ছয় তারে ভালোবাসা

ছয় তারে ভালোবাসা

সে ছিল এডগার এলেন পোর মানস প্রেয়সী এনাবেল লির অন্ধভক্ত, আর আমি ছিলাম বনলতা সেনের শাশ্বত প্রেমিক। সে ছিল ৩.৮ সিজিপিএ-ওয়ালা ক্লাস টপারদের একজন, আমার সিজিপিএ কেউ জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে বলতাম, কেন লজ্জা দিচ্ছেন ভাই? সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কন্যাটি যখন প্রাইভেট কার থেকে নেমে ক্লাসে প্রবেশ করত, পুরো ক্লাস যেন ঝলমল করে উঠত! আর আমি যখন ক্লাসে ঢুকতাম, জানালায় বসা দাঁড়কাকটা ভাবত, ‘ছোকরার এলোমেলো চুলে একবার বাসা বাঁধতে পারলে শীতকালটা বেশ আরামে কেটে যেত!’ তার জন্মের সময় ঢাকা শহরে তুষারপাত হচ্ছিল কি না জানা নেই, তবে আমার জন্মের সময় খুবসম্ভব কারেন্ট চলে গিয়েছিল— নতুবা এই গায়ের রং হয় কী করে!

এত বৈপরীত্যের মধ্যেও সেই অলিম্পাসের চূড়া থেকে কিভাবে ওর নাম লেখা কিউপিডের ছোড়া তীর নির্ভুলভাবে আমাকেই বিদ্ধ করে, সে প্রশ্নের জবাব মনে হয় না স্বয়ং সিগমুন্ড ফ্রয়েডও দিতে পারতেন!

উঁহু, বাবা! প্রকৃতি কোনো অসামঞ্জস্য সহ্য করে না। সে বড় নির্দয় বিচারক! কয় দিনই বা ক্লাস শেষে ওর পিছু পিছু ছবির হাটে লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘুরেছি? বড়জোর মাস দেড়েক! এরই মধ্যে হঠাৎ করে একদিন পেছন দিক থেকে এসে আমার কলার চেপে ধরল :

‘আমার পিছু নিস ক্যান প্রতিদিন, ক্লাস শেষ হলে?’

বিকেলের নরম রোদ বড় আয়েস করে এলিয়ে পড়েছিল ওর গালে, মুখে, ঠোঁটে!

একেই কি বলে শ্রাবস্তীর কারুকার্য?

‘প্রতিদিন না, আজই এলাম, তা-ও তোমার পিছু পিছু না’, আমি কাঁচুমাচু মুখে মিথ্যের ডালি সাজাই—‘শুনেছি, আজ এখানে সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টিং এক্সিবিশন হবে!’

‘ছবির হাটে আজ সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টিং এক্সিবিশন’, ওর ভ্রু কুঁচকে যায়—‘জানতাম না তো?’

হঠাৎ আমার দিকে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—

‘বল, দু-একজন সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টারের নাম বল।’

আমার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখ দেখে ও খুশি হয়ে যায়। আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবলীলায় বলে দিই,

‘আর্নস্ত চে গুয়েভারা! ওই যে একটা ছবি আছে না—মাথায় বিপ্লবীর টুপি আর একমুখভর্তি দাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক লোক, সেটাই তার আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি!’

আমি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করি কিছুক্ষণ। শ্রাবণের প্রথম বাদলধারার মতো ওর মুখচ্ছবি হাসিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে মুহূর্তের জন্য। ওর এই হাসি দেখার জন্য আমি আজীবন কেবলাকান্ত সেজে থাকতে রাজি আছি—ও কি তা জানে?

হঠাৎ থেমে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে সবার সামনে! আমি তার কিছু শুনি, কিছু শুনি না। যা বলে তার খুব অল্পই বুঝি, বেশির ভাগই বুঝি না। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, ও হেঁটে চলে যায়, একবারের জন্যও ফিরে তাকায় না।

নাকি তাকায়? কে জানে!

তারপর আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ শীতকালটি আসে। আমি ক্যাম্পাস বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিই। আলমারির কোণ থেকে টেনে বের করি ধুলাজর্জরিত গিভসন গিটারখানা। টুংটাং সুর তুলি তাতে—কিছু কর্ড সার্কেল, কমল ভাইয়ের গিটার ক্লাসে শেখা পুরনো কিছু লেসন প্র্যাকটিস করি। সর্বোপরি চেষ্টা করি ওকে মন থেকে শিফট চাপ দিয়ে ডিলিট বাটন প্রেস করার মতো পার্মানেন্টলি ডিলিট করতে।

পারি আর কই!

আমার লিরিক লেখার খাতায় জমে ওঠে একটি, দুটি করে নতুন কিছু গান। তাতে সুর বসাই।

কিছুটা বন্ধুদের আহ্বানে আর অনেকটাই প্রাণের টানে ফিরে আসি আবার ক্যাম্পাসে। এবার আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী আমার গিটারখানা।

বন্ধুদের নতুন কম্পোজ করা গানগুলো শোনাই। টিএসসি, হাকিম চত্বরের চায়ের দোকান ও আশপাশের জায়গা সরগরম হয়ে ওঠে গানের সুরে।

‘সেই ছেলেবেলা থেকে মনের খাতায় কত শত আঁকিবুঁকি

স্বপ্ন আমার নাটাই ছেঁড়া ঘুড়ি,

গায়ক নায়ক কত কিছু হওয়া এক জীবনের খাতায়

বন্ধু মহলে ভীষণ বাহাদুরি!

আজ শেষ বিকেলের আলোয় আমার একটাই খালি চাওয়া

চাইলেই তুমি দিতে পারো সহজেই

ভার্সিটির প্রতিটি বিকেল তোমার স্মৃতিতে নাওয়া

দাও একটা বিকেল যাতে তুমি মিশে নেই,

মিশে নেই……’

বন্ধুবান্ধবদের গান পছন্দ হয়। অনেকেই শিখে নেয় গানটা। অনেকেই জিজ্ঞেস করে—গানটা কাকে নিয়ে? আমি মৃদু হাসি। ওরা আমার হাসির অর্থ পড়তে পারে না। বিরক্ত হয়, প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেয়।

আমি সচেতনভাবে ওকে এড়িয়ে চলি! ও যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, আমি তার উল্টো রাস্তা ধরি। কখনো-সখনো একদম এড়াতে না পারলে জ্যাকেটের হুডি দিয়ে চেহারা ঢেকে ফেলি।

এক সকালে ডিপার্টমেন্টের করিডরে এসে দেখি, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ও। ওর বিপরীতে, দোতলার বাউন্ডারিতে আমারই গিটার হাতে বসা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু। ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে আমার খুব চেনা একটা সুর, প্রিয় কিছু শব্দ—

আজ শেষ বিকেলের আলোয় আমার একটাই খালি চাওয়া

চাইলেই তুমি দিতে পারো সহজেই

ভার্সিটির প্রতিটি বিকেল তোমার স্মৃতিতে নাওয়া

দাও একটা বিকেল যাতে তুমি মিশে নেই…

আমি আমার হারানো প্রেমের চোখে এমন দুর্লভ মায়াবী একটা চাহুনি দেখলাম অতনুর প্রতি, যা একটিবার, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্যও যদি আমার জন্য হতো, আমি ধন্য হতাম!

বিকেলে টিএসসিতে অতনু গিটারটা ফেরত দিতে এলে আমি হাসিমুখে তা ফেরত নিই। ও চলে গেলে সবার সামনে গিটারটা শক্ত পাথুরে মেঝেতে আছড়ে ভাঙি। আমার সুর আমার পিঠে ছুরি বসিয়েছে। আমার আর গান লেখার শখ নেই!

দিনকয়েক পরের ঘটনা। শীত প্রায় শেষ, বসন্ত হয় হয়। মধ্যে আবার ক্যাম্পাসে যাইনি প্রায় এক সপ্তাহ। হঠাৎ একদিন সাতসকালে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। আমি আবার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর পাঁয়তারা করছি, এমন সময় আম্মুর ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়। এই ভোরবেলা কে নাকি দেখা করতে এসেছে আমার সঙ্গে!

ড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি একদম জমে যাই পুরোপুরি!

‘কী রে ক্যাবলা, রাগ করেছিস আমার ওপর?’

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে ও-ই প্রথম মুখ খোলে। ওর হাতে সুন্দর করে র‌্যাপিংপেপারে মোড়ানো ওটা কী? দেখে তো গিটার মনে হচ্ছে!

ও আমার ইঞ্চিখানেক দূরত্বে এসে দাঁড়ায়। মধ্যে থাকে কেবল একটা গিটার, র‌্যাপিংপেপারে মোড়া সুদৃশ্য সেই গিটার!

‘আমাকে নিয়ে গান লিখিস লুকিয়ে লুকিয়ে, আমাকে বলিসনি কেন?’ ও যুদ্ধাংদেহী ভাব ধারণ করে! আমি কাঁচুমাচু করি। ও আরো কাছে সরে আসে, আমি সন্ত্রস্ত হই—

‘আম্মু আছে বাসায়!’

‘তাই না? আমাকে নিয়ে যখন গান লিখিস, তখন তোর মা এসে পিটুনি দেয় না?’ ও আমার পিঠে মৃদু কিল দেয়।

‘একটুতেই এত রাগ? অতনু না হয় একবার গানই শুনিয়েছে আমাকে, তাই বলে নিজের গিটার ভেঙে ফেলেছিস।’ ও আবার মেকি রাগের ভাব দেখায়—‘কত পয়সা খসালি আমার দেখ!’

আমার হাতে গিটার তুলে দিয়ে ও একটু দূরে দাঁড়ায়—

‘চে গুয়েভারা, অ্যাঁ? তা বিপ্লবী, অস্ত্রের বদলে গিটার কেন তোমার হাতে?’

‘যে যুদ্ধের যা অস্ত্র’, মৃদু হেসে বলি আমি!

সেদিন প্রথমবারের মতো এনাবেল লির হাত বনলতা সেনের প্রেমিকের হাতে মুঠোবন্দি হয়। চোখে চোখে বলা হয়ে যায় মাসখানেকে জমানো অনেক না-বলা কথা।

বন্ধু মহল এখনো আমাকে জিজ্ঞেস করে, সেদিন এনাবেল লির অধরে বনলতা সেনের প্রেমিকের অধর মিলেছিল কি না। আমি মুচকি হেসে বলি—সে গবেষণা জাতির বিবেকই করুক!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত