জুলির ডায়েরির পাতায়,
আমি জুলি, ‘এ’ লেভেলের একজন স্টুডেন্ট। হিমেল আমার চাচাতো ভাই। আমরা এক সঙ্গেই বড় হয়েছি। আমি যখন থেকে বুঝি ভালোবাসা কী, ঠিক তখন থেকেই ওকে ভালোবাসি। কিন্তু কোনো দিন বলা হয়নি। হিমেলও ব্যাপারটি বোঝেনি। বুঝবেই বা কিভাবে, একসঙ্গে বড় হয়েছি, তাই সে আমাকে আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করেনি। ও ছেলে হিসেবে কেমন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি ওকে ভালোবাসি বলে নয়, সত্যি বলতে ও একটু আলাদা, আবার অদ্ভুত টাইপেরও বটে। ওর অদ্ভুত টাইপটাও আমার অনেক ভালো লাগে। ওর সঙ্গে থেকে ওর অদ্ভুদ চিন্তাগুলো আমার মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। তার পরও কেন জানি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’—এই তিন শব্দের বাক্যটি ওকে বলতে ইচ্ছা করে না।
কয়েক মাস ধরে আমি একই তারিখে ১৪৩ টাকা করে ওর মোবাইল নম্বরে পাঠাচ্ছি। আমার এই কাজগুলো ও কখনোই বুঝতে পারত না। হিমেল প্রায়ই বলে, ‘জুলি, মোবাইল রিচার্জটা আমি এখনো পাচ্ছি, কী করি বলো তো?
তো, আমি ওকে একদিন বললাম, ‘এটা কোনো মেয়ের কাজ। যে ১৪৩ (১৪৩=I love you) টাকা দিয়ে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটাই বারবার বলতে চাচ্ছে।’
হিমেল বলল, ‘আমারও তা-ই মনে হয়। কিন্তু এটা সম্ভব না? আমার কারো মায়ায় আবদ্ধ হতে একেবারেই ইচ্ছা করে না। মায়ায় আবদ্ধ হওয়া মানেই একটা ঘোরের মধ্যে আটকে পড়া। এ কথাটি ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মুক্তপ্রিয়। স্বাধীনভাবে থাকতেই ভালো লাগে।’
—হুম, আমি জানি। স্বাধীনপ্রিয় বলেই খরচের টাকা বাঁচিয়ে নিউ মার্কেট যাস পাখি কিনতে। আর কেনার কয়েক মিনিট পরই পাখিগুলো উড়িয়ে দিস আকাশে। তুই আসলেই একটা অদ্ভুত পাগল।
একদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছি, হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি, হিমেল কিছু ছোট ছেলেদের সঙ্গে। আমি কৌতূহলে দৌড়ে যাই দেখতে।
—কী রে, তুই এখানে কী করিস?
—ছোট ছেলেদের দেখিয়ে হিমেল বলল, ‘দেখ না, এইটুকু বয়সে কাজ করার জন্য মা-বাবার আদর ছেড়ে ঢাকা আসতে হয়েছে ওদের। ওরা এখানকার দোকানগুলোতে খুব পরিশ্রমের কাজ করছে। এদের কাজ করতে দেখলে খুব কষ্ট হয়। আমরা কিভাবে বড় হয়েছি আর ওরা কিভাবে বড় হচ্ছে। জুলি, প্রতিদিন বিকেলে ওরা ছুটি পায়, আমিও মাঝেমধ্যে আসি ওদের সঙ্গে খেলতে। আর জানিস, ওদের কারো ফোন নেই বলে ওরা ওদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। আমি মাঝেমধ্যে আমার ফোনটা ওদের কথা বলার জন্য দিই। জুলি, একটি মজার বিষয় কি জানিস, ওই যে ১৪৩ টাকা আমার ফোনে আসে, ব্যালান্সটা আমি ব্যবহার করি না, ওদের দিয়েই শেষ করি।’
আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমার শুধু হিমেলের কথাগুলো শুনতেই ভালো লাগছিল। তার পরও মজা করার জন্য বলি,
—হিমেল, আমার তো মনে হচ্ছে, ওই মেয়েটি একদিন না একদিন তোর কাছে ধরা দেবে, তখন কি রিচার্জের টাকাগুলো ফেরত দিবি না?
—অবশ্যই, ফেরত দেব। এই অদ্ভুত রিচার্জ পাওয়াতে নিজেকে ঋণী ভাবছি। খুব অস্থিরতা অনুভব করছি। আর এই ভেবে রিচার্জের টাকাটা ওদের দিয়েই কথা বলাই। কেননা ওই মেয়ে আসার আগেই যদি মারা যাই!
—তুই মারা যাবি কেন? তুই হাজার বছর বেঁচে থাকবি। তুই কারো মাঝে বেঁচে না থাকলেও আমার মাঝে বেঁচে থাকবি। আমি যদি তোর চেয়ে এক মিনিট বেশি বেঁচে থাকি, ওই এক মিনিটও তুই আমার মাঝে বেঁচে থাকবি।
হিমেল কিছু বলেনি। আমি তখন ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলে চলে আসছিলাম। ঠিক তখনই সবার চেয়ে ছোট ছেলেটা দৌড়ে এসে বলল—আপু, হিমেল ভাই এত ভালো কেন? আমি ছেলটিকে কিছু না বলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। আর মনে মনে বলতে থাকি, ‘হিমেল তুই অনেক ভালো’, ‘হিমেল তুই অনেক ভালো’…।
‘হিমেল তুই অনেক ভালো’—এ কথাটি জুলি এক হাজারবারেরও বেশি লিখেছে। ডায়েরিতে খালি পেজ থাকলে হয়তো আরো লিখত।
আজ ১৩ নভেম্বর, আজ রাত ১১টায় হিমেলের ফ্লাইট। ও কানাডা যাচ্ছে মাস্টার্স আর পিএইচডি করার জন্য। ওকে যে কেউ দেখলেই মনে করবে, আজ হিমেলের আনন্দ দিবস। হিমেলের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আনন্দ-উল্লাস কাজ করছে। কাজ করারই কথা। আজ হিমেলের ১১ বছরের স্বপ্ন পূর্ণ হতে যাচ্ছে।
হিমেল যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন ওর স্কুলে কয়েকজন কানাডিয়ান ভিজিটর আসেন। ঠিক তখন থেকেই কোনো এক বিচিত্র কারণে ওর মধ্যে কানাডা যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে। হিমেলের দিন-রাতের ভাবনার মধ্যে কানাডা যাওয়ার ইচ্ছাটি যুক্ত হয়ে যায়। আর ও জানতে শুরু করে কানাডার কালচার সম্পর্কে। এমনকি হিমেলের চিন্তার ডায়েরিতে যুক্ত হয় কানাডার সৌন্দর্যের তালিকা। আর হিমেলের কল্পনাজুড়ে কানাডার Abraham Lake, BANFF NATIONAL PARK। শুধু তা-ই নয়, কানাডার সব জায়গা সম্পর্কে হিমেলের জানা। কোথায় কিভাবে যেতে হবে, কোথায় থাকতে হবে, যাতায়াতের ভাড়া, খাবারের মূল্য—সবই হিমেল ওর ‘কানাডা হিজিবিজি নোট’ নামের ডায়েরিতে লিখে আসছে। আজ হিমেলের হাতে Brock University-এর scholarship-এর লেটার।
তার পরও ভাগ্যের কী পরিহাস! যে মানুষটা হিমেলের Brock university’s scholarship-এর কথা শুনে সবার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল, সেই জুলিটা আজ সাত দিন ধরে হাসপাতালের বেডে। জুলিকে এ অবস্থায় রেখে হিমেলের যেতে ইচ্ছা করছে না। জুলিটার সুস্থ হতে আর কত দিন লাগবে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা নাকি জুলির রোগটাই আইডেন্টিফাই করতে পারছেন না। হিমেল দুপুর পর্যন্ত জুলির কাছেই ছিল। হিমেল বিকেলে আরো একবার জুলির কাছে যাবে। হিমেলের ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ও যখন জুলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে চাইবে, তখন জুলি ওর হাত ধরে বলবে, ‘হিমেল, তুই নিজের খেয়াল রাখিস।’
বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট। হিমেল ডাক্তারের সামনেই বসা। আর জুলি ICO-তে।
—ডাক্তার হিমেলকে বলল, ‘হিমেল প্রত্যেক মানুষকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। আবার আমাদেরকেও কাছের মানুষের মৃত্যু গ্রহণ করতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শুধু ব্যতিক্রম মায়েদের ক্ষেত্রে। কোনো মা-ই সন্তানের মৃত্যু গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখেন না। হিমেল, আমরা জুলিকে আর দুই দিনের বেশি ধরে রাখতে পারছি বলে মনে হয় না। জুলির সময় ঘনিয়ে আসছে। ওকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমাদের নেই। আর এই খবরটা জুলির মাকে দেওয়ার ক্ষমতাটাও আমার নেই।’
হিমেল বাসায় ফিরেই পাখিটির দিকে তাকাল। পাখিটিকে দেখে মনে হচ্ছে, পাখিটি পুরোপুরি উড়তে শিখেছে। হিমেলের পাখি পুষতে ভালো লাগে না, মুক্ত করে দিতেই ভালো লাগে। তার পরও পুষতে হচ্ছে। কেননা জুলি ইচ্ছাকৃতভাবেই উড়তে পারে না এমন একটি বাচ্চা পাখি হিমেলকে দিয়েছিল। যেন হিমেলকেই পুষতে হয়।
হিমেলের ১১টায় ফ্লাইট বলে ও সব কিছু নিয়েই রেডি। এখন বাজে ৬টা ৫৯ মিনিট। হিমেল সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে আর মনে মনে বলছে, ‘আল্লাহ আমার দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তার পরও কেন জানি মনে হচ্ছে, একটি মানুষের একটি স্বপ্নই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমি আমার ১১ বছরের স্বপ্নটি দিয়ে দিলাম। তুমি আমার জুলিকে ফিরিয়ে দিয়ো।’
আঁধার ঘনিয়ে আসছে। হিমেল ছাদের রেলিংয়ের পাশে, ডান হাতে জুলির দেওয়া পাখিটি আর বাঁ হাতে ওর Scholarship’s letter, Certificate, passport, আর বিমানের টিকিট। হিমেল দাঁড়িয়ে মেঘের ডাক শুনছে। মেঘগুলো ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে। মনে হয়, বৃষ্টি হবে। আর সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস।
হিমেল পাখিটি উড়িয়ে দিল আকাশে আর কাগজগুলো উড়িয়ে দিল বাতাসের সঙ্গে। পাখিটি উড়ে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীন কোনো গন্তব্যে। আর কাগজগুলো মাটিতে পড়ার আগেই জুলি এই গ্রহের মায়া ত্যাগ করেছে। মেঘগুলো এসে জুলিকে ডেকে নিয়ে গেল মেঘেদের দেশে।