আমার বাড়ি

আমার বাড়ি

– মা ও মা, তোমার শশুড়বাড়ি আর বাপের বাড়ি হলে তোমার বাড়ি কোন টা? এইটা যদি তোমার বাড়ি না হয় তুমি এইখানে কেন থাকো? আমার ছয় বছরের মেয়ে তিন্নির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে সারাদিনে জমে থাকা রাগটা আর সারাজীবন জমিয়ে রাখা অভিমান গুলো হুরমুর করে বেড়িয়ে আসতে চাইলো। সবে স্কুলে দিলাম ওকে। ইদানীং অনেক কিছু জানতে চায় সে। প্রশ্ন করে সবটা নিয়ে। দুই দুইটা সিজার এর পরে কোমরটা ভীষণ ধরে আজকাল৷ ভারী কাজে হাপিয়ে উঠি। কাল ননদ কে দেখতে দেখত আসছিল। অনেক কাজ আর রান্নায় সকালে আর উঠতে পারছিলাম না। তখন শাশুড়ী গজগজ করছিল।

– আমার বাড়িতে এইসব হবে না। এইটা তোমার বাপের বাড়ি না যে এত বেলা বিছানায় কাটাবে । এইটা শশুড়বাড়ি।

মেয়ে সে কথা শুনেছে। তাই এ প্রশ্ন। কালকের বাসি এটো থালা বাসান গমলায় ডুবিয়ে একটা থালা নিয়ে সাবান লাগিয়ে ঘসতে ঘসতে বললাম-

– গিয়ে ঠাম্মির থেকে জিজ্ঞেস কর, মেয়ে হাওয়ার বেগে ছুটে গেল, ওর ঠাম্মির কোলে গিয়ে বসল। ওদের কথা গুলো আমি রান্না ঘরে দাাঁড়িয়ে শুনছিলাম। জানি মেয়ে প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে যখন পারবে না তখন বলবে মা শেখায় আর কি!

– ঠাম্মি এইটা কি আমার বাড়ি?

– হু তোমার বাড়ি,

– বাবার বাড়ি?

– হু তোমার বাবার ও বাড়ি।

– তোমার, দাদুর,পিসিমণির ও বাড়ি?

– হু।

– তাই আমরা এইখানে থাকি?

– ওমা, আমরা আমাদের বাড়িতে তো থাকব। তাই না?

– তো এইটা মায়ের বাড়ি না হলে, মা কেন থাকে?

– তোমার মা কয় থাকবে তো? এইখানেই তো থাকবে।

– মা এইখানে থাকলে এইটা মার বাড়ি না কেন?

– দূর বাবা, এত কথা কে শেখায় তোমায়, তোমার মা?

মেয়ে জানে না এই কথার উত্তর কিভাবে দিতে হয়। তখন চকলেট দেখিয়ে বলে, যাও দাদুর কাছ থেকে চকলেট নিয়ে আসো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার থালাবাসন ঘষতে থাকি। চোখের সামনে যেন ছোট বেলাটা ভাসতে ভাসতে ঝাপসা হয়ে আসে। আমি আর দুই ভাই কত মজা করে উঠানে বসে খেলতাম। মা চিড়ে ভাজা দিতো সবাইকে ভাগ করে। আমি বেশি পেতাম কারণ ঠাম্মির ভাগের অর্ধেক টা আমার অধিকার ছিলো।

ঠাম্মির সাথে থাকতাম, একটা কালো মেহগনি গাছের আলমারীর আয়না আর পড়ার টেবিল আর ঠাম্মির পুরানো আলনায় আমার আর ঠাম্মির কাপড় গুলো পাশাপাশি জড়িয়ে থাকত। জনলার উড়তে থাকা সবুজ সাদা পর্দাটা যেন আমার সত্যিকারে জীবন মনে হতো। আমার রুম। আমার ঘর। আমার খাট। আমার আলনা। শব্দ গুলো উচ্চারণ কত সহজ ছিলো তখন। যখন থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন থেকে সবাই বুঝিয়ে গেল। এখন এইটা না ওটা আমার বাড়ি। সেখানে শাক দিয়ে ভাত খেলেও বাপেরবড়িতে বলতে হবে মাংস ছিল। আমি অবাক হতাম না। ছোট বেলা থেকে দেখেছি। মা কে কখনো মামার বাড়ি গিয়ে খারাপ বলতে দেখি নি। এই বাড়িটা আমার বাড়ি থেকে মুহূর্তে বাপেরবাড়ি হয়ে পর আলাদা হয়ে গেল। যে বাড়িতে আমি যাই নি এখনো সে বাড়িটা আমার? অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমাদের ছোট বেলা থেকে শশুড় বাড়ির গল্প শুনিয়ে এসেছে সবাই। তাই আমরা মনে মনে প্রস্তুতই থাকি।

আমার যত শব্দ ছিল তা আমাদের হয়ে গেল। আমার কোন শব্দই রইল না। আমার বাড়ি বলতে কিছু রইল না।

কেউ যখন জিজ্ঞেস করে তোমাদের বাড়ি কোথায়, অন্য সবার মতো আমিও বলতে শুরু করি, বাপের বড়ি অমুক জায়গায় শশুড়বাড়ি অমুক জায়গায়। ছোট বেলা থেকে এত শুনি আমরা এই লাইনটা এইটার ভিতরে হারিয়ে যাওয়া আমি টা কে আলাদা করে কখনো কারো চোখেই পড়ে না। আদরের মেয়েটাকে বড় যত্ন করে যখন নিজের বাড়ি বলে যে বাড়িতে পাঠানো হয়, কেউ খবরও রাখে না, কত বছর যে লেগে যায় সে বাড়িকে শশুড়বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি বানাতে৷ কত্ত কিছু যে সয়ে যেতে হয়, শুধু মানুষ গুলো কে নিজের আপন করার চেষ্টায়। কেন যে মানুষ গুলো আপন করতে পারে না যখন, তখন কেন যে ওর

আনে কোন মেয়েকে। যখন এইটা কখনো তাদের বাড়ি বলতে পারে না তখন কেন অন্য বাড়ি থেকে আনে একটা মেয়েকে?

– বাপের বাড়ি থেকে কি দিলো? বাপের বাড়ি না এইটা। এইটা কি তোমার নিজের বাড়ি এত সাহস হয় কোথেকে? এইসব এই বাড়িতে হয় না। বাচ্চাদের শান্ত করার জন্য দাদু ঠাম্মি খেলার ছলে বলে, বের করে দিব মা কে। এই টা আমার সোনার বাড়ি। তোমার মায়ের না৷ কথা গুলো প্রতিদিনের নিত্যজীবনে এত বার শুনি একসময় আর আলাদা লাগে না ওদের বলতে। কিন্তু যে শুনে তার বার বারেই লাগে। বাপের বাড়ির কোন ঝামেলায়, অসুখে বিসুখে আর্থিক সহযোগিতায় যখন তোমার আগে যাওয়া লাগবে তখন হয়ে যাবে,

– এই ঘর আগে। ওটা তোমার বাড়ি না। ওটা বাপের বাড়ি। বাপের বাড়িতে মেয়েদের এত খবরদারী ভালো না।

বাপের বাড়িতেও তুমি অথিতি। দুয়েক দিন রাখার জন্য কত জোর করে ওরা। কিন্তু তোমার কোন জোরেই নেই আর সে ঘরে। কখনো রাগ করে কোন বিপদে প্রথম আশ্র‍য় হিসেবে বাপের বাড়ি যাই আমরা মেয়েরা৷ তখন তাদের প্রথম দায়িত্ব আমাদের বুঝানো,

– ওটাই আসল বাড়ি। সেখানেই মরতে হবে। থাক কিছুদিন। তবে জীবন টা ওখানেই। বড় স্বাভাবিক ভালো কথা। কিন্তু তুমি নেই কোন কোণায় সে বাড়ির অস্বস্তিতে আর। বড় স্বাভাবিক অদ্ভুত ব্যাপার। শশুড়বাড়িতে থেকে বাপের বাড়ির কাউকে নিমন্ত্রন করলে বলবে,

– তুই কেন করছিস? ওরা তো করল না। তুই তো আমাদের মেয়ে। যদি বাপের বাড়িতে গিয়ে কোন অনুষ্টানের জন্য শশুড়বাড়িতে নিমন্ত্রণ করি তখন এরা বলবে,

– তুমি কেন করছো? তুমি তো আমাদের বউ। ওরা করল না তো।

এই কথা গুলো সাধারণ পরিবারের বড় সাধারণ কথায়, মেয়েটা এক সময় নিজেই ভুলে যায় প্রশ্ন করতে আমি কোন বাড়ির মানুষ তো? সবার ভাগ্য এক হয় না। সবাই নিজের বাড়ি পায় না। তা না। আসলে বাড়ি পায় না। পায় মানুষ গুলো। যে শশুড়বাড়িতে মানুষ গুলো আপন হয় সে বাড়িটা নিজের হয়। আর অধিকাংশেরই সবটা দিয়ে শুধু পায়, এই বাড়িতে এইসব চলবে না। এইটা তোমার বাড়ি না। আমি তুমি সবাই যেন এক সময় প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভুলে যেতে শুরু করি প্রশ্ন করা, আমার বাপের বাড়ি আর শশুড়বাড়ি আছে, আমার বাড়ি কোন টা? এইটা যদি কখনোই আমার বাড়ি হয়ে না উঠে আমি কেন থাকি এইখানে? কেন নিজের জীবনের সব সুখ আহ্লাদ শেষ করি শুধু পরের বাড়ির জন্য? আমার বাড়ি কোনটা একটু বল না কেউ? মেয়ে তোমার বাড়ি কোন টা?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত