আয়েশা সমগ্রের অংশবিশেষ

আয়েশা সমগ্রের অংশবিশেষ

আয়েশা হিসেব করে দেখেছে, তার এক মগ গরম চা খেতে টানা একুশ মিনিট সময় লাগে। আগে এত বেশি সময় লাগতো না। বারো থেকে তেরো মিনিট সময়ের মধ্যে সে এক কাপ চা দু-একবার ফুঁ দিয়ে পান করে ফেলতো। আজ কেন এমন হলো? সে চিন্তিত মনে শাদবিনকে (বয়ফ্রেন্ড) ফোন করে বলল, “এ্যাই কী করছ?”

শাদবিন ইদানীং প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে। দু’টো টিউশুনির পাশাপাশি একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে। নামে মাত্র ইন্টারভিউ, চাকরির কোনো দেখা নেই। লেখালেখি নামে যা করতো সেটা আর এগুচ্ছে না। শাদবিন ফোন রিসিভ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “আমি রিকশায়!” “সকাল সকাল রিকশায় কোথায় যাচ্ছ?” “গতকাল না বললাম, আজ একটা ভালো কোম্পানি ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছেন। জ্যামে আটকে আছি। এতক্ষন মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছিলাম, তৃতীয়বার পড়ার মাঝেই তুমি ফোন করলে।” আয়েশা বলল, “তুমি চাকরির ইন্টারভিউ নিয়ে চিন্তা করছ? অথচ আমি আছি আরো দুশ্চিন্তার মধ্যে!” শাদবিন কৌতূহল নিয়ে বলল, “তোমার আবার কীসের চিন্তা?”

“আজ হিসেব করে দেখলাম আমার গরম চা খেতে আগের চেয়ে আট মিনিট বেশি সময় লাগে।”

“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।”

“দুধ চা বানিয়ে বই হাতে চা নিয়ে বসলাম। মগ আগেরটাই! ওই যে তোমার দেয়া, আমার ছবি খোদাই করা সাদা মগটা। অথচ পার্থক্য আমার রুচির। এত সময় ধরে কেউ চা খায় বলো? বিরক্তিকর!”

“এই বিষয়টি আমার চাকরির চেয়ে তোমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে?”

“অবশ্যই, চাকরি আজ না হোক কাল হবে। কিন্তু এমন যদি হয়, আমার আর কোনোদিন চা খেতে ইচ্ছে করছে না সেদিন কেমন হবে বলো তো?”

শাদবিন ফোন কেটে দিল। আয়েশাকে কয়েকটা কঠিন কথা বলতে খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু ভালো একটা কাজে যাচ্ছে, তার ছেলেমানুষী নিয়ে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। সে আবার শুরু থেকে আয়তুল কুরসী পড়া শুরু করল। আশ্চর্য তো, এখন পড়ায় ভুল হচ্ছে কেন? অথচ একটু আগেও

ঠিকঠাক পড়েছিল। রিকশা চলতে শুরু করল। শাদবিন আয়তুল কুরছি বাদ দিয়ে দুরুদ শরীফ পড়া শুরু করল। আয়েশা নবীন একজন লেখকের একটা উপন্যাসের বই খুলে বসেছে। বইয়ের নাম- ‘টক মিষ্টি ঝাল, প্রেম হবে কাল!’ দু’পাতা পড়ার পর আর পড়া এগুচ্ছে না। কে কাকে গল্পে কী বলছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু প্রকৃতির বর্ণনায় একের পর এক পাতা ভরে রাখা হয়েছে। অথচ শাদবিন তাকে বইটা উপহার দেয়ার সময় বলেছে, নবীন হলেও এই লেখক চমৎকার লেখেন।

এখন আয়েশার মনে হচ্ছে, এর চেয়ে সেও বেশ ভালো একটা ছোট গল্প লিখতে পারবে। সে বই বন্ধ করে ছোট বোন আনিকার রুমের সামনে গেল। আনিকা ফোনে কার সাথে কথা বলে হাসাহাসির এক পর্যায়ে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে! অথচ ত্রিশ মিনিট আগে তার জন্য আয়েশা টেবিলের উপর চা রেখে গেছে। তখনও এভাবেই সে হাসতে হাসতে বলেছিল, “আপু হিহিহি.., চা টবিলের উপর রাখো হিহিহি!” একটা মানুষ এতক্ষণ ফোনে কীভাবে কথা বলে একইভাবে হাসতে পারে আয়েশা ভেবে পায় না। সে তো দশমিনিট কথা হলেই শাদবিনকে বলে, “ফোন রাখো, আমার মাথা ব্যথা করছে!” বিকেল চারটা বাজে। শাদবিন পার্কের বেঞ্চিতে মুখ ভোঁতা করে একা একা বসে আছে। কারণ তার ইন্টারভিউ ভালো হয়নি। ফাইলের কাগজপত্র নিয়োগকর্তা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলেছেন, “এমবিএ-টা শেষ করে আসুন। ধন্যবাদ!” একটা দশ/বারো বছরের ছোট বাচ্চা মেয়ের কথায় শাদবিনের ভাবনার ঘোর ভাঙল।

“ভাইজান সারাদিন কিছু খাইনি, ক’টা টাকা দেন।” শাদবিন মানিব্যাগ থেকের দশটাকার একটা নোট বের দিয়ে বলল, “নাম কী তোমার?”

“আমার নাম, লাইলি।”

“লাইলি শোনো, আমিও দুপুরে কিছু খাইনি। এখানে আশেপাশে ভালো কোনো ভাতের হোটেল আছে? তাহলে চলো একসাথে গিয়ে ভাত খাওয়া যাক।”

“আপনি কেন খান নাই ভাইজান?”

“মনটা ভালো না লাইলি, এই চাকরিটাও সম্ভবত হবে না। সে বাদ দাও, চলো যাই।”

লাইলি বলল, “চলেন ভাইজান। চাকরির জন্য মন খারাপ কইরেন না। ভাত খান, ভাত খাইলে মন ভালো হইব!”

শাদবিন মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত! কারো ভাতের জন্য মন খারাপ, করো চাকরির জন্য মন খারাপ, কারোর আবার দুধ চায়ের সময়ের হিসেবে গরমিলের জন্য মন খারাপ!” শেষ কথাটা ভাবতেই তার আয়েশার কথা মনে পড়ল। সারাদিন ফোন অফ ছিল, বেচারী কখন থেকে চেষ্টা করছে কে জানে? কী খবর দেবে তাকে? এই চাকরিটাও হবে না জানা কথা। ভাতের হোটেলে বসে সে ভাত মাছ তরকারির অর্ডার দিয়ে ফোন অন করতেই আয়েশার রিং এলো। শাদবিন বলল, “ফোন অন

করতেই তোমার ফোন, বাহ্! তুমি কি অটো ডায়াল দিয়ে রেখেছিলে?” আয়েশা বলল, “না তো, মাত্রই ফোন দেয়ার জন্য ফোন হাতে নিলাম। কী করছ তুমি?”

“লাইলির সাথে বসে ভাত খাচ্ছি।”

“লাইলি কে?”

“আমি তাকে চিনি না।

কিছুক্ষণ আগেই পরিচয়। সেও সারাদিন কিছু খায়নি, আমিও খাইনি। দু’জনের মধ্যে আপাতত এটুকুই মিল!” আয়েশা বলল, “ইন্টারভিউ ভালো হয়নি তাই তো?” শাদবিন জবাব দিল না। জবাব না পেয়ে বিষয়টা আয়েশা সহজেই বুঝে নিল। তারপর বলল, “আমি কিন্তু আগে থেকেই জানতাম এই ইন্টারভিউ ভালো হবে না।”

“কীভাবে জানতে?”

“জানো তো আমার সিক্সথ সেন্স ভালো, তোমার ক্ষেত্রে আরো ভালো। বুঝতে পারি।”

“বুঝতে পারলে ভালো।”

“সন্ধার পর বের হতে পারবে? তোমাকে নিয়ে একটা কফি শপে যাব। নতুন শপ, তারপরও কফি বেশ ভালো বানায়।”

“এত আগ্রহ নিয়ে বলছ যখন যাব।

লাইলি ইতোমধ্যে মাছ, তরকারি দিয়ে আনন্দিত ভঙ্গিতে ভাত খাওয়া শুরু করেছে। সে চোখ উজ্জ্বল করে বলল, “ভাইজান, ভাবীর সাথে পড়ে কথা কইয়েন। ভাত সামনে নিয়ে ফোনে কথা কইতে হয় না। শাদবিন সত্যি সত্যি ফোন কেটে দিয়ে লাইলির সাথে ভাত খেতে যোগ দিল। কৈ মাছের ঝোলে প্রচণ্ড ঝাল হয়েছে। তারপরও মেয়েটা এত আনন্দ ভাত-ঝোলে মাখামাখি করে খাচ্ছে। তার কাছে আজ মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে ভাত খাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত