ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় হঠাৎ সজীব বলল, ‘আজ খাওয়াতেই হবে, হিমাদ্র।’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল হিমাদ্র—কেন? খাওয়াতেই হবে কেন?
—কেন আবার, তুই ক্লাস পরীক্ষায় প্রথম হলি যে!
—ক্লাস পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটাও একটা কারণ হলো।
—এত কথা বুঝি না, খাওয়াতে হবে, ব্যস।’ পাশে থাকা রাতুল জবাব দিল।
পেছনে থাকা মুন্না ও আকরাম রাতুলের কথায় জোর দিল।
সবার তোপের মুখে আজ আর শেষরক্ষা হলো না হিমাদ্রর। পকেটে অল্প কিছু টাকা পড়ে আছে, এ দিয়েই মাসটা চালাতে হবে। বন্ধুদের বিদায় দিয়ে পলাশীর পথ ধরে নীলক্ষেতের দিকে একা হাঁটছিল হিমাদ্র।
নভেম্বরের শেষ দিক, উত্তরের বাতাস শীতের জানান দিচ্ছে। রোদের তাপ শরীরে খারাপ লাগছে না। তা ছাড়া দুপুরে এই পথে তেমন পথচারী না থাকায় হাঁটতে ভালোই লাগে। নীলক্ষেত পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মোড় ঘুরলেই হিমাদ্রর বাসা, তাই এ ক্ষেত্রে গাড়ির চেয়ে পা দুটিই বেশি ব্যবহার করে সে।
মাস তিনেক হলো স্নাতকোত্তর কোর্সে এখানে (বুয়েট) ভর্তি হয়েছে হিমাদ্র। আতিকুল্লাহ স্যারের সহযোগিতায় প্রাপ্ত টিউশনির টাকায় খারাপ চলে না। কিন্তু এভাবে খরচ করা সহজ হয় না। নীলক্ষেত পার হয়ে ঢাবির রাস্তায় পড়েছে হিমাদ্র। বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল তার। আজকে যে টাকাটা খরচ হলো, তা দিয়ে বাড়িতে চার দিনের বাজার চলে যেত। না, এভাবে আর খরচ করা চলবে না। ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল হিমাদ্র। পেছনে গাড়ির প্রচণ্ড হর্নে ভাবনা ভাঙল, ফিরে তাকাল হিমাদ্র—দেখল একটা ‘টয়োটা এক্স-করলা’ পেছনে থেমেছে। হিমাদ্র ঘুরে তাকাতেই গাড়ি থেকে অরণী নেমে বলল, ‘কী ভাবছিলেন অত?’
হিমাদ্র অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি? কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’
—হ্যাঁ, বাসায় যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখন আর বাসায় যাব না।
—মানে?
—আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।
—কোথায়? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল হিমাদ্র।
—ভয় পাচ্ছেন? দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল অরণী।
খোঁচাটা হজম করল হিমাদ্র। গত দুইবারের আলাপে অরণী সম্পর্কে যা বুঝতে পেরেছে, তাতে অরণী তাকে এই মুহূর্তে ছেড়ে যাওয়ার পাত্রী নয়। কাজেই তর্কে না গিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠল সে। কিন্তু শুধু দুবারের আলাপে তাকে এতটা বিশ্বাস কী করে করছে অরণী?
—কি হলো, ভয় কাটেনি এখনো? নীরবতা ভাঙল অরণী। আবারও খোঁচাটা সহ্য করল হিমাদ্র ‘না, কিসের ভয়?’
—তাহলে চুপ করে আছেন যে?
—আপনার পড়াশোনা কেমন চলছে?
কথাটা শুনে হাসল অরণী। ‘আমার কথা বাদ দেন। আপনার কথা বলেন। কোথায় থাকেন বলেন তো, দেখা নেই। ক্লাস আর বাসা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না নাকি? ।
—তা নয়, আমি তো আপনাকে ঠিকই দেখেছি।
—দেখেছেন! কোথায়? আলাপ করেননি কেন?
—আপনার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল। একদিন বাইকে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন, আর একদিন ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তার দেয়ালে বসেছিলেন। খুব সহজ গলায় বলল হিমাদ্র।
—ও, ওর নাম সানি, আমার বন্ধু। একদিন আলাপ করিয়ে দেব। কথাটা বলে সামনের রাস্তা দেখায় অরণী। মন্থর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে।
—শুধুই বন্ধু! সানির চোখ-মুখ কিন্তু অন্য কিছু বলছিল।
—মানে?
—সে বোধ হয় বন্ধুর চেয়ে একটু বেশিই ভাবছে।
গাড়িটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে পার্ক করল অরণী। ইঞ্জিনটা বন্ধ করে বলল, ‘ওটা তার ব্যর্থতা, চলেন।’ প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য হিমাদ্র জিজ্ঞাস করল, ‘এখানে কেন?’
অরণী কিছু না বলে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন হিমাদ্র। পেছনের দিকের টেবিলটায় বসল দুজন। পুরো রেস্টুরেন্ট মানুষে প্রায় পরিপূর্ণ। অরণী চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে আপনি আপনি করেন কেন? আমি তো আপনার ছোট।’ কথাটা যেন কানেই গেল না হিমাদ্রর, তার মাথায় এখন অন্য ভয়—এখানকার খাবারের বিল যদি তার দিতে হয়, তাহলে তার পকেটে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
—বললেন না?
—না, এমনি, তুমি বলার সাহস হচ্ছিল না।
—অনুমতি দিলাম, এখন থেকে তুমি বলবেন। মুচকি হাসিতে কথাটা বলে বেয়ারাকে অর্ডারটা দিল অরণী।
—এ রকম অনুমতি তাহলে আমার কাছ থেকেও নিতে হবে। আস্তে করে কথাটা বলল হিমাদ্র।
এবার একটু জোরেই হাসল অরণী। হাসিটার জন্য অরণীর ওপর নজর পড়ল হিমাদ্রর। লম্বা-চওড়া বদনখানিতে ফুলহাতা থ্রি-পিস, মাথায় হিজাব দিয়ে চুলগুলো আটকানো, সুশ্রী মুখমণ্ডলের ঠোঁট দুটিতে হালকা রঙের লিপস্টিক লাগানো। বক্ষদেশ এমনভাবে কাপড়ে মোড়া যে সেদিকে নজর পড়ে না।
—কী দেখছ অমন করে?
—আজকাল সচরাচর ধনীর মেয়েদের এ রকম শালীন পোশাকে, সাবলীল চলাফেরায় দেখা যায় না।
—ধন্যবাদ। তবে আমরা ওই রকম ধনী নয়ও কিন্তু।
খাবার হিসেবে চিকেন বার্গার আর দুই গ্লাস জুস এসেছে। আজকাল ফাস্ট ফুড খাওয়ার একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে।
—তোমার টিউশনি কেমন চলছে? প্রশ্ন করল অরণী।
—আমি টিউশনি করি, তুমি জানো কিভাবে?
জুসে চুমুক দিয়ে অরণী বলল, ‘আমি তোমার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানি, চলো উঠি।’ বলেই টেবিল ছাড়ল অরণী।
দুই
আজকাল প্রয়ই দেখা হয় হিমাদ্র আর অরণীর। এখানে-ওখানে চা-কফি খাওয়া, আড্ডা দেওয়া ছাড়াও জীবনের নানামুখী বাস্তবতা নিয়ে কথা হয় তাদের মধ্যে। সানিকে নিয়ে হিমাদ্রর মনে যে ভয় জন্মেছিল, সে রকম কিছু ঘটতে দেয়নি অরণী।
আজ দুপুরটা মেঘলা, বৃষ্টি হতে পারে। ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছিল দুজন। আকাশে মেঘ জমে থাকায় পরিবেশটা বেশ থমথমে, রাস্তায় লোকজন কম। হঠাৎ অরণী আস্তে করে বলল, ‘আমরা কি সারা জীবন এভাবে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে হাঁটতে পারি না, হিমাদ্র?’
কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল হিমাদ্রর, দুই পা সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল—‘মানে?’
—মানেটা তুমি জানো, হিমাদ্র। বলল অরণী।
—কিন্তু তুমি জানো না। জোর দিয়ে বলল হিমাদ্র।
মিনিটখানেক নীরব থাকার পর হিমাদ্র শান্তভাবে বলল, ‘দেখো অরণী, আমি জানি তুমি খুব ভালো মেয়ে, যে তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পাবে তার জীবনে কোনো অপূর্ণতা থাকবে না। কিন্তু আমি তোমার যোগ্য নই।
—যোগ্য-অযোগ্যর কথা নয়, তুমি ভালোবাস কি না?
—এটা ছেলেখেলা নয়, অরণী। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করো। তোমার পরিবার এটা কখনোই মেনে নেবে না, তা ছাড়া এই কঠিন সংসারজীবনে আমি তোমাকে সুখী করতে পারব না।
—টাকা-পয়সার সুখের কথা ভাবছ তো, ও ভয় তুমি না-ই বা পেলে। অর্থ-প্রতিপত্তিতে সর্বদা সুখ হয় না, হিমাদ্র, মাঝেমধ্যে অপূর্ণতা ও অভাবের মধ্যেও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়।
—তুমি ইমোশনাল হয়ে পড়েছ, চলো বাড়ি যাও।
হঠাৎ করে রাগ ধরে গেল অরণীর, ‘আমি মোটেই ইমোশনাল নই, আমি তোমার দিকটা জানতে চাই।
—আমাকে ক্ষমা করো। অন্তর ফেটে যাচ্ছিল হিমাদ্রর, তবু কথাটা স্বাভাবিকভাবে বলল সে।
তাত্ক্ষণিক আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো অরণীর চোখ ভরে জল পড়তে লাগল। রাস্তাটা পার হয়ে অন্য ফুটপাত দিয়ে দ্রুত চলে গেল অরণী। পেছন পেছন যাওয়ার মনোবল পেল না হিমাদ্র, সে মাথাটা নামিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। এমন সময় বৈশাখী গর্জনে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো—সঙ্গে হিমাদ্ররও বুক ফেটে আর্তনাদ বের হতে লাগল।
তিন
দিন পনেরো গত হয়েছে, হিমাদ্র একবারের জন্যও দেখা পায়নি অরণীর। মনে মনে ক্যাম্পাস এলাকার বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছে, কিন্তু দেখা মেলেনি। ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। বাসায় যাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। কিছুতেই যেন আজকাল ভালো লাগে না। উত্কণ্ঠা নিয়ে শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসে ভাবছিল কী করা যায়, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল হিমাদ্রর।
—হ্যালো, হিমাদ্র।
—অরণী, তুমি কোথায়? কেমন আছ? সুস্থ আছ তো, তোমার ফোন বন্ধ কেন? কথাগুলো একসঙ্গে বলে গেল হিমাদ্র।
—আমি ভালো আছি। তুমি কি আজ বিকেলে ফ্রি আছ? আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবে?
—হ্যাঁ, কখন আসব বলো? হিমাদ্র উদ্বিগ্ন।
—নির্ঝর কফি শপ, বিকেল ৫টা।
ফোনটা রাখার পর হিমাদ্রর নিজেকে অস্থির মনে হচ্ছিল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এত দিন বাস্তবতা আর ভালোবাসার মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছে, তাতে একবারের জন্যও সে ভালোবাসাকে হারাতে পারেনি। কিন্তু অরণী এত দিন কী করেছে, সে কি তার কথায় ভিত্তি করে তাকে ভুলে গেছে, নাকি এখনো অরণী তাকে আগের মতো ভালোবাসে। নানা ভাবনা এসে ভিড় করছে মাথায়, সময় যেন কাটছেই না।
নির্ঝর কফি শপের উত্তর কর্নারের টেবিলটায় নীল শাড়ি পরে বসেছিল অরণী। চোখের নিচে কালো একটা রেখা দেখা দিয়েছে, কিছুটা শুকিয়েও গেছে সে। অরণীকে এভাবে দেখে আজ প্রথম কী যেন হারানোর ভয় হলো হিমাদ্রর। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘এ কী করেছ নিজের শরীরের!’
—ও কিছু না, তুমি কেমন আছ?
—না মরে বেঁচে আছি।
—কেন?
—কেন তা জানি না। তবে এ কয়টা দিন আমি ভালো ছিলাম না। কিন্তু তোমার এ অবস্থা কেন?
—বড় আপুর সঙ্গে তোমার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তুমি চাইলে আপু-আব্বুর সঙ্গে কথা বলবে, আর না চাইলে এটাই আমাদের শেষ দেখা। কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে বলছে অরণী, কিন্তু হিমাদ্র দেখল তার চোখ দুটি ছলছল করছে।
অন্যদিকে তাকিয়ে হিমাদ্র বলল, ‘মা বলতেন, কেউ যদি অনেক কষ্টে থেকেও তোমার কাছে সব গোপন করে পাছে তুমি কষ্ট পাবে ভেবে, তবে জেনে রেখো সে তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসে। একই ঘটনা যদি অন্যের জন্য তোমার ক্ষেত্রে ঘটে, তবে তার জন্য তোমার ভালোবাসা সত্য। আমার মনে হয়, মায়ের কথাটা আজ দুজনের বেলায়ই সত্যি।’ অরণীর দিকে তাকাল হিমাদ্র।
—ভালোবাসাকে আটকে বাস্তবতাকে জয়ী করার প্রচেষ্টা আমার ভুল ছিল। বাস্তবতা নিয়ে দিন কাটানো যায়, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য চাই ভালোবাসা।
মাথা নিচু করে বসে ছিল অরণী। হাতটা ধরে নিজের কাছে এনে হিমাদ্র বলল—
‘তোমার দুঃখগুলি আমায় দাও
কিনে নেব ভালোবাসা দিয়ে,
আমার সুখগুলি তুমি নাও
বিনিময়ে চাই না কিছুই ফিরিয়ে।’
…I Love You অরণী।
অরণী কোনো কথা বলতে পারল না, শুধু তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।