– “তোমার ছেলে…”। আম্মু একটু টেনে টেনে কথাটা বলে থামলেন।
আব্বু, আম্মু আর অরণ্য রাতের বেলা একসাথে খেতে বসেছিল। আম্মু সবার প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে আব্বুকে কথাটুকু বললেন।
আম্মুর কথা শুনে আব্বু মুখে কিছু না বলে শুধু মুখ তুলে আম্মুর দিকে তাকালেন, যেন এর পরে আম্মু কি বলবে তা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
অরণ্যও ভাত মাখাতে মাখাতে থেমে যেয়ে আম্মুর মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছিল যে আম্মু কোন প্রসঙ্গে কি বলতে চাইছেন। আম্মু অনেকক্ষেত্রেই তাকে নিয়ে কিছু একটা কথা তার আব্বুকে বলার সময় ‘তোমার ছেলে’ বলে থাকেন।
অরণ্য মনে মনে গুনতে শুরু করল,
আম্মু যখন কোনও কিছু নিয়ে রেগে যায় তখন ‘তোমার ছেলে’ বলে;
আম্মু যখন কোনও কিছু নিয়ে দুঃখ পায় তখন ‘তোমার ছেলে’ বলে;
আম্মু যখন কোনও কিছু নিয়ে অভিমান করেন তখন ‘তোমার ছেলে’ বলে,
আম্মু যখন কোনও কিছু নিয়ে মজা করেন তখন ‘তোমার ছেলে’ বলে;
আম্মু যখন…
অরণ্য আর বেশি দুর ভাবতে পারল না; আম্মু আবার বলা শুরু করলেন, “…তোমার ছেলে বড় হয়ে গেছে। এখন আর আমার হাতের রান্না ওর ভাল লাগছে না। এবার ওর বিয়ে দিয়ে দাও – বৌয়ের রান্না খেয়ে দেখুক।“
আব্বু আম্মুর কথা শুনে একটু মুচকি হেসে আবার প্লেটের ভাতের দিকে নজর নামিয়ে বললেন, “ভালই তো! অরণ্যের বিয়ে দিলে তোমারও সারাদিন একজন সঙ্গী হয়। তা, তোমার জানাশোনার মধ্যে সে রকম কোনও মেয়ে আছে নাকি?”
অরণ্য বুঝতে পারল যে আম্মু কোনও কিছু একটা নিয়ে অভিমান করেছে আর আব্বু যথারীতি আম্মুর সাথে মজা করছে। অরণ্য অবশ্য বুঝতে পারল না যে আম্মু হঠাৎ এমন কথা কেন বলছেন।
তবে আব্বু-আম্মুর এইসব বিয়ে-বিয়ে কথাবার্তা আর যেন না বাড়ে তাই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “তা কেন আম্মু! তোমার রান্না তো আমার খুব ভাল লাগে। তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সেরা রাধুনী। দেখ না, তোমার রান্না আমি কেমন গপগপ করে খাই?”
আব্বু এবার অরণ্যের সাথে গলা মেলালেন, “একদম ঠিক বলেছিস অরণ্য। তোর আম্মুর রান্না খেয়ে খেয়ে প্রতি দুই মাস পরপর আমার আগের জামা-কাপড় সব চেঞ্জ করতে হয়।‘ তারপর আম্মুর অভিমান করার কারন জানতে আবার যোগ করলেন, ‘তা অরণ্য, সত্যি করে বল তো, তুই কি করেছিস!“
অরণ্য মনে করার চেষ্টা করল, ‘সকালে বা দুপুরে খাওয়ার সময় কি সে কিছু বলেছিল? বা কোনও কিছু নিয়ে নাক সিটকেছিল? কই মনে পড়ছে না তো!’
আম্মুই রহস্য ভাঙলেন, “তোমার ছেলে আজকে স্কুলে যাওয়ার সময় বলে কি জানো! বলে, আম্মু, আজকে টিফিন দিওনা, বরং এক’শ টাকা দাও। আমি ভাবলাম আজ বুঝি ওর কোনও বন্ধুর জন্মদিন, সেখানে দাওয়াত আছে তাই টিফিন নিবে না আর এক’শ টাকায় কোনও গিফট কিনবে।’
‘তুমি তো জানই, আমি ওর সব বন্ধুদেরই চিনি, ওদের জন্মদিনও আমার জানা আছে, জন্মদিনের গিফটগুলো তো আমাকেই কিনতে হয়। কিন্তু, কই, আজ কারো জন্মদিন বলে তো মনে পড়ছে না! তো, তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কিরে, আজকে কার জন্মদিন?’
তা, তোমার ছেলে কি বলল জান! সে বলে, না আম্মু, আজকে কারো জন্মদিন নাই। আজকে টিফিনে প্রতিদিনের মত রুটি-ভাজি-ডিম না খেয়ে বার্গার খেতে ইচ্ছা করছে। আমাদের স্কুলের সামনে একটা দোকান আছে, আজকে ওখান থেকে টিফিনে বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কনে খাব।“
আম্মুর কথা শুনে আব্বু হো হো করে হেসে দিলেন, “এ আর এমন কি? একদিন তো অরণ্যের বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে ইচ্ছা করতেই পারে! তোমারও তো কতদিন মনে হয় যে আজকে প্রতিদিনের রান্না না খেয়ে সবাই মিলে চাইনিজ খেয়ে আসতে। তাতে এমন কিই বা হয়েছে?’ তারপর আব্বু অরণ্যের দিকে ফিরে বললেন, ‘অরণ্য, তুই আমাদের ফেলে একাএকা বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে ফেললি? এরপর একদিন তোর স্কুলের সামনের সেই দোকানের বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বাসায় নিয়ে আসিস, আমরা সবাই মিলে একসাথে খাবো।“
অরণ্য কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এর জন্য এত কিছু হবে সে চিন্তা করেনি। অরণ্য বলল, “না, আসলে হয়েছে কি, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে, নাম রিয়া। খুব অহংকারী, আমাদের কারো সাথে মিশে না, কথাও বলে না।
লাল টুকটুকে একটা গাড়িতে করে রোজ স্কুলে আসে। সেই গাড়ী আবার ড্রাইভার চালায়। সঙ্গে একটা আয়া খালা থাকে, সে রিয়ার ব্যাগটা স্কুলের গেট পর্যন্ত নিয়ে আসে আর তারপর রিয়া ব্যাগটা নিয়ে সোজা ক্লাসে যেয়ে বসে।
টিফিন পিরিয়ডে আমরা সবাই যখন একসাথে ভাগাভাগি করে টিফিন খাই, তখন রিয়া প্রতিদিন ওই দোকান থেকে বার্গার, স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই – এইসব কিনে খায়।
ওকে খেতে দেখে আমারও একটু একটু খেতে ইচ্ছা করত, তাই আজকে আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম।“
অরণ্যের কথা শুনে আব্বু-আম্মু কেমন থমকে গেলেন। আম্মু বললেন, “তোদের ক্লাসে নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে? কই জানি নাতো!’
তারপর আব্বুর কাছে জানতে চাইলেন, এই এলাকায় নতুন কেউ এসেছে নাকি?”
আব্বু স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করেন। অনেকদিন হল এই শহরে আছেন, সবাইকে চেনেনও। নতুন কেউ আসলেও তিনি চিনবেন, এই কারনে আম্মু প্রশ্নটা আব্বুকে করলেন।
আব্বু অরণ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটার বাবার নাম জানিস?”
অরণ্য বলল, “রিয়ার বাবার নাম তো জানি না তবে রিয়ার ভাল নাম রিয়া কাশেম।“
অরণ্যের কথা শুনে আব্বুর মুখটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। তিনি আম্মুকে বললেন, “যা ভেবেছি ঠিক তাই! মেয়েটা কাশেম সাহেবের মেয়ে। কাশেম সাহেব মাস খানেক আগে বিদেশ থেকে ফিরে এই শহরে এসেছেন, ব্যাবসা করেন। ভদ্রলোক বিপত্নীক।
শুনেছি, ভদ্রলোক ব্যাবসার কাজে সারাদিন বাহিরে থাকেন, কখনো শহরের বাহিরেও যেতে হয়, মেয়েটা বাসাভর্তি কাজের মানুষের কাছে থাকে। তারাই ওর দেখাশোনা করে।“
আব্বুর কথা শুনে আম্মুর মুখটাও কেন যেন ম্লান হয়ে গেল।
পরদিন অরণ্য যখন নাস্তা করে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল, আম্মু অরণ্যকে দুইটা টিফিন বক্স দিলেন।
অরণ্য অবাক হয়ে বলল, “আম্মু তুমি দুইটা টিফিন বক্স দিচ্ছ কেন? আমি তো এত খেতে পারবো না!”
আম্মু বললেন, “আরে গাধা ছেলে, তোকে দুইটা টিফিন খেতে হবে না। আজকে টিফিন পিরিয়ডে রিয়াকে ডেকে একটা বক্স দিবি আর ওর সাথে একসাথে বসে খাবি।“
অরণ্য একটা ইতস্তত করল, “যে অহংকারী মেয়ে, আমাদের সাথে কথাই বলতে চায় না। যদি না নেয়?”
আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “নিবে না মানে? রিয়া নিতে না চাইলে বলবি যে আম্মু এটা নিতে বলেছে। আর বলেছে, না নিলে আম্মু ওর কান মলে দিবে।“
সেদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা বাজতেই ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে এক সাথে হৈ-হৈ করে উঠল। যে যার টিফিনের বাক্স খুলে বসল আর রিয়া তার বেঞ্চ ছেড়ে দরজার দিকে হাঁটা দিল।
অরণ্য পিছন থেকে ডাকল, “এই রিয়া শোন?”
রিয়া পিছন ফিরে তাকাতেই অরণ্য একটা টিফিন বক্স রিয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “এটা নে, আম্মু তোর জন্য পাঠিয়েছে।“
রিয়া কি করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঝের নকশা দেখতে শুরু করল।
অরণ্য আবার বলল, “নে, আমার সাথে বসে টিফিন করে নে। আম্মু বলছে, তুই না খেলে আম্মু স্কুলে এসে তোর কান মুলে দেবে।“
অরণ্যের কথা শুনে রিয়ার কি যেন হল। ওর ঠোঁটের কোনা কাঁপতে শুরু করল, চোখ দুইটা ছলছল করে উঠল, যেন এখনই কেঁদে ফেলবে।
অরণ্য রিয়াকে দেখে অবাক হল। কানমলার কথা শুনেই এত ভয় পায় কেউ। মেয়েরা এত ছিঁচকাঁদুনে হয়!