছিলাম তেমন কিছু চোখে পড়েনি। আসলে ভূতপ্রেতেরাও লোক বুঝে দেখা দেয় কিনা। যাই হোক, এখানে পৌঁছে আমরা প্রথম আশাহত হলাম। যখন শুনলাম সোরেন নিরুদ্দেশ। শেষে ঠিক করলাম পুটুসিবাউ পর্যন্ত রাস্তা তো আরমান্দোর মোটামুটি জানা, অতএব পরেরদিন বেরিয়ে পড়াই ঠিক হল।

রাস্তার অবস্থা প্রথমের দিকে ভালো হলেও শেষের দিকে খুবই খারাপ। পুটুসিবাউ পৌঁছাতে সাড়ে চারদিন লাগল। খুব সুন্দর ছবির মতো একটা জনপদ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কাপুয়াস নদী। রাতটা আমরা একটা গেস্ট হাউসে কাটিয়ে পরেরদিন ঘোড়ায় করে বেরোলাম সেই ডায়াক আদিবাসীদের গ্রামে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পাহাড়ের কোলে শান্ত নিরিবিলি এলাকা। সর্দার আরমান্দোকে দেখেই চিনতে পারলেন। এবারে ওনার জন্য আরও দামী কিছু উপঢৌকন কেনা হয়েছিল সিঙ্গাপুর থেকে। সেগুলো তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। কিন্তু আরমান্দোকে জীবিত দেখে গ্রামের সেই বৃদ্ধ গুণিন বললেন, তাঁর ভবিষ্যৎবাণী নাকি আজ পর্যন্ত বিফল হয়নি। মৃত্যুকে যদি কেউ ধোঁকা দেয় তার পরিণতি নাকি সাংঘাতিক হতে পারে। আমরা তাঁর কথায় বেশি গুরুত্ব দিইনি। অবশ্য দিলে কয়েকটা তাজা প্রাণ হয়তো বেঁচে যেত।

যে ডায়াক ছেলেগুলো আগেরবার গিয়েছিল তারা এই গুণিনের কথা শুনে বেঁকে বসল। কিন্তু আমরা তো যাবই। আরমান্দো ওদের পারিশ্রমিক তিনগুণ বাড়িয়ে দিল। তাতে ফল হল চমৎকার। পাঁচজনের জায়গায় কুড়িজন ছেলে রাজি হয়ে গেল যেতে। আমরা পুরনো দু’জনকে রেখে নতুন তিনজনকে সঙ্গে নিলাম। সেই রাতে গ্রামের দু’শো জন লোকের ভুরিভোজ, ফূর্তির পয়সাও আরমান্দো দিল। গোল করে আগুন জ্বেলে বাজনার তালে তাদের সাথে নাচে আমরাও যোগ দিলাম।

পরেরদিন ভোর থাকতে বেরিয়ে কাপুয়াস নদীর ধার দিয়ে হাঁটা শুরু হল। দেখলাম পাখিরাও বেরিয়ে পড়েছে খাবারের খোঁজে। ডালপালার আড়ালে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে বাদামী রঙের ওরাংওটাং। গুলি গুলি চোখ করে দূর থেকে দেখেই পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এরা দলবদ্ধভাবেই ঘোরাফেরা করে। শরীরটাকে দুলিয়ে অদ্ভুতভাবে ছুঁড়ে দেয় একডাল থেকে অন্য ডালে। যত এগোচ্ছি ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছে চারপাশের জঙ্গল। তোদের জেনে রাখার জন্য কিছু তথ্য বলে দিই, বোর্ণিওর এই ট্রপিক্যাল রেন ফরেস্টের মোট আয়তন প্রায় চার লাখ কুড়ি হাজার বর্গ কিলোমিটার। কত রকমের যে গাছ আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। বনের মধ্যে একধরনের খুব লম্বা গাছ দেখিয়ে আরমান্দো বলল, “এর নাম আয়রনম্যান ট্রি বা বোর্ণিও’স আয়রন ট্রি। এই গাছগুলো প্রায় হাজার বছর বাঁচে। খুব ধীরে ধীরে বাড়ে বলে এদের ঘনত্ব অন্য গাছের তুলনায় অনেক বেশি আর লোহার মতো শক্ত।”

ঘন জঙ্গলে আর এক ধরনের ছোট ছোট গাছ দেখা গেল। ডায়াক কুলিদের দলপতি কুবা জানাল, এর স্থানীয় নাম ‘টংকট আলি’, একধরনের ওষুধ তৈরি হয় এটা দিয়ে। এর চাহিদা সারা পৃথিবী জুড়ে। চলতে চলতে বুরান একটা গাছের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগিয়ে গিয়ে দেখি বিশাল বড়ো আর মোটা একটা গাছ, অনেকটা বট বা অশ্বত্থের মতো দেখতে। কিন্তু গাছের মাঝখানটা পুরো ফাঁকা। চারপাশে পা ছড়িয়ে আইফেল টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে আছে। আরমান্দো জানাল, “এর নাম ‘স্ট্রাংলিং ফিগ’ বা ‘কিলার ট্রি’।”

জিজ্ঞেস করলাম, “এর মাঝের জায়গাটা এরকম ফাঁকা হল কী করে?”

কুবা বলল, “এই গাছগুলো আসলে পরজীবী। কোনও পাখি বহুবছর আগে গাছের খাঁজে হয়তো এই ‘স্ট্রাংলিং ফিগ’-এর দানা পটি করে ফেলেছিল। পরে আসল গাছটাকে মেরে এই পরজীবী গাছটাই জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর আগের গাছটা মরে গিয়ে মাটিতে মিশে গেছে। সেই জায়গাটা পুরো ফাঁকা।”

আমাদের অনুবাদকের কাজটা বুরান ভালোই করছে। দেখলাম ও ডায়াক ভাষাও মোটামুটি বলতে পারে। পাহাড়ের ঢালে নামতে নামতে উপর থেকে বনের মধ্যে আরেকটা গাছ চোখে পড়ল। সব গাছ ছাড়িয়ে সাদা কাণ্ড উঠে গেছে অনেক উপরে। মেঘের কোলে গিয়ে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাই দূর থেকে চোখে পড়ছে। কুবা চেনাল, “মধুমক্ষী গাছ।”

আরমান্দো বলল, “এদের ভাল নাম ‘মেনগারিস।’ এক একটা ষাট থেকে নব্বই মিটার লম্বা হয়। বোর্ণিওর সবচেয়ে লম্বা গাছেদের মধ্যে একটা। এর উঁচু ডালে বনের যত মধুমক্ষী এসে বাসা বানায়, যাতে ভাল্লুকগুলো মধুর নাগাল না পায়।”

এ জঙ্গলে সবথেকে দামী গাছ হল ‘পারফিউম ট্রি’, স্থানীয় ভাষায় এদের বলে ‘গাহারু’। এখনকার বাজারদর অনুযায়ী প্রায় দশ হাজার টাকা প্রতি কেজি। সুপারি বা পামগাছের মতো মোটা, সাদা রঙের। এছাড়া নদীর ধারে ধারে সুন্দরবনের মতো ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্য, পামতেলের গাছ, দারুচিনি, লবঙ্গ থেকে শুরু করে বহুরকম মশলার গাছ ভর্তি। শাল, সেগুনগাছের জঙ্গল আছে মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গায়ে। আছে আরও কত রকমের নাম না জানা অর্কিডের রঙিন ফুল।

প্রথমদিনের শেষে আমরা পাহাড়ের ঢালে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে তাঁবু ফেললাম। এখানের বেশিরভাগ মাটিই খুব স্যাঁতস্যাঁতে হয় বলে মাটি থেকে কিছুটা উপরে একটা মাচা করে তার উপর তাঁবু খাটাতে হয়। কিছুটা দূরেই ছিল ‘পেট্রোলিয়াম ট্রি’-এর একটা বন। সাত-আট মিটার করে লম্বা গাছগুলোর ডালে সবুজ আমড়ার মতো থোকা থোকা ফল ঝুলছে। আমাদের কুলিগুলো দিব্যি সেই ফল পেড়ে চেপে চেপে তেল বের করে মাটির প্রদীপে করে জ্বালিয়ে দিল। অনেকটা রেড়ির তেলের মতো।

সন্ধ্যার পর ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে জোনাকির মিটমিট করা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে সময় কেটে যায়। ক্যাম্প চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দিলাম। এ জঙ্গলের মশা খুব সাংঘাতিক। হাতে পায়ে মলম মেখেও নিস্তার নেই। কানের কাছে ক্রমাগত বোঁ বোঁ আওয়াজ। শেষে কুবা কী একটা জংলি পাতা নিয়ে এসে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল। প্রচুর ঝাঁঝালো ধোঁয়া গল গল করে বেরিয়ে এলাকা ছেয়ে ফেলল। ফলে মশার উপদ্রব কমল কিছুটা। এদিকে অস্বস্তিকর একটা গুমোট করে আছে। একটুও হাওয়া নেই গাছের পাতায়। চপচপে ঘামে পোশাক জড়িয়ে ধরেছে।

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের হাঁটার ধকলে চোখে ঘুম এঁটে ধরেছে।বাইরে আকাশ ডেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ঝমঝমিয়ে। আবহাওয়াটা অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ভোরের দিকে। বুরান হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ‘বাবা গো! মা গো!’ করে। হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। একপাল গণ্ডার চলেছে তাঁবুর গা ঘেঁষে। বুরান যে তাঁবুতে ছিল সেটা ছিঁড়ে গেছে।  আগুনটা বৃষ্টিতে নিভে গিয়েছিল বলে এই বিপত্তি।

পরেরদিন সকালে আবার হাঁটা শুরু। ঘণ্টাদুয়েক পর একটা কর্কশ আওয়াজ শুনে উপরে তাকিয়ে দেখি গাছের ডালে চকচকে হলুদ টুপি পরা লম্বা সাদা ঠোঁট বিশিষ্ট হর্নবিল। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে দেখতে হল তার রূপ। অবশ্য এ জঙ্গলে পাখির কোনও খামতি নেই। হাজারো রংবাহারি পাখির স্বর্গরাজ্য।

কুবা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল একটা ব্যাপারে। বিষধর সাপের অভাব নেই এখানে। সাত-আট ফুট লম্বা কিং কোবরা, কালো স্পিটিং কোবরা তো আছেই, এছাড়া আছে মালায়ন পিট আর গ্রিন ভাইপার। গাছের ডালে পাতার মধ্যে থেকে ঝুলতে থাকে। অনেক সময় নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ে। একবার কামড়ালে বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নেই। চারিদিকে চোখ সজাগ রেখে পথ চলতে হবে সেজন্য। পথ বলতে অবশ্য কিছু নেই।বছরের পর বছর জমা হওয়া ঝরা পাতা পচে মিশে গেছে মাটির সাথে। পাহাড়ের নিচে জলাজমি আর শ্যাওলায় মোড়া পাথর।

সপ্তাহ খানেক সময় লাগল কাপুয়াসের উৎসস্থল পর্যন্ত পৌঁছাতে। পরেরদিন থেকে খোঁজা শুরু হল সেই জলাশয় যার পাশে আরমান্দো সেই গুহাটা দেখেছিল। কুবাও এসেছিল আগেরবারে। ও বলল, “উত্তর-পশ্চিমকোণে ছিল সেই জলাশয়।”

একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তাঁবু ফেলা হল। যথারীতি সেই ওরাংওটাংয়ের মাংস সেঁকা আর হাতে গড়া রুটি খেয়ে শুতে গেলাম। মাঝরাতে শুরু হল এক নতুন উৎপাত। একপাল হাতি এসে আমাদের তাঁবু লণ্ডভণ্ড করে দিল। এরা দেখলাম আগুনকেও খুব একটা ভয় পায় না। কুবা বলল, আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে এরা যখন তখন খাবারের লোভে হামলা করে। বছরে কত মানুষ এদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে। আরমান্দো আর আমি চার রাউন্ড ফায়ার করতে তবে সুড়সুড় করে পালাল।

হাতির দলটাতে ছোট বড়ো মিলিয়ে কম করে পঞ্চাশটা হাতি ছিল। একটা জ্বলন্ত মশাল বাঁধা ছিল গাছের ডালে। দলপতিটা যাওয়ার সময়ে সেটা শুঁড় দিয়ে মাটিতে শুইয়ে বিশাল একটা ডাক ছেড়ে বুঝিয়ে দিল যে আমরা এখানে অনাহূত।

পরেরদিন থেকে খোঁজা শুরু হল সেই জলাশয়। আমরা পন্টিয়ানাক থেকে একটা সরকারি জরিপের ম্যাপ জোগাড় করে এনেছিলাম। দুশো বছরের পুরনো জলদস্যুদের ম্যাপটা তো দক্ষিণ চিন সাগরে তলিয়ে গেছে। আরমান্দো এই নতুন ম্যাপের উপরে একটা আনুমানিক পথ এঁকেছে। সেই অনুযায়ী আমরা ম্যাপটাতে পেন্সিল দিয়ে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সার্ভে করতে শুরু করলাম।

একটা জিনিস বেশ কয়েকদিন পরে খেয়াল হল। আরমান্দো আগেরবারে যখন এসেছিল সময়টা ছিল জুন-জুলাই মাস। অর্থাৎ ভরা বর্ষা। আর এবারে আমরা এসেছি জানুয়ারিতে। শীতকাল। এখন পর্যন্ত মাত্র দু’বার বৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিষুবীয় অঞ্চল বলে শীত তেমন মালুম হয় না। কিন্তু এমন তো হতে পারে যে সেই জলাশয় শুকিয়ে গেছে। কথাটা বুরান আর আরমান্দোকে বুঝিয়ে বলতে ওরাও মাথা নাড়ল। তাহলে এখন উপায়?

বুরান বলল, “ছ’মাস বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা কর। নতুবা অন্য কোনওভাবে সেই গুহাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা কর।”

বলা বাহুল্য, ছ’মাস অপেক্ষা করার মতো রসদ আমরা সঙ্গে আনিনি।

একটু থেমে অরুণদাদু বললেন, “আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন স্যাটেলাইট জি.পি.এস. ব্যবস্থা এত বিপুলভাবে চালু হয়নি। অগত্যা সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে দিকনির্ণয় করতে হবে। এখানে তোদেরকে জানিয়ে রাখি, এই যন্ত্রের মাধ্যমে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ মাপতে গেলে দিগন্তরেখায় সূর্য যেখানে মেশে সেই বিন্দুটা যত নিখুঁতভাবে সেক্সট্যান্টের কাঁটার সাথে মেলানো যাবে, তত নিখুঁত হবে এই পরিমাপ। এখন মুশকিল হচ্ছে এই ঘন জঙ্গলে এটা ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করা একপ্রকার অসম্ভব। আর সামান্য এদিক ওদিক হলে ফলাফলের যে বিশাল ফারাক আসবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। আরমান্দো বলল, “এখানের সবথেকে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যদি পরিমাপ করা যায়, তাহলে এক হতে পারে।”

আমরা সবাই তার মতামতকে সম্মতি জানালাম। কারণ, ওরোসাম্বাদের মন্দিরে পৌঁছানর জন্য একমাত্র সূত্র যেটা আমাদের হাতে ছিল, সেটা হল অক্ষাংশ ১ ডিগ্রী ১৫ মিনিট উত্তর, আর দ্রাঘিমাংশ ১১৩ ডিগ্রী ৫৮ মিনিট পূর্ব।

বুরান আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমরা তখন যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে ঠিক উত্তরে একটা খুব উঁচু পাহাড় চোখে পড়ছিল। তার চূড়াটা ঢাকা পড়েছিল মেঘে। তবে এ ভাসা মেঘ, বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির থাকবে না। ওটার চূড়ায় উঠতে পারলে, ঠিকঠাক দিকনির্ণয় করা যাবে বলে মনে হয়। সেইমতো আমরা তাঁবু উঠিয়ে রওনা হলাম।

আটদিন হাঁটার পর মাঝে পড়ল একটা গিরিখাত। তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাওয়ার কোনও রাস্তা আপাতত চোখেই পড়ছে না। প্রায় কুড়ি ফুট চওড়া আর পঞ্চাশ-ষাট ফুট গভীর হবে। নিচেটা পুরো অন্ধকার।

বুকা বলল, “বাঁদিক ধরে মাইল তিনেক গেলে একটা পুরনো গাছের মোটা গুঁড়ি পাওয়া যাবে। আমি তিন-চার বছর আগে এদিকে একবার এসেছিলাম। তাই মনে আছে।”

ওর কথামতো আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।

কিন্তু দু’দিন কেটে গেল কোনও কিছুই চোখে পড়ল না। এমনও হতে পারে যে ও যখন এসেছিল তখন ছিল। পরে নিজে থেকেই ভেঙে সেটা খাদে পড়ে গেছে। ডায়াক কুলিদের মধ্যে একটা আঠার-উনিশ বছরের ছেলে ছিল। সে এগিয়ে এসে বলল, “আমি ওপারে যাবার রাস্তা করে দিচ্ছি।”

লম্বা মোটা দড়ির একপ্রান্তে লোহার একটা শাবল বেঁধে জোরে ছুঁড়ে দিল ওপারে। পাঁচবারের মাথায় পাথরের খাঁজে আটকে গেল সেটা। এদিকে একটা গাছের গায়ে ভালো করে বেঁধে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে চলে গেল উলটোদিকে। ওদিকটাও একটা গাছে বেঁধে দিল। আমরা সবাই টেনে দেখে নিলাম, তারপর কোমরে বেল্ট বেঁধে ঝুলে ঝুলে এক এক করে পৌঁছানো হল অপর প্রান্তে। এবার শুরু হল খাড়াই পাহাড়ে ট্রেকিং। গাছপালার ডাল খামচে ধরে উপরে ওঠা। কিন্তু এটা প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজ। কিছুটা করে উঠেই হাঁফ ধরে যাচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ দম নিয়ে শুরু হচ্ছে পথ চলা। লম্বা নাকওয়ালা বিকান্তান বানরদের দল গাছের উপর থেকে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসছে। শেষে পিস্তলের দু’টো গুলি খরচ করতে হল ওদের জন্য। অবশ্য মরা বানরদু’টো আমাদের ডিনারে কাজে লেগে যাবে। পশ্চিমে মেঘের গায়ে লাল রং গুলে দিয়ে ঢলে পড়ল সূর্য।

আমরা তখন অথৈ জলে। আটকে রয়েছি জঙ্গলের মাঝামাঝি। তাঁবু ফেলার মতো জায়গাই নেই। অগত্যা একটা গাছ থেকে অন্য গাছে দোলা টাঙিয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থা হল। কিছুটা দূর থেকে একটা ঝর্ণার আওয়াজ কানে আসছিল কুলকুল করে। বুকা টর্চ নিয়ে একাই চলে গেল জল আনতে। জঙ্গলে যে ক’দিন আছি, ঐ  ঝর্ণার জলই ভরসা। তবে ফুটিয়ে ছাড়া মুখে দিই না। আমরা গাছে উঠে শুয়ে পড়লাম দোলায়। নিচে কুলিরা আগুন জ্বেলে বানরের মাংস সেঁকা শুরু করে দিল। উপরদিকে তাকালে গাছপালার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রদের দেখা যাচ্ছে। নিজের বাড়িঘর থেকে কত দূরে নির্জন বনের মধ্যে নিশাচর পাখি আর জন্তুদের দূরাগত ডাক শুনতে শুনতে বিভূতিভূষণের আরণ্যকের কথা মনে পড়ল। কতবার পড়েছি বইটা! এখনও সমান আকর্ষণ।

একটা ঝিমুনিভাব এসেছে ততক্ষণে। সারাদিনের ক্লান্ত চোখ টেনে ধরছে। কুলিরা ধোঁয়া দিয়েছে মশা আর পোকামাকড় তাড়ানোর জন্য।

আরমান্দো চিন্তিত গলায় বলল, “আমাদের রাস্তাটা অনেকটা ঘুরে গেল। আরও কতদিন লাগবে কে জানে?”

আমি বললাম, “এসব কাজে ধৈর্য রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই।”

বুরান প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, ডায়েরিতে আর কোনও সূত্র কি ছিল? ঐ মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য?”

আরমান্দো বলল, “সূত্র ঠিক নয়, তবে ফিদালগো ফেরার সময়ে কিন্তু ঐ গুহার কথা উল্লেখ করেননি। আমার ধারণা, তিনি অন্য পথে ফিরেছিলেন। তার মানে ঐ মন্দিরে যাওয়ার পথ একটা নয়। আরও আছে।”

আমি বললাম, “কিন্তু সে রাস্তা খুঁজে পাবার কোনও উপায় আছে কি?”

আরমান্দো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “উপায় এখন একটাই। এই হাজার মাইল জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে অন্ধকারে না হাতড়ে সেক্সট্যান্টের সাহায্যে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মেপে একটা আন্দাজ বের করা।”

বুরান বলল, “তাহলে আমরা যে পথে এগোচ্ছি সেদিকেই যাওয়া হোক। পাহাড়ের মাথায় উঠলে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।”

আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, এমন সময় হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার কানে এল। বুকার গলা। তাড়াহুড়ো করে নামলাম নিচে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল সে গেছে জল আনতে। সবার আগে আরমান্দো দৌড়াল টর্চ আর রাইফেল নিয়ে। তার পিছনে আমি। বুরানও দেখলাম হোল্ডস্টার থেকে রিভলভার বের করে আসছে। প্রায় দুশো মিটার গিয়ে চোখে পড়ল ঝর্ণাটা। সাদা জলের রেখা নামছে অনেকটা উপর থেকে। পাথরের খাঁজে আলো ফেলতে একটা জলের জার দেখতে পেলাম। বুকা এটাই এনেছিল সঙ্গে করে। কিন্তু সে কোথায়?

তার নাম ধরে ডাকা হল অনেকবার। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। অন্ধকার জঙ্গল। কোনদিকে যাব? বুঝে উঠতে পারছি না। তবু সন্তর্পণে ঝর্ণার চারদিক ভালো করে খুঁজে দেখলাম তিনজনে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। ঝর্ণার ধার দিয়ে নেমে আমরা অনেকটা নিচে পর্যন্ত ঘুরে এলাম। আশেপাশে যত ঝোপঝাড় ছিল টর্চের আলোয় খোঁজা হল তন্নতন্ন করে। কিন্তু সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আধঘণ্টা পর আবার একটা আওয়াজ কানে এল। হাড় হিম করা একটা ডাক। দেখলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আরমান্দোর মুখ। আমি রাইফেলটা বাগিয়ে ধরেছি তখন। ঢিপঢিপ করছে বুকের ভিতরটা। এটা কোনও পার্থিব প্রাণীর ডাক হতে পারে বলে মনে হয় না।

বললাম, “এখন ফেরা যাক। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। কাল সকালে আবার দেখা যাবে।”

ফিরে আসতে বাকি চারজন জিজ্ঞেস করল বুকার কথা। কিন্তু তাদের উত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না আমাদের। আমি শুধু কুলিদের বললাম, “চারদিকে গোল করে আগুন জ্বালো। পালটে পালটে সারারাত পাহারা দিতে হবে।”

আধা ঘুমে আধা আতঙ্কে রাতটা কেটে গেল। ভোর হতে সবাই মিলে আবার যাওয়া হল সেই ঝর্ণার কোলে। দিনের আলোয় খোঁজা শুরু হল নতুন করে। কিন্তু সারাদিন কেটে গেল তার কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। আশ্চর্য!

কুলিদের মনের অবস্থা খুবই খারাপ। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না ওদের। আরমান্দো জানাল, “আর সময় নষ্ট করা যাবে না। সামনের দিকে এগোতে হবে।”

আমরা আবার পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু সেদিন খুব বেশি পথ এগোন গেল না। প্রচণ্ড গুমোট করেছে। একদিন পর থেকে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল গোটা আকাশ। দিনের বেলাও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল বন। তারপর দ্বিতীয়দিন রাত থেকে শুরু হল আকাশভাঙা বৃষ্টি। আর প্রচণ্ড মেঘের গর্জন। কড়াৎ কড়াৎ করে বিদ্যুতের রেখা নেমে আসছে। পঞ্চাশ ফুট দূরের একটা গাছ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পাহাড়ের গা দিয়ে জলের স্রোত নামছে হুহু করে। আমরা দাঁড়ানোর জায়গা পাচ্ছি না। শেষে কুলিরা বড়ো গাছের ডালপালা কেটে দু’টো মাচা বানাল গাছের উপরে। তার উপরে উঠে মাথায় তাঁবুর কাপড় চাপা দিয়ে বসে রইলাম সারারাত। ঘুম নেই চোখে। জামাকাপড় ভিজে চুপচুপে। এদিকে বৃষ্টির তোড় উত্তরোত্তর বাড়ছে। অসহায় অবস্থায় বসে আছি আমরা।

দু’দিন কেটে গেল বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণ নেই। সঙ্গে শুকনো খাবার যা এনেছিলাম তা আগেই শেষ হয়েছে। আগুন জ্বালতে না পারলে পেটে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আগুন জ্বালবে কী করে? বৃষ্টির সাথে কনকনে ঝড়ো হাওয়ায় লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সবকিছু।

হঠাৎ প্রচণ্ড একটা চিৎকার। চমকে উঠে দেখি কুলিদের মাচাটা ভেঙে পড়েছে একদিকে। চারটে গাছে চারদিকের কোণ বাঁধা ছিল মাচার। একটা গাছের গুঁড়ি জলের স্রোতে ধসে গেছে। প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মালপত্র। ওরা জঙ্গলের মানুষ বলে কোনওরকমে গাছের ডালে উঠে বসেছে।

পরেরদিন সকাল থেকে কমতে শুরু করল বৃষ্টি। দুপুরের পরে পরিষ্কার হয়ে গেল আকাশ। তিনদিন ধরে অভুক্ত আমরা। শুকনো কাঠকুটোও কোথাও নেই যে আগুন জ্বালা হবে। একটা ছোট স্টোভ ছিল ভাগ্যিস! তাতে করেই চাল ডাল ফুটিয়ে খেলাম সবাই। সে যেন অমৃত।

যাই হোক, আরও দু’দিন পরে আমরা পাহাড়ের একেবারে মাথায় পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে জলের প্রবল স্রোতের রহস্যটা বোঝা গেল। পাহাড়ের মাথায় একটা জলাধার। বৃষ্টির জলে পূর্ণ হয়ে একদিক দিয়ে প্রবল স্রোতের আকারে নামছিল। আর তাতেই যত বিপত্তি। ভূতাত্ত্বিকরা বলেন কয়েক লক্ষ বছর আগে এই অঞ্চলটা অগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে তৈরি হয়েছিল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটাও সম্ভবত একটা আগ্নেয়গিরির মুখ। গোল লেকটার ব্যাস একশো ফুটের মতো হবে। পরিষ্কার কাচের মতো নীল জল টলটল করছে। প্রাণভরে আগে পান করলাম সবাই মিলে। তারপর দু’চোখ ভরে যা দেখলাম সেটা স্বর্গীয় শোভা ছাড়া আর কিছু নয়। উপর থেকে মনে হচ্ছে ঢেউ খেলানো দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মখমলের চাদরে ঢাকা মায়াবী জগৎ। সবকিছু ভুলে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আমরা। একটা অপূর্ব রামধনু খেলে গেল চোখের সামনে। আর যদি কিছু নাও পাই, তবুও এত কষ্ট করে এখানে আসা সার্থক।

আরমান্দোও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে চেয়ে। আমিই প্রথম কথা বললাম, “যন্ত্রটা বের করে মাপজোখ শুরু কর এবার।”

সে নির্লিপ্ত গলায় জানাল, “আমি এখানে এসেই ওটা খুঁজেছি। কিন্তু নেই আমার ব্যাগে।”

“সে কী!”

“তিনদিনের টানা ঝড়বৃষ্টিতে অনেককিছুই হাতছাড়া হয়েছে। তার মধ্যে সম্ভবত সেক্সট্যান্টটাও ছিল। সামনের দৃশ্যটা দেখে মন ভরে গেল। এবার বাড়ি ফিরব।”

আমি অবাক গলায় বললাম, “সব আশা ছেড়ে দিলে!”

আরমান্দো মাথা নিচু করে বলল, “কম্পাসটাও নষ্ট হয়ে গেছে সেদিনের বজ্রাঘাতে। এবারে আমরা সত্যিকারের অন্ধ।”

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম লেকের পাশে পাথরের উপর।

বুরান দেখলাম সবথেকে বেশি আশাহত হয়েছে। শুধু বলছে, “এটা কিছুতেই হতে পারে না। এতদূর এত কষ্ট করে এসে খালি হাতে ফিরে যাব?”

আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, “জীবনের সব রাস্তাতেই যে সাফল্য আসবে এমন তো নয়। মানুষের চেষ্টাটাই আসল। আমরা নতুন উদ্যম নিয়ে পরে আবার আসব।”

কিন্তু কথাটা ওর মাথায় ঢুকল বলে মনে হল না। হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে আমরা জিজ্ঞেস করতে বলল, “বাড়িতে আমার অসুস্থ বোন। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। জমিজমা যা ছিল বাবা সব বন্ধক দিয়েছে। ভেবেছিলাম এখান থেকে ফিরে গিয়ে জীবনটা পালটে ফেলব। আর কিছুই হবে না।”

বুরানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে আরমান্দো বলল, “তোমাদের বলিনি একটা কথা। বলার প্রয়োজন পড়বে ভাবিনি কখনও। আমাদের বংশের যা কিছু সম্পদ ছিল আমার বাবা আর দাদা জুয়া খেলে সব শেষ করে দিয়েছে। আমার ভাগে ক্যাসেলের যে অংশটা পড়েছিল সেটা বিক্রি করে সব টাকা নিয়ে চলে এসেছি এই অভিযানের জন্য। ফিরে গিয়ে কী করব জানি না।”

ভেবে দেখলাম, এদের মধ্যে আমি একমাত্র ভালো আছি। বেশি মনখারাপ করে লাভ নেই।

হঠাৎ কী মনে হল, জামাজুতো খুলে লেকের জলে ঝাঁপ দিলাম। এরকম আকাশছোঁয়া প্রাকৃতিক সুইমিংপুলে স্নান করার সৌভাগ্য আবার কোনওদিন হবে কি না জানি না। জলটা বেশ ঠাণ্ডা। একটা ডুব দিতেই অদ্ভুত কিছু জিনিস চোখে পড়ল। জলের নিচে কয়েকটা পাথরের মূর্তি রয়েছে। আর একবার বড়ো করে দম নিয়ে ডুব দিয়ে পৌঁছে গেলাম একেবারে মূর্তিগুলোর খুব কাছে। পর পর পাঁচটা কালো গ্রানাইট পাথরের তৈরি দৈত্যাকৃতি মূর্তি। প্রত্যেকেরই চারটে করে হাত। আশ্চর্য!

উপরে ভেসে উঠে চেঁচিয়ে বললাম ওদেরকে তাড়াতাড়ি জলে নামতে। আমার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে পোশাক খুলে ঝাঁপ দিল। একবার করে উপরে উঠে দম নিচ্ছি আবার ডুব দিয়ে মূর্তিগুলোকে লক্ষ করছি। সবক’টা মূর্তির হাতে ধরা লোহার মোটা শিকল। এতটুকু মর্চে পড়েনি তাতে। শিকলগুলো একসাথে গিয়ে আটকানো আছে ঠিক মাঝখানে পাথরের মেঝেতে। যেন সবাই মিলে কিছু একটা টেনে তোলার চেষ্টা করছে। যেটা টেনে তোলার চেষ্টা করছে সেটা মনে হয় একটা ঢাকনা। আমরা সেটা টানাটানি করে একচুলও সরাতে পারলাম না। বুঝলাম এখানে ঢাকনার নিচে কোনও রাস্তা যদি থেকেও থাকে সেটা বের করতে গেলে ক্রেন আনতে হবে। যা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।

উপরে উঠে এসে দেখলাম কুলিরা রান্না চাপিয়েছে। পরিষ্কার জলে স্নান করে আমাদের শরীর মন বেশ তরতাজা হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া সেরে আরমান্দো বলল, “এই মূর্তিগুলো যে ওরোসাম্বাদের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে মূর্তিগুলো থাকার নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। এ রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত আমরা এখানেই তাঁবু ফেলে থাকব।”

আমি বললাম, “জলের নিচে ঐ বড়ো লোহার ঢাকনাটা কীভাবে সরানো যায় সবাই মিলে সেটা চিন্তা কর। আমার স্থির বিশ্বাস রাস্তা ওর নিচেই আছে।”

বুরান অনেকক্ষণ বসেছিল চুপ করে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ‘ইউরেকা’ বলে।

“কী হল?” আমরা দু’জনেই ঘুরে তাকালাম ওর দিকে।

“ঐ মূর্তিগুলো একধরনের লিভার। ঢাকনাটা তোলার জন্যই মূর্তিগুলো ওখানে বসানো হয়েছে।”

“কীরকম?”

মুখে নয়, আমি কাজে করে দেখাচ্ছি। বলে সে আর একটা ডায়াক ছোকরা আমাদের সঙ্গে আনা মোটা দড়ির কাছিগুলো নিয়ে জলে ডুব দিল। কি জানি কী মাথায় ঢুকেছে ওর। মিনিট কুড়ি ধরে দেখলাম তারা ডুবছে আর উঠছে। তারপর পাঁচটা কাছির মাথা পাঁচ দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বুরান উপরে উঠে বলল, “পাঁচটা মূর্তির গলায় ভালো করে বেঁধে দিয়েছি। এবারে পাঁচদিক থেকে সবাই একসাথে দড়ি ধরে টানতে হবে।”

আমরা তিনজন, আর ডায়াকরা চারজন। সবাই লেকটার চারদিকে গোল হয়ে গিয়ে কাছিতে টান দিলাম জোরে। প্রথমে কিছুই হল না। বুরান বলল, “হাজার বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি জ্যাম হয়ে গেছে। আবার সবাই চেষ্টা কর। জোর লাগাকে হেঁইয়া!”

সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করলাম, যদি বুরানের বুদ্ধিতে খুলে যায় দরজা। পাঁচবারের মাথায় মনে হল কাছিটা সরে এসেছে কিছুটা। দেখলাম লেকের জল গোল হয়ে ঘুরছে মাঝখানে। ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। মিনিট পনেরো লাগল পুরো জল নামতে। মূর্তিগুলোকে টানার ফলে পেছনদিকে হেলে গেছে অনেকটা। লোহার ঢাকনাটা শিকলের সাহায্যে ঝুলছে মাঝখানে। তার নিচে একটা বড়ো গর্ত। বুরান দু’হাত তুলে লাফাচ্ছে আর গলা ফাটাচ্ছে। আমরাও ওর আনন্দে সামিল হলাম। এটা যে ওরোসাম্বাদের মন্দিরে যাবার রাস্তা, সে বিষয়ে আমরা একশো শতাংশ নিশ্চিত। অতদিন আগের ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধিটা ভেবে বেশ অবাক হচ্ছি। সবক’টা মূর্তি পিছনে হেলে গেলে তাদের হাতে ধরা শিকলে টান পড়বে, আর ঢাকনাটা খুলে উঠে আসবে উপরে। আরমান্দো বলল, “ফিদালগোর ডায়রিতে বা জলদস্যুদের ম্যাপে কিন্তু এ রাস্তার কোনও উল্লেখ ছিল না।”

যখন সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল, আশ্চর্যজনকভাবে বেরিয়ে পড়ল এই পথটা। কাছিগুলো লেকের কিনারায় পাথরের গায়ে ভালো করে পেঁচিয়ে দিলাম যাতে ঢাকনাটা আবার বন্ধ না হয়ে যায়। তারপর আমরা তিনজনেই ছুটলাম কড়াইয়ের মতো ফাঁকা লেকের মধ্যে দিয়ে। সেই গর্তটার সামনে গিয়ে দেখি একটা চওড়া ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে।নিচেটা অন্ধকার। নামার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম আমরা।

এরপর যেটা ঘটল, সেটা স্বপ্নেও আমরা ভাবিনি।

আচমকা গুলির আওয়াজে শান্ত পরিবেশটা বারুদের গন্ধে ভরে গেল। মেশিনগান থেকে একটানা গুলি ফায়ার হচ্ছে। আমি লাফ দিয়ে চলে গেলাম একটা পাথরের আড়ালে। আরমান্দোও শুয়ে পড়েছে মাথায় হাত দিয়ে। বুরানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে গড়িয়ে পড়ে গেল ফাঁকা লেকটার মধ্যে। কী ব্যাপার, কারা এরা? জনাদশেক লোক হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে এল। গায়ের রং কালো, দেখতেও ইন্দোনেশিয়ান, পরনে কিন্তু শহুরে পোশাক। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলল, “কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করলে গুলি করে পাহাড়ের খাদে ফেলে দেব। প্রাণে বেঁচে যাবে যদি চুপচাপ থাক।”

ওদের মধ্যে থেকে দু’তিনজন এগিয়ে এসে আমাদের হাত-পা পিছমোড়া করে বেঁধে আমাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে এগিয়ে গেল কুয়োর দিকে।

ডায়াক কুলিরা পালিয়েছে ভয়ে। আরমান্দো অনেকটা দূরে পড়েছিল। আমি কিছুটা পরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী মনে হয়? কারা এরা?”

“বুঝতে পারছি না। হয়তো দূর থেকে আমাদের পিছু নিয়েছিল।”

আমি বললাম, “আমার ধারণা বুকার সেদিন রাতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মনে হয় ওরই যোগাযোগ আছে এর পেছনে।”

আরমান্দো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হতে পারে। আগেরবারেও তো এসেছিল আমার সাথে। বেশি কথা বলত না। গুপ্তধনের লোভ সামলানো সহজ নয়।”

“বুরান কোথায় গেল, তাকে দেখছি না?”

খেয়াল হল ও গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর সাড়াশব্দ নেই কোনও। গুলি লাগেনি তো! ওর নাম ধরে চিৎকার করলাম অনেকবার। কোনও সাড়া নেই। বেচারা আমার কথায় এসেছিল এতদূর। ও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষ। ওর যদি কিছু হয় পরিবারটা ভেসে যাবে একেবারে। একটু আগেও আনন্দে লাফাচ্ছিল ও। মুখটা মনে পড়তে কান্না পেল খুব জোর।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এত উপরের আকাশে বাজ বা চিল ছাড়া কোনও পাখি ওড়ে না। ওদেরই দেখা যাচ্ছে দু’একটা। আমরা যদি মুক্তি না পাই, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ওদের খাবার হব। কপালে কী লেখা আছে কে জানে?

কিছুক্ষণ পর কালো আকাশের বুকে ফুটে উঠল বিন্দু বিন্দু তারারা। কোটি কোটি জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছে। হাতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে অসাড় হয়ে গেছে শরীর। কতক্ষণ পড়ে আছি ওভাবে, সে জ্ঞানটাও আর নেই। একটা হিমেল বাতাস কাঁপিয়ে দিল আমাদের।

হঠাৎ মনে হল একটা কালো ছায়ামূর্তি খালি জলাধারের দিক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। নড়েচড়ে বসলাম। ভালো করে লক্ষ করে দেখি বুরান!

ওর নাম ধরে ডাকতে একটা অস্পষ্ট শব্দ এল শুধু। অনেক কষ্ট করে এগিয়ে এল আমার কাছে। ছুরি দিয়ে আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিয়েই অচৈতন্য হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি হাতে পায়ের দড়ি খুলে ছুটে একটা জলের বোতল এনে ওর মুখে ঢেলে দিলাম।

“আঃ…  অরুণদা, গুপ্তধনটা পেলে আমার বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিও। ওরা আমার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকবে…।”

আমার কোলেই মাথা রেখে কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল বুরান। ওর শরীরে দু’টো গুলি লেগেছে। তাও এতক্ষণ কীভাবে বেঁচে ছিল ভেবে পেলাম না। আমি আর আরমান্দো জঙ্গলের মধ্যে পাথরের টুকরো দিয়ে সমাধিস্থ করলাম ওর দেহ।

মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে বসেছে ততক্ষণে। পড়ে থাকা মালপত্রের মধ্যে একটাও টর্চ পেলাম না। শেষে দু’টো ডাণ্ডার মাথায় কাপড় জড়িয়ে কুলিদের সংগ্রহ করা পেট্রোলিয়াম ফলের তেলে ডুবিয়ে মশাল জ্বাললাম। আগ্নেয়াস্ত্র ওরা সবই নিয়ে গিয়েছিল। শুধু দু’টো ড্যাগার পেলাম খুঁজে। খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দু’টো ব্যাগে পুরে বেঁধে নিলাম পিঠে। এবার সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু হল।

সিঁড়ির ধাপগুলো অনেকটা চওড়া আর উঁচু উঁচু। বেশ বোঝা যাচ্ছে, যারা বানিয়েছিল তারা মানুষের থেকে দ্বিগুণ লম্বা আর বলবান প্রাণী। কিন্তু কোথায় নামছি আমরা! এ যেন পাতাল প্রবেশ। যদিও আমরা সমতলভূমি থেকে প্রায় আড়াই-তিন হাজার ফুট উপরে ছিলাম।

নামতে নামতে পা ব্যথা হয়ে গেল। সিঁড়ি এঁকে বেঁকে চলেছে। শেষ আর হয় না। উপরে আর নিচে, দু’দিকেই অন্ধকার। আরমান্দো একবার ঘড়ি দেখে বলল, “দুপুর দু’টো।”

মানে আগেরদিন ভোর রাতে আমাদের নামা শুরু হয়েছে। মশাল নিভে যাবার আগে কিছুটা করে তেল তাতে ঢেলে দিচ্ছি। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেলে বোতলের এক-দু’ফোঁটা জল বরাদ্দ। কিছু শুকনো বাদাম আর খেজুর ছিল। তাই দিয়ে কাজ চালাচ্ছি।

দু’দিনের মাথায় আচমকা বাজ পড়ার মতো আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। গম গম করে উঠল পাহাড়ের সুড়ঙ্গ।আর উত্তরোত্তর আওয়াজটা হয়েই চলেছে। আরমান্দো বলল, “মেশিনগানের গুলি চলছে নিচে। গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনি হয়ে এরকম শোনাচ্ছে।”

সত্যি তাই! বললাম, “তাহলে কি ওরা কোনও বিপদে পড়েছে?”

“তাই তো মনে হচ্ছে। চল এগনো যাক।”

আমরা আবার সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলাম। গুলির শব্দটা মিনিট দশেক পরে একেবারে বন্ধ হল। আরও ঘণ্টা সাতেক নামার পর দেখলাম গুহাটা শেষ হয়েছে। আর মুখেই একটা লোক পড়ে আছে উপুড় হয়ে। মশালের আলোয় দেখলাম রক্ত বেরিয়ে কালো জমাট হয়ে আছে চারপাশ। পাশে পড়েছিল আমাদেরই একটা রাইফেল। সেটা তুলে নিয়ে দেখলাম ম্যাগজিনে গুলি শেষ। ব্যাগ থেকে গুলি বের করে ভরে নিলাম। আরমান্দো লোকটাকে সোজা করতে দেখলাম, বুকের পাঁজরের সবক’টা হাড় ভেঙে ঢুকে গেছে ভেতরে। এরকম আঘাত যে করতে পারে তার শক্তি কতটা, সেটা চিন্তার বিষয়। আরও কিছুটা এগিয়ে একটা খুব বড়ো ঘরে প্রবেশ করলাম। মাথার ছাদটা অনেক উপরে। সারা ঘরের মেঝেতে রক্ত। লোকগুলো পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কারোর মুণ্ডু নেই, কারোর হাত পা ছিঁড়ে গেছে। নারকীয় দৃশ্য। আর দেখলাম পাহাড়ের মাথায় যেমন ছিল, চারহাত বিশিষ্ট গোটা দশেক দৈত্যাকৃতি মূর্তি দেয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে। তবে এদের ভঙ্গিটা অন্যরকম। সবাই যেন মাথা নিচু করে কাউকে প্রণাম করছে। ঠিক মাঝখানে একটা সবুজ পাথরের স্থাপত্য। ভয়ঙ্কর তার চেহারা। বড়ো বড়ো চোখ, হাতে একটা বর্শা। এটাই কি ওরোসাম্বাদের দেবতা ‘জেনুমরিস’!

এ ঘরে মৃদু আলো এসে পড়ছে গোল গোল খুপরি দিয়ে। কিছুটা দূরে মেঝেতে আমাদের আর একটা রাইফেল চোখে পড়তে আরমান্দো এগিয়ে গেল সেদিকে।

আমি একটা মৃতদেহের কাছে গিয়ে বললাম, “আমার ধারণাই ঠিক। এই দেখ, এখানে বুকার দেহ পড়ে আছে।” তার বুকের মাঝখান থেকে একটা বিশাল বড়ো ফালা।

আরমান্দো বলল, “শুধু বুকা নয়, আমার আগের বারের সাথী সোরেন মাঙ্গো পড়ে রয়েছে এখানে। সিঙ্গাপুর থেকে আসার আগে একটা টেলিগ্রাম করেছিলাম ওকে। তখনই মনে হয় ও নিজের মৃত্যুর গল্প রটিয়ে গা ঢাকা দেয়। প্ল্যান ভালোই করেছিল।”

সেই মুহূর্তেই বিকট একটা হুঙ্কার দিয়ে আরমান্দোর পিছন থেকে পাথরের মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল একটা দৈত্য। চোখের সামনে যা দেখলাম, ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। গায়ের রং তামাটে। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। বোঝা যাচ্ছে, কয়েকঘণ্টা আগে যে গুলি চলেছে তা সবই ঐ দৈত্যটাকে লক্ষ করে। কিন্তু অমানুষিক শক্তিতে এখনও যুঝে চলেছে সে। আগের দলের সবাইকে খতম করেছে। এবার তার শিকার আমরা। তার ক্ষতবিক্ষত পেশিগুলো থর থর করে কাঁপছে। চোখ আগুনের মতো লাল। এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আরমান্দোর দিকে।

আরমান্দো রাইফেল তাক করে একটার পর একটা গুলি চালাতে শুরু করল। গুলিগুলো লাগছে তার শরীরে। রক্তও ঝরছে। কিন্তু তাও সে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। আরমান্দোর থেকে দৈত্যটার দূরত্ব তখন হাত পাঁচেক হবে। আমার উইনচেস্টারের ম্যাগনাম .৪১০ বোরের বুলেট তার বাঁ কানের ফুটো দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। একটু টলে গেল দৈত্যটা। তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তার ভয়ঙ্কর চোখের দিকে তাকালে শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এবার সে লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমার পরের গুলিটা গিয়ে লাগল ওর চোখে। বিকট চিৎকার করে পড়ে গেল। আবার ওঠার চেষ্টা করছে সে। দু’দিক দিয়ে দু’জনের রাইফেল সমানে গর্জে যাচ্ছে। আবার গুলি ভরে নিলাম ম্যাগাজিনে। প্রচণ্ড আওয়াজে আর বারুদের গন্ধে গরম হয়ে গেল জায়গাটা। আরমান্দো এগিয়ে গেল প্রথমে। মাথাটা পা দিয়ে নাড়িয়ে দেখে হাসিমুখে হাত মুঠো করে বুড়ো আঙুল দেখাল। মানে দৈত্যটার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।

কিন্তু তারপরে যেটা ঘটল, সেটা ভাবলে এখনও আমার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। অনেক বড়ো খেসারত দিতে হল সামান্য অসতর্ক মুহূর্তের জন্য। চোখের পলকে দৈত্যটার বড়ো বড়ো নখওলা চারটে হাত আরমান্দোর শরীরটাকে ধরে ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে দিল।

এই পর্যন্ত বলে অরুণদাদু চুপ করে ঘাড়টা এলিয়ে দিলেন পিছন দিকে। দেখলাম তাঁর চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর চঞ্চলদাই প্রথম কথা বলল, “তারপর?”

চশমাটা খুলে ধুতির খুঁটে চোখ মুছে অরুণদাদু সোজা হয়ে বসে বললেন, “পঁচিশ রাউন্ড গুলি তখনও ছিল আমার ব্যাগে। পাগলের মতো সবক’টা গুলি ম্যাগাজিনে ভরেছি আর ফায়ার করেছি। তাও সাহস করে যেতে পারিনি সেই দৈত্যটার কাছে। প্রায় সারাটা দিন দূরে চুপ করে বসেছিলাম। বন্দুক তাক করে। এই বুঝি সে আবার উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে! মনে মনে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আরমান্দো আর নেই।

“এই হাজার হাজার মাইল জঙ্গলের মধ্যে থেকে কীভাবে ফিরব তাও জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল বুরানের কথা। সে বলেছিল ‘আমার পরিবারটা ভেসে যাবে।’ ভাবলাম, গুপ্তধন নিজের জন্য না হোক, ওর জন্য নিয়ে যেতে হবে। ফিদালগোর ডায়েরিতে লেখা ছিল, গুপ্তধন আছে জেনুমরিসের মূর্তির নিচে।

“এগিয়ে গেলাম সেই মূর্তির দিকে। কিন্তু এত ভারি জিনিস আমার পক্ষে সরানো কোনওমতেই সম্ভব নয়। লক্ষ গেল বেদিটার নিচে বেশ কিছু আঁকিবুঁকি কাটা আছে আর তার মাঝে একটা গর্ত। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল এই গর্তের মাপের একটা জিনিস ঐ দৈত্যটার গলায় ঝুলতে দেখেছি। ছুটে গিয়ে মৃত ওরোসাম্বার গলা থেকে কেটে নিয়ে আসলাম সেটা। তারপর জিনিসটা ঠিক মাপে মাপে বসাতেই মূর্তিটা ঘড়ঘড় করে সরে গেল। নিচে স্তূপাকৃতি ভাঙ্গাচোরা রংবেরঙের পাথরের টুকরো পড়ে রয়েছে অনেক। আমি ভালো দেখে গোটা দশেক তুলে নিলাম। এগুলো যে খনিজ হিরে সেটা আরমান্দো আগেই বলেছিল আমাকে। ধাতব টুকরোটা বেদির গা থেকে খুলে নিতে বন্ধ হয়ে গেল তার মুখ।

“তারপর বেরিয়ে আসলাম মন্দিরের প্রধান দরজা দিয়ে। পাহাড় থেকে নেমে শুরু হল ফেরার পথ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা একা এতটা পথ পেরিয়ে শহরে ফেরা মানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। সূর্যকে লক্ষ করে দিক ঠিক করতাম। গাছের ফলমূল থেকে শুরু করে ইঁদুর, পাখি, সাপ, বাঁদর সব খেয়েছি এই ক’দিনে। দিনের কোনও হিসাব নেই। ঘড়ি ছিল না আমার হাতে। জঙ্গলের মধ্যে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাচ্ছি। কোথায় পুটুসিবাউ? বিষাক্ত কোনও ফল খেয়ে পেটে ব্যথা শুরু হল। ওষুধ নেই সঙ্গে কিছু। ছটফট করছি। সারা গায়ে পোকামাকড়ের কামড়ে ঘা হয়ে গেছে।

“তখন একমাসের উপর ঘুরছি জঙ্গলে। মনে হচ্ছিল কয়েকবছর। আমার তখন ধারণা হয়েছিল যে আর ফিরতে পারব না কোনওদিন। ওদের মতো আমার কপালেও মৃত্যু লেখা আছে এখানে। আচমকা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একদল ফটোগ্রাফারের সাথে দেখা হল। তারাই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল মালয়েশিয়ার বন্দর শহর কুচিং-এ। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর ফিরলাম জাহাজে করে।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “আর সেই পাথরগুলো?”

“বিক্রি করে যা টাকা পেয়েছিলাম, তার চল্লিশ শতাংশ পাঠালাম বুরানের পরিবারকে। আর পঞ্চাশ শতাংশ দিয়ে আরমান্দোর ক্যাসেল কিনে সেখানে ওর নামে একটা স্কুল করা হয়েছে। বাকি যেটুকু ছিল আমার এই বাড়িঘর, জমি, যা দেখছিস। ব্যাঙ্কেও রাখা আছে কিছু শেষ জীবনের জন্য।”

চঞ্চলদা প্রশ্ন করল, “ওরোসাম্বারা কী সত্যিই অন্যগ্রহের প্রাণী?”

দাদু বললেন, “না। ওরা এক বিশেষ ধরণের জিনগত রোগের শিকার। কোটিতে একটা এখনও এরকম বাচ্চা জন্মায় যাদের চারটে হাত, তিনটে পা বা একটা চোখ। যদিও বেশীরভাগ সময়েই তারা বাঁচে না। এটা নিয়ে আমেরিকার বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ডঃ শেরমন ডালাসের সাথে আমার অনেক চিঠি লেখালিখি হয়েছিল। তাঁর মতে ওরোসাম্বারা ছিল দীর্ঘজীবী, প্রচণ্ড শক্তিশালী আদিম গুহামানব। তাদের চারটে হাতের জন্য জিনগত রোগ দায়ী।”

ঝিন্টু এবার লোহার সেই চ্যাপটা ধাতব বলটা হাতে নিয়ে বলল, “বুঝেছি, এটাই সেই গুপ্তধনের চাবি। তুমি তো বুড়ো হয়ে গেছ, এবার আমাদের পালা।”

অরুণদাদু হেসে বললেন, “থ্রি চিয়ার্স ফর থ্রি মাস্কেটিয়ার্স!”

আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, “হিপ পিপ হুররে!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত