ঔরসজাত সন্তান

ঔরসজাত সন্তান
“আমি একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছি” কথাটা শোনার পর আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। সোহাগ কি বলতেছে এগুলা! চোখ বড় বড় করে বললাম,
“ফাইযলামি করিস?”
“না, আমি সিরিয়াস”

সোহাগের ভাবভঙ্গি বলছে, ও ভণিতা করছে না। এবার রাগ চড়ে গেল মাথায়। সিগারেটে এক টান মেরে বললাম,

“মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোর শালা ফাউল! নিজে ডাক্তার হইলেও পাগল ছাগল হইতে পারে কেউ, এইটা তোরে দেখলেই যে কেউ বুঝব। এমনেই পড়ছস গাইনিকোলজি, তার উপর এখন প্রেগন্যান্ট মেয়েগুলাও তোর কাছ থেকে মুক্তি পাইব না। শালা, পার্ভাসনের একটা লিমিট তো থাকে?!” রাগ আধখাওয়া সিগারেট মাটিতে ছুড়ে ফেললাম। সোহাগের পাগলামীর রোগ অনেক আগে থেকেই। আমরা যখন খেলার সুযোগ খুঁজতাম, তখনও ও বই নিয়ে বসে থাকত। ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বিরাট মাঠটা দেখা যেত। আমরা মাঠ থেকে ওকে ভেংচাতাম, ডাকাডাকি করতাম। সোহাগ তখন পর্দা টেনে দিত, কখনো কখনো জানালা আটকে দিত। কলেজের পরে যখন আমরা কোনো মতে কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করতেছি, কিংবা কেউ কেউ পড়ালেখা ছেড়ে বিদেশে গিয়ে লাখপতি হওয়ার রাস্তায় হাঁটা শুরু করব, তখন সোহাগ আটঘাট বেঁধে পড়ালেখায় লেগে গেল।

যার ফলে ঢামেকে সুযোগ পেয়ে গেল। পাঁচ বছরের এমবিবিএস শেষ করে সবাই যখন ওকে মেডিসিন কিংবা নিউরোলজি, কিংবা অর্থোপেডিকে আশা করতেছে, তখন সে গাইনিকোলজি পড়া শুরু করল। আমরা যখ বিয়ে করে বউ নিয়ে বাচ্চা হওয়ানোর চেষ্টা করতেছি, তখন সোহাগ জমিয়ে চেম্বার আর পড়াশোনা চালাচ্ছে। কত করে বললাম, বিয়ে কর, শুনে না। আংকেল আন্টি বাধ্য হয়ে ওর বড় বোনকে বিয়ে দিল, ছোট দুটোকেও বিয়ে দিল, কিন্তু সোহাগ নড়ল না। কত ছেলেরা ওকে সমকামী বলে ক্ষেপালো, সোহাগের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন আমি দুই বাচ্চার বাবা, তখন যদি বন্ধুর মুখে এমন কথা শুনি, তাহলে রাগ উঠা কি অস্বাভাবিক?! সোহাগ আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল,

“তুই কিন্তু আমার কথা পুরোটা না শুনেই রিএক্ট করলি”

“কি শুনাবি তুই আমাকে? ঐ প্রেগন্যান্ট মেয়েটা তোর পুরাতন ক্রাশ, এজন্য এখন এই অবস্থাতেও প্রেমে পড়ছিস?”

“নাহ, ওকে আমি চিনতাম না আগে কখনো, দেখিও নাই”

“তাহলে? কি চলতেছে তোর মাথায় একটু বল তো?”

আসলে মেয়েটার এখন ছয় মাস চলে। আমার কাছে প্রথম থেকেই আসত। তুই তো জানিস, ছেলে হওয়ায় মেয়েরা আমার কাছে তেমন একটা ফ্রি হতে চায় না। কিন্তু মেয়েটার মাঝে এরকম কিছু নাই। মেয়েটা সবসময় একা একা আসে আমার কাছে। ওর আল্ট্রা করলাম, ওষুধ দিলাম, করল, চলে গেল। মেয়েটা গত পাঁচ মাস যাবৎ আমার কাছে আসে। গতকাল প্রশ্ন করলাম, কেউ নেই কেন?”

“মেয়েটা কি বলল?”

“মামা মামীর কাছে সে বড় হইছে। জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল বলে পালিয়ে গেল। ছেলের সাথে দুই বছর সংসারের পর ছেলে আরেক মেয়েকে নিয়ে আসলো। শ্বশুর বাড়ি ঘর থেকে বের করে দিল। তখন ও প্রেগন্যান্ট বলার পর সবাই অস্বীকার করল। ওর জামাইয়ের কথা, মেয়েটার চরিত্র খারাপ। এই বাচ্চা নাকি তার না, কারণ মেয়েটার সাথে তার কোনো শারীরিক সম্পর্ক নাই। সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। সব শেষ!

“মেয়েটা যে মিথ্যা বলতেছে না, এর প্রমাণ কি?”

“আমার খোঁজ নেয়া শেষ। মেয়েটা সত্য বলতেছে”

শেষ প্রশ্ন করলাম,

“প্রেমে পড়লি কেন?”

“ও দেখতে ঠিক আম্মুর মত”

সোহাগের চোখ টলমল করতেছে। আন্টির চলে যাওয়ার দিনের কথা মনে পড়ল। যেদিন আন্টি মারা গেছে, তার পর টানা এক মাস এত কান্না করছে ও! আমরা কেউ ওকে শান্ত করতে পারিনি। একটা ছেলে এত কান্না করতে পারে আমাদের কারো জানা ছিল না। আন্টি মারা গেছে দুই বছর হয়ে গেছে। এখনো আন্টির কথা উঠলেই ওর চোখ ছলছল করে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। যাইই হোক, আমি ওর পাশে থাকব। কয়েক দিন পর ওদের বিয়ে হলো। আংকেল কিংবা অন্য কেউ ওকে আটকাতে পারেনি। সোহাগের একটাই কথা, স্পার্ম দিলেই কেউ বাবা হয় না। বাবা সেই হয়, যে কিনা সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই ভালোবাসে। ঐ ছোট্ট প্রাণটা ওরই সন্তান, ঔরসজাত হওয়াটা মূল না। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের পর থেকে মেয়েটা সোহাগের পাঞ্জাবির কোণা ধরে থাকলো, যেন ছাড়লেই সোহাগ পালিয়ে যাবে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সোহাগ তার মায়ের মত দেখতে মেয়েটার অনাগত সন্তানের হবু বাবা হয়ে গেছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত