প্রখ্যাত গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ রাতের খাবার খেতে এসেছিলেন তাঁর বন্ধু বদরুদোজ্জা সাহেবের সাথে, রাজেন্দ্রপুর শহরের অভিজাত রেস্তোঁরা, ‘ক্যাফে পাতিসেরি’-তে। সুস্বাদু বিদেশী খাবারের জন্যে এই ক্যাফের সুনাম আছে উচ্চবিত্তদের মাঝে।
বদরুদোজ্জা সাহেব ক্যাফে পাতিসেরির বেশ ভক্ত। তিনি এখানকার শীতল, ধীর পরিবেশটা বড় পছন্দ করেন। আরো পছন্দ করেন এখানকার পশ্চিমা খাবারগুলো। সেই মুহুর্তে বদরুদোজ্জা সাহেব আহমেদ শরীফকে দেখাচ্ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক শিমুল দস্তিদার এই ক্যাফেতে খেতে এসে তার সাথে ঠিক কোন টেবিলে বসেছিলেন। বদরুদোজ্জা সাহেব নিজে ঠিক সংস্কৃতিমনা মানুষ নন, তবে যারা শিল্পের চর্চা করেন, তাদের প্রতি তার এক রকমের দূর্বলতা রয়েছে।
ক্যাফের ওয়েইট্রেস মিস ইশিতা এগিয়ে এসে পরিচিত খদ্দের বদরুদোজ্জা সাহেবকে আমন্ত্রণ জানাল বসবার। নিয়মিত খদ্দেরেরা কে কী খায়, এটা মনে রেখে মিস ইশিতা নিজের মনে বেশ প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করে।
– “শুভ সন্ধ্যা স্যার !! আপনি ভাগ্যবান। এমন দিনে এলেন- স্টাফ করা টার্কি আছে আজ মেন্যুতে। আপনার সবচেয়ে প্রিয় ওটা, তাই না ?? … বলুন স্যার। কী দেবো আগে, স্যুপ না কোন মাছভাজা ??”
বদরুদোজ্জা সাহেব বন্ধু আহমেদ শরীফের দিকে ইঙ্গিত করলেন। ” কী, শুনলে তো ?? তোমার পছন্দের ফ্রেঞ্চ কিছু নেই। কেবল ইংরেজ খাবার। ” আহমেদ শরীফ হাত নাড়লেন সহাস্যে। ”
আজ আমি নিজেকে তোমার মর্জির উপরেই ছেড়ে দিলাম দোস্তো। তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী খানা খাওয়াও।” -“বেশ।”, বদরুদোজ্জা সাহেব খাবার আর পানীয় আনতে বললেন।
গমনরত মিস ইশিতার দিকে তাকিয়ে ন্যাপকিন বিছাতে বিছাতে বললেন, ” এখানকার সার্ভিস বেশ ভালো, বুঝলে। এই ইশিতা মেয়েটার কথাই ধরো। স্বাদু খাবার সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান রাখে। নারী জাতি সাধারণতঃ খাদ্যরসিক হয় না হে। প্রচুর মহিলা দেখতে পাবে, যারা প্রাচুর্যের মাঝে থেকেও খাবারের বিষয়ে মাথা ঘামায় না।
নিত্য হাল ফ্যাশনের আসবাব আর পোশাক কিনতে পেরেই তারা খুশি !! ” আহমেদ শরীফ মাথা নাড়লেন, “তা বটে।” -“ভাগ্যিস, ব্যাটাছেলেরা ওরকম নয় ! ”
বদরুদোজ্জা সাহেব সন্তুষ্ট স্বরে বললেন। -“কখনোই না ?? ” চোখ নাচালেন আহমেদ শরীফ। -“তা অল্প বয়সের ছোকরাগুলো করে থাকে বটে, ” সায় দিলেন বদরুদোজ্জা সাহেব। “কিন্তু ওরা… হাহ !! এই যুগের ছোকরাগুলোকে দেখো আহমেদ। না আছে সাহস, না আছে সাধনা। ওদের জন্যে আমার দুই পয়সার সহানুভূতি নেই।
এবং আমার ধারণা…” গলা নামালেন তিনি। ” ওদেরও আমাদের জন্যে দুই পয়সার দরদ নেই। হয়তো ওরাই ঠিক করছে। তবুও, ওদের দেখলেই মনে হয় যেন দুনিয়ায় ষাট বছর বয়েস হয়ে গেলেই আর কারো বাঁচবার অধিকার নেই।
এভাবে চললে আর কয়দিন পরে দুনিয়ায় বয়স্কদের সাথে শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্পর্কটাও লোপ পাবে। ” -“এটা অবশ্য খুবই সম্ভব। ” -” নাহ, তুমিও দেখি নিরাশায় ডুবে গেলে। বলতে বাধ্য হচ্ছি আহমেদ, ঐসব চোর-লুটেরা-খুনখারাবি’র পুলিশি জালে জড়িয়ে তুমিও শেষ হয়ে গেছো।” আহমেদ শরীফ হাসলেন। ” চিন্তা করো তো, ষাট বছরের সবগুলো বুড়োকে যদি একের পর এক সরিয়ে দেয়া হতে থাকে, তাহলে পুলিশের কী দুর্দশাটাই না হবে !! … হা হা হা !! বাদ দাও ওসব দোস্তো। বরং তোমার খবর বলো। দিনকাল চলছে কেমন ?? ” -” গ্যাঞ্জাম !! এই দুনিয়ায় খালি গ্যাঞ্জামই অবশিষ্ট আছে মনে হয়। খালি ঝামেলা আর খালি মিষ্টি-মিষ্টি কথা। ভাবখানা এমন, যেন মিষ্টি কথার তোড়ে সকলে আসল ঝামেলাই ভুলে যাবে। এ অনেকটা ঐ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতন ব্যাপার আর কী…” ঠিক সেই মুহুর্তেই খাবার পরিবেশন করতে মিস ইশিতার আগমন ঘটলো। বদরুদোজ্জা সাহেব সহাস্যে বললেন, ” নাহ, এই সুন্দরী মহিলাটি সত্যিই জানেন আমার ঠিক কী চাই !! ” -” এ কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না, স্যার। আপনি তো এখানে নিয়মিতই খেতে আসেন। আপনি কী খেতে ভালোবাসেন, এ তো মনে রাখা আমাদের কর্তব্যের মাঝেই পড়ে। ” আহমেদ শরীফ প্রশ্ন করলেন। “আচ্ছা, লোকেরা কি সবসময় একই খাবারের অর্ডার দেয় নাকি ?? কখনো স্বাদ বদলের জন্যেও মেন্যু বদলায় না ?? ” -“পুরুষেরা সাধারণতঃ, না স্যার। তবে মহিলারা স্বাদ বদল করে- পুরুষেরা সবদিনই একই অর্ডার দেয়।” -” কী, বলেছিলাম না ?? ” বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন বদরুদোজ্জা সাহেব। চারপাশে চোখ বুলিয়ে তিনি বললেন, “কোণের ঐ দাঁড়িওয়ালা বুড়োটাকে দেখছো আহমেদ ??… মিস ইশিতা আমায় গতবার বলছিলো ঐ লোক প্রতি মঙ্গল আর বিষ্যুদবার রাতে এখানে খেতে আসে। গত দশবছর ধরে। এক হপ্তাও বাদ যায় নি। এই ক্যাফেতে সে একটা মাইলফলকের মত। অথচ, আজব ব্যাপার- এই লোকটা কে,কী করে, কোথায় থাকে- সেটা এই ক্যাফের কেউই জানে না ! ভাবলে আজব লাগে না !! ” টার্কির বাদবাকি অংশ নিয়ে মিস ইশিতা ফিরে আসবার পরে বদরুদোজ্জা সাহেব তাকে বললেন। ”
ঐ যে, তোমাদের ঐ দাঁড়িওয়ালা খদ্দের আজও এসেছে দেখছি।” -“হ্যাঁ স্যার।” মিস ইশিতা জবাব দিলো। “প্রতি মঙ্গল আর বিষ্যুদ বার। জানেন স্যার, গত হপ্তায় কিন্তু লোকটা সোমবার রাতে এসেছিলো ! এমন চমকে উঠেছিলাম স্যার, ভেবেছিলাম আমিই বোধহয় দিন ভুল করেছি। অবশ্য পরেরদিন রাতেও তিনি খেতে এসেছিলেন। বোধহয় একদিন এমনিই নিজের রুটিন ভেঙ্গেছিলেন উনি।” -” অভ্যাসের এমন পরিবর্তন ?? ভারী অদ্ভূত ব্যাপার তো !! ” বিড়বিড় করে বললেন আহমেদ শরীফ। “একটা মানুষ কেন নিজের অভ্যাস এমন বদলাবে , বলতে পারেন কেউ ?? ” – “আমার মনে হয় স্যার, উনি কোন ধরণের দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। ” – ” সে কী ! কেন বলুন তো, তার আচরণে ঐদিন কোন পরিবর্তন দেখেছিলেন না কি ?? ” – “আচরণ নয় স্যার। ভদ্রলোক তো সর্বদা কথা কম বলেন, স্বভাবেও ভারী শান্ত। সেদিনও তেমনটাই করেছিলেন। আশ্চর্য ছিলো স্যার, তার মেন্যু বদলটা … হাসবেন না স্যার। ভদ্রলোক গত দশ বছর ধরে এখানে খেতে আসেন।
কিন্তু স্যার সেদিন রাত্রে উনি যা অর্ডার দিলেন- টমেটোর ঘন স্যুপ, গরুর মাংস, পুডিং আর ব্ল্যাকবেরি টার্ট – ভীষণ অবাক হয়েছিলাম স্যার। জীবনে উনি এই সব খেতে চাননি।…” -” বলতেই হয়, খুব খুব আশ্চর্য ঘটনা এটা !! ” আহমেদ শরীফ বললেন। মিস ইশিতা শ্রাগ করে চলে গেলেন। -“তারপর, গোয়েন্দাপ্রবর, ” মৃদু হেসে বললেন বদরুদোজ্জা সাহেব। ” আপনি কিছু অনুমান করছেন নাকি ?? ” -“আপাততঃ, ও কাজটা তুমিই করো।” অন্যমনস্ক স্বরে বললেন আহমেদ শরীফ। -“বুঝেছি, আমায় ওয়াটসন বানাতে চাও, না কি ?? … শোনো, ব্যাখ্যা খুব সরল। বুড়োকে কোন ডাক্তার বিশেষ ডায়েট দিয়েছিলো- সোজা হিসাব।” -“টমেটোর ঘন স্যুপ, গরুর মাংস, পুডিং আর ব্ল্যাকবেরি টার্ট ?? ভেবে পাচ্ছি না কোন ডাক্তার এই রকমের ডায়েট দেবে…” -“তোমার জানা নেই দোস্তো, এই ডাক্তারেরা পারে না- এমন কোন কাজ নেই।
…কিংবা এমনও হতে পারে, ভদ্রলোক কোন কারণে মানসিক চাপে আছেন- এইজন্যে তিনি খেয়াল না করেই আজব একটা অর্ডার দিয়েছিলেন…” -” হুঁম। ” -” কি, বিশ্বাস হচ্ছে না ??… আরে বাবা এতো গম্ভীর হয়ে গেলে কেনো ??
… বাপরে, তোমায় ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে- এই বুড়ো এখনি কোথাও একটা খুন করতে যাচ্ছে… হা হা হা… নাও নাও, খাবার জুড়িয়ে গেলো এদিকে…” বদরুদোজ্জা সাহেব হাসতে হাসতে বললেন। অথচ আহমেদ শরীফ হাসছিলেন না। তাঁকে চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। ০২। আহমেদ শরীফ আর বদরুদ্দোজা সাহেবের পুনরায় দেখা হলো সপ্তাহ তিনেক পর। শহরের শেষ প্রান্ত থেকে দুজনেই পাতালরেলে উঠছিলেন। লোকের ভীড়ে কথাই হলো না তেমন। আশ্চর্যজনক ভাবে কামরাটা প্রায় শুণ্য হয়ে গেলো মাঝামাঝি এসে।
দুই প্রবীণ বন্ধু তখন পাশাপাশি এসে বসলেন কামরারা পেছনের দিককার ফাঁকা সিটে। -” শালার মানুষ !! ” সখেদে বললেন বদরুদ্দোজা সাহেব। ” চারদিকেই গিজগিজ করছে। একজন অন্য আরেকজনের জন্যে বিন্দুমাত্র ছাড়ও দেয় না !! ” -” কী করবে বলো, ” আহমেদ শরীফ বললেন। ” এটাই জীবন। তুমি হলেও তাই করতে।” -” তা অবশ্য ঠিক। এটাই জীবন। আজকে আছি, কাল নাই। … ভালো কথা, জীবনের কথা যখন চলেই আসলো- জানো নাকি, ঐ যে, আরে ক্যাফে পাতিসেরির সেই দাঁড়িওয়ালা বুড়ো, সে নাকি গত সপ্তায় খেতে যায় নি। আরে, ঐ মিস ইশিতাই আমায় এ কথা বললো। ” গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ সোজা হয়ে বসলেন। ” সত্যি ?? সত্যি বলছো ??”
বদরুদ্দোজা সাহেব বললেন- ” আমার কী মনে হয় জানো। ঐ যে সেদিন বলেছিলাম, ডাক্তার লোকটাকে ডায়েট দিয়েছেন ?? আমার ধারণা- ঐ ডাক্তারের আচরণে লোকটা মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছিলো। যে কারণে খাবারের ফরমায়েশ দেয়ার সময়ও সে এমন মেন্যুর আদেশ দেয়, যা তার সাথে যায় না। আমার মনে হয়, ঐ মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়াটাই লোকটার কাল হয়েছে। নিশ্চয় এখন সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিংবা কে জানে, হয়তো মরেই গেছে।… শালার এই ডাক্তারদের আরো সাবধান হওয়া উচিৎ। ” -” সাধারণতঃ, তারা সাবধানই থাকে।” সতর্ক স্বরে বললেন আহমেদ শরীফ। নিজের স্টপেজ আসতেই বদরুদ্দোজা সাহেব উঠে পড়লেন।
যাবার আগে বললেন- “আশ্চর্যের কথা হলো, ঐ লোকটার নামধাম আমরা আর কখনোই জানবো না। … পৃথিবী বড় আজব জায়গা, নাকি বলো হে ?? ” গোয়েন্দা আহমেদ শরীফের আচরণে অবশ্য মনে হলো না যে পৃথিবীটা খুব বিস্ময়কর স্থান। বাড়ি এসেই তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজের লোকটিকে কোন কিছুর আদেশ দিয়ে বাইরে পাঠালেন। … খানিক পরেই আহমেদ শরীফকে দেখা গেলো একটি নামের তালিকায় চোখ বুলাতে। একটি বিশেষ এলাকায় গত কয়েকদিনে মৃত মানুষগুলোর তালিকা সেটি। আহমেদ শরীফের চোখ থেমে গেলো একটি বিশেষ নামের উপর। ” সিদ্দিকুর রহমান – বয়স উনসত্তর। হুঁম, একে দিয়েই শুরু করা যাক। ”
সেই সন্ধ্যায় গোয়েন্দা আহমেদ শরীফকে দেখা গেলো স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালের স্বনামখ্যাত চিকিৎসক- ডাঃ ইউনুসের সাথে কথা বলতে। ডাঃ ইউনুস বলছিলেন, ” সিদ্দিকুর রহমান ?? ওহ হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ঐ দাঁড়িওয়ালা, আত্মকেন্দ্রিক লোকটা। বেচারা কাছেই থাকতেন, এই হাসপাতালের পেছনে একটা দোতলা বাড়িতে। আশেপাশের সবগুলো বাড়ি ভেঙ্গে এপার্টমেন্ট বানানো হয়ে গেছে, যে তিনচারটা বাড়ি বাদ ছিলো- সেটার মাঝে একটা ছিলো তার। সরাসরি আমি কখনো তার চিকিৎসা করিনি, তবে তার মুখ চিনতাম।
… মৃতদেহ প্রথমে খুঁজে পায় গোয়ালা। দুধ দিতে এসে সে দেখে গতবারের রেখে যাওয়া বোতলভাঙ্গা- নিশ্চয়ই বেড়ালের কাজ- দুধ গড়াচ্ছে। তখন সেই লোক হাঁকডাক করে লোক জড়ো করে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে দেখে মিঃ সিদ্দিকুর সিঁড়ির গোড়ায় মরে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই বেচারার পা পিছলে গিয়েছিলো। ঘাড় ভেঙ্গে গেছে সাথে সাথেই। বেচারা পরে ছিলো স্লিপিং গাউন। ” আহমেদ শরীফ বললেন, ” হুঁম। দেখা যাচ্ছে, – ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে এটা বড় বেশি সরল।” -” ঠিক তাই।” -“মৃতের আত্নীয়-স্বজন ?? ” -” ঐ এক দূরসম্পর্কের ভাগ্নে বোধহয়। রক্তের কিছু নয়। মাসে একবার মামাকে দেখতে আসতো সে। নামটা বোধহয়- আশরাফ হোসেন। সে নিজেও ডাক্তার। শহরের বাইরে নিশ্চিন্তপুরের দিকে বাসা বোধহয়। ” -” চাচার মৃত্যুতে সে কি ভেঙ্গে পড়েছে ?? ” -” উম্ম, এটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কী জানেন, ছোকরা মামাকে পছন্দ করতো ঠিকই- কিন্তু ভালোবাসতো নাকি বলতে পারি না।
বয়সের তফাতের কারণে একটা দূরত্বতো ছিলোই…” -” আপনি যখন মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন, তার ঠিক কতক্ষণ আগে উনি মারা গিয়েছিলেন বলুন তো ?? ” -” এই রে, গোয়েন্দামার্কা সওয়াল শুরু হলো বুঝি…” ডাঃ ইউনুস হাসলেন। ” অন্ততঃ আটচল্লিশ ঘন্টা। তবে বাহাত্তর ঘন্টার বেশি নয়। তাকে এখানে আনা হয় ছয় তারিখ সকালে। কী জানেন, আমরা আসলে আরো অনেক বেশি নিশ্চিত। সিদ্দিকুর সাহেবের গাউনের পকেটে একটা চিঠি ছিলো। ভাগ্নে ডাঃ আশরাফ তিন তারিখে পাঠিয়েছিলো নিশ্চিন্তপুর থেকেই। চিঠির সাথের খাম থেকে পাওয়া তথ্যমতে সিদ্দিকুর সাহেব চিঠিটা পেয়েছেন তিন তারিখ রাত দশটা বিশে। তারমানে মৃত্যুটা হয়েছে রাত দশটা বিশের পর। পোস্টমর্টেমে পাকস্থলি থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে এটা মিলে যায়। ভদ্রলোক মৃত্যুর দুঘন্টা আগে রাতের খাবার খেয়েছিলেন। পোস্টমর্টেম থেকে আমরা তাই মোটামুটি নিশ্চিত- মৃত্যু হয়েছে রাত এগারোটার দিকে।” -” শেষ কবে তাকে জীবিত দেখা গেছে জানেন নাকি ??
” -” এইতো, কাছেই দেখা গিয়েছিলো। তিন তারিখ রাত আটটার দিকে। ক্যাফে পাতিসেরিতে। বিষ্যুদবার। প্রতি বিষ্যুদবার রাতেই নাকি ভদ্রলোক ওখানে খেতে যেতেন। ” -” তার আর কোন আত্মীয় নেই নাকি ?? খালি ঐ ভাগ্নে ?? ” -” ওহ হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম বলতে। ভদ্রলোকের এক পিঠাপিঠি ভাই ছিলেন। যা শুনলাম, বহু বছর আগেই তারা ঝগড়া করে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই ভাই, রাজ্জাকুর রহমান – তার নাকি বিয়ে হয়েছিলো এক ধনী শিল্পপতির মেয়ের সাথে। বিয়ের পর রাজ্জাকুর সাহেব চাকরি ছেড়ে দেন। এই নিয়ে ঝগড়া হয় দুই ভাইয়ের, এরপর থেকে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ব্যাপার কী জানেন, খুবই অদ্ভূত যে মৃত্যুটাও দুই ভাইয়ের একই দিনে। রাজ্জাক সাহেব বয়সে সামান্য বড় ছিলেন সিদ্দিক সাহেবের চেয়ে। উনি মারা গেছেন ঐ তিন তারিখেই, দুপুর তিনটায়। কী অদ্ভূত কাকতালীয় ব্যাপার, না ??
” -” রাজ্জাক সাহেবের স্ত্রী বেঁচে আছেন নাকি ?? ” -” উহুঁ, বহু আগেই মারা গেছেন ভদ্রমহিলা। ” -” রাজ্জাক সাহেব থাকতেন কোথায় ?? ” -” উনি বোধহয় থাকতেন নতুনবাজারের দিকে। আমার তো আসলে জানবার কথা নয়- ডাঃ আশরাফই আমায় এগুলো বলেন লাশ নেবার সময়। বললেন- পরপর দুটো আঘাত, তিন তারিখ দুপুরে রাজ্জাক সাহেব মারা গেলেন আর এখন সিদ্দিক সাহেব। ” আহমেদ শরীফের নীরবতা দেখে ডাঃ ইউনুস কী বলবেন ভেবে পেলেন না। “আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন নাকি মিঃ শরীফ ?? আমি কিন্তু আপনার প্রশ্নের ধারা দেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। ” -” পা পিছলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। খুব সরল ঘটনা। ”
ধীরে ধীরে বললেন গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ। “আমার মনে যা আসছে- সেটিও খুব সরল। একটু সামান্য ধাক্কা- এই যা। ” -” মানে, মানে… খুন ?? এই অদ্ভূত সন্দেহের কারণ ?? ” ডাঃইউনুসকে খুবই বিস্মিত দেখাচ্ছিলো। -” উহুঁ, উহুঁ, সন্দেহ নয়। … অনুমান মাত্র। ” -” যদি আপনি ভাগ্নেকে সন্দেহ করে থাকেন মিঃ শরীফ, বলতেই হচ্ছে- আপনার অনুমান ভুল। রাত সাড়ে আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত ডাঃ আশরাফ তাস খেলছিলেন তার বন্ধুদের সাথে – নিশ্চিন্তপুরে। তদন্তে পুলিশ এই জানতে পেরেছে। ” বললেন ডাঃ ইউনুস। -” হুঁম… নিশ্চিতভাবেই পুলিশ তথ্যটা যাচাই করেছে- এই বিষয়ে তারা খুবই সতর্ক।” বিড়বিড় করলেন গোয়েন্দাপ্রবর।-”
আপনি নিশ্চয়ই ভাগ্নের সম্পর্কে কিছু পেয়েছেন মিঃ শরীফ। তাই নয় কি ?? ” -” মোটেই না, মোটেই না। আপনি বলার আগ পর্যন্ত আমি- এমনকি জানতামই না যে কোন ভাগ্নের অস্তিত্ব আছে। ” -” তবে ?? অন্য কাউকে সন্দেহ করছেন নাকি ?? ” -” তাও নয়।… কি জানেন ইউনুস সাহেব, মৃত্যুর পূর্বে একটা মানুষের সারাজীবনের অভ্যাসের হঠাৎ পরিবর্তনটাই আমায় ভাবিয়ে তুলছে। মাছ ঢাকতে শাকের পরিমানটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। ” -” কী বলছেন ভাই, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ” গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ হাসলেন। ”
আমায় পাগল ঠাওরাবেন হয়তো, কিন্তু ডাক্তার- আমি স্পষ্টঃ অনুভব করছি, মৃত্যুটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। যা হোক, আপনি এতোটা সময় দিলেন- সে জন্যে কৃতজ্ঞ থাকলাম আপনার কাছে। ” আহমেদ শরীফ উঠে দাঁড়ালেন। বিদায় দেবার জন্যে এগিয়ে এলেন ডাঃ ইউনুসও। দরজার কাছে এসে ঘুরে দাঁড়ালেন গোয়েন্দা। “শেষ প্রশ্ন ডাক্তার, সিদ্দিকুর সাহেবের দাঁতের পাটি- সেটি কি আসল ছিলো, না নকল ?? ” -” না না, আসল !! ভদ্রলোক নিশ্চয়ই দাঁতজোড়ার খুব যত্ন নিতেন। এই বয়েসে দাঁতের অমন চমৎকার অবস্থা সচরাচর দেখা যায় না। ” -” তাহলে আপনি বলছেন, ভদ্রলোক তার দাঁতের নিয়মিত যত্ন নিতেন ?? ঝকঝকে দাঁত ছিলো তার, কেমন ?? ” -” একদম। বিষয়টা আমার খুব স্পষ্টঃ স্মরণ আছে। কারণ শেষ বয়েসে দাঁত সামান্য হলদেটে হয়ে যায়- কিন্তু সিদ্দিকুর সাহেবের দাঁতজোড়া ছিলো ঝকঝকে সাদা।
আমার মনে হয় না তিনি ধূমপান করতেন- অবশ্য যদি এটাই আপনি জানতে চেয়ে থাকেন। ” -” ঠিক এটা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না ডাক্তার। একটা ঢিল ছুঁড়লাম আর কি অন্ধকারে- মনে হয় লেগে যাবে। … শুভরাত্রি ডাঃ ইউনুস। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ” গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ বেরিয়ে এলেন। -” এবার, ” রাস্তায় নেমে বললেন তিনি- “দেখতে হবে ঢিলের টুকরা জায়গামত পড়েছে কি না…” ০৩। আহমেদ শরীফ ক্যাফে পাতিসেরিতে এসে আগেরদিনের টেবিলটাতেই বসলেন। মেন্যু হাতে যে ওয়েইট্রেসটি এলো- সে মিস ইশিতা নয়, অন্য আরেকজন। তার কাছ হতেই জানা গেলো মিস ইশিতা ছুটিতে রয়েছে। ঘড়িতে তখন রাত আটটা। সামান্য চেষ্টা করেই গোয়েন্দা মহাশয় এই ওয়েইট্রেসটির সাথে মৃত সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বিষয়ে আলাপ জমাতে সক্ষম হলেন। – ” হ্যাঁ স্যার, আমি ভদ্রলোককে চিনতে পারছি। বছরের পর বছর ধরে তিনি আমাদের এখানে আসতেন।
কী জানেন স্যার, আমরা কিন্তু এমনকি তার নামটাও জানতাম না। খবরের কাগজে দেখলাম তিনি মারা গেছেন। ছবি দেখে তাকে চিনে নিলাম আর কী… ” – ” সে রাতেও তিনি বোধহয় এখানেই খেয়েছিলেন, না কি ?? ” -” অবশ্যি স্যার। সেদিন তো বিষ্যুদবার ছিলো। তিন তারিখ। প্রতি বিষ্যুদাবারেই তো ভদ্রলোক এখানে আসতেন। মঙ্গলবারেও। একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে…” -” সেদিন রাত্রে উনি কী খেয়েছিলেন, তা বোধহয় তোমার মনে নেই ?? …” -” উম্মম, দাঁড়ান স্যার- মনে করে দেখি। … পুডিং ছিলো না স্যার। কেবল আপেল পাই, ব্ল্যাকবেরি টার্ট, গরুর মাংস আর পনির। … চিন্তা করুন স্যার, এখান থেকে গিয়েই বেচারা সিঁড়ির উপর থেকে পড়ে গেলেন। পত্রিকায় লিখেছে, উনি সেসময় স্লিপিং গাউন পরেছিলেন নাকি। … এখানে অবশ্য উনি তার পরিচিত পোশাকেই এসেছিলেন। এখানে-ওখানে ভাঁজ হয়ে থাকা পুরোনো ছাঁটের স্যুট আর প্যান্ট। কতরকমের অদ্ভূত খদ্দেরই না এখানে আসে স্যার…” ওয়েইট্রেস প্রস্থান করলো।
আহমেদ শরীফ পেট পুরে খেলেন। তাঁকে বেশ প্রসন্ন দেখাচ্ছিলো। ” দেখা যাচ্ছে, এমন কি সেরা বুদ্ধিমানেরাও বোকার মত ভুল করে থাকে। বদরুদোজ্জা শুনলে অবাক হবে। ” …উপরওয়ালার সাথে সখ্য থাকায় রাত প্রায় দশটা বাজা সত্ত্বেও থানায় ঢুঁকতেই গোয়েন্দা আহমেদ শরীফকে বেশ সমাদর পেলেন। -” সিদ্দিকুর রহমান সাহেব, যা শুনলাম- একজন নিঃসঙ্গ, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। ” দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন। ” অথচ দেখা যাচ্ছে, তার মৃত্যুতে আপনি বেশ বিচলিত বোধ করছেন ?? ” কর্মকর্তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে আহমেদ শরীফ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শব্দ বাছাই করলেন। ” পরিস্থিতি- আর কিছু নয় অফিসার- পরিস্থিতি। সেটাই আমায় বাধ্য করলো একটু খোঁজ নিতে। ” -” বেশ, বলুন – কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। ” -” তেমন কিছু নয়, মৃত ব্যক্তির পরণের স্লিপিং গাউনে নাকি একখানা চিঠি ছিলো। সেটা একবার দেখতে চাই। ” -“ওহ, ঐ চিঠি। ওটা বেশ কাজে লেগেছিলো। দুর্ঘটনার সময়টা আন্দাজ করতে বেশ সাহায্য করেছে সেটা। ” -” নিশ্চয়ই আপনারা কর্তব্যরত ডাক্তারদের সাহায্য নিয়েছিলেন ?? ” -” হ্যাঁ, অবশ্যই। ” -” চিঠিখানা, একবার দেখাতে পারেন ?? ” চিঠিটা হাতে আসার গোয়েন্দা সেটিকে বেশ খুঁটিয়ে দেখলেন। গুটি গুটি হরফে তাতে লেখা রয়েছেঃ শ্রদ্ধেয় সিদ্দিক মামা, দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে রাজ্জাক মামার বিষয়ে যে কাজটি আপনি করতে দিয়েছিলেন, সেটি আমি করতে পারি নাই।
তিনি আপনার সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখান নাই। তার শরীর প্রচন্ড খারাপ। আল্লাহ না করুন, অতিসত্ত্বর তার কিছু হয়ে যেতে পারে। তার জন্যে আমি চিন্তিত। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছি। দুঃখিত যে তবুও আপনার অনুরোধ সম্পন্ন করতে পারি নাই। ইতি- আপনার স্নেহধন্য- আশরাফ হোসেন। আহমেদ শরীফ চিঠিটার পাঠানোর সময় দেখে নিলেন। বেলা সাড়ে তিনটা, তিন তারিখ। গোয়েন্দা বিড়বিড় করলেন। ” সবকিছুই কেমন নিখুঁত, তাই না ?? … ” ০৪। পরদিন বেলা চড়বার পূর্বেই আহমেদ শরীফ গিয়ে পৌঁছলেন নতুনবাজার। রাজ্জাকুর রহমান সাহেব মৃত্যুর সময় এ বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ির দেখাশোনা করেন রহিমা আক্তার, মোটামুটি মাঝবয়স পেরিয়ে আসা এক মহিলা। প্রয়াত রাজ্জাক সাহেবের দেখাশোনা আর রান্নার কাজটাও তিনিই করতেন।
আহমেদ শরীফকে দেখে মহিলা প্রথমে বেশ আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন। অভিজ্ঞ গোয়েন্দা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিষ্টি কথায় খানিক পরেই গলিয়ে ফেললেন মহিলাকে। একজন ‘সহানুভূতিশীল শ্রোতা’ পেয়ে মহিলাও নিজের যাবতীয় কথা উগড়ে দিতে লাগলো পেটের ভেতর থেকে। গত চৌদ্দটা বছর ধরে সে রাজ্জাক সাহেবের সেবা করে আসছে। কাজটা অনেক কঠিন- সে ছাড়া অন্য কেউ হলে কবেই এই কাজের মুখে লাথি মেরে চলে যেতো !! প্রয়াত রাজ্জাক সাহেব ছিলেন খুবই নিঃসঙ্গ এবং … লোকমুখে শোনা যায় ভদ্রলোকের প্রচুর টাকা ছিলো, কিন্তু সত্যি বলতে কী, উনি লোকটা ছিলেন একদম ‘কিপ্টুস’। এই যে তিনি, রহিমা আক্তার, কত যত্ন করে এই চৌদ্দটা বছর তাকে দেখে শুনে রাখলো, বিনিময়ে তার জন্যে কি তিনি কিছু রেখে যেতে পারতেন না ??
… অথচ তার ভাগ্যে কিছুই জুটলো না। বহু বছর আগে নাকি রাজ্জাক সাহেব এক উইল করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর সমস্ত টাকাপয়সা/জায়গাজমি পাবে তার ভাই সিদ্দিকুর রহমান। সেই উইল নাকি এখনো বলবৎ আছে। সত্যিই, কী হৃদয়হীন আচরণ !! – গোয়েন্দা আহমেদ শরীফ একমত পোষণ করলেন। কিন্তু তার ভাই সিদ্দিক সাহেব নাকি সম্প্রতি এই কিপ্টে লোকটিকে- মানে, রাজ্জাক সাহেবকে- অর্থ সাহায্য করতে চেয়েছিলেন ?? … …এই কথায় রহিমা আক্তার অবাক হলেন। হ্যাঁ, তিনি জানতেন বটে সিদ্দিক সাহেবের কাছ হতে ডাঃ আশরাফ নামের এক লোক আজকাল আসতো রাজ্জাক সাহেবের কাছে। কিন্তু তিনি তো ভেবেছিলেন- এর আসল কারণ হচ্ছে দুই ভাই ঝগড়া ভুলে আবার একত্রিত হতে চায়। -” এই বিষয়ে রাজ্জাক সাহেবকে কিছু বলতে শোনেন নি ?? ” আহমেদ শরীফ আসল প্রশ্নটি করলেন। -” উহু, তারে তো ত্যামন কিসু কইতে হুনি নাই। খালি একবার য্যান কইসিলো, ‘সিদ্দিক্যা ? অমন ঝগড়াইট্যা ভাইয়ের দরকার নাই আমার ‘। তা এমন কতা তো মাইনষে কতই কয়… বোঝলেন, একবার … ”
… গোয়েন্দা মহাশয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলেন। দ্রুত প্রস্থান করলেন তিনি, সৌজন্যের ধার না ধেরেই…। অতএব, দুপুরের পর গোয়েন্দা আহমেদ শরীফকে দেখা গেলো নিশ্চিন্তপুরতে, ডাঃ আশরাফের বাসা কাম চেম্বারের সামনে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে ডাক্তার এলেন। -“আমি কিন্তু রোগী নই ডাক্তার। ” বললেন আহমেদ শরীফ। ” তবে হ্যাঁ, যেহেতু বয়েস হয়েছে, তাই আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। উকিল না পাঠিয়ে তাই আমি সশরীরেই এলাম। ” হাবেভাবে বোঝা গেলো ডাক্তারের মাঝে কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। ডাঃ আশরাফ হোসেন দেখতে সাধারণ, ক্লিন শেভড- মাঝারি উচ্চতার মানুষ। ” আহ, উকিল !! ” ভদ্রলোকের গলার স্বরে কৌতুক, ” ও ব্যাটাদের আমিও দেখতে পারি না। যা হোক, আপনার কথা আমার মাঝে আগ্রহ জাগিয়েছে মিস্টার…” -” আহমেদ শরীফ। আমি একজন বেসরকারী গোয়েন্দা। ”
আহমেদ শরীফ তার কার্ড এগিয়ে দিলেন। ডাঃ আশরাফ চোখ মিটমিট করলেন। -” আমার মক্কেলদের মাঝে অনেকেই মহিলা। ” বললেন আহমেদ শরীফ। -” খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তার সাথে আমার সম্পর্কটা কোথায় তা ঠিক…” -” বলছি। কয়েকদিন আমার কাছে এক ভদ্রমহিলা আসেন। তিনি বলেন, বহু বছর আগে তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে তিনি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। এই স্বামী ভদ্রলোক আর কেউ নন, আপনার প্রয়াত মামা ডাঃ আশরাফ। ” -” কী যা তা বলছেন, আমার মামী- মিসেস রহমান তো বহু আগেই দেহত্যাগ করেছেন। ” -” আমি মিঃ রাজ্জাকুর রহমানের কথা বলছি না ডাঃ আশরাফ, আমি বলছি মিঃ সিদ্দিকুর রহমানের কথা।” -” কী বললেন, সিদ্দিক মামা ?? কিন্তু উনি তো বিয়েই করেন নি !! ” -” করেছেন ডাঃ আশরাফ, করেছেন। ” চোখের পলক না ফেলে মিথ্যে বললেন আহমেদ শরীফ। “সে বিয়ের রেজিস্ট্রি করা কাগজ আমি নিজের চোখেই দেখেছি।” -” না না, এ যে অবিশ্বাস্য !! ” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ডাঃ আশরাফ। ” আপনি মিথ্যে বলছেন, সিদ্দিক মামা বিয়ে করেন নি !! ” -” খুব খারাপ হলো বিষয়টা, তাই না ?? মিছেমিছি আপনি একটা খুন করলেন। ” -” খুন… আমি ?? কাকে ?? ” ভগ্ন স্বরে বললেন ডাঃ আশরাফ। -” সিদ্দিকুর রহমানকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করবার জন্যে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ডাঃ আশরাফ। ” জানালার কাছে গিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ পুলিশের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন আহমেদ শরীফ। ” আর ভালো কথা, দেখতে পাচ্ছি আপনি দুপুরের খাবারেও ব্ল্যাকবেরি টার্ট খাচ্ছিলেন। এটা ঠিক যে, কালোজামে ভিটামিন আছে। কিন্তু, ডাঃ আশরাফ- জেনে নিন – কখনো কখনো এটা অব্যর্থ মারণাস্ত্র হিসেবেও কাজ করে। যেমন আপনার গলায় ফাঁসির দড়ি সেটাই পড়িয়েছে। ” ০৫।
ক্যাফে পাতিসেরিতে বসে বন্ধু বদরুদোজ্জাকে বলছিলেন আহমেদ শরীফ। ” বিষয়টা আমার কাছে সেদিনই আশ্চর্যের বলে ঠেকেছিলো বন্ধু। খেয়াল করো, প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকা একজন মানুষ কখনোই সেই কাজটি করবে না- যা তার কাছে অনিশ্চিত, যা সে আগে কখনোই করেনি। ধরো, তুমি যদি প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকো, তুমি হয়তো তোমার পায়জামা পরেই এই ক্যাফেতে খেতে চলে আসতে পারো- মনের ভুলে। কিন্তু তুমি কখনোই অন্যের পায়জামা পরে বের হবে না বন্ধু। … লক্ষ করো। যে মানুষ আজীবন ঘন টমেটোর স্যুপ, ব্ল্যাকবেরি টার্ট খায় নি; সে কী করে অস্থিরতার মুহুর্তে ঠিক সেই খাবারের ফরমায়েশ দেয় ?? … তুমি বললে, সে মানসিক অশান্তিতে ছিলো। আমি বলবো, মানসিক অশান্তির সময় সে সেই খাবারই আনতে দেবে- যা সে সচরাচর খেয়ে থাকে।
ঐদিনের কথা শুনেই আমার মন বুঝতে পারলো, কোথাও কোন গড়বড় রয়েছে- যেটা আমি ঠিক ধরতে পারছিলাম না। পরে তুমি আমাকে জানালে, সিদ্দিকুর রহমান, দাঁড়িওয়ালা বুড়ো আর এই ক্যাফেতে আসছে না। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বুঝলাম, যদি আমার আশঙ্কা সত্য হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই বুড়োর খারাপ কিছু হয়েছে। ধারণা করলাম, সে মৃত। জানা গেলো, সে রাত আটটায় খাবার খেতে এসেছিলো এই ক্যাফেতে। মৃত্যুর দুইঘন্টা পূর্বে সে খাবার খায়, রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটার দিকে তার মৃত্যু হয়। সব কিছু মিলে যাচ্ছে। পাকস্থলির পোস্টমর্টেম, স্লিপিং গাউনের পকেটে চিঠি। সবকিছু বড় বেশি নিখুঁত, মাছ ঢাকতে শাকের পরিমাণ যেন একটু বেশিই… ভাগ্নে আশরাফ পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে, ভাগ্নে আশরাফের নিখুঁত এলিবাই-ও রয়েছে। অথচ সেই কিন্তু সিদ্দিকুর রহমানের একমাত্র উত্তরাধিকারী। সিদ্দিকুর রহমানের রেখে যাওয়া সম্পত্তি খুব বেশি কিছু নয়। তাহলে তাকে খুন করে ডাঃ আশরাফের লাভটা কী হতে পারে ?? … উত্তর পাওয়া যায় একটু উলটো দিকে চিন্তা করলে। রাজ্জাকুর রহমান সাহেব বিয়ে করেছিলেন বিত্তশালী বাবার মেয়েকে।
অতএব, স্ত্রীর মৃত্যুর পর কিপ্টে জীবনযাপন করা রাজ্জাক সাহেব পেলেন তার সমুদয় সম্পত্তি। রাজ্জাক সাহেবের মৃত্যুর পর এই সম্পত্তির মালিক হবেন সিদ্দিক সাহেব, সিদ্দিক সাহেবের মরণের পর ডাঃ আশরাফ। এই শেকলটা মেলানোর পর বাকি সব সহজেই আন্দাজ করা গেলো। ” – “কিন্তু এই সবই তো তোমার অনুমান মাত্র দোস্তো, ” বদরুদোজ্জা সাহেব বললেন, ” প্রমাণটা পেলে কীভাবে ?? ” -” বলছি। নিজেকে ডাঃ আশরাফের জায়গায় কল্পনা কর। সে দ্রুত তার উভয় মামার মরণ কামনা করছে। দুই তারিখ দুপুরে সে রাজ্জাক সাহেবকে দেখে সে ডাক্তারি বিদ্যায় বুঝতে পারে, তিনি বড়জোর রাতটা টিকবেন। চতুর ডাঃ আশরাফ তখনি নিজের অন্য মামা সিদ্দিকুর রহমানকেও সরিয়ে দেবার নকশা আঁটে। দুই তারিখেই আশরাফ হোসেন একটা চিঠি পাঠায় নিশ্চিন্তপুর থেকে, তারিখের স্থলে দুই এর জায়গায় তিন লিখে রাখে।
পরদিন দুপুরে রাজ্জাক সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়েই সে গাড়ি ছুটিয়ে সিদ্দিক সাহেবের বাসায় আসে। এরপর সিঁড়ির উপর থেকে ধাক্কা, সিদ্দিক সাহেবের হত্যা- রুটিনমাফিক হয়ে যায় সব। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আছে মৃত্যুর দুই ঘন্টা পূর্বে ভরপেট খেয়েছিলেন সিদ্দিক সাহেব। ঠিক, কিন্তু রাতের খাবার নয়, ওটা ছিলো দুপুরের খাবার দোস্তো !! এরপরের কাজ খুব আরো সহজ। সিদ্দিক সাহেব সেজে রাত আটটায় খেয়েদেয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যাওয়া আর নকল দাঁড়ি খুলে ফেলে জোরে গাড়ি চালিয়ে সাড়ে আটটার সময় তাসের আড্ডায় উপস্থিত হওয়া- খুব কঠিন কোন কাজ নয়, কী বলো ?? ” -” কিন্তু ডাকবিভাগের খামের তারিখ ?? ” বদরুদোজ্জা সাহেবের প্রশ্ন। -” সহজ ব্যাপার বন্ধু।
হাত ঘুরিয়ে 02কে 03 করে দেয়া কী আর এমন কাজ। কেউ তো আর খামটা খুঁটিয়ে লক্ষও করে নি, আমি ছাড়া। …তবে এইসব কিছু নয়, যে জিনিসটা আসলে আমার মনে প্রথম সন্দেহ জাগিয়ে তোলে, সেটা ছিলো তার দেয়া খাবারের ফরমায়েশ। আশরাফ হোসেন তার মামার সাজ, হাঁটাচলা, কথাবলা রপ্ত করেছিলো ঠিকই- কিন্তু খাদ্যভ্যাসটা নকল করতে পারেনি। আশরাফ হোসেন এই ক্যাফেতে সিদ্দিক সাহেবের বেশে খেতে এসেছিলো আসলে দুইবার। একবার খুনের রাতে, আরেকবার হচ্ছে সেই সোমবার, যে সপ্তায় আমরা খেতে এসেছিলাম। সেই সোমবারে আসবার কারণ ছিলো নিজের ছদ্মবেশ যাচাই করে নেয়া- আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয়া। লক্ষ করলে দেখে থাকবে, এই দুইবারেই মানসিক ভাবে অস্থিতিশীল থাকায় সে একই রকম খাবার আনতে নির্দেশ দেয়।
ডাঃ ইউনুসের দেয়া সাক্ষ্য থেকে জানা যায় সিদ্দিক সাহেবের দাঁতজোড়া ছিলো ঝকঝকে সাদা, কিন্তু আলোচ্য দুইদিনেই ‘সিদ্দিক সাহেব’ ক্যাফেতে এসে খেয়েছিলেন ব্ল্যাকবেরি টার্ট। হিসেবটা মেলে না কিন্তু। আর আজ দুপুরে আশরাফ হোসেনের খাওয়ার পরেই সেখানে উপস্থিত থেকে বুঝতে পারলাম, আমার সন্দেহ একদম ঠিক। পুলিশের বড়কর্তাদের সাথে খাতির থাকায় পুলিশ প্রস্তুতই ছিলো, আশরাফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে তাই বেগ পেতে হলো না। … ” গোয়েন্দা আহমেদ শরীফের বক্তব্য শেষ হবার খানিক পরেই মিস ইশিতা তাঁদের টেবিলে এনে রাখলেন স্টাফ করা টার্কি আর … আর একপাত্র ব্ল্যাকবেরি টার্ট। -“এগুলো আজ আর আমার মুখে রুচবে না। ” উদাস স্বরে বললেন বদরুদ্দোজা সাহেব। ” মিস ইশিতা, অনুগ্রহ করে আমায় আজকে সাদামাটা একপাত্র খিচুড়িই দিন বরং…” [ উপরের গল্পটি আগাথা ক্রিস্টি রচিত “ফোর এন্ড টুয়েন্টি ব্ল্যাকবার্ডস” গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা। মূল গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ক্রিস্টির সৃষ্ট গোয়েন্দা -এরকুল পোয়ারো। ]