আপনি তো একজন ডক্টর, তাই না?” প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি, পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা। নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি আজকে দু’সপ্তাহ হলো। হসপিটাল আর চেম্বারের ফাঁকে এমনিতেই আমি সময় পাই না, তার ওপর বাসা বদলানোর ঝক্কি। গত দু’সপ্তাহ আমার ওপর দিয়ে বিশাল ঝড় গেছে। সারাদিন পর বাসায় ফিরে কোনোরকমে মুখে কিছু দিয়েই মরার মতো ঘুম দিই। এমনকি, তমালের সাথে পর্যন্ত কথা বলার সময়টুকু হয় না। সে বলেছে, দুইদিন পর আমরা ভুলে যাবো আমরা একজন আরেকজনকে কী বলে সম্বোধন করি। ওয়ান ফাইন মর্নিং ঘুম থেকে উঠে আমি নাকি তাকে বলবো,”আপনি কে? এই বাসায় আপনি কোত্থেকে আসছেন?” কথা অবশ্য সত্য, বাসায় থাকি দুইজন মানুষ, সকালবেলা যে যার ধান্ধায় বের হয়ে যাই, ফিরতে ফিরতে রাত। শুক্রবার ছাড়া নিজেদের মধ্যে গল্পও করতে পারি না। তমাল নিজেও যে খুব ফ্রি থাকে তা না। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই যখন যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে যায়, তখন যা হয় আর কী!
আমি দু’একবার পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটিকে দেখেছি। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে; কর্মজীবী, দেখেই বোঝা যায়। মাঝে মাঝে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মুখোমুখি হতে হয়। আমি প্রথমদিন ভদ্রতার একটা হাসি দেব কিনা ভাবছিলাম, মেয়েটা গ্রাহ্যই করলো না। সে তার মতো তার ফ্ল্যাটের দরজা লক করে তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে গেল। আমি তাই দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করিনি। আজকে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করছে আমি ডাক্তার কিনা। আমি সংক্ষেপে বললাম, “জ্বী।” মেয়েটি মাথা ঝাঁকালো। বললো, “নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত থাকেন?” আমি হাসলাম, “হ্যাঁ, কীভাবে দিন কেটে যায় টেরই পাই না।” “আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। পার্সোনাল। আপনি কখন ফ্রি থাকবেন বলুন, আমি তখনই আসবো।”
এই তাহলে মতলব! ডাক্তার নামের জীবটিকে মানুষ শুধুমাত্র তখনই স্মরণ করে যখন তার অসুখ হয়। পরিচয় হয়নি এমন একজন মানুষ যখন প্রথমেই বলে, আপনার সাথে পার্সোনাল কথা ছিল, তখন বুঝতে হবে তার অবশ্যই কোন উদ্দেশ্য আছে। প্রতিবেশীর সাথে গল্পের ছলে সমস্যার কথা বলে ট্রিটমেন্ট নেয়া ভিজিট এড়ানোর অত্যন্ত পুরোনো এবং প্রচলিত একটি পন্থা। আমি এই অবস্থা দেখি এবং বিরক্ত হই, কিন্তু মুখের ওপর কিছু বলতে পারি না এখনো।
আমি বিব্রত হেসে বললাম, “আসলে, ওভাবে ফ্রি আমাকে আপনি তেমন পাবেন না। সারাদিনই এতো ব্যস্ত থাকতে হয় যে “উইকেন্ডে? শুক্রবার তো একটু ফ্রি থাকেন, তাই না? আমি শুক্রবার বিকেলে আসবো। আশা করি তখন আপনাকে পাবো।” আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা তার আগেই বলে উঠলো, “দেখুন, আমার কথাগুলি পার্সোনাল এবং জরুরী। আমার একটা সমস্যা আছে। সেইটার কথা বলতেই আসবো।”
আমি ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তাদের নিজেদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্যাকেও জরুরী ভাবে। এই মেয়েও সম্ভবত এর ব্যতিক্রম নয়। সেধে একটা মানুষ বাসায় আসতে চাচ্ছে, তাকে না করাটা এক ধরণের অভদ্রতা। অভদ্রতা করতে পারলাম না। বললাম, “ঠিক আছে। আমি শুক্রবার বিকেলে বাসায় আছি। আপনি চলে আসবেন। আমি অবশ্য ভুলেই গিয়েছিলাম মেয়েটার আসার কথা। শুক্রবার দুপুরে খাওয়ার পর আমি ভাতঘুম দিলাম। তমাল গেছে গাজীপুর, তার বন্ধুর সাথে কী একটা কাজে। ডোরবেল বেজে ওঠায় অবাক হলাম। এতো তাড়াতাড়ি তো তমালের ফিরে আসার কথা না! লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে দেখি মেয়েটা। তখনই মনে পড়লো, তাকে তো আজকেই আসতে বলেছিলাম। দরজা খুলে দিয়ে হাসলাম, “আসুন।”
“আপনি নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন আমার আসার কথা।”
“কীভাবে বুঝলেন?”
“আপনার চোখমুখ দেখে।
আপনি ঘুমাচ্ছিলেন।” কথাটা বলে মেয়েটি সুন্দর করে হাসলো। আমি লক্ষ্য করলাম, হাসলে শ্যামলা এই মেয়েটিকে অপূর্ব রূপবতী দেখায়। আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সপ্তাহে এই একটা দিনই দুপুরে আমি ঘুমের বিলাসিতা করি। আপনি আসুন, ভেতরে আসুন।” ড্রয়িংরুমে বসলাম আমরা। আমি বললাম, “আপনার নাম জানা হয় নি।”
“দিবা। আমার ডাকনাম দিবা।”
“আমি তাসনিয়া।”
“নেইমপ্লেট দেখেছি দরজায়।” বলে দিবা আবার হাসলো। আমি বললাম, “চা খান তো?”
“হ্যাঁ, খুব!”
“আমিও!”
আমরা দুজনেই হাসলাম। এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, যেচে কোন এক সমস্যার সমাধান চাইতে আসা এবং আমার সাধের ঘুম ভাঙানো মেয়েটাকে আমি একটু একটু পছন্দ করছি। চা বানিয়ে এনে আমি বললাম, “আপনার কোন একটা সমস্যার কথা বলবেন বলছিলেন।” দিবা বললো, “হ্যাঁ, ওটা বলতেই এসেছি। আমার একটা গল্প আছে। আপনাকে আমি গল্পটা শোনাবো। আপনি প্লিজ একটু শুনবেন।” সাধারণত যারা ফ্রি ট্রিটমেন্টের ধান্ধায় আসে,তারা এভাবে কথা বলে না। আমি কিছুটা আগ্রহী হয়ে বললাম, “বলুন, আমি শুনছি।”
সে শুরু করলো- “আমার জন্ম পটুয়াখালির প্রত্যন্ত একটা গ্রামে। জন্মের ঠিক পরপরই আমার মা মারা যান। বাবা ছিলেন খুব গরীব। আমি পেটে থাকা অবস্থায় মাকে ডাক্তার দেখাতে পারেন নি। মা মারা যান প্রসবজনিত জটিলতার কারণেই, অনেক নাকি ব্লিডিং হচ্ছিলো। ওই এলাকা এতোই ব্যাকওয়ার্ড, পাঁচ-ছয় মাইলের মধ্যে আপনি কোনো ডাক্তার পাবেনও না। মার পেট থেকে আমাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে অশিক্ষিত এক দাই। আমি পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই মা মারা গেলেন। সবাই তখন মাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেষ পর্যন্ত আমার দিকে যখন খেয়াল হলো, আমি যতোদূর শুনেছি, দাই আমাকে দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলো।”
“কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। “আমার পিঠের নিচে সে একটা অঙ্গের মতো কিছু একটা দেখতে পায়। প্রথমে ভেবেছে নাড়ি বা অন্যকিছু, কোনোভাবে ছিঁড়ে চলে এসেছে; কিন্তু পরে দেখে এটা আমার গায়ের সাথেই লেগে আছে। সম্ভবত দাই ভেবেছিল এটা আমার তৃতীয় পা।” আমি হতবাক হয়ে দিবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মানে?” “ওটা অবশ্য পা ছিল না। ওটা অন্যকিছু। দাই যখন দেখলো এটা আমার শরীরেরই একটা অংশ, সে ভয়ে চিৎকার করে সবাইকে দেখায়। গ্রামের মানুষজন অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বোঝেনই তো। ওরা বলাবলি করা শুরু করলো,আমি নাকি একটা দানব। আমি পেট থেকে বের হয়েই মা’কে মেরে ফেলেছি। এখনই আমাকে জ্যান্ত পুঁতে না ফেললে আমি বাকি সবাইকে মেরে ফেলবো!”
আমি বলার মতো কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। থ্রিলার গল্প বা উপন্যাসে এইরকম ঘটনা পড়েছি; আজকে চোখের সামনে এমন একজন এসে গল্প বলে যাচ্ছে। চোখ বড় বড় করে আমি দিবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দিবা বললো, “সেদিন ওরা সবাই আমাকে মেরেই ফেলতো। আল্লাহ আমার বাবার হাত দিয়ে আমাকে বাঁচালেন। বাবা দুই হাতে আমাকে ধরে বললেন – এইটা আমার মেয়ে। ওর তিনটা পা, চারটা হাত, দুইটা মাথা যা-ই থাকুক না কেন, এইটা আমার মেয়ে। খবরদার, আমার মেয়ের গায়ে যেন ফুলের টোকাও না লাগে! আমার বাবা আমাকে কোলে নিয়ে মায়ের দাফন কাফন করলেন। আশেপাশের মানুষজন ভয়ে আমার কাছে আসে নাই। দূরে দাঁড়িয়ে এরা আমার মৃত্যু কামনা করে গেছে। “
“এরপর?” আমি লক্ষ্য করলাম আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে।
“এরপর আর কী! দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবশত, যেটাই বলেন, আমি মরি নাই।
তখন বাড়ির বাকিরা,পাড়া প্রতিবেশী, পুরো গ্রামের মানুষ ক্রমাগত বাবাকে বুঝাতে থাকলো যে আমি সত্যি সত্যি একটা দানব। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার অশুভ শক্তি প্রকাশ পাবে। তার আগেই বাবা কেন আমাকে মেরে ফেলছেন না। নিজের মেয়ে নিজ হাতে মারতে মায়া লাগবেই; বাবা আমাকে ডোবায় ফেলে দিয়ে আসলেই শেয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি তারা বাবাকে বুঝালো। সেইসব কথা শুনতে শুনতে বাবা একদিন দিবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললাম, “একদিন?” “একদিন বাবা আমাকে নিয়ে ঘর ছাড়লেন। আমার বাবা নিজেও ওই একই গ্রামের একজন অশিক্ষিত গরীব মানুষ, কিন্তু এই একটা জায়গায় আমার বাবা মুক্তভাবে চিন্তা করেছিলেন। অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন তিনি।” বলতে বলতে দিবার চোখে পানি এসে গেল। আমি তাকে সময় দিলাম। সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করলো- “পরিচিত এলাকা ছেড়ে আমরা চলে আসি অনেক দূরে।
খুলনা শহরে এসে বাবা থিতু হন। সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় নতুনভাবে সবকিছু শুরু করা বাবার জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছিলেন। আমি যখন একটু বুঝতে শিখলাম, আমি দেখলাম ছোট ছোট বাচ্চারা কোনকিছু গায়ে না পরে ঘুরে বেড়ায়, ওরা কেউ আমার মতো না। আমি খেয়াল করলাম, আমি যখন অনেক ছোট, তখনো বাবা আমাকে খালি গায়ে থাকতে দিতেন না। হঠাৎ আমি বুঝে গেলাম, আমার পেছনে যে জিনিসটা আছে, সেটা সাধারণত মানুষের থাকার কথা না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাই আমার একমাত্র বন্ধু, বাবাকে বলতে বাবা আস্তে আস্তে আমাকে বোঝালেন পুরো ব্যাপারটা। আমার জন্মের সময়ের গল্প, কীভাবে আমরা পালিয়ে এসেছি এইসব। আমি বুদ্ধিমান বাচ্চা ছিলাম। আমি বুঝে গেলাম এই কথাটা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতি স্বাভাবিকতা চায়; আমি স্বাভাবিক নই।”
“তারপর?”
“আমি আর দশটা বাচ্চার মতোই স্কুলে পড়েছি, কলেজে গিয়েছি। আমি অসম্ভব ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম। স্কলারশিপের টাকায় আমি ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। পড়া শেষ হওয়ামাত্র আমার একটা ভাল বেতনের চাকরিও হয়ে গেছে, সেটাই এখনো কন্টিনিউ করছি।”
“আপনার বাবা নিশ্চয়ই আপনার সাথেই থাকেন?”
“না, বাবা গত বছর মারা গেছেন।”
“ওহ, আমি সরি!”
“ঠিক আছে। আর এটাই আমার গল্প।”
আমি বললাম, “আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমার অসম্ভব কৌতূহল হচ্ছে। আমি কি আপনার সেই অঙ্গটি দেখতে পারি?” দিবা উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে পেছন ঘুরে সে তার কামিজটি তুলে ধরলো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, পিঠের নিচে, যেখানে শিরদাঁড়ার শেষ, সেখানে, ঠিক মাঝখানে প্রায় ইঞ্চি পাঁচেকের একটা প্রবৃদ্ধি। অনেক আগে এমব্রায়োলজির কোন একটা বইতে দেখা একটা ছবি চোখের সামনে আবছাভাবে ভেসে উঠলো। হিউম্যান টেইল! এটা একটা লেজ!
মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বয়স যখন চার থেকে ছয় সপ্তাহ, তখন প্রতিটি ভ্রূনেরই লেজ থাকে। মোটামুটি আট সপ্তাহের মধ্যে এই লেজ অদৃশ্য হয়ে যায়। খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে, এই লেজ থেকে যেতে পারে জন্মের পরেও, দিবার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই-ই হয়েছে। এইরকম হলে সাধারণত সার্জারি করে এই লেজ কেটে ফেলা হয়। দিবাকে যদি ছোটবেলায় ডাক্তার দেখানো হতো, তার ক্ষেত্রেও এটাই করা হতো। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যা দেখছি ভুল দেখছি না তো? এটা লেজই তো? দিবার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরলো আমার। “আপনি বুঝতে পেরেছেন কিছু?” আমি দিবাকে সংক্ষেপে এবং যতোটা সম্ভব, তার বোধগম্য করে ব্যাপারটা বোঝালাম। দিবা চুপ করে পুরোটা শুনলো। আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। এরপর বললাম, “আপনি এর আগে কখনো কোন ডাক্তার দেখাননি?”
“না। আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে আমি পুরো গল্পটা বললাম এবং জিনিসটা দেখালাম।”
“একটা প্রশ্ন করি?”
“সিওর!”
“আমাকে তো আপনি চেনেন না, আমি তো আপনার বন্ধুও নই, পরিচিতও নই- শুধু একজন ডাক্তার হিসেবেও যদি বলতেন, তবু প্রশ্ন থেকে যায়, আপনি আমাকেই কেন বললেন ব্যাপারটা?”
“আমি আপনাকেও বলতাম না, যদি না ইমরান আমার জীবনে আসতো।”
“ইমরান কে?”
“ইমরান আমার কলিগ।
প্রথমে একজন ভাল বন্ধু ছিল। আস্তে আস্তে বুঝলাম ও আমার প্রতি কিছুটা দুর্বল। আরো পরে বুঝতে পারলাম, সে আমাকে অসম্ভব ভালবাসে। আমি কাউকে আমার এই অভিশপ্ত জীবনে জড়াতে চাই নি কখনো। তাই ইমরানকেও অ্যাভয়েড করতাম সবসময়। মাঝে মাঝে রীতিমতো অপমানও করেছি। কাজ হয় নি। তাকে আমি বারবার ফিরিয়ে দিয়েছি, সে তারচেয়ে বেশি ভালবাসা নিয়ে আমার কাছে এসেছে। একসময় আমিই হার মানলাম। পৃথিবীতে আমার বাবার পর এই ছেলেটিকে আমি সবচেয়ে ভালবাসি।”
দিবা কাঁদছে। আমি চুপ করে রইলাম। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “ইমরান আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে যেদিন,তার পরদিন সকালে আপনার সাথে আমার দেখা। আমার মাথায় তখন আর কিছু কাজ করে নি। আমি আপনাকে বলে ফেললাম আপনার সাথে আমার কথা আছে।” “আপনি কী করবেন ভাবছেন? চাইলে সার্জারি করিয়ে ফেলতে পারেন। ছোট সার্জারি, তেমন কমপ্লিকেশনও নেই।” “ওকে ছাড়া বাঁচবো না আমি। যদি সার্জারিই এটার সলিউশন হয়, আমি সার্জারি করাবো।” দু’হাতে মুখ ঢেকে দিবা কাঁদছে। এই মেয়েটাকে কাঁদলেও এতো সুন্দর দেখায় কেন? আমি খুব আস্তে দিবার মাথায় হাত রাখলাম। বললাম, “আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দেব? আপনি কি একটা ছোট রিস্ক নিতে পারবেন?” সে চোখ তুলে তাকালো। আমি বললাম,”এখন তো আপনি জানেন আপনার সমস্যাটা কী। আপনি কি পুরো গল্পটা আমাকে যেভাবে বলেছেন, ইমরান নামের ছেলেটিকেও সেভাবে বলতে পারবেন?”
“আমি ভেবেছি অনেকবার। প্রতিবার ভয়ে পিছিয়ে গেছি। যদি ও!” “আমার মনে হয় ইমরান আপনাকে ভালবাসে। সে আপনাকে ভালবাসলে আপনি যা ডিসিশন নেবেন, সে অবশ্যই আপনার পাশে থাকবে। আপনি একবার বলেই দেখুন না তাকে!” দিবা ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ বসে রইলো। এরপর বললো, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শ মাথায় রাখবো। আজকে আসি।” বুধবারের কথা। সারাদিন পর বাসায় এসেছি। মাঝখানে দিবার সাথে দেখা হয়নি আর। বাসায় ফেরার পর তমাল একটা খাম দিল আমাকে। বললো, “আমাদের প্রতিবেশী এসেছিলো। তোমার সাথে তার পরিচয় আছে? আমাকে এটা দিয়ে বলেছে আপুকে দেবেন!” আমি বললাম, “এসেছিলো বাসায় গত সপ্তাহে, একটা ব্যাপারে কথা বলতে। ওই রিলেটেড কিছুই হবে।”
খাম ছিঁড়ে একটা চিঠি পেলাম- “তাসনিয়া আপু, অনেক দোটানার পরে শেষ পর্যন্ত আপনি যা বলেছিলেন তা-ই করেছি। ইমরানকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু বলেছি। সে গাধা প্রকৃতির মানুষ। কতোটুকু কী বুঝেছে জানি না। আমি বলতে বলতে কেঁদে ফেলে বলেছি, আমি সার্জারি করাবো। সে বলেছে, “সার্জারি কেন করাবা? কতো মানুষেরই তো হাত-পায়ে একটা দুইটা আঙ্গুল বেশি থাকে, বিয়ের আগে মানুষ কি সেগুলি ছেঁটে ফেলে তারপরে বিয়ে করতে যায়?” আমার কোন আপত্তি সে শোনে না। এবং সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আগামী মাসেই আমাকে বিয়ে করবে। আমি বাসায় এসে সারারাত কেঁদেছি। এতো সুখ কী আমার কপালে সইবে? আপনাকে আমি ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারবো না তাই ধন্যবাদ দিচ্ছি না। আপনার সাথে দেখা করেও এই কথাগুলি বলা যেতো; কিন্তু আমার ধারণা, দেখা হলে আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবো এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারবো না। তাই চিঠি লিখে পাঠালাম। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
ইতি,
দিবা।
পুনশ্চ : ইমরান আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আমার মুখে আপনার কথা শুনে সে ভেবে নিয়েছে আপনি একজন সুপারহিরো টাইপ মানুষ। সে এই সুপারহিরোর সাথে একবার হলেও কথা বলতে চায়। পুনশ্চ ২ : আমার তো তিনকূলে কেউ নেই। আপনি এবং ভাইয়া, আপনারা দুইজন কী আমার বিয়েতে আমার অভিভাবক হিসেবে থাকবেন,প্লিজ?” চিঠিটা শেষ করে আমি খুব সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাগ্যিস দিবা এই কথাগুলি আমাকে সামনাসামনি বলে নি। মাত্র একদিনের পরিচয়ে একটি কমবয়সী মেয়ের সামনে আমি কেঁদে ফেললাম, ব্যাপারটা খুব ভাল হতো না। চোখের পানি মুছে অস্ফুটে বললাম, “সুখী হও তোমরা।
গল্পের বিষয়:
গল্প