জীবনানন্দিতা

জীবনানন্দিতা

নন্দিতা, ক্লাস ইলেভেন, আমার দুর্বলতা—আমাদের পাড়াতেই থাকে। আমি আপাতত স্নাতকপর্ব পার করে চাকরির চেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিকে-ওদিকে কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে বেড়াই। আর হ্যাঁ, অবসরে সময়-সুযোগ পেলেই আমি আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ এবং তাঁর কবিতায় ডুবে থাকি।

আমার “নন্দিতাপ্রেম”এর কথা নন্দিতা না জানলেও আমার বন্ধুরা জানত। সেই বন্ধুরা, যারা সবাই একটা করে “নন্দিতা” জুটিয়ে ফেলেছে—তাদের ক্রমাগত “উৎসাহ” আর ভিতরের তাড়না থেকে তাই “চলো কিছু করে দেখাই” ভেবে মাঝে একদিন সাহস জুটিয়ে স্কুলফেরত নন্দিতাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলে ফেললাম, তোমার সঙ্গে ক’টা ব্যক্তিগত কথা আছে। আমাকে একটু সময় দেওয়া যাবে?

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই ভয় হচ্ছিল, এবার না উল্টোদিক থেকে তেড়ে কিছু শব্দ এসে আমাকে স্রেফ উড়িয়ে দেয়। দেখলাম সে-সব কিছুই হল না। নন্দিতা খুব ক্যাজুয়ালি বলল, এখন তো সময় নেই, পরে কখনও…দেখি। ব্যস! এরপর নন্দিতা উধাও।

সেদিনের সেই “দেখি”র প্রকৃত অর্থ অনুধাবন না করতে পেরে, সেই “দেখি” অনেকদিন হয়ে গেল দেখে, একদিন ফের স্কুলফেরত নন্দিতাকে ধরব বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, দেখা গেল, সে পথ দিয়ে নন্দিতা নয়, নন্দিতার বোন, নবম শ্রেণী, ইপ্সিতা আসছে।

সামান্য হতাশ আমি তবুও গলাটা যথাসাধ্য মোলায়েম এবং আন্তরিক করে ইপ্সিতাকে বললাম, আরে ইপ্সিতা, কেমন আছিস? আমার প্রশ্নের উত্তরে ইপ্সিতার একটুও ইতস্তত না করে “দারুণ আছি শৈলেনদা। তুমি কেমন আছ?” উত্তর শুনে কেন জানি না মনে হল, এমনকি ওকেও সম্ভবত এমন “হাই”, “হ্যালো”র মুখোমুখি মাঝে-মাঝেই হতে হয়। ফলে আমিও একটু নিশ্চিন্ত হয়ে এরপর ইপ্সিতার সঙ্গে আরও দু-চার মিনিট হাবিজাবি বকার পরেও নন্দিতার দেখা নেই দেখে ইপ্সিতাকে বলেই ফেললাম, কী ব্যাপার, তোর দিদিকে দেখছি না আজ। ইপ্সিতা ঠোঁটে একটা অর্থবোধক হাসি ঝুলিয়ে বলল, দিদির জ্বর হয়েছে, আজ স্কুলে যায়নি।

এরপর আর আমার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। তাই কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখিয়ে ইপ্সিতাকে বললাম, আমি চলি রে, পরে কথা হবে। ইপ্সিতাও হাত নেড়ে চলে গেল।

ইপ্সিতার সঙ্গে দেখা হবার কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় তখন বাড়িতে আমি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ানোয় ব্যস্ত—দেখি, নন্দিতা-ইপ্সিতার বাবা শ্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মানে রবীনকাকু আমাদের বাড়িতে হাজির। রবীনকাকুকে দেখে প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম নন্দিতা তার বাবাকে কিছু বলেছে কিনা, ভয় পাচ্ছিলাম ইপ্সিতার কাছে নন্দিতার খোঁজ করেছি—সে জন্যেই রবীনকাকু এসেছেন কিনা। ভিতরে ভিতরে প্রবল ঘামছিলাম। তবু নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, কাকু, ভিতরে আসুন।

রবীনকাকু “ভিতরে” এলেন, চেয়ারে বসলেন—এবং প্রায় বিনা ভূমিকায় বললেন, শৈলেন, তুমি কি আমার মেয়ে ইপ্সিতাকে একটু ইংরেজিটা দেখিয়ে দিতে পারবে? মানে তোমার কি ওকে পড়ানোর মতো সময় হবে?

বলাই বাহুল্য এমন একটা দুরন্ত প্রস্তাবের জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তবু রবীনকাকুর অমন প্রস্তাব শুনে আমি সে মুহূর্তেই মনে মনে দেখলাম, আমি ইপ্সিতাকে ইংরেজি পড়াচ্ছি… লোডশেডিং… হ্যারিকেনের আলো… চায়ের কাপ হাতে নন্দিতার প্রবেশ… হ্যারিকেনের লাল আলো… নন্দিতার উজ্জ্বল মুখে স্বর্গীয় আভা…।

হয়ত আরও অনেক কিছু ভাবতাম—সংবিৎ ফিরল রবীনকাকুর কথায়, কী হল শৈলেন, তোমার কি সময় হবে না?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ কাকু, হবে, সময় হবে। আমি তাড়াতাড়ি উত্তর দিলাম।
—তুমি কি কাল থেকেই পড়াতে পারবে? ফের রবীনকাকুর স্পষ্ট প্রশ্ন।
রবীনকাকুর প্রশ্ন শুনে মনে মনে বললাম, কাকু, পারলে তো আজ থেকেই পড়াই… মুখে বললাম, ঠিক আছে কাল থেকেই যাব। কাল সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা নাগাদ ইপ্সিতাকে তৈরি থাকতে বলবেন। সপ্তাহে তিনদিন পড়াব। তাতে হবে তো?

এবার রবীনকাকু আমাকে হতাশ করে বললেন, তিন দিন হবে না হে, ওটা তুমি দু-দিন কর। অন্যান্য সাবজেক্টেরও তো পড়ার চাপ আছে।

রবীনকাকুর উত্তরে সামান্য ঝিমিয়ে পড়া আমি বললাম, ঠিক আছে কাকু, সপ্তাহে দু-দিন। বুধবার আর শুক্রবার। ভালোই হল কাল শুক্রবার পড়েছে…

—আর ইয়ে, ওই টাকা-পয়সার ব্যাপারটা…। রবীনকাকু থেমে থেমে বলেন।
—আরে ওটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না কাকু। আপনি বাড়ি যান।
—না, না, তবুও…
—বললাম তো, আমি ঠিক সময় বলে দেব।

রবীনকাকু নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। আনন্দে সে রাতে আমার ভালো করে ঘুম হল না।

পরদিন সন্ধ্যায় “ভট্টাচার্য” বাড়ির সদর দরজার মাথার উপরে বসানো কলিং বেলটা চেপে ধরার দেড় মিনিটের মধ্যে এলোমেলো পোশাকের উপর একটা চাদর জড়ানো যে এসে হাজির হল, তাকে আমি সে মুহূর্তে সেখানে আশা করিনি। আমাকে বাড়ির দোরগোড়ায় দেখেই নন্দিতার ভুরুজোড়া সোজা উপর দিকে উঠে গেল এবং তারপর সে কোনওরকম ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, কাকে চাই?

ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে গিয়ে কোনও বাড়িতে প্রথম দিন এমন অভিজ্ঞতা হলে, আমি আর সে বাড়িমুখো হতাম কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু এখানে আমার আপাত প্রতিপক্ষ যেহেতু নন্দিতা, তাই যেন ঝড়ের শব্দেও আমি টের পেলাম বসন্‌ত্‌ রাগ। তারপর গলায় যথাসম্ভব শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্য এনে বললাম, কাউকে চাই না। আমি ইপ্সিতাকে পড়াতে এসেছি। ইংরেজি।

আমার এমনতর উত্তরের জন্য যে নন্দিতা “সম্ভবত” নয় “নিশ্চিতভাবেই” প্রস্তুত ছিল না সেটা বোঝা গেল উল্টোদিক থেকে ফের ধেয়ে আসা প্রশ্নে, বাবা কি তাহলে কাল রাতে তোমাদের বাড়িতেই গিয়েছিল?

আমি টের পাচ্ছিলাম যে, নন্দিতার প্রশ্ন করার ধরনটা আমাকে উত্তেজিত করে তুলছে। কী বলতে, কী বলতাম কে জানে। বাঁচিয়ে দিলেন রবীনকাকু এসে। নন্দিতাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে রবীনকাকু আমাকে বললেন, আরে শৈলেন, এসো, এসো। তারপর নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, নন্দিতা, ওকে পড়ার ঘরে নিয়ে যা।

রবীনকাকুর কথায় আমি স্পষ্ট দেখলাম নন্দিতার নাকের পাটা-দুটো, লাল হয়ে গেছে। তবু মাস্টারমশাই বলে কথা। নন্দিতা, মুখটা ব্যাজার করে রেখেই বলল, এসো।

ভট্টাচার্য বাড়ির কোণার দিকে একটা ঘরে আমাকে বসানো হল। দেখলাম সে ঘরে রয়েছে একটা পড়ার টেবিল আর তিনটে চেয়ার। চেয়ারগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে, ওগুলো বাতিল ডাইনিং টেবিলের সেট থেকে আমদানী করা। টেবিলের একদিকে একটা চেয়ার রাখা ছিল, যেটাতে আমি বসলাম। অন্যদিকে ছিল দু-টো চেয়ার, যার একটাতে ইপ্সিতা বসল। নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে প্রথমেই মনে হল, আহা, যদি এমন হত—ওদিকে নন্দিতা, এদিকে আমি…!

আমার চিন্তার মধ্যবর্তী সময়ে টেবিলের ও-প্রান্তে বসা ইপ্সিতা উসখুস করছে দেখে “মুখোমুখি বসিবার” কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরলাম দ্রুত। পড়ানোর প্রথম দিন, তাই সব গার্জিয়ানরা ইংরেজি সাহিত্যের যে “বেস”এর খোঁজ করেন, সেটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে ইপ্সিতাকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম “টেন্স”এর চত্বরে। বারোটা টেন্সের মধ্যে ব্যবহারিক জীবনে দশটার সঠিক ব্যবহার বুঝিয়ে যখন উঠব-উঠব করছি, ঘড়িতে সময় দেখলাম সাড়ে ন’টা। বুঝতে পারলাম প্রায় ঘন্টা তিনেক একটা ঘোরের মধ্যে পড়িয়ে গেছি। এরই মধ্যে বারবার আমার চোখ খুঁজেছে “তাকে”। এরই মধ্যে চা-বিস্কুট এসেছে, জল এসেছে, কিন্তু নন্দিতা আসেনি। একবারও আসেনি। তবে এর মধ্যেও একটা ভালো লাগার ক্ষণ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন নন্দিতা-ইপ্সিতার মা। কাকিমা নিজের হাতে চা-বিস্কুট, জল পৌঁছে দিয়ে সেদিন বলেছিলেন, শৈলেন একদম “নিজের জন” মনে করে পড়াবে। আহা, কাকিমা না জেনেই কী সুন্দর আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছিলেন সেদিন!

ইপ্সিতাকে মাসখানেক পড়ানোর পরই টের পেতে শুরু করলাম বুধবারের পর শুক্রবারটা খুব তাড়াতাড়ি আসে, কিন্তু শুক্র থেকে বুধ বড্ড দূরে। এর মধ্যে পড়াতে গিয়ে যতবার মুখোমুখি হয়েছি নন্দিতার, দেখেছি আপোষহীন এক জোড়া চোখ একরাশ অপছন্দ নিয়ে আমাকে মেপে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হত, আমি তো ওর কোনও ক্ষতি করিনি। আমি ওকে ভালোবাসি—এটা কি কোনও অপরাধ? তবে কেন…?

বন্ধু-বান্ধবদের নন্দিতার সেই “দৃষ্টি”র কথা বলাতে ওরা বলল, দেখ, এমনটা হয়, হয়ে থাকে, অত চিন্তার কিছু নেই। ওদের কথায় ফের উৎসাহিত হয়ে নন্দিতায় আনন্দিত থাকার চেষ্টা করা শুরু করলাম আমি। শুধু একটা ব্যাপার তাও আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। আমি বুঝতে পারছিলাম না, এই অপছন্দ ব্যাপারটা পার্মানেন্ট কিনা। মনে হত, যদি তেমনটা হয়, তাহলে আর এত ঝামেলা করে আলেয়ার পিছনে দৌড়ে বেড়ানো কেন!

এভাবে নন্দিতার চরম ঔদাসীন্যের মধ্যে মাস কয়েক কেটে যাবার পর নিজেকেই একদিন বললাম, – এখানে তোমার জন্য কিছু নেই। এবং এর কিছুদিন পরই “এ পাট চুকাতে হবে” ভেবে অভিমানী আমি একদিন রবীনকাকুকে বলেই ফেললাম, কাকু, একটা কথা বলি—আমি আজকাল চাকরির পরীক্ষার পড়া নিয়ে একটু চাপে পড়ে গেছি। আপনি যদি ইপ্সিতার জন্য অন্য কাউকে…।

আমার কথা শেষ হবার আগেই রবীনকাকু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, তা বললে তো হবে না বাছা। তুমি যে পদ্ধতিতে পড়াও, তার সঙ্গে ইপ্সিতা পুরো মিশে গেছে। আমি খেয়াল করেছি, আজকাল ইংরেজিই ওর প্রিয় সাবজেক্ট হয়ে গেছে। এ সবই তোমার কৃতিত্ব। যাব বললেই হবে নাকি? প্রয়োজনে তুমি সপ্তাহে একদিন পড়াও। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া যাবে না।

ওদিকে আমার গভীরে তখন অভিমানের আগুন, তাই ফের মিথ্যে অজুহাত দিয়ে বললাম, আমি নিজে .বি.সি.এস. পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আজকাল। আমার পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি না হয় আবার আসব। মাঝের এই দু-তিনটে মাস যদি…।

কথাগুলো আমি একটু জোরে জোরেই বলেছিলাম। আমি কি চাইছিলাম যে, আমার এই অভিমানের পাতাগুলো নন্দিতা অবধি পৌঁছক? সে জন্যেই কি ওই উচ্চকিত উচ্চারণ?

হয়ত সেটাই চেয়েছিলাম। তাই আমার সে ইচ্ছা পূরণ করে মিনিট খানেকের মধ্যেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল নন্দিতা। আমার চোখে চোখ রেখে তার প্রথম কথা, যাবে মানে? বছরের মাঝখানে যাব বললেই যাওয়া যায় নাকি? না, না, ওসব হবে না। শুধু এ বছর না, মাধ্যমিক অবধি ইপ্সিতাকে তোমাকেই পড়াতে হবে।

আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই নন্দিতা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কোনও কথা নয় শৈলেনদা। বুধ-শুক্র যেমন আসছ, আসবে। পারলে সঙ্গে “সোমবার”টাও জুড়ে নাও।

নন্দিতার মুখে “শৈলেনদা” শুনে আমার হঠাৎ মনে হল, আমার মাথার উপরে কেউ হাল্কা করে ফ্যানটা “দুই”এ চালিয়ে, চুলগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছে আর আমি চোখ বুজে আরাম উপভোগ করছি। মনে মনে বেজায় খুশি সে সময়কার আমি কাউকে সে কথা একটুও টের না পেতে দিয়ে বেশ ভয় পেয়েছি এমন ভাব করে রবীনকাকুকে বললাম, এমন ধমক খাওয়ার পর পড়ানো ছাড়ি কী করে বলুন?

রবীনকাকুও দেখলাম আমার মতোই মুখ করে বললেন, ঠিক, ঠিক। আমিও তো ওই ধমকের ভয়ে দিনে তিন কাপের বেশি…।

বাবা, তুমি থামবে, নন্দিতার অস্ফুট গলা। এরপর সবাই চুপ। শুধু ইপ্সিতাকে দেখলাম একবার আমার মুখের দিকে আরেকবার ওর দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে হিসেব করতে লাগলাম, ঠিক ক’বে থেকে “সপ্তাহে তিনদিন” শুরু করা যায়। মনে হল কানের পাশে “প্রিয় কবি” যেন চুপিচুপি বলে গেলেন, “নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ”।

নন্দিতার “ধমক” খেয়ে অবশেষে বরফ গলেছে ভেবে আমি ইপ্সিতাকে পড়ানোর সময় আরও উদগ্রীব তাকিয়ে থাকতাম দরজার দিকে। কিন্তু সে আসে কই! ক’দিনের মধ্যেই বুঝতে পারি, অবস্থা কিছুই বদলায়নি, বরফ আদৌ গলেনি এবং সে আসবে না।

এল। আবার সেই ঝড়ের গতিতে একদিন সে এল। ঘরে ঢুকে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার প্রশ্ন, শৈলেনদা, এ গুলো তুমি কী শেখাচ্ছ ইপ্সিতাকে। আমি তখন বেশ ঘাবড়ে গেছি। বললাম, কী শেখাচ্ছি মানে? পরিষ্কার করে বল।

—তুমি ইপ্সিতাকে বলেছ, এম-ও-এন-ও-টি-ও-এন-ও-ইউ-এস…যেহেতু বানানটা একঘেয়ে, তাই মনোটোনাস মানে একঘেয়ে?
—হ্যাঁ, ওটা আমার পড়ানোর স্টাইল।
—তুমি বলেছ, “গাঙ্গুলী”, “বুলবুলি”, “কাকলি”…এ রকম কিছু “লি’ ছাড়া প্রায় সব “লি”ই অ্যাডভার্ব?
—হ্যাঁ, বলেছি। তবে সঙ্গে বলেছি অ্যাডজেকটিভ-এর সঙ্গে ওই “এল-ওয়াই” মানে “লি” যোগ করতে হবে।
—এমন অদ্ভুত পড়ানোর স্টাইলের কথা আমি আগে কখনও শুনিনি।
—দ্যাখো, আমার পড়ানোর একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। তোমাদের এ পদ্ধতি ভালো না লাগলে, আমি আর পড়াতে আসব না।
—হুম্‌ম্‌, বুঝতে পারছি তোমার আজকাল খুব দেমাক বেড়েছে। তোমার এত রাগের কী আছে? আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল, সেটা জানার চেষ্টা করেছি মাত্র।
—কিন্তু তোমার প্রশ্ন করার ধরনটা অন্যরকম ছিল…
—থামো, তোমাকে নিজেদের লোক মনে করি বলেই তো…

হঠাৎ থেমে যায় নন্দিতা। তারপর যেমন এসেছিল—ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আমার মাথাতেও তখন ঝড়ের দাপাদাপি—আমার কানের কাছে যেন একটানা বেজে চলে “তোমাকে নিজেদের লোক মনে করি বলেই তো”…।

তারপর আবার কিছুদিন ফের সব চুপচাপ। নন্দিতার খেয়াল-খুশির দোলাচলে পড়ে আমার অবস্থা তখন দমকলের ব্যবহৃত বালতির মতো—যে বালতির নীচে আঙটা নেই বসানোর মতো—ফলে কেউ ধরে না রাখলে গড়িয়ে যাবার ভয়। কখনও মনে হত, এই বুঝি নন্দিতা ধরা দিল—তারপরেই টের পেতাম, নন্দিতা…সে আসলে অনেক, অনেক দূরের কেউ।

এমন একটা সময়ে মানসিকভাবে প্রবল বিধ্বস্ত আমি একদিন আবার দক্ষিণের নির্মল হাওয়া টের পেলাম, যখন ইপ্সিতা বলল, জানো শৈলেনদা, তোমার শেখানো একটা ভয়েস চেঞ্জ দেখে দিদি কাল রাত্রে বলছিল, না, শৈলেনদা সত্যিই অন্যরকমভাবে ভাবে।

কথাটা শুনে উদগ্রীব আমি প্রায় ছেলেমানুষের মত ইপ্সিতাকে প্রশ্ন করে ফেলি, কোনটা? কোনটা? ইপ্সিতার মুখ দেখে মনে হল, ও এই আপাত যুদ্ধের কোলাহলে বেজায় মজা পেয়েছে। ও একটু হেসে বলল, ওই যে “Trespassers will be prosecuted”, তুমি যেটাকে active voice-এ এনেছ “The law will prosecute the trespassers” লিখে। দিদি বলছিল, ওরা নাকি শিখেছিল, “Someone will prosecute the trespassers”।

“দিদি আর কী বলছিল?” বলতে গিয়েও আমি থেমে যাই। মনে হয়, ছাত্রীর সামনে এমনতর লাফালাফি দেখানোটা ঠিক নয়। চেহারায় তাই একটু গাম্ভীর্য এনে কেটে কেটে বললাম, হুম্‌ম্‌, ঠিক আছে। তোর দিদি ভালো বলেছে মানে তো বিরাট ব্যাপার। ছাড় ও সব, আজ ভাবছি লেটার রাইটিং নিয়ে আমরা একটু নাড়াচাড়া করব। আমার কথা শুনে দেখলাম ইপ্সিতা প্রথমে অবাক, পরে বেজায় খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ, পলাশদা, তবে তাই হোক। আমি বলা শুরু করলাম, লেখ, Returning home I saw your letter peeping through our letter-box….

তখন ইপ্সিতার পরীক্ষার দিনগুলো দৃষ্টির মধ্যে এসে গেছে। আমি সপ্তাহে তিনদিন যাই নন্দিতাদের বাড়ি। আমার মনের ভুল কিনা জানি না, এ সময়টাতে মনে হত, ওই “ভস্ম করে দেব” ভঙ্গিটা যেন উধাও হয়েছে নন্দিতার চোখ থেকে। এই সময়টাতে আমাকে অবাক করে নন্দিতা এমনকি দু-চারদিন নিজে হাতে চা-বিস্কুট, জল দিয়ে গেছে আমাকে।

নন্দিতার চোখের ওই সামান্য নরম হওয়া দৃষ্টিকে ভরসা করে একদিন ইপ্সিতা তখন টয়লেটে গেছে, নন্দিতা চায়ের কাপ হাতে আমার সামনে, “শেষ দেখতে চাই” ভেবে মরীয়া আমি বলেই ফেললাম, আচ্ছা, বলতে পারো, ওই “দেখি”র মেয়াদটা ঠিক ক’বে শেষ হবে?

ব্যস, আমার কথা শুনে নন্দিতা দুম করে চায়ের কাপটা আমার টেবিলে নামিয়ে দিয়ে দুড়দাড় করে মেঝে কাঁপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি তখন ভয়ে কাঁপছি। নন্দিতার অমন চলে যাওয়া দেখে আমি ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছিলাম, এই বুঝি রবীনকাকু এসে আমাকে বললেন, কাল থেকে তোমার আর আসার দরকার নেই। পরবর্তী আধঘন্টাতেও তেমনটা ঘটল না দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। পরে দৃশ্যটা মনে মনে রিওয়াইন্ড করে টের পেয়েছিলাম যে, নন্দিতা দুড়দাড় শব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল ঠিকই, কিন্তু এবার তার সেই অগ্নিদৃষ্টিটা অনুপস্থিত ছিল।

ঠিক করলাম, এবার ফের একদিন সরাসরি প্রোপোজ করব। তাতে যা হয় হোক। কিন্তু প্রোপোজ করতে গেলেও তো সুযোগের দরকার হয়। ভাবলাম, একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় নন্দিতাকে রাস্তায় ধরে যা বলার বলে দেব। কিন্তু ভেবে দেখলাম, সেখানেও বিপদ। মনে হল, ইপ্সিতা এখন আমার ছাত্রী, ওর সামনে ওসব বলা ঠিক না। ঠিক তখনই হাল্কা একটা সুযোগ এল। একদিন তখন ইপ্সিতাকে পড়াচ্ছি—রবীনকাকু ঘরে ঢুকে বললেন, শৈলেন, কাল নন্দিতার জন্মদিন, ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করব। তুমি কিন্তু অবশ্যই এস।

নন্দিতার জন্মদিন বলে কথা। তাই “নিশ্চই আসব কাকু”, বলেও প্রথমেই চিন্তায় পড়লাম, নন্দিতার জন্মদিনে উপহার হিসেবে ঠিক কী দিলে ভালো হয়।

অনেক ভেবে পরদিন সকালে এক কপি “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” কিনে বাড়ি ফিরলাম। একবার ভাবলাম, প্রিয় কবির এই বইয়ের ভিতরে একটা চিরকুট গুঁজে দিলে কেমন হয়। তারপর মনে হল ব্যাপারটা একটু এদিক-ওদিক হলেই কেলেঙ্কারির একশেষ। অনেক ভেবে, বইয়ের তৃতীয় পাতায় লিখলাম, “প্রিয় নন্দিতার জন্মদিনে “দেখি” বাকি রয়ে গেছে শুভেচ্ছা জানানোর। তাই এই প্রীতি উপহার”। ইচ্ছে করেই “দেখি” শব্দটা ইনভার্টেড কমার মধ্যে রেখে দিলাম।

তারপর দুরু-দুরু বক্ষে নন্দিতার জন্মদিনের আনন্দমুখর সন্ধ্যায় হাসি-হাসি মুখ করে বইটা আমি নন্দিতার হাতে তুলে দিলাম। অবাক, অপমানিত আমি দেখলাম যে, নন্দিতা সে উপহারের মোড়কটাও খুলে দেখল না শুধু একটা সৌজন্যের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বইটা অবহেলায় টেবিলের উপর রেখে চলে গেল।

সে মুহূর্ত থেকেই উৎসব-বাড়ির আনন্দ আমার কাছে কেমন তেতো ঠেকতে লাগল। এমনকী আমি যখন খেতে বসেছি—খাওয়ার টেবিলের আশেপাশেও নন্দিতাকে একবারের জন্যেও দেখতে পেলাম না। অপমানের জ্বালা নিয়ে কোনও রকমে খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে সে রাতে বাড়ি ফিরে ঠিক করে নিলাম, আর নয়। এবার ভুলতে হবে নন্দিতার কথা, ভুলতেই হবে। এ ভাবে দিনের পর দিন বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে লাভ নেই ভেবে সে মুহূর্তেই ঠিক করে নিলাম, ইপ্সিতার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই ও বাড়ির পাট তুলে দেব। তার মানে আর অল্প কিছু দিন পড়ালেই আমার কাজ শেষ। বা, হয়ত ভুল বললাম, শেষ নয়, আসলে শুরু…।

দিন দুয়েক পরে ব্যাপারটা আরও খারাপ দিকে গড়িয়ে গেল। অবাক আমি দেখলাম ইপ্সিতা আমাকে মোড়কহীন “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” ফেরত দিয়ে বলছে, শৈলেনদা, দিদি তোমাকে এটা দিতে বলেছে।

বইটা হাতে নিয়ে আমি টের পাচ্ছিলাম আমার কপালের দু’পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে। তবু নিজেকে সংযত করে বললাম, বইটা ফেরত দিয়েছে? কেন?

আমার কথা শুনে ইপ্সিতা দেখলাম খুব নার্ভাস গলায় ফের বলল, দিদি বলেছে, ও কবিতা পড়ে না। ঘরে পড়ে থেকে বইটা শুধু শুধু ধুলো খাবে…

—তাতে কী হল? এর জন্য উপহারের বই ফেরত দিতে হবে? গলা তুলে বললাম।
—না, মানে দিদি বলছিল, তোর শৈলেনদা নিশ্চয়ই কবিতা ভালোবাসে। বইটা তাই ওর কাছে থাকলেই ভালো। সে জন্যেই…
—আর কী বলেছে তোর দিদি?
—বলেছে, তোমাকে রাগ না করতে।

ইপ্সিতার কথা শুনে মনে হল আমার কান দিয়ে যেন আগুন বেরচ্ছে। এ তো সরাসরি অপমান। মনে হল, এ কেমন মেয়ে, যে জন্মদিনের উপহার হিসেবে দেওয়া একটা বইও বাহানা করে এভাবে ফেরত দেয়! ঠিক করলাম, সে মুহূর্তেই ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসব।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে-উঠতেই হঠাৎ মনে হল, এমন তো হতে পারে, এই বইতে আমার প্রশ্নের উত্তর নন্দিতা গুঁজে দিয়েছে লুকিয়ে। রাগ চেপে রেখে পড়ানোর শেষে বইটা নিয়ে বাড়ি ফিরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বইটাতে আমার জন্যে রাখা আছে এমন কিছু পেলাম না। হঠাৎ আমার নিজের লেখা লাইনটাতে চোখ বোলাতে গিয়ে নজরে এল, “দেখি” শব্দটা কেটে দেওয়া আছে।

এবার আমার বিপদ আরও বাড়ল। মনে হল, ওই শব্দটা কেটে দেওয়ার দু-টো অর্থ হতে পারে। এক, ওই শব্দটার জন্যেই নন্দিতা আমাকে বইটা ফেরত দিয়েছে। দুই, “দেখি”র মেয়াদ শেষ, এবারে তুমি বলো কী বলতে চাও। আমার তখন চুল ছেঁড়ার অবস্থা। কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে মনে হল, এ ভাবে চলতে পারে না, পরদিন একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, তাতে আমার যা হয় হোক।

সে হেস্তনেস্ত করার আগে সে রাতেই আমার জ্বর এল, ধুম জ্বর। পরের তিনদিন প্রায় জ্ঞানহীন আমি এক ঘোরের মধ্যে শুধু টের পেয়েছি নন্দিতার অস্থির হাঁটাচলা। ঘোরের মধ্যে কখনও দেখেছি স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় নন্দিতা, দুই বিনুনি, আমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, পাশে অবাক ইপ্সিতা দেখছে তার দিদির এই নতুন রূপ। কখনও দেখেছি, ইপ্সিতাকে পড়াতে গেছি, দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নন্দিতা। মুখের উপর দরজা বন্ধ করার আগে সে বলে দিল, তোমাকে তো ভালো ছেলে বলে জানতাম। সেই ঘোরের মধ্যেই কতবার চীৎকার করে বলে উঠেছি, বিশ্বাস করো আমি খারাপ ছেলে নই…। আবার কখনও বলেছি, নন্দিতা, তুমি আমার স্বপ্নে এলেই যখন—চুল বেঁধে কেন এলে? খোলাচুলেই তো ধরা পড়ে তোমার অনন্ত রূপ।

দিন তিনেক পর, আমার জ্বর তখন একটু কম, আমাকে দেখতে আমাদের বাড়িতে এলেন রবীনকাকু, সঙ্গে ইপ্সিতা। ইপ্সিতাকে দেখেই বললাম, তোর পরীক্ষার তো আর একমাসও বাকি নেই। এ সময় আমার এই জ্বর। তোর খুব ক্ষতি হয়ে গেল রে।

আমার কথা শুনে রবীনকাকু হাত নেড়ে বললেন, তুমি থামো তো। তোমাকে ও সব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি সারা বছর যা পড়িয়েছ, তাতেই হয়ে যাবে। ওষুধপত্র ঠিকঠাক খাচ্ছ তো? বললাম, হ্যাঁ, ওগুলো মায়ের দায়িত্বে আছে। নড়চড় হবার উপায় নেই।

ইপ্সিতাও দেখলাম আমাকে স্বস্তি দেবার লক্ষ্যে বলল, শৈলেনদা, চিন্তা কোরো না। তুমি এতদিন যা পড়িয়েছ, তাতেই হয়ে যাবে।

ইপ্সিতার কথা শুনে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বললাম, না, আমি ভাবছি তোর দিদির কথা। যা কড়া গার্জিয়ান তোর। এবার তোদের বাড়ি গেলে আমি জানি, আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে বেশ কড়া কিছু কথাবার্তা।

আমার কথা শুনে রবীনকাকু হেসে ফেললেন। বললেন, না হে, সে কাল বলছিল, কী জানি আমার জন্মদিনের খাবার খেয়েই শৈলেনদা অসুস্থ হয়ে পড়ল কিনা।

ইপ্সিতা দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে আমার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে। এদিকে কথা বলতে বলতে রবীনকাকুর চোখ গেল আমার মাথার কাছে রাখা “জীবনানন্দ”র দিকে। বললেন, কী হে, তুমি কী “রূপসী বাংলা”র কবিকে মাথায় নিয়ে ঘুমোও নাকি?

রবীনকাকুর কথা শুনে একটু যেন লজ্জা পেলাম। বললাম, উনিই তো আমার জীবন দর্শন। যখনই কষ্ট পাই, ব্যথা পাই, মনে পড়ে, “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—/ আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে”। রবীনকাকু বললেন, দারুণ বলেছ, তবে আমিও দু-কলি “জীবনানন্দ” শোনাই? বললাম, শোনান। ইপ্সিতার অবাক দৃষ্টির মধ্যে রবীনকাকুর বলা শুরু করলেন —

“সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়”।
রবীনকাকুর গলায় জীবনানন্দ শুনে আমার মনে হল শরীর থেকে সমস্ত জ্বর উধাও। মনে হল প্রকৃত অভিভাবক কেউ দর্শনের গভীর কিছু অভিব্যক্তি আমার প্রিয় কবির কবিতার মাধ্যমে কত সহজে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, কাকু কি জানেন, বোঝেন আমার “দূরতর দ্বীপ”এর উপলব্ধির কথা? নিজেই নিজেকে মনে মনে উত্তর দিলাম, হয়ত জানেন, নিশ্চয়ই জানেন।
কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলতে হবে, উপলব্ধির যে দরজা সেদিন রবীনকাকু আমার জ্বরগ্রস্ত চোখের সামনে খুলে দিয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু সে উপলব্ধি নিয়েই স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা জীবন। গলায় আবেগ ঢেলে সেদিন বলেছিলাম, কাকু আপনার এ দিকটা তো জানা ছিল না। একদিন আপনার বাড়িতে গুছিয়ে শুনব জীবনানন্দ, শুধু জীবনানন্দ।

রবীনকাকু যাবার সময়ে বলে গেলেন, আমাদেরও দিন ছিল হে। তারপর ফের বললেন, শৈলেন, তুমি বরং ক’দিন বিশ্রাম নিয়ে ফের পড়াতে যেও। অযথা চিন্তা কোরো না। কাকুকে বলতে পারলাম না, কাকু বিশ্রাম নেব কী—আমি তো এমনকি ভোরবেলাতেও পড়ে থাকি “বিকেলের নক্ষত্রের কাছে”।

জ্বরমুক্ত আমি ক’দিন পরে ইপ্সিতাকে সেদিন পজিটিভ সেন্টেন্স, নেগেটিভ সেন্টেন্স বোঝাচ্ছিলাম—হঠাৎ পড়ানোর ঘরে নন্দিতার প্রবেশ। ও ঘরে ঢুকে বেশ ধমকের সুরেই বলল, শৈলেনদা, আবার কিন্তু জ্বর বাঁধিও না। মনে রেখো, ইপ্সিতার কিন্তু সামনেই পরীক্ষা। বললাম, জ্বর কি আর কেউ ইচ্ছে করে বাঁধায়? উলটো দিক থেকে আরও দাপুটে গলায় উত্তর ভেসে এল, কেউ কেউ বাঁধায়, ইচ্ছে করে বাঁধায়। তারপর যে গতিতে এসেছিল সেই গতিতেই নন্দিতা আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অবাক আমি সেদিন কি নন্দিতার চোখের কোণে সামান্য জলের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলাম?

নন্দিতা সেদিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার পর আমি আরও বেশি করে বুঝতে পারছিলাম যে, আমার সংকট বাড়ছে, বাড়বে। এ মেয়েকে ভুলে যাব বললেই ভোলা যাবে না। তবু আবহাওয়া একটু হাল্কা করার জন্য ইপ্সিতাকে বললাম, দেখেছ, বলেছিলাম না, আমার জন্যে কিছু ধমক জমা আছে।

ইপ্সিতা বলল, না শৈলেনদা, ওটা বোধহয় ঠিক ধমক না। কারণ দিদি কাল রাতেই বলছিল, জন্মদিনে কী খাওয়ালাম কে জানে। যাই বল ইপ্সিতা, আমার মনে হয় শৈলেনদা বাইরে আজেবাজে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে জ্বরটা বাঁধিয়েছে।

ইপ্সিতার কথা শুনে আমি হেসে বললাম, দিদিকে বলে দিও যে, কথাট কুল ড্রিংকস, কোল্ড ড্রিংকস নয়। সে যাক—তাকে বলে দিও আমি “কোল্ড ড্রিংকস” পান করি না, পছন্দ করি না। এবার ঠোঁটের গোড়ায় একটা অর্থপূর্ণ হাসি ঝুলিয়ে ইপ্সিতা বলল, “ঠিক আছে শৈলেনদা, বলে দেব”।

ইপ্সিতা যে “সে কথা” বলে দিয়েছে বুঝলাম দু-দিন পরেই আবার পড়ানোর ঘরে ফের ঝড়ের আবির্ভাবে। “শৈলেনদা, তুমি বলেছ আমার জন্মদিনের খাবার খেয়ে তোমার জ্বর হয়েছিল”?

—আমি আবার এসব কখন বললাম। আমি আমতা-আমতা করি।
—তুমি বলোনি যে, তুমি কুল ড্রিংকস খাও না?
—হ্যাঁ, বলেছি। আমি সত্যিই ও সব পছন্দ করি না।
—তার মানে তো দাঁড়ালো এই যে তোমার শরীর খারাপ হয়েছে আমাদের বাড়ির খাবার খেয়ে।
—একদমই না।

নন্দিতার সেদিনের কথা শুনে আমি টের পেলাম আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। আপাত কঠিন চোয়ালের শক্তি পরীক্ষা করার জন্যে সেদিন ইপ্সিতার সামনেই সটান নন্দিতাকে বলি, তোমার খামখেয়ালির সঙ্গে তাল রাখা সত্যিই খুব কঠিন কাজ।

আমার অমন বিস্ফোরণের জন্যে নন্দিতা সম্ভবত ঠিক তৈরি ছিল না। আমার কথা শুনে নন্দিতার কাঁধটা ঝুঁকে পড়ল। নন্দিতাকে সে অবস্থায় দেখেও, কিছুতেই নরম হব না ঠিক করে আমি ফের বললাম, তোমাকে জন্মদিনে একটা কবিতার বই উপহার দিলাম, আর তুমি কিনা কবিতা পড় না এই দোহাই দিয়ে আমার সে উপহারটাই ফেরত দিয়ে দিলে।

আমার কথা শুনে নন্দিতার ঝুঁকে পড়া কাঁধ ফের সোজা হল। আমার চোখে চোখ রেখে নন্দিতা বলল, আমার মনে হয়েছিল কবিতার বইটা তোমার কাছে অনেক ভালো থাকবে। অমন বড় কবির বই আমার বাড়িতে অবহেলায় পড়ে থাকবে এটা আমি চাইনি বলেই তোমাকে বইটা ফিরিয়ে দিয়েছি।

—মুখে বলছ, বড় কবি—অথচ তাঁর কবিতাগুলো পড়ে দেখবার ইচ্ছে হল না একবার? চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম আমি।
—কে বলেছে পড়িনি?

এবার আমার অবাক হবার পালা। নন্দিতার উত্তর শুনে ভিতরে ভিতরে বেশ ঘেঁটে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, কী পড়েছ?

নন্দিতা নিশ্চিতভাবেই এই “শৈলেনদা”কে আগে দেখেনি। তার গলার স্বর নেমে আসে খাদে। খুব মৃদু সে বলে, অনেকগুলো কবিতাই পড়েছি। তবে, “আট বছর আগের একদিন” পড়ার পর আর পড়তে পারিনি। এত কষ্ট হচ্ছিল…।

নন্দিতার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল সেই কবিতা, সেই কবিতার মুখ, সেই কবিতার ঘরবাড়ির কথা। আমিও জোরে জোরে বলা শুরু করলাম,

“শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;”
ঠিক সেই সময়ই শুনতে পেলাম নন্দিতার চীৎকার, শৈলেনদা, থামো, প্লীজ থামো। এই কবিতাটা পড়ার পর থেকে আমার ভিতরে আমি একটা অন্য রকম কষ্ট টের পাচ্ছি। সে জন্যেই…। প্লীজ।
আমি একটুও না দমে বললাম, নন্দিতা, কবিতাটা বারবার পড়, মন দিয়ে পড়, দেখবে কষ্ট নয়, এক অন্য বোধের জন্ম হচ্ছে মননে।

আমার কথা শেষ হবার আগেই দেখলাম ঘরে ঢুকলেন রবীনকাকু। রবীনকাকু সম্ভবত বাইরে থেকে শুনেছিলেন আমার উচ্চারণ করা লাইনগুলো। মন্ত্রমুগ্ধ আমরা এরপর রবীনকাকুর গলায় শুনলাম,

“হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো—বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো
কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”।
এতবার পড়া কবিতার লাইনগুলো সেদিন রবীনকাকুর গলায় শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল লাইনগুলো জীবন্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। নন্দিতা দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইপ্সিতা চুপ। ঘরের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। অস্বস্তি কাটানোর জন্যে আমিই বললাম, কাকু, আমি আজ আসি। সম্ভব হলে কাল ফের একটু রাতের দিকে আসব। কথাগুলো বলতে গিয়ে টের পেলাম, আবেগে আমার গলা তখনও কাঁপছে।
বাড়ি ফিরব বলে উঠে দাঁড়িয়েছি, সে সময় আবার প্রবল বেগে নন্দিতার প্রবেশ। বলল, শোনো শৈলেনদা, আমার “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” কালকেই ফেরত দিয়ে যাবে।

নন্দিতার এ হেন কথা শুনে দৃশ্যত অবাক আমি বলেই ফেললাম, তোমার বই মানে? তুমি তো সে বই ফিরিয়ে দিয়েছ। উত্তরে নন্দিতা আরও দৃঢ় বলল, হ্যাঁ, আমার। ওই বইটা আমার। জানো না, কিছু দিয়ে ফেরত নিলে কালীঘাটের কুকুর হতে হয়?

আড় চোখে দেখলাম নন্দিতার কথা শুনে ইপ্সিতা হাসছে। আমি চুপ। রবীনকাকু ফের জীবনানন্দে ফিরলেন—

“মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে
জন্ম নিয়েছিলো কবে;
পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন
কুয়াশার যে ইঙ্গিত ছিলো—
সেই সব ধীরে-ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে
পেয়েছিলো এখানে ভূমিষ্ঠ হ’য়ে—আলো জল আকাশের টানে;
কেন যেন কাকে ভালোবেসে”।
রোদ-বৃষ্টির এমনতরো মাখামাখিতে আমার কেন জানি না সে মুহূর্তে মনে পড়ল কে যেন বলেছিল, “পাশাপাশি থেকেও নারকেল পাতারা কখনোই মিলিত হতে পারে না, ঝড় না উঠলে”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত