আমি তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আমার ভাই নেভালদা ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ে। আমার পেপটিক আলসার হয়েছিল। হবু ডাক্তারের ভাই কি আর পাড়ার ডাক্তার দেখাবে? নেভালদা আমাকে সোজা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেল। সকালে তখন তেমন ভিড় জমেনি। আর ভিড় জমলেই কি? আমাকে তো আর লম্বা লাইন দিতে হবে না। আমার ভাই ওখানে পড়ে না? ঠিক তাই হোল। আমাকে ডাক্তার আগেই দেখলো। সাদা কি এক শরবত খেতে দিয়ে এক্সরে করতে বললো। তারপর নেভালদা হাসপাতালের এক বারান্দায় আমাকে বসিয়ে রেখে ক্লাস করতে চলে গেল। সাথে কড়া নির্দেশ দিয়ে গেল, এখানেই বসে থাকবি। কোথাও যাবি না।’ আমিও সুবোধ ছেলের মতো বসে থাকলাম। কিন্তু মাথায় একটি পোকা বার বার খোঁচা দিচ্ছিলো, শহীদ মিনার এই মেডিকেল কলেজের গেটের কাছে।
মনে পড়ে সেই বারো -তেরো বছর বয়সের কথা। লক্ষ্মীবাজারের সুহৃদ সংঘের সাথে ভোর সকালে সবার সাথে গান গাইতে গাইতে লক্ষ্মীবাজার থেকে শহীদ মিনারে হেঁটে গিয়েছি। মা বলতেন, তুই এতদূর হাঁটতে পারবি না। আমার ভাই বোনেরা তারপরও সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। সেই মিছিলে ছিলেন সমর দাস। শীতের সকালে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মিছিলে দাঁড়িয়েছি। খালি পায়ে হেঁটেছি, পায়ের তলায় ইটের গুড়ো পড়েছে, কিন্তু ব্যথা পাইনি, ক্লান্ত হইনি। মনে হয়েছে এই ভাবে গান গেয়ে গেয়ে আরো হাজার মাইল হাঁটতে পারবো।
কলেজে পড়ার সময় থেকে দেশ ছাড়ার আগে প্রতি বছর একুশের সেই সকালে একই ভাবে আমি হেঁটেছি। আমার বাবা-মা আর গির্জার পাদ্রীরা শিখিয়েছিলো, রবিবার গির্জায় না গেলে পাপ হয়। আমি সেই কথা মেনে প্রতি রবিবার গির্জায় গিয়েছি। তারপর একসময় আর রবিবারে গির্জায় যাওয়া হয়ে উঠেনি। মনে সেই পাপ বোধ আর অনুভব করিনি। কিন্তু কখনো একুশের সকালে শহীদ মিনারে যাবো না এই চিন্তা মাথায় আসলেই এক অপরাধবোধ আমাকে অসাড় করে ফেলতো। একুশের সকালে বাড়িতে থাকতে পারতাম না। ফুল হাতে নয়ত খালি হাতে বুকে একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে পৌঁছে গেছি শহীদ মিনারে। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখেছি শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে গান গেয়েছি, নাটক করেছি, পাহারা দিয়েছি।
একবার একুশের আগের রাতে আমি মহাখালী থেকে রওনা দিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর টিএসসি’র দিকে। ওখানে আমাদের নাটকের (ঢাকা পদাতিক) দলের সবাই জড়ো হবে। মহাখালীতে তখন অনেক বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। চারিদিকে ইট আর বালির স্তূপ। আমাদের বাড়ির পাশে ছিল একটি বস্তি। তখন রাত নয়টা বাজে। মোটর সাইকেলে মহাখালী থেকে বের হবার পথে আমি থমকে দাঁড়ালাম। বস্তির একটি ভাঙা বাড়িতে দুজন আট-দশ বছরের ছেলে বসে আছে। টিম টিম করে কম আলোর একটি লাইট জ্বলছে। আর সেই ভাঙা ঘরের মাঝে এলাকার ইট আর বালু দিয়ে সেই ছোট ছোট ছেলেরা একটি স্তম্ভ
তৈরি করেছে। কত লম্বা হবে? খুব বেশি হলে তিন ফুট। মাথার উপর বাঁশের চটি দিয়ে মাথাটি একটু বাঁকা করে দিয়েছে। ছেলে দুটা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সেই ইট-সুরকির স্তম্ভের দুপাশে বসে আছে। চোখে ঘুম নেই।
আমি মোটর সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, এইটা কি বানাইছস?’ ছেলে দুটার চটপট উত্তর, আমগো শহীদ মিনার। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়নি অনেকক্ষণ। ওদের কে শিখিয়েছে এমন করে ইট-বালু চুরি করে শহীদ মিনার বানাতে হবে?
আমার এতো দিনের আরাধনা একুশের সকালে শহীদ মিনারে যেতেই হবে কোথায় উড়ে গেল। আমি ছেলে দুটার সাথে মাটিতে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘গান গাইতে পারিস?’
– হ, পারি তো।
– একটা গান গা দেখি।
ওরা গান ধরলো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? আমি একবারও ওদের সুর, লয়, তাল, আর উচ্চারণ খেয়াল করলাম না। শুধু দেখলাম দুটি ছেলে হাতে পতাকা নিয়ে শহীদের কথা মনে করছে। আমি ওদের সাথে ঠোঁট মিলাতে পারলাম না। নিজেকেই এবার অপরাধী লাগছিলো একুশকে আমি আমার মতো করে আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম বলে। একুশ কেবল আমার একার নয়। একুশ বস্তির ঐ দুজন কিশোর বালককেও উদ্বেলিত করে।
ওদের মিনারটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। কোনো প্ল্যাস্টার নেই, কোনো রং নেই। নেই কোনো নিখুঁত শিল্পীর কাজ। কিন্তু ওই স্তম্ভটি জুড়ে আছে ছেলেগুলোর আদর, মমতা আর ভালোবাসা। সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আজ শহীদ মিনারে না গেলে আমার পাপ হবে না। কোনো অপরাধ বোধ আমাকে স্পর্শ করবে না। নেভালদা কখন যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল টের পাইনি। আমাকে বললো, চল বাড়ি যাবো।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম শহীদ মিনারটি কোথায়?’ নেভালদা সাহস দিল, দেখবি? আয়।
ঢাকা মেডিকেলের গেট থেকে বেড়িয়ে বাম দিকে মোড় নিয়ে একটু হাঁটতেই চোখের সামনে দেখলাম শহীদ মিনার। মাথা উঁচু করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। মনে কত প্রশ্ন জন্মেছিল। কে এটা বানিয়েছে? এটা এভাবে কেন বানালো? নিজে নিজে কত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু বড় হয়ে জেনেছি সেই শিল্পীর ব্যাখ্যা। মাঝখানে যে স্তম্ভ ওটা হচ্ছে ‘মা’ আর তার দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার শহীদ সন্তানেরা। মা তার মাথাটি একটু আলতো করে সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে আদর আর স্নেহ নিয়ে তার সন্তানদের জন্য। এই মা হচ্ছে আমার দেশ। এই সন্তানরা হচ্ছে এই দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছে।
কিন্তু কলেজে গিয়ে শহীদ মিনারের অন্য এক ব্যাখ্যা শুনলাম। নটরডেম কলেজে গরীবে নেওয়াজ এর ক্লাস শোনার জন্য অন্য ক্লাস থেকে ছেলেরা ছুটে আসতো। অসাধারণ উনার ব্যাখ্যা আর বক্তব্য। উনি বললেন, ‘মাঝখানের ওই মিনার যার মাথাটি একটু নিচু তার অর্থ হচ্ছে ৫২ সনে পাকিস্তানীরা আমাদের হত্যা করে আমাদের চেতনাকে একটু নুইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরের যে মিনার গুলো আছে তাকিয়ে দেখো ওদের মাথা নিচু নয়। বরং সোজা। আমাদের প্রজন্ম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি নতুন করে শহীদ মিনারের অর্থ খুঁজতে শুরু করলাম। তাইতো শহীদ মিনারকে এই ভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়?
শহীদ মিনার আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গল্প। এখনো মানুষ দ্রোহে, আনন্দে এই শহীদ মিনারের কাছেই বার বার ফিরে আসে। শহীদ মিনার আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমি কে? আমার আত্মার ঠিকানাটি কোথায়?
একাত্তরের পর সারা দেশে মানুষ তাদের ভালোবাসা আর আদর দিয়ে তৈরি করেছে হাজার শহীদ মিনার। প্রিয় জনকে হারানোর বেদনা আর স্বাধীনতার আনন্দকে এক করেছে এই শহীদ মিনারগুলো। আমাদের স্কুলেও বকুল তলায় তৈরি হয়েছিল শহীদ মিনার। আমাদের প্রিয়জনদের হারানোর বেদনার কথা মনে করার জন্য। এই শহীদ মিনারটি কি শুধুই ইট সুরকির তৈরি ছিল? নাকি প্রতিটি ইট আর বালুকণায় লেখা ছিল অনেকগুলো গল্প।
একদা আমাদের শিক্ষকরা তাদের পরিবার নিয়ে পরম বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে তাদের সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। একদা তারা ভেবেছিলেন এই স্কুলে তাদের প্রাণ মুক্ত দেশের নির্মল বাতাসে ভরে উঠবে। একদা তারা ভেবেছিলেন তাদের সন্তানেরা এই স্কুলের ছায়ায় নিরাপদে বেড়ে উঠবে এই ক্রান্তিকালে। এই সব আশা আর স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠেনি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে আমাদের শিক্ষদের। ধরে নিয়ে গেছে তাদের সন্তানদের। জগতের কি আশ্চর্য সমীকরণ। ওই রাতে আমাদের ১৩ জন ভাইবোনের মধ্যে ১২ জনসহ বাবা-মায়ের ওখানে থাকার কথা ছিল। আমার মায়ের কি মনে হয়েছিল সেই দিন, বাবাকে আর আসতে দেয়নি। জগতের সকল মা বোধহয় এই ভাবেই তার পরিবারকে আগলে রাখে।
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের পূর্বের শহীদ মিনার
লাল রঙের স্তম্ভটি শুধুই যারা চলে গেছেন তাদের কথা মনে করা? নাকি এই আমরা যারা এখন বেঁচে আছি তাদেরও অনেক গল্প ওখানে লেখা আছে?
যে মানুষগুলোকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিয়ে গিয়েছিলো তারা ফিরে আসেনি। তাদের লাশ ফেরত পাওয়া যায়নি। তাদের শেষকৃত্য হয়নি। তাদের প্রিয়জনেরা ফুল নিয়ে বসে থাকে বছরের পর বছর। শুধু জানে না কোথায় ভালোবাসার এই ফুলটি রাখতে হবে? শোকের আয়ু কতদিন? বছর, মাস, যুগ ধরে কি মানুষ শোক করে? শোকের কোনো ভাষা নেই। নেই কোনো দিনপঞ্জী। যে হারিয়েছে কেবল সে জানে হারানোর বেদনা কি?
সেদিন যারা স্কুলে তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে তাদের কাছে এই লাল রঙের মিনারটি ছিল প্রিয়জনদের খুঁজে পাবার একমাত্র চিহ্ন। হয়তো প্রিয়জনেরা আলতো করে সেই মিনার ছুঁয়ে দিতো। অনুভব করতো হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্পর্শ। কাছে এসে ফিস ফিস করে বলতো, ‘ঘুমাও শান্তিতে। আমরা তো জেগে আছি। কিন্তু সেই শহীদ মিনারটি এখন আর নেই।
যেদিন স্কুলের শহীদ মিনারটির ভাঙার ছবি দেখেছি আমি সারাদিন নীরব হয়ে ছিলাম। আমার মনে পড়েছে লঙ্কা ভাই সেঙ্কা ভাই আর অংকুর কথা। ওদের কেমন লেগেছিল? ওরা বাবাকে খুঁজে পাবার শেষ জায়গাটিও হারালো। ওরা এখন ফুল নিয়ে কোথায় অপেক্ষা করবে? বাবার কথা মনে হলে আকাশের তারার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকবে? হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার কিছু নেই।
একদা কি আদর করেই না বকুল তলায় এক ভিনদেশি ব্রাদার ওই শহীদ মিনারটি তৈরি করেছিল। গাছের ঠাণ্ডা শীতল বাতাসে আমাদের প্রিয়জনেরা দেখবে তাদের ছাত্ররা স্বাধীন দেশে ছুটে বেড়াচ্ছে। বেড়ে উঠছে তাদের ছায়ায়। আমাদের ছেলেরা জানবে একদা এই মানুষগুলো তাদের জীবন দিয়েছিলো বলেই ওরা বেড়ে উঠছে ওদের স্বপ্ন নিয়ে।
যে স্কুলের ছাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন- সেই স্কুলে শহীদ মিনার কেন ভাঙতে হবে? যে স্কুলে ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা আর নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন বেড়ে উঠেছে, যে স্কুলে (শহীদ) জুয়েল, রকিবুল হাসানের মতো আরো কত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে সেই স্কুলে শহীদ মিনারকে এমন অনাদরে থাকতে হবে কেন?
একজন বিদেশী হেডমাস্টার যে মমতা নিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছিলেন স্কুলের বকুল তলায়, একজন বাঙালি হেড মাস্টার সেই মমতাকে ধারণ করলো না? হাজার মাইল দূরে অচেনা বাতাসের দেশে বসে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আহারে আহারে।
আর্কিটেকচার একটি শিল্প। ক্যানভাসে ছবি আঁকার মত। অনেকে বলে ওটা হচ্ছে ‘আর্ট-টেক্চার। যেখানে শিল্পী কেবল নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেয় না। অন্যের ভালো লাগা, ভালোবাসাকে মূল্য দেয়। আমাদের নতুন স্কুল ভবনের নকশা যিনি করেছেন তাকে কি এই শহীদ মিনারের গল্পটি বলা হয়েছিল? উনি কি জানতেন কত হাজার ছাত্র এই স্মৃতি বুকে নিয়ে এখনো ঘোরে ফেরে? লাল রঙের এই শহীদ মিনার আমাদের কষ্ট, ব্যথা আর ভালবাসা দিয়ে তৈরি। এই ভালবাসা আমরা যত্ন করে বুকের ভিতর পুষে রাখি।
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের বর্তমান শহীদ মিনার
এখন যে শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে ওটার দিকে কেউ একবার তাকিয়ে দেখেছেন? কোথাও কোন যত্নের ছোঁয়া নেই। এতো বড় দৃষ্টি নন্দন বিল্ডিং এর মাঝে বড় অনাদরে তৈরি হয়েছে নতুন শহীদ মিনার। তিনটি স্তম্ভই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করা এই তিনটি স্তম্ভ কার কথা বলছে? মায়ের কথা? আমাদের মা, আমাদের দেশ তো একটি। শহীদ মিনারে মানুষ মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে তারপর মাথা নত করে ফুল দেয়। আর স্কুলের ওই শহীদ মিনারে ছেলেরা মাথা নিচু করে শহীদ মিনার দেখে। একুশ মানে মাথা নত না করা। কিন্তু শহীদ মিনারের আকৃতির কারণেই মাথা উঁচু করে তাকানোর সুযোগ কোথায়? শহীদ মিনার যে কোন জায়গায় তৈরি করা যায় না। তৈরি করতে হয় এমন জায়গায় যেন সবাই দেখতে পারে, সহজেই যেতে পারে। কিন্তু স্কুলের এই জায়গাটি কি ভাবে ঠিক করা হোল। একজন সাধারণ মানুষও বুঝবে কি অনাদর আর অবহেলা করে এই জায়গাটি ঠিক করা হয়েছে।
শহীদ মিনার আর একুশ এখন কেবল আমাদের নয়। একুশ এখন সারা পৃথিবীর মানুষের। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষণা করার পর সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশ সরকার এর যৌথ সাহায্যে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস স্তম্ভ তৈরি হয়েছে। সিডনির একটু দূরেই ঢাকার শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রায় ৩৫ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়াতে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য সরকারী বিল পাশ হয়েছে। কানাডায় শহীদ মিনার এর ছবি নিয়ে স্ট্যাম্প বের হচ্ছে। নিশ্চয় অন্যান্য দেশেও শহীদ মিনার তৈরির কাজ অনেকেই করছেন। পৃথিবীর মানুষ যখন একুশকে বুকে ধারণ করছে আমাদের স্কুল তখন অনাদরে শহীদ মিনারকে ঠেলে দিয়েছে অপ্রয়োজনীয়ের তালিকায়।
শেষে একটি গল্প বলি। বীর শ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানের কথা মনে আছে? একাত্তরের পাকিস্তানী বিমান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সময় শহীদ হয়েছিলেন। সেই
মানুষটিকে পাকিস্তানে কবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু উনার আত্মা শান্তি পায়নি। তাই ত্রিশ বছর পর ২০১৬ সালের জুন মাসে সেই কবর তুলে এনে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে ঘুম পাড়িয়েছে এই বাঙালি। এই কাজটি কি খুব জরুরী ছিল? আমি বলি, ‘হ্যা। জরুরী, ভীষণ জরুরী ছিল। মানুষ তার প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে ঘুমাতে চায়। যেমন আমাদের তিন শিক্ষক আর দু’জন ছাত্র বকুলতলায় ঘুমিয়েছিল। হটাৎ ওদের ঘুম ভাঙিয়ে সেই লাল রঙের প্রাণের ছোঁয়ার শহীদ মিনার ভেঙে কোথায় নিয়ে গেলেন? একবারও মনে হয়নি, ‘ওরা আসবে, চুপি চুপি। কেউ যেন ভুল করে গেয়ো নাকো মন ভাঙ্গা গান।
নতুন করে তৈরি কালো রঙের তিনটি স্তম্ভে আমাদের সেই কষ্টের রং নেই। নেই আমাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি। শহীদ মিনার কি শুধু ইট সুরকি দিয়ে তৈরি হয়? ওই যে মহাখালীর বাচ্চাগুলো যে শহীদ মিনার বানিয়েছিল ওগুলো কি শুধুই ইট সুরকির? নতুন বিল্ডিং এর জন্য জায়গা দরকার। কিন্ত এই লাল রঙের শহীদ মিনার কে ঘিরেও নতুন ডিজাইন হতে পারত। যেমন আমরা শত বছরের পুরান গাছ না কেটে সেই গাছকেও মূল ডিজাইনের সাথে সম্পৃক্ত করি । আমাদের স্কুলে ট্রফি রাখার যে বড় ডিসপ্লে রয়েছে। ওটা অনেক পুরনো। গায়ে চিড় ধরেছে। ভার্নিশ উঠে গেছে। তারপর আমরা ওটা ফেলে দেইনি। কারণ ওটা আমাদের স্কুলের ইতিহাসের অংশ। সব পুরাতন বিদায় করতে নেই। তাহলে আমরা ইতিহাস বিহীন এক গুবলেট প্রজন্মকে জন্ম দেব। শহীদ মিনারের জায়গাটি স্কুলের। কিন্তু শহীদ মিনারটি স্কুলের নয়। ওটা আমাদের।
শহীদ মিনার আমাদের পরিচয়। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের দ্রোহ, আমাদের আনন্দ, আমাদের দেশ। মন খারাপ করা কোনো এক দিনে, অভিমানে হারিয়ে যাওয়ার এক ক্ষণে টুপ করে ফিরে আসার আস্থার জায়গা। সেই ভালোবাসার আর আস্থার জায়গাটি পরম মমতা ভরে আগলে না রাখলে আমাদের নিরাশার দিনে – কোথায় যাবো? আমাদের প্রজন্মকে মাথা নত না করে বাঁচার মন্ত্র শিখাব কি করে? শহীদ মিনার কেবল ইট-সুরকি–লোহা দিয়ে তৈরি করা স্তম্ভ নয়। শহীদ মিনার আমার ভালোবাসা।