মাই মুন

মাই মুন

বাসর ঘরে বসে আছে মাইমুনা, তার সদ্য বিবাহিত জীবনের স্বাদ গ্রহণের প্রতীক্ষায়। কী খুব নির্লজ্জের মতো শোনালো? আসলে ঘটনা হচ্ছে গিয়ে, যার সাথে একটু আগেই আজ কলেমা পড়ে তার বিয়ে হলো সেই পারভেজ আহমেদকে সে ছোটবেলা থেকেই চেনে।

শুধু এতটুকু হলেও হয়তো কম বলা হবে, আরো যা ঘটনা তাতে প্রথম যৌবনের প্রারম্ভকাল হতে পারভেজের মন যার জন্যে উতলা হয়ে ছিলো সে মাইমুনা ব্যতীত আর কেউ নয়। মাইমুনা তখন বলতে গেলে শৈশবকাল থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছে সম্ভবত, এমতাবস্থায় সে যখন তাদের বাড়ির বারান্দায় ক্রিকেট বল ফেলে, তাদের ছাদের নারকেল গাছের সাথে ঘুড়ির সুতা আটকে বাহানা তৈরি করে মাইমুনাদের বাড়ি এসে সদর দরজায় কড়া নেড়ে অপেক্ষা করতো। একই পাড়ায় থাকার সুবাদে প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার দরুন এর ওর বাড়িতে যাতায়াতের পথটুকু সুগম হয়েছে। পারভেজের ছোটবোন জেসমিনের সাথেও বেশ খাতির মাইমুনার। যদিও জেসমিনের মাইমুনার সাথে বয়সের পার্থক্য রয়েছে অনেকখানি। তথাপি গোটা পাড়ায় মেয়ের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হেতু এই মেলবন্ধনের সৃষ্টি।

মাইমুনা কিন্তু তখন পারভেজের মনের অভিসন্ধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ইশারা ইঙ্গিত কিছুতেই যখন আর কাজ হচ্ছিলো না তখন পারভেজ আর কোন উপয়ান্তর না পেয়ে ধরেছিলো তার ছোট বোন জেসমিনকে। জেসমিনই হাসিঠাট্টা ফাজলামোতে মাইমুনাকে ভাবী বানানোর কথা তুলেছিলো। সেসব শোনার পর থেকেই একটু একটু করে ধীরে ধীরে যেন কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে পরিপূর্ণ নারী মনের বিকাশ ঘটছিলো মাইমুনার। এরপর থেকে যেন পারভেজকে দেখলেই লজ্জায় মুখ লুকোনোর চেষ্টা করতো। কিন্তু নাছোড়বান্দা পারভেজ তার শত প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে একদিন যথারীতি তাকে প্রপোজ করে বসে, এরপর গতানুগতিক ধারার প্রেম না হলেও যতখানি সম্পর্ক গড়ায় তাতে দুই পরিবারের কারো আর অজানা থাকেনা। সকলে খুশি মনেই মেনে নেন। পারভেজের মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে বড় চাকরি হলে পরে তার যেন বিয়ের আর তর সয়না।

মাইমুনাও ততদিনে গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে চাকরিবাকরির চেষ্টা করছে। বিয়ের পর যথারীতি তাদের জীবনে একে একে এসেছে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। পরপর তিন সন্তানের জন্ম আর একা হাতে

তাদের মানুষ করতে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়া হয়ে ওঠেনি মাইমুনার। তবুও সুখী সাংসারিক পরিমন্ডলে ঘেরা জীবন তাদের। পারভেজের কাজের চাপ আর ব্যস্ততায় যদিও খুব একটা সময় মেলে না কিন্তু সে যখনই সুযোগ পায় ফরেন ট্রিপে নিয়ে যায় তাদের। দুঃখ বলতে শুধু একটাই, তাদের একমাত্র ছেলে অনিক অটিস্টিক শিশু। আর তাই স্পেশাল চাইল্ড হিসেবে তার স্পেশাল কেয়ার ও নিতে হয়। যদিও স্বামী পারভেজের কাছ থেকে কখনো বিধাতার প্রতি কোন অভিযোগ কিংবা আফসোস শুনেনি সে, কিন্তু তবুও যেন মনটা খচখচ করে ওঠে। কিছু অপূর্ণতা ছাড়া বোধহয় কারুরই জীবনকাল পূর্ণ হয়না বড় মেয়ে ইভানা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন একদিন তার প্রিয় বান্ধবী শ্রুতিকে নিয়ে এলো বাসায়।

এ ঘর ও ঘর করে হাসি আড্ডায় মেতে উঠে লাঞ্চ করে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে চলে যাবার কালে সে যখন মাইমুনার বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে যে, আন্টি আজ তাহলে আসি তখন কি মনে করে জানি মাইমুনা শোয়া থেকে উঠে এসে হাত টেনে তাকে খাটে বসিয়ে বলেন, আজ প্রথম এলে আর দূর থেকেই বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলে!!! জবাবে শ্রুতি একটু হেসে বলে ফেলে, এবার থেকে এত আসবো যে বিরক্ত হয়ে যাবেন তারপর আচমকা ঘরের দেয়ালের যেদিকে তার আর পারভেজের বিয়ের ফটো ফ্রেম করে বাধানো সেদিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, আন্টি আপনার আর আংকেলের বিয়ের ছবিটা বলে যেন কথাটা আর শেষ না করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে মাইমুনা বলে ওঠে, কি? সুন্দর নয়? কপট রাগের ভান ধরে গম্ভীর স্বরে বলেন।

তা দেখে শ্রুতি আমতা আমতা করে বলে, না আন্টি আসলে আমি তা মিন করিনি তারপর মাইমুনার প্রসন্ন হাসির আওয়াজে সাহস পেয়ে বলে ওঠে, আমাদের বাড়ির পাশের সরকারি কলোনীতে এক আংকেল দেখতে হুবহু আংকেলের মতো তাই ছবিটা দেখে চোখ আটকে গিয়েছিলো, এত মিল মানে আমি বিস্ময় চেপে রাখতে পারছিলাম না আর কিছুতেই বুঝলেন আন্টি। মাইমুনা হেসে বলে, পৃথিবীতে যে একই চেহারার সাতজন লোকের বাস সে কথাটি বোধহয় সত্য তাহলে। শ্রুতি চলে যায় কিন্তু মাঝরাতে বিছানার এপাশ ওপাশ করেও মাইমুনার আর কিছুতেই যেন আজ ঘুম আসেনা। অফিসের কাজে পারভেজকে প্রায়ই এ শহর ও শহর, হিল্লিদিল্লি করে বেড়াতে হয় কিন্তু কোন সরকারি চাকরি করা আত্মীয় তো তাদের নেই যে পারভেজ সেখানে উঠবে!!!

অতঃপর সে দোনামোনা না করে শ্রুতিকে একদিন সরাসরি বলেই ফেললো যে তাদের বাড়িতে যেতে চায় সামার ভ্যাকেশনে। ওদিকটায় কখনো যাইনি তো তাই দেখার ইচ্ছে হলো। শুনে হোস্টেলে থাকা শ্রুতি হেসে বলে, আমার বাড়ির গল্প শুনে যে আপনি যেতে আগ্রহী হয়েছেন আন্টি সেটাই অনেক। মাইমুনা তারপর এক ছুটির দিনে ইভানাসহ শ্রুতিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। মেঝো মেয়ে জিনিয়াকে অনিকের দায়িত্ব বুঝিয়ে বলেন যে, দুয়েকটা দিন থেকেই চলে আসবেন। পুরো যাত্রাপথ এক অজানা

আশংকায় মন ভার হয়ে থাকে মাইমুনার। যখন শ্রুতিদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে তখন সে শ্রুতিকে বলে যে আগে একটু আশপাশটা ঘুরে দেখতে চাইছিলাম।

ইভানা বলে যে, মা সারারাত জার্নি করে আমার মাথা ধরেছে এখন একটু ঘুমিয়ে না নিলে হবে না আমার। আর তাই ইভানা শ্রুতিকে তাদের বাড়িতে রেখে আন্টিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। ইতস্তত করতে করতে একসময় মাইমুনা শ্রুতিকে অকপটে বলেই ফেলে, গল্প অনুযায়ী সবই তো দেখালে কিন্তু তোমার সেই কলোনীর আংকেলকে তো দেখালে না!!! শ্রুতি মৃদু হেসে আন্টিকে সাথে করে নিয়ে চলে কিছুদূর, তারপর একটা বিল্ডিং এর ফ্ল্যাটের দরজার কাছটায় এসে বলে এ বাড়িতেই থাকেন উনি। হঠাৎ একটা কল আসতেই শ্রুতি বলে, আন্টি আপনি দাড়ান আমি একটু কলটা এটেন্ড করেই আসছি এখানে খুব নেটওয়ার্ক প্রব্লেম করে, ছাদে গিয়ে কথা বলেই আসছি আমি। তারপর শ্রুতি ওপরে চলে যেতেই মাইমুনার যেন আর ধৈর্য্যে কুলোয় না, শ্রুতির দেরি দেখে ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে সে ডোরবেলের সুইচটা চেপে বসে। দরজা খুলে যেতেই দেখে একটা বছর সাতেকের বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কাকে চাই?

সে কিছু বলার আগেই পেছন থেকে খবরের কাগজ হাতে পাঞ্জাবি পাজামা পড়া ভদ্রলোক পেপার ভাজ করতে করতে, কে এলো রে খোকা? বলে যখন সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তখন দুজনের কারো মুখেই আর কোন কথা নেই। বাকরুদ্ধ অবস্থা থেকে ভদ্রলোকের সম্বিৎ ফিরলো সিড়ি বেয়ে দ্রুত গতিতে মাইমুনার নেমে পড়া দেখে। সে পেছন থেকে তার হাত টেনে তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলে ক্রন্দনরত মাইমুনা বলে ওঠে, ছোবেনা আমায় তুমি আজ থেকে তোমার আর আমাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। পারভেজ বলে, একবার আমার কথা তো শোন কি শুনবো? ছেলের শখ এত বেশি ছিলো যে, আমি আর সন্তান জন্ম দিতে পারবো না দেখে বিয়ে করেছো আবার তাইতো???

বিশ্বাস করো, আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি। কন্ঠে যেন আকুতি ঝরে পড়ে পারভেজের। এই তোমার ভালোবাসা? প্রতারণা করে এসেছো এতটা বছর ধরে আমাদের সাথে। সবার চোখে স্ত্রীকে ভালোবাসা আদর্শ স্বামী, সন্তানদের স্নেহ করা আদর্শ বাবা আর আধুনিক মনস্ক মানুষ সেজে। তারপর আর পেছন দিকে তাকায় না মাইমুনা, ফিরে এসে পারভেজকে ডিভোর্স দিয়ে একটা বুটিক শপ খুলে বিজনেস শুরু করে। মেয়ে জিনিয়া ক্যাটারিং সার্ভিস চালায় আর ইভানা করে টিউশনি।

এই দিয়ে তাদের বেশ ভালোভাবে স্বচ্ছলতার মাঝেই চলে যায় দিন। মিথ্যে বিলাসিতায় থাকার চেয়ে বরং সত্য জেনে সাদামাটা জীবনযাপন করাটাও সম্মানের, যা বিশ্বাস করে মাইমুনা। শুধু কখনো সখনো যখন কেউ তাকে খুব বেশি আহ্লাদ করে মাইমুন বলে ডাকে তখন সে আর সহ্য করতে পারে না। চেঁচিয়ে বলে

ওঠে ডোন্ট কল মি মাইমুন, ইটস মাইমুনা। কারণ বাসর রাতে তাকে বলা পারভেজের প্রথম কথাটি ছিলো ইউ আর মাই লাভ, মাই-মুন, তোমায় আমি আজ থেকে এভাবেই ডাকবো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত