ক্যাম্পাস ভ্রমণ

ক্যাম্পাস ভ্রমণ

এক সুন্দরী রমণী ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। কিন্তু একসেপ্ট করতে গিয়ে দেখি রিকুয়েস্ট ডিলেট করা সাড়া। এইটা কোন কথা! শোকে পাথর হয়ে খিচ মেরে বসে রইলাম। এমন সময়ে কে যেন কাঁধে হাত রাখলো। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি স্বয়ং আব্বাজান দাঁড়িয়ে। ভড়কে গেলাম আমি। তিনি দন্তপাটি বের করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

কিরে!’

জি আব্বা।

তুই যেন কিসে পড়িস?’

কাম সাড়ছে! হঠাৎ করে এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হবো ভাবতেও পারি নাই। এখন কী জবাব দেই? আমি তো নিজেও জানি না কিসে পড়ি! সেই যে মার্চে লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হইছে, সেইসাথে আমার পড়াশোনাও বন্ধ হইছে। এতকাল কী করছি না করছি কোনকিছুর হিসাব নাই। পড়াশোনার হিসাব রাখবো ক্যামনে! কোন বন্ধুকে যে নক দিয়ে জিজ্ঞেস করবো কিসে পড়ি, সে সুযোগও নাই আপাতত। ওদেরও নিশ্চয় আমার মতো অবস্থা। আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করি। ‘হঠাৎ পড়াশোনার খবর? কী হইছে আব্বা? কোন সমস্যা?’ উত্তর তো দিলামই না। উল্টো প্রশ্ন ছুড়লাম কয়েকটা। ‘সমস্যা কিছুই না। তোর খোঁজখবর রাখা হয় না তেমন, তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। আচ্ছা, তুই যেন কোন ভার্সিটিতে পড়িস?’

এইবার উট পাহাড়ের নিচে আইছে। কিসে পড়ি এইটা ভুলে গেলেও কোন ভার্সিটিতে পড়ি এইটা মনে আছে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে রীতিমতো চিৎকার করে জবাব দিলাম। আহা। কতদিন পর ক্যাম্পাসের নাম মুখে নিলাম। যেখানে সারাবেলা ফাত্রামি করে কাটিয়েছি, খেয়ে না খেয়ে আড্ডাবাজি করেছি, সেই জায়গার স্মৃতি ও নাম কী ভোলা যায়? যায় নারে পাগলা। আমার জবাব শুনে আব্বার চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠলো।

চল যাইগা।’

কই?’

তোর ক্যাম্পাসে।’

হঠাৎ?’

লকডাউনে আর কত বসে থাকা যায়।

একটা বছর তো গেলোই। নতুন বছরের প্রারম্ভে পুরাতনকে ভুলে গেলে চলবে না। চল যাই। দেখবি ভালো লাগতেছে।’ আব্বার দার্শনিক বয়ান শুনে আমার চোখ ভিজে আসলো। ক্যাম্পাসকে খুব মিস করতে লাগলাম। শেষমেষ তার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারলাম না। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন সকালে আমরা ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরুবো।

বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা নেওয়া হলো। বহুদিন পর বাইরের আলো বাতাস দেখতেছি। আব্বা আর আমার উচ্ছ্বাস দেখে বোঝার উপায় নাই আমরা ক্যাম্পাস দেখতে যাচ্ছি নাকি চিড়িয়াখানা। দুজনেই আনন্দে আটখানা। এর মাঝে আব্বা গান ধরলো। ভাটিয়ালি গান। আমি সেই গানের তালে বিটবক্সিং আর র‌্যাপ জুড়ে দিলাম। তাছাড়া কীইবা করবো, ভাটিয়ালি তো পারি না। পরে আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে রিকশাচালক জাস্টিন বিবারের গান ধরলো। কিছুক্ষণ বেইবি বেইবি চিল্লিয়ে ক্ষান্ত হলে আমরা আবিষ্কার করলাম কেউই ক্যাম্পাসের রাস্তা চিনি না। আব্বা খুব বিরক্ত হলেন। কিন্তু আমার কোন দোষ নাই। সেই লাস্ট কবে গেছিলাম, রাস্তা কী আর মনে আছে। পরবর্তীতে রাস্তায় থাকা মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে ক্যাম্পাসে পৌছালাম। মেইন গেট দেখার সাথে সাথে হুহু শব্দে কান্না জুড়ে দিলাম। আহারে আমার ক্যাম্পাস। কতদিন পর দেখা। সবকিছু যেন বদলে গেছে। গেটের সামনে বন্ধুবান্ধবদের গ্যাদারিং ছিল, নাই। হকাররা সিগারেট বেচতো, নাই। দেয়ালে দেয়ালে কলকাতা হারবালের বিজ্ঞাপন থাকতো, নাই। এক মামা ভ্যানে করে ভেলপুরি বেচতো, নাই। যদিও ভেলপুরির ভ্যানটা আছে, কিন্তু যে মামা বেচতো সে নাই। হয়তো পাশে কোথাও মুততে গেছে। যাই হোক, বড় স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম আমি। ব্যাপারটা আব্বার দৃষ্টি এড়ালো না।

চেহারা অমন করছিস ক্যান? টয়লেট পাইছে?’

হ।

মিথ্যে বলে লাভ নাই। আসলেই আমার টয়লেট পাইছে। এই ক্যাম্পাসটাই বড় অদ্ভুত। এখানে পড়াশোনা হোক বা না হোক, টয়লেট ঠিকই হয়। ক্যাম্পাসে আসার পর আমার প্রথম কাজটাই হয় টয়লেট পরিদর্শন। আব্বাকে নিয়ে ছুটলাম সেদিকেই।

এখানকার টয়লেট কোন সাধারণ টয়লেট নয়। বরং ছোটখাটো একটা মিউজিয়াম বলা যায়। পুরো ক্যাম্পাসের রূপ-নকশা, ইতিহাস-ঐতিহ্য লেপ্টে আছে এর দেয়ালে। যেসব ছেলেরা পাবলিক ভার্সিটিতে চারুকলায় চান্স না পেয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে, তাদের জন্য এই টয়লেট আর্ট এক্সিবেশন থেকে কম না। আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যাই এখানে থাকা শিল্পকর্ম দেখে। এতটাই মুগ্ধ হই যে আসল কাজ করতে ভুলে যাই। আজও তাই হয়েছে। আব্বা আর আমি ঘণ্টা খানেক সময় টয়লেটে কাটিয়ে বেরিয়ে আসি। খেয়াল করে দেখি আব্বার চেহারার মানচিত্রে জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন।

আব্বা, তুমি ঠিক আছো?’

অ্যা! হ্যা। আমি ঠিক আছি। শোন, ক্যাম্পাস থেকে বেরুনোর আগে আরেকবার টয়লেটে আসতে হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি। তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।’

আব্বার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে নিজের ডিপার্টমেন্টের সামনে চলে এসেছি তা নিজেও জানি না। যদিও চেনার উপায় ছিল না এটা আমার ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু দেয়ালে যখন ‘সজীব প্লাস জুলেখা’ হোল স্কয়ার লেখাটা চোখে পড়লো, এক ঝটকায় চিনে ফেলেছি। আব্বাকে বললাম এটা আমার ডিপার্টমেন্ট, মনভরে ঘুরে দেখো। আর এই ফাঁকে আমি করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আহা! এই করিডোরের কত স্মৃতি রয়েছে। এখানে দাঁড়িয়েই জুলেখাকে প্রথম প্রপোজ করেছিলাম। পর মুহূর্তে এক থাবড়া মেরে আমার কানশা জ্বালিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা।

সে স্মৃতি মনে পড়তেই বাম কানটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। হাঁটু কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। পেছন থেকে পিঠে হাত পড়তেই চিল্লিয়ে উঠলাম আমি! ‘আফা আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কোনদিন আপনার দিকে নজর দিবো না। আব্বার কসম!’ ‘এসব কী কস তুই? শরীর ঠিক আছে?’ আব্বার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই আমি। চোখ খুলে আশপাশে তাকিয়ে দেখি আব্বা ছাড়া আর কেউ নাই। ভীষণ শরমিন্দা হলাম। উঠে দাঁড়িয়ে আব্বার দিকে বাঁকা চোখে তাকালাম। লোকটা সবকিছু

বুঝে ফেলেছে কিনা বুঝতেছি না। ‘খিদেয় দুনিয়াদারি আন্ধার দেখতেছিলাম। চলেন কিছু খেয়ে নেই।’ পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করলাম। ‘হ। খালিপেটে তোর মাথা ঠিক থাকে না। চল খাইগা।’

ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় বাইরে যাওয়া লাগলো। ফুটপাত থেকে ডিম বার্গার কিনে সেটা খেতে খেতে আবার ভিতরে গেলাম। বিশাল একটা মাঠ আছে আমাদের। আব্বাকে নিয়ে সেখানেই গেলাম। আসছি পর্যন্ত একটা কাউয়া চোখে পড়েনি, কিন্তু মাঠে এসে তিন চারজন যুবককে পাওয়া গেল। তারা এক কোণায় দাঁড়িয়ে দলবদ্ধভাবে বিড়ি-সিগারেট টানতেছে। তা দেখে বড্ড মেজাজ খারাপ হলো আমাদের। ‘দেখেছিস, যুব সমাজ ক্যামনে ধ্বংস হচ্ছে! মনডা চায় গিয়ে থাবড়ায়া আসি।’ ‘মন তো আমারও চায়। কিন্তু করোনালীন সময়ে এটা ঠিক হবে না। থাবড়া দিয়ে উল্টো ভাইরাস এফেক্টেড হবার চান্স থাকে। বাদ দেন আব্বা।’ রাগ ঝাড়লাম ঠিকই, কিন্তু রাগের কারণ ভিন্ন। হতচ্ছাড়াগুলো কী আয়েশ করে সিগারেট টানতেছে। দেখে লোভ সামলানো কঠিন। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত একটা সিগারেট ধরাইতে পারি নাই। কারণ আব্বা রয়েছে সাথে। কখন যে সুযোগ হবে কে জানে। আদৌ সুযোগ হবে কিনা বলা মুশকিল। অবশ্য না হলেই ভালো। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ভাবতেছি ছেড়েই দিবো।

আমাদের ক্যাম্পাস ভ্রমণ শেষ। এখন বাসার দিকে রওনা হতে হবে। আব্বারে নিয়ে বেরিয়ে আসতেছি এমন সময় দূরে শহীদ মিনারের কাছে এক ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। যাক, অন্তত একজন সিকিউরিটি গার্ড তো আছে। ভাবছিলাম ক্যাম্পাসের দেখভাল করার জন্য কোন লোক নাই। আমি আব্বার কাছে খুচরা একশ টাকা চাইলাম। বললাম, সিকিউরিটি গার্ডকে দিয়ে আসি। বেচারা এত কষ্ট করতেছে। কিছু চা-নাস্তার খরচ না দিলে কেমন দেখা যায়। আব্বা খুশিমনেই টাকাটা দিলেন। আমি সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকা নিজের পকেটে পুরে লোকটির কাছে এগিয়ে গেলাম। ডাক দিয়ে তার পকেটে জোরপূর্বক টাকাটা গুজে দিলাম। বললাম, চা-সিগারেট খাইয়েন মামা। এই বলে চলে আসতেছি এমন সময় ডাকলেন তিনি।

কে তুমি বাবা? তোমাকে তো চিনলাম না।

না চেনারই কথা মামা। আমি এখানকার ছাত্র। সেই যে লকডাউনের আগে এসেছিলাম, এর মাঝে আর আসা হয়নি। আজ একটু ঘুরতে আসলাম। আপনি কী এখানে নতুন চাকরি নিয়েছেন?’

নতুন তো না। প্রায় সাত বছর যাবৎ আছি।

তাই নাকি! বেশ তো। আপনাকেও অবশ্য চেনা চেনা লাগছে।

হ্যা। স্বাভাবিক। ভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে চেনা লাগারই কথা।

বিশ্বাস করেন, আমি এই সাসপেন্সের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এরপর যা ঘটছে সেটাকে শ্যুট করলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য থ্রিলার সিনেমা বানানো যেতো। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আজ বছরের শেষদিন। আগামীকাল নতুন বছর শুরু। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু ভালোয় ভালোয় শুরু করবো। সবাইকে নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত