রঙিন পাঞ্জাবি

রঙিন পাঞ্জাবি
আজ বিয়েটা শেষমেষ করেই ফেলেছি। যদিও ভুল করেছি মনে হচ্ছে। তারপরেও এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। আমি আনোয়ার হোসেন। সদ্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। একটা সরকারী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসাবে চাকরি করতাম। চাকরি থেকে সদ্য অবসর নিলেও বিপত্নীক হয়েছি কয়েক বছর আগে। এরপর থেকে আমি যেন জীবন থেকেই অবসর নিয়েছি। এগারো বছর বয়সে ঘরে আনা আমার লাল টুকটুকে বউটা একদিন হুট করে স্টোক করে মারা গেলো। হসপিটালে নেয়ার সময়টুকু পর্যন্ত দেয়নি। তাকে হারিয়ে আমি দীর্ঘদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এভাবে একা হয়ে যাব স্বপ্নেও ভাবেনি । কী আর করব ! একটা সময় বাস্তবতা আমাকে সব মানিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। অফিসের কাজের চাপে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম, আমি যে একা, আমার জীবন সঙ্গি যে নেই, সেটা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর উপযুক্ত অভিবাবকের অভাবে সংসারটা তখন ভেসে যাচ্ছিল। আত্মীয় স্বজনের অনেকেই পুনরায় বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি রাজি হইনি। আমার লাল টুকটুকে বউয়ের স্থান আমি কাউকে দিতে চাইনি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলাম। ছেলে প্রথমে না না করেছিল। পরে অবশ্য সব মেনে নিয়েছে। মেয়েটও ভালো। সংসারের যাবতীয় বিষয়ে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই অভিজ্ঞ ছিল। অল্প সময়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। সাথে সাথে স্বামীকেও বস করে নিয়েছে। আমি বেশ খুশিই হয়েছিলাম। অল্প বয়সী একটা মেয়ের সংসারের প্রতি এতটা টান আমাকে মুগ্ধ করেছে। যত বিপত্তি বাঁধল আমি অবসর নেয়ার পর। একটা সময় অফিস ছিল, সকাল নয়টা বের হতাম আবার সন্ধ্যা সাতটায় ফিরতাম। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম।
আমার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন, গল্প করার জন্য, কষ্ট শেয়ার করার জন্য, অভিমান করার জন্য, অভিযোগ করার জন্য, খুনসুটি করার জন্য সেটা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। অবসর নেয়ার পর হঠাৎ করে শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা আমাকে যেন চেপে ধরেছে। প্রাকৃতিক নিয়মে একজন মানুষ বিধবা হবে বিপত্নীক হবে, এটাই স্বাভাবিক। কেউ আগে, কেউ পরে! আমারও একা হয়ে যাওয়া, বিপত্নীক হয়ে যাওয়া আমি প্রকৃতির নিয়ম বলেই মেনে নিয়েছি। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম আমার চাকরিটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি যেন নিজের সংসারেই বোঝা হয়ে গেলাম। পরিবারে যেন আমি কেউ না। কোথাও আমার কোন সংযুক্তি নেই। একটা কোন কাজ করলে ছেলের বউয়ের রাগ, ছেলের রাগ। “বাবা তুমি কেন ধরছ এসব? সারাজীবন কি তোমার সংসার করতে হবে? মসজিদে যাও, নামাজ পড়। তাবলীগে যাও।”
আমি কাচুমাচু করতে থাকি। নিজেকে বড্ড অপ্রয়োজনীয় আর বোঝা মনে হতে লাগে। এটা তো আমার বাড়ি। আমি সারাজীবন পরিশ্রম করে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি বানিয়েছি। সারাবছর অন্যের অফিসে শ্রম দিয়েছি। বাড়ির কত কাজ মন মত হয়নি। ভেবে রেখেছি কখনো অবসর নিলে মনের মতো করে নিজের হাতে সব করব। বাড়ির ছাদে একটা বিশাল বাগান করব। বাড়ির পেছনে ফলের গাছ লাগাব। আমি শেষ বিকেলে ছেলে বউ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে খেলব। নিঃসঙ্গতা আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। অথচ বাস্তবতা কেমন যেন পিকে। অবসরে যাওয়ার পর থেকে ছেলে আর ছেলের বউ আমাকে যেন অব্যবহৃত আসবাবপত্র মনে করতে লাগল। কোন কিছুতেই আমার উপস্থিতি ওদের পছন্দ হচ্ছিল না।
ওরা আমার জীবনযাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। আমি কি করতে পারব, আর কি করতে পারব না। আমি কি পরলে বেশি বাড়াবাড়ি হবে। নিজের পছন্দের পাঞ্জাবি পড়লেও নাকি বড্ড বেমানান লাগে। মানুষ হাসাহাসি করে, অবসরপ্রাপ্ত বিপত্নীক মানুষ রঙিন পাঞ্জাবি কেন পরবে! একটু টিভিতে সিরিয়াল দেখলে, আমার না-কি বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। আমার উচিত পত্রিকা পড়া। অথচ একটা সময় ওর মায়ের সাথে বসে বসে সিরিয়াল দেখতাম। আমার ভালো লাগতো না প্রথম প্রথম, পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। একটা সময় একটা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর একজোড়া বাটা সেন্ডেল দিয়ে বছরের পর বছর অফিস করেছি শুধু একটা বাড়ি করব, ওদের জন্য। এখন রঙিন পাঞ্জাবি দেখলে, পরতে ইচ্ছে করে। অথচ কোনো ভাবেই পরতে দেয় না। একদিন এতটাই রাগ হয়েছে, যেদিন দেখলাম, আমার এন্ড্রয়েড মোবাইলটা নিয়ে নরমাল বাটন মোবাইল দেয়া হয়েছে আমাকে। আমার আলমারি থেকে রঙিন পাঞ্জাবি সরিয়ে, সাদা পাঞ্জাবি রাখা হয়েছে।
পরেরদিন সকালে কাউকে কিছু না বলে সোজা চলে গেলাম, আমার চরের বাড়িতে। একবার স্ত্রীর হাতের বালা বিক্রি করে বহু বছর আগে চরে আধাকানি ফসলি জমি কিনে রেখেছিলাম। একটা সময় প্রতি বছর ধান আসত। গত কয়েক বছর এমনি পড়ে ছিল। কেউ চাষাবাদ করেনি। আমি ব্যাংক থেকে জমানো কিছু টাকা নিয়ে সোজা চলে গেলাম সেখানে। কাউকে কিছু বলেও আসিনি। সাথে করে মোবাইলও আনিনি। প্রথম পনেরোদিন কেউ খোঁজ নেয়নি। ওরা অন্য কোথাও খুঁজেছে কি-না জানি না। না-কি আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে শান্তি পেয়েছে জানতে পারিনি।
পনেরো দিন পর ছেলে এসে উপস্থিত। সারা দেশে না-কি বাবাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। বাবার অনুপস্হিতে কষ্ট পেয়েছে কি-না সেটা বুঝতে দেয়নি। অথবা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিতও হয়নি। উল্টো না বলে এসে তাদের হয়রানি করানোর জন্য বৃদ্ধ বয়সে ছেলের কাছে বকা শুনতে হয়েছে। এদিকে পনেরো দিনে আমার মাথা গোঁজার জন্য একটা মাটির ঘর তৈরি হয়ে গেছে। অামাকে আর ওরা ফিরিয়ে নিতে পারেনি। আসলে ওভাবে জোর করে নিতেও চায়নি। আমি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে আবার নতুন করে সংসার শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লেগেছে। একটা ছেলে ছিল পাশের বাড়ির সব কাজে সহযোগীতা করত। তারপরও কেমন যেন একা একা লাগত। বেশি খারাপ লাগতো গভীর রাতে। অনেক বেশি মনে পড়তো,আমার লাল টুকটুকে বউকে। মনে মনে খুশিই ও মরে যাওয়ায়, এমন অবহেলা দেখতে হয়নি।
একদিন কঠিন জ্বরে পড়লাম। ছেলেটা সেবা করে একা সুস্থ করে তুলতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তার বিধবা মাকে ডেকে এনেছিল। ৪০ বছর বয়সী বিধবা মহিলা সব বাধা ভুলে নিজের প্রিয়জনের মতো করে সবা শশ্রুষা করে মরার বাড়ি থেকে আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। এরপর থেকে প্রায় আসতো,ছেলের সাথে। ছেলে না থাকলেও আসতো। গ্রামের লোকজন বিষয়টা সহজভাবে নেয়নি। আবার আমাকেও কিছু বলেনি। সরাসরি ছেলের কাছে গিয়ে নালিশ করে এসেছে। ছেলে রাগান্বিত হয়ে বাবার কাছে কৈফিয়ত চাইতে এসে দেখে, মহিলা আমাকে ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছে। কোনো কিছু না জেনেই মহিলাকে নোংরা ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে, যেটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ৪০ বছর বয়সী অসহায় বিধবা মহিলাকে আমি বিয়ে করেছি।
ফুলশয্যার ঘরে আমেনা আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। আমি গিয়ে কী বলব ভেবে কুল পাচ্ছি না। তবে দশবছর আগে যে বিয়ের কথা বলায় অপরাধবোধ কাজ করছিল। আজ আর সেই অপরাধবোধ নেই। তবে বড্ড মন খারাপ হচ্ছে লাল টুকটুকে বউয়ের জন্য। আমার পরনে রঙিন পাঞ্জাবি। কী যে ভালো লাগছে নিজের কাছে। বিয়ে উপলক্ষ হলেও রঙিন পাঞ্জাবি পরতে পেরেছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত